স্বপ্নের জাদুকরী – শৈলেন ঘোষ
আঃ কী ভালোই না লাগে এখন, এই সকালটা। আর তো মাত্তর কটা দিন। কদিন পরেই মা-দুর্গা ঘরে আসবেন। পুজো বসবে। ড্যাম-কুড়-কুড় বাদ্যি বাজবে।
দেখ না, কদিন আগেও তো আকাশ মেঘে-মেঘে ঢেকে ছিল। কদিন ধরে আকাশ ভেঙে বর্ষার সে কী দাপাদাপি! আর এখন? না, এখন মেঘও নেই, ঝমঝমানি বিষ্টিও নেই। যেমন তারা দল বেঁধে এসেছিল, তেমনি দল বেঁধে কোথায় যে পাড়ি দিয়েছে, আকাশের কোন রাজ্যে কে জানে! এখানে এখন তকতকে আকাশের বুক-ভরতি ঝকঝকে নীল আলো। আঃ! মুঠো-মুঠো খুশির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, এদিক ওদিক, চারিদিকে। ওই আলোর মতো খুশি হয়ে দূরে আকাশের দোলনায় দুলতে-দুলতে দুধ-ধবধব মেঘের দল যখন উড়ে যায়, কিংবা ধরো মেঘের সঙ্গে সাদা-ধবধব বকের পাঁ বভতি উড়তে-উড়তে হারিয়ে যায়, তখন স্থির হয়ে চেয়ে-চেয়ে দেখে হীরালাল। ভারি ভালো লাগে হীরালালের ওই আকাশ আর মেঘ দেখতে। ইচ্ছে করে ওই বকের মতো উড়তে, লুকোচুরি খেলতে, মেঘের সঙ্গে, আলোর সঙ্গে। দেখতে-দেখতে হঠাৎ এমন আনমনা হয়ে যায় হীরালাল। হঠাৎ আনমনা ওর মনের কোণে দিদির কথা ভেসে ওঠে। মন বলে, এই সময় যদি দিদি থাকত!
দিদিকে হীরালালের মনে নেই। হীরালাল যখন খুব ছোট্ট, হাঁটতে গিয়ে ছোট্ট পা দুটি যখন তার টুলটুল করে টলে পড়ত, কিংবা হাতের পাতা দুটি তার খুশির আনন্দে দুলে-দুলে ঢেউ খেলত, সেই তখন থেকে দিদি নেই। এখন তবে কেমন করে মনে পড়বে হীরালালের দিদির মুখখানি, চোখ দুটি?
মায়ের কাছে দিদির গল্প কত শুনেছে হীরালাল। এই পুজোর সময় দিদি যখন সাজত, তখন নাকি ভারি সুন্দর লাগত দিদিকে। ডাগর-ডাগর চোখে কাজল পরত। পায়ে আলতা দিত। কপালে কাঁচপোকার টিপ সাজিয়ে হীরালালকে কোলে নিয়ে ঠাকুর দেখতে যেত। কিন্তু এখন? এখন হীরালাল একা। মা বলেছে, দিদি নাকি মেঘের দেশে চলে গেছে। তাই এই পুজোর সময়, ওই নীল আকাশের মেঘ দেখতে-দেকতে হীরালাল ভাবে মেঘের দেশ কোন দেশে? সেই দেশে যাবে সে। দিদিকে সে ডেকে আনবে।
হীরালাল তোমার মতো। হয়তো বা তোমার চেয়ে একটু বড়ো। ভারি মিষ্টি চোখ দুটি তার। সারাক্ষণ দোল খাচ্ছে। হঠাৎ যদি কান্না-ছোঁয়া দুঃখ এসে ওর বুকের মধ্যে আলতো-হাওয়ায় কেঁপে ওঠে, তবু ও চোখের পাতা দুটি ভিজতে দেবে না। দুঃখ হলে ও মার কাছে ছুটে যাবে। মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরবে। মা যখন জিজ্ঞেস করবে, ‘কী রে, কী হল?’ তখন হীরালাল আঁচল থেকে মুখ সরিয়ে মায়ের চোখ দুটির দিকে চাইবে। চেয়ে-চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলবে, ‘কিছু না।’
মাঝে-মাঝে মায়ের জন্যেই থির হয়ে কেঁপে ওঠে হীরালাল। যখন দিদি ছিল, তখন এক-কথা। এখন মা ভারি একা। একা-একাই সারাদিন কত কাজ করবে মা। না করলে চলবেই বা কেমন করে। হীরালালের বড়ো হতে এখনও অনেক দেরি। যতদিন না বড়ো হচ্ছে হীরালাল, ততদিন দুধের ঘটি নিয়ে মাকে বাড়ি বাড়ি দুধ বেচে আসতেই হবে। কোন সকালে উঠবে মা। সেই গরমের দিনে, তখনও আকাশে ভোরের আলো ফুটবে না, পাখি ডাকবে না। চারদিক নির্মূপ। শুধু শোনা যাবে বাড়ির কোল ঘেঁষে ছোট্ট নদীর ছুটে চলার তিরতির শব্দ, তখন মা উঠবে। কিংবা ধরো, এখন, এই শরতে ভোরের মিষ্টি হাওয়ায় যখন ওই নদীর তীরে-তীরে শুধু কাশের হাওয়ায় নাচনের নূপুর বাজে, তখন মা জাগবে। আবার নয়তো কনকনে শীতের ভোরে তুমি যখন লেপের মধ্যে মুখ লুকিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে ঘুম দাও আর জানতে পার না ঘরের বাইরে গাছের পাতায় একটি-একটি শিশির-ফোঁটা টুপটাপ লাফ দিয়ে খেলা করছে, তখন মায়ের ঘুম ভাঙবে। গোয়ালে যাবে মা। লক্ষ্মীকে খেতে দেবে। লক্ষ্মী ওদের মোষ। কালো কুচকুচ করছে। কেমন নাদুস নুদুস মোষটা। লক্ষ্মীর একটা বাচ্চাও আছে। ঠিক ওর মায়ের মতো, অমনি কালো, অমনি মোটা। সাংঘাতিক দুষ্টু। তুমি যাও না সামনে, এমন মাথা নেড়ে তেড়ে আসবে যে, পালাতে পথ পাবে না। তবে হীরালালকে দেখলে ভারি আনন্দ ওর। তিড়িং-তিড়িং লাফাবে, ছুটবে আর হীরালালের বুকের ওপর মুখ লুকিয়ে আদর করবে। তখন কী ভালোই না লাগে হীরালালের।
মা যখন দুধ বেচে ঘরে ফেরে,তখন আকাশ উপচে রোদ উঠে যায়। বই নিয়ে তখনও পড়বে হীরালাল। তারপর মা এসে পড়া ধরলে,তখন ছুটি।মা এত জানে কী করে? মায়ের মুখে-মুখে কত ছড়া। কত গল্প। এমন কী হীরালালের বই-ভরতি শক্ত-শক্ত বানানগুলো পর্যন্ত মুখস্থ। অবাক হয়ে যায় হীরালাল। হবেই তো! কেননা, হীরালালকে কত কষ্ট করে বানানগুলো শিখতে হয় বল! অবিশ্যি এ-কথা বলি না, পড়তে হীরালালের খারাপ লাগে। ও যতই পড়ে, ততই যেন ওই গাছ আর পাখি, ওই নদী আর মাঠ কিংবা ওই ফুল আর ফড়িং আপন হয়ে মনে-মনে ওর সঙ্গে কথা বলে। জিজ্ঞেস করো না তুমি যা ইচ্ছে। ভাবছ হীরালালকে হারিয়ে দেবে! তবেই হয়েছে। তুমি নিজেই গো-হারান হয়ে বসে পড়বে।
মা এলে, পড়া শেষ করে এক কোঁচড় মুড়ি নেবে হীরালাল। তারপর লক্ষ্মীর পিঠে চেপে ওই নদীর দিকে পাড়ি দেবে। রোজ রোজ। শীতের দিনে তো ওই নদী ঠিক যেন একফালি রুপালি রাংতা। তখন নদীর জল ডিঙিয়ে এ-পার থেকে ও-পার যেতে লক্ষ্মীর কী মজাই না লাগে! যতই বকো,এক-একদিন লক্ষ্মী জল ছেড়ে নড়বেই না। একদিন হয়েছে কী,হীরালাল লক্ষ্মীর পিঠে বসে,মাঝ-নদীতে জলের উপর কোঁচড় থেকে মুড়ি নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঝাঁকে-ঝাঁকে মাছ আসছে! টাপুস-টুপুস মুড়ি খাচ্ছে আর নেচে-নেচে পালিয়ে যাচ্ছে! দেখতে-দেখতে কার না ভালো লাগে! বল, কে না আনমনা হয়ে যায়! ব্যস! যেই না হীরালাল একটু আনমনা হয়েছে, লক্ষ্মী অমনি ঝপাং করে জলের মধ্যে বসে পড়েছে। পড়বি তো পড় হীরালালও চিতপটাং। হীরালালের চোখে জল, মুখে জল। জলে-জলে নাকানিচোবানি। ওঃ! সে কী দারুণ মজা। তাই বলে ভাবছ, হীরালাল বুঝি লক্ষ্মীকে খুব একচোট পিটুনি দিয়েছে। মোটেই না। উলটে হীরালাল খিলখিল করে হেসে উঠে নদীর জলে সাঁতার কাটতে শুরু করে দিল আর টুপটাপ ডুব মেরে লক্ষ্মীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগল। খেলা শেষ হলে লক্ষ্মীর পিঠে চেপে আবার ঘরে ফেরা।
নদীর গা ঘেঁষে ওই যে বনটা, দেখ কী গভীর! গাছের গায়ে গা হেলিয়ে একটা যেন দানব! অন্ধকারে থেকে-থেকে চোখ মটকাচ্ছে! দানবের মাথায় আলুথালু চুল। তার নখের ডগাগুলো যেন খোঁচা খোঁচা ডালপালা! কেউ সামনে গেলেই তাকে খিমচে দেবার জন্যে আঁকপাঁক করছে। দেহটা তার দূর, কত দূর হয়তো অনেক দূর অবধি ছড়িয়ে-মড়িয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
কী জানি কেন, আজই হঠাৎ হীরালালের চোখ দুটি বনের দিকে তাকিয়ে থমকে যায়! বনের গভীরে ও যায়নি কোনোদিন! এতদিন এই পথে ও লক্ষ্মীর পিঠে চেপে কতবার আনাগোনা করেছে, কিন্তু এমন করে সে তো কোনোদিন বনের দিকে তাকিয়ে দেখেনি! অবাক চোখে দাঁড়িয়ে আজই ও প্রথম ভাবল, কী আছে। এই বনের গভীরে! দেখে এলে হয় না!
হঠাৎ এ কী! এমন কেন হল! এক টুকরো কালো মেঘে আকাশের সূর্য কেন ঢেকে গেল! এই তো রোদ ঝলমল দিন ছিল! কোত্থেকে মেঘ এল! আলোর বুঝি রাগ হয়েছে, তাই মুখ ভার করেছে!
বনের ভেতর যেতে-যেতেও যাওয়া হল না হীরালালের। বলা তো যায় না। শরৎ-মেঘের মন বোঝা ভার! কখন তিনি কোনখানে যে ঝমঝমিয়ে নেমে পড়বেন, কেউ জানে না। না থাক। আজ না, কাল যাওয়া যাবে। ঘরের দিকে মুখ ফেরাল হীরালাল।
‘হীরালাল!’ হঠাৎ কে যেন ভারি আদর করে ডাকল তাকে! এতো একটি মেয়ের গলার স্বর! এ ডাক তো তার চেনা নয়! দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকাল হীরালাল, এ-পাশে ও-পাশে! না, কাউকে তো সে দেখতে পাচ্ছে না। তবে কি সে ভুল শুনল। হবেও বা! হীরালাল লাফ দিয়ে লক্ষ্মীর পিঠের ওপর বসে পড়ল। তারপর হাঁক দিল, ‘হ্যাট-হ্যাট। লক্ষ্মী হাঁটা দিল।
ক-পা-ই বা গেছে লক্ষ্মী, আবার আচমকা তেমনি করে ডাক দিল মেয়েটি, হীরালাল!’
চমকে উঠল হীরালাল। অবাক কাণ্ড! তক্ষুনি একটা দমকা হাওয়া শনশনিয়ে ঝাঁপটা মেরে বয়ে গেল বনের ডালে-ডালে। মেঘে-মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ! এ কী! ঝড় উঠল যে! ঝড়ের ঝাঁপটায় ধুলোর ঘূর্ণি ছোটে সাঁই-সাঁই! ছুটতে-ছুটতে হীরালালের মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘হীরালাল।’
হীরালালের মনে হল, সেই ডাক ঝড়ের সঙ্গে বনের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। নিমেষের মধ্যে লক্ষ্মীর পিঠ থেকে লাফ দিল মাটিতে। তারপর চিৎকার করে বনের দিকে ছুটল, ‘কে!
হয়তো দুর্যোগ মাথায় নিয়ে হীরালাল বনের মধ্যেই ছুটে যেত! তারপর যে কী হত কেউ জানে না। কিন্তু এমনই সময়ে হঠাৎ মা ডাকল, হীরালাল।
ছোটা হল না। ছুটতে-ছুটতে থামল হীরালাল। কান পেতে আবার শুনল ঝড়ের শব্দে মায়ের ডাক, ‘হীরালাল, ঘরে আয়, ঝড় উঠেছে!’
‘যাচ্ছি মা।’ হীরালাল চেঁচিয়েই উত্তর দিল। মায়ের ডাক শুনে বনের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেই ওর মনে হল, বনটা যেন ঝড়ের ঝাঁপটায় মাথা ঝাঁকিয়ে হীরালালকে ঠাট্টা করছে। ওই তো, হাজার-হাজার গাছের পাতা হীরালালের বিপদ দেখে একসঙ্গে কেমন হাততালি দিচ্ছে দেখ! কিছু বলার নেই হীরালালের। কাকে বলবে? বনকে, না গাছকে? তাই চটপট লক্ষ্মীর পিঠে বসে ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে-করতে হীরালাল ঘরে ছুটল!
সত্যিই অবাক কথা। কেননা, হীরালাল সকালে ঘুম থেকে যখন উঠল, তখন তো মেঘ ছিল না! কে বুঝবে তখন, একটু পরে ঝড় উঠবে! তখন, কেমন মিষ্টি হাওয়া শিউলি গাছে দোল খাচ্ছিল আর ঝরা-ফুলে শিউলিতলা ভরে যাচ্ছিল। আর এখন? আকাশের মনের কথা কেউ জানে না, কেউ জানে না। এই বৃষ্টি এল যদি, এই উঠল রোদ। এই ছায়া ভরে গেল, এই ফুটল আলো!
ঝড় থামল বটে, কিন্তু মেঘ কাটল না। আজ আর ঘর থেকে বেরুল না হীরালাল। ভারি ছটফট করছিল তার মনটা। তখন কে তাকে ডাকল? কাউকে তো দেখতে পেল না হীরালাল! ওই বনে যে থাকে, সে তার নাম জানে! যতই ভাবছে, মন তার বার-বার ছুটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এখনি যাই, খুঁজে আসি!
মেঘ কাটেনি বলেই আজ আকাশে তারা ফোটেনি। হীরালাল কতবার ছুটে-ছুটে উঠে এসেছে এই উঠানে। কতবার থেকে-থেকে উঁকি মেরেছে দূর আকাশে! কিন্তু দেখ, তারার আকাশ আজ মুখে-চোখে অন্ধকারের কালি মেঘে চোখ মটকাচ্ছে। হীরালাল যতই দেখছে, বুকটা তার কেমন যেন নিরাশ হয়ে কেঁপে উঠছে। মন ভাবছে, কাল যদি মেঘ না কাটে!
মনের ভাবনা মনে নিয়েই হীরালাল রাতেরবেলা মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমোবার আগে শুধু একটিবার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা, মেঘ কেন করে?’
মা বলেছিল, ‘মেঘ না করলে বিষ্টি হবে কেন? বিষ্টি না হলে ফুল ফুটবে কেন? ফুল না ফুটলে পুজো হবে কেমন করে দুয়াঠাকুরের?’
মায়ের কথা শুনে খানিক চুপ করে ছিল হীরালাল। তারপর আবার বলেছিল, ‘আচ্ছা মা, দিদি না থাকলেও কেন পুজো হয়?’
মায়ের মুখের কথা হীরালালের এই একটি কথায় আর কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। অন্ধকার এই ঘুমের রাতে হীরালাল দেখতে পায়নি মায়ের চোখ দুটি। দেখেনি চোখ দুটি উছলে গেছে জলে-জলে। হঠাৎ এমন নিস্তব্ধ আর নিথর হয়ে গেল চারিদিক। হীরালালের নিজেরই অবাক লাগছে! কী হল, মা কেন কথা কয় না। আর তখনই হঠাৎ মায়ের হাতের নরম আঙুলগুলি হীরালালের কপাল ছুঁয়ে কেঁপে উঠল। হীরালাল মায়ের গলাটি জড়িয়ে ধরল। তখন তার মনে হল, বাইরে ওই ঝিঁঝিগুলো যেন ডাকতে-ডাকতে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। ওরা একটু থামলে পারে না।
থামল। কেননা, বাইরে টাপুর-টুপুর বিষ্টি নামল। হীরালালের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। মন ভাবল, এ বিষ্টি যদি আর না থামে! কাল সকালে উঠে, তাহলে কেমন করে বনে যাবে সে! কেমন করে খুঁজবে তাকে। যে ওর নাম ধরে ডেকে-ডেকে বনের মধ্যে হারিয়ে গেল! আহা! কত যেন আদর-মাখা মিষ্টি-সুরের সে ডাক, ‘হীরালাল, হীরালাল!’ এখনও হীরালালের কানে-কানে বাজছে সেই সুর। শুনতে-শুনতে ঘুমের আবেশ যেন আপনা থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে হীরালালের চোখ দুটিতে। আধো-আধো ঘুমে-ঘুমে ও ভাবে, দিদিও কি তাকে ওই নামে ডাকত, ‘হীরালাল, হীরালাল।’
না। মা বলছে, দিদি ডাকত, ‘হীরামন, হীরামন।’ ডাকতে-ডাকতে দিদি তাকে কোলে নিয়ে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুট দিত। তারপর ছুটতে-ছুটতে হারিয়ে যেত।
ভাবতে-ভাবতে শেষ হয়ে গেল ভাবনা। ঘুমিয়ে পড়ল হীরালাল।
.
আজ অনেক সকাল-সকাল উঠেছিল হীরালাল। বিষ্টি থেমেছে। আঃ! আলো, আলো, চারিদিকে আলো। আকাশের নীল পোশাকে আলোর রোশনাই চমক দিয়ে ঠিকরে পড়ছে আকাশ থেকে মাটিতে। খুশিতে দু হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল হীরালাল। তারপর ছুট দিল হীরালাল। ছুট দিল বনের দিকে। যেন আলোর পিছনে আর-এক আলো!
আজ ভারি শান্ত বনের গাছপালা। বিষ্টির জলে চান করে ঝলমলিয়ে উঠেছে গাছের পাতারা। এ-পাতার জল এখনও ও-পাতায় টুপটাপ লাফ দিয়ে খেলা করছে। যদিও ভিজে মাটি কাদা-কাদা, তবু হীরালাল ছুটতে-ছুটতেই বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
হঠাৎ দাঁড়াল কেন হীরালাল! দেখ, কী ভয়ংকর থমথম করছে এখানটা, বনের সামনেটা। এত অন্ধকার কেন! পাতার ফাঁকে-ফাঁকে টুকরো আলোর ফুলকিটুকু পর্যন্ত উঁকি মারছে না।
ভয় পেল না হীরালাল। সেই অন্ধকার বনের ভেতরে, এ-গাছ ও-গাছ জড়িয়ে ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে সে এগিয়ে চলল। ডাগর-ডাগর চোখে তার অবাক-অবাক চাউনি। অবাক চোখ দুটি তার ইতি-উতি খুঁজছে কাকে? খুঁজছে তাকে, যে ডেকেছে তার নাম ধরে।
খুঁজতে খুঁজতে আরও একটু ভেতরে যখন চলে গেছে হীরালাল, তখন কী গহন! যে পথ দিয়ে এসেছে, সে-পথও তো আর দেখা যায় না। গাছে-গাছে ঢেকে গেছে। ভারি নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ চারিদিক। গাছে পাখি নেই, কোনো সাড়া নেই। শুধু ভিজে পাতায় হীরালালের পায়ে চলার খসখসানি শব্দ শুনে নির্জন বনটা চমকে উঠছে।
হঠাৎ শিউরে উঠল হীরালাল। ওখানে গাছের ঝোপটা নড়ে যেন! মস্ত এই গাছটার আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে পড়ল। লুকিয়ে লুকিয়ে উঁকি মারল। সত্যিই তো! নড়ছে, কী ওটা! | দেখে ফেলেছে হীরালাল। স্পষ্ট দেখল, একটা হরিণ। উরিববাস! শিং দুটো দেখ, যেন মাথা ফুড়ে ডাল গজিয়েছে! হলদে গায়ে ছাপ-বাহারি! মুখ উঁচিয়ে কেমন কচি-কচি পাতা খাচ্ছে! খেতে-খেতে কানও নড়ছে। পিড়িং-পিড়িং। ল্যাজও নাচছে, তুড়ক-তুড়ক। এই যাঃ। কী হল দেখ!
হরিণটা তো খাচ্ছে, নিশ্চিন্তে আপন মনেই খাচ্ছিল। হীরালাল করেছে কী, হরিণটাকে আরও একটু ভালো করে দেখবে বলে যেই আর একটু উঁকি মেরেছে, ব্যস! হরিণটা দেখে ফেলেছে! চট করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হীরালালের চোখের ওপর চোখ রেখে নট-নড়ন নট-কিছু! হীরালাল তো তাই দেখে ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে গেছে! কী করবে এখন? তাড়াতাড়ি ঝোপের আড়ালে বসে পড়ল! আর বলব কী, ঠিক তক্ষুনি, একেবারে বসার সঙ্গে-সঙ্গে, আবার সেই ডাক, ‘হীরালাল।’
হীরালালের বুকের ভেতর যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠল। সেই ডাকের সুরে-সুরে নিস্তব্ধ গহন বন দুলে উঠল। ডাক শুনে ঝোপের আড়াল থেকে ঝটপট বেরিয়ে পড়েছে হীরালাল। তাই দেখে হরিণটাও দিয়েছে ছুট! কী জানি কী মনে হল, হীরালালও ছোটা দিল। ছুটল সে হরিণটার পেছনে-পেছনে। ভাবল নাকি, হরিণটাই তাকে ডেকেছে।
ঝোপ আর জঙ্গল, খানা আর খন্দ লাফিয়ে-লাফিয়ে তিরের মতো পালায় হরিণটা। আর হীরালাল গাছ ডিঙিয়ে, ঝাড় পেরিয়ে তার পিছনে ধাওয়া করল। আরি ব্যস। কী ছুট! কিন্তু যতই ছোটো, হরিণের সঙ্গে হীরালাল পারবে কেন! একী! ছুটতে-ছুটতে যে হীরালাল বনের আরও গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে! যাক, তবু সে ছুটবে। সে হরিণটাকে ধরবে।
যাঃ! দেখ, ছুটতে-ছুটতে হীরালালের পা পিছলে গেল! ধপাস! পড়েছে হীরালাল। লেগেছে খুব? না, একটুও লাগেনি, বুঝতে-না-বুঝতেই ও বাবা, এ যে সারা বন যেন একসঙ্গে হেসে উঠল! হা-হা, হি-হি, হো-হো!
হাসি শুনে আঁতকে উঠেছে হীরালাল। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়েছে। চোখে-মুখের কাদা সরিয়ে সামনে চাইতেই হীরালালের চক্ষু ছানাবড়া! ও মা! এ তো একটা হরিণ নয়! অসংখ্য হরিণ গাছের ফাঁকে, ঝোপের ধারে শিং উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হীরালাল পিছনে ফিরল, সেখানে হরিণ। সামনে তাকাল, সেদিকে হরিণ। আশে-পাশে যেদিকে চাও, হরিণ আর হরিণ! এখন কী করবে হীরালাল? ওই দেখ, হরিণগুলো এগিয়ে আসছে! গুতিয়ে দেবে নাকি হীরালালকে! আর বলতে! পালাও হীরালাল! কিন্তু কোনদিকে পালাবে! কোথায় পথ? ওই তো এসে পড়ল হরিণের দল!
বলতে-বলতেই হীরালাল মেরেছে লাফ! লাফিয়েই ওই ঝাঁকড়া গাছটার একটা ডাল ধরে ফেলেছে। গাছের ওপর তরতর করে উঠে পড়েছে! উঃ! খুব রক্ষে। হরিণগুলো শিং উঁচিয়ে লাগিয়ে দিল লাফালাফি। লাফালে কী হবে! ধরতে হচ্ছে না। হীরালাল এ-যাত্রায় বাঁচল হয়তো!
কিন্তু শোনো, ওই তো সেই মেয়েটি আবার ডাকল, ‘হীরালাল’।
হীরালাল থমকে গেল।
সে চিৎকার করে উঠল, ‘হীরালাল, তোমার মাথার কাছে সাপ!’
হীরালাল চকিতে ওপরে তাকিয়েছে। সত্যি তো একটা ময়াল! হীরালাল প্রাণের ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাপ। গাছের ওপর থেকে চক্ষের নিমেষে মারল লাফ। তারপর দে ছুট।
সাপটাও তো ছাড়বার পাত্তর নয়! সড়াত করে গাছ থেকে গড়িয়ে পড়ে লাগাল তাড়া! উরি বাবা! কী বিরাট সাপটা! আর বলতে, তাই না দেখে কোন ফাঁকে যে কোথা দিয়ে হরিণগুলো সটকে পড়ল, কেউ দেখতেই পেল না!
সাপের ভয়ে হীরালাল তো ছুটছে, কিন্তু বনের ঘোঁতঘাঁত তো সে জানে না! সাফ-সাফ সিধে রাস্তা হলে এককথা, হীরালাল পাঁই-পাঁই ছুটে পালাত। কিন্তু এখানে? ছুটতে গেলেই গাছের ধাক্কা। নয়তো কাঁটা-ঝোপে আটকা। কিন্তু আটকা পড়ুক, কি ধাক্কা লাগুক, ওকে ছুটতেই হবে।
তারপর হাঁপিয়ে পড়েছে।
তারপর পা কেটে রক্ত পড়ছে!
তারপর সাপটা এগিয়ে এসেছে!
এবার ঠিক ধরবে! এই মারল ছোবল!
না, পারল না! কী সববনাশ! ওই দেখ সামনে একটা চিতা বাঘ! সাপটা দেখতে না পেলেও হীরালাল দেখে ফেলেছে! ওই তো, ওই ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে তাক কষছে! যাঃ! এবার হীরালালের নির্ঘাত মরণ! এখন কাকে সামলাবে? বনের দুই যম–চিতাকে না সাপকে?
হীরালাল, শিগগির গাছে উঠে পড়!’ এ কী! আবার যে সে হাঁকল!
একটু যে থতমত খায়নি হীরালাল, তা নয়। তবু নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে ঝটপট সামনের গাছটাতেই উঠে পড়ল! আর সঙ্গে-সঙ্গে ‘হালুম’ করে ডাক ছেড়ে চিতাটা দিয়েছে এক লাফ! দেরি করে ফেলল! ততক্ষণে শিকার তার গাছের ডালে হীরালালকে ধরতে গিয়ে পড়বি-তো পড় সাপের ঘাড়ে। তারপর যা লেগে যা নারদ-নারদ! বাঘে-সাপে মারামারি। কামড়া-কামড়ি, খামচা-খামচি। বাঘের যত তর্জন গর্জন, সাপের তত ফোঁসফোঁসানি! ও ওকে আছাড় মারে, তো ও একে কামড়ে ধরে! বনের নির্জনে সে কী তুলকালাম কাণ্ড! কাণ্ড দেখে, শেয়াল হাঁকে, ফেউ ডাকে! ভালুক পালায়, বাঁদর চেঁচায়! আর ভয়ে জুজু হীরালাল, গাছের ডালে বসে-বসে তাই দেখে শিউরে ওঠে।
অনেক পরে সব শেষ। বাঘটার ভয়ংকর হুংকার সাপটার প্রচণ্ড ফোঁসফোঁসানি থেমে নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারিদিক। দুটোই লড়তে-লড়তে মরে গেল।
হীরালাল কিন্তু তক্ষুনি-তক্ষুনি গাছ থেকে নামল না। যদিও বাঘটা লটকে পড়েছে, সাপটাও নড়ছে না, তবু কে বলবে তারা সত্যি-সত্যি মরেছে কি না! তাই আরও অনেকক্ষণ গাছেই বসে রইল হীরালাল।
কই, না তো! অনেকক্ষণ পরেও তো বাঘের নিশ্বাস পড়ছে না। সাপটাও ধোঁকাচ্ছে না! এখন কি তবে নামা যায় গাছ থেকে!
হ্যাঁ, হীরালালের এতক্ষণে সাহস হল। খুব সাবধানে নামল সে! তারপর অবাক চোখে চেয়ে দেখল! চোখ তার ঠিকরে পড়ছে। এমন করে, এত কাছ থেকে বাঘের চেহারা হীরালাল আর কোনোদিন দেখেনি! কী সাংঘাতিক পায়ের থাবা কী ভীষণ খোঁচা-খোঁচা নখ!
হঠাৎ বুকটা ধক করে উঠল হীরালালের! আবার কীসের শব্দ যেন! পাতার ওপর খসখসানি! চটপট লুকিয়ে পড়ল হীরালাল! উঁকি মারল। হ্যাঁ, শব্দটা দূর থেকে এদিকেই এগিয়ে আসছে! সঙ্গে-সঙ্গে এই গাছ থেকে আর এক গাছে এগিয়ে গেল হীরালাল। এবার তার স্পষ্ট নজরে পড়ল, তিনজন সৈনিক! এ কী! এরা এ সময়ে বনের ভেতরে কেন? তাদের হাতে বন্দুক, পিঠে ব্যাগ। হাঁটছে, ক্লান্ত। চলতে-চলতে সতর্ক দৃষ্টি তাদের এদিক-ওদিক ঘুরছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল তারা। মরা বাঘটার দিকে নজর পড়ল! অস্ফুট স্বরে একজন বলে উঠল, ‘বাঘ!
আর একজন আঁতকে উঠল, ‘সাপ!”
আর একজনের চোখ দুটো ঠিকরে পড়ল। ভয়ে-ভয়ে বলে উঠল, ‘সববনাশ!
তিনজনে বন্দুক উঁচিয়ে তফাতে দাঁড়াল। দেখছে তারা বেবাক হয়ে। চোখের পাতা পড়ছে না। এখন বুঝতে পেরেছে ওরা, বাঘটা মরেছে, সাপটাও জ্যান্ত নেই। আলতো পায়ে এগিয়ে এল তারা। বন্দুক দিয়ে খোঁচা মারল বাঘের পিঠে, সাপের পেটে। তারপর নিজেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চাপা-গলায় হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে একজন বলে উঠল, ‘এক বিপদ থেকে আর এক বিপদ। যাও বা ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এলুম, এখন আবার বাঘ! বনের ভেতর জ্যান্ত বাঘের খপ্পরে না পড়তে হয়!’
আর একজন উত্তর দিল, ‘ঠিকই বলেছিস। আমাদের তিনজনের তিনটে বন্দুক। কিন্তু গুলি মাত্র একটা। সামনে বিপদ এলে সামাল দেব কেমন করে?’
আর একজন বলল, সুতরাং আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন ডিঙিয়ে পালাতে হবে।’
বলেই সৈনিক তিনজন হাঁটা দিল।
হীরালালের কী মনে হল, ওদের পিছু নিল।
সৈনিক তিনজনের পায়ে শক্ত জুতো। শব্দ যাতে না ওঠে, তাই সামলে-সামলে পা ফেলছে। আর খালি পায়ে তার চেয়ে আরও সাবধানে হীরালাল হাঁটছে এ-গাছ থেকে ও-গাছের আড়ালে। এ ঝোপ থেকে ও ঝোপের অন্ধকারে। অবাক কথা, এখন হীরালালের বাঘের ভয় নেই। না সাপের ভয়। এখন তার মনেও পড়ছে না সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ছে না সেই মিষ্টি ডাক, ‘হীরালাল’। তার চোখের দৃষ্টি এখন ওই সৈনিক তিনজনের ওপর। কোথায় যাচ্ছে ওরা? কোথায় পালাচ্ছে?
না, একথা তো হীরালালের জানার কথা নয় যে, ওই তিনজন সৈনিক যুদ্ধের ভয়ে দল ছেড়ে পালাচ্ছে। মরতে ওরা ভয় পায়। ওরা জানে, সৈনিক হয়েও চোরের মতো পালালে তার কী শাস্তি! ধরা পড়লে, রাইফেলের গুলিতে বুকগুলো ঝাঁঝরা হয়ে যাবে!
থামল তারা হঠাৎ। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কী কথা বলাবলি করল, শুনতে পেল না হীরালাল। কিন্তু দেখতে পেল, তিনজনের চোখ একই সঙ্গে ঘুরছে যেন। ঘুরতে-ঘুরতে এক জায়গায় স্থির হয়ে গেল তাদের চোখ। যেদিকে চাইল তারা, হীরালালও তাকাল সেদিকে। একটা পোড়ো বাড়ি না সামনে? হ্যাঁ তো! কই এতক্ষণ হীরালাল তো বাড়িটা দেখতে পায়নি! দেখবে কেমন করে! জঙ্গলের আড়ালে এমন ঢাকা পড়ে আছে, নজরই যায় না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সৈনিক তিনজন সেইদিকে। বাড়িটার সামনে একটু দাঁড়াল। উঁকি মারল। না, হয়তো কেউ নেই। একটু দোনোমনো করল হয়তো! কিন্তু সে তো আর হীরালালের নজর গেল না। তারপর তিনজনেই ভাঙা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল।
হীরালালও হামাগুড়ি দিল। কী আছে বাড়িটার ভেতরে! তাই তো! লোক তিনটে বাড়ির ভেতরে ঢোকে কেন? দেখতে হবে তো! তাই হীরালালও চুপিসারে এগিয়ে গেল সেইদিকে।
সত্যি, পোড়ো-বাড়ির ভেতরটা এত ঘুপচি, চারিদিকে এত ঝোপ-জঙ্গল আর ঝাঁক-ঝাঁক পাতায় ছেয়ে রয়েছে যে, শত চেষ্টা করেও হীরালাল ভেতরে কী হচ্ছে, না হচ্ছে টের পেল না। হীরালালকে আরও কাছে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আরও কাছে যাওয়া মানেই তো বিপদ! তবে বনের ভেতরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকলে কাউকে আর দেখতে হচ্ছে না! লুকিয়ে-লুকিয়ে তুমি যা ইচ্ছে যত পার দেখ, ঘুণাক্ষরে কেউ জানতেও পারছে না।
তাই হীরালাল লুকিয়ে-ছাপিয়ে আরও কাছে এগিয়ে চলল। নিমেষের মধ্যে সে বাড়িটার পিছন দিকে চলেও এসেছে। এদিকে দেওয়ালের গায়ে ঢাপ্পস গর্ত। হয়তো এককালে জানলা ছিল। এখন তার চিহ্নটি পর্যন্ত নেই। হ্যাঁ, ওই গর্তে মাথা গলিয়ে হীরালালকে দেখতে হবে।
কিন্তু কাজটা তো সহজ নয়। তবু হীরালাল থাকতে পারল না। গর্তের ভেতরে সে উঁকি মারল। মেরেই চক্ষুস্থির! আরে! আরে! তারা যে সৈনিকের পোশাক খুলে ফেলেছে! পিঠে-ঝোলানো ব্যাগ থেকে অন্য কাপড় বার করে পরে ফেলেছে! মাথায় পাগড়ি বেঁধেছে! পায়ে চটি চড়িয়েছে। আর সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, তারা নকল দাড়ি-গোঁফ এঁটে এখন একেবারে অন্য মানুষ। হীরালাল এবার স্পষ্ট দেখতে পেল, এক কোণে বন্দুকের নল দিয়ে একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলল তারা। তারপর খুলে-ফেলা পোশাকগুলো আর বন্দুক তিনটে গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিল। তারপর নিজেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে-করতে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘চেনা যাচ্ছে?’
আরও একটু ভালো করে দেখে অন্য দুজন ঘাড় নাড়ল, ‘না।’ ‘তবে চ, এবার বেরিয়ে পড়ি।
‘চ।’
তিনজনে পোড়ো-বাড়ির দরজা ডিঙিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। দেখতে-দেখতে হীরালাল তো থ। কেননা, এমন করে কাউকে কোনোদিন সে দাড়ি-গোঁফ পরে অন্য মানুষ সাজতে দেখেনি। তবে কি লোকগুলি সৈনিক নয়, অন্য কিছু! ভেবেই পায় না হীরালাল।
কিন্তু এত যে কাণ্ড হচ্ছে, পায়ে-পায়ে এমন যে বিপদ ঘুরছে অথচ হীরালালের ভারি ইচ্ছে হচ্ছিল ওই বন্দুক তিনটে নেড়েচেড়ে দেখতে। এমন নয় যে সে বন্দুক কোনোদিন দেখেনি। তবে হাত দিয়ে তো ছোঁয়নি কোনোদিন! তাই ভারি লোভ হচ্ছিল তার! আর তাই আরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল হীরালাল গা ঢাকা দিয়ে পোড়ো-বাড়ির পিছনে। তারপর যখন, লোক তিনটের সাড়া-শব্দ আর শোনা গেল না, তখন নিঃসাড়ে বেরিয়ে এল হীরালাল ঝোপের ভেতর থেকে। খুব সাবধানে এগিয়ে এল পিছন থেকে সামনে। পোড়ো বাড়ির অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়াল সে। গা-টা কী রকম ছমছমিয়ে উঠল। কী ভয়ংকর কালো ঘুরঘুট্টি ভেতরটা। এর ভেতরে মানুষ যাবে কেমন করে!
তা হোক। ও তো আর অনেক ভেতরে যাচ্ছে না। ওই তো, ওই সামনেই, ওই কোণে বন্দুক তিনটে পোঁতা আছে। হাত বাড়ালেই তো পাওয়া যায়! ধাঁ করে ছুটে গেল হীরালাল সেই অন্ধকারের দিকে। তারপর পোড়ো-বাড়ির গহ্বরে সে হারিয়ে গেল।
‘আঃ–! চিৎকার করে উঠল হীরালাল আচমকা! হাত বাড়াল। হাত বাড়িয়ে ছুটতে গেল। কিন্তু ওই দেখ, কালো-জমাট অন্ধকারটা নিমেষের মধ্যে ওকে জড়িয়ে ধরল। অন্ধকার, অন্ধকার। চারিদিক অন্ধকার। যেদিকেই তাকায় হীরালাল, সেদিক থেকেই কে যেন মুঠো-মুঠো অন্ধকার ওর চোখে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ওকে অন্ধ করে দিচ্ছে। হীরালাল কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সামনে হাঁটে, হোঁচট খায়। হাত বাড়িয়ে থমকে যায়। অন্ধকার দানবটা যেন তার কেলেকিষ্টি মুখখানা ভয়ংকর হাঁ করে হীরালালকে কামড়ে ধরেছে। হীরালালের দম আটকে আসছে। এখানে এখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না। এখানে কি হীরালালের সব শেষ হয়ে যাবে?
চমকে উঠল হীরালাল। হঠাৎ তার কানে ভেসে এল ভাঙা বাড়ির দূর অন্দর থেকে সেই ডাক, ‘হী-রা-লা ল!’
এবার হীরালাল আর থাকতে পারল না। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় তুমি?’
সে বলল, ‘এইদিকে।
হীরালাল বলল, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি না। চারদিকে অন্ধকার।’
সে বলল, ‘এগিয়ে এস।’
হীরালাল বুঝতে পারে না কোনদিকে এগিয়ে যাবে সে। ভারি রাগ ধরছে তার। কেন এমন করে লুকিয়ে লুকিয়ে বার-বার ডাকছে সে! না, তাকে হীরালাল খুঁজে বার করবেই। তাকে জিজ্ঞেস করবে, এই লুকোচুরি খেলার মানে কী! তাই অন্ধকারেই থমকে-থমকে পা ফেলল সে, আর কানামাছির মতো হাত ছড়িয়ে এগিয়ে চলল।
কিন্তু এ কী! আর কতদূরে যাবে হীরালাল! যতই এগোয় এ যে শেষ নেই। কত বড়ো বাড়িটা! এ কি বাড়ি না প্রাসাদ! হয়তো তাই।
হুস-স-স। হীরালালের গায়ের ওপর দিয়ে যেন ঝটকা মেরে এক ঝলক হাওয়া বয়ে গেল! থমকে যায় হীরালাল। এই অন্ধকার বন্ধ ঘরে হাওয়া কোত্থেকে আসে! হীরালাল চকিতে নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু তারপরেই তার যেন মনে হল, হাওয়ার মতো উড়তে-উড়তে আবছা কালো ছায়ারা তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। হীরালাল ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
তবে কি এই ছায়ারাই তাকে ডাকছিল! এ-কথা মনে হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই হীরালালের চোখের পাতা দুটি আপনা থেকেই খুলে গেল। চোখ খুলেই হীরালাল ভয়ে আঁতকে ওঠে! এ কী! এ যে চারিদিক থেকে অন্ধকারের ঢেউ যেন পাক খেতে-খেতে তার দিকে তেড়ে আসছে! এখন কী করবে হীরালাল! ভয়ে পালাতে গেল হীরালাল। ছুট দিল সে। কিন্তু কোথায় ছুটল, কোনদিকে পালাবে কিছুই ঠাওর করতে পারল না যে! অন্ধকার, অন্ধকার! চারিদিকে শুধু অন্ধকারের ঢেউ গড়িয়ে-গড়িয়ে এগিয়ে আসছে। ছড়িয়ে-ছড়িয়ে কুণ্ডলি পাকাচ্ছে। তারপরে, ওই তো হীরালালের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে! কী ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল হীরালাল! তার সেই চিৎকার পোড়ো-বাড়ির দেওয়ালে-ছাতে, ঘরে-উঠোনে প্রতিধবনিত হয়ে কেঁপে উঠল। কিন্তু কেউ তার সেই চিৎকারে সাড়া দিল না। কেউ তাকে বাঁচাতে এল না। তখন হীরালাল একাই লড়াই শুরু করে দিল সেই অন্ধকারের সঙ্গে।
কিন্তু কতক্ষণ পারবে হীরালাল একা-একা! ও তো ছোট্ট! অন্ধকারের সঙ্গে যুঝতে-যুঝতে ভারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে হীরালাল। ওর মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছিল। নিস্তেজ হয়ে চোখের পাতা দুটি যেন বুজে আসছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে হীরালালের। হ্যাঁ, ওই তো! অন্ধকার পোড়ো-বাড়ির টুটা-ফাটা মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল হীরালাল। তারপর আর কিছু জানে না হীরালাল।
.
অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ চমকে চোখ মেলেছিল হীরালাল। আশ্চর্য! তখন এতটুকু অন্ধকার ছিল না। রাশি-রাশি সোনালি রঙিন আলো ওর চোখের তারা দুটির ওপর উছলে পড়েছে। ঝলসে গেল হীরালালের চোখ দুটি। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। কই, সেই পোড়োবাড়ি কোথায় গেল? সে তো দেখতে পাচ্ছে না। এ যে এক সুন্দর রঙে-রঙে রং-ছবি আলোর দেশ। চেয়ে দেখ, চারিদিকে যেন সোনার ঝকমকি গলে-গলে গড়িয়ে পড়ছে। আলোদের টুপটাপ রোশনাই। বাজনার টুং টাং ছন্দ। আঃ। কী মিষ্টি লাগছে হীরালালের। ও কী! আলোর স্রোতে ও কাদের গান শোনা যায়? দেখ, দেখ, কত ফুল! না, না, ফুল না। ফুলের পাপড়ি সাজিয়ে তবে ওরা কারা? আহা! ছোট্ট-ছোট্ট কত মেয়ে। পাখির পিঠে বসে আছে। পাখিরা উড়ছে আর ওরা কেমন গান গাইতে-গাইতে আলোর স্রোতে ভাসছে! সেই আলো দেখতে-দেখতে, সেই গান শুনতে-শুনতে অবাক হয়ে গেল হীরালাল। ভাবল, এমন গান তো সে কোনোদিন শোনেনি। এমন ফুল-পাপড়ি মেয়ের দলকে তো সে কোনোদিন পাখির পিঠে উড়তে দেখেনি!
দেখতে-দেখতে চোখ জুড়িয়ে গেল হীরালালের। তার মনের ভাবনাগুলি মন থেকে কোথায় যেন সরে গেল ধীরে-ধীরে। ভুলে গেল হীরালাল। সব ভুলে গেল। ওই আলোর দোলনায় দোল খেতে-খেতে নিজেকে হারিয়ে ফেলল হীরালাল।
হীরালাল, কেমন লাগছে?’
বুকের ভেতরটা চমকে উঠল হীরালালের। এ কী! এখানেও সেই মেয়েটি! সে আবার ডাকছে! কিন্তু কই সে?
হীরালালকে কথা বলতে না দেখে, সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘বলছ না, কেমন লাগছে?’
হীরালাল উত্তর দিল না।
সে আদর করে বলল, ‘তোমার ভালো লাগলে, আমারও ভালো লাগবে, হীরালাল।’
এবার হীরালাল থাকতে পারল না। এবার হীরালালও কথা কইল। জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি? আমার সঙ্গে তখন থেকে তুমি লুকোচুরি খেলছ?’
সে বলল, ‘ভালো লাগছে না?’
‘না, একটুও না। তুমি আমায় দেখা দিচ্ছ না কেন?’
‘এই তো, আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে!
‘কই?’
‘এই তো।
হীরালাল চরকি খেয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘কই? কই? কই?’
হঠাৎ সে খিলখিল করে হেসে উঠল। কী জানি, কী ছিল হাসিতে, কী জাদু, সঙ্গে-সঙ্গে সেই গান থেমে গেল! সেই পাখি উড়ে গেল। সেই আলো নিবে গেল।
হীরালাল আবার হারিয়ে গেল অন্ধকারে। অন্ধকারে দু-হাত তুলে সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আলো জ্বালাও।’
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। হীরালালের চিৎকারের শব্দটা অন্ধকারে ঘুরপাক খেতে-খেতে নিথর হয়ে হারিয়ে গেল। হীরালাল এবার ছুটতে গেল অন্ধকারে। ঠোক্কর খেল। অন্ধকারে এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে হাঁপিয়ে গেল!
এমন সময়ে,
গুড়ুম-ম-ম!
হঠাৎ বন্দুক ছুড়ল কে?
আবার,
গুড়ুম-ম-ম!
লাগেনি। হীরালাল বসে পড়েছে। কিন্তু ব্যাপার কী! সেই তিনজন সৈনিক তাকে দেখতে পেয়েছে নাকি! এই রে! এখন তো তবে হীরালালের আর নিস্তার নেই!
গুড়ুম-ম-ম!
এবার হীরালাল স্পষ্ট দেখতে পেল, বন্দুকের নল থেকে আলোর ফুলকি ছুটতে ছুটতে দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা মেরে হারিয়ে যাচ্ছে।
তারপরেই গট-মট-খট-খট। একসঙ্গে পায়ে চলার শব্দ।
ওই তারা আসছে। এদিকেই আসছে।
অন্ধকারের গভীরে, আরও গভীরে গা ঢাকা দিল হীরালাল। কিন্তু পারল না। ওদের হাতে আলো। হঠাৎ ঝলসে উঠে অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ল সেই আলোর রোশনাই। ছড়িয়ে পড়ল একেবারে হীরালালের মুখের ওপর। হীরালাল থতমত খেয়ে গেছে। দেখতে পেয়েছে তারা হীরালালকে। একজন চিৎকার করে উঠল, ‘উধার কৌন হ্যায়?’
উত্তর না দিয়ে, আগু-পিছু কিছু না ভেবে হীরালাল আচমকা পিছনদিকে ছুটতে শুরু করে দিল। পাঁই পাঁই করে ছুটছে সে সেই পোড়-বাড়িটার অন্দরে!
তারা আবার হাঁক পাড়ল, ‘রোখ যা।’
হীরালাল থামল না।
তখন তারাও ছুটল হীরালালের পিছনে। অন্ধকারে আলো ফেলে, বন্দুক উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, না দাঁড়ালে গুলি মেরে দেব।’
সে-কথা শুনল না হীরালাল। সে ছুটছে। ছুটছে কিন্তু পালাবার পথ পাচ্ছে না। যতই অন্দরে সে ঢুকে পড়ছে, ততই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। শেষে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে না পাশটা, পিছনটা, সামনেটা। এই রে! গর্তে পা পড়ে গেছে হীরালালের। হীরালাল হুমড়ি খেয়ে ছিটকে পড়েছে। উঃ ভয়ানক লেগেছে। লাগুক। তবু তাকে উঠতেই হবে। কিন্তু না, পারল না। ওই তারা ছুটে এসেছে দুড়দাঁড়িয়ে। হীরালালকে ওরা পাকড়াও করে ফেলল। হীরালাল ভয়ে কুঁচকে গেল। হীরালাল এখন স্পষ্ট দেখতে পেল, এ-লোকগুলো সেই লোক নয়। এরা আর একদল সৈনিক।
এখনও হাঁপাচ্ছে হীরালাল। এই সৈনিকদের একজন হীরালালের ঘাড় ধরে টেনে তুলল। কর্কশ-গলায় খেঁকিয়ে উঠল, ‘এই ছেলে, এখানে কী করছিস?’
হীরালাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
আবার কড়কে উঠল, ‘কথা বলছিস না কেন?’
তবু হীরালাল চুপ করে রইল।
একজন জিজ্ঞেস করল, ‘এদিকে তিনজন সৈনিককে আসতে দেখেছিস?’
হীরালাল মুখ খোলে না।
‘কথা বলবি না? এই গুলি চালা!’ একজন হুকুম করল।
আঁতকে উঠল হীরালাল। ওর বুকের ওপর বন্দুকের নল! হীরালাল কথা বলল। বলল, ‘অন্ধকারে হারিয়ে গেছি।’
‘কে তুই?’
হীরালাল।’
‘এই পোড়ো-বাড়ির অন্ধকারে কী করছিস?
বললুম তো হারিয়ে গেছি।’
‘এখানে আমাদের মতো তিনজন সৈনিককে আসতে দেখেছিস?’ হীরালাল আবার চুপ করে গেল।
‘তারা যুদ্ধের ভয়ে আমাদের দল ছেড়ে পালাচ্ছে।’
হীরালাল এবারও চুপ।
‘তাদের সন্ধান বলতে পারলে তোকে মেডেল দেব,’ একজন লোভ দেখাল হীরালালকে।
তবুও হীরালাল কথা বলল না।
তখন একজন ভীষণ চেঁচিয়ে ধমক মারল, ‘দেখেছিস কি না বল?’
হীরালাল কিছুই বলল না।
বলল না বলে তো আর সৈনিক শুনবে না। তারা হীরালালকে ছাড়বে কেন? তারা হীরালালকে হ্যাঁচকা মেরে টান দিল। হীরালাল টলতে-টলতে চলতে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমায় ছেড়ে দাও, আমায় ছেড়ে দাও।’
হীরালালের কথা তারা শুনল না। তারা ছাড়ল না হীরালালকে। ওরা সৈনিক। ওদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া অত সহজ না তো!
সৈনিক-সর্দার হুকুম করল, ‘ছেলেটাকে অন্ধকারের বন্ধ-ঘরে আটকে রাখ। না বললে ছাড়ান নেই।’
অন্ধকারে বন্ধ-ঘর কোথায়, তারা খুঁজে পেল না।
তখন সৈনিক-সর্দার বলল, ‘তবে হাত-পা বেঁধে এখানে ফেলে রেখে দে!’
হীরালালের হাত-পা বাঁধা হল। কিন্তু তবুও হীরালালের মুখ দিয়ে একটিও কথা সরল না। হাত-পা বেঁধে, হীরালালকে অন্ধকারে ফেলে রেখে, তারা যেমন করে এসেছিল তেমনি করে চলে গেল। কিন্তু কোথায় যে চলে গেল হীরালাল দেখতে পেল না।
এবার হীরালাল কী করবে? এখন সত্যিই সে এক ভয়ংকর বিপদের মধ্যে পড়েছে। এখন, এই অন্ধকারে তাকে বাঘ-ভালুকের পেটে না যেতে হয়। বলা যায় না, বাঘ-ভালুক বাসা বাঁধতেও পারে ওইখানে! কি সাপ-খোপ!
অন্ধকারে ভয়ংকর ভয়টা যখন তার বুকের ওপর চেপে বসেছে, তখন হাত-পা-বাঁধা অবস্থায় সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। উঠে দাঁড়ালও সে। ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে! পা টানছে সে। হাঁটবে। বাঁধা পায়ে ঘসটানি লাগছে। ঘসতে-ঘসতে হাঁটল। কিন্তু কোনদিকে যাচ্ছে হীরালাল? জানে না। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে চারিদিক থেকে যেন জমাট অন্ধকারটা নিশ্বাস ফেলছে। সত্যিই তাই! ওই শুনতে পাচ্ছ না, নিশ্বাস ফেলে কে যেন হাঁসফাঁস করছে।
থমকে গেল হীরালাল। কে ও! ও কার চোখ! অন্ধকারে দপদপ করে জ্বলছে। এগিয়ে আসছে সে ধীরে ধীরে হীরালালের দিকে।
হীরালাল ভয়ে কাঠের মতো স্থির হয়ে গেল। অমনি তার শ্যাওলা-পড়া দাঁতগুলো অন্ধকারে ছরকুট্টে ভেংচি কেটে উঠল। হীরালাল ভয়ে ককিয়ে উঠল, ‘বাঁচাও।
হীরালালের সুরে সুর মিলিয়ে কেমন যেন একটা হাসি, কিংবা একটা আর্তনাদ, অথবা একটা কান্না সেই অন্ধকারে কান-ফাটানো শব্দে ঘুরপাক খেতে লাগল। হীরালাল ভয়ে ছুটে পালাতে গেল। ভুলে গেল তার হাত-পা বাঁধা। ছিটকে পড়ল একেবারে মাটির ওপর। তড়িঘড়ি উঠতে যাবে কী, দেখে তার মুখের সামনে সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো প্যাট-প্যাট করে চেয়ে আছে। দুটো হাত মুঠো পাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কে ও! ওই হাত দুটো খামচে ধরল হীরালালকে। হীরালাল চেঁচাতে গেল, পারল না। ওর গলার স্বর যেন কে কেড়ে নিল! কাঁপতে লাগল হীরালাল ঠক-ঠক করে। ভয়ে নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়ল।
.
অনেকক্ষণ পর, ঠিক কতক্ষণ পর হীরালাল ঠিক মনে করতে পারছে না, হীরালালের কানে-কানে সেই মিষ্টি সুরে সে যেন আবার ডাক দিয়েছিল, ‘হীরালাল, ও হীরালাল, উঠে পড়।
চমকে উঠেছিল হীরালাল। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি হীরালাল। চোখ দুটি চাইতেই অবাক হয়ে গেল সে! এ কী! এ কোথায় এসেছে হীরালাল! কে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে! এ তো সেই বন নয়। এখানে কোথায় সেই বনের পোড়ো-বাড়ি। অন্ধকার পেরিয়ে ও আলোয় এসেছে কেমন করে! এখানে তো মেলা বসেছে। কত লোকজন! কত দোকান-পসার! দাঁড়াল হীরালাল। আবার ভিড়ের মধ্যে পা চালাল। বেবাক হয়ে এদিক-ওদিক চোখ ফেরাল। না, এ মেলা তো সে কোনোদিন দেখেনি! এ মেলাতে সে তো কোনোদিন আসেনি! কে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে! আজব কাণ্ড! সে কি স্বপ্ন দেখছে!
না, স্বপ্ন না। যা দেখছে সব সত্যি! এই মেলা। মেলায় মিষ্টি-খাবার, মুড়কি-মুড়ি, আলুর বড়া, জিবে গজা, রঙিন জামা, জুতো-মোজা, খেলনা-পুতুল, চেঁচামেচি, হই-হল্লা সব সত্যি! ভিড়ের মাঝ দিয়ে হাঁটে হীরালাল। ভিড়ের ফাঁকে-ফাঁকে হাঁটে। কেউ ঠেলা মারে, কেউ পা মাড়ায়। কেউ চেয়ে দেখে, কেউ চোখ টেরায়। হীরালাল দেখছে আর ভাবছে, তাই তো। এই ছিল বন, হয়ে গেল মেলা! কোথায় গেল সেই পোড়ো-বাড়ি।
এখন কী করবে হীরালাল! ভারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কোনদিকে যাবে।
হাঁটতে-হাঁটতে থমকে দাঁড়াল হীরালাল। কারা যেন ওইদিকে একসঙ্গে হাততালি দিচ্ছে। মেলার ওইদিকে ওটা কীসের ভিড়! এগিয়ে গেল হীরালাল। ভিড়ের মধ্যে উঁকি মারল। আরে! ম্যাজিক হচ্ছে। একটা লোক ম্যাজিক দেখাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে। ‘লেড়কা-লোক এক দফে তালি লাগাও।’
হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ম্যাজিক দেখছে, অনেক ছোটো, অনেক বড়ো, অনেক লোক। তারা যেই হাততালি দিচ্ছে অমনি সঙ্গে-সঙ্গে শূন্য ঝুড়ি থেকে পায়রা বেরুচ্ছে। আবার পায়রা হুস করে উবে যাচ্ছে। ঝুড়ি-চাপা শুকনো মাটিতে গাছ গজাচ্ছে। ছোট্ট গাছে আম ফলছে, সেই আম কেটে-কেটে সবাইকে খেতে দিচ্ছে ম্যাজিকঅলা। সবাই খাচ্ছে আর অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।
দেখতে-দেখতে হীরালালও অবাক হয়ে গেল। ভারি মজার কাণ্ড তো!
অনেকক্ষণ খেলা চলল। অনেক খেলার পর অনেক পয়সা। যখন ম্যাজিকঅলার থলি ভরে গেল, তখন খেল খতম। খেল খতম মানেই মজা শেষ। মজা শেষ মানে, ভিড়-ভাট্টা হালকা। লোকজন সব একটি-একটি কাট্টা। তারপর সেই জমজমাট জায়গাটা এক্কেবারে ফাঁকা!
হল কী, সববাই যখন চলে গেল, ম্যাজিকঅলা পুটলি বাঁধল। সাজ-সরঞ্জাম গুটিয়ে নিল। ঘরে যাবে বলে পা বাড়াল। ঠিক তখুনি হীরালালের দিকে তার নজর পড়ল।
হ্যাঁ, ওই তো হীরালাল একা চুপটি করে বসে আছে, একটু দূরে। এক-মনে দেখছে ম্যাজিকঅলাকে। দেখছে, তার মাথায় টুপি। লম্বা। গায়ে জামা। ইয়া ঢাঞ্জুস। জামার এদিকে পকেট, ওদিকে পকেট। জামার হাতার ভেতর হাতা। লোকটার বুক-ভরতি মেডেল। হীরালালের মনে হল, লোকটার চেয়ে জামাতেই যেন বেশি রহস্য। জামাটাই যেন একটা ম্যাজিক। আহা! ওই ম্যাজিক যদি হীরালালের জানা থাকত!
লোকটার চোখে চোখ পড়তেই হীরালাল থতমত খেয়ে গেছে। কেননা, সে যে হীরালালের মুখের দিকে চেয়ে মুচকি-মুচকি হাসছে! সত্যি! তার হাসিতেও কেমন যেন ম্যাজিক ম্যাজিক গন্ধ! হীরালাল চোখ না ফিরিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল তার দিকে। লোকটা এগিয়ে এল। হীরালালের সামনে এসে দাঁড়াল। হীরালাল কথাই বলল না। হঠাৎ লোকটাই কথা বলল, ‘আরে খোঁকা, খেলা তো শেষ হয়ে গেল, ঘোরে যাবে না?’
হীরালাল ও কথার জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মন্ত্র পড়ে তুমি ম্যাজিক করো?’
লোকটা উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, মনতর ভি আছে. কায়দা ভি আছে।’
‘তুমি আমায় ম্যাজিকের মন্ত্র শিখিয়ে দেবে?’ জিজ্ঞেস করল হীরালাল।
ম্যাজিকঅলা হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে জিজ্ঞেস করল, ‘কেননা? মনতর শিখে তেমহি কী করবে?’
‘আমি অদৃশ্য হয়ে যাব। অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র জানো তুমি?’
ম্যাজিকঅলা এতক্ষণ হাসছিল। হীরালালের কথা শুনে হঠাৎ যেন মুখখানা তার গম্ভীর হয়ে গেল। হীরালালের চোখ দুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘অদৃশ্য কোনো হোবে?’
হীরালাল উত্তর দিল, ‘কারণ আছে।’
‘কী কারণ?’ জিজ্ঞেস করল ম্যাজিকঅলা। হীরালাল ও কথার উত্তর না দিয়ে, বিরক্ত হয়েই বলল, ‘তুমি অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র শিখিয়ে দিতে পারবে কি না তাই বল!’
ম্যাজিকঅলা হীরালালের কথার ওপর আর কোনো কথা বলল না। শুধু ওর মুখের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবতে লাগল। সে-সময় ম্যাজিকঅলার চোখ দুটো দেখলে বুঝতে বাকি থাকে না যে, তার মতলবটা কী! হীরালালকে দেখে তার ঠিক মনে হয়েছে, হয় ছেলেটা ঘর থেকে পালিয়েছে, না-হয় পথ হারিয়েছে। ছেলেটা বাচ্চা, একবার যদি ভুলিয়ে-ভালিয়ে দলে নিতে পারে, তবে ভালো করে ফয়দা ওঠাবে।
‘আমার মুখের দিকে চেয়ে-চেয়ে কী দেখছ?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল হীরালাল।
ম্যাজিকঅলা সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘না, বলছি, তোমহার নাম কী আছে?’
হীরালাল।’
‘ঘর?’
‘ঘর আছে, মা আছে। এখন নেই।’
‘তবে তুমহি এখোন কুথা যাচ্ছ?’।
‘কে একজন মেয়ে আড়াল থেকে বার-বার আমায় ডাক দিচ্ছে। ডাকতে-ডাকতে আমায় ঘোরাচ্ছে। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। তাকে খুঁজতে-খুঁজতে আমি এখানে চলে এসেছি। আমার মনে হচ্ছে, সে বোধহয় অদৃশ্য। সে-ও বোধহয় ম্যাজিক জানে। কিন্তু জানো এত মিষ্টি তার গলার স্বর। আমি তার ডাক শুনলে থাকতে পারি না। আমার মনে হচ্ছে, আমিও অদৃশ্য না হলে বোধহয় তাকে দেখতে পাব না। তাই জিজ্ঞেস করছি, তুমিও অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র জানো কি না!’
ম্যাজিকঅলা হীরালালের কথা শুনে হয়তো অবাক হল। হয়তো বা ভয় পেল। কিন্তু তার মুখ দেখে সে কথা বোঝার উপায় ছিল না। তবে তার মাথায় যে অন্য একটা মতলব দানা বেঁধেছে, সে তার চোখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। তাই সে চট করে বলল, ‘অদৃশ্য কোরার মনতর তো হামি জানে হীরালাল। লেকিন অদৃশ্য হোবার আগে তোমহাকে তো ট্রেনিং লিতে হোবে!’
‘সেটা কী?’ জিজ্ঞেস করল হীরালাল।
‘মানে, অদৃশ্য হোবার কায়দা তো তোমহাকে শিখতে হোবে।’
‘সে আর এমন কী কথা!’
ম্যাজিকঅলা এবার মুচকি-মুচকি হাসতে-হাসতে বলল, ‘কোথা আছে হীরালাল। সাতদিন তোমহাকে ভি হামার সাথে খেলা দেখাতে হোবে।’
‘সাতদিন?’ ভাবনা হল হীরালালের। জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়ি যাব না?’
ম্যাজিকঅলা বলল, ‘সেই তো কোথা। বাড়ি ভি যাবে, আউর অদৃশ্য ভি হোবে, দোনো তো এক সাথে হোবে না। আগে শোচো ভাই, ঘর যাবে, না ম্যাজিক শিখবে।’
হীরালাল এখন সত্যিই খুব দোটানার মধ্যে পড়ল। কিন্তু দোটানার মধ্যে পড়লেও, এখন অদৃশ্য হবার ইচ্ছেটাই তাকে বেশি টানছে। কারণ, ও ভাবল অদৃশ্য হলেই বুঝি সে তাকে খুঁজে পাবে। সেই মেয়েটিকে, যে তাকে বার-বার ডাকছে অথচ দেখা দিচ্ছে না। তাই আর দোনোমোনো না করে হীরালাল বলল, ‘বেশ, আমি তোমার কথায় রাজি।’
হীরালালের কথা শুনে ম্যাজিকঅলার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। তাড়াতাড়ি হীরালালের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোবে চোলো।’
‘কোথায়?’
‘হামার ঘর।’
‘কত দূর?’
‘যাদা নেহি।’
‘চলো তবে।’ হীরালাল ম্যাজিকঅলার সঙ্গে হাঁটা দিল।
.
ঈশ বাবা! ম্যাজিকঅলার ঘরটা একেবারে যা-তা! ছিঃ, ছিঃ! বিচ্ছিরি নোংরা চিরকুট একটা বিছানা। একপাশে গোটানেনা। একদিকে হাঁড়ি আর কটা এঁটো বাসন। ম্যাজিকের সাজ-সরঞ্জাম বলতে কিছু নেই। আর ভেতরটায় একটা গা-ঘিনঘিন বোঁটকা গন্ধ। হীরালাল ঘরে ঢুকেই নাক সিঁটিয়ে বলে উঠল, ‘এই তোমার ঘর?’
‘হ্যাঁ, হামার ঘর।’
‘এখানে সাতদিন আমায় থাকতে হবে?’
‘থাকতে হোবে, খেলা ভি শিখতে হোবে।’
হঠাৎ হীরালাল চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এখানে আমি থাকতে পারব না। থুঃ!’
‘মানে?’
মানে, তোমার ঘরটা নোংরা। বিচ্ছিরি গন্ধ। ইঁদুরের গর্ত। এখানে মানুষ থাকতে পারে?’ চিৎকার করেই কথাটা বলে হীরালাল ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
ম্যাজিকঅলা চক্ষের নিমেষে ছুটে গিয়ে দরজায় খিল তুলে দিল।
দরজা বন্ধ করছ কেন?’ বেশ ব্যস্ত হয়েই হীরালাল জিজ্ঞেস করল।
এবার ম্যাজিকঅলা নিজমূর্তি ধরল। টেরা-চোখে তাকাল হীরালালের দিকে। টেরা-চোখে তাকিয়ে বেঁকা সুরে বলল দরোয়াজা হামি খুলবে না।’ বলে হো-হো-হো করে হেসে উঠল। সে হাসিতে শয়তানির নিশ্বাস ছড়ানো।
হাসি শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন চমকে উঠল। তবু সাহসে বুক উঁচিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন খুলবে না?’
লোকটা এবার হীরালালের কথার উত্তর না দিয়ে, দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে আগের চেয়েও আরও জোরে হেসে উঠল, হা-হা-হা!
চেঁচিয়ে উঠল হীরালাল, দরজা খুলে দাও!’ বলে লোকটার জামা ধরে টানাটানি লাগিয়ে দিল।
লোকটা হাসতে-হাসতে হঠাৎ থেমে চোখ পাকিয়ে ধমক মারল, ‘এ লেড়কা, হল্লাগুল্লা করো মাত। হল্লা কোরলে জিব ছিঁড়ে লিবো। দরোয়াজা আউর নেহি খুলবে। ঘরকা অন্দর মে তুম বনধ থাকবে।’
এবার সত্যি-সত্যি কান্না পেয়ে গেল হীরালালের। লোকটা যে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ধরে এনেছে, এবার বুঝতে পেরেছে হীরালাল। তক্ষুনি মায়ের কথা মনে পড়ে গেল হীরালালের। এখন কী করে সে মায়ের কাছে যাবে। কান্না পেলেও হীরালাল সামলে নিল। এখন কাঁদলেও এই লোকটার হাত থেকে সে নিস্তার পাবে না। কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না। বাঁচতে তাকে নিজেকেই হবে। কিন্তু কী করে যে বাঁচবে, সে তো জানে না। কারণ ও ছোট্ট। এই ধুমসো লোকটার সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে ওঠা তো সহজ কথা নয়।
তাই, কী যে করবে হীরালাল ভেবে পাচ্ছিল না। ভাবতে-ভাবতে মনটা যখন তার ভীষণ ছটফট করছিল, তখনই ওই ম্যাজিকঅলা লোকটা একটা কাণ্ড করে বসল। বলা নেই, কওয়া নেই, করল কী, হীরালালের ঘাড়টা খপাত করে খামচে ধরল। হীরালাল তো প্রথমটা ভড়কে যাবেই। তারপর চোখের পাতা পড়তে-না পড়তেই হীরালাল ভয়ংকর চিৎকার করে সটান লোকটার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছোটোই হোক কী বড়োই হোক আচমকা কেউ যদি কারও ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে ধাক্কা মারে, তবে সে যত বড়োই পাট্টা হোক নির্ঘাত চিতপটাং! হলও তাই। ধাক্কা খেয়ে ম্যাজিকঅলা মেরেছে এক ডিগবাজি! ডিগবাজি মেরেই মেঝের ওপর লটকা-টকি। তাই দেখে হীরালাল ছুট্টে গিয়ে দরজার খিলে মেরেছে ধাক্কা। ধাঁই-ই-ই করে খিল ছিটকে খুলে পড়ল। দরজা খুলেই মার ছুট।
না, পারল না হীরালাল। চৌকাঠ ডিঙিয়ে একটা পা বাইরে ফেলেছে মাত্তর, ব্যস! তার আগেই ম্যাজিকঅলা লোকটা উঠে পড়েছে। কিছু না পেয়ে হীরালালের জামাটাই খপ করে ধরে ফেলেছে। ধরেই মেরেছে এক টান। টাল খেতে-খেতে হীরালাল মারল গিয়ে দেওয়ালে এক ধাক্কা। উঃ! কপালে ভীষণ লেগেছে। তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাজিকঅলার চোখের দিকে তাকিয়েই হীরালাল জুজুবুড়ি! কী সাংঘাতিক দেখতে লাগছে ম্যাজিকঅলাকে! কী বীভৎস তার মুখখানা! চোখ দুটো রাগে টকটক করছে! সারা শরীর তার ঠকঠক করে কাঁপছে। তার ঠোঁটটা বিড়বিড় করে কী যেন আওড়াচ্ছে! হঠাৎ সে তার ডান হাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসে ফুঁ মারল। মেরে বিকট একটা চিৎকার করে, হাতের মুঠি খুলে হীরালালের মুখের ওপর ছুঁড়ে দিল। হীরালালের গায়ের ওপর যেন বাজ পড়ল। হীরালাল ‘ও মা’ বলে ককিয়ে উঠেই ধপাস করে মাটিতে পড়ে ছটফটাতে লাগল! হাত-পা ছুঁড়তে লাগল।
ধীরে ধীরে হীরালালের হাত-পা নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়ল। চোখের পাতা দুটিও খুঁজে গেছে।
শুনলে অবাক হবে, অনেকক্ষণ পর হীরালাল যখন উঠে বসল, তখন সে একেবারে অন্য মানুষ। সে দেখছে ফ্যালফ্যাল করে এদিক-ওদিক চারপাশ। এই ঘরটা, ওই ম্যাজিকঅলা লোকটা, সব যেন তার কত চেনা! হীরালালের মুখের দিকে তাকাও, তোমার মনে হবে, হীরালাল আর সে হীরালাল নেই! কে যেন ওকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে। ভুলিয়ে দিয়েছে তার মাকে, লক্ষ্মী তার মোষকে। আর মনে পড়ে না তার ছোট্ট তাদের ঘরখানির কথা। কিংবা মাঠের গান, নদীর ঢেউ আর ঢেউয়ের সঙ্গে দুলতে-দুলতে হারিয়ে যাওয়া।
সত্যি-সত্যি হারিয়ে গেল হীরালাল। হবেও-বা, ম্যাজিকঅলার ওই মুঠোর মধ্যে হীরালালকে সব ভোলাবার মন্ত্র ছিল। হয়তো হীরালালকে সম্মোহন করে দিয়েছে লোকটা। তাই হীরালাল সব ভুলেছে।
ম্যাজিকঅলা এতক্ষণ হীরালালের সামনেই ছিল। হীরালাল উঠে বসতেই ম্যাজিকঅলা হাত নেড়ে ইশারা করল। ম্যাজিকঅলার চাউনিটা কেমন শয়তানিতে ভরা দেখ! দেখলেই তোমার বুক দুরুদুরু করে কেঁপে উঠবে! হঠাৎ লোকটা গলায় এক ভয়ংকর শব্দ করে হীরালালকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ খোঁকা, বোলো তো তোমার নাম কী আছে?’
কে জানে কেন, হীরালাল কোনো উত্তর দিল না। শুধু বোকার মতো তাকিয়ে রইল।
ম্যাজিকঅলা আবার জিজ্ঞেস করল, কী নাম?’
হীরালালের মুখে কথা নেই। থাকবেই বা কেমন করে! হীরালাল নিজেকে যেমন ভুলেছে, নিজের নামটাও তো তেমন ভুলে গেছে।
ম্যাজিকঅলা এবার হীরালালের ওপর চোখ রাখল। কী ভয়ংকর সে চাউনি! তারপর খুব চাপা গলায় বলল, ‘তোমহার নাম কাকাতুয়া!’
তবুও হীরালাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
‘বোলো, কাকাতুয়া। বোলো!’
এবার হীরালাল ধরা-ধরা গলায় বলল, ‘কাকাতুয়া।
বহুত আচ্ছা।’ লোকটা হীরালালের চিবুকটা ধরে আদর করল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আউর হামার নাম? হামার নাম, উস্তাদ। বোলো উস্তাদ।’
হীরালাল তেমনি ধরা-গলায় বলল, ‘উস্তাদ।’
শাবাশ!’।
ম্যাজিক দেখাতে-দেখাতে ম্যাজিকঅলা থেকে-থেকে যেমন করে চেঁচিয়ে ওঠে, এবার তেমনি চিৎকার করে লোকটা হীরালালকে নতুন নামে ডাক দিল, ‘এ কাকাতুয়া।’
যেমন করে ম্যাজিকঅলা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ঠিক তেমনি চেঁচিয়ে হীরালাল উত্তর দিল, ‘উস্তাদ!
‘তোমহি এখন কী দেখাবে।
‘আমি এখন খেলা দেখাব।’
‘কোন খেলা দেখাবে?’
ম্যাজিক খেলা।’
এবার ম্যাজিকঅলা হীরালালের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, ‘বহুত খুব।
.
তারপর কটা দিন কেটে গেল। ক-দিনে কটা নতুন খেলা শিখে ফেলল হীরালাল। নতুন খেলা শিখতে শিখতে হীরালালের আর এক নতুন জীবন শুরু হয়ে গেল। এখন সে ম্যাজিকঅলার সাকরেদ। আর আজই প্রথম সাকরেদি করতে গিয়ে হীরালাল আর এক বিপদের হাতছানি দেখতে পেল!
হীরালালকে নিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় খেলা দেখাতে যে ম্যাজিকঅলার দস্তুরমতো ভয় ছিল, সে তো জানা কথা। কেননা, রাস্তা-ঘাটে হীরালালকে কেউ যদি চিনে ফেলে, তা হলে যে কী হবে, সে-কথা কী আর ম্যাজিকঅলাকে বলে দিতে হবে। মারের চোটে বাছাধনের বদন বিগড়ে তো দেবেই, তার ওপর পুলিশ ডাকবে, নাকে দড়ি দিয়ে খাটাবে, লোকে ছ্যা-ছ্যা করবে। ম্যাজিক খেলা লাটে উঠবে। তাই ম্যাজিকঅলা আজ আর তেমন কোনো দূরে, অজানা জায়গায় ম্যাজিক দেখাতে গেল না। কাছেপিঠে একটা ছোট্ট মাঠের ওপর ডুগডুগি বাজিয়ে দিল। বাজিয়ে-বাজিয়ে হাঁকতে লাগল :
‘মাদারি কা খেল দেখো,
মাদারি কা খেল।
আজব খোঁকার খেল দেখো,
হরেক মজার খেল।
’ রোজ যেমন করে, আজও তেমনি হীরালাল ডুগডুগির তালে-তালে ম্যাজিকের মাল-পত্তর বাঁধাই-করা ঝোলাঝুলি খুলে ফেলল। একদিকে একটা মড়ার মাথা সাজিয়ে রাখল আর একদিকে সাত-সতেরো জিনিস ছড়িয়ে রাখল। দেখতে-দেখতে কত লোক। চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর শুরু হয়ে গেল, খেলার মজা, মজার খেলা! লোকটা ডুগডুগি বাজায়, আর মাঝে-মাঝে হাঁক দেয়, ‘কাকাতুয়া!
হীরালাল সাড়া দেয়, ‘উস্তাদ!
‘তুমহার ভুক লেগেছে?
‘হ্যাঁ উস্তাদ!
‘তো কী খাবে?’
‘বাদাম খাব।’
‘বাদাম?’
‘হ্যাঁ, উস্তাদ।
সেই কথা শুনে তখন ম্যাজিকঅলা সামনে যারা খেলা দেখছিল, তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে ভান করল। বলল, ‘দেখেন স্যার, কাকাতুয়া এখোন বাদাম খানে মাংতা। বোলেন তো, আমি এখোন বাদাম কিধার পাব! আচ্ছা, ঠিক হ্যায়। চেষ্টা তো করতে হোবে,’ বলে ম্যাজিকঅলা একটা খালি কৌটো নিয়ে খুলে খুলে সবাইকে দেখাল। চেঁচাল, ‘দেখেন বাবুরা, এর ভেতর কুচ্ছ না আছে–দেখিয়ে স্যার, আভি আভি বাদাম এসে যাবে।’ বলেই ম্যাজিকঅলা কৌটোর ওপরে ঢাকা দিয়ে কৌটোটা বন্ধ করে দিল। তারপর হাঁক পাড়ল,’লেড়কালোক, একদফে জোরসে তালি লাগাও।’
অমনি চটপট, চটাপট চারদিক থেকে তালি পড়ল। ম্যাজিকঅলা চোখ বুজে বিড়বিড় করে কী সব মন্তর আওড়ালে, কেউ শুনতে পেল না। তারপর চোখ খুলে, কৌটোটা নেড়ে দিল। চিৎকার করে কৌটোটা খুলে ফেলতেই, ওই দেখ, কৌটো-ভর্তি বাদাম!
‘কাকাতুয়া! কৌটো খুলে আবার সে হীরালালকে ডাক দিলে।
হীরালাল তেমনি করেই সাড়া দেয়, ‘উস্তাদ।’
‘বাদাম খা লেও!’।
‘না উস্তাদ, বাবুলোকদের দিয়ে দাও।’
‘বহুত আচ্ছা।’ বলে, ম্যাজিকঅলা কৌটো থেকে বাদাম বার করে, সেই বাদাম ছেলে-বুড়ো যারা দেখছিল সবাইকে বিলিয়ে দিল।
দেখ, দেখ, ওই তিনটে লোককে যেন চেনা লাগছে! তাই তো, লোকগুলোর যে গাল-ভরতি দাড়ি! কোথায় যেন দেখেছি।
আরে, আরে! এ যে সেই তিনজন সৈনিক। সেই যে, বনের সেই পোড়ো-বাড়িটার ভেতর পালিয়ে এসে, লুকিয়ে-লুকিয়ে নিজেদের পোশাক ফেলে, ছদ্মবেশে সেজে আছে!
হ্যাঁ, তাই তো! তারাও যে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ম্যাজিক দেখছে। ওই তো! হাত বাড়িয়ে বাদাম নিচ্ছে! কুচমুচ করে চিবুচ্ছে! না, হীরালাল এখন আর তাদের মনে করতে পারবে না। হীরালাল তো এখন আর হীরালাল নেই। এখন তো ও সব ভুলে গেছে! ও তো এখন কাকাতুয়া!
কাকাতুয়া!’ আবার লোকটা ডাক দিল।
‘উস্তাদ!
‘এখোন কী খেলা দেখাবে?’
‘জ্যোতিষ-খেলা।’
‘শাবাশ! ম্যাজিকঅলা হীরালালের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করল। তারপর চেঁচিয়ে চারপাশের লোকদের বলল, ‘হাঁ স্যার, এ-খেলাটা বহুত কড়া খেলা। দেখিয়ে বাবু, হামার এই সাকরেদ আভি-আভি আপনাদের জ্যোতিষকা খেলা দেখাবে। আপনাদের ভাগ্যমে কী আছে, আভি-আভি আপনাদের মালুম হয়ে যাবে।
বলে ম্যাজিকঅলা আবার তেমনি চিৎকার করে উঠল, কাকাতুয়া!’
‘উস্তাদ।
ইধার আসো।’
হীরালাল এগিয়ে এল। একেবারে ম্যাজিকঅলার সামনে। ‘হামার আঁখ কা উপার নজর রাখো।’
হীরালাল ম্যাজিকঅলার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর যে কী হল, হঠাৎ হীরালাল টলে পড়ল। টলতে-টলতে ম্যাজিকঅলার গায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল। ম্যাজিকঅলা ধরে ফেলল হীরালালকে। ধীরে-ধীরে মাটির ওপর শুইয়ে দিল। তারপর একটা কাপড় দিয়ে হীরালালের মুখখানা চাপা দিয়ে ডেকে উঠল,’এ কা-কা-তুয়া।’
অনেক দূর থেকে শব্দ ভেসে এলে যেমন শুনতে লাগে, হীরালালের গলা থেকেও সঙ্গে-সঙ্গে তেমনি সাড়া জেগে উঠল, ‘উ-স-তা-দ!
‘হামি এখন যো বাবুর গায়ে হাত রাখিয়েছি, এ বাবুকা কাম কী আছে?
‘কিচ্ছু না।’
বাবুকা কাম হোবে?’
‘দেরি হবে।’
‘দেরি কোতো হোবে?’
‘সাত মাস।’
ম্যাজিকঅলা এবার আর একজনের কাছে এল। আবার ডাক দিল,
‘কা-কা-তু-য়া!
‘উ-স-তাদ!
‘এ-বাবুকা ভাগ্য কেমন আছে?’
‘খুব খারাপ।
‘খারাপ কেন?’।
‘এ-বাবু একজন সৈনিক। এখানে ওঁর দুজন বন্ধুও আছেন। তাঁরাও সৈনিক। একদিন এ-বাবুদের দাড়ি গোঁফ খসে পড়বে। তারপর বাবুরা চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটবে!’
‘তাজ্জব বাত!’
হ্যাঁ, সত্যিই তো। ম্যাজিকঅলা এবার ওই তো তিনজন ছদ্মবেশী সৈনিকের কাছেই এসেছে! যদিও তারা চার-পায়ে হাঁটবে শুনে, রাজ্যের লোক হো-হো করে হেসে উঠল, কিন্তু ওই তিনজন সৈনিকের ভয়ে দফা শেষ। তারাও অবিশ্যি সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসবার চেষ্টা করল, কিন্তু হীরালালের মুখে ওই কথা শুনে, তাদের মুখে হাসি ফোটে কী করে! তাদের তো মাথা এখন বাঁহ-বাঁই ঘুরছে। ভেবে কিনারাই করতে পারছে না, কী করে বলল এই ছেলেটা, তারা সৈনিক। এ কি সত্যি ম্যাজিক, না অন্য কিছু। তারা ভাবল, এমনও তো হতে পারে ছেলেটা তাদের চেনে! হয়তো আগে দেখেছে! হয়তো তাদের পালিয়ে আসার খবরটা সে জানে। তাদের দাড়ি-গোঁফ, এ যে সব নকল, হয়তো এটাও তার জানা! নইলে বলল কেমন করে দাড়ি-গোঁফ খসে পড়বে। কিন্তু একটা কথার মানে তারা কিছুতেই বুঝতে পারল না। ওই যে বলল না, চার পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটবে তারা!
লোক তিনটে আর দাঁড়াল না। নিজেদের মধ্যে চোখের ইশারায় কথা হয়ে গেল। খেলা চলছে তখনও। ফাঁক বুঝে তিনজন চুপচাপ কেটে পড়ল।
কেটে পড়ল বটে, কিন্তু কী ভয়ানক দুর্ভাবনা তাদের। ভয়ে তিনজনেই এখন জুজু। তিনজনে একটা নিরিবিলি জায়গায় তিন মুণ্ডু এক করে ভাবতে বসল। একজন বলল, ‘এখান থেকে এক্ষুনি পালানো উচিত।’
আর একজন বলল, ‘এই ছদ্মবেশটা খুলে ফেলে আর একটা নতুন ছদ্মবেশ পরতে হবে।’
কিন্তু শেষজন বলল, ‘না, তাতে আমরা রেহাই পাব না। ওই ম্যাজিক যদি সত্যি হয় তা হলে ছেলেটার কথা মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে। আর যদি সত্যিনা-ও হয়, তাহলে বলতে হবে, ছেলেটা আমাদের কথা কোনো-না-কোনোভাবে জেনে ফেলেছে। সুতরাং এখন বাঁচতে হলে আমাদের লক্ষ্য হবে ছেলেটাকে ধরে সরিয়ে ফেলা!
‘ধরব কেমন করে?’ একজন জিজ্ঞেস করল।
‘গোপনে!’
‘আমরা নিজেরাই ধরা পড়ে গেলে?
‘ধরা পড়তে পারি। কিন্তু এ-ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর ভয় পেলে চলবে না।’
‘ওই দেখ, ম্যাজিক ভেঙে গেছে।’
হ্যাঁ সত্যিই ম্যাজিক ভেঙেছে। লোকের ভিড় কাটছে। ‘এখন চ আমরা ম্যাজিকঅলার পিছু নি। চ দেখি, কোথায় ছেলেটা থাকে।’
তারপর সেই নিরিবিলি জায়গা থেকে তিনজনে বেরিয়ে এল। নিঃসাড়ে ম্যাজিকঅলা আর হীরালালের পিছু নিল।
না, এখন আর হীরালালকে নিয়ে ম্যাজিকঅলার ভয় নেই। হীরালাল যে পালিয়ে যাবে, এমন কথাও আর ম্যাজিকঅলা ভাবে না। ছেলেটার মগজ সে অনেক আগেই সাফ করে দিয়েছে। এখন হীরালাল জানে, এই তার ঘর। ম্যাজিকঅলা তার আপন জন। আগে হলে কী হত বলতে পারি না, এখন ওই মড়ার খুলিটা দেখলে ওর একটুও ভয় লাগে না। অত কী, রাত্রে যখন শুতে যায় হীরালাল, ওই মড়ার মাথাটা তো ঠিক তার মাথার ওপর, ওই তাকটাতে বসানো থাকে। তার ঘুমুবার সময় ওই খুলিটা হেসে উঠল, অথবা তুড়ক তুড়ক লাফিয়ে উঠলেও হীরালাল শিউরে উঠবে না।