ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল দ্রুত। জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় এসে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করা, টাকা দিয়ে বৈধভাবে ডলার কেনা, প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করা-এইসব ঝামেলা খুব অল্পের ওপর দিয়ে গেল অবনীবাবুর জন্য। তাঁর এক বন্ধু কলকাতার লিন্ডসে স্ট্রিটে ট্রাভেল এজেন্সি চালান। সকালবেলায় ট্রেন থেকে নেমেই হোটেলে জিনিসপত্র রেখে পরিষ্কার হয়ে অফিস খোলার সময়েই অর্জুন চলে এসেছিল ভদ্রলোকের কাছে। পরিচয় দিয়ে সব বলতেই তিনি অভয় দিলেন, কোনও চিন্তা নেই। আজ রাতেই আপনি ঢাকা পৌঁছে যাবেন বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী হিসেবে।
রাত্রে? অজানা জায়গায় রাত্রে পৌঁছতে পছন্দ করল না অর্জুন।
তার আগের ফ্লাইট দুপুরে। তখন সব ফর্মালিটিস শেষ করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। অবশ্য সন্ধেবেলায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটা ফ্লাইট আছে। আচ্ছা দেখছি, কী করা যায়!
পাশপোর্ট, টাকা-পয়সা ভদ্রলোকের হাতে জমা করে দিয়ে অর্জুন বেরিয়ে এসেছিল। একটা গোটা দিন তার হাতে পড়ে আছে এবং কোনও কাজ নেই। কলকাতায় অর্জুন অনেকদিন পরে এল। পাতাল রেলে চড়ে মনে হল, এই শহরের মানুষের দুটো চরিত্র। মাটির ওপর যারা হেঁটে বেড়াচ্ছে, মাটির নীচে এসে তারা কীরকম পালটে যায়। কেউ পাতালে নেমে সিগারেট খাচ্ছে না, ময়লা ফেলছে না। সুশৃঙ্খলভাবে যাওয়া-আসা করছে। অথচ ওপরে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। এমন কী করে হয়?
দুপুরের খাওয়া শেষ করে সে আবার লিণ্ডসে স্ট্রিটের অফিসে ফিরে এল। অবনীবাবুর বন্ধু তখন কাজে বেরিয়েছেন। ভিজিটার্স রুমে আরও কয়েকজন অপেক্ষা করছেন। সোফায় বসে একটা পত্রিকা তুলে নিল অর্জুন। ঢাকা এখন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজধানী। ভারতীয় হিসেবে সে সেখানে বিদেশি বলে গণ্য হবে। অথচ সেখানকার মানুষেরা বাংলাভাষায় কথা বলেন, রবীন্দ্রনাথের গান তাঁদের জাতীয় সঙ্গীত। একজন গুজরাতি অথবা পঞ্জাবির পক্ষে ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব নয়।
দেশলাই আছে?
প্রশ্নটা কানে আসামাত্র অর্জুন তাকাল। মোটাসোটা এক ভদ্রলোক তাকেই প্রশ্ন করছেন। উনি বসে আছেন পাশের সোফায়। ভদ্রলোকের বয়স অন্তত পঞ্চাশ হবে। তার ডবল বয়সী একটি মানুষের হাতে দেশলাই তুলে দিতে সঙ্কোচ হল অর্জুনের। সে নীরবে মাথা নাড়ল, না।
ও। স্মোক করেন না বুঝি! গুড। আমি তো লাস্ট থার্টি ইয়ার্স ধরে ভাবছি ধূমপান কবব না, কিন্তু পারছি না। আজকাল ইচ্ছে করেই পকেটে দেশলাই রাখি না, যাতে কম খাওয়া হয়।
সিগারেটই বা রাখেন কেন?
না রেখে পারি না। কীরকম খালি-খালি লাগে। এমনকী রোজার সময় হোল ডে যখন পানিও খাই না তখন সিগারেটের কথাও ভুলে যাই। কিন্তু সন্ধেবেলায় ইফতার করার পরই সিগারেট ধরাই। ভদ্রলোক ম্লান হাসলেন। অর্জুনের মনে হল লোকটা জটিল নয়। জটিল মানুষেরা সাধারণত এত কথা বলেন না। পত্রিকাটা নামিয়ে রেখে সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বিদেশে যাচ্ছেন?
বিদেশ? হ্যাঁ ভাই, খাতায়-কলমে আপনার বিদেশ, কিন্তু আমার স্বদেশ। আমি আজ ঢাকায় যাচ্ছি।
লোকটির সঙ্গে আলাপ করার আগ্রহ জন্মাল অর্জুনের। সে বাংলাদেশে এর আগে কখনও যায়নি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে এবার সে যদিও টুরিস্ট হিসেবে যাচ্ছে, কিন্তু তার লক্ষ অন্য। ভদ্রলোকের নাম মোহম্মদ ইউসুফ। ব্যবসা করেন। সেইসব কাজেই মাঝে-মাঝে ওঁকে কলকাতায় আসতে হয়। এখানকার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ওঁর আত্মীয়স্বজন আছেন। ঢাকা এবং কলকাতা ওঁর কাছে প্রায় একই। আলাপ করতে-করতে ইউসুফ বললেন, কলকাতায় এলে একটা ব্যাপার দেখে খুব খারাপ লাগে ভাই। আপনারা তো বাঙালি, অথচ বাংলা ভাষার জন্য আপনাদের একটুও মায়া-মমতা নেই। আপনারা যেন ঠিক বাঙালি হিসেবে নিজেদের চরিত্র ঠিক রাখতে পারছেন না। আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা যত কষ্টেই থাকি না কেন, ভাষার ব্যাপারে সবাই এক, অভিন্ন।
ইউসুফভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে চমৎকার সময় কেটে যাওয়া ছাড়াও অনেকরকম তথ্য জানতে পারল অর্জুন, ঢাকা সম্পর্কে। কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি শহরের যে দূরত্ব, ঢাকা তার অনেক কাছে। কিন্তু ঢাকা কলকাতার থেকেও আধুনিক এবং পূর্ণ বাঙালি শহর।
ভিসা, টিকিট এবং ডলার পাওয়া গেল ঠিক সময়ে। ইউসুফ ভাই টিকিট কেটেছিলেন ঢাকা থেকেই, আসার সময়। এই অফিসে অন্য প্রয়োজনে এসেছিলেন। কথা হল, এয়ারপোর্টে তিনি অর্জুনের সঙ্গে দেখা করবেন।
বিদেশে যাওয়ার সময় একটা আলাদা ধরনের উত্তেজনা থাকে। আন্তজাতিক বিমানের নিয়ম অনুযায়ী ঠিক দু ঘণ্টা আগে যখন অর্জুন দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছাল তখন সন্ধে পেরিয়ে গেছে। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের টিকিট পাওয়া যায়নি, অনেক চেষ্টায় বাংলাদেশ বিমানে একটা ব্যবস্থা হয়েছে।
ইউসুফভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। নির্দিষ্ট নিয়মগুলো পর-পর করে যেতে তিনিই সাহায্য করলেন। তারপর ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসের বেড়া ডিঙিয়ে ওরা এসে বসল লাউঞ্জে। সেখানে তখন অনেক যাত্রীই এসে গিয়েছেন। বিদেশে যাওয়ার অন্যান্য ফ্লাইটের ঘোষণা চলছে। অর্জুনের মনে হল পৃথিবীটা খুবই ছোট। মানুষ ইচ্ছে করলেই এবং টিকিট কাটার সামর্থ্য থাকলে যে-কোনও দেশে মুহূর্তেই চলে যেতে পারে।
এই সময় একজন ভদ্রমহিলা লাউঞ্জে এলেন। তিনি যে খুবই সুন্দরী, সেব্যাপারে তাঁর সচেতন মনোভাব অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। সঙ্গে একজন বিশালদেহী পুরুষ, গায়ের রং বেশ কালো। ইউসুফভাই বললেন, ইনি বাংলাদেশের সিনেমার নায়িকা। খুব নাম করেছিলেন এককালে। এখন পড়তির দিকে। এঁর নাম মঞ্জশ্রী রায়।
অর্জুন অবাক হল, আপনাদের ওখানে হিন্দুরা সিনেমায় নামে?
আশ্চর্য? কেন নামবে না? বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সবার সমান অধিকার আছে।
অর্জুন মঞ্জুশ্রী দেবীকে দেখছিল। খানিকটা দূরেই বসে আছেন তিনি। শালোয়ার কামিজ এবং বেগুনি রঙের ওড়নায় ওঁকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। বাংলাদেশি মানুষেরা এই লাউঞ্জে বসে তাঁর দিকে যে সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন, সেটা বুঝে বেশ গম্ভীর হয়ে আছেন। অর্জুনের মনে হল প্রযোজক ভদ্রলোক বেশ চিন্তিত। ঘন-ঘন সিগারেট খাচ্ছেন। মানুষটির মুখ খুবই রুক্ষ, চোখ এবং ঠোঁটের কোণে একধরনের নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি অজান্তেই ফুটে উঠেছে।
এই সময় টাকমাথা ফরসা বেঁটে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখেই প্রযোজক সোজা হয়ে বসলেন। বোধ হয় এর জন্যই তিনি গেটের দিকে মুখ করে এতক্ষণ বসে ছিলেন। টাকমাথা ভদ্রলোক চেয়ারের পাশে হাতব্যাগ নামিয়ে কোনওদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে গেলেন কোনার দিকে, যেখানে দেওয়ালে পর-পর টেলিফোন ঝোলানো আছে। তাঁকে ডায়াল করতে দেখল অর্জুন। এবং তারপরেই সেই প্রযোজক উঠে গেলেন সেই দিকে। পাশের টেলিফোনটি তুলে নিয়ে তিনিও ডায়াল শুরু করলেন। ব্যাপারটায় খটকা লাগল। অর্জুন ইউসুফভাইকে বলল, আমি একটু আসছি। তারপর চলে এল তৃতীয় টেলিফোনটির সামনে। এসে বুঝল যাত্রীদের জন্যে বিনা পয়সায় কথা বলার ব্যবস্থা হয়েছে এই ফোনের মাধ্যমে। সে এলোমেলো নম্বর ঘোরাল, যদিও তার কান খাড়া ছিল। তার বাঁ দিকে প্রযোজক, যাঁর বাঁ দিকে টাকমাথা। প্রযোজক যেন টেলিফোনে কথা বলছেন এমন ভঙ্গি করে কানে রিসিভার লাগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত দেরি হল? ব্যাগেজ আইডেন্টিফাই করেছেন তো? অর্জুন শুনতে পেল টাকমাথা বলছেন, সব ঠিক আছে।
এই তিনটে শব্দ শোনামাত্র প্রযোজক যেন টেলিফোনে কথা বলা হয়ে গিয়েছে এমন ভঙ্গিতে রিসিভার নামিয়ে আবার সিনেমার নায়িকার কাছে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে টাকমাথা আবার ডায়াল করছিলেন। অর্জুন শুনতে পেল লোকটির চাপা হাসি, একদম ভেতর থেকে বলছি। এইমাত্র সে দেরি কেন হল তা জিজ্ঞেস করে গেল। কদিন পরেই বাছাধন টের পাবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। রিসিভার নামিয়ে রেখে হেলতে-দুলতে নিজের ব্যাগের কাছে গিয়ে বসল টাকমাথা। প্র যাজকের সঙ্গে তার দূরত্ব এখন অনেকটা। অর্জুন আরও কয়েক সেকেন্ড টেলিফোনের পেছনে খরচ করল, যাতে কেউ তাকে সন্দেহ না করে। স্পষ্টতই একটা চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছে সে। ওই টাকমাথা লোকটা একটি শয়তান। সে প্রযোজককে একরকম বোঝাচ্ছে আবার যাকে টেলিফোন করল তাকে আর-একরকম। কী ব্যাপারে এরা যুক্ত, সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। অর্জুন নিজেকে বোঝাল, পৃথিবীতে এরকম ঘটনা কতই না হচ্ছে, সব ব্যাপারে নাক গলানোর কী দরকার, যতক্ষণ না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাহায্যের জন্য তার কাছে আসছে। ইউসুফভাইয়ের পাশে এসে বসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পেলেন?
পেলাম মানে? অর্জুন বুঝতে পারল না।
টেলিফোনের লাইন তো বেশিরভাগ সময় পাওয়া যায় না।
অর্জুন বাস্তবে ফিরে এল, ও হ্যাঁ, তা ঠিক।
এই সময় সিঙ্গাপুরগামী একটি প্লেনের যাত্রীদের জন্য কিছু ঘোষণা করা হল। ইউসুফভাই বললেন, ভারী অদ্ভুত জায়গা এই সিঙ্গাপুর আর ব্যাঙ্কক। ওসব জায়গা থেকে যারা আসে তাদের সম্পর্কে খুব সচেতন থাকে বাংলাদেশ এবং ভারতের কাস্টমস অফিসাররা। স্মাগলাররা অবশ্য খুব স্মার্ট।
স্মাগলিং হয় ওখান থেকে?
অত্যন্ত। বেকার ভাল যুবকদের সামান্য টাকার লোভ দেখিয়ে ওরা পাপচক্রে লাগিয়ে দিয়েছে। যাকগে, আপনি তো প্রথম ঢাকায় যাচ্ছেন, ওঠার জায়গা কি ঠিক আছে?
না। কোনও হোটেলে উঠব।
হোটেল? ইউসুফভাই যেন আঁতকে উঠলেন, আমি থাকতে আপনি হোটেলে উঠবেন মানে? এ কীরকম কথা!
অর্জুন হাসল, আপনি আমাকে চেনেন না, জানেন না।
ছাড়েন। হঠাৎ নিজস্ব শব্দ বেরিয়ে এল ইউসুফভাইয়ের মুখ থেকে, আমি মানুষের মুখ দেখলেই বুঝতে পারি কে ভাল, কে মন্দ।
অর্জুন কথা বাড়াল। অচেনা মানুষকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আতিথ্য দেওয়ার চল পশ্চিমবাংলায় নেই, বাংলাদেশে হয়তো আছে। কিন্তু সে পরে ভদ্রলোককে বুঝিয়ে কোনও হোটেলে চলে যাবে। খানিক বাদেই ঢাকাগামী যাত্রীদের বিমানের দিকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হল। সবাই হুড়মুড়িয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্জুন উঠে দাঁড়ালে ইউসুফভাই বললেন, ভিড় একটু হালকা হোক। আমাদের ফেলে রেখে তো বিমান যাবে না।
অর্জুন দেখল টাকমাথা ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গিয়েছেন। প্রযোজক এবং অভিনেত্রী সম্ভবত ইউসুফভাইয়ের মতোই অপেক্ষায় বিশ্বাসী। শেষপর্যন্ত প্রায় সব যাত্রী চলে গেলে অর্জুনরা এগোল। প্যাসেজ দিয়ে নেমে এসে প্লেনের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির দেখা পেল ওরা। সেখানে আগে আসা কিছু যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। ইউসুফভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে উঠতেই অর্জুন টাকমাথাকে দেখতে পেল। হঠাৎ ইউসুফভাই বলে উঠলেন, আরে মিস্টার ঘোষ, কবে এসেছিলেন কলকাতায়?
টাকমাথা তাকালেন। তারপর হাসার চেষ্টা করলেন, এই তো, কদিন আগে।
অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম।
হ্যাঁ, আমিও।
এখনও কালীগঞ্জে আছেন?
মাঝে-মাঝে যাই। টাকমাথা, যাঁর নাম মিস্টার ঘোষ, তাঁর যেন কথা বলতেই ইচ্ছে করছিল না। প্লেনের সামনে পৌঁছে যেতেই সবাই যে যার মতো নেমে প্লেনে উঠল। ছোট প্লেন। অর্জুন আর ইউসুফভাইয়ের আসন পাশাপাশি। মিস্টার ঘোষ অনেক পেছনে। একটু পরে প্রযোজক এবং অভিনেত্রীকে প্লেনে উঠে সামনে বসতে দেখা গেল।
হঠাৎই অর্জুন জিজ্ঞেস করল, বাসে যার সঙ্গে কথা বললেন তিনি কী করেন?
সঠিক জানি না। বোধ হয় বিজনেস। আমার সঙ্গে আলাপ বিমানে কলকাতায় যাতায়াতের পথে। আগে মাঝে-মাঝেই দেখা হত, এখন হয় না। কালীগঞ্জে বাড়ি। ইউসুফ বললেন।
কালীগঞ্জটা কোথায়?
ঢাকা থেকে এখন ঘণ্টা দেড়েক লাগে। আগে ট্রেনে গিয়ে নৌকো করে যেতে হত। এখন সুন্দর রাস্তা হয়ে গিয়েছে। প্রচুর হিন্দু পরিবার সেখানে এখনও বাস করেন।
এই ভদ্রলোকের পুরো নাম কী?
জানি না ভাই। আলাপ হওয়ার সময়, হাঁ মনে পড়েছে, এ. বি. ঘোষ বলেছিলেন। এর পরে বি বলেই মনে আছে।
বিমান কলকাতা ছাড়ল। অর্জুন তাকিয়ে দেখল, নীচে হিরের মতো কলকাতার আলো জ্বলছে। তারপরেই আকাশের ওপরে আকাশ। এয়ার হোস্টেসদের আনাগোনা, খাবার দেওয়া ইত্যাদিতে মন ছিল না ওর। কালীগঞ্জের এ. বি. ঘোষ তাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। বি কি বিহারীর আদ্যক্ষর? এই লোকটির কথা জলপাইগুড়ির পবনবিহারী জানেন না। কালীগঞ্জের লোক যখন, তখন পবনবিহারীর দূর সম্পর্কের আত্মীয় হতে পারেন। কিন্তু মানুষটি যে সুবিধের নয়, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জিয়া আন্তজাতিক বিমানবন্দর ছোট, কিন্তু ছিমছাম। হাতব্যাগ নিয়ে অর্জুন দ্রুত এ. বি. ঘোষের পেছনে চলে এল প্লেন থেকে নামার সময়। ভদ্রলোক কোনওদিকে তাকাচ্ছেন না। বাঁ দিকে ডিউটি-ফ্রি শপের প্রলোভন তাঁকে টানল না। ইমিগ্রেশনের কাউন্টারে পৌঁছে সোজা নিজের পাশপোর্ট বের করলেন স্ট্যাম্প মারানোর জন্য। ওঁর পেছনে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল না অর্জুন। এখানে বিদেশিদের জন্য আলাদা কাউন্টার। এ. বি. ঘোষ বাংলাদেশের মানুষ বলে যে কাউন্টার থেকে পাশপোর্টে ছাপ মারালেন, সেখানে অর্জুনের দাঁড়ানো। নিষেধ।
কিন্তু ভদ্রলোককে পাওয়া গেল লাগেজ নেওয়ার জায়গাটিতে। চুপচাপ একটা ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এরকম লোকের সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলা ঠিক নয়। নিজের সুটকেসের জন্য অর্জুন অপেক্ষা করছিল এমন সময় ইউসুফভাই পাশে এসে দাঁড়ালেন, কী ভাই, ওইভাবে দৌড়লেন কেন?
অর্জুন হাসল। এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় না।
আমার মনে হচ্ছে ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে আপনি উৎসুক।
কিছুটা। অর্জুন স্বীকার করল।
আসেন আমার সঙ্গে। ইউসুফভাই এগিয়ে গেলেন এ. বি. ঘোষের দিকে। অতএব অর্জুন নিরীহ মুখে অনুগামী হল। কাছে গিয়ে ইউসুফভাই বললেন, আজ রাত্রে নিশ্চয়ই ঢাকায় থাকবেন?
আমি তো এখন ঢাকায় থাকি! ভদ্রলোক জবাব দিলেন।
ঢাকায় কোথায়?
বনানীতে।
আমি গুলশনে। কার্ডটা রাখুন। পকেট থেকে নিজের কার্ড বের করে দিলেন ইউসুফভাই।
থ্যাঙ্ক ইউ। কার্ড নিলেন এ. বি. ঘোষ, আপনি প্রায়ই ইন্ডিয়ায় যান?
ব্যবসার কাজে যাইতেই হয়। এঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার ভাইয়ের মতন। অর্জুন। বাংলাদেশ দেখতে এসেছে। তা আমি বললাম ঢাকা শহর মানে বাংলাদেশ না। যেতে হবে গ্রামে। আমার মৈমনসিংহে বাড়ি। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। ইউসুফভাই কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা-কলকাতার ভাষা মিশিয়ে।
অর্জুন নমস্কার করল। এ. বি. ঘোষ অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়ালেন, আমি এ. বি. ঘোষ। ঢাকায় আগে কখনও এসেছেন?
না। এই প্রথমবার।
হোটেলে উঠবেন?
অর্জুন জবাব দেওয়ার আগে ইউসুফভাই বললেন, না, না আমার বাসায়।
এ. বি. ঘোষ বললেন, আমাদের কালীগঞ্জ একসময় খুব বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। বরিশাল অথবা নোয়াখালির গ্রামের মতো নয়, তবু একটা চরিত্র আছে। ইউসুফভাইয়ের সঙ্গে চলে আসতে পারেন।
এই সময় সুটকেসগুলো নিয়ে বেল্ট পাক খেতে লাগল। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল নিজের জিনিসপত্র তুলে নিতে। ভিড়টাও বেড়ে গিয়েছিল। ট্রলিতে সুটকেস চাপিয়ে ইউসুফভাইয়ের সঙ্গে কাস্টমসের বেড়া ডিঙিয়ে যখন অর্জুন বেরিয়ে, এল বাইরে তখন এ. বি. ঘোষ অদৃশ্য হয়েছেন। প্রযোজক এবং অভিনেত্রীকে রিসিভ করতে অনেক মানুষ এসেছেন এয়ারপোর্টে।
বাইরে বেরিয়ে আসতেই একটা লোক সামনে দাঁড়াল, সালাম ছার। গাড়ি আনছি।
ইউসুফভাই জিজ্ঞেস করলেন, সব খবর ভাল?
জি।
চল। আসুন অর্জুনবাবু।
হাঁটতে-হাঁটতে অর্জুন বলল, আপনি যদি আমাকে একটা মাঝারি হোটেলে নামিয়ে দেন …।
হোটেল? আমি থাকতে আপনি হোটেলে উঠবেন, একথা বললেন কী করে?
ইউসুফভাই, আপনি আমাকে এখনও ভাল করে চেনেন না।
আরে রাখেন ভাই! ব্যবসায়ী লোক, মুখ দেখেই মানুষ চিনতে পারি। চলেন।
ঢাকার রাস্তায় যেসব গাড়ি চলে তার প্রায় সবগুলোই জাপানের গাড়ি। তাদের চেহারা সুন্দর, চলেও ভাল। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে অর্জুনের মনে হচ্ছিল সে বুঝি আমেরিকা অথবা ইউরোপের কোনও শহরে এসেছে। তারপরেই চোখ এবং মন জুড়িয়ে গেল। রাস্তার দুদিকে যত নির্দেশাবলী, তা বাংলায় লেখা। মাঝে-মাঝে কিছু স্লোগান লেখা রয়েছে, যেমন, সবার জন্য ডাল-ভাত। আরামদায়ক গাড়ির মধ্যে বসে অর্জুনের মনে হল, বাঙালি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করার ব্যাপারে এরা খুবই সচেতন। তার ভাল লাগছিল।