রাজকুমারী রিয়া
আমি চোখ খুলে দেখতে পেলাম আমাকে ঘিরে তিনজন মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। নিরানন্দ সরীসৃপের মতো মানুষটিকে হঠাৎ করে প্রাণবন্ত মানুষের মতো দেখাচ্ছে। লালচে চুলের বিরক্ত মানুষটিকেও কেমন জানি সহৃদয় মানুষ মনে হচ্ছে। যে মানুষটিকে পুরুষ না মহিলা বলে নিঃসন্দেহ হতে পারছিলাম না এখন হঠাৎ করে তাকে বেশ সুন্দরী একজন মহিলা মনে হল। নিশ্চয়ই আমার মস্তিষ্কে কিছু একটা করা হয়েছে যে কারণে গোমড়ামুখী নিরানন্দ তিনজন মানুষকেই হঠাৎ করে মোটামুটি সহৃদয় মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
মহিলাটি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তোমার এখন কেমন লাগছে?
আমি মহিলাটির চোখের দিকে তাকালাম। মহিলাটির চোখে সত্যিকারের এক ধরনের উদ্বেগ। আমার জন্যে হঠাৎ করে এই মমত্ববোধ কেমন করে এল? আমি বললাম, জানি না।
নিরানন্দ মানুষটি বলল, জানার কথা নয়। বুঝতে একটু সময় লাগবে।
আমি মহিলাটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?
আমার নাম রিকি।
তোমাকে আগে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি তোমার নাম বলতে চাও নি।
রিকি অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসল, হেসে বলল, আগে আর এখনের মাঝে একটা বড় পার্থক্য আছে।
কী পার্থক্য?
আগে তুমি ছিলে ট্রাকিওশান সরানো একজন ফালতু মানুষ শব্দটার জন্যে কিছু মনে করো না।
এখন?
এখন তোমার মস্তিষ্কে একটা ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস বসিয়ে তোমার পুরো নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করে নিয়েছি–তুমি এখন ফালতু মানুষ নও। রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
তার মানে আমার আর একটা অস্তিত্ব তৈরি করে নিয়েছ।
বলতে পার।
এটা বেআইনি। এটা তোমরা করতে পার না।
অন্য কারো বেলায় সেটা সত্যি তোমার জন্যে নয়। তুমি ভুলে যাচ্ছ শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে তুমি মানুষ হিসেবে তোমার সমস্ত অধিকার নিজে থেকে ছেড়ে দিয়েছ।
লাল চুলের মানুষটা সহৃদয় ভাবে হেসে বলল, তুমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। ট্রাইকিনিওয়াল বসিয়ে মস্তিষ্ক ম্যাপ করা হলে শরীরের ওপর খুব বড় অত্যাচার হয়।
আমি কিছু বললাম না।
তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে?
আমি উঠে বসার চেষ্টা করে বললাম, একটু দুর্বল লাগছে।
মহিলাটি আমাকে ধরে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে বলল, হঠাৎ করে উঠে বোসো না। ধীরে ধীরে ওঠ।
আমি চারদিকে তাকালাম, সবকিছুই আগের মতো আছে তবুও কোথায় যেন সবকিছুকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। আমার মস্তিষ্কের মাঝে নিশ্চয়ই কিছু একটা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমি মাথার পেছনে হাত দিয়ে সেখানে ছোট একটা ধাতব টিউব অনুভব করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী?
ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস। ভেতরে ছোট ক্ষতটুকু শুকিয়ে গেলে খুলে নিতে পারবে।
আমার শরীর শিরশির করে ওঠে, মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি সংযোগ করার জন্যে সেখানে একটি পোর্ট খুলে রেখেছে ব্যাপারটি চিন্তা করে আমার সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে।
মহিলাটি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তুমি নিজে থেকে ইন্টারফেসটা খোলার চেষ্টা করো না কিন্তু মস্তিষ্কের সাথে লাগানো আছে–চিকিৎসক রোবট ছাড়া আর কেউ খুলতে পারবে না।
আমার রেগে ওঠার কথা ছিল কিন্তু কোনো একটা বিচিত্র কারণে আমি কেন জানি রেগে উঠতে পারলাম না। ভেতরে ভেতরে আমি কেমন জানি অবসন্ন এবং উদাসীন অনুভব করতে থাকি।
মহিলাটি লাল চুলের মানুষটিকে বলল, শিরান, তুমি ত্রাতুলকে দাঁড় করিয়ে দাও।
ঠিক আছে, ক্লিশা। শিরান নামের লাল চুলের মানুষটি আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল। আমার প্রথমে মনে হল হাঁটুতে কোনো জোর নেই, আমি পা ভেঙে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু দুই পাশ থেকে দুজন আমাকে সময়মতো ধরে ফেলল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর আমি নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারলাম। দেয়াল ধরে ঘরের ভেতরে একটু ঘুরে এসে আমি তিনজন মানুষের দিকে তাকালাম, বললাম, রিকি, শিরান এবং ক্লিশা–তোমরা আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে?
ক্লিশা একটু ব্যাকুল চোখে বলল, অবশ্যই বলব।
তোমরা আমাকে কেন এনেছ? আমাকে কী করেছ? এখন আমাকে দিয়ে কী করবে?
ক্লিশা অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, দেখো ত্রাতুল, একটি খুব বড় প্রজেক্টে মানুষের কিছু অস্তিত্বের প্রয়োজন। আইন খুব কঠিন তাই আমরা সবার মস্তিষ্ক ম্যাপ করতে পারি না। তোমার ট্রাকিওশান নেই বলে তোমারটা করেছি। এর বেশি কিছু নয়।
আমার মস্তিষ্কের ম্যাপ মানে আমি। যার অর্থ এখন আমার দুটো অস্তিত্ব।
বলতে পার।
আমার অন্য অস্তিত্ব এখন কোথায়?
একটি বিশাল তথ্য কেন্দ্রে আছে।
কীভাবে আছে? সে কি কষ্টে আছে?
ক্লিশা হাসল, বলল, না সে কষ্টে নেই। তাকে কোনো ক্ষেত্র দেওয়া হয় নি। তার শরীর নেই, ইন্দ্রিয় নেই, কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা নেই।
আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই ভয়ংকর একটি অনুভূতি। একজন মানুষের কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা নেই আমি তো চিন্তাও করতে পারি না।
শিরান নামের লাল চুলের মানুষটি আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, এখন এসব চিন্তা করে লাভ নেই। দেখো কত তাড়াতাড়ি নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পার। যত তাড়াতাড়ি তুমি দাঁড়াতে পারবে তত তাড়াতাড়ি তুমি তোমার নিজের জগতে যেতে পারবে।
সবকিছু এখনো আমার কাছে খানিকটা দুর্বোধ্য মনে হতে থাকে। আমি অবিশ্যি সেটি নিয়ে মাথা ঘামালাম না। শিরান নামের মানুষটি সত্যি কথাই বলেছে, আমার মস্তিষ্কের আরেকটা কপি কোথাও থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? আমি এখান থেকে বের হয়ে যাব–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কিছুক্ষণের মাঝেই আমি মোটামুটিভাবে হাঁটতে শুরু করলাম। নিজের শরীরের ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ ফিরে এল। হঠাৎ করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালে মাথাটা একটু ঘুরে ওঠে। এ ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গ নেই। ক্লিশা বলেছে কিছুক্ষণের মাঝে এ সমস্যাটিও থাকবে না।
ঘণ্টাখানেকের মাঝে আমি আমার নিজের পোশাক পরে বের হয়ে এলাম। রাত্রিবেলা আমাকে যখন এখানে এনেছে তখন বুঝতে পারি নি, দিনের বেলা দেখতে পেলাম পুরো এলাকাটি খুব সুন্দর। পাহাড়ের পাদদেশে চমৎকার একটি হ্রদ, হ্রদের পানি আশ্চর্য রকম নীল–দেখে ছবির মতো মনে হয়। পুরো এলাকাটি গাছপালা দিয়ে ঘেরা, রাস্তাগুলো জনশূন্য। মাঝে মাঝে নিচু হয়ে একটি–দুটি বাইভার্বাল উড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কোনো যানবাহন নেই। সূর্যের নরম একটা উত্তাপ, হ্রদ থেকে হালকা শীতল বাতাস বইছে, বাতাসে এক ধরনের জলে ভেজা গন্ধ। আমি রাস্তা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকি, এলাকাটিতে এক ধরনের শান্তি শান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে। এখানে কয়েকদিন থেকে গেলে মন্দ হয় না।
আমি বড় রাস্তা থেকে সরে গিয়ে গাছপালায় ঢাকা ছোট একটি রাস্তা ধরে খানিকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকি। রাস্তাটি সম্ভবত হ্রদের তীরে গিয়েছে, গাছের পাতা বাতাসে শিরশির করে নড়ছে–শব্দটি শুনতে বড় মধুর লাগতে থাকে। বড় বড় শহরগুলো থেকে গাছপালা পুরোপুরি উঠে গিয়েছে–এখানে এসে হঠাৎ করে এর গুরুত্বটুকু নতুন করে মনে পড়ল। রাস্তাটি সরু হয়ে আর ঘন গাছপালার ভেতরে চলে এসেছে, গাছের ওপর পাখি কিচিরমিচির করে ঝগড়া করছে, আরো উপরে নীল আকাশে সাদা মেঘ। সব মিলিয়ে পরিবেশটি ভারি মধুর।
অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি হঠাৎ করে গাছপালার ভেতর থেকে বের হয়ে হ্রদের সামনে চলে এলাম। সামনে বিস্তৃত বালুবেলা সকালের নরম রোদে চিকচিক করছে। দূরে হ্রদের টলটলে পানি, পাহাড়ের ছায়া পড়ে পানিতে গাঢ় একটি নীল রঙ, দেখে মনে হয় বুঝি অতিপ্রাকৃত একটি দৃশ্য। এই অস্বাভাবিক সুন্দর দৃশ্যটি দেখে আমি কয়েক মুহূর্ত প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিচ্ছি ঠিক তখন মনে হল একটি মেয়ের আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। এই অপূর্ব প্রায় অলৌকিক সুন্দর একটি জায়গায় মেয়ে কণ্ঠের আর্তচিৎকার এত অস্বাভাবিক মনে হল যে আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। মনে হল নিশ্চয়ই ভুল শুনেছি–কিন্তু ঠিক তখন আমি দ্বিতীয়বার একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। এটি মনের ভুল নয়, সত্যি সত্যি কোনো একটি মেয়ে চিৎকার করেছে।
আমি মেয়েটির গলার আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটতে থাকি। হ্রদের তীরের টানা বাতাসে ছোটবড়া বালিয়াড়ি তৈরি হয়েছে। তার দুটি অতিক্রম করে তৃতীয়টির উপরে উঠতেই দেখতে পেলাম, বালিয়াড়ির অন্য পাশে কয়েকজন মানুষ মিলে একটি মেয়েকে টানাহ্যাঁচড়া করছে। আমি বালিয়াড়ির উপরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে?
মানুষগুলো ঘুরে আমার দিকে তাকাল এবং আমি দেখতে পেলাম এরা সত্যিকারের মানুষ নয়–এগুলো সাইবর্গ। মাথার পাশে যান্ত্রিক করোটি, সেখানে নানা ধরনের টিউবে কপোট্রন শীতল করার তরল প্রবাহিত হচ্ছে। কারো কারো একটি চোখ কৃত্রিম, সেখানে লাল আলো জ্বলছে। সাইবর্গগুলো একবার আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আবার মেয়েটিকে টানাহ্যাঁচড়া করতে থাকে। একটি সাইবর্গ তার শক্তিশালী হাত দিয়ে মেয়েটিকে প্রায় শূন্যে তুলে নিয়ে ফেলে দিল। আমি সাইবর্গগুলোর এক ধরনের কুৎসিত যান্ত্রিক হাসি শুনতে পেলাম।
কী করছ? কী করছ তোমরা? বলে চিৎকার করতে করতে আমি বালিয়াড়ি থেকে ছুটতে ছুটতে সাইবর্গগুলোর দিকে যেতে থাকি। একটা শক্তিশালী সাইবর্গ তার বাম পা দিয়ে মেয়েটিকে বালুতে চেপে ধরে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে খসখসে গলায় বলল, তুমি কে? এখানে কেন এসেছ?
আমি কাছাকাছি একটা বালিয়াড়ির উপর দাঁড়িয়ে থেকে চিৎকার করে বললাম, আমি যেই হই না কেন, তুমি মেয়েটিকে ছেড়ে দাও।
মেয়েটিকে যদি ছেড়েই দেব তা হলে ধরে আনলাম কেন?
আমিও সেটা জানতে চাই। কেন ধরে এনেছ?
দেখার জন্যে। অনেক দিন মেয়ে দেখি না।
দেখার জন্যে পা দিয়ে মাটিতে চেপে ধরে রাখতে হয় না। তোমার গোবদা পা সরাও–মেয়েটিকে ছাড়।
সাইবর্গটি একটা নোংরা মুখভঙ্গি করে বলল, অন্যরকম করে দেখতে চাই।
আমি ক্রুদ্ধ গলায় বললাম, বাজে কথা বলো না। সাইবর্গ মাত্রই নপুংসক। মিছিমিছি অন্যরকম ভান করো না।
সব সময় তো নপুংসক ছিলাম না এখন না হয় হয়েছি।
অনেক বাজে কথা হয়েছে। এখন মেয়েটিকে ছেড়ে দাও।
সাইবর্গটি আমার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে অন্য সাইবর্গগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এই মানুষটি খুব দুর্ব্যবহার করছে।
সাইবর্গগুলো সম্মতির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। মেয়েটিকে মাটিতে চেপে রাখা সাইবর্গটি বলল, সাইবর্গের সাথে দুর্ব্যবহার করলে তার শাস্তি পেতে হবে। এটাকেও ধরে আন।
আমি তীক্ষ্ণ চোখে সাইবর্গগুলোকে লক্ষ করলাম, দেখতে ভিন্ন মনে হলেও এগুলো আসলে হাইব্রিড তিন মডেলের। এই মডেলগুলোর বড় ধরনের সমস্যা আছে। তা ছাড়াও এদের মেটাকোড এত সহজ যে ইচ্ছে করলেই এগুলোকে আমি চোখের পলকে বিকল করে দিতে পারি। কিন্তু এরা কী করে আমার দেখার ইচ্ছে করল, আমি কয়েক পা এগিয়ে দুই হাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি নোংরা আবর্জনা কোথাকার! এর মাঝে যদি এখান থেকে বিদায় না হও তোমাদের কপোট্রনের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেব।
দুটি সাইবর্গ মুখে অশ্লীল কথার তুবড়ি ছুটিয়ে বালিয়াড়ি ভেঙে আমার কাছে ছুটে আসতে থাকে, আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্বমুহূর্তে ফিসফিস করে বললাম, কালো গহ্বরে এনিফর্মের নৃত্য।
সাইবর্গ দুটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল, একজন ফিসফিস করে বলল, কী বললে? কী। বললে তুমি?
আমি বলেছি কালো গহ্বর অর্থাৎ ব্ল্যাকহোলে এনিফর্মের নৃত্য।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সাইবর্গ দুটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। আমি পা দিয়ে ধাক্কা দিতেই একটি সাইবর্গ বালিয়াড়ি দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আমি দ্বিতীয় সাইবর্গটিকে গুঁড়িয়ে দেবার আগে কৌতূহলী হয়ে তার ব্যাগটিতে উঁকি দিলাম, সেখানে একটি মাঝারি আকারের অস্ত্র লুকানো আছে। কাজটি ঘোরতর বেআইনি, সাইবর্গকে এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনা যায় নি, তাদের কাছে কখনোই অস্ত্র থাকার কথা নয়। আমি ব্যাগটি থেকে অস্ত্রটি বের করে তাকে ধাক্কা দিতেই এই সাইবর্গটিও বালিয়াড়ি থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ল।
অন্য দুটি সাইবর্গ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আমি অস্ত্রটি তাদের দিকে তাক করে বললাম, দশ সেকেন্ডের আর দুই সেকেন্ড বাকি আছে আবর্জনার পিণ্ড। এই মুহূর্তে দূর হও।
আমার কথায় এবারে ম্যাজিকের মতো কাজ হল। সাইবর্গ দুটি মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে পালিয়ে গেল, এরা দৌড়ে অভ্যস্ত নয়, বিশেষ করে বালুর উপরে দৌড়ানো খুব কঠিন, সাইবর্গ দুটি কয়েকবার পা হড়কে নিচে পড়ে গিয়েও থামল না।
আমি বালিয়াড়ির ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলাম। মেয়েটি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে শরীর থেকে বালু ঝাড়ছে। আমি কাছে যেতেই বড় বড় চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিশ্বাস ফেলে বলল, ধন্যবাদ। তুমি না এলে যে কী সর্বনাশ হত!
কিছু হত না। আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, আধুনিক প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ব্যর্থ আবিষ্কার হচ্ছে সাইবর্গ। মানুষ আর যন্ত্র মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে লাভের মাঝে লাভ হয়েছে এটা মানুষও হয় নি যন্ত্রও হয় নি।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। এই ব্যাপার নিয়ে আমার অনেক দিনের কৌতূহল। কিছু কিছু জিনিস আমি জানি।
মেয়েটি মাথার এলোমেলো চুলকে হাত দিয়ে খানিকটা বিন্যস্ত করার চেষ্টা করে বলল, সেটি অবিশ্যি দেখতে পেলাম। এই দুটি সাইবর্গকে কী সহজে কাবু করে ফেললে।
মেটাকোড জানলে তুমিও পারবে। আমি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম, আমার নাম শ্রাতুল। কিন্তু আমি সেটা প্রমাণ করতে পারব না। আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই।
মেয়েটি এবার মনে হল প্রথমবার সত্যিকার কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে তাকাল, তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল এবং শুধুমাত্র এই হাসিটির কারণে আমার হঠাৎ করে মনে হল মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। আমি বললাম, কী হল? তুমি হাসছ কেন?
আমি শুধু নেটওয়ার্কে শুনেছি কোনো কোনো মানুষ নাকি শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলে। কখনো কাউকে দেখি নি।
জেলখানায় গেলেই দেখবে। বড় বড় অপরাধীরা শরীরে ট্রাকিওশান রাখে না। রাখলেও ভুল ট্রাকিওশান রাখে।
কিন্তু সেটা তো অন্য ব্যাপার। অপরাধ করার জন্যে ট্রাকিওশান সরানো–।
আমি হেসে বললাম, তুমি কেন ধরে দিলে আমি একজন অপরাধী না। আমি তো অপরাধী হতেও পারি।
মেয়েটি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, আমার একবারও মনে হয় নি যে তুমি অপরাধী হতে পার। তাকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাল, ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি অপরাধী?
আমি হেসে ফেললাম, প্রথমবার বুঝতে পারলাম মেয়েটির মাঝে এক ধরনের সারল্য রয়েছে যেটি আমি বহুদিন কারো মাঝে দেখি নি। বললাম, তুমি কি মনে কর আমি অপরাধী হলে সেটি তোমার কাছে স্বীকার করব?
করবে না, তাই না?
না। অপরাধী হওয়ার পর প্রথম কাজই হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা।
মেয়েটি খুব একটি নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছে সেরকম ভঙ্গি করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই আমি অপরাধী না। ঠিক করে বলতে হলে বলতে হয় যে বড় ধরনের অপরাধী না।
তার মানে ছোট ছোট অপরাধ করেছ?
হ্যাঁ, এই যে দুটি সাইবর্গকে অচল করেছি সেটাও ছোট একটা অপরাধ।
কিন্তু সেটা তো করেছ আমাকে বাঁচানোর জন্যে।
তবুও। আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিন্তু তোমাকে সাহায্য করার জন্যে কেউ এল না কেন?
আমি বুঝতে পারছি না। গত কয়েকদিন থেকে আমার শুধু অঘটন ঘটছে। নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করার পর থেকে
আমি চমকে উঠে বললাম, তোমার নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করা হয়েছে?
হ্যাঁ।
তার মানে তোমার মাথাতেও ট্রাইকিনিওয়াল বসানো হয়েছে?
হ্যাঁ, এই দেখ। মেয়েটি আমার সামনে তার মাথাটি এগিয়ে নিয়ে আসে, আমি তার ঘন কালো রেশমের মতো চুল সরিয়ে দেখতে পেলাম মাথার পেছনে ছোট একটা ধাতব সকেট লাগানো–এটা নিশ্চয়ই ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস আমার মাথাতেও আছে।
আমি একটু অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই কিছু একটা ছিল, মেয়েটা কেমন যেন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? তুমি এরকমভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
না, আমি একটু বোঝার চেষ্টা করছি। আমার নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করেছে কারণ আমার মানুষ হিসেবে কোনো অধিকার নেই। কিন্তু তোমাকে কেন করল?
ও! মেয়েটার মুখে নির্দোষ সারল্যের একটা হাসি ফুটে উঠল, বলল, তার কারণ আমি হচ্ছি রাজকুমারী রিয়া!
রাজকুমারী রিয়া?
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, সত্যিকারের রাজকুমারী নই–কিন্তু তবু নাকি আমি রাজকুমারী।
কেমন করে শুনি?
জিনেটিক কোডিং করে একেবারে নিখুঁত একজন মানুষ তৈরি করা হয়েছে তুমি জান?
হ্যাঁ, জানি। একটি মেয়েকে তৈরি করা হয়েছে। সেটা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে–
আমি সেই মেয়ে।
আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম–খানিকক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। মেয়েটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, আমি নেটওয়ার্কে এই মেয়েটির ছবি দেখেছি, কালো চুল, কালো গভীর চোখ, মসৃণ ত্বক। ছবিতে শুধুমাত্র চেহারার সৌন্দর্যটুকু ধরা পড়ে–ভেতরের সৌন্দর্য ধরা পড়ে না। সামনাসামনি কথা বলে বোঝা যায়। এই মেয়েটির ভেতরে একটি আশ্চর্য সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। আমি খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললাম, তুমি সেই রিয়া?
হ্যাঁ।
তুমি এখানে কেন?
আমি জানি না। আমার নিউরাল ম্যাপিং করে এখানে নিয়ে এসেছে। বলেছে এখানে এক সপ্তাহ থাকতে হবে। আমি কাউকে চিনি না, জানি না, যেখানেই যাই সেখানেই একটা অঘটন ঘটে।
অঘটন?
হ্যাঁ। আমি একটা ছোট গেষ্ট হাউজে আছি সেখানে দুই দল মারামারি করল একটা বিস্ফোরক আমার এই কনুই ঘেঁষে গিয়েছে, পেছনে একটা দেওয়াল ধসে গিয়েছে। গত রাতে গেস্ট হাউজের একটা বিম খুলে পড়েছে–একটুর জন্যে বেঁচে গেছি। দুপুরে খাবার গলায় আটকে গেল–নিশ্বাস বন্ধ করে মারাই গিয়েছিলাম, একজন এসে হেইমলিক। ম্যানুভার১৬ করে আমাকে বাচাঁলো। এখানে কী হয়েছে তা দেখতেই পেলে!
আমি ভুরু কুঁচকে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রিয়া একটু হেসে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
আমাকে এরা তৈরি করেছে একেবারে নিখুঁত মানুষ হিসেবে।
হ্যাঁ।
মানুষের যেসব গুণ থাকার কথা সব নাকি আমার মাঝে দিয়েছে আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না!
কেন?
মাঝে মাঝে এমন সব চিন্তা আমার মাথার মাঝে আসে যেগুলো নিখুঁত ভালোমানুষের মাঝে আসার কথা নয়। যাই হোক–যা বলছিলাম, আমার কী মনে হয় জান?
কী?
এরা আমাকে পরীক্ষা করছে। এতদিন আমাকে আর আমার মাকে খুব ভালো করে রেখেছে, যত্ন করে রেখেছে। ভালো স্কুলে গিয়েছি ভালো মানুষের সাথে মিশেছি সব সময় আমাকে চোখে চোখে রেখেছে। এখন আমার ওপর একটা পরীক্ষা করছে। বিপদ–আপদ অঘটন হলে আমি কী রকমভাবে ব্যবহার করি সেটা দেখতে চাইছে।
রিয়া মেয়েটি নিশ্চয়ই বুদ্ধিমতী, পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষের তো বুদ্ধিমত্তা থাকারই কথা–তার কথায় একটি যুক্তিও আছে। আমি নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি ঠিকই বলেছ। মনে হয় তোমাকে একটা পরীক্ষা করছে। তোমার ট্রাকিওশান নিশ্চয়ই সব তথ্য কোনো একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে পাঠিয়ে যাচ্ছে
রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু ত্রাতুল তুমি জান একটা জিনিস?
কী?
আমার কখনো যেটা হয় নি সেটা হচ্ছে।
কী হচ্ছে?
আমার কেন জানি ভয় করছে।
ভয়?
হ্যাঁ, রিয়ার বড় বড় কালো দুটি চোখে ভয়ের একটি আশ্চর্য ছায়া পড়ল। মেয়েটি পৃথিবীর নিখুঁত মানুষ, তার চেহারায় মানুষের অনুভূতির কী চমৎকার একটি প্রতিফলন হয়– আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকি। আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, কী নিয়ে ভয় রিয়া?
আমি সেটা জানি না। সেজন্যেই ভয়।
আমার হঠাৎ খুব ইচ্ছে করল এই কোমল চেহারার মেয়েটিকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে বলি, তোমার কোনো ভয় নেই রিয়া–আমি তোমার পাশে আছি। কিন্তু আমি সেটা মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।
বালিয়াড়ির নিচে খচমচ করে এক ধরনের শব্দ হল–আমি তাকিয়ে দেখলাম সাইবর্গ দুটো ওঠার চেষ্টা করছে। রিয়া আমার কাছে এসে হাত ধরে বলল, ঐ যে ওগুলো উঠে দাঁড়াচ্ছে।
পারবে না। আমি বললাম, আমার হিসেবে এখনো পনের মিনিট কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তা ছাড়া ওপর থেকে গড়িয়ে এসেছে, আমি নিশ্চিত কপোট্রনের কিছু যোগাযোগ নষ্ট হয়েছে। ভেতরে কিছু ভেঙেচুরে গেছে।
নষ্ট হয়ে তো ক্ষতিও হতে পারে, হয়তো আমাদের আক্রমণ করে বসল।
তার আশঙ্কা নেই কিন্তু খামকা ঝুঁকি নেব না। চলো, আমরা যাই।
রিয়া আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমার সাথে কিছুক্ষণ থাকবে?
অবশ্যই থাকব। আমি নরম গলায় বললাম, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ—-তোমার সাথে কিছুক্ষণ থাকা তো আমার জন্যে অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। রিয়া কিছু না বলে বালিয়াড়ি ভেঙে হাঁটতে শুরু করল–আমি হাতের অস্ত্রটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রিয়ার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম।