বেঁটেখাটো গড়ন রেণুকা বিশ্বাসের। এবং বয়স চল্লিশের নিচে নয় বলেই মনে হয়।
কিন্তু বয়েস হলেও বোঝবার উপায় নেই, কারণ ছেলেপিলে না হওয়ার দরুনই বোধ হয় দেহের গড়ন এখনও এ বয়সেও বেশ আঁটসাঁট এবং যৌবন যেন সমস্ত দেহে ছড়িয়ে আছে এখনও।
রীতিমত ফর্সা গাত্রবর্ণ। রামানুজের মতই কটা চুল, কটা চোখ। পরিধানে কিন্তু বাঙালী মেয়েদের মত ড্রেস করে একটি ভাল শাড়ি পরা। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। খোঁপায় একটি ফুল গোঁজা। হাতে চারগাছা করে সোনার চুড়ি।
কথাটা মহান্তিকে তুলতে হল না-মিসেস বিশ্বাসই উত্থাপন করল। বললে, একটা বড় স্যাড ব্যাপার ঘটে গিয়েছে!
কি হল?
আমাদের হোটেলেরই একজন বোর্ডার মনে হচ্ছে গতরাত্রে সমুদ্রের জলে সুইসাইড করেছিল
সুইসাইড! মহান্তি তাকাল মিসেস বিশ্বাসের মুখের দিকে।
তাছাড়া আর কি! কিন্তু বুঝতে পারছি না ভদ্রলোক হঠাৎ ওভাবে সুইসাইড করতে গেলেন কেন? অথচ পাঁচ-সাতদিন এখানে আছেন, খুব সোবার ধীর-স্থির বলেই তো মনে হয়েছে ভদ্রলোককে।
তবে হঠাৎ সুইসাইড করতে গেলেন কেন?
তাই তো বলছি-কিছু মাথামুণ্ডু বোঝাই যাচ্ছে না। বলেছিলেন এক মাস থাকবেন–
কোন্ ঘরে থাকতেন? মহান্তি আবার প্রশ্ন করে।
দোতলার দুটো পাশাপাশি ঘর নিয়ে ছিলেন।
সঙ্গে আরও কেউ ছিল বুঝি?
না, একাই ছিলেন। বড়লোক মানুষ, তাই হয়তো একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকা অভ্যাস। দুটো ঘর হয়ত সেইজন্যই নিয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের তো চিনতে পারছি না—আপনার সঙ্গে এরা–
আমার বিশেষ বন্ধু—
ও—তা আপনি কি মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতেই এসেছেন?
হ্যাঁ। আপনার হোটেলের বোর্ডার কালী সরকারের ব্যাপারেই–
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, রেণুকা বিশ্বাসের কটা চোখের চাউনি যেন হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল এবং পর্যায়ক্রমে আমাদের সকলের মুখের উপর দিয়ে দ্রুত একবার ঘুরে গেল।
বুঝলাম ভদ্রমহিলাটি বুদ্ধি ধরে এবং সজাগ। অতঃপর রেণুকা বিশ্বাস একটু যেন নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, কি ব্যাপার বলুন তো মিঃ মহান্তি? কোন রকম সন্দেহজনক কিছু কি?
তা একটু সন্দেহের কারণ ঘটেছে বৈকি মিসেস বিশ্বাস!
মিঃ মহান্তি, এটা আমার হোটেল, দশজন আসা-যাওয়া করছে সর্বক্ষণ এবং দশজনকে নিয়ে ব্যাপার। সেরকম কিছু হলে বুঝতেই পারছেন হোটেলের একটা দুর্নাম ছড়িয়ে পড়বে।
ব্যস্ত হবেন না মিসেস বিশ্বাস-কিরীটীই এবার কথাটা বললে, মিঃ মহান্তি যথাসাধ্য। গোপনেই ব্যাপারটা অনুসন্ধান করবেন এবং আপনার যাতে করে কোন ক্ষতি না হয় সেটাও
উনি দেখবেন বৈকি। তবে
কী বলুন?
বুঝতেই তো পারছেন একটা সন্দেহজনক মৃত্যুর ব্যাপার—
সন্দেহজনক মৃত্যু! কি বলছেন আপনি?
দুঃখিত আমরা মিসেস বিশ্বাস, মহান্তিই এবারে বলে, কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারে সত্যিই খানিকটা সন্দেহ রয়েছে, আমাদের ধারণা।
সন্দেহ! দুর্ঘটনা—মানে সুইসাইড নয় বলেই তাহলে আপনাদের ধারণা?
হ্যাঁ, দুর্ঘটনা অবশ্যই-তবে সুইসাইড কিনা সত্যি-সত্যিই এখনও সেটা প্রমাণসাপেক্ষ।
মানে?
বুদ্ধিমতী আপনি-কিরীটী বলে, আপনিই ভেবে দেখুন না, আপনি যা যা একটু আগে কালী সরকার সম্পর্কে বললেন, তাতে করে লোকটা হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই সুইসাইড করে বসবে, সেরকম কিছু বলে কি আপনার মনে হয়?
না।
তাছাড়া কালী সরকারকে—কিরীটী বলে, আমি এককালে ভাল করে চিনতাম। আমার সহপাঠী ছিল।
হ্যাঁ। লোকটা অবস্থাপন্ন নিঝঞ্জাট শান্ত স্থির বিবেচক বুদ্ধিমান।
কিন্তু–
হ্যাঁ, পরে তেমন কোন কারণ ঘটতে পারে এই তো বলতে চান! তা অবিশ্যি পারে। তবে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছুই তো চোখে পড়ছে না বা মনেও আসছে না।
মিসেস রেণুকা বিশ্বাস আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে বলে, তবে কি আপনারা মনে করেন, সত্যিই ব্যাপারটার মধ্যে কোন গণ্ডগোল আছে? মানে–
ঠিক, মিসেস বিশ্বাস, আপনার সন্দেহ মিথ্যা নয়। আমাদের ধারণা তাই। মিঃ মহান্তি জবাব দেয় এবারে।
রেণুকা বিশ্বাস হঠাৎ যেন কেমন গম্ভীর হয়ে পড়ে। কপালে চিন্তার রেখা দেখা দেয়।
কিরীটীর ইঙ্গিতে অতঃপর মিঃ মহান্তি বলে, মিসেস বিশ্বাস, কালী সরকার যে ঘরে ছিল সে ঘরটা একবার দেখতে চাই আমরা।
নিশ্চয় নিশ্চয়-উঠুন, চলুন—
আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি আর ঠিক সেই সময় হোটেলের মালিক মিঃ হরডন বিশ্বাস এসে ঘরে ঢুকল।
এই যে মিঃ মহান্তি, আপনি এখানে আর আমি থানায় গিয়ে—
কথাটা শেষ হয় না বিশ্বাসের। আমাদের দিকে নজর পড়ায় থেমে গেল যেন সঙ্গে সঙ্গে।
আপনি যে কারণে গিয়েছিলেন, আমরাও সেই কারণেই আপনার এখানে এসেছি মিঃ বিশ্বাস। কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা তদন্ত করতেই এসেছি।
তদন্ত করতে?
হ্যাঁ।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তো আপনার কথাটা মিঃ মহান্তি!
জবাব দিল এবারে রেণুকা বিশ্বাস, ওঁদের ধারণা কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারের মধ্যে কোন গোলমাল আছে—মানে সামথিং সাসপিসাস–
সন্দেহজনক! সে কি?
ওঁরা তো তাই বলছেন।
মিঃ মহান্তি—
হ্যাঁ, মিঃ বিশ্বাস। মহান্তি বললেন, ব্যাপারটা আপনারা যা ভেবেছেন তা মনে হয় না।
তবে?
মনে হচ্ছে ইটস এ কেস অব মার্ডার-হোমিসাইড। তাকে কেউ হত্যা করে জলে ভাসিয়ে দিয়েছে।
সে কি! একটা অধস্ফুট চিৎকার বিশ্বাসের কণ্ঠ চিরে যেন বের হয়ে আসে।
আতঙ্ক-একটা বিস্ময় যেন ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমি দেখছিলাম লোকটাকে—মানে রেণুকা বিশ্বাসের স্বামী হরডন বিশ্বাসকে।
ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, রোগাটে, ডিসপেপটিক টাইপের চেহারা। মাথার চুল সামনের দিকে কিছু আছে। পিছনের সবটাই প্রায় বলতে গেলে ঘাড় পর্যন্ত কামানো। ছোট কুতকুতে একজোড়া চোখ। ধারালো খাড়া নাক। নাকের নীচে মাছির মত একটুখানি গোঁফ। বাদবাকি সব ক্লিন সেভ করা। ছোট ছোট দাঁত। দাঁত তো নয়—যেন মুক্তোর পংক্তি। পরনে প্যান্ট ও বুশকোট, পায়ে পাম্পসু।
হরডন বিশ্বাস তোতলাতে তোতলাতে বলে, মা-মার্ডার! আপনি কী বলছেন মিঃ মহান্তি?
বললাম তো আমার তাই ধারণা।
বাট হাউ অ্যাবসার্ড! এ যে অসম্ভব! কে-কে তাকে হত্যা করবে? আর হত্যা করতে যাবেই বা কেন?
কে হত্যা করবে, কেন হত্যা করবে তাকে এসব প্রশ্নের জবাব যদি পেতাম তবে আর ভাবনা ছিল কী মিঃ বিশ্বাস! সোজা খুনীকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরতাম। এতক্ষণে!
হরডন বিশ্বাস এবারে যেন একান্ত হতাশ এবং অন্যন্যোপায় হয়েই তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। শুকনো গলায় বললে, কি হবে রেণু?
কি আবার হবে–তুমি অত নার্ভাস হয়ে পড়ছ কেন?
বোঝা গেল হরডন বিশ্বাস নার্ভাস হয়ে পড়লেও রেণুকা বিশ্বাস এতটুকু নার্ভাস হয়নি। এবং তার কণ্ঠস্বরেই সেটা প্রকাশ পায়।
তুমি কি ব্যাপারটা কত সিরিয়াস বুঝতে পারছ না রেণু! অন্য কিছু নয়—মার্ডার-খুন! ব্যাপারটা একবার জানাজানি হয়ে গেলে এবং জানাজানি হবেই-সমস্ত হোটেলে কিরকম একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হবে তখন–
জানবে কী করে তারা? আর জানতেই বা যাবে কেন? রেণুকা বুঝি সানা দেবার চেষ্টা করে তার স্বামীকে।
বুঝতে পারছ না কেন ডারলিং! এরকম একটা সাংঘাতিক ব্যাপার-এ তুমি কতক্ষণ চাপা দিয়ে রাখতে পারবে? কী হবে মহান্তি সাহেব? আমি কি তবে ধনেপ্রাণে মারা যাব? এত টাকা খরচ করে হোটেল করেছি-সবে জমে উঠেছে–
হরডন বিশ্বাসের প্রায় কেঁদে ফেলবার যোগাড়।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় মহান্তি।
কিরীটীই বলে তখন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ব্যাপারটা মিঃ মহান্তি যথাসাধ্য গোপনে এবং সতর্কতার সঙ্গে ডীল করবেন।
আপনি-আপনি কে? হরডন কিরীটীর দিকে তাকাল।
আমি–আমি মানে—
কিরীটীকে ইতস্তত করতে দেখে মহান্তি বলে, মিঃ বিশ্বাস, ওঁর একটা বিশেষ পরিচয় আছে। বিখ্যাত ব্যক্তি উনি।
কে?
রহস্যভেদী কিরীটী রায়ের নাম শুনেছেন?
শুনিনি! বহুবার শুনেছি। আপনিই তাহলে সেই–
হ্যাঁ-উনিই তিনি। যাক, চলুন উপরে, একবার কালী সরকার যে ঘরে ছিল সে ঘরটা দেখে আসি।
চলুন।
তোমায় যেতে হবে না, তুমি থাক—আমি যাচ্ছি। রেণুকা বলে ওঠে।
তুমি যাবে? তবে তাই যাও রেণু। রামানুজ-রামানুজকে দেখছি না! সে কোথায় গেল? কোথায় যে থাকে সব! কাজের সময় কাউকে যদি সামনে পাওয়া যায়!
কেন, রামানুজকে দিয়ে কি হবে?
একটুকু চা-তাছাড়া সিগারেট আমার সব ফুরিয়ে গিয়েছে।
হেয়ার স্ট্যাণ্ডিং ব্রাদার–
দরজার বাইরে থেকে রামানুজের গলা শোনা গেল। সে ঘর থেকে গেলেও দূরে যায়নি। এতক্ষণ কান পেতে দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল।
রামানুজ এসে ঘরে ঢুকল।