দিনচারেক পরের কথা। রাত তখন প্রায় নটা কি সাড়ে-নটা। জীবনবাবুর বসবার ঘরে কিরীটী
সুব্রত ও রাজু গল্প করছিল, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল—ক্রিং ক্রিং..
জীবনবাবু উঠে গিয়ে রিসিভারটা কানের কাছে তুলে ধরলেন, হ্যালো!…কে, কিরীটী রায়? ..ডেকে দেবো?…ধরুন।….
রিসিভারটা কাত করে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে জীবনবাবু বললেন, ওহে কিরীটী, পুলিস-ইনসপেক্টর মিঃ রামিয়া তোমায় ফোনে ডাকছেন। কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফোন ধরল।
মিনিট পনেরো ধরে ফোনে কি-সব কথাবার্তা বলে কিরীটী ফোন রেখে রাজুর সামনে এসে দাঁড়াল।
আমি একবার বাইরে বেরুব জীবন।
ব্যাপার কি বল তো? এত রাত্রে আবার কোথায় যাবে?
কিরীটী বলল, মিঃ রামিয়ার ওখানে।
তারপর রাজুর দিকে ফিরে বলল, সুব্রত থাক, তুই চল আমার সঙ্গে।… কথাটা বলে ওপরে নিজের ঘরে কাপড় বদলাতে চলে গেল কিরীটী।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে চলতে চলতে একসময় কিরীটী বললে, মিঃ সুন্দর দাস এখানকার একজন মস্তবড় মার্চেন্ট। তাকে তার অফিস-ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং তার ঘরের সেক্রেটেরিয়েট টেবিলের ওপরে রক্তমুখী ড্রাগন আঁকা একটা খাম পাওয়া গেছে। মিঃ রামিয়া সেখান থেকেই আমাকে একটু আগে ফোন করেছিলেন।
আমরাও কি সুন্দর দাসের ওখানেই যাচ্ছি?
হ্যাঁ।
বড় রাস্তার উপরেই মিঃ সুন্দর দাসের প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ি-মার্বেল রক।
রাতের অন্ধকার তখন চারিদিকে বেশ ঘন হয়ে এসেছে, রাস্তার দুপাশের ইলেকট্রিক বাতি থাকায় চারিদিক বেশ আলোকিত।
মার্বেল রকের সামনেই দুজন পুলিস মোতায়েন ছিল। কিরীটী ও রাজুকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদেরই একজন জিজ্ঞেস করে, আপনি কি মিঃ কে. রায়?
কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, হ্যাঁ।
আসুন আমার সঙ্গে, ইনসপেক্টর সাহেব ওপরে আছেন। কিরীটী ও রাজু লোকটার পিছু পিছু এগিয়ে যায়। সুন্দর দাসের বাড়িতে অফিস-ঘরটা দোতলায় দক্ষিণ কোণে।
একটা লম্বা টানা বারান্দায় পর পর খান-পাঁচেক ঘর, সর্বশেষের ঘরখানাই সুন্দর দাসের অফিস-ঘর।
অফিস-ঘরের পিছনদিকে, নীচে ছোট একটা গলিপথ, সেই গলির অপর পাশে একটা দোতলা বাড়ি। কিরীটীর নজরে পড়ল।
বাড়িটার দরজায় তালাবন্ধ। জানালা-দরজা সব ভিতর হতে বন্ধ।
দুটো বাড়ির ব্যবধান মাত্র হাত-তিনেক।
পুলিসের পিছু পিছু কিরীটী ও রাজু ঘরে এসে প্রবেশ করল।
মিঃ রামিয়া ঘরের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরকার কাগজপত্রগুলো নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন।
গুড ইভনিং মিঃ রামিয়া—
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে মিঃ রামিয়া মুখ তুলে তাকালেন।
গুড ইভনিং, আসুন, এই ঘরের মিঃ সুন্দর দাসের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ঐ সুন্দর দাসের মৃতদেহ!
কিরীটী প্রথমেই একবার নিঃশব্দে চোখ বুলিয়ে ঘরটা দেখে নিল।
অতি আধুনিক কায়দায় ঘরখানি সাজানো-গোছানো। মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো। দেওয়ালে দামী দামী সব ল্যাণ্ডস্কেপ বিদেশী চিত্রকরদের। সিলিং থেকে ঝোলানো সাদা ডিম্বাকৃতি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোয় সমস্ত ঘরখানি ঝলমল করছে।
সেক্রেটারিয়েট টেবিলের একপাশে গদি-মোড়া একখানি রিভলভিং চেয়ার; তারই একপাশে সুন্দর দাঁসের মৃতদেহ মেঝেয় কার্পেটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কিরীটী নীচু হয়ে মৃতদেহটা পরীক্ষা করে দেখল। মৃতদেহে ক্ষতের চিহ্নমাত্র নেই। কোনরূপ গুলির দাগ বা ছোরাছুরি দিয়ে কাটা কোন ক্ষত পর্যন্ত নেই।
মিঃ রামিয়া বললেন, কোন ইনজুরি বা কিছুই মৃতদেহে নেই।
কিরীটী কোন জবাব দিল না।
মৃতদেহের পজিশানটা আর একবার ভাল করে দেখে কিরীটী আবার ঘরের চারিদিকে তাকায়। বেশ প্রশস্ত ঘরটা। ঘরের মধ্যে যাতায়াত করবার মাত্র একটিই দরজা। বারান্দার দিকে দুটো জানালা, তাতে কাঁচের শার্সি আটা।
রাস্তার দিকে গোটা-তিনেক জানালা, তারও দুটো বন্ধ, একটা ভোলা। জানালাগুলোর কোনটাতেই গরাদ নেই। দামী নেটের পর্দা টাঙানো।
গলির দিকে কোন জানালা নেই। শুধু ওপরে দেওয়ালে দুটো স্কাইলাইট। একটায় কাঁচ আটকানো, অন্যটায় কোন কাচই নেই।
কিরীটী এগিয়ে এসে টেবিলটার সামনে দাঁড়াল।
সেই খামটা কই? মিঃ রামিয়া, ফোনে যে খামের কথা বলেছিলেন? ইন্সপেক্টর খামখানা এগিয়ে দিলেন। পার্চমেন্ট-পেপারে তৈরী একখানি চৌকো খাম। সাদা রংয়ের অতি সাধারণ দেখতে। খামটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে কিরীটী বলল, কোন কিছুই তো আঁকা দেখছি নে।
ইনসপেক্টর অল্প একটু হেসে খামের ভাঁজে ভাঁজে খুলে ফেললেন।
খামের ভিতরে একটা অতি বীভৎস ড্রাগনের প্রতিচ্ছবি আঁকা। ড্রাগনের রং কালো, মুখখানা রক্তবর্ণের।
ঘরে ঢোকার পর থেকেই একটা সূক্ষ্ম অস্পষ্ট গন্ধ যেন কিরীটীর নাকে এসে লাগছিল। গন্ধটা যে ঠিক কি ধরণের বলা শক্ত। খুব কটু নয়, অথচ সমস্ত গা-টা ঘিনঘিন করে।
খামটার ভাঁজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধটা যেন আরো স্পষ্ট ও তীব্র হয়ে নাকে এসে লাগল কিরীটীর।
কিরীটী খামটা নাকের কাছে তুলে ধরে শুকলো। রাজু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে জিজ্ঞাসা করল, কি?
শুঁকে দেখ। কিরীটী বলল।
রাজু খামটা শুঁকতে শুঁকতে বললে, কিসের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছি।
খামটা নিতে পারি ইনসপেক্টর? কিরীটী বললে।
স্বচ্ছন্দে। ও খাম কিন্তু মৃত্যুর দূত। রামিয়া হাসতে লাগলেন।
কিরীটী মৃদু হেসে খামখানা পকেটের মধ্যে রেখে দিল। তারপর সমস্ত ঘরটা ঘুরে ঘুরে আবার দেখতে লাগল।
হঠাৎ ওপাশের দেয়ালে একটা সুতোর মত কি কিরীটীর চোখে পড়ল। এগিয়ে এসে হাত দিয়েই কিরীটী বুঝল, অতি সূক্ষ্ম কিন্তু বেশ শক্ত একটা রেশমী সুতো। সূতোটা টান দিয়ে দেখল, সেটা স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে গলে এসেছে এবং সুতোটা টেনে বুঝতে পারল, সেটার অপর প্রান্ত কোথাও আটকানো। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মনে হল সেই চিদাম্বরমের কেসটা।
চলুন ইনসপেক্টর।
কিরীটী ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গেল।
বারান্দার শেষপ্রান্তে এসে নীচের গলিপথ বেশ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে।
সুন্দর দাসের প্রাইভেট সেক্রেটারী একজন বাঙালী অল্পবয়সী ছোকরা। নাম-মহিম রায়।
কিরীটী মহিম রায়কে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা মহিমবাবু, গলির ওপারের বাড়িটা কার?
ওটা একজন পাঞ্জাবী ডাক্তারের, মাসখানেক হল উনি সপরিবারে দেশে ভাটিণ্ডায় গেছেন। বাড়িটা বর্তমানে তালা-বন্ধই আছে।
বাড়িতে কেউ থাকে না তাহলে?
বাইরে শুধু দারোয়ান থাকে।
গলির মধ্যে যেতে হলে বড় রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হবে, না?
হ্যাঁ। মহিম বললেন।
চলুন না, একবার গলিটা ঘুরে আসি।
চলুন।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কিরীটী জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা মহিমবাবু, সন্ধ্যার পর ঠিক কটা হবে যখন আপনি মিঃ দাসের ঘরে যান?
সাড়ে সাতটা কি পৌনে-আটটা হবে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে ভেজানো ছিল, অল্প একটু ঠেলতেই খুলে গেল। অন্ধকার ঘর। একটু অবাক হলাম। কেননা আমি জানতাম মিঃ দাস ঘরেই আছেন। আমায় তিনি পৌনে আটটার সময় ঘরে গিয়ে ব্যবসা-সংক্রান্ত কয়েকটা আবশ্যকীয় কাগজপত্র চেয়ে নিয়ে আসতে বলেছিলেন; আজ রাত্রে একটা পার্টির সঙ্গে জরুরী কনসালটেশন ছিল, কাগজপত্রগুলো সেই সংক্রান্তই। ঘর অন্ধকার দেখে ভেবেছিলাম প্রথমে, মিঃ দাস হয়ত ঘরে নেই—কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল মিঃ দাস তো কখনও দরজায় চাবি না দিয়ে অফিস-ঘর ছেড়ে যেতেন না। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো। জ্বাললাম। দেখি ঘরের মধ্যে মিঃ দাস উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।
শেষ আপনার কখন মিঃ দাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
বিকেলে তিনটে সাড়ে-তিনটের সময়।
তখন তিনি কোথায় ছিলেন?
তার অফিস-রুমে।
তারপর?
আমি প্রথমটা যেন থমকে গেলাম। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ঠেলা দিয়ে ডাকলাম, স্যার! স্যার! … কিন্তু কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। চিৎকার করে চাকরবাকরদের ডাকলাম। পুলিসেও খবর দেওয়া হল।
আপনি তো সারাটা দুপুর আপনার ঘরেই ছিলেন?
যা, অফিস-রুমের পাশেই আমার বসবার ঘর।
আচ্ছা কোনরকম শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন? কিংবা তিনটে থেকে সাতটার মধ্যে কেউ মিঃ দাসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, বলতে পারেন?
আমি ঠিক পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটার সময় মিনিট পনেরোর জন্য নীচে টিফিন খেতে গিয়েছিলাম, সেই সময় যদি কেউ এসে থাকে তো বলতে পারি না। মিঃ দাসের বেয়ারা সুখলাল বলতে পারে।
কিরীটী লক্ষ্য করে দেখল, গলিতে গ্যাসলাইট থাকলেও বেশ অন্ধকার, আর মিঃ দাসের অফিস-ঘরের পিছনের এ-পাশের বাড়ির একটা ভোলা ছাদ আছে। ছাদের প্রাচীরের ওপর একসার ফুলের ও পাতাবাহারের টব। অন্ধকারে গাছের পাতাগুলো অল্প অল্প হাওয়ায় থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।
রাজুকে ছাদের দিকে নজর রাখতে বলে কিরীটী মহিমবাবুকে নিয়ে ঘুরে ও-বাড়ির গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
রাজু অন্ধকার ছাদটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সহসা কার চাপা কণ্ঠস্বরে চমকে পাশে তাকাল।
বাবু?
বছর বারো-তেরোর একটি ছোকরা। দেখলে ভিখিরী বলেই বোধ হয়।
বাবু?
কি রে?
বাবু, এই চিঠিটা আপনাকে দেবার জন্য একজন বাবু দিয়ে গেলেন।
আমাকে? রাজু বিস্মিত হয়ে শুধাল।
হ্যাঁ, বাবু।
রাজু একটু যেন অবাক হয়েই ছেলেটার হাত থেকে চিঠিটা নিল। ছেলেটা চিঠিটা দিয়েই দ্রুতপদে ওদিককার আঁধার গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দূরের গ্যাসপোস্ট থেকে একটুখানি আলো অস্পষ্ট ভাবে এদিকে এসে পড়েছে। সেই স্বল্পালোকে রাজু খামখানা চোখের সামনে তুলে ধরল।
ঠিক সেই সময় পিছন থেকে একটা অস্পষ্ট চাপা হাসির শব্দে রাজু চমকে পিছন ফিরে তাকাল।