বেলুড় মঠে সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী শিষ্যগণের নিকট কথিত।
প্রাচীন ঋষিগণের উপর আমি অসীম শ্রদ্ধাভক্তিসম্পন্ন, কিন্তু পরবর্তী কালে তাঁহাদের দোহাই দিয়া যেভাবে জনসমাজে লোকশিক্ষা প্রবর্তিত হইয়াছে, সেই শিক্ষাপ্রণালী আমি বিশেষ আপত্তিকর মনে করি। ঐ সময় হইতে স্মৃতিকারেরা সর্বদাই ‘ইহা কর, উহা করিও না’ ইত্যাদি-রূপ বিধিনিষেধ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু ‘কেন এই কাজ করিতে হইবে? কেন ইহা করিব না?’—বিধিনিষেধগুলির উদ্দেশ্য বা যুক্তি তাঁহারা কখনই দেন নাই। এইরূপ শিক্ষাপ্রণালী আগাগোড়া বড়ই অনিষ্টকর—ইহাতে যথার্থ উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হইয়া লোকের ঘাড়ে কতকগুলি অনর্থের বোঝা চাপান হয় মাত্র। এই বিধিনিষেধগুলির উদ্দেশ্য সাধারণ লোকের নিকট গোপন করিয়া রাখিবার এই কারণ প্রদর্শিত হইয়া থাকে যে, তাহারা ঐ উদ্দেশ্য বুঝিবার যথার্থ অধিকারী নয়—সেইজন্য তাহাদের নিকট বলিলেও তাহারা উহা বুঝিবে না। এই অধিকারিবাদের অনেকটা খাঁটি স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁহারা ভাবিতেন, তাঁহারা যে-বিষয়ে বিশেষ চর্চা করিয়া জ্ঞানলাভ করিয়াছেন, লোককে যদি তাহা জানাইয়া দেওয়া হয়, তবে তাহারা আর তাঁহাদিগকে আচার্যের উচ্চ আসনে বসাইবে না। এই কারণেই তাঁহারা অধিকারিবাদের মতটা বিশেষভাবে সমর্থন করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। সামর্থ্যরহিত বলিয়া যদি কোন লোককে তোমরা উচ্চ বিষয় জানিবার অনধিকারী বা অনুপযুক্ত মনে কর, তবে তো তোমাদের তাহাকে অধিক পরিমাণে শিক্ষা দিয়া যাহাতে সে ঐ তত্ত্বসকল বুঝিবার শক্তি-লাভ করিয়া উপযুক্ত হয়, সেজন্য চেষ্টা করা উচিত; তাহার বুদ্ধি যাহাতে মার্জিত ও সবল হয়, সূক্ষ্ম বিষয়সমূহ সে যাহাতে ধারণা করিতে পারে, সেজন্য তাহাকে অল্প শিক্ষা না দিয়া বরং বেশী শিক্ষা দেওয়াই তো উচিত। এই অধিকারিবাদ-মতাবলম্বিগণ—মানবাত্মার মধ্যে যে গূঢ়ভাবে সমুদয় শক্তি রহিয়াছে—এ কথাটা যেন একেবারে ভুলিয়া যান, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ব্যক্তিই জ্ঞানের অধিকারী হইতে পারে, যদি তাহাকে তাহার ভাষায়, তাহার উপযোগিভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়। যে আচার্য অপরের জ্ঞানোন্মেষ করিতে পারিতেছেন না, তিনি তাঁহার শিষ্যগণের নিন্দা না করিয়া এবং উচ্চতর জ্ঞান তাহাদের জন্য নয়, এই বৃথা হেতুবাদে তাহাদিগকে চিরদিনের জন্য অজ্ঞান ও কুসংস্কারে ফেলিয়া না রাখিয়া তিনি যে তাহাদিগকে তাহাদের ভাষায়, তাহাদের উপযোগিভাবে শিক্ষা দিয়া তাহাদের জ্ঞানোন্মেষ করিয়া দিতে পারিতেছেন না, সেজন্য যেন বিরলে অশ্রুবিসর্জন করেন। সত্য যাহা, তাহা নির্ভয়ে সকলের সমক্ষে উচ্চৈঃস্বরে প্রকাশ করিয়া বল—দুর্বল অধিকারিগণের ইহাতে বুদ্ধিভেদ হইবে, এ আশঙ্কা করিও না। মানুষ নিজে ঘোর স্বার্থপর, তাই সে চায় না যে, সে যতদূর জ্ঞানলাভ করিয়াছে, অপরেও তাহা লাভ করুক—তাহার আশঙ্কা হয়, তাহা হইলে লোকে তাহাকে মানিবে না, সে অপরের নিকট হইতে যে-সকল সুযোগ-সুবিধা পাইতেছে, অন্যের নিকট হইতে যে বিশেষ সম্মান পাইতেছে, তাহা আর পাইবে না। সেইজন্য সে তর্ক করিয়া থাকে যে, দুর্বলচিত্ত লোকের নিকট উচ্চতম আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কথা বলিলে তাহাদের বুদ্ধি গুলাইয়া যাইবে। অতএব আমরা শ্লোক শুনি—
ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্।
যোজয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্॥
কর্মাসক্ত অজ্ঞ ব্যক্তিদিগকে জ্ঞানের উপদেশ দিয়া জ্ঞানী ব্যক্তি তাহাদের বুদ্ধিভেদ জন্মাইবেন না। কিন্তু জ্ঞানী যুক্তভাবে কর্মসমুদয় স্বয়ং আচরণ করিয়া তাহাদিগকে কর্মে নিযুক্ত রাখিবেন।
আলোকের দ্বারা অন্ধকার দূর না হইয়া পূর্বাপেক্ষা গভীরতর অন্ধকারের সৃষ্টি হইয়া থাকে—এই স্ববিরোধী বাক্যে আমার বিশ্বাস হয় না। অমৃতস্বরূপ সচ্চিদানন্দ সমুদ্রে ডুবিলে মানুষ মরে—এ কথা যেমন, পূর্বোক্ত কথাটিও তদ্রূপ। কি অসম্ভব কথা! জ্ঞানের অর্থ—অজ্ঞানজ ভ্রমসমূহ হইতে মুক্ত হওয়া! সেই জ্ঞানের দ্বারা ভ্রম আসিবে—জ্ঞানালোক আসিলে মাথা গুলাইয়া যাইবে!! ইহা কি কখনও সম্ভব! এইরূপ মতবাদের উৎপত্তির প্রকৃত কারণ এই যে, মানুষ সাধারণ লোকের নিকট হইতে সম্মান হারাইবার ভয়ে খাঁটি সত্য যাহা, তাহা প্রচার করিতে সাহসী হয় না। তাহারা সনাতন সত্যের সহিত ভ্রমপূর্ণ কুসংস্কারগুলির একটা আপস করিতে চেষ্টা করে এবং সেইজন্য এই মতবাদের পোষকতা করে যে, লোকাচার ও দেশাচার মানিতেই হইবে। সাবধান, তোমরা কখনও এইরূপ আপস করিতে যাইও না; সাবধান, এইরূপে পুরাতন ভাঙাঘরের উপর এক পোঁচ চুণকাম করিয়া উহাকে নূতন করিয়া চালাইতে চেষ্টা করিও না। মড়াটার উপর কতকগুলো ফুল চাপা দিয়া উহার বীভৎস দৃশ্য ঢাকিতে যাইও না। ‘তথাপি লৌকিকাচারং মনসাপি ন লঙ্ঘয়েৎ’—তথাপি মনে মনেও লোকাচার লঙ্ঘন করিবে না—এইসব বাক্য গঙ্গাজলে ভাসাইয়া দাও। এইরূপ আপস করিতে গেলে ফল এই হয় যে, মহান্ সত্যগুলি অতি শীঘ্রই নানা কুসংস্কাররূপ আবর্জনাস্তূপের নীচে চাপা পড়িয়া যায়, আর মানুষ ঐগুলিকে পরম আগ্রহে সত্য বলিয়া গ্রহণ করে। এমন কি শ্রীকৃষ্ণ নির্ভীকভাবে গীতার যে মহান্ সত্যসমূহ প্রচার করিয়া গেলেন উহারাও পরবর্তী কালের শিষ্য প্রশিষ্যদের হাতে অসম্পূর্ণ অপব্যাখ্যা লাভ করিয়াছিল। ফলে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শাস্ত্রটির মধ্যে এমন অনেক জিনিষ ঢুকিয়াছে, যাহা মানুষকে পথভ্রান্ত করিতে পারে।
এই আপসের চেষ্টা আসে ঘোর কাপুরুষতা হইতে, লোকভয় হইতে। তোমরা নির্ভীক হও। আমার শিষ্যগণের সর্বোপরি খুব নির্ভীক হওয়া চাই। কোন কারণে কাহারও সহিত কোনরূপ আপস করা চলিবে না। উচ্চতম সত্যসমূহ অধিকারিনির্বিশেষে প্রচার করিতে থাক। লোকে তোমাকে মানিবে না অথবা লোকের সঙ্গে অনর্থক বিবাদ বাধিবে—এ ভয় করিও না। এইটি নিশ্চয় জানিও যে, সত্যকে পরিত্যাগ করিবার শত শত প্রলোভন সত্ত্বেও যদি তোমরা সত্যকে ধরিয়া থাকিতে পার, তোমাদের ভিতর এমন এক দৈব বল আসিবে, যাহার সম্মুখে মানুষ—তোমরা যাহা বিশ্বাস কর না, তাহা বলিতে সাহসী হইবে না। যদি তোমরা চতু্র্দশ বৎসর ধরিয়া সত্য পথ হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হইয়া ক্রমাগত সত্যের যথার্থ সেবা করিতে পার, তবে তোমরা লোককে যাহা বলিবে, তাহাকে তাহার সত্যতা বুঝিয়া স্বীকার করিতেই হইবে। এইরূপে তোমরা সর্বসাধারণের মহা কল্যাণ করিতে পারিবে, তোমাদের দ্বারা লোকের বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে, তোমরা সমুদয় জাতিকে উন্নত করিতে পারিবে।