[২৭ জানুআরী ১৯০০ খ্রীঃ ক্যালিফোর্নিয়া, প্যাসাডেনা শেক্সপিয়ার ক্লাবে প্রদত্ত।]
ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আজ সকালে আলোচনার বিষয় ছিল ‘বেদান্তদর্শন’। বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী হইলেও একটু নীরস ও অতি বিরাট।
ইতোমধ্যে আপনাদের সভাপতি এবং উপস্থিত কয়েকজন ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলা ‘আমার কাজ ও এতদিনের কার্যক্রম’ সম্বন্ধে কিছু বলিবার জন্য আমাকে অনুরোধ করিয়াছেন। বিষয়টি কাহারও কাহারও নিকট আকর্ষণীয় হইতে পারে, কিন্তু আমার নিকটে নয়। বস্তুতঃ কেমন করিয়া যে আপনাদের নিকট এ-সম্বন্ধে বলিব, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না। এ-বিষয়ে এই আমার প্রথম বলা।
আমার ক্ষুদ্র শক্তি দ্বারা এতদিন কি করিবার চেষ্টা করিয়াছি, তাহা বুঝাইবার জন্য আপনাদিগকে কল্পনায় ভারতবর্ষে লইয়া যাইতেছি। বিষয়বস্তুর খুঁটিনাটি ও বৈচিত্র্য লইয়া আলোচনার সময় আমাদের নাই। একটি বৈদেশিক জাতির সর্বপ্রকার বৈচিত্র্য এই অল্প সময়ের মধ্যে আপনাদের হৃদয়ঙ্গম করাও সম্ভব নয়। ভারতবর্ষের যথার্থ স্বরূপ কিছুটা আপনাদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করিব।
ভারতবর্ষ একটি ভগ্নস্তূপে পরিণত বিশাল অট্টালিকার মত। প্রথম দর্শনে কোন আশাই জাগে না। এ এক বিগতশ্রী বিধ্বস্ত জাতি। কিন্তু একটু ধৈর্য্য ধরিয়া লক্ষ্য করিলে এই রূপের পশ্চাতে ভারতের আর একটি সত্য দেখিতে পাইবেন। মানুষটি যে-আদর্শ ও মূলনীতির বহিঃপ্রকাশ, সে-আদর্শ ও মূলনীতি যতদিন ব্যাহত বা বিনষ্ট না হয়, ততদিন মানুষটি বাঁচিয়া থাকে, ততদিন তাহার আশা আছে। আপনার পরিধানের জামা কুড়িবার চুরি হইয়া গেলেও তাহা আপনার মৃত্যুর কারণ হয় না। আর একটি নূতন জামা আনিতে পারিবেন। জামা এ-ক্ষেত্রে অপ্রধান। ধনবানের ধনরাশি অপহৃত হইলে তাহার প্রাণশক্তি অপহৃত হয় না। মানুষটি বাঁচিয়া থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখিলে কি দেখিতে পাই, তাহা পরে বলিতেছি।
এ কথা সত্য যে, ভারতবর্ষ এখন আর একটি রাজনৈতিক শক্তি নয়, ভারতবর্ষ দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ একটি জাতি। নিজেদের শাসনকার্যে ভারতবাসীর কোন হাত নাই। ত্রিশকোটি পরাধীন দাস ভিন্ন ভারতবাসী আর কিছুই নয়। ভারতবাসীর জনপ্রতি মাসিক আয় গড়ে দুই শিলিং মাত্র। জনসাধারণের অধিকাংশের পক্ষে উপবাসই স্বাভাবিক অবস্থা। ফলে আয়ের বিন্দুমাত্র স্বল্পতা ঘটিলে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সামান্য দুর্ভিক্ষের অর্থ বহু লোকের মৃত্যু। এই দিক্ দিয়া দেখিলে শুধু ধ্বংসস্তূপ—আশাহীন ধ্বংসাবশেষই দেখিতে পাই।
কিন্তু আমরা জানি, ভারতবাসী কখনও ধনসম্পদের চেষ্টা করে নাই। পৃথিবীর যে- কোন জাতি অপেক্ষা বিপুলতর অর্থসম্পদের অধিকারী হইয়াও ভারতবাসী কোন দিন অর্থের জন্য লালায়িত হয় নাই। যুগ যুগ ধরিয়া ভারতবর্ষ এক শক্তিমান্ জাতি ছিল, কিন্তু তাহার কখনও ক্ষমতার লোভ ছিল না। অন্য জাতিকে জয় করিবার জন্য ভারতবাসী কখনও বাহিরে যায় নাই। নিজেদের সীমার মধ্যেই তাহারা সন্তুষ্ট ছিল, বাহিরের সহিত বিবাদে রত হয় নাই। ভারতীয় জাতি কখনও সাম্রাজ্য-লাভের আকাঙ্ক্ষা করে নাই। পরাক্রম ও সম্পদ এ-জাতির আদর্শ ছিল না।
তবে? ভারতবাসী ভুল করিয়াছিল কি ঠিক পথে চলিয়াছিল, তাহা এখানে আলোচ্য নয়। পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে এই একটি জাতিই গভীরভাবে বিশ্বাস করিত—এই জীবনই একমাত্র সত্য নয়। ঈশ্বরই সত্য। সুখে দুঃখে তিনিই তাহার আশ্রয়স্থল। ভারতবর্ষের অধঃপতনকালে এইজন্যই সর্বপ্রথম ধর্মের অবনতি ঘটিয়াছিল। হিন্দুগণ ধর্মের ভাবে পানাহার করে, ধর্মের ভাবে নিদ্রা যায়, ধর্মের ভাবে বিচরণ করে, ধর্মের ভাবে বিবাহাদি করে, ধর্মের ভাবে দস্যুবৃত্তি করে।
আপনারা কি কখনও এমন দেশ দেখিয়াছেন? সেখানে যদি আপনি দস্যুদল গঠন করিতে চান, তবে দলের নেতাকে কোনরূপ ধর্ম প্রচার করিতে হইবে, তারপর কতকগুলি অসার দার্শনিকতত্ত্ব সূত্রাকারে প্রকাশ করিয়া বলিতে হইবে, ‘এই দস্যুবৃত্তিই ভগবান্-লাভের সবচেয়ে সুগম ও সহজ পন্থা’। তবেই নেতা তাহার দল গঠন করিতে পারিবে। অন্যথা নয়। ইহাতেই প্রতিপন্ন হয়, এ-জাতির লক্ষ্য ও প্রাণশক্তি—ধর্ম। এই ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ হয় নাই বলিয়াই জাতি এখনও বাঁচিয়া আছে।
রোমের কথা মনে করুন। রোমের জাতীয় লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠা ও উহার বিস্তার। যে মুহূর্তে এই সাম্রজ্যবাদে বাধা পড়িল, অমনি রোম চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া ধ্বংস হইল। গ্রীসের আদর্শ ছিল বুদ্ধিবৃত্তি। যে মুহূর্তে বুদ্ধির ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিল, গ্রীসও অতীতের গর্ভে বিলীন হইয়া গেল। ঠিক এই অবস্থাই বর্তমান কালের স্পেন ও অন্যান্য নবীন দেশগুলির হইয়াছে। প্রত্যেক জাতিরই এ পৃথিবীতে একটি উদ্দেশ্য ও আদর্শ থাকে। যতক্ষণ এই লক্ষ্যটির উপর কোন আঘাত না আসে ততক্ষণ বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও জাতি বাঁচিয়া থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই আদর্শটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সঙ্গে সঙ্গে ঐ জাতিরও মৃত্যু ঘটে।
ভারতে সেই প্রাণশক্তি আজিও অব্যাহত। এই শক্তি ভারতবাসী কখনও ত্যাগ করে নাই। ভারতীয়দের সর্বপ্রকার কুসংস্কার সত্ত্বেও এই প্রাণশক্তি আজিও জাতির জীবনে সমভাবে প্রবাহিত। অতি ভয়ানক ঘৃণ্য কুসংস্কারসকল ভারতবর্ষে বর্তমান। তাহাতে কিছুই আসে যায় না। জাতির জীবনপ্রবাহ ও জীবনোদ্দেশ্য আজিও তেমনই আছে।
ভারতবাসীরা কোনকালেই একটি শক্তিশালী বিজয়ী জাতি হইতে পারিবে না। কোনদিন তাহারা রাজনীতির ক্ষেত্রে এক বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হইবে না। এ-কাজ তাহাদের নয়। বিশ্বসভায় ইহা ভারতবর্ষের ভূমিকা নয়। ভারতের ভূমিকা কি? ভারতবর্ষের আদর্শ—ভগবান্, একমাত্র ভগবান্। যতদিন ভারতবর্ষ মৃত্যুপণ করিয়াও ভগবানকে ধরিয়া থাকিবে, ততদিন তাহার আশা আছে।
অতএব বিশ্লেষণান্তে আপনার সিদ্ধান্ত হইবে, বাহিরের এই দুঃখ-দারিদ্র্য অকিঞ্চিৎকর, ইহা অন্তরের মানুষটিকে মারিতে পারে নাই; সে মানুষটি আজিও বাঁচিয়া আছে, এখনও তাহার আশা আছে।
দেখিতে পাইবেন, সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়িয়া ধর্মবিষয়ক কার্যধারা চলিয়াছে। এমন একটি বৎসর আমার মনে পড়ে না—যে-বৎসর কয়েকটি নূতন সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় নাই। স্রোত যত তীব্র হয়, ততই উহাতে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হইতে থাকে। সম্প্রদায়সমূহ অবনতির লক্ষণ নয়—জীবনের পরিচায়ক। সম্প্রদায়ের সংখ্যা আরও বাড়িতে থাকুক। এমন দিন আসুক, যখন প্রত্যেক মানুষ এক একটি সম্প্রদায় হইয়া দাঁড়াইবে। সম্প্রদায় লইয়া কলহের কোন কারণ নাই।
এখন আপনারা নিজেদের দেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। আমি কোনরূপ সমালোচনা করিতেছি না। এদেশের সামাজিক বিধিবিধান, রাজনৈতিক সংগঠন প্রভৃতি সব কিছুই ইহজীবনের যাত্রাপথ সুগম করিবার জন্য রচিত হইয়াছে। মানুষ যতদিন বাঁচিয়া থাকে, ততদিন খুব সুখে থাকিতে পারে। আপনাদের রাস্তাঘাটের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন—কি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন! কি সুন্দর সব শহর! কত উপায়েই না মানুষ অর্থোপার্জন করিতে পারে! জীবনের সুখ-সম্ভোগের কত পথ! কিন্তু যদি কেহ এখানে বলে, ‘আমি কোন কাজ করিতে চাই না, শুধু ঐ বৃক্ষতলে বসিয়া ধ্যান করিব’, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে জেলে যাইতে হইবে। কোন সুযোগই তাহাকে দেওয়া হইবে না—কোন সুযোগই নয়। সকলের সহিত তাল মিলাইয়া চলিলেই এ-সমাজে মানুষের বাঁচিয়া থাকা সম্ভব। ইহলৌকিক সুখসম্ভোগের মত্ততায় তাহাকে যোগ দিতে হইবে, অন্যথা মৃত্যু অনিবার্য।
ভারতবর্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। সেখানে যদি কেহ বলে, ‘পর্বতশিখরে ধ্যানাসনে বসিয়া নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া আমি আমার অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করিব’, সকলেই তাহাকে বলিবে, ‘যাও, ঈশ্বর তোমার সহায় হউন’। একটি কথাও তাহাকে বলিতে হইবে না। কেহ তাহাকে একখণ্ড পরিধেয় বস্ত্র দিবে, অনায়াসে তাহার অভাবপূরণ হইবে। কিন্তু যদি কেহ বলে, ‘এ-জীবনটা আমি একটু উপভোগ করিতে চাই’, অমনি সমস্ত দরজা তাহার নিকট বন্ধ হইয়া যাইবে।
আমি বলি, উভয় দেশের ধারণাই অযৌক্তিক। এদেশে যদি কেহ স্থির আসনে বসিয়া নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে চায়, তবে কেন সে সুযোগ পাইবে না, তাহা বুঝিতে পারি না। অধিকাংশ লোকে যাহা করে, প্রত্যেকের পক্ষেই এখানে কেন তাহাই কর্তব্য হইবে? আমি ইহার কোন কারণ দেখিতে পাই না। আবার ভারতবর্ষে কোন ব্যক্তি কেন ইহজীবনে সুখ-সম্ভোগ ও অর্থোপার্জন করিবে না, তাহারও কারণ খুঁজিয়া পাই না। কিন্তু দেখুন, জোর করিয়া কোটি কোটি লোককে তাহাদের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। ইহা ঋষিমুনিদের অত্যাচার। এ-অত্যাচার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের, মনীষীদের, এ-অত্যাচার অধ্যাত্মবাদীর, জ্ঞানী পুরুষের। আর মনে রাখিবেন, অজ্ঞ-জনের অত্যাচার অপেক্ষা জ্ঞানবানের অত্যাচার অনেক বেশী শক্তিশালী। নিজেদের মত অন্যের ঘাড়ে চাপাইবার জন্য জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানেরা সহস্র বিধিনিষেধের প্রচলন করিয়াছেন। যে-সকল বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করা অজ্ঞ-জনের সাধ্য নয়।
আমি বলি, এ অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। একজন আধ্যাত্মিক মহামানব সৃষ্টি করিবার জন্য কোটি কোটি মানুষকে বলি দিয়া লাভ নাই। যদি এমন কোন সমাজ গঠন করা সম্ভব হয়, যেখানে আধ্যাত্মিক মহামানবেরও আবির্ভাব হইবে, সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অন্যান্য সকলেও সুখে থাকিবে, ভাল কথা; কিন্তু যদি কোটি কোটি মানুষকে নিষ্পেষিত করিয়া একজন আধ্যাত্মিক মহামানব সৃষ্টি করিতে হয়, তাহা অন্যায়। বরং বিশ্ব-মানবের মুক্তির জন্য একজন মহাপুরুষের দুঃখভোগ শ্রেয়।
প্রত্যেক জাতির মধ্যে আপনাকে সেই জাতির বিশিষ্ট পন্থা অনুযায়ী কাজ করিতে হইবে। প্রত্যেক ব্যক্তির সহিত সেই ব্যক্তির নিজস্ব ভাষায় কথা বলিতে হইবে। ইংলণ্ড বা আমেরিকায় যদি ধর্মপ্রচার করিতে যান, তাহা হইলে রাজনৈতিক পন্থা অনুসারে আপনাকে কাজ করিতে হইবে। সেখানে পাশ্চাত্য রীতি অনুযায়ী ভোট-ব্যালট, প্রেসিডেণ্ট-নির্বাচন প্রভৃতি দ্বারা সংস্থা ও সমিতি গঠন করিতে হইবে, কারণ উহাই পাশ্চাত্যজাতির ভাষা ও রীতি। পক্ষান্তরে আপনি যদি ভারতবর্ষে রাজনীতি সম্বন্ধে কিছু বলিতে চান, তাহা হইলে আপনাকে ধর্মের ভাষায় কথা বলিতে হইবে। অনেকটা এইভাবে বলিতে হইবেঃ যে-ব্যক্তি প্রত্যহ প্রাতে তাহার গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়া রাখে, তাহার অশেষ পুণ্য হইবে, সে স্বর্গে যাইবে অথবা ঈশ্বর লাভ করিবে। ঐভাবে না বলিলে তাহারা শুনিবে না। এ শুধু ভাষার ব্যাপার। বিষয়বস্তু কিন্তু একই। কিন্তু কোন জাতির হৃদয়ে প্রবেশ করিতে হইলে আপনাকে সেই জাতির ভাষায় কথা বলিতে হইবে। কথাটি খুবই ন্যায়সঙ্গত—এ-বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করা আমাদের উচিত নয়।
আমি যে-সম্প্রদায়ভুক্ত, তাহাকে বলা হয় সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়। ‘সন্ন্যাসী’ শব্দের অর্থ ‘যে-ব্যক্তি সম্যকরূপে ত্যাগ করিয়াছে।’ ইহা অতি প্রাচীন সম্প্রদায়। যীশুর জন্মের ৫৬০ বৎসর পূর্বে বুদ্ধও এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁহার সম্প্রদায়ের অন্যতম সংস্কারক মাত্র। এত প্রাচীন এই সম্প্রদায়! পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদেও আপনি সন্ন্যাসীর উল্লেখ পাইবেন। প্রাচীন ভারতে নিয়ম ছিল যে, প্রত্যেক নরনারীকে শেষ জীবনে সমাজ হইতে বিদায় লইয়া একমাত্র স্বীয় মুক্তি ও ভগবৎ-চিন্তায় মনোনিবেশ করিতে হইবে। ইহা ছিল চরম ঘটনা—মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি বিশেষ। সুতরাং প্রাচীনকালে বৃদ্ধগণ সন্ন্যাস অবলম্বন করিতেন। পরবর্তী কালে তরুণ যুবকগণ সংসার ত্যাগ করিতে লাগিল। যুবকগণ কর্মঠ। বৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া সর্বক্ষণ মৃত্যুচিন্তা করা তাহাদের পক্ষে অসম্ভব, সুতরাং তাহারা ধর্মপ্রচার, বিভিন্ন সম্প্রদায়-গঠন প্রভৃতি কার্যে ব্রতী হইল। এইরূপে যুবক বুদ্ধ তাঁহার মহান্ সংস্কারকার্য আরম্ভ করেন। তিনি যদি বৃদ্ধ হইতেন, তবে অবশ্যই নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়াই নীরবে নির্বাণ লাভ করিতেন।
সন্ন্যাসি-সম্প্রদায় বলিতে ‘চার্চ’ বুঝায় না এবং সেই সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা পুরোহিত নন। পুরোহিত ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। ভারতবর্ষে সমাজিক জীবনের অন্যান্য কাজের মত পুরোহিত-বৃত্তিও একটি জন্মগত পেশা। সূত্রধরের পুত্র যেমন সূত্রধর হয়, কর্মকারের পুত্র যেমন কর্মকার হয়, ঠিক সেইভাবে পুরোহিতের সন্তানও পুরোহিত হয়। পুরোহিতকে বিবাহ করিতে হয়। অবিবাহিতকে হিন্দুরা অসম্পূর্ণ মনে করে। তাই ধর্মগত আচার-অনুষ্ঠানে অবিবাহিতের অধিকার নাই।
সন্ন্যাসীদের সম্পত্তি থাকে না, তাঁহারা বিবাহ করেন না। তাঁহাদের কোন সংস্থা নাই। তাঁহাদের একমাত্র বন্ধন গুরুশিষ্যের বন্ধন। এই বন্ধনটি ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য। শুধু শিক্ষাদানের জন্য যিনি আসেন এবং সেই শিক্ষার জন্য কিছু মূল্যদান করিয়াই যাঁহার সহিত সম্বন্ধ চুকিয়া যায়, তিনি প্রকৃত শিক্ষক নন। ভারতবর্ষে ইহা সত্যসত্যই দত্তক গ্রহণের মত। শিক্ষাদাতা গুরু আমার পিতার অধিক, আমি তাঁহার সন্তান—সব দিক্ দিয়া আমি তাঁহার সন্তান। সর্বাগ্রে—পিতারও অগ্রে তাঁহাকে শ্রদ্ধা করিব এবং তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিব; কারণ ভারতবাসীরা বলে, পিতা আমার জন্মদান করিয়াছেন, কিন্তু গুরু আমাকে মুক্তির পথ দেখাইয়াছেন, সুতরাং গুরু পিতা অপেক্ষা মহত্তর। আজীবন আমরা গুরুর প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পোষণ করি। গুরু-শিষ্যের মধ্যে এই সম্বন্ধই বর্তমান। আমি আমার শিষ্যদিগকে দত্তকরূপে গ্রহণ করি। অনেক সময় গুরু হয়তো তরুণ, শিষ্য বয়োবৃদ্ধ। তাহাতে কিছু আসে যায় না। শিষ্য সন্তান, সে আমাকে ‘পিতা’ বলিয়া সম্বোধন করিবে; আমাকেও তাহাকে পুত্র বা কন্যারূপে সম্বোধন করিতে হইবে।
এক বৃদ্ধকে আমি গুরুরূপে পাইয়াছিলাম, তিনি এক অদ্ভুত লোক। পাণ্ডিত্য তাঁহার কিছুই ছিল না, পড়াশুনাও বিশেষ করেন নাই। কিন্তু শৈশব হইতেই সত্যের প্রত্যক্ষানুভূতি লাভ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁহার মনে জাগিয়াছিল। স্বধর্ম-চর্চার মধ্য দিয়া তাঁহার সাধনার আরম্ভ। পরে তিনি অন্যান্য ধর্মমতের মধ্য দিয়া সত্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় একের পর এক সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ে যোগদান করিলেন। কিছুকাল তিনি সম্প্রদায়গুলির নির্দেশ অনুযায়ী সাধন করিতেন, সেই সেই সম্প্রদায়ের ভক্তদের সহিত বাস করিয়া তাহাদের ভাবাদর্শে তন্ময় হইয়া যাইতেন। কয়েক বৎসর পর আবার তিনি অন্য এক সম্প্রদায়ে যাইতেন। এইভাবে সকল সাধনার অন্তে তিনি সিদ্ধান্ত করিলেন—সব মতই ভাল। কোন ধর্মমতেরই তিনি সমালোচনা করিতেন না; তিনি বলিতেন, বিভিন্ন ধর্মমতগুলি একই সত্যে পৌঁছিবার বিভিন্ন পথ মাত্র। আর তিনি বলিতেনঃ এতগুলি পথ থাকা তো খুবই গৌরবের বিষয়, কারণ, ঈশ্বরলাভের পথ যদি একটিমাত্র হইত, তবে হয়তো উহা একজন ব্যক্তির পক্ষেই উপযোগী হইত। পথের সংখ্যা যত বেশী থাকিবে, ততই আমাদের প্রত্যেকের পক্ষে সত্যলাভের সুযোগ ঘটিবে। যদি এক ভাষায় শিখিতে না পারি, তবে আর এক ভাষায় শিখিবার চেষ্টা করিব, সকল ধর্মমতের প্রতি তাঁহার এমনই শ্রদ্ধা ছিল।
যে-সকল ভাব আমি প্রচার করিতেছি, সেগুলি তাঁহার চিন্তারাশিরই প্রতিধ্বনি মাত্র। ইহাদের একটিও আমার নিজস্ব নয় শুধু মন্দগুলি ছাড়া। আমার উক্তির মধ্যে যাহা মিথ্যা ও মন্দ, সেইগুলিই আমার। সত্য ও কল্যাণকর যে-সকল কথা আমি উচ্চারণ করিয়াছি, সবই তাঁহার বাণীর প্রতিধ্বনিমাত্র। আপনাদিগকে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার রচিত তাঁহার জীবনচরিত১পড়িয়া দেখিতে বলি।
তাঁহারই চরণপ্রান্তে কয়েকজন যুবকের সহিত একত্র আমি এই ভাবধারা লাভ করিয়াছি। তখন আমি বালকমাত্র। প্রায় ষোল বৎসর বয়সে আমি তাঁহার নিকট গিয়াছিলাম। অন্যান্য সঙ্গীদের কেহ আরও ছোট, কেহ বা একটু বড়। সবসুদ্ধ বার জন বা কিছু বেশী হইবে। সকলে মিলিয়া এই আর্দশ-প্রচারের কথা ভাবিলাম। শুধু প্রচার নয়, এই আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করিতে চাহিলাম। ইহার অর্থ—আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্য দিয়া হিন্দুর আধ্যাত্মিকতা, বৌদ্ধের করুণা, খ্রীষ্টানের কর্মপ্রবণতা ও ইসলামের ভ্রাতৃত্ব ফুটাইয়া তোলা। প্রতিজ্ঞা করিলাম, ‘এই মুহূর্তেই আমরা একটি বিশ্বজনীন ধর্ম প্রবর্তন করিব; আর বিলম্ব নয়।’
আমাদের বৃদ্ধ গুরুদেব কখনও মুদ্রা স্পর্শ করিতেন না। সামান্য খাদ্য, বস্ত্র যাহা প্রয়োজনীয়, তাহাই তিনি গ্রহণ করিতেন, বেশী কিছু নয়। অন্য কোনরূপ দান তাঁহাকে নেওয়ান যাইত না। আশ্চর্য আধ্যাত্মিক ভাবরাশির সহিত এই নির্বিণ্ণতার ফলে তাঁহার কোনরূপ বন্ধন ছিল না। ভারতীয় সন্ন্যাসী আজ হয়তো রাজবন্ধু, রাজ-অতিথি—কাল তিনি ভিখারী, বৃক্ষতলশায়ী। সকলের সংস্পর্শে তাঁহাকে আসিতে হইবে। সর্বদা তাঁহাকে পরিভ্রমণ করিতে হইবে। প্রবাদ আছে, ‘গড়ান পাথরে শেওলা জমে না।’ গত চৌদ্দ বৎসরকাল আমি কোন স্থানে তিন মাসের বেশী থাকি নাই—সর্বদা ঘুরিয়াছি। আমরা সকলেই ঐরূপ করিয়া থাকি।
মুষ্টিমেয় ঐ কয়টি বালক এই মহান্ ভাবধারার প্রেরণায় নিজেদের জীবন গড়িয়া তুলিতে লাগিল। সর্বজনীন ধর্ম, দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি প্রভৃতি তত্ত্বের দিক্ দিয়া খুবই ভাল—কিন্তু কাজে এগুলি ফুটাইয়া তোলা চাই।
তারপর একদিন গুরুদেবের প্রয়াণকাল উপস্থিত হইল। সকলে মিলিয়া যথাসাধ্য তাঁহার সেবা করিলাম। আমাদের বন্ধু-বান্ধব বিশেষ কেহ ছিল না। এই সব অদ্ভুত ধারণা-পোষণকারী তরুণদের কথা কে-ই বা শুনিবে? অন্ততঃ ভারতবর্ষে তরুণেরা তো কিছুই নয়। একবার ভাবিয়া দেখুন, বারটি বালক মানুষের কাছে বড় বড় আদর্শের কথা বলিতেছে, সেই আদর্শ জীবনে পরিণত করিতে দৃঢ়সংকল্প। সকলেই হাসিত। হাসি হইতে ক্রমে গুরুতর বিষয়ে পরিণতি ঘটিত। রীতিমত অত্যাচার আরম্ভ হইল। ঠাট্টা-বিদ্রূপ যতই প্রবল হইয়া উঠিল, আমরাও তত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলাম।
তারপর আসিল দারুণ দুঃসময়—ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষে এবং অন্যান্য ভ্রাতাদের পক্ষেও। কিন্তু আমার পক্ষে সে কি নিদারুণ দুর্ভাগ্য। একদিকে মা ও ভাইয়েরা। পিতার মৃত্যুতে আমরা তখন চরম দারিদ্র্যে উপনীত। বেশীর ভাগ দিন না খাইয়া থাকিতে হইত। পরিবারের একমাত্র আমিই আশা-ভরসা—সাহায্য করিবার উপযুক্ত ছিলাম। আমার সম্মুখে তখন দুইটি জগৎ। একদিকে মাতা ও ভ্রাতাদিগকে না খাইয়া মরিতে দেখিতে হইবে; অপর দিকে বিশ্বাস করিতাম যে, গুরুদেবের ভাবধারা ভারতের তথা জগতের পক্ষে কল্যাণকর, সুতরাং এই আদর্শ জগতে প্রচার করিয়া কার্যে পরিণত করিতেই হইবে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই দ্বন্দ্ব চলিল। কখনও কখনও পাঁচ ছয় দিন ধরিয়া অবিরত প্রার্থনা করিতাম। সে কি হৃদয়-বেদনা! আমি তখন দারুণ যন্ত্রণা অনুভব করিতেছিলাম! তরুণ হৃদয়ের স্বাভাবিক স্নেহ আত্মীয়গণের দিকে টানিতেছে—অতি প্রিয়জনদের দুরবস্থা সহ্য করিতে পারিতেছি না। অপর পক্ষে সহানুভূতি জানাইবার একটি লোকও নাই। বালকের কল্পনার প্রতি কে সহানুভূতি দেখাইবে? যে কল্পনার জন্য অপরকে এত কষ্ট পাইতে হয়, সেই কল্পনার প্রতি কাহারই বা সহানুভূতি জাগিতে পারে? একজন ছাড়া কেহই সহানুভূতি জানাইল না।
সেই একজনের সহানুভূতিই আশা ও আশীর্বাদ বহন করিয়া আনিল। তিনি এক নারী। আমাদের মহাযোগী গুরুদেব তাঁহাকে অতি অল্প বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন। পতি যৌবনে ধর্মোন্মাদনায় মগ্ন থাকাকালে একবার পত্নী তাঁহার সহিত দেখা করেন। অতিশৈশবে বিবাহ হইলেও বড় না হওয়া অবধি পত্নী স্বামীকে বিশেষ দেখিতে পান নাই। পরবর্তী কালে পত্নীর সহিত দেখা হইলে পতি বলিলেন, ‘দেখ, আমি তোমার স্বামী। এই দেহের উপর তোমার দাবী আছে। কিন্তু বিবাহিত হইলেও যৌন-জীবন যাপন করা আমার পক্ষে অসম্ভব। এ বিষয়ে বিচারের ভার তোমাকেই দিলাম।’ পত্নী সাশ্রুনয়নে বলিলেন, ‘ভগবান্ তোমার সহায় হউন, তোমায় আশীর্বাদ করুন। আমি কি তোমাকে অধঃপাতে লইয়া যাইব? যদি পারি, তোমাকে সাহায্যই করিব। তুমি তোমার সাধনা লইয়া থাক।’
সেই নারী এরূপ প্রকৃতির ছিলেন। সাধনায় মগ্ন হইয়া স্বামী ক্রমে নিজের ভাবে সন্ন্যাসী হইয়া গেলেন। দূর হইতে পত্নী যথাশক্তি সাহায্য করিতে লাগিলেন। স্বামী যখন অধ্যাত্ম-জগতে এক বিরাট পুরুষ হইয়া দাঁড়াইলেন, স্ত্রী ফিরিয়া আসিলেন। বলিতে গেলে তিনিই তাঁহার প্রথম শিষ্যা। অবশিষ্ট জীবন তিনি স্বামীর সেবায় অতিবাহিত করিলেন। বাঁচিয়া আছেন, কি মরিয়া গিয়াছেন—ঐ লোকোত্তর মহাপুরুষের সে খেয়াল ছিল না। কথা বলিতে বলিতে তিনি এত তন্ময় হইয়া যাইতেন যে, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর বসিলেও তাঁহার হুঁশ হইত না। জ্বলন্ত অঙ্গার! সদাসর্বদা তিনি ছিলেন এমনই দেহজ্ঞান-রহিত।
সেই নারী তাঁহারই সহধর্মিণী, তিনি ঐ বালকদের আদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করিতেন; কিন্তু তাঁহার কোন শক্তি ছিল না। আমাদের অপেক্ষা তিনি দরিদ্র ছিলেন। যাহা হউক আমরা সংগ্রামে ঝাঁপ দিলাম। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করিতাম যে, এই ভাবধারা একদিন সমগ্র ভারতবর্ষকে যুক্তিপরায়ণ করিয়া তুলিবে এবং নানা দেশ এবং নানা জাতির কল্যাণসাধন করিবে। এই বিশ্বাস হইতেই স্থির প্রতীতি জন্মিল যে, এই ভাবরাশি নষ্ট হওয়া অপেক্ষা কয়েক জন লোকের দুঃখ-বরণ করা ভাল। একজন মা ও দুইটি ভাই যদি মরে, কি আসে যায়? এও তো ত্যাগ। ত্যাগ কর—ত্যাগ ছাড়া কোন মহৎ কার্য সম্পন্ন হয় না। বক্ষ চিরিয়া হৃৎপিণ্ড বাহির করিতে হইবে এবং সেই রক্তসিক্ত হৃদয় বেদীমূলে উৎসর্গ দিতে হইবে। তবেই তো মহৎ কার্য সাধিত হয়। অন্য কোন পথ আছে কি? কেহই সেই পথ আবিষ্কার করিতে পারে নাই। আপনাদের মধ্যে যে-কেহ কোন মহৎ কার্য সাধন করিয়াছেন, তাঁহাকেই ভাবিয়া দেখিতে বলি। সে কী বিরাট মূল্য! সে কী বেদনা! কী নিদারুণ যন্ত্রণা! প্রত্যেকের জীবনে প্রতিটি সফলতার পিছনে কী ভয়ানক দুঃখভোগ থাকে, তাহা তো আপনাদের সকলেরই জানা আছে।
এইভাবেই আমাদের সেই তরুণ দলটির দিন কাটিতে লাগিল। চারিপাশের সকলের নিকটে অপমান ও লাঞ্ছনাই পাইলাম। অবশ্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া অন্ন সংগ্রহ করিতে হইত। এখানে ওখানে দু-এক টুকরা রুটি মিলিত। একটি অতি পুরাতন ভগ্নপ্রায় বাড়ী বাসস্থান হিসাবে জুটিল, উহার তলায় গোখুরা সাপের বাসা, তাহাদের ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনা যাইত। অল্প ভাড়ায় বাড়ী পাওয়ায় আমরা সেই গৃহে গিয়া বাস করিতে লাগিলাম।
এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইল। ইতোমধ্যে ভারতের সর্বত্র পরিভ্রমণ করিলাম। উদ্দেশ্য—ক্রমশঃ এই ভাবধারা প্রচারের চেষ্টা। দশ বৎসর কাটিয়া গেল—কোন আলোকরেখাই দেখিতে পাইলাম না! দশটি বৎসর! সহস্রবার হতাশা আসিল; কিন্তু একটি জিনিষ আমাদের সর্বদা আশান্বিত করিয়া রাখিয়াছিল—সেটি হইল আমাদের পরস্পরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও গভীর ভালবাসা। প্রায় একশত নরনারী আমার চারিপাশে রহিয়াছে; কাল যদি আমি সাক্ষাৎ শয়তান হইয়া যাই, তাহারা বলিবে, ‘আমরা এখনও আছি! আমরা তোমাকে কখনই ত্যাগ করিব না!’ এই ভালবাসাই পরম আশীর্বাদ।
সুখে দুঃখে, দুর্ভিক্ষে যাতনায়, শ্মশানে, স্বর্গে বা নরকে যে আমাকে কখনই ত্যাগ করে না, সে-ই তো বন্ধু। এ বন্ধুত্ব কি তামাসা? এমন বন্ধুত্বের দ্বারা মোক্ষ-লাভও সম্ভব। আমরা যদি এমনভাবে ভালবাসিতে পারি, তবে এই ভালবাসাই আমাদের মুক্তি আনিয়া দিবে। এই বিশ্বস্ততার মধ্যেই একাগ্রতার সার নিহিত। যদি তোমার সেই বিশ্বাস, সেই শক্তি, সেই ভালবাসা থাকে, তবে জগতে তোমার কোন দেবার্চনার প্রয়োজন নাই। সেই দুঃখের দিনে এই ভালবাসাই আমাদের হৃদয়ে সদা জাগ্রত ছিল। সেই ভালবাসাই আমাদিগকে হিমালয় হইতে কন্যাকুমারিকা এবং সিন্ধু হইতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত পরিচালিত করিয়াছিল।
সেই তরুণদলটি এইভাবে সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ করিতে লাগিল। ধীরে ধীরে আমরা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে লাগিলাম। শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধাচরণ পাইলাম, সাহায্য আসিল অতি অল্পক্ষেত্রে। কারণ একটি দোষ আমাদের ছিল—আমরা ছিলাম দুঃখদারিদ্র্যে রুক্ষচিত্ত। জীবনে যাহাকে নিজের পথ নিজেই করিয়া লইতে হয়, সে একটু রুক্ষ হয়; শান্ত কোমল ও ভদ্র হইবার—‘ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়া’ ইত্যাদি বলিবার বেশী সময় তাহার থাকে না। নিজেদের জীবনেই আপনারা উহা সর্বদা লক্ষ্য করিয়াছেন। এইরূপ ব্যক্তি যেন একটি আধারে অযত্নরক্ষিত অমসৃণ হীরকখণ্ড।
আমরা ঠিক সেইরূপ ছিলাম। ‘কোন আপস চলিবে না।’—এই ছিল আমাদের মূলমন্ত্র। ‘ইহাই আদর্শ এবং এ আদর্শ কার্যে পরিণত করিতে হইবে। মরিয়াও—রাজার নিকট যেমন এ আদর্শ প্রচার করিব, চাষার নিকট তেমনি এ আদর্শ তুলিয়া ধরিব।’ স্বভাবতই আমরা বিরোধিতার সম্মুখীন হইলাম।
কিন্তু মনে রাখিবেন, ইহাই জীবনের অভিজ্ঞতা; যদি আপনি যথার্থই পরের মঙ্গল কামনা করেন, বিশ্বজগৎ আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াও কিছুই করিতে পারিবে না। আপনার শক্তির নিকট তাহারা পরাস্ত হইবেই। যদি আপনি আন্তরিক ও প্রকৃতই নিঃস্বার্থ হন, স্বয়ং ঈশ্বরের সমস্ত শক্তি আপনার মধ্যে জাগ্রত থাকিয়া সমস্ত বাধা বিপত্তি চূর্ণ বিচূর্ণ করিবে। সেই বালকের দল এমনি ছিল। তাহারা ছিল প্রকৃতির হাত হইতে সদ্যোনিঃসৃত শিশুর মত পবিত্র; গুরুদেব বলিতেন, ‘ভগবানের বেদীমূলে আমি অনাঘ্রাত পুষ্প ও অস্পৃষ্ট ফলই নিবেদন করিতে চাই।’ মহাপুরুষের সেই বাণী আমাদিগকে সঞ্জীবিত করিত। কলিকাতার পথে তিনি যে-সব বালককে যেন কুড়াইয়া পাইয়াছিলেন, তাহাদের ভবিষ্যৎ তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইতেন। ‘এই ছেলেটি বা ঐ তরুণটি ভবিষ্যতে কী হয়, দেখিও’—তাঁহার এই ধরনের কথা শুনিয়া লোকে ঠাট্টা করিত। অবিচলিত বিশ্বাসে তিনি বলিতেন, ‘মা আমাকে ইহা দেখাইয়া দিয়াছেন। আমি নিজে দুর্বল হইতে পারি, কিন্তু মা যখন এরূপ বলিয়াছেন, তখন তাঁহার ভুল হওয়া কখনও সম্ভব নয়। এইরূপ হইবেই।’
দশটি বৎসর কোন আশার আলো ছাড়াই কাটিয়া গেল। ইতোমধ্যে আমার শরীর ভাঙিয়া পড়িতে লাগিল। কখনও রাত্রি নয়টায় একবেলা আহার কখনও ভোরে আটটায় একবেলা আহার, তাও আবার তিনদিন পরে—এবং সর্বদাই অতি সামান্য কদর্য অন্ন। পরিণামে শরীরের উপর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ভিখারীকে কে-ই বা ভাল খাবার দেয়? আবার ভাল জিনিষ দিবার সামর্থ্যও ভারতবাসীর নাই। শুধু একবেলা আহারের জন্য বেশীর ভাগ সময় পায়ে হাঁটিয়া, তুষারশৃঙ্গ চড়াই করিয়া, কখনও দশ মাইল পথ দুর্গম পর্বত চড়াই করিয়া চলিয়াছি। ভারতবর্ষে রুটিতে খাম্বির দেয় না। কখনও কখনও এই খাম্বির-না-দেওয়া রুটি বিশ-ত্রিশদিন ধরিয়া সঞ্চিত রাখা হয়, তখন ইহা ইঁটের চেয়েও শক্ত হয়। ভিখারীকে সেই রুটির অংশ দেওয়া হয়। একবেলা আহারের বন্দোবস্ত করিবার জন্য আমাকে দ্বারে দ্বারে ফিরিতে হইত। তদুপরি এই ইঁটের মত শক্ত রুটি চিবাইতে গিয়া মুখ দিয়া রক্ত পড়িত। এই রুটি চিবাইতে সত্য সত্যই দাঁত ভাঙে। নদী হইতে জল আনিয়া একটি পাত্রে ঐ রুটি একটি পাত্রে ভিজাইয়া রাখিতাম। মাসের পর মাস ঐভাবে থাকিতে হইয়াছে—ফলে শরীর অবশ্যই খারাপ হইতেছিল।
তারপর ভাবিলাম, ভারতবর্ষে চেষ্টা করিয়াছি, এবার অন্য দেশে করা যাক। এমনি সময় আপনাদের ধর্ম-মহাসভার অধিবেশন হইবার কথা ছিল। ভারতবর্ষ হইতে একজনকে ঐ সভায় প্রেরণ করিতে হইবে। আমি তখন একজন ভবঘুরে। তবু বলিলাম, ‘ভারতবাসী তোমরা আমাকে প্রেরণ করিলে আমি যাইব। আমার কোন ক্ষতির ভয় নাই, ক্ষতি যদি হয় তাহাও গ্রাহ্য করি না।’ অর্থ সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। অনেক দিনের আপ্রাণ চেষ্টায় শুধু আসিবার খরচ যোগাড় হইল; এবং আমি এদেশে আসিলাম। ধর্ম-মহাসভার দুই-এক মাস পূর্বে আমি আসিলাম, এবং পরিচয়হীন অবস্থায় পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইলাম।
তারপর ধর্ম-মহাসভা আরম্ভ হইল, সেই সময় কতিপয় সহৃদয় বন্ধুর সহিত আলাপ হইলে তাঁহারা আমাকে খুবই সাহায্য করিলেন। কিছু কিছু অর্থ-সংগ্রহ, দুইটি পত্রিকা প্রকাশ প্রভৃতি যৎসামান্য কাজ আরম্ভ করিলাম। তারপর ইংলণ্ডে গেলাম। সেখানেও কাজ চলিল। সেই সময় আমেরিকায় থাকিয়াও ভারতের জন্য কাজ চালাইলাম।
ভারতের জন্য আমার পরিকল্পনা যেভাবে রূপ পাইয়াছে এবং কেন্দ্রীভূত হইয়াছে, তাহা এইঃ আমি আপনাদিগকে ভারতের সন্ন্যাসীদের কথা বলিয়াছি। কেমন করিয়া আমরা কোনরূপ মূল্য গ্রহণ না করিয়া অথবা একখণ্ড রুটির মূল্যে দ্বারে দ্বারে ধর্মপ্রচার করিয়া থাকি, তাহাও বলিয়াছি। সেইজন্যই ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের ব্যক্তিও ধর্মের মহত্তম ভাবরাশি ধারণ করে। এ সকলই এই সন্ন্যাসীদের কাজ। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা যায়—‘ইংরেজ কাহারা?’ সে উত্তর দিতে পারিবে না। হয়তো বলিবে, ‘পুঁথিতে যে-সব দৈত্যদানবের কথা আছে—ইংরেজরা তাহাদেরই বংশধর—তাই না?’ ‘তোমাদের শাসন- কর্তা কে?’ ‘জানি না।’ ‘শাসনতন্ত্র কি?’—তাহারা জানে না। কিন্তু দর্শনের মূলতত্ত্ব তাহারা জানে। যে ইহজগতে তাহারা দুঃখকষ্ট ভোগ করে, সেই জগৎ সম্বন্ধে তাহাদের ব্যবহারিক জ্ঞানেরই অভাব। এই সব লক্ষ লক্ষ মানুষ পরলোকের জন্য প্রস্তুত—এই কি যথেষ্ট? কখনই নয়। একটুকরা ভাল রুটি এবং একখণ্ড ভাল কম্বল তাহাদের প্রয়োজন। বড় প্রশ্ন এই, এ-সকল লক্ষ লক্ষ পতিত জনগণের জন্য সেই ভাল রুটি আর ভাল কম্বল কোথা হইতে মিলিবে?
প্রথমেই আপনাদিগকে বলিব, তাহাদের বিপুল সম্ভাবনা রহিয়াছে, কারণ পৃথিবীতে তাহারা সবচেয়ে শান্ত জাতি। তাহারা যে ভীরু, তা নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তাহারা অসুর-পরাক্রমে যুদ্ধ করে। ইংরেজের শ্রেষ্ঠ সৈন্যদল ভারতীয় কৃষক-সম্প্রদায় হইতে সংগৃহীত। মৃত্যুকে তাহারা গ্রাহ্য করে না। তাহাদের মনোভাব এইঃ ‘এ জন্মের পূর্বে অন্তত বিশ বার মরিয়াছি, হয়তো তারপর আরও অসংখ্যবার মরিব। তাহাতে কী আসে যায়?’ তাহারা কখনও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে না। বিশেষ ভাবপ্রবণ না হইলেও যোদ্ধা হিসাবে তাহারা ভাল।
তাহাদের জন্মগত প্রবৃত্তি অবশ্য কৃষিকর্মে। আপনি তাহাদের সর্বস্ব কাড়িয়া লউন, তাহাদের হত্যা করুন, করভারে জর্জরিত করুন, যাহা ইচ্ছা করুন—যতক্ষণ তাহাদিগকে স্বাধীনভাবে ধর্ম আচরণ করিতে দিতেছেন, তাহারা শান্ত ও নম্র থাকিবে। তাহারা কখনও অন্যের ধর্মে হস্তক্ষেপ করে না। ‘আমাদের ভাবানুযায়ী ঈশ্বরের আরাধনা করিবার অধিকার আমাদের দাও আর সব কাড়িয়া লও’—ইহাই তাহাদের মনোভাব। ইংরেজরা যখনই ঐ জায়গায় হস্তক্ষেপ করে, অমনি গণ্ডগোল শুরু হয়। উহাই ১৮৫৭ খ্রীঃ সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ—ধর্ম লইয়া নির্যাতন ভারতবাসী সহ্য করিবে না। ভারতবাসীর ধর্মে হস্তক্ষেপ করিতে গিয়াই বিশাল মুসলমান রাজ্যগুলি একেবারে ফাটিয়া বিলয় পাইল।
অধিকন্তু ভারতের জনসাধারণ শান্ত, নম্র, ভদ্র—সর্বোপরি তাহারা পাপাসক্ত নয়। কোনপ্রকার উত্তেজিত মাদকদ্রব্য প্রচলিত না থাকায় তাহারা অন্য যে কোন দেশের জনসাধারণ অপেক্ষা অনন্ত গুণে শ্রেষ্ঠ। এখানকার বস্তি-জীবনের সহিত তুলনা করিয়া আপনারা ভারতবর্ষের দরিদ্র জনসাধারণের সুন্দর নৈতিক জীবন বুঝিতে পারিবেন না। বস্তি মানেই দারিদ্র্য! কিন্তু ভারতবর্ষে দারিদ্র্যের অর্থ পাপ, অশ্লীলতা ও অপরাধ-প্রবণতা নয়। অন্যান্য দেশে এমন ব্যবস্থা যে, নোংরা ও অলস ব্যক্তিরাই দারিদ্র্য হয়! নগর-জীবন ও উহার বিলাসব্যসন চায়, এমন মূর্খ বা বদমাশ ব্যতীত আর কাহাকেও এ-সব দেশে দরিদ্র থাকিতে হয় না। তাহারা কিছুতেই গ্রামে যাইবে না। তাহারা বলে, ‘আমরা এই শহরেই বেশ ফূর্তিতে আছি। তোমরা অবশ্যই আমাদের আহার যোগাইবে।’ ভারতবর্ষের ব্যাপার এরূপ নয়, সেখানে গরীবেরা উদয়াস্ত খাটিয়া মরে, আর এক জন আসিয়া তাহাদের শ্রমের ফল কাড়িয়া লয়। তাহাদের সন্তানেরা উপবাসী থাকে। লক্ষ লক্ষ টন গম ভারতে উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও ক্বচিৎ কখনও একটি কণা কৃষকের মুখে যায়। আপনারা পশু-পক্ষীকেও যে শস্য খাওয়াইতে চান না, ভারতের কৃষক সেই শস্যে প্রাণধারণ করে।
এই পবিত্র সরল কৃষককূল কেন দুঃখভোগ করিবে? ভারতের নিমজ্জমান জনসাধারণ ও অবনমিত নারীসমাজের কথা আপনারা এত শুনিতে পান, কিন্তু কেহই তো আমাদের সাহায্য করিতে অগ্রসর হন না। অনেকে বলেনঃ ‘তোমরা যদি আমাদের নিজেদের স্বভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তন কর, তবেই তোমরা ভাল হইবে, তবেই তোমাদের সাহায্য করা চলে। হিন্দুদের সাহায্য করা বৃথা।’ কিন্তু ইঁহারা বিভিন্ন জাতির ইতিহাস জানেন না। ভারতবাসী যদি তাহাদের ধর্ম ও আনুষঙ্গিক রীতিনীতিগুলি পরিবর্তন করে, তবে আর ভারতবর্ষ থাকিবে না, কারণ ধর্মই ভারতবাসীর প্রাণশক্তি। ভারতীয় জাতিই লুপ্ত হইয়া গেলে আপনাদের সাহায্য গ্রহণ করিবার জন্য সেখানে আর কেহই থাকিবে না।
আর একটি মহৎ শিক্ষণীয় বিষয় আছে, বস্তুতঃ আপনারা কাহাকেও সাহায্য করিতে পারেন না। আমরা কে কাহার জন্য কি করিতে পারি? আপনি আপনার রীতি অনুসারে গড়িয়া উঠিতেছেন, আর আমি আমার ভাবে। সকল পথই শেষ পর্যন্ত রোমে আসিয়া মিলিত হয়—এ কথাটি মনে রাখিয়া আমি হয়তো আপনাদের জীবনে কিছুটা গতি সঞ্চার করিতে পারি। জাতীয় জীবন ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠে। এ পর্যন্ত কোন জাতিগত সভ্যতাই সম্পূর্ণ সার্থক হয় নাই। ঐ সভ্যতাকে কিছুটা আগাইয়া দাও, তবেই উহা স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছিবে। ঐ সভ্যতাকে আমূল পরিবর্তিত করিতে চেষ্টা করিবেন না। একটি জাতির প্রচলিত প্রথা, নিয়মকানুন, রীতিনীতি বাদ দিলে তাহার আর কী অবশিষ্ট থাকে? ঐগুলিই জাতিকে সংহত করিয়া রাখে।
কিন্তু অতি পণ্ডিত এক বিদেশী আসিয়া বলিলেন, ‘দেখ, তোমাদের সহস্র বৎসরের রীতিনীতি নিয়ম-কানুন ছাড়িয়া দিয়া আমার এই নিরেট পাত্রটি গ্রহণ কর।’—ইহা নিতান্ত মূর্খতা।
পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করিতে হইবে, কিন্তু এ-বিষয়ে আমাদের আর একটু অগ্রসর হইতে হইবে। সাহায্য করিতে গিয়া নিঃস্বার্থ হওয়ার প্রয়োজন। ‘আমি তোমাকে যেরূপ করিতে বলি, ঠিক সেরূপ করিলে তবে তোমায় সাহায্য করিব, নতুবা নয়।’—ইহার নাম কি সাহায্য?
অতএব হিন্দু যদি তোমাদিগকে আধ্যাত্মিক সাহায্য করিতে চায়, সে সাহায্যে নিয়ন্ত্রণের কোন প্রশ্ন থাকিবে না; সাহায্য—সেবা, পূর্ণ নিঃস্বার্থতা। আমি দিলাম, এখানেই উহা শেষ। আমার নিকট হইতে উহা চলিয়া গেল। আমার মন, আমার শক্তি, আমার যাহা কিছু দিবার আছে, সব দিয়াছি, দেওয়ার ভাব লইয়াই দিয়াছি, আর কিছু নয়। অনেক সময় দেখিয়াছি, যাহারা অর্ধেক পৃথিবী শোষণ করিয়া ফিরিয়াছে, তাহারাই ‘অসভ্য’ হিদেনদিগকে ধর্মান্তরিত করিবার কাজে কুড়ি হাজার ডলার দান করিয়াছে। কিসের জন্য? ঐ হিদেনদের উপকারের জন্য, না তাহাদের নিজেদের আত্মার পরিত্রাণের জন্য? একবার ভাবিয়া দেখুন দেখি।
পাপের সমুচিত ফল ফলিতেছে। আমরা মানুষেরা নিজের চক্ষুকেই ফাঁকি দিতে চাই। কিন্তু অন্তরের অন্তস্তলে স্ব-স্বরূপে তিনি সদা বিরাজিত। তিনি তো কোনদিন ভোলেন না। আমরা কোনদিনই তাঁহাকে প্রতারিত করিতে পারি না। তাঁহার চোখকে কখনই ফাঁকি দেওয়া যায় না। যথার্থ পরোপকারের প্রেরণা সহস্র বৎসর পরেও ফলবতী হয়। বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সুযোগ পাইলেই তাহা আবার বজ্রের মত ফাটিয়া পড়িতে চায়। আর যে ভাবাবেগের পশ্চাতে স্বার্থান্বেষী মনোবৃত্তি থাকে—সংবাদপত্রে শিরোনামার সমারোহ
এবং লক্ষ লক্ষ লোকের করতালি লাভ করিলেও উহার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইবেই। আমি কোন প্রকার গর্ব করিয়া বলিতেছি না, কিন্তু মনে রাখিবেন—আমি আপনাদিগকে সেই মুষ্টিমেয় যুবকদের কথা বলিতেছি। আজ ভারতবর্ষে এমন একটি গ্রাম নাই, এমন নরনারী নাই, যাহারা তাহাদের কাজ জানে না এবং তাহাদিগকে আন্তরিক আশীর্বাদ করে না। এমন একটি দুর্ভিক্ষ নাই, যেখানে এই যুবকদল ঝাঁপাইয়া পড়িয়া যতগুলি মানুষকে পারে বাঁচাইবার চেষ্টা করে না। এই সেবা হৃদয়কে স্পর্শ করিবেই। দেশবাসী তাহাদের কথা জানিতে পারিয়াছে। যখনই সম্ভব, তাহাদের সাহায্য করুন, কিন্তু সেই সাহায্যের পিছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করিতেছে, লক্ষ্য রাখিবেন। স্বার্থপূর্ণ হইলে সেই দান দাতা বা গ্রহীতা—কাহারও উপকারে আসিবে না। সাহায্য যদি নিঃস্বার্থ হয়, তবে উহা গ্রহীতার পক্ষে কল্যাণকর হইবে, এবং লক্ষগুণ কল্যাণকর হইবে আপনার নিজের পক্ষে; আপনার জীবন যেমন সত্য, এ-কথা তেমনি নিশ্চিত সত্য, জানিবেন। জগদীশ্বরকে কখনও ফাঁকি দেওয়া যায় না। কর্মফলকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। সুতরাং আমার পরিকল্পনাগুলি ভারতের জনগণকে লক্ষ্য করিয়া। ধরুন, আপনি সমগ্র ভারতবর্ষে বিদ্যালয় স্থাপন করিতে শুরু করিলেন, তথাপি আপনি তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে পারিবেন না। কেমন করিয়া পারিবেন? চার বৎসরের একটি ছেলে বরং লাঙ্গল ধরিবে, অথবা অন্য কোন কাজ করিবে, তবু সে আপনার বিদ্যালয়ে পড়িতে যাইবে না। তাহার পক্ষে বিদ্যালয়ে যাওয়া অসম্ভব। আত্মরক্ষাই মানুষের প্রথম প্রেরণা। কিন্তু যদি পর্বত মহম্মদের কাছে না আসে, মহম্মদকেই পর্বতের নিকট যাইতে হইবে। আমি বলি, শিক্ষা কেন দ্বারে দ্বারে যাইবে না? চাষার ছেলে যদি বিদ্যালয়ে আসিতে না পারে, তাহা হইলে কৃষিক্ষেত্রে অথবা কারখানায়—যেখানে সে আছে, সেখানেই তাহাকে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে। ছায়ার মত তাহার সঙ্গে সঙ্গে যাও। শত সহস্র সন্ন্যাসী জনসাধারণকে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিদ্যা দান করিতেছেন; কেন এই সন্ন্যাসীরাই জাগতিক ক্ষেত্রেও বিদ্যাবুদ্ধি বিতরণ করিবেন না? জনসাধারণের কাছে তাঁহারা ইতিহাস বা অন্যান্য বহু বিষয়ের কথা বলিবেন না কেন? শ্রবণের মাধ্যমেই শ্রেষ্ঠ শিক্ষা লাভ হয়। যে শিক্ষা আমরা মায়েদের কাছ হইতে কানে শুনিয়া লাভ করিয়াছি, উহাই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। গ্রন্থাদি অনেক পরে দেখা দিয়াছে। পুঁথিগত বিদ্যা কিছুই নয়। কানে শুনিয়া আমরাই চরিত্র-গঠনকারী শ্রেষ্ঠ নীতিসমূহ পাই। তারপর জনসাধারণের আগ্রহ যখন বাড়িবে, তখন তাহারা আপনাদের বইও পড়িবে। প্রথমে কাজ শুরু করিয়া দেওয়া যাক—ইহাই আমার মনোভাব।
দেখুন, আপনাদিগকে অবশ্যই বলিব সন্ন্যাস-ব্যবস্থায় আমি খুব বেশী বিশ্বাসী নই। ঐ ব্যবস্থার অনেক গুণ আছে, অনেক দোষও আছে। সন্ন্যাসী ও গৃহস্থদের মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য থাকা উচিত। কিন্তু ভারতে সন্ন্যাস আশ্রমের প্রতিই সমস্ত শক্তি আকৃষ্ট হইয়াছে। আমরা সন্ন্যাসীরা শ্রেষ্ঠ শক্তির প্রতীক। সন্ন্যাসী রাজার চেয়ে বড়। ভারতবর্ষে এমন কোন শাসক-নৃপতি নাই, যিনি ‘গৈরিকবসন’-ধারীর সম্মুখে বসিয়া থাকিতে সাহস করেন। তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়ান। যদিও এই সন্ন্যাসীরাই জনগণের আত্মরক্ষার প্রধান অবলম্বন। তবুও ভাল লোকের হাতেও এত ক্ষমতা থাকা ঠিক নয়। সন্ন্যাসীরা পৌরোহিত্য ও অধ্যাত্মজ্ঞানের মাঝখানে দণ্ডায়মান। তাঁহারা জ্ঞানবিস্তার ও সংস্কারের কেন্দ্রস্বরূপ! ইঁহারা ঠিক য়াহুদীদের ভাববাদীদের (Prophets) মত, এই মহাপুরুষগণ সর্বদা পৌরোহিত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া কুসংস্কার দূর করিবার চেষ্টা করিতেন। ভারতবর্ষের সন্ন্যাসীরাও এই ধরনের। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও এতখানি ক্ষমতা সেখানে ভাল নয়। অন্য কোন উন্নততর পন্থা আবিষ্কার করিতে হইবে। কিন্তু স্বল্পতম বাধার পথেই কাজ করা সম্ভব। সমগ্র জাতির আত্মা সন্ন্যাসের পক্ষপাতী। আপনি ভারতবর্ষে গৃহস্থরূপে কোন ধর্ম প্রচার করুন, হিন্দু জনসাধারণ বিমুখ হইয়া প্রস্থান করিবে। যদি আপনি সংসার ত্যাগ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে হিন্দুরা বলিবে, ‘লোকটি ভাল, সংসার-ত্যাগী, খাঁটি লোক, মুখে যা বলে কাজেও তাই করে।’ আমি যাহা বলিতে চাহিতেছি, তাহা এই যে সন্ন্যাস একটি অসাধারণ শক্তির প্রতীক। আমরা এইটুকু করিতে পারি, ইহার রূপান্তর সাধন করিতে পারি, অন্য রূপ দিতে পারি—পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের হাতে অবস্থিত এই প্রচণ্ড শক্তির রূপান্তর ঘটাইতে হইবে, উহাই জনসাধারণকে উন্নত করিয়া তুলিবে।
পরিকল্পনাটি এতক্ষণে কাগজে কলমে সুন্দরভাবে লিখিত হইয়াছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলি, আমি আদর্শবাদের স্তর হইতেই এ পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছিলাম। এ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি শিথিল ও আদর্শবাদীই ছিল। যত দিন যাইতে লাগিল, ততই উহা সংহত ও নিখুঁত হইতে লাগিল; প্রকৃত কর্মক্ষেত্রে নামিয়া আমি উহার ত্রুটি প্রভৃতি লক্ষ্য করিলাম।
বাস্তব ক্ষেত্রে ইহার প্রয়োগ করিতে গিয়া আমি কী আবিষ্কার করিলাম? প্রথমতঃ এই সন্ন্যাসীদের কি ভাবে লোকশিক্ষা দিতে হইবে সেই বিষয়ে শিক্ষিত করিয়া তুলিবার কেন্দ্র থাকা প্রয়োজন। যেমন ধরুন, আমার একটি লোককে আমি ক্যামেরা দিয়া পাঠাইলাম; তাহাকে ঐ-সকল বিষয়ে সর্বপ্রথম শিক্ষিত হইতে হইবে। ভারতবর্ষে প্রায় সব লোকই অশিক্ষিত, সুতরাং শিক্ষার জন্য প্রচণ্ড শক্তিশালী বহু কেন্দ্র প্রয়োজন। ইহার অর্থ কি দাঁড়ায়?—টাকা। আদর্শবাদের জগৎ হইতে আপনি প্রতিদিনের কর্মক্ষেত্রে নামিয়া আসিলেন।
আমি আপনাদের দেশে চার বৎসর ও ইংলণ্ডে দুই বৎসর কঠোর পরিশ্রম করিয়াছি। কয়েকজন বন্ধু আমাকে সাহায্য করিয়াছেন বলিয়া আমি কৃতজ্ঞ। তাঁহাদের একজন আজ আপনাদের মধ্যেই এখানে আছেন। আমেরিকান ও ইংরেজ বন্ধুরা আমার সঙ্গে ভারতে গিয়াছেন এবং অতি-সাধারণভাবে কাজের সূচনা হইয়াছে। কয়েকজন ইংরেজ সঙ্ঘে যোগদান করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে এক বেচারী তো অতিরিক্ত পরিশ্রম করিয়া ভারতে মৃত্যুই বরণ করিলেন। এক ইংরেজ দম্পতি অবসর গ্রহণ করিয়া, নিজেদের সামান্য যাহা কিছু সংস্থান আছে, তাহা দ্বারা হিমালয়ে একটি কেন্দ্র স্থাপন করিয়া শিক্ষা প্রচার করিতেছেন। আমি তাঁহাদিগকে আমার দ্বারা স্থাপিত ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ (Awakened India) নামে একটি পত্রিকার ভার দিয়াছি। তাঁহারা জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাদান ও অন্যান্য কাজে ব্রতী আছেন। আমার আর একটি কেন্দ্র আছে কলিকাতায়। সকল বৃহৎ আন্দোলনই রাজধানী হইতে আরম্ভ করা প্রয়োজন। রাজধানী কাহাকে বলে? রাজধানী একটি জাতির হৃৎপিণ্ড। সমুদয় রক্ত হৃৎপিণ্ডে আসিয়া জমা হয়, সেখান হইতে সর্বত্র সঞ্চারিত হয়; তেমনি সব সম্পদ্, সব ভাবাদর্শ, সব শিক্ষা, সব আধ্যাত্মিকতা প্রথমে রাজধানীর অভিমুখে গিয়া সে-স্থান হইতে অন্যত্র সঞ্চারিত হয়।
আপনাদিগকে আমি আনন্দের সহিত বলি যে, সাধারণভাবে কাজটি আরম্ভ করিতে পারা গিয়াছে। কিন্তু ঠিক ঐরূপ কাজ আমি সমান্তরালভাবে মেয়েদের জন্যও করিতে চাই। আমার আদর্শ—প্রত্যেকে স্বাবলম্বী হইবে। আমার সাহায্য শুধু দূর হইতে। ভারতীয় নারী, ইংরেজ নারী এবং আশা করি, আমেরিকান নারীরাও এই ব্রত গ্রহণ করিবে। যখনই তাহারা কাজে হাত দিবে, অমনি আমি হাত গুটাইয়া লইব। কোন পুরুষ নারীর উপর হুকুম চালাইবে না। কোন নারীও পুরুষের উপর হুকুম চালাইবে না। প্রত্যেকেই স্বাধীন। যদি কোন বন্ধন থাকে, তবে তাহা কেবল প্রীতির বন্ধন। পুরুষ নারীর জন্য যাহা করিয়া দিতে পারে, তাহা অপেক্ষা নারী অনেক ভালভাবে নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করিবে। পুরুষেরা মেয়েদের ভাগ্য গঠনের ভার গ্রহণ করাতেই নারীজাতির যত কিছু অনিষ্ট হইয়াছে। একটি প্রারম্ভিক ভুল লইয়া আমি কাজ শুরু করিতে চাই না। একটি ক্ষুদ্র ভ্রান্তি ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া চলিবে এবং শেষ অবধি এত বৃহৎ আকার ধারণ করিবে যে, উহাকে সংশোধন করা কঠিন হইয়া পড়িবে। সুতরাং আমি যদি ভুল করিয়া পুরুষকে নারীর কর্মধারা নির্ণয় করিবার কাজে লাগাই, তাহা হইলে নারীরা কখনও ঐ নির্ভরতার ভাব হইতে মুক্ত হইতে পারিবে না—উহাই প্রথা হইয়া দাঁড়াইবে। কিন্তু আমার একটি সুবিধা আছে। আপনাদিগকে আমার গুরুদেবের সহধর্মিণীর কথা বলিয়াছি। আমাদের সকলেরই তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তিনি কখনও আমাদের উপর হুকুম চালান না। সুতরাং ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কর্মের এই অংশটি নিষ্পন্ন করিতে হইবে।