মানুষ না ভূত
কোল্ফিল্ডটা প্রায় উনিশ-কুড়ি বিঘে জমি নিয়ে।
ধূ-ধূ প্রান্তর। তার মাঝে একপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে কুলিবস্তি বসানো হয়েছে। টেমপোরারি সব টালি ও টিনের সে তুলে ছোট ছোট খুপরী তোলা হয়েছে। কোন-কোনটার ভিতর থেকে আলোর কম্পিত শিখার মৃদু আভাস পাওয়া যায়। অল্প দূরে পাকা গাঁথনি ও উপরে টালির সে দিয়ে ম্যানেজারের ঘর তোলা হয়েছে এবং প্রায় একই ধরনের আর দুটি কুঠি ঠিকাদার ও সরকারের জন্য করা হয়েছে। ম্যানেজারের কোয়াটার এতদিন তালাবন্ধই ছিল। বিমলবাবু পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে দেয়।
কোয়ার্টারের মধ্যে সর্বসমেত তিনখানি ঘর, একখানি রান্নাঘর ও বাথরুম।
মাঝখানে ছোট একটি উঠোন। দক্ষিণের দিকে বড় ঘরটায় একটা কুলি একটা ছাপর খাটের ওপরে শঙ্করের শয্যা খুলে বিছিয়ে দিল।
আচ্ছা আপনি তা হলে হাতমুখ ধুয়ে নিন স্যার। ঠাকুরকে দিয়ে আপনার জন্য লুচি ভাজিয়ে রেখে দিয়েছি, পাঠিয়ে দিচ্ছি গিয়ে। বংশী এখানে রইল।
বিমলবাবু নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।
শঙ্কর শয্যার ওপরে গা ঢেলে দিল।
রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল।
কিন্তু কুয়াশার আবছায়ায় কিছু বোঝবার জো নেই।
একটু বাদে বিমলবাবুর ঠাকুর লুচি ও গরম দুধ দিয়ে গেল। দু-চারটে লুচি খেয়ে দুধটুকু এক ঢোকে শেষ করে শঙ্কর ভাল করে পালকের লেপটা গায়ে চাপিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন বিমলবাবুর ডাকে ঘুম ভেঙে শঙ্কর দরজা খুলে যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের অরুণ রাগ তখন ঝিলিক হানছে।
সারাটা দিন কাজকর্ম দেখেশুনে নিতেই চলে গেল।
বিকেলের দিকে সুব্রত এসে পৌঁছল।
কিরীটী তার হাতে একটা চিঠি দিয়েছিল।
সুব্রতর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শঙ্কর বেশ খুশীই হল।
তারও দিন দুই পরের কথা।
এ দুটো দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেছে।
সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে আবশ্যকীয় কয়েকটা কাগজপত্র শঙ্কর টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় বসে দেখছে।
সুব্রত বিকেলের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
শঙ্কর উৎকীর্ণ হয়ে উঠল, কে?
আমি স্যার, চন্দন সিং।
ভিতরে এস চন্দন।
চন্দন সিং অল্পবয়েসের পাঞ্জাবী যুবক।
এই কলিয়ারীতে ম্যানেজারের অ্যাসিসটেন্ট হয়ে কাজে বহাল হয়েছে।
কি খবর চন্দন সিং?
আপনি আমায় ডেকেছিলেন?
কই না! কে বললে? কতকটা আশ্চর্য হয়েই শঙ্কর প্রশ্ন করলে।
বিমলবাবু অর্থাৎ সরকার মশাই বললেন।
বিমলবাবু বললেন! তারপর সহসা নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে। বসো ঐ চেয়ারটায়। তোমার সঙ্গে গোটাকতক কথা আছে।
চন্দন সিং একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসল।
এখানকার চাকরি তোমার কেমন লাগছে চন্দন?
পেটের ধান্ধায় চাকরি করতে এসেছি স্যার, আমাদের পেট ভরলেই হল স্যার।
না, তা ঠিক বলছি না। এই যে পর পর দুজন ম্যানেজার এমনিভাবে নিহত হলেন—
সহসা চন্দন সিংয়ের মুখের প্রতি দৃষ্টি পড়তে শঙ্কর চমকে উঠল। চন্দনের সমগ্র মুখখানি ব্যেপে যেন একটা ভয়াবহ আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। কিন্তু চন্দন সিং সেটা সামলে নিল।
শঙ্কর বলতে লাগল, তোমার কী মনে হয় সে সম্পর্কে?
চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে চেয়ে মনে হয় যেন কী একটা কিছু বেচারী প্রাণপণে এড়িয়ে যেতে চায়।
তুমি কিছু বলবে চন্দন?
সোৎসুকভাবে শঙ্কর চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে তাকাল।
একটা কথা যদি বলি, অসন্তুষ্ট হবেন না তো স্যার?
না, না–বল কি কথা?
আপনি চলে যান স্যার। এ চাকরি করবেন না।
কেন? হঠাৎ এ-কথা বলছ কেন?
না স্যার, চলে যান আপনি। এখানে কারও ভালো হতে পারে না।
ব্যাপার কি চন্দন? এ বিষয়ে তুমি কি কিছু জান? টের পেয়েছ কিছু?
ভূত!…আমি নিজের চোখে দেখেছি।
ভূত!
হ্যাঁ। অত বড় দেহ কোন মানুষের হতে পারে না।
আমাকে সব কথা খুলে বল চন্দন সিং!
আপনার আগের ম্যানেজার সুশান্তবাবুমারা যাবার দিন-দুই আগে বেড়াতেবেড়াতে পশ্চিমের মাঠের দিকে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারিদিকে অস্পষ্ট আঁধার, হঠাৎ মনে হল পাশ দিয়ে যেন ঝড়ের মত কী একটা সন্ন্ করে হেঁটে চলে গেল। চেয়ে দেখি লম্বায় প্রায় হাত পাঁচ-ছয় হবে। আগাগোড়া সর্বাঙ্গ বাদামী রংয়ের আলখাল্লায় ঢাকা।
সেই অস্বাভাবিক লম্বা মূর্তিটা কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ একটা পৈশাচিক অট্টহাসি শুনতে পেলাম। উঃ,সে হাসি মানুষের হতে পারে না।
তারপর?
তার পরের দিনই সুশান্তবাবুও মারা যান। শুধু আমিই নয়, সুশান্তবাবুও মরবার আগের দিন সেই ভয়ঙ্কর মৃর্তি নিজেও দেখেছিলেন।
কি রকম?
রাত্রি প্রায় বারোটার সময় সে রাতে কুয়াশার মাঝে পরিষ্কার না হলেও অল্প অল্প চাঁদের আলো ছিল–রাত্রে বাথরুম যাবার জন্য উঠেছিলেন, হঠাৎ ঘরের পিছনে একটা খুকখুক কাশির শব্দ পেয়ে কৌতূহলবশে জানালা খুলতেই দেখলেন, সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি মাঠের মাঝখান দিয়ে ঝড়ের মত হেঁটে যাচ্ছে।
সে মৃর্তি আমি আজ স্বচক্ষে দেখলাম শঙ্করবাবু! দুজনে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখে বক্তা সুব্রত। সে এর মধ্যে কখন একসময়ে ফিরে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।