০১-০৫. আজকের দিনের আগরপাড়া স্টেশন নয়

অদৃশ্য শত্রু

০১.

আজকের দিনের আগরপাড়া স্টেশন নয় কিন্তু, ভুল করবেন তা হলে। বাইশ বছর আগেকার সেই ছোট আগরপাড়া স্টেশন। এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন চলেছে—সারাটা পৃথিবী জুড়ে।

পৌষের হাড়-কাঁপানো শীতের এক সকাল। সকালের আলো ফুটেছে বটে তবে কুয়াশার ঘন আবছায়ায় সব ঝাপসা-ঝাপসা।

স্টেশনের অল্প দূরেই স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টার।  

খান দুই ঘর। পাকা মেঝে। পাকা দেওয়াল, উপরের কিছু অংশ পাকা—কিছুটা অংশ রাণীগঞ্জের টালি ছাওয়া। সামনে ছোট একটু বাগানের মত-অজস্র বড় বড় গাঁদাফুল, যেন হলুদের একটা বন্যা।

পিছনেও সামান্য একটু খোলা জায়গা পাঁচিল ঘেরা। তার মধ্যে রান্নাঘর-স্নানঘর ইত্যাদি।

স্টেশন মাস্টার রসময় ঘোষাল ব্যাচিলর মানুষ—একাই কোয়ার্টারে থাকে। অনেক দিনের পুরানো চাকর নিতাই-সে-ই সব কাজকর্ম করে দেয় রসময়বাবুর। এক কথায় রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাজ সব কিছু—অর্থাৎ জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত।

রসময় মানুষটা শান্তশিষ্ট ও একটু আয়েসী। বদখেয়াল বা নেশা বলতে সত্যিকারের কিছুই নেই—তবে ভদ্রলোকের একটা নেশা আছে।

যত রাজ্যের গোয়েন্দা কাহিনী সংগ্রহ করে পড়া।

রসময় যে কেবল গোয়েন্দা কাহিনী পড়েই আনন্দ পান তাই নয়—তার একটা বিচিত্র বিলাস আছে-ঐ সব গোয়েন্দা কাহিনী গোগ্রাসে গেলেন আর নিজেকে ঐ সব গোয়েন্দার চরিত্রে খাড়া করে মনে মনে সব জটিল পরিস্থিতি কল্পনা করে এবং সেই সব পরিস্থিতির জট মনে মনেই খোলে। মনে মনে বিচিত্র সব রহস্য গড়ে তুলে সেই সব রহস্য একটু একটু করে ভেদ করে।

মধ্যে মধ্যে নিতাইকে বলে, বুঝলি নিতাই এই মাস্টারী করা আমার কর্ম নয়।

নিতাই বোকা সরল মানুষ। প্রশ্ন করে, কেন কত্তা?

কেন কি রে—তুই কি মনে করিস এই স্টেশনমাস্টারী করে সারাটা জীবন কাটাব?

কাটাবেন না!

না—আমি তলে তলে চেষ্টা করছি।

কি চেষ্টা করছেন কত্তা?

পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি যদি একটা পেয়ে যাই, বুঝলি না—ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের চাকরি। পেয়ে যেতাম চাকরি একটা, বুঝলি! কিন্তু ঐ বয়সটাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে–

বয়েসটা আবার বাধা কি কত্তা—

পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে যে—এ বয়েসে কি আর চাকরি জোটে!

রসময় ঘোষাল মানুষটি যেমন সাদাসিধে-চেহারাটাও তেমনি সাদাসিধে। গোলগাল নাদুস-নুদুস গড়ন-গোবর গণেশ প্যাটার্নের। মাথায় সামনের দিকে চুল পাতলা হয়ে গিয়ে টাক দেখা দিয়েছে। গোলালো মুখ।

ভোঁতা নাক। ছোট ছোট চোখ—সরল চাউনি।

একটা নতুন গোয়েন্দা কাহিনী হাতে পড়েছিল গত সন্ধ্যায়।

বইটা স্টেশনের পয়েন্টসম্যান রামধনিয়া এনে দিয়েছিল। ওয়েটিং রুমে টেবিলের উপর পড়েছিল। সে পেয়েছে। বোধ হয় কোন যাত্রী পড়তে পড়তে কখন ফেলে চলে গিয়েছে।

বইটার নামটি ভারি লোভনীয় মনে হয়েছিল রসময়ের বইটা হাতে পেয়েই।

বিষের কাঁটা। বেশ মোটা বইটা।

বইটা হাতে পেয়ে রসময়ের গতরাত্রে আর ঘুম হয়নি। আহারাদি কোনমতে শেষ করে বইটা হাতে লেপের তলায় গিয়ে ঢুকেছিল—একেবারে শেষ করে তবে নিশ্চিন্ত।

শেষ যখন হল রাতের অন্ধকার তখন ফিকে হয়ে গিয়েছে।

আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে নিতাইকে চা করতে আদেশ দেয় রসময়।

মুখ ধুয়ে চা পান করে সোজা চলে আসে স্টেশনে।

ভোর হয়েছে বটে তবে শীতের কুয়াশায় চারিদিক তখনও ঝাপসা-ঝাপসা।  

স্টেশনে ঘরে ঢুকতেই রসময়ের নজরে পড়ল ছোটবাবু অর্থাৎ জীবন সমাদ্দার গত দিনের টিকিটগুলো বান্ডিল করে বাঁধছে।

রসময়কে ঘরে ঢুকতে দেখে জীবনবাবু বলে, গুড মর্নিং স্যার—

গুড মর্নিং।

ঢাকা মেল আজ লেট স্যার।

কত?

তা ঘণ্টাখানেক তো হবেই।

টেলিগ্রাফের টক টক একঘেয়ে শব্দ শোনা যায়।

ফার্স্ট নৈহাটি লোকাল পাস করেনি?

হ্যাঁ—এই গেল ছেড়ে, মিনিট দশেক হবে।

টেলিফোনটা বেজে উঠল।

জীবনবাবু ফোনটা তুলে নিল।

আগরপাড়া স্টেশন—ঢাকা মেল ছেড়েছে–ঠিক আছে।

ফোনের রিসিভারটা ঝুলিয়ে রেখে জীবনবাবু চেঁচায়—ওরে ও শুকলাল—সিগন্যাল দে বাবা–ঢাকা মেল—

জীবনবাবু ঢাকা মেল পাস করার জন্য বের হয়ে গেল।

আবার টেলিফোন–

রসময় ফোনটা ধরে, হ্যালো—এস এম আগারপাড়া—কি বললেন, দমদমের আগে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে—ঢাকা মেল লাইন ক্লিয়ার পাবে না…হা-হা ঠিক আছে এখানেই দাঁড় করাচ্ছি।

রসময় ঘর থেকে বের হয়ে হাঁক দেয়, রামধনিয়া–ওরে রামধনিয়া, শুকলালকে। সিগন্যাল দিতে বারণ কর—

বিরাট লৌহদানব স্টেশনের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেল।

মেলের গার্ড নেমে এলেন।

কি ব্যাপার, সিগন্যাল দিলেন না কেন—একে তো এক ঘণ্টা প্রায় লেট—

দমদমের আগে একটা ছোট অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, রসময় বললে।

যত সব ঝামেলা—

গার্ড অদূরবর্তী টি-স্টলের দিকে এগিয়ে গেলেন।

রসময় ঘরে ঢুকতে যাবে—মেলের পরিচিত ড্রাইভার আব্দুল এসে সামনে দাঁড়াল।

আব্দুল মিঞা যে, কি খবর?

আব্দুল সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, করতা-ডিসট্যান্ট সিগল্যালের কাছে কি উগগা পড়ি আছে দেইলাম–

কি আবার পড়ে আছে? রসময় শুধায়।

মানুষ মত লরে—একবার চাই আস্তক—

কাটা পড়েছে নাকি?

আব্দুল বলে, সেই রকমই মনে হয় তার—কেউ কাটাই পড়েছেএকেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ ঐ সময় আবার ঘরের মধ্যে টেলিফোন বেজে ওঠে। রসময় তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ফোন ধরে।

সিগন্যাল দেয়ার নির্দেশ এসেছে। রসময় ফোনটা রেখে সিগন্যাল দেবার আদেশ দিয়ে দিল।  

সিগন্যাল পেয়ে ট্রেন ছাড়ল। এখন আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ট্রেন নেই। ট্রেন আসবে—রানাঘাট লোকাল সেই সাতটায়।

কিন্তু আব্দুল কি বলে গেল। কাল রাত্রে নিশ্চয়ই হয়তো কেউ কাটা পড়েছে— অ্যাক্সিডেন্ট—একবার দেখা দরকার।

রসময় ঘর থেকে বের হয়ে প্ল্যাটফরম ধরে ডিসট্যান্ট সিগন্যালের দিকে এগিয়ে চলল।

কুয়াশা কেটে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সূর্যের আলোয় চারিদিক পরিষ্কার।

লাইনের দুপাশে বুনো ঘাস ও ছোট ছোট আগাছাগুলোর উপরে শিশিরবিন্দুগুলো প্রথম সূর্যের আলোয় যেন মুক্তোর মত মনে হয়। টল টল করছে।

ঠিক ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে নয়—তার থেকেও প্রায় একশ গজ দূরে যেখানে রূপশ্রী কটন মিলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটা গুডস্ ট্রেনের লাইন চলে গিয়েছে সেই লাইন ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেলে ডাইনে যে ছোট কালভার্টটা-তারই ধারে কি যেন একটা পড়ে আছে রসময়ের নজরে পড়ে।

কালো মত কি যেন একটা মনে হয়।

রসময় সেই দিকে এগিয়ে যায় অতঃপর এবং বস্তুটার কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ায়-বাঁ দিক দিয়ে হাত দশেক ব্যবধানে মেন লাইন চলে গিয়েছে।

আব্দুল মিথ্যা বলেনি—সে ঠিকই দেখেছে। একটা মানুষের দেহই বটে—তবে তখন আর চিনবার উপায় নেই। মুখটা রক্তাক্ত। ক্ষত-বিক্ষত হাত দুটো ভেঙে দুমড়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।  

গায়ে একটা কালো গরমের গ্রেট কোট ছিল বোধ হয়—সেটা এখানে-ওখানে ছিঁড়ে গিয়েছে। সব কিছু জড়িয়ে একটা মাংসপিণ্ড বলেই মনে হয়। পায়ের জুতো দুটো বেশ দামী বলেই মনে হয়—পায়ে মোজাও আছে।

লোকটা যে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের নয় তা বোঝা যায়। কোন সম্রান্ত শ্রেণীরই লোক। প্রথমেই যেটা মনে হয় রসময়ের ঐ মুহূর্তে, লোকটা সুইসাইড করে নি তো!

কিন্তু সাইড লাইনে এসে সুইসাইড করবে?

ঐ লাইনে তো যখন-তখন ট্রেন চলে না।

মিলের মাল নিয়ে মধ্যে মধ্যে গুডস্ ট্রেন যাতায়াত করে।

.

কিন্তু সুইসাইড হোক বা অন্য কিছু যাই হোক এলাকাটা তারই স্টেশনের অন্তর্গত–অতএব অবিলম্বে তাকে একটা পুলিসে খবর দিতে হবে।

রসময়ের মনের মধ্যে তখন নানা চিন্তা মাকড়সার জাল বুনে চলেছে। রসময় অন্যমনস্ক ভাবে নানা কথা ভাবতে ভাবতে স্টেশনে ফিরে এল।

সাড়ে ছয়টা বাজে প্রায়।

থানা খুব বেশি দূর নয়। একটা নোট লিখে তাড়াতাড়ি রসময় স্টেশনের একজন পয়েন্টম্যানের হাতে থানার দারোগা জলধরবাবুর কাছে পাঠিয়ে দিল।

জলধরবাবু রসময়ের পরিচিত। অফ-ডিউটি থাকলে মধ্যে মধ্যে রসময় জলধরের ওখানে গিয়ে আড্ডা জমায়। চুরি, রাহাজানি, খুন-খারাপির গল্প শোনে বসে।

তবে আগরপাড়ার মত ছোট একটা জায়গায় কি-ই বা এমন চমকপ্রদ ঘটনা যখনতখন ঘটতে পারে।

.

০২.

রাণাঘাট লোকালটা পাস করবার পর জলধরবাবু এসে মাস্টারের ঘরে ঢুকলেন।

কি ব্যাপার ঘোষাল-কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটল?

থানার ও. সি. জলধর চাটুজ্যের বয়স হয়েছে—পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। ডিসপেপসিয়ার ক্রনিক রোগীরোগাটে পাকানো চেহারা। মাথার চুল প্রায় পেকে গিয়েছে। ওষ্ঠের উপরে একজোড়া কাঁচাপাকা ভারী গোঁফ।

জলধরের সঙ্গে একজন কনস্টেবলও ছিল, গিরিধারী।

এই যে চাটুয্যে সাহেব আসুন—আমার তো মনে হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্ট নয়।

তবে কি?

সুইসাইড।

আত্মহত্যা!

হুঁ–কিংবা এ কেস অফ মার্ডারও হতে পারে—রসময় আস্তে বলে।

সে কি মশাই-রেল লাইনের ধারে মার্ডার!

কেন তা কি কখনও হয়নি?

না, না—তা নয়-লোকটা ভদ্রলোক বলে মনে হল নাকি?

ভদ্রলোক তো বটেই, সম্ভ্রান্ত ঘরের বলে মনে হয়।

কোথায়?

চলুন না কালভার্টটার কাছে।

দুজনে এগিয়ে যায়।

রসময় যেন রীতিমত একটা রোমাঞ্চ বোধ করে। তার মনে হয় সে যেন আর স্টেশন মাস্টার রসময় ঘোষাল নয়—সি. আই. ডি.-র কোন একজন নামকরা অফিসার। একটা হত্যারই ইনভেস্টিগেশনে চলেছে।

ঘটনাস্থলে পৌঁছে রসময় আঙুল তুলে দেখাল, ঐ দেখুন!

মনে হল জলধর চাটুজ্যেও যেন থমকে দাঁড়ালেন সামনের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন সামনের দিকে, তারপর সামনে এগিয়ে গেলেন এক পা এক পা করে।

মৃতদেহটা লাইনের এক পাশে পড়ে আছে। একটা বীভৎস লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। লাইনের পাশে পাশে একটা মানুষের সরু পায়ে-চলার পথ। লাইনের উপরে বা পাশে ঠিক নয়, সেই সরু পায়ে-চলার পথের উপর পড়ে আছে দেহটা।

গিরিধারী ওদের পশ্চাতেই ছিল।

সে বলে ওঠে, হায় রাম!

কি চাটুজ্যে সাহেব—কি মনে হয়? ব্যাপারটা রীতিমত সাসপেন্স কিনা?

ঊঁ–

বলছিলাম মৃত্যুটা স্বাভাবিক, মানে একটা আচমকা অ্যাক্সিডেন্ট বলে মনে হয় কি?

উঁহু-মনে হচ্ছে না তা-মৃদুকণ্ঠে বলেন জলধর চাটুজ্যে।

সুইসাইডও হতে পারে। কিম্বা—

কি? জলধর তাকালেন রসময়ের মুখের দিকে।

মার্ডারও তো হতে পারে!

জলধর রসময়ের কোন কথার জবাব দিলেন না। আরও একটু এগিয়ে চললেন মৃতদেহটার কাছে।

গায়ের গরম গ্রেট কোটটা দামী ছিল বলে মনে হয়। কোটটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে যেন। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা।

মাথাটা ও মুখটা একেবারে থেতলে গেছে। মানুষটাকে চিনবার উপায় নেই। তবে দামী জামা ও পায়ের দামী জুতো দেখে মনে হয় কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই হবে। বাঁ হাতে একটা দামী রিস্টওয়াচও দেখা গেল। কাচটা ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে।

মৃতদেহটাকে চিৎ করে ফেললেন জলধর চাটুজ্যে।

জামার পকেটগুলো খুঁজে দেখতে গিয়ে ভিতরের বুকপকেটে একটা দামী পার্স পাওয়া গেল।

পার্সের গায়ে সোনার জলে ইংরাজীতে এমবস্ করা—এম. এন. রায়। ভিতরে প্রায় হাজারখানেক টাকার নোট—একশ টাকা ও দশ টাকার নোটও আছে দেখা গেল।

আর একটা কার্ডও পাওয়া গেল পার্সের মধ্যে। কার্ডে লেখা : এম. এন. রায়-রায় এন্ড কোং, ৯৩ ক্লাইভ রো, থার্ড ফ্লোর।

জলধর চাটুজ্যের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

যাক, তাহলে মৃত ব্যক্তির কিছুটা পরিচয় বা হদিস পাওয়া গেল, কি বলেন?

হুঁ। মৃদুকণ্ঠে জলধর চাটুজ্যে বলেন।

এবং শুধু তাই নয়-মৃত ব্যক্তি যে ধনী, অবস্থাপন্ন তাও জানা গেল তার পার্স থেকে। রসময় বলে।

গিরিধারীকে মৃতদেহের প্রহরায় রেখে জলধর চাটুজ্যে ফিরে এলেন। রসময়ও সঙ্গে সঙ্গে চলল।

কি মনে হচ্ছে চাটুজ্যে সাহেব? রসময় প্রশ্ন করে পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে, সুইসাইড, না মার্ডার?

বলা শক্ত।

তা ঠিক।

স্টেশনে পৌঁছে রসময়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জলধর থানার দিকে হাঁটতে শুরু করেন।

দেখে-শুনে ব্যাপারটা মনে হচ্ছে সুইসাইড কেসই একটা। এবং লোকটা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের নয়। পায়ের জুতো, মোজা ও পরিহিত সুটটা দেখে মনে হয় অবস্থাপন্ন ঘরেরই মানুষ।

অতএব অবিলম্বে লালবাজারে একটা সংবাদ দিতে হবে। মৃতদেহেরও একটা ব্যবস্থা। করতে হবে। তার মানেই নানা ঝামেলা।

থানায় ফিরে লালবাজারে ফোন করতেই স্বয়ং ডেপুটি কমিশনারই ফোন ধরলেন।

অবিনাশ চক্রবর্তী-চক্রবর্তী সব শুনে বললেন, আমি ইন্সপেক্টার মৃণাল সেনকে পাঠাচ্ছি।

অবিনাশ ফোন রেখে তখুনি মৃণাল সেনকে ডেকে পাঠালেন।

একটু পরে মৃণাল এসে ঘরে ঢুকল। অল্প বয়েস। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। পরিশ্রমী ও উৎসাহী।

আমাকে ডেকেছেন স্যার?

হ্যাঁ–তোমাকে এখুনি একবার আগরপাড়া যেতে হবে—সেখানকার থানার ও. সি. জলধর চাটুজ্যে একটু আগে ফোন করেছিল, একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। জলধরবাবুর ধারণা, ব্যাপারটা পিছনে কোন ফাউল প্লে আছে!

আমি এখুনি যাচ্ছি স্যার।

মৃণাল সেন স্যালুট দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

মৃণাল সেন আগরপাড়ায় যখন এসে পৌঁছল বেলা তখন প্রায় সোয়া নয়টা।

জলধরবাবুর মুখ থেকে মৃণাল সমস্ত ব্যাপারটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সর্বপ্রথম জেনে নিল। তারপর সে জলধরবাবুকে নিয়ে অকুস্থানে গেল।

ইতিমধ্যে সংবাদটা আশেপাশে ছড়িয়ে গিয়েছিল।

অনেকেই এসে ভিড় করেছিল আশেপাশে। কিন্তু গিরিধারীর জন্য কিছুটা দূরত্ব রেখে তারা জটলা পাকাচ্ছিল।

জলধরবাবু সকলকে তাড়া দিলেন।

তাড়া খেয়ে সবাই পিছিয়ে গেল বটে কিন্তু স্থানত্যাগ করল না।

মৃণাল সেন মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখল।

মৃতদেহ ও তার পরিধেয় বস্ত্র দেখে মনে হয় মৃত ব্যক্তি হয়ত চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে লাইনের উপরেই এসে পড়ে, তার পর ইঞ্জিনের সামনে লোহার জালে আটকা পড়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। এবং শেষটায় হয়ত ধাক্কা খেয়ে পাশে ছিটকে পড়েছে।

কিম্বা হয়ত রেল লাইনের উপরেই সে শুয়েছিল আত্মহত্যা করবার জন্য—শেষটায় ঐ অবস্থা হয়েছে।

আত্মহত্যা করে থাকলে কোন প্রশ্ন নেই। এবং অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে থাকলেও লোকটা হয়ত চিৎকার করেছিল, সে চিৎকার হয়ত কেউ শুনতে পায়নি, এমন কি ইঞ্জিনড্রাইভারও শুনতে পায় নি। তা ছাড়া এ লাইন দিয়ে তো সাধারণত ট্রেন চলাচলও বড় একটা করে না।

কিম্বা হয়ত আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা কোনটাই নয়।কারণ ঠিক ঐখানে ঐভাবে এসে আত্মহত্যা করা বা দুর্ঘটনা ঘটা কোনটাই সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে না।

হয়ত ব্যাপারটা একটা মার্ডার কেস।

চলুন ফেরা যাক মিঃ চ্যাটার্জী-মৃণাল সেন বলে, মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আর একটা খোঁজ নেবেন তো

কি বলুন তো!

রূপশ্রী কটন মিলে খোঁজ নেবেন, গতকাল কোন ওয়াগন লোডিং হয়েছে কিনা–

নেবো।

হ্যাঁ—আরও একটা খোঁজ নেবেন।

কি?

এ তল্লাটে এম. এন. রায় বলে কেউ আছেন কিনা—যদি থাকেন তার যথাসম্ভব পরিচয়।

বেশ।

পার্সটা যেটা মৃত ব্যক্তির জামার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল সেটা নিয়ে মৃণাল ফিরে এল।

.

পরের দিন—যেটুকু সূত্র হাতের মধ্যে আপাতত পাওয়া গিয়েছিল তার সাহায্যেই মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করে মৃণাল সেন।

ক্লাইভ রো—বেশি দূর নয়, লালবাজারের কাছেই।

প্রথমেই মৃণাল ক্লাইভ রোতে রায় এন্ড কোম্পানির অফিসে গিয়ে হাজির হল! একটা বিরাট পাঁচতলা বিল্ডিং ৯৩ নং ক্লাইভ রোতে।

তিনতলায় রায় এন্ড কোম্পানির অফিস।

বিরাট অফিস-দেখেই বোঝা যায়—বিরাট বিজনেস।

 আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিল মৃণাল সেন-প্রধানত কয়লার খনি, ঐ সঙ্গে নানাজাতীয় কেমিকেলস-এরও ব্যবসা করে রায় এন্ড কোম্পানি।

এনকোয়ারিতে গিয়ে সন্ধান নিয়ে মৃণাল ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করার জন্য স্লিপ দিল বিশেষ জরুরী বলে।

.

০৩.

একটু পরেই অফিস ম্যানেজার মিঃ মুখার্জীর ঘর থেকে মৃণালের ডাক এল।

মৃণাল বেয়ারার সঙ্গে গিয়ে ম্যানেজারের অফিসে প্রবেশ করল।  

দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। মোটাসোটা বেশ ভারিক্কী চেহারা। পরিধানে সাহেবী পোশাক-মুখে পাইপ। চোখে সুদৃশ্য ফ্রেমের চশমা।

বি সিটেড প্লিজ!!

মিঃ মুখার্জী কি একটা ফাইল দেখছিলেন—চোখ তুললেন না—মৃদুকণ্ঠে মৃণালকে বসতে বললেন।

মৃণাল বসল।

ফাইলটা দেখা হল একটু পরে-সেটা একপাশে ঠেলে রেখে মুখ তুলে তাকালেন মিঃ মুখার্জী।

ইয়েস মিঃ সেন, হোয়াট ক্যান ড়ু ফর ইউ।

আমি লালবাজার থেকে আসছি। কথাটা বলে মৃণাল তার পরিচয় দিল।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মুখাজীর দুটো কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। কয়েকটা মুহূর্ত মৃণালের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলেন, লালবাজার থেকে আসছেন—কি ব্যাপার বলুন তো?

মিঃ এম. এন. রায়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।

আমাদের ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের সঙ্গে?

তিনিই কি ম্যানেজিং ডাইরেক্টার?

হ্যাঁ,–কিন্তু তিনি তো আজ এখনও আফিসে আসেন নি!

আসেন নি?

না।

ও, তা সাধারণত কখন অফিসে আসেন তিনি?

ঠিক দশটায় আসেন—অত্যন্ত পাংচুয়াল তিনি—অথচ আজ এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল—এলেন না। তাই ভাবছিলাম

অসুখ-বিসুখ করেনি তো!

না, না, মশাই-ভদ্রলোকের যদিও ষাট বছর বয়স হল—কখনও আজ পর্যন্ত একটা দিনের জন্যও তাকে অসুস্থ হতে দেখিনি। তবে আগরপাড়ায় তার বন্ধুর ওখানে গিয়ে যদি আটকে পড়ে থাকেন কোন কারণে

আগরপাড়ায়—তিনি আগরপাড়ায় কাল গিয়েছেন নাকি? মৃণাল প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ।

কোন ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপার কি?

না-না, তার এক বন্ধু আগরপাড়ায় থাকে। তার এক জরুরী চিঠি পেয়ে—

জরুরী চিঠি?

হ্যাঁ—এক ভদ্রলোক গতকাল বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ চিঠিটা নিয়ে আসে—সেই চিঠি পড়ার পরই তিনি আমাকে বলেন—তিনি অফিসের পর আগরপাড়া যাবেন।

চিঠিটায় কি ছিল কিছু আপনি জানেন?

চিঠিটা তিনি সঙ্গে নিয়ে যাননি—সম্ভবত তার টেবিলের উপরেই এখনও পড়ে আছে।

কি করে আপনি সেকথা জানলেন?  

আমি সে সময় তার ঘরে তার পাশেই বসেছিলাম—চিঠিটা তিনি পড়া হলে টেবিলের উপরেই রেখে দিলেন দেখলাম—তারপর বের হয়ে গেলেন।

হুঁ-আচ্ছা দেখুন তো এই পার্সটা-বলতে বলতে মৃণাল সেন জলধর চাটুজ্যের কাছ থেকে পাওয়া পার্সটা পকেট থেকে বের করে মিঃ মুখার্জীকে দেখান।

একি, এ তো মিঃ রায়েরই পার্স! এটা আপনি পেলেন কোথায়?

আর ইউ সিয়োর—ঠিক জানেন?

ঠিক জানি মানে—এ পার্সটা তার ৫৯তম বার্থ-ডেতে আমিই তাকে প্রেজেন্ট করেছিলাম যে—কিন্তু এ পার্সটা আপনি কোথায় পেলেন?

মিঃ মুখার্জীর গলার স্বরে স্পষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ পায় যেন।

তাহলে আপনি নিঃসন্দেহ যে এ পার্সটা আপনাদের ম্যানেজিং মিঃ এম. এন. রায়েরই?

 হ্যাঁ—কিন্তু মিঃ সেন, আপনি তোকই বললেন না, মিঃ রায়ের এ পার্সটা আপনি কোথায় পেয়েছেন?

বলছি সব কিছুই, ব্যস্ত হবেন না মিঃ মুখার্জী-তার আগে একবার মিঃ রায়ের অফিসঘরটা আমি দেখতে চাই—আর সেই চিঠিটা যদি পাওয়া যায় একবার সেটাও দেখব।

চলুন।

মিঃ মুখার্জী উঠে দাঁড়ান।

পাশের ঘরটাই ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের বসবার ঘর।

বেয়ারা দরজার গোড়ায় টুলের উপরে বসেছিল।

মিঃ মুখার্জীকে দেখে তাড়াতাড়ি সেলাম দিয়ে বলে, বড়া সাক্ তো আভি আয়া নেই সাব!

ঠিক হ্যায়-মুঝে মালুম হ্যায়।

মিঃ মুখার্জী মৃণাল সেনকে নিয়ে ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

টেবিলের উপরেই চিঠিটা পাওয়া গেল। একটা পেপার-ওয়েট দিয়ে অন্যান্য চিঠিপত্রের সঙ্গে চাপা দেওয়া রয়েছে চিঠিটা।

তুলে নিল হাতে মৃণাল সেন চিঠিটা!

চিঠিটা ইংরাজীতে টাইপ করা। পুরু সাদা লেটার প্যাডের কোণে ইংরাজী এম অক্ষরটি মনোগ্রাম করা।

নিচে নাম সই করা, অ্যাফেকশনেটলি—ইওরস মণি।

চিঠিটার বাংলা তর্জমা করলে এই দাঁড়ায় :

৩০/৩/৪৩

প্রিয় মহেন,

অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না। ধন্যবাদ দিয়ে তোমায় ছোট করব না। তবে তোমার সৌজন্যে বর্তমানে আমার আরামেই কাটছে এখানে। সামনের শনিবার যদি একবার আসো তাহলে ভাল হয়—এবং আসবার সময় তোমার সেই চিঠিটা যদি আনো তাহলে আমরা ব্যাপারটা একটু আলোচনা করতে পারি, কারণ আমি গত পরশু ব্যাঙ্ক থেকে আমার চিঠিটা আনিয়েছি।

যদিও আগে তুমি কখনও এখানে আসনি, তাহলেও এখানে আসতে তোমার কোন কষ্ট হবে না। ইচ্ছা করলে গাড়িতেও আসতে পার বা ট্রেনেও আসতে পার—তবে রাতটা কিন্তু ছাড়ছি না। গাড়িতে যদি আসো, তাহলে স্টেশন থেকে উত্তর-মুখো যে পথটা গেছে সেই পথ ধর এগিয়ে এলেই দেশবন্ধু কলোনিতে এসে পৌঁছতে পারবে। আর ট্রেনে যদি আসো তো–একটা রিকশা নিয়ে ঐ পথটা দিয়ে আসতে পার।

স্টেশন থেকে দেশবন্ধু কলোনি প্রায় মাইলখানেক হবে। পথটা ধরে সোজা এগিয়ে এলে একটা রেস্তোরাঁ দেখবে-নামটা তার বিচিত্ৰ-পান্থনিবাস—সেখানে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেও আমার সলিটারি কর্নার তারা দেখিয়ে দেবে।

ভালবাসা নিয়ো—আসবে কিন্তু—আসা চাই-ই। আমি অপেক্ষা করব।

তোমার স্নেহধন্য-মণি।

মৃণাল সেন চিঠিটাই বার-দুই পড়ে ভাঁজ করে নিজের পকেটেই রেখে দিল, চিঠিটা আমি রাখলাম মিঃ মুখার্জী!

বেশ।

মিঃ মুখার্জী-মিঃ রায় গত পরশু নিশ্চয় তার গাড়ি নিয়েই গিয়েছেন?

না।

গাড়ি নিয়ে যাননি?

না–ট্রেনেই গিয়েছিলেন। কেন—ট্রেন কেন?

তার ড্রাইভার রামরূপবয়েস অনেক হয়েছে, রাতে ভাল করে চোখে দেখতে পায় না—তাই তিনি রাত্রে কখনও ওকে নিয়ে বেরুতেন না। কোথায়ও যেতে হলে ট্যাকশিতেই যেতেন।

আশ্চর্য তো।

তাই। লোকটা বুড়ো হয়ে গিয়েছে। ভাল করে চোখে দেখে না। তবু তাকে ছাড়াবেন। আমরা কতবার বলেছি একটা ভাল দেখে ড্রাইবার রাখুন। কিন্তু তিনি কারও কথাই শোনেন নি। বলেন, ও এতকাল আমার কাছে কাজ করল –এখনও চমৎকার গাড়ি চালায়—কেবল রাত্রে একটু কম দেখে—সেই অজুহাতে ওকে আমি তাড়িয়ে দিতে পারি না এই বয়সে। সেটা অন্যায় হবে। তাছাড়া আমি তো রাত্রে বড় একটা বেরই হই না। 

লোকটাকে খুব স্নেহ করেন মিঃ রায় মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ—রামরূপেরও স্যারের উপরে অগাধ ভালবাসা ও ভক্তি। তাছাড়া লোকটার আরও একটা গুণ হচ্ছে, অত্যন্ত বিশ্বাসী। অমন বিশ্বাসী লোক আজকাল বড় একটা চোখে পড়ে না।

হুঁ-তাহলে তিনি ট্রেনেই গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আর একটা কথা—মিঃ গাঙ্গুলী ওঁর বিশেষ বন্ধু বলেই মনে হয়—

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। তিন বন্ধু ছিলেন। এক বন্ধু গত হয়েছেন। এখন দুই বন্ধু আছেন। মিঃ রায় আর আগরপাড়ার ঐ মিঃ গাঙ্গুলী।

অনেক দিনের বন্ধুত্ব বুঝি ওঁদের?

হ্যাঁ–মিঃ রায়ের মুখে শুনেছি ছোটবেলা থেকেই বন্ধু ছিলেন ওঁরা। মহেন্দ্রনাথ রায়, মণীন্দ্র গাঙ্গুলী আর ডাঃ নলিনী চৌধুরী।

নলিনী চৌধুরী নেই?

না।

আচ্ছা মিঃ মুখার্জী-মিঃ গাঙ্গুলী যে চিঠির মধ্যে লিখেছেন কি একটা চিঠির কথা–তিনি ব্যাংক থেকে নিয়ে এসেছেন, সে সম্পর্কে কিছু জানেন?

জানি, সে এক মজার ব্যাপার।

কি রকম?

তাহলে আপনাকে ঐ চিঠির ব্যাপারটা মোটামুটি বলতে হয়। ঐ তিন বন্ধুর মধ্যে মিঃ রায়ের অবস্থাই সব চাইতে ভাল তার ব্যবসার দৌলতে।

এ ব্যবসা কি তারই হাতের?

না।

তবে?

তার বাপেরই তৈরি, বিরাট লাভবান ব্যবসা। অবশ্য তার পরিশ্রমও এতে কম নেই।

মিঃ মুখার্জী বলতে লাগলেন—মণীন্দ্র গাঙ্গুলী সিঙ্গাপুরে ভাল চাকরি করতেন। যুদ্ধ বাধার পর বোমা পড়তে শুরু হলে সেখান থেকে কোনমতে নিঃস্ব কপর্দকহীন অবস্থায় প্রাণটা মাত্র হাতে করে মালয় ও বর্মা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেশে ফিরে আসেন। এসে কিছুদিন আমাদের স্যারের বালীগঞ্জের বাড়িতেই ছিলেন। তারপর স্যারের কাছ থেকেই। কিছু টাকা নিয়ে আগরপাড়ায় দেশবন্ধু কলোনিতে একটা জায়গা কিনে ছোট একটা বাড়ি করে বসবাস করছেন। ডাঃ নলিনী চৌধুরী-তিন বন্ধুর মধ্যে একটু খেয়ালী প্রকৃতির ছিলেন বরাবর। নিজের ছোটখাটো একটা ল্যাবোরেটারি ছিল, সেখানে সর্বক্ষণ বসে বসে রিসার্চ করতেন। মাসকয়েক হল তিনি মারা গেছেন ব্ল্যাড-ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে।

তার ছেলেমেয়ে নেই?

না, মিঃ চৌধুরী ও মিঃ গাঙ্গুলী বিয়েই করেননি। দুজনেই ব্যাচিলার।

চিঠির কথা কি বলছিলেন?

ডাঃ চৌধুরীর এক ভ্রাতা হেমন্ত চৌধুরী ছিলেন বর্মায়। শোনা যায়, যুদ্ধ বাধার সঙ্গেই  তিনিও দেশে ফিরে আসেন। এবং আসবার সময় নাকি প্রভূত অর্থ সঙ্গে নিয়ে আসেন। যাহোক, এসে তিনি শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। এবং দেশে ফিরে আসার মাস আষ্টেক পরে হঠাৎ একদিন রাত্রে ঘরের মধ্যে সর্পদংশনে তার মৃত্যু হয়।

সর্পদংশনে মৃত্যু!

সেই রকমই শুনেছি। ডাঃ চৌধুরীর দাদা তার মৃত্যুর দিন দশেক আগে ডাঃ চৌধুরী–তার ছোট ভাইকে শ্রীরামপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠান, এবং ঐ সময়ই তিনি তার ছোট ভাইকে প্রথম বলেন যে বর্মা থেকে আসবার সময় তিনি প্রভূত অর্থ নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। সেই অর্থ তিনি তার ভাইকে দিয়ে যেতে চান—সেই অর্থ দিয়ে যেন ডাঃ চৌধুরী তার আজন্মের বাসনা-মনের মত একটা ল্যাবোরেটারি তৈরি করে তার ইচ্ছামত রিসার্চ চালিয়ে যান।

তারপর?

কিন্তু তাঁর সে বাসনা পূর্ণ হল না। দাদার মৃত্যুর মাস কয়েক আগে থাকতেই ডাঃ চৌধুরীর শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি ক্ষেপ করেন নি। দাদার মৃত্যুর দিন পনেরো-কুড়ি বাদে হঠাৎ ধরা পড়ল তার লিউকিমিয়া, ব্লাড ক্যানসার হয়েছেডাঃ চৌধুরী শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। মিঃ রায় সে সময় ইউরোপে। প্রত্যহই প্রায় তিনি খোঁজ নিতেন মিঃ রায় ফিরেছেন কিনা। মিঃ রায়ের ইউরোপ থেকে ফিরবার আগেই ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যু হল। ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যুর দিন পনেরো বাদে মিঃ রায় দেশে ফিরে এলেন এবং তার ফিরে আসবার কয়েকদিন পরেই একদিন অফিসে ডাঃ চৌধুরীর লএডভাইসার কালীপদবাবু মিঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে দুখানা চিঠি তাঁর হাতে দিলেন। একখানা তার নামে, অন্যটা তাদের বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীর নামে। এবং চিঠি দুটো দিয়ে তিনি বললেন, তার মৃত ক্লায়েন্টের নির্দেশমতই তিনি ঐ চিঠি দিলেন।

 .

০৪.

তারপর।  

মিঃ মুখার্জী বলতে লাগলেন–

মিঃ রায়ের মুখেই শোনা আমার কথাগুলো। ডাঃ চৌধুরীর দুখানা চিঠি একখানা স্যারের নামে, অন্যখানা মিঃ গাঙ্গুলীর নামে। চিঠিতে ছিল—বরাবরের যাঁর ইচ্ছা ছিল বিরাট একটা ল্যাবোরেটারি গড়ে তুলবেন কিন্তু অর্থের জন্য পারেন নিশেষটায় সেই অর্থ এল যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়—যাই হোক, সেই অর্থের দায়িত্ব তিনি তার দুই বন্ধুর হাতে যৌথভাবে তুলে দিয়ে গেছেন। ব্যাঙ্ক থেকে চিঠি নিয়ে তারা যেন ঐ অর্থ দিয়ে ভাল একটা ল্যাবোরেটারি তৈরি করেন। ভারটা অবিশ্যি তিনি তার ভাগ্নের হাতেও দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু কেন যে দেন নি তা তিনিই জানেন—যদিও তার নিজস্ব ল্যাবোরেটারিটা তিনি ঐ ভাগ্নেকেই দিয়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্নেকে তিনি ভালও বাসতেন যথেষ্ট এবং ঐ ভাগ্নে তার সঙ্গেই বরাবর কাজও করেছে।

তবে দিলেন না কেন?

তা জানি না। হয়ত বন্ধুদের যত বিশ্বাস করতেন ভাগ্নেকে ততটা করতেন না।

আচ্ছা, আপনি বলছেন বিপুল অর্থ নাকি ডাঃ চৌধুরীর ভাই হেমন্ত চৌধুরী বর্মা থেকে সঙ্গে করে এনেছিলেন—সে অর্থ কত?

সে এক মশাই বিচিত্র ব্যাপার।

কি রকম?

ডাঃ চৌধুরীর ভাই হেমন্ত চৌধুরীর বিপুল অর্থের কথাই শুনেছি কিন্তু সে কি নগদ টাকাকড়ি না অন্য কিছু তাও এখন পর্যন্ত জানা যায় নি। এবং সেই অর্থ কোথায় আছে-–আদৌ আছে কিনা—কি ব্যাপার—সেও একটা রহস্যের মত।

কি রকম?

আপনাকে তো আগেই বলেছি, ডাঃ চৌধুরী মানুষটা যেমন খেয়ালী তেমনি রহস্যপ্রিয় ছিলেন। তাঁর চিঠির মধ্যে ছিল ব্যাঙ্ক থেকে নির্দেশ নিতে তার অর্থ সম্পর্কে। ব্যাংকে খোঁজ করতে দেখা গেল

কি?

দু বন্ধুর নামে দুখানা চিঠি আছে আলাদা আলাদা ভাবে—এবং সে চিঠির মধ্যে কতকগুলো অঙ্ক পর পর বসানো কেবল।

অঙ্ক!

হাসে চিঠি আমিও মিঃ রায়ের কাছে দেখেছি। আর একটা জিনিস–

কি?

চিঠির কাগজটা কোনোকুনি ত্রিকোণাকার ভাবে যেন কাঁচি দিয়ে কাটা।

সে আবার কি!

তাই। আর সম্ভবত ঐ চিঠির কথাই লিখেছেন মিঃ গাঙ্গুলী আমাদের স্যারের কাছে এবং চিঠির ব্যাপারটা আলোচনার জন্যই হয়ত ডেকেছেন—কিন্তু মিঃ সেন, এখনও আপনি বললেন না তো-স্যারের ব্যাগটা আপনি কোথায় পেলেন?

মিঃ মুখার্জী, আমি অতীব দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাচ্ছি, মিঃ রায় বোধ হয় আর বেঁচে নেই।

সে কি! বিস্ময়ে মিঃ মুখার্জী যেন একেবারে থ হয়ে যান।

হ্যাঁ—যতদূর জানা গেছে তাতে মনে হয় ট্রেন-অ্যাক্সিডেন্টে সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

না, না—আই কানট বিলিভ ইট-এ যে কিছুতেই আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না—

মৃণাল সেন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ডেড বডিটা এখনও মর্গেই আছে—আইডেন্টিফিকেশন-এর জন্য আপনাকে একবার আমার সঙ্গে যেতে হবে। ভাল কথা, তার ছেলেমেয়ে আছে তো—তার স্ত্রী–

অনেক দিন আগেই তার স্ত্রী মৃত্যু হয়েছে।–

স্ত্রী তাহলে নেই?

না।

ছেলেমেয়ে?

দুই ছেলে এক মেয়ে। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল না!

সম্পর্ক ছিল না?

না। অল্প বয়সে স্ত্রীর মৃত্যু হয়—তারপর থেকেই তার ছেলেমেয়েরা তাদের মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে-যদিও মোটা একটা মাসোহারা বরাবরই তাদের জন্য গেছে। কোম্পানি থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত।

ছেলেমেয়েরা এখনও কি তাদের মামার বাড়িতেই আছে?

না—বড় ছেলে সৌরীন্দ্র ডাক্তার-বর্তমানে সে ইস্টার্ন ফ্রন্টে ইমারজেন্সি কমিশনে আছে-ক্যাপ্টেন। ছোট ভবেন্দ্র-সে বি. কম. পাস করতে না পেরে বছরখানেক হল–সেও বাপের সঙ্গে রাগারাগি করে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে যুদ্ধের চাকরি নিয়েছে। বেরিল না কোথায় আছে যেন শুনেছি-সুবেদার মেজর–

আর মেয়ে?  

মেয়ে কুন্তলা বছর দেড়েক হল মামীর মৃত্যুর পর বাপের কাছে চলে এসেছে। এম. এ. পড়ে

বাড়িতে তাহলে ঐ এক মেয়ে আর তিনিই ছিলেন?

না—আর একজন ছোট ভাই আছেন মিঃ রায়ের।

ভাই?

হ্যাঁ, সুরেন্দ্রনাথ। লেখাপড়া বিশেষ কিছু করেনি। আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে এখন একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। অত্যন্ত বেহিসাবী উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির মানুষ।

হুঁ–তাহলে তো দেখছি একমাত্র আপনি ছাড়া আর উপায় নেই। চলুন আপনাকে দিয়েই মৃতদেহ আপাতত আইডেন্টিফাই করিয়ে নেওয়া যাক। হ্যাঁ  আর একটা কথা–আপাতত অফিসে কাউকে ব্যাপারটা জানাবেন না কিন্তু–

বেশ।

অফিসের গাড়িতেই দুজনে বের হয়।

পথে যেতে যেতে একসময় মৃণাল শুধায়, মিঃ মুখার্জী, মিঃ রায়ের কোন উইল আছে কিনা জানেন?

এ্যা-কিছুদিন আগেই তিনি উইল করেছেন। আমি উইলের একজন সাক্ষী। তাহলে তো উইল সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনি সব কিছু জানেন?

জানি। কিন্তু সে সম্পর্কে আপাতত কিছু আপনাকে আমি বলতে পারছি না বলে দুঃখিত।

বলতে পারছেন না কেন?  

সেই রকম নির্দেশই আছে—আর সত্যিই যদি দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়ে থাকে, কালপরশুই তো সব জানতে পারবেন উইলের ব্যাপারে।

মৃণাল সেন আর কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।

মিঃ মুখার্জীই আবার এক সময় প্রশ্ন করেন, আচ্ছা মিঃ সেন, অ্যাক্সিডেন্টে মিঃ রায়ের মৃত্যু হয়েছে বলছেন—ট্রেনে কাটা পড়ছেন কি?

তা এখনও ঠিক বলা যাচ্ছে না। মৃণাল সেন বলে।

মর্গে গিয়ে মৃতদেহ দেখবার পর মিঃ মুখার্জী কেঁদে ফেললেন। মুখটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলেও মুখার্জীর চিনতে কষ্ট হয় না মানুষটাকে!

বললেন, মৃতদেহটা তার মনিবেরই বটে। মিঃ মুখার্জীকে বিদায় দিয়ে মৃণাল সেন লালবাজারে ফিরে এল।

.

০৫.

পরের দিন কলকাতার ইংরাজী ও বাংলা সমস্ত দৈনিক কাগজেই লক্ষপতি বিজনেস ম্যাগনেট-রায় এন্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার মহেন্দ্রনাথ রায়ের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদটা তার ফটোসহ প্রকাশিত হল।

মহেন্দ্রনাথ যে কেবল লক্ষপতি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন তাই নয়—তার দানধ্যানও যথেষ্ট ছিল এবং একজন দেশকর্মী বলেও তার পরিচয় ছিল।

সকাল তখন নয়টা হবে।

মৃণাল তার অফিস কামরায় ঢুকতে যাচ্ছে, সার্জেন্ট সাহা এসে বললেন, স্যার, আপনাকে ডি. সি. মিঃ চক্রবর্তী দুবার খোঁজ করেছেন।

মৃণাল কোন কথা না বলে ডি. সি.-র ঘরে গিয়ে ঢুকল।

ডি. সি.-র পাশেই একজন মধ্যবয়সী যুবক বসে ছিল-কালো সুশ্রী চেহারা। মৃণাল ঘরে ঢুকতেই বললেন, এই যে মৃণাল, এস পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি সুব্রত রায়।

সুব্রতকে না দেখলেও তার নামের সঙ্গে মৃণালের যথেষ্ট পরিচয় ছিল। সে হাত তুলে সুব্রতকে নমস্কার জানায়।

অতঃপর মিঃ চক্রবর্তী বলেন, কালকের সেই অ্যাক্সিডেন্ট কেসটা—মহেন্দ্র নাথের ব্যাপারটা তোমার কাছ থেকে উনি জানতে চান ডিটেলস-এ।

সুব্রত ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলে, চলুন মিঃ সেন, আপনার অফিস ঘরে যাওয়া যাক।

বেশ তো চলুন।

দুজনে এসে মৃণালের অফিস ঘরে বসে।

আপনি কেসটা সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড় নাকি সুব্রতবাবু? মৃণাল প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ।

কি ব্যাপার বলুন তো? সংবাদপত্রে news-টা পড়েই কি—

তা ঠিক নয়।

তবে?

আপনি বোধ হয় জানেন, মৃত ঐ মিঃ রায়ের একটি ছোট ভাই আছে!

আপনি সুরেন্দ্রনাথের কথা বলছেন তো?

হ্যাঁ।

তাকে আপনি চেনেন?

হ্যাঁ—তার সঙ্গে আমার অনেক দিন থেকেই পরিচয়। সে-ই আমায় কাল রাত্রে টেলিফোন করে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে সব কথা বলে।

কি বলেছেন তিনি?

তার ধারণা ব্যাপারটা ঠিক একটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, ওর মধ্যে সুনিশ্চিত একটা কোন ফাউল প্লে আছে।

ফাউল প্লে!

হ্যাঁ—সে বলতে চায় এ আত্মহত্যাও নয়—দুর্ঘটনাও নয়—তাকে অর্থাৎ তার দাদাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে।

কেন-হঠাৎ তার একথা মনে হল কেন? আপনাকে তিনি বলেছেন কিছু সে সম্পর্কে?

সে বলতে চায়—তার মত মানুষ আত্মহত্যা করতে পারেন না কিছুতেই।

কেন?

তাছাড়া সে বলতে চায় আত্মহত্যা হঠাৎ করবার মতন তার কোন কারণ ছিল না।

কারণ ছিল না তিনি বুঝলেন কি করে?

সুব্রত হেসে বলে, তা তো জানি না। তবে সে বলতে চায়—তার দাদার কোন অর্থের অভাব বা দুশ্চিন্তা ছিল না। বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান। খুব ভাল করে না ভেবে কখনও তিনি কোন কাজ নাকি করতেন না। অবিশ্যি ছেলেদের ব্যাপারে তার মনে একটা অশান্তি ছিল, তবে সে অশান্তি কোনদিনই তাকে তেমন বিচলিত করতে পারেনি।

হুঁ–তা ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্টও নয় যে, তাই বা তিনি বুঝলেন কি করে?

যে লোক তার মতে অত্যন্ত সাবধানী, হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কিছু কখনও করেননি, অমন একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবে আদৌ নাকি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

তাহলে তার ধারণাইটস এ কেস অফ মার্ডার—হোমিসাইড।

সুব্রত পুনরায় মৃদু হেসে বলে, কতকটা তাই সে বলতে চায়।

সুব্রতবাবু, কেন এখনও ঠিক বলতে পারছি না—আমারও কিন্তু ঠিক তাই ধারণা।

মানে?

আমারও কেন যেন মনে হচ্ছে ঐ ব্যাপারটার মধ্যে কোন ফাউল প্লে আছে।

আপনারও মনে হয় ব্যাপারটার মধ্যে ফাউল প্লে আছে মিঃ সেন?

হ্যাঁ।

কেন বলুন তো?

মৃণাল সেন সংক্ষেপে তখন গতকালের ব্যাপারটা পুনরাবৃত্তি করে।

সব শোনবার পর সুব্রত বলে, পোস্ট মর্টে তো আজ হবে?

হ্যাঁ—মোটামুটি একটা রিপোর্ট হয়ত আজই পেয়ে যাব।

তারপর একটু থেমে মৃণাল সেন ডাকে, সুব্রতবাবু?

উঁ।

সব তো শুনলেন, আপনার কি মনে হচ্ছে?

ব্যাপারটা সহজ বা স্বাভাবিক নয়, এইটুকু বলতে পারি আপাতত আপনাকে।

অ্যাক্সিডেন্ট বা আত্মহত্যা নয়?

তাই তো মনে হয়।

কেন?

আপনি বলেছেন মৃতের মুখটা এমন ক্ষতবিক্ষত ছিল যে চেনার উপায় ছিলনা।

হ্যাঁ।

ট্রেনের চাকার তলায় আত্মহত্যা করলে বা অ্যাক্সিডেন্ট হলে অমন করে মুখটা মিউটিলেটেড হবে কেন?

এজাক্টলি-আমারও তাই মত। কিন্তু আমি ঠিক এখনও বুঝতে পারছি না সুব্রতবাবু, অনুসন্ধানের ব্যাপারটা কি ভাবে কোথা থেকে শুরু করব–

মোটামুটি একটা পোস্টমর্ট রিপোর্ট তো আজই আপনি পাবেন! হয়ত সেই রিপোর্টেই কিছু পাওয়া যাবে।

আপনি তাই মনে করেন?

দেখুন না, যেতেও পারে। তাহলে এখন আমি উঠি মিঃ সেন, রিপোর্টটা পেলেই কিন্তু আমাকে জানাবেন।

নিশ্চয়ই।