অতঃপর জয়ন্ত চৌধুরী তার জোঠতুতো ভাই-বোনদের একটা মোটামুটি পরিচয় দিল।
বড় জগদীন্দ্র, বয়স ত্রিশ-একত্ৰিশ হোর—চিরদিনই রুগ্ন—ক্রনিক হ্যাঁপানীর রোগ। ম্যাট্রিক পরীক্ষা বার দুই দিয়েছিল, পাস করতে পারেনি।
বাড়িতে সৰ্ব্বক্ষণ বসে থাকে—এবং বসে বসে পেসেন্স থেলে তাস নিয়ে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে একটু বিলাসী ও লোভী।
দ্বিতীয় মণীন্দ্ৰ চৌধুরী-বড় ভায়ের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট হবে। জগদীন্দ্ৰ তবু ম্যাট্রিক পরীক্ষণ দিয়েছিল, সে তাও দেয়নি। খেলাধূলায় খুব নেশা। ওই অঞ্চলের একজন নামকরা ফুটবল প্লেয়ার। সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলে। স্বাস্থ্য ভাল এবং সৌখিন প্রকৃতিরবেশভূষা ও সাজসজ্জার দিকে বিশেষ নজর।
তৃতীয় ফণীন্দ্ৰ—ডান পা-টা খোঁড়া। চলার সময় পা-টা একটু টেনে টেনে চলে। ফণীন্দ্রর নেশা গান-বাজনায়। ভাল তবলা বাজায়। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য মোটামুটি—এবং সেও তার দাদার মতই ভোজনবিলাসী।
চতুর্থ শচীন্দ্ৰ—ভাইদের মধ্যে সেই দেখতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর। ভাইদের মধ্যে ও-ই ম্যাট্রিকটা পাস করেছে। কবিতা লেখা ও রহস্য-রোমাঞ্চের বই পড়া তার একটা নেশা।
স্বাতী-বোন; স্থানীয় কলেজ থেকে বি. এ. পাস করেছে—গত বছর। এম. এ. পড়ার ইচ্ছা। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, না-যথেষ্ট হয়েছে।
চিত্রাঙ্গদা দেবী তার বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান করছিলেন, এমন সময় হঠাৎ প্রকাশ পেলো চিত্রাঙ্গদা দেবীর ধানবাদ অফিসের যে তরুণ অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজারটি বছর দুই হল তার ধানবাদ অফিসে যোগ দিয়েছে।–অনিন্দ্য চক্রবর্তী—তাকেই নাকি স্বাতী বিয়ে করতে চায়।
অনিন্দ্যও সেকথা চিত্রাঙ্গদা দেবীকে জানিয়েছিল।
কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবী রাজী হননি; শোনামাত্রই কথাটা নাকচ করে দিয়েছেন। বলেছেন, অসম্ভব-হতে পারে না।
তবু স্বাতী জিজ্ঞাসা করেছিল তার বড়মাকে, (চিত্রাঙ্গদা দেবীকে সকলে ‘বড়মা’ বলে ডাকে বরাবর) কেন, অসম্ভব কেন?
‘কেন’র জবাব তোমাকে আমি দেবো না। অসম্ভব—এইটাই শুধু মনে রেখো।
তবু তর্ক তুলেছিল স্বাতী। বলেছিল, অনিন্দ্য তোমার আফিসে চাকরি করে বলেই কি এ বিয়ে হতে পারে না?
তর্ক করো না স্বাতী। চিত্রাঙ্গদা দেবী বলেছিলেন।
ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে সেটা তোমার ভুয়ো অর্থহীন ভ্যানিটিতে লাগবে, তাই কি—
চুপ কর, ডেপোমি করো না-দুটো পাস করে ভাব যেন কি একটা হয়ে গিয়েছ, তাই না?
ডেঁপোমি আমি করছি না—বরং তুমিই অন্যায়। জুলুম করবার চেষ্টা করছ।
স্বাতী?
তোমার ঐ চোখরাঙানোকে আর যে ভয় করুক আমি করি না তুমি জান—
অকৃতজ্ঞ।
কেন আশ্রয় দিয়ে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছ বলে? কিন্তু ভুলে যেও না পায়ে ধরে আশ্রয় দিতে আমরা তোমাকে সাধিনি—তুমিই—
হ্যাঁ, অন্যায় হয়েছে আমার। পথে ভেসে বেড়ানোই তোমাদের উচিত ছিল।
সেটা হয়ত সুখেরই হত।
ক্ৰোধে যেন অতঃপর একেবারে ফেটে পড়েছিলেন চিত্রাঙ্গদা দেবী। বলেছিলেন যেমন অপদাৰ্থ আমানুষ ছিল বাপ তেমনিই হবে তো তোমরা—একপাল ভেড়া জন্ম দিয়ে গিয়েছে–
হ্যাঁ, বাপ আমাদের অপদাৰ্থ অমানুষ তো হবে—কারণ তুমি যে তার সন্তানদের প্রতি কৃপা দেখিয়ে আশ্রয় দিয়ে বাহাদুরী কুড়োবার সুযোগ পেয়েছ!
স্বাতী, তুমি স্পর্ধার সীমা লঙঘন করছ। চাপা কণ্ঠে তর্জন করে উঠেছিলেন চিত্রাঙ্গদা দেবী অতঃপর।
ভাগ্যে মণীন্দ্র ওই সময় সামনে এসে পড়েছিল, সে কোনমতে বোনকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কিরীটী প্রশ্ন করে, আপনি কার কাছে শুনলেন এসব কথা? আপনি তো সেখানে থাকেন না?
না, স্বতীই আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল সব কথা।
তারপর কি হল?
কি আর হবে, ব্যাপারটা ওইখানেই চাপা পড়ে গেল। জয়ন্ত চৌধুরী বললে।
আর ওই অনিন্দ্য চক্রবর্তী—তার কি হল?
সে এখনো চাকরি করছে।
তা আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন মিস্টার চৌধুরী এবার বলুন তো?
কেন, আপনি চিঠিটা পড়েছেন তো। বড়মার ধারণা হয়েছে এই মাসের পনেরো তারিখে তার জন্মদিন-এবং তার কোষ্ঠীতেও আছে নাকি এই সময়টা তাঁর অপঘাতে মৃত্যুযোগ; কাজেই তিনি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।
কোষ্ঠীতে মৃত্যুযোগ আছে বলে?
হ্যাঁ, তার কোষ্ঠীতে যা যা ছিল, সব ফলে গিয়েছে আজ পর্যন্ত একেবারে ঠিক ঠিক। তাই
কিন্তু এক্ষেত্রে আমি তাকে কি সাহায্য করতে পারি?
দেখুন কথাটা তাহলে আপনাকে আমি আরো একটু স্পষ্ট করে বলি—জেঠিমার ঐ চিঠিটা পাবার পর থেকেই আমারও মনে হচ্ছে সত্যিই হয়ত জেঠিমকে ঘিরে একটা ষড়যন্ত্র ঘন হয়ে উঠছে—
ষড়যন্ত্র!
হ্যাঁ। আর তাই আমি আপনার কথা জেঠিমাকে ফোনে জানিয়েছিলাম—বলেছিলাম আপনার সাহায্য নিলে হয়ত সব ষড়যন্ত্র ফাস হয়ে যেতে পারে।–
কিন্তু–
মিঃ রায়, তাই জেঠিমা ও আমার দুজনেরই ইচ্ছে বিশেষ করে ঐ সময়টা সেখানেই আপনি উপস্থিত থাকুন—আপনি অমত করবেন না।
কিরীটী অতঃপর কি যেন ভাবে কয়েক মূহুর্ত, তারপর বলে, আপনার কথা হয়ত মিথ্যে নয়। কিন্তু সেখানে আমি কি ভাবে যেতে পারি?
সেটা আপনিই ভেবে বলুন।–
আচ্ছা জয়ন্তবাবু, কোষ্ঠীর ব্যাপারে বুঝি চিত্রাঙ্গদা দেবীর খুব বিশ্বাস? কিরীটী মৃদু হেসে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
কিন্তু মিস্টার চৌধুরী, সত্যিই যদি তাঁর এই সময় অপঘাতে মৃত্যুযোগ থাকে, কারো সাধ্য আছে কি তাকে রক্ষণ করার?
সে কি আর আমি বুঝি না! তাছাড়া তারও ধারণা–
কি?
তাঁর মৃত্যু যদি ঘটেই তো ওরাই তাঁকে হত্যা করবে। তাই আরো বেশি করে ওদের গতিবিধির ওপর সর্বক্ষণ প্রখর দৃষ্টি রাখবার জন্যই একজনের সাহায্য আমরা চাই।
কিরীটী আবারও হাসল। তারপর বলল, ঠিক আছে মিস্টার চৌধুরী, আমি যাব। অন্য কোন কারণ নয়—ব্যাপারটা সত্যিই বিচিত্র, তাই যাব। কিন্তু আপনার কি ধারণা বলুন তো?
আমার?
হ্যাঁ।
খুব একটা অসম্ভব নয় কিছু।
কি?
বড়মাকে ওদের কারো পক্ষে হত্যা করা।
কিন্তু কেন বলুন তো?
একটা কথা আপনোক বলা হয়নি মিস্টার রায়–
কি বলুন তো? আমার যে পাঁচজন জোঠতুতো ভাইবোনের কথা একটু আগে আপনাকে বললাম তাদের অবস্থাও আজ কোণঠাসা জন্তুর মত।
কি রকম?
বড়মাকে আপনি দেখেননি—কিন্তু দেখলে বুঝবেন স্ত্রীলোক হলেও তার অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব আছে। এবং আছে প্রত্যেকের উপরে প্রভুত্ব করবার একটা অদ্ভুত লিন্সা।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তাঁর ধারণা চিরদিন, ধারণাই বা বলি কেন মনে হয় স্থির বিশ্বাস যে তার মত সুন্দরী নেই-তাঁর মত বুদ্ধিমতী নেই-তিনি যা করবেন বা করেন, সেটাই ঠিক। তিনি যা বোঝেন, সেটাই শেষ বোঝা। সবাইকে তারই নির্দেশ মেনে চলতে হবে। বলতে পারেন। তীরে এটাই বিচিত্র একটা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স—তাঁর যে গুণ নেই তা নয়—বরং অনেক গুণাই আছে—তাছাড়া মনে স্নেহ-মমতাও আছে। তবু ঐ কমপ্লেক্সটুকুই তাঁর যা কিছু রাহুর মত গ্রাস করেছে—শোনা যায়, ওই কারণেই জেঠামশাইয়ের সঙ্গেও কোন দিন যাকে বলে সত্যিকারের মিল তো হয়নি—দুজনের মধ্যে কোন দিন সত্যিকারের একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি।
Interesting! তারপর?
কিরীটীর চুরুটাটা একসময় নিভে গিয়েছিল, পুনরায় সে তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিল।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে লাগল, এবং আমার কি মনে হয় জানেন মিস্টার রায়?
কি?
আমার ধারণা আমার মেজ জেঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে বড়মা তার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তার মধ্যেও বড়মার অসহায়দের জন্য মমতা বা দায়িত্ববোধের চাইতেও হয় বেশি ছিল কতকগুলো অসহায় ছেলেমেয়ের উপর তার সেই আধিপত্য বিস্তার বা dominate করবার লিন্সটাই। কিন্তু হাজার হলে ওরাও তো মানুষ-দুর্ভাগ্যের জন্যে ওদের বড়মার আশ্রয়ে যেতে হলেও দিনের পর দিন তাঁর ঐ নিষ্ঠুর বিলাস তাদের সহ্যশক্তির ওপর মর্মান্তিক ভাবে পীড়ন করেছে হয়ত এবং যার ফলে আজ তারা সত্যিই মরীয়া হয়ে উঠেছে; এবং সত্যিই হয়ত ওরা আজ বড়মাকে হত্যাও করতে পারে তাঁর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যেই। হয়ত আমারও অবস্থা ওদেরই মত হত। আমার বাবার মৃত্যুর পর ওঁর ইচ্ছাক্রমে ওঁর ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিলে, কিন্তু thank God—ভগবান আমায় বঁচিয়েছেন। মামারা আমাকে আশ্রয় দিয়ে মানুষ করে তোলেন।
কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না মিস্টার চৌধুরী, একদিন না হয় ওরা অসহায় ছিল। কিন্তু আজ তো ওদের বয়স হয়েছে, আজও তাহলে ওরাই বা কেন দিনের পর দিন ওইভাবে পীড়ন সহ্য করে ওখানে পড়ে আছেন?
সেটা তো খুবই স্বাভাবিক—জেঠিমার সম্পত্তির লোভে। শুনলেন তো সব কটাই অপদার্থ-নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবার মত কোন শক্তি নেই।
কিন্তু আপনাদের বড়মা যে ওদেরই তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে যাবেন, তারই বা স্থিরতা কোথায়? তিনি যেরকম বিচিত্র প্রকৃতির স্ত্রীলোক-হয়ত একটি কপর্দকও কাউকে দেবেন। না তাঁর বিপুল সম্পত্তির—
না, তিনি already উইল করে দিয়েছেন।
কি উইল করেছেন?
শুনেছি। ওদের প্রত্যেকের জন্যেই একটা মোটা মাসোহারা ও নগদ টাকার ব্যবস্থা করেছেন তার উইলো।
ওঁরা কি সেকথা জানেন?
নিশ্চয়ই জানে।
কিরীটী অতঃপর চুপ করে থাকে।
তারপর বলে, কিন্তু সত্যিই কি আপনি মনে করেন জয়ন্তবাবু—তারা তাদের আশ্রয়দাত্রী জেঠিমাকে শেষ পর্যন্ত মাত্র ঐ কারণেই হত্যা করতে পারেন!
অন্ততঃ আমি হলেও পারতাম মনে হয়—
ঠিক আছে। কবে সেখানে যেতে হবে বলুন?
আজ আপনি পারলে কাল নয়।
বেশ। আমি সামনের শনিবার যাব।
আমি এসে আপনাকে তাহলে নিয়ে যাব।
না, আমি একাই যাব। আপনি কেবল আপনার বড়মাকে গোপনে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখবেন।
গোপনে!
হ্যাঁ আমার সেখানে যাবার ব্যাপারটা যেন তারা কেউ না জানতে পারেন।
কিন্তু—
কি ভাবে, কি পরিচয়ে যাব বুধবার আপনাকে জানাব।
বেশ। জয়ন্ত চৌধুরী উঠল।