ঘনাদা চৌকাঠ পেরিয়েই থমকে দাঁড়ালেন।
আমরা সবাই অবাক।
ঘনাদা তারপর নাকটা বার দুই কুঁচকোলেন সেই সঙ্গে ভুরু জোড়াও।
আমরা উৎকণ্ঠিত।
ঘনাদা নাসিকাধ্বনি করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দিশাহারা।
আমরা শশব্যস্ত হয়ে তখন যে যার আসন থেকে উঠে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছি। হতভম্ব হয়ে। ঘনাদার এ নাসিকা কুঞ্চন মোটেই শুভলক্ষণ নয়। এত ভেবে চিন্তে যে ফন্দি করা হয়েছে তা বুঝি শুরুতেই যায় ভেস্তে।
কিন্তু তাই বা কী করে হয়? ঘনাদার পঞ্চেন্দ্রিয় অতি তীক্ষ না হয় মানলাম, কিন্তু আমাদের যা মতলব তা তো ঘ্রাণে টের পাবার জিনিস নয়। ঘনাদা নাকে শুকেই কি তাঁর জন্য সাজানো ফ্যাসাদটা আঁচ করে ফেললেন!
এ সব চিন্তা নিমেষে আমাদের মনে তখন খেলে গেছে।
ঘনাদাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আমরা রহস্যটা বুঝতে ও তাঁকে আশ্বস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।
কী হয়েছে, ঘনাদা!
কী হয়েছে? ঘনাদা যেন আসামির দিকে সরকারি কৌঁসুলির মতো তাকিয়ে ফেটে পড়লেন, এখানে দু-দণ্ড এসে বসতাম। তা-ও বন্ধ করতে চাও।
বলেন কী, ঘনাদা! আমরা সত্যিই আকাশ থেকে পড়ি।
আপনার বসবার জন্যই তো এত আয়োজন! বললে শিবু।
বনোয়ারি এখুনি এল বলে। গৌরের ইঙ্গিত।
হাত না পড়লে ফেরত। আমি সে ইঙ্গিত একটু মোটা করে দিলাম।
একেবারে বাদশাহি শিঙাড়া। শিশির সোজা বাংলায় ব্যাখ্যা করে দিলে, হাতের মুঠোয় ধরে না।
কিন্তু কোনও টোপেই কাজ হল না।
ও ছাইপাঁশ তোমরাই খেয়ো।বলে ঘনাদা একেবারে রাইট অ্যাবাউট টার্ন করে সোজা তাঁর তেতলার কুঠুরির দিকে পা বাড়ালেন।
আমাদের তখন চোখ কপালে উঠেছে।
হরি ময়রার দোকানের বাদশাহি শিঙাড়া ঘনাদার কাছে ছাইপাঁশ! জেগে আছি না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি চিমটি কেটে বুঝি দেখতে হয়!
তবু ঘনাদার সঙ্গে খানিকটা যেতে হল শেষ চেষ্টা করতে।
আপনার জন্য সবাই যে বসে আছি, ঘনাদা! আমার করুণ নিবেদন।
মৌলবি সাহেব সেই কায়রো থেকে এসেছেন! শিবুর বেফাঁস বোকামি। কিন্তু সেটা সামলাবার দরকার হল না। তাতেই কাজ হবে বলে একটু যেন আশা পেলাম।
কে এসেছেন! ঘনাদা সিড়ির পয়লা ধাপ থেকে ফিরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
মৌলবি জিয়াউদ্দিন খাঁ। অবস্থা বুঝে শিশির একটু উসকে দিল। মিশরের আল আঝার থেকে আসছেন শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি সবিস্তারে জানাতে বিলম্ব করলাম না।
কেন? ঘনাদার গলার স্বরটা কেমন যেন কম্পিত মনে হল। সেটা ভয়ে না বিরক্তিতে বোঝবার চেষ্টা না করাই ভাল।
আপনি ছাড়া আর গতি নেই যে! গৌর ঘনাদাকে টঙে তোলবার ব্যবস্থা করলে, ইবন জুবেরের ও পরোনো পথির নইলে মানে-করবে কে?
ঘনাদার মুখের ওপর দিয়ে একটু ছায়া সরে গেল কি? ও, ইবন জুবের। বলে যে রকম ব্যস্ত হয়ে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন তাতে বুঝলাম তাঁর স্মরণশক্তিটা একটু খুঁচিয়ে দেওয়া দরকার।
ভাগ্যে ইবন জুবেরের নামটা আপনার কাছে শুনেছিলাম! তাঁর পিছু পিছু নাছোড়বান্দা হয়ে উঠতে উঠতে বললাম, মৌলবি সাহেবকে সে গল্প বলতেই উনি তো একেবারে আহ্লাদে আটখানা!
ঘনাদা ততক্ষণে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও।
রিলে রেসের মতো আমার কথার খেই ধরে গৌর শুরু করে দিলে, ইবন জুবেরের নিজের হাতে লেখা একটা দুষ্প্রাপ্য পুঁথি আপনাকে দিয়ে একটু পড়িয়ে নেবার জন্যে মৌলবি সাহেব অনেক আশা করে এসেছেন।
হুঁ, বলে ঘনাদা তাঁর গড়গড়ার কলকো তুলে নিয়ে তাতে টিকে সাজাতে ব্যাপৃত হলেন।
আপনার সঙ্গে আমরা অমন অভদ্রের মতো চলে আসায় কী ভাবছেন কে জানে!
ঘনাদা নীরবে টিনের কৌটো খুলে টিকের ওপর অম্বুরী তামাক রাখলেন গুলি পাকিয়ে।
শুধু একবার পুঁথিটা একটু পড়ে দিয়েই যদি চলে আসতেন, আমাদের মান থাকত। বড় মুখ করে ডেকে এনেছি।
ঘনাদা দেশলাই জ্বেলে একটা টিকে ধরাতে তন্ময় হলেন।
আরবি তো আপনার বলতে গেলে ডালভাত। সেই নকল ইবন ফরিদের আরবি শুনেই তার বিদ্যের দৌড় আর শয়তানি কী রকম সেবার ধরে ফেলেছিলেন। হতভাগা নাম ভাঁড়িয়ে ইবন ফরিদের নাম চালাতে গেছল আপনার কাছে। মার কাছে মামার বাড়ির গল্প!
ঘনাদারই পুরোনো গল্পের নজির টেনে তাঁকে তাতাবার চেষ্টা করলাম।
ঘনাদার তাতবার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। তাঁর কলকেটাই ধরে উঠল তাঁর ফুয়ে।
পুঁথিটা নাকি সুদানের ওয়াদি ঘাজালের এক বহু পুরোনো খুদে পিরামিডে মৌলবি সাহেব পেয়েছেন। আমরাও কোনওরকমে ফু দিয়ে চললাম ঘনাদার ছাইচাপা আগুন জাগিয়ে তোলবার আশায়।
ঘনাদা গড়গড়ার ওপর কলকে বসিয়ে নলটা বাগিয়ে ধরে মৃদুমন্দ টান দিতে শুরু করলেন।
ইবন জুবের স্পেনের গ্রানাদা থেকে বাগদাদ যাবার পথে এ-পুঁথি নাকি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এতদিন বাদে সে-পুঁথি উদ্ধার হয়েও শেষে পড়বার লোকের অভাবে মাঠে মারা যাবে!
ঘনাদার নয়, তাঁর গড়গড়ার নলের আওয়াজই শুধু শোনা গেল।
বনোয়ারি এতক্ষণে শিঙাড়াগুলো ভাজিয়ে আনল বোধ হয়।
ঘনাদা একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন।
মৌলবি সাহেবকে অনেক আশা দিয়ে আমরাই এনেছিলাম।
তাহলে ভালই হয়েছে চলে এসে। মৌলবি সাহেবকে নিরাশ আর করতে হল । ঘনাদা এতক্ষণে মুখ খুললেন।
তার মানে! আমরা বিমূঢ়, ঘরের দরজা থেকে একটা কথা না বলে ফিরে এলেন। আর নিরাশ করা কাকে বলে!
ঘরে ঢুকলে আরও নিরাশ করতে হত! ঘনাদার উক্তি তাঁর গড়গড়ার ধোঁয়ার মতোই।
আমাদের হাঁ করা মুখগুলোর দিকে চেয়ে ঘনাদার করুণা হল কি না জানি না। দয়া করে একটু সবিস্তারে বললেন, নিরাশ করতে হত এই জন্যে যে ও-পুঁথি জাল। যত তেতোই হোক সত্যি কথাটা তো না বলে পারতাম না!
ও পুঁথি জাল!
আপনি জানলেন কী করে?
পুঁথি তো চোখেও দেখেননি।
শোনেননি পর্যন্ত তখন পুঁথির কথা।
জাল আর আসল পুঁথি কি শুকেই বোঝা যায়!
জাল পুঁথির গন্ধ পেয়েই চলে এলেন নাকি!
আমাদের প্রত্যেকের বিস্ময় নানা ভাবে নানা ভাষায় প্রকাশ পেল। ঘনাদা ততক্ষণ নির্বিকার ভাবে রাম টানে গড়গড়ার জলে তুফান তুলছেন।
আমাদের কথা শেষ হতেই এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে ঘনাদা যা বললেন তাতে আমরাও চতুর্দিকে শুধু ধোঁয়াই দেখলাম।
পুঁথির গন্ধে নয়, চলে এসেছি ঘরের দুর্গন্ধে! ঘনাদা কড়া গলায় জানালেন।
দুর্গন্ধে! আমরা তাজব—ও-ঘরে দুর্গন্ধ! রোজ সকালে দস্তুরমতো ফিনাইল দিয়ে ও-ঘর মোছা হয়। তার ওপর ফ্লিট দিয়েছি আধঘণ্টা আগে!
ওঃ, ফ্লিট দিয়েছ? ঘনাদা প্রায় তাঁর কলকের মতোই গরম হয়ে উঠলেন— তাই বিশ্রী বিদঘুটে প্রাণবারকরা দুর্গন্ধ!
বলেন কী, ঘনাদা। ফ্লিট তো মাছি তাড়াবার জন্য দিতে হয়। আপনি তো আর মাছি নন! মেসের সব ঘরেই তো ফ্লিট দিচ্ছি এখন। বর্ষায় যা মাছি বেড়েছে! আপনার ঘরেও তো আজ দেব।
আমার ঘরে ফ্লিট দেবে! ঘনাদা যেন তাঁর কলকের জ্বলন্ত টিকেই হয়ে উঠলেন, তার চেয়ে ঘরে আগুন দেবে বলল না!
ফ্লিট আর আগুন এক! আমরা একেবারে থ—ঘরের মাছি তাড়াতে আপনি চান না!
না। বজ্রগম্ভীর স্বরে বললেন ঘনাদা, তোমাদের ওই আধা বৈজ্ঞানিক বাতিক
আমার নেই। পোকা, মাকড়, মাছি-সব একেবারে দুনিয়া থেকে সোপার্ট করে দেবে, কেমন! এদিকে পোকা মারবার বিষে মানুষই জরজর হতে চলেছে-সে খোঁজ রাখো? জানো খাবারের জলে হাওয়ায় কী পরিমাণ বিষ ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
লক্ষণ সব শুভ! পালে হাওয়া লেগেছে। এখন শুধু হালটা ঠিকমতো ধরতে পারলেই হয়।
জোয়ারের টানেই নৌকোর মুখটা ধরে রেখে বললাম, কিন্তু মাছি বাড়লে বড় জ্বালাতন করে যে!
করুক। ঘনাদা নির্বিকার—একটা কৃতজ্ঞতা তো আছে?
মাছির কাছে কৃতজ্ঞতা! আমাদের চোখ সব কপালে উঠেছে তখন।
হ্যাঁ, জ্যোতিষের একটু হিসাব, আর এই মাছি না হোক, এদেরই জাত-ভাইয়ের সাহায্য না পেলে-
ঘনাদা কথাটা শেষ করবার আগেই শিবু চটপট পূরণ করে দিলে, পৃথিবীর ইতিহাস উলটে লেখা হত।
হিমালয়টা হঠাৎ কাত হয়ে পড়ে যেত। সংশোধন করলে শিশির।
রুশ মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি যেত বানচাল হয়ে। গৌর তার সিদ্ধান্ত জানালে।
না। ঘনাদা গড়গড়ার নলটাকে সরিয়ে রেখে আমাদের দিকে অনুকম্পাভরে চেয়ে বললেন, ওসব কিছু নয়, ক্যামেরুনসের মান্দারা পাহাড়ের একটা গোপন গুহায় দুটো কঙ্কাল পাওয়া যেত!
কার ঘনাদা?
একটা ডা. লার্বোর আর একটা ঘনশ্যাম দাসের!
কী সর্বনাশ! ভুলে ফেলে আসছিলেন বুঝি!
হাসি চেপে শিবুর বেয়াড়া মন্তব্য সামলাতে চটপট যার যা মাথায় আসে বলতে হল।
গুহার মধ্যে মানুষখেকো জন্তু জানোয়ার ছিল বুঝি! শিশিরের জল্পনা।
কামড় দিতে গিয়ে নাকে মাছি ঢুকে নিশ্চয় হেঁচে ফেলেছিল! আমার বিস্তারিত ব্যাখ্যা।
না, না গুহার ভেতর চাপা পড়েছিলেন। আর এক ঝাঁক মাছি এসে পাথরটা সরিয়ে দেয়। গৌরের সহজ সরল সমাধান।
প্রায় তাই!
আমাদের চোখগুলো ছানাবড়া করে তুলে ঘনাদা শুরু করলেন, তখন সুদানের বহু পুরোনো এক খ্রিস্টান মঠের ধ্বংসাবশেষ দেখবার জন্যে ওয়াদি ঘাজালে কিছুদিনের জন্য আছি। সেখানেই হঠাৎ একদিন ড, লার্বো আর লুইগি ক্যাপেলা দুজনের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল। ক্যাপেলাকে আগে কখনও দেখিনি। ড. লার্বো আমার চেনা। তবু ড. লার্বোকে প্রথম চিনতেই পারিনি। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ফ্রান্সে তার সঙ্গে পরিচয়। তখন লার্বো বয়সে তরুণ। তার বাবার সঙ্গেই আফ্রিকার নৃতত্ত্ব বিষয়ে কাজ করে সবে ডক্টরেট পেয়েছে। তার বাবা মঁসিয়ে আঁদ্রে লার্বোর কোনও রকম পদবি-টবি ছিল না। কিন্তু পর্যটক পণ্ডিত হিসেবে তাঁর নাম তখন যথেষ্ট। বাবা আঁদ্রের ব্যাপার নিয়েই তাঁর ছেলে লার্বো আমার কাছে এসেছিল। আঁদ্রে বছর কয়েক আগে আফ্রিকায় পর্যটনে গেছেন। তারপর থেকে তাঁর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। এরকম নিরুদ্দেশ হওয়া তাঁর স্বভাব। কিন্তু এবার যেন বড় বেশিদিন নিখোঁজ হয়ে আছেন। আমি তখন সদ্য আফ্রিকারই ক্যামেরুনস থেকে ফিরেছি। তাই লার্বো আমার কাছেই কোনও খবর পাওয়ার আশায় এসেছিল।
বিশেষ কিছু খবর তাকে দিতে অবশ্য পারিনি। ক্যামেরুনস তখন জার্মানদের দখলে। সমুদ্রের ধারে দৌয়ালা তাদের রাজধানী। সেখানে আঁদ্রের সঙ্গে একবার দেখা আমার হয়েছিল বটে। ক্যামেরুনসের উত্তরে একটা কী জায়গা যেন তাঁর ইজারা নেওয়া আছে। সেইখানেই তিনি যাচ্ছেন বলেছিলেন। লার্বোর সঙ্গে সেদিন আরও অনেক কথাই হয়েছিল। আফ্রিকার নৃতত্ত্ব শুধু নয়, সেখানকার বহু লুপ্ত শিল্পকলা সম্বন্ধে তার জ্ঞান দেখে খুশিই হয়েছিলাম।
যাকে সুস্থ-সবল জোয়ান দেখেছিলাম ভেঙেপড়া কুঁজো এক আধবুড়ো চেহারায় তাকে আর চিনব কী করে! লার্বো নিজে থেকে এসে পরিচয় দেবার পর শুধু তার চেহারা দেখে নয়, আরও অনেক কিছুতেই অবাক হয়েছিলাম।
তখন সুদানিদেরই একটা আধা হোটেল আধা সরাইয়ে আছি। একাধারে হোটেলের খানসামা ও বাবুর্চি ওসমান এসে খবর দিলে, দুজন সাহেব আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
দুজন এসে ঘরে ঢোকবার পর কাউকেই চিনতে পারলাম না। একজনের হেভিওয়েট বসারের মতো বিরাট চেহারা। আর একজন শুকনো শীর্ণ বুড়োটে মানুষ।
বুড়োটে মানুষটিই প্রথম সম্ভাষণ করে বললে, আমায় চিনতে পারছেন না নিশ্চয়, মি. দাস। আমার সঙ্গে প্যারিসে আপনার দেখা হয়েছিল কয়েকবার। আমার নাম ড. লার্বো।
সত্যিই প্রথমটা যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। লার্বোর কাছে তার কাহিনী শোনবার জন্যে উদগ্রীব হলেও আপাতত তার আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কারণ জানতে চাইলাম।
কারণ আর কিছু নয়, আমায় দিয়ে একটা পুরোনো পুঁথির দাম যাচাই করানো। পুঁথিটা ষণ্ডামাকা ক্যাপেলাই অনেক কষ্টে নাকি সংগ্রহ করেছে। ড. লার্বো টুকিটাকি পুরোনো পাণ্ডুলিপি, হাতের শিল্পকাজ এই সবই এখন সংগ্রহ করে নানান মিউজিয়মে আর খেয়ালি বড়লোকদের কাছে বিক্রি করে। পুঁথিটা ক্যাপেলার কাছে সে কিনতে চায়। আমায় ওয়াদি ঘাজালে দেখে চিনতে পেরে একটু পাকা মতামত নিতে এসেছে।
পুঁথিটা নাড়াচাড়া করে হেসে বললাম, কেনবার তো অনেক কিছু আছে ড. লাবো। এ-পুঁথি না-ই বা কিনলেন?
কেন, এ-পুঁথির দাম নেই?ক্যাপেলা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে জানতে চাইলে। পালোয়ানের মতো চেহারা হলেও মানুষটার মুখ-চোখের গড়ন এমন যে সব সময়েই করুণ দেখায়।
দুঃখের সঙ্গে বললাম যে, সস্তা কাগজে লিখে তেঁতুল জলে ভিজিয়ে রেখে পুরনো করা হয়েছে তার বেশি কিছু দাম ও-পুঁথির নেই। এ পুঁথির এরকম আরও দুটো নকল যে আমি দেখেছি তাও জানালাম।
বুদ্ধির গোড়ায় তখন আমাদেরও ধোঁয়া লেগেছে। চট করে ধরে ফেলে শিবুই সবার আগে বলে ফেললে, এই ইবন জুবেরের নকল পুঁথিই নাকি সেটা!
হুঁ, এই পুঁথিরই আরেক নকল! ঘনাদা বলতে শুরু করলেন, দুজনকে নকলের প্রমাণগুলো বুঝিয়ে দিয়ে লার্বোকেই জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু আপনার আসল কাজ ছেড়ে এসব বাজে মালের কারবারে এসেছেন কেন?
এসেছি মামলায় সর্বস্বান্ত হয়ে। দুঃখের সঙ্গে বললে লার্বো।
মামলাটা যে কী লার্বো তারপর আমার অনুরোধে বিস্তারিত ভাবে জানালে।
ক্যামেরুনস যখন জার্মানদের দখলে তখন ১৯০৩ সালে লার্বোর বাবা আঁদ্রে উত্তরের মান্দারা পাহাড়ের কাছে একটা পাহাড়ি জায়গা একজন জার্মানের কাছে লেখাপড়া করে ইজারা নেন। কেন যে ওই অখদ্দে জায়গা তিনি বেছে নিয়েছিলেন ইজারা নিতে তা কেউ জানে না। শুধু শেষবার চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হবার আগে ছেলের কাছে একটি চিঠির চিরকুট তিনি পাঠান। তাতে দু-লাইনে লেখা ছিল—আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমি মান্দারা পাহাড়ে আগলে আছি। যত তাড়াতাড়ি পারো, এসো।
কিন্তু তখন প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ক্যামেরুনস নিয়েও লড়াই চলছে ইংরেজ ফরাসির সঙ্গে জার্মানদের। সেখানে যাওয়া অসম্ভব। যুদ্ধ থামবার পর গোল কমবার বদলে বাড়ল। জার্মানির অধিকার ভাগ করে নিলে ইংরেজ আর ফরাসি। সরকারি কাগজপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে। ইজারার দাবি প্রমাণ করাই শক্ত। তবু লার্বো একবার ইংরেজ একবার ফরাসি সরকারের সঙ্গে মামলা লড়লে। মামলায় কেঁচো খুঁড়তে সাপ বার হল। জানা গেল লাববার বাবার ইজারা নেওয়া জায়গা গোড়াকার মালিক দাবি করছে। লার্বোর বাবা আঁদ্রে নাকি তাঁর কাছেই ইজারা নিয়ে পুরো দাম দেননি। ইজারা বাতিল হলেও কী ঐশ্বর্যের কথা আঁদ্রে জানিয়েছিলেন তার একবার খোঁজ করতে পারলেও হত। কিন্তু সে জার্মান মালিক মান্দারা পাহাড়ের ও-অঞ্চলে লার্বোকে ঢুকতে দিতেই রাজি নয়। এক সঙ্গে ফরাসি সরকার ও সেই দাবিদার গোড়াকার মালিকের সঙ্গে সর্বস্বান্ত হয়ে লড়ে একেবারে না হারলেও ফল যা দাঁড়িয়েছে তা হতাশ হবারই মতো।
সেটা কী রকম? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
লার্বো তার উত্তরে যা জানাল তা অদ্ভুত শর্তের এক চুক্তি। ১৯০৩ সালে আঁদ্রে ইজারা নেন জায়গাটা। ঠিক সেই ১৯০৩-এর হিসেবে মাপা একটি বছরের জন্যে লার্বো একবার মাত্র সেখানে গিয়ে যা খোঁজ করবার করে আনতে পারবে। বছরের এক সেকেন্ড পার হয়ে গেলে সেখানকার কোনও কিছুতে, এমনকী একটা নুড়িতেও, আর তার অধিকার নেই।
তাহলে মাপা বছর বলতে কী বোঝাল? গৌর তার বিদ্যে একটু জাহির করবার সুযোগ ছাড়তে পারল না, তিনশো-পয়ষট্টি দিন পাঁচঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট ছেচল্লিশ সেকেন্ড!
ঘনাদা গৌরের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যে নিজের তথ্য নির্ভুল প্রমাণ করবার জন্য একটু ক্ষুণ্ণ হয়েই তাকে স্বীকার করতে হল, আজই সকালে এ বছরের বর্ষপঞ্জিতে পড়লাম যে!
ও, আজ পড়েছ! গৌরের এমন একটা পাণ্ডিত্যকে যেন তাচ্ছিল্য করেই ঘনাদা আবার শুরু করলেন, সব কথা শুনে একটু অসন্তুষ্টই হলাম। বললাম, তা এই চুক্তির সুযোগই আপনি নিচ্ছেন না কেন! যে কোনও সময় থেকে শুরু করে পুরো এক বছর তো! এক বছর নেহাত কম সময় নয়। আপনার বাবা যে ঐশ্বর্যের কথা বলেছেন সত্যি যদি তা থাকে তাহলে এক বছরে খুঁজে আনতে পারবেন না! আপনার বাবা গুপ্ত ঐশ্বর্যের কিছু হদিসও নিশ্চয় আপনাকে দিয়ে গেছেন!
তা দিয়ে গেছেন। ড. লার্বো হতাশ ভাবে বললেন, কিন্তু এই ভাঙা শরীর নিয়ে একলা সেই অজানা বিপদের দেশে গুপ্ত ঐশ্বর্য সন্ধান আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তা ছাড়া বলেছি তো আমি সর্বস্বান্ত। এই সুদানে এসেছি আমেরিকার এক মিউজিয়মের টাকায়। এখানে থেকে ক্যামেরুনসে যাবার আর এক বছর ধরে মান্দারা পার্বত্য অঞ্চলে খোঁজ করবার মতো সম্বলই আমার নেই।
যা বলতে যাচ্ছিলাম তা আর বলা হল না। আমার আগেই করুণ মুখে ক্যাপেলা বললে, যদি সহায় সম্বল দুই-ই আপনি পান ড. লার্বো?
সহায় সম্বল দুই-ই! ড. লার্বো একটু হতভম্ব হয়ে ক্যাপেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, তার মানে…
তার মানে, আমি আপনার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত, ড. লাবো। আপনার যা খরচ লাগে তা-ও জোগাতে!
আপনি সত্যি আমায় এই সাহায্য করবেন, সেনর ক্যাপেলা! ড. লার্বো উচ্ছ্বসিত হয়ে ক্যাপেলার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।
তাকে বাধা দিয়ে ক্যাপেলাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি ভাল করে বুঝেসুঝেই ড. লার্বোকে সাহায্য করতে যাচ্ছেন তো, সেনর ক্যাপেলা?
বোঝবার এমন কী আছে! ক্যাপেলা করুণ মুখে হেসে বললে, ড, লার্বোর বাবা আঁদ্রে লাববার আমি একজন ভক্ত ছিলাম। ছেলে বয়সে আফ্রিকা সফরে একবার তাঁর সঙ্গী হবার সৌভাগ্যও হয়েছিল। দেখতেই পাচ্ছেন আফ্রিকার পুরোনো জিনিস খুঁজে বার করা আমার ব্যবসা। বাতিকও বটে। আঁদ্রে লার্বোর সম্মানে সেই বাতিকেই না হয় কিছু সময় আর পয়সা খরচ করলাম!
খুশি মুখে বললাম, খুব ভালো কথা। আঁদ্রে লার্বোর গুপ্তধন কী তা জানি না, কিন্তু তা পাওয়া গেলে ভাগ চাইবেন না তো?
না, ভাগ আমি চাইব না, ষণ্ডামাকা ক্যাপেলা কাঁদোকাঁদো গলায় বললে, ভাগ আমি চাইব না, দিব্যি গেলে বলছি।
লার্বোর আর তর সইছিল না। ক্যাপেলাকে সঙ্গীসহায় পেয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই আফ্রিকার পুর থেকে একেবারে পশ্চিম প্রান্তে ক্যামেরুনসে রওয়া হয়ে গেল। যাবার আগে আমার দু-একটা পরামর্শ নিয়ে কথা দিয়ে গেল যে ফলাফল যা-ই হোক এক বছরের মধ্যে খবর একটা দেবেই।
কিন্তু খবর আর আসে না। তাদের সুদান থেকে ক্যামেরুনস যাবার সময়টা মোটামুটি বাদ দিয়ে এক বছর পূর্ণ হতে যখন হপ্তা দুয়েক মাত্র বাকি, তখন আর ধৈর্য ধরতে না পেরে নিজেই রওনা হয়ে পড়লাম। প্রথমে বাইট অফ বিয়াফ্রা, অর্থাৎ বিয়াফ্রা উপসাগরের ধারে দৌয়ালা শহরে নামলাম। সেখান থেকে নতুন রাজধানী ইয়াওন্দে-তে। সেখানে একটা ছোট প্লেনের ব্যবস্থা টেলিগ্রামেই করিয়ে রেখেছিলাম। প্লেনটা নিয়ে মান্দারা পাহাড় অঞ্চলেই সোজা যেতে পারতাম। কিন্তু তার বদলে প্রথমে মাঝামাঝি রেই-বৌবা শহরে নেমে হের ব্রান্টের আস্তানায় একবার গেলাম। ব্রান্ট আমার অনেক কালের চেনা বন্ধু। আফ্রিকায় তার সঙ্গে বিরল অজানা প্রাণীর খোঁজে কয়েকবার ঘুরেছি। আপাতত সে রেই-বৌবা শহরকে ঘাঁটি করে আশপাশে জীববিজ্ঞানের সন্ধান চালাচ্ছে জানতাম। ব্রান্টের সঙ্গে আলাপ সেরে ল্যামি দুর্গের কাছে একটি হাউসাদের গ্রামে নেমে আমার পুরোেনো বন্ধু মোড়লের সঙ্গে একবার দেখা করে এলাম। সেখান থেকে প্লেনে উঠে মান্দারা পাহাড়ের দিকে রওনা হবার আগে ফেন অর্থাৎ মোড়লকে শুধু বলে এলাম, ইদান মুগুন মুতুম ইয়া শিরকা জানবা, কাই কা স লাওজে কা ইয়াঙ্কে!
মোড়লকে ওই সব আপনি বললেন! আর শুনেও আপনাকে ছেড়ে দিলে!
বেটপকা শিবুর এই কথায় আমাদের কাশি যদি হঠাৎ সংক্রামক হয়ে ওঠে তাহলে বোধহয় খুব দোষ দেওয়া যায় না।
ঘনাদার মুখের চেহারা দেখে গৌরই প্রথম সামলে নিয়ে ভালমানুষ সাজলে, ওটা ওই হাউসা ভাষা? না ঘনাদা?
হ্যাঁ, হাউসাদের একটা প্রবাদ! ঘনাদা কিছুটা যেন তুষ্ট হয়ে প্রবাদটা ব্যাখ্যা না করেই বললেন, মান্দারা পাহাড়ের কোলে প্লেন নামাতে তারপর বেশ বেগ পেতে হল। পাহাড়ি জায়গা। সমতল কোথাও নেই বললেই হয়। তার মধ্যে ওপর থেকে একটা জিপ গোছের গাড়ি এক জায়গায় দেখে লার্বো আর ক্যাপেলার আস্তানা কাছাকাছি হতে পারে বলে অনুমান করেছিলাম। নামবার পর দেখলাম আমার অনুমানে ভুল হয়নি। প্লেন থেকে মাটিতে পা দিতেই প্রথম অভ্যর্থনা করলে স্বয়ং ক্যাপেলা। প্লেন দেখে জিপটা চালিয়েই সে ছুটে এসেছে। কাছে এসে তার মার্কামারা করুশ স্বরে বললে, আপনি সত্যিই অন্তর্যামী, দাস।
একেই লড়াইয়ে ষাঁড়ের মতো শরীর, তার ওপর এক মুখ দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে আর এই পাহাড়ি মরুর রোদে জলে পোড় খেয়ে ক্যাপেলার চেহারা একেবারে দুশমনের মতো হয়েছে। কিন্তু চোখ মুখ গলার স্বর সেই করুণ।
হেসে বললাম, কেন বলুন তো! আপনাদের ডেরা ঠিক চিনে নেমেছি বলে?
না, বুদ্ধি করে প্লেনটায় এসেছেন বলে। একটা প্লেনই চাইছিলাম।
হ্যাঁ, আপনার মেয়াদ তো ফুরিয়ে এল! হাতে আর কত সময় আছে?
বারো ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট আটাশ সেকেন্ড! কাঁদো কাঁদো সুরে বললে ক্যাপেলা।
একটু অবাক হয়ে বললাম, সময়টার ঠিক হিসাব রেখেছেন? ১৯০৩ সালের চুক্তি মনে আছে?
খুব মনে আছে। ক্যাপেলা করুণভাবে আশ্বাস দিলে, সময়ের হিসেব একেবারে কাঁটায় কাঁটায় রেখেছি।
একটা কথা বলতে গিয়েও থেমে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে এখনও আপনারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন কী বলে? সময় তো মাত্র এই!
সেইটে আপনার বন্ধু ড. লার্বোকে বোঝাতে পারেন? ক্যাপেলার গলায় যেন করুশ মিনতি।
সত্যি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে বললাম, তার মানে লার্বো সময়ের দাম বুঝতে চাইছেন না এখনও! কোথায় তিনি?
সামনের পাহাড়ে ওই মস্ত বড় গুহাটা দেখছেন। সোজা ওর ভেতর চলে যান। আমি একটু পরে আসছি!
সেই দিকেই যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে ফিরে তাকালাম।
তারপর ঠাণ্ডা গলাতেই বললাম, আপনি যেন প্লেনটায় উঠতে চান মনে হচ্ছে, সেনর ক্যাপেলা?
সেই রকমই তো বাসনা। করুশ স্বরে বললে ক্যাপেলা, জিপে করেই যাচ্ছিলাম, ভাঙাচোরা রাস্তা হলেও শ-আড়াই মাইল সময় মতো যাওয়া যেত। কিন্তু প্লেনটা যখন পাওয়া গেল তখন ছাড়া উচিত কি! উড়ে গেলে তো মাত্র শ-দুই মাইল।
হুঁ, গলাটা মধুর করেই বললাম, রেই-বৌবা পাহাড়েই যেতে চান নিশ্চয়। যেখানে এই অঞ্চলের মালিকের সেরেস্তা। লার্বোর নিজের লোক বলে তারা আপনাকে জানে। সুতরাং সময়ের মেয়াদ ফুরোবার আগেই গুপ্তধন দখলের কথা তাদের জানালে আপনার কাজ হাসিল হবে। তারা বিশ্বাসঘাতক বলে আপনাকে সন্দেহ করবে না। কিন্তু প্লেনে যে যাচ্ছেন গুপ্তধন তো দেখছি না। আসল মালই না থাকলে দাবি দিয়ে লাভ কী?
সে ভাবনা আপনাকে ভাবতে হবে না। ক্যাপেলা মিহি সুরে জানালে, আপনি বোধহয় খবর রাখেন না যে আগেকার মালিক মারা যাবার পর তার সম্পত্তি এখন এক ট্রাস্টের জিম্মায়। সেই ট্রাস্টের সঙ্গে এখানে আসবার আগে আমাদের কথা হয়ে গেছে যে শর্ত মতো নির্দিষ্ট সময়ের এক সেকেন্ড আগে দাবি জানাতে পারলেও তা গ্রাহ্য হবে তো বটেই, গুপ্তধন সরিয়ে আনবার জন্যেও একটা উপরি দিন পাওয়া যাবে। আর গুপ্তধন সঙ্গে না নিলেও এইটি আমি নিয়ে যাচ্ছি। আপনার বন্ধু অমন বেয়াড়া বলেই এটি হাত করতে এত দেরি হয়েছে।
ওটা তো দেখছি একটা চাবি! হেসে বললাম, গুপ্তধনের সিন্দুক আছে নাকি এখানে।
সিন্দুক নয়, ইস্পাতের তৈরি গুপ্ত এক ঘর। আঁদ্রে লার্বো প্রথম মহাযুদ্ধের কিছু আগে বিপদের দিন আসছে বুঝে গোপনে এক ইস্পাতের দুর্ভেদ্য দরজা দেওয়া লুকোনো ঘরটি এই পাহাড়ের এক গোপন গুহায় তৈরি করান। তার ভেতরই তাঁর সমস্ত ঐশ্বর্য লুকোনো। এ-ঘরের উড়ো খবর আমি জানতাম, কিন্তু আসল হদিস পাইনি বলে কিছু করতে পারিনি। তারপর ভাগ্য কী ভাবে ড. লার্বোর সঙ্গে আমার যোগাযোেগ করিয়ে দেয় তা তো আপনিও জানেন।
বাঃ, আপনার মতো সহজ সরল শয়তান আমি কখনও দেখিনি। কিন্তু শয়তানদেরও কখনও কখনও কথার ঠিক থাকে। আপনি যেন গুপ্তধনের ভাগ নেবেন না বলেছিলেন মনে পড়ছে। সেকথার খেলাপ তো করছি না।করুণ ভাবে হাসল ক্যাপেলা—ভাগ তো নয়, গুপ্তধনের সবটাই আমি নেব যে!
হ্যাঁ, তাহলে কথার খেলাপ হয় না বটে। চাবিটা খুশি হয়ে ড, লার্বো আপনাকে দিয়েছেন বলে কিন্তু মনে হচ্ছে না।
না, তা দেননি।কাঁদোকাঁদো ভাবেই জানালে ক্যাপেলা, একটু পেড়াপিড়ি করতে হয়েছে। দুর্বল মানুষ একটু জখম হয়েছেন তাইতে। ওই গুহার ভেতর তাড়াতাড়ি গেলে হয়তো শুশ্রুষা করতে পারবেন।
কিন্তু চাবিটা তাঁকে ফেরত দিতে চাই যে!কাঁধের হ্যাভারস্যাকটা মাটিতে রেখেই বললাম, ওটা নিজে থেকে দিলেই বাধিত হব। আমার আবার তাড়াতাড়ি করতে গেলে হাতপাগুলো বশে থাকে না। তখন আপনারই শুশ্রুষা দরকার হবে।
না, তা বোধহয় হবে না। মুখখানা যেন কাঁচুমাচু করে জানালে ক্যাপেলা, আরশোলা টিকটিকি আমি পারতপক্ষে ছুঁই না, কিন্তু ছুঁলে আঙুলের টিপুনিতেই মারা যায়। আমার দুঃখের ইতিহাস আপনি বোধহয় জানেন না। দুনিয়ার সেরা মুষ্টিযোদ্ধা হয়তো হতে পারতাম, কিন্তু রাস্তার ঝগড়াঝাঁটিতে দুটো মানুষকে সাবাড় করার দরুন হুলিয়ার ভয়ে নাম ভাঁড়িয়ে এই আফ্রিকায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। এখানে একটা ছুঁচো মারলে অবশ্য হুলিয়ার ভয় নেই।
না, ভয় যা-কিছু থোঁতা মুখ ভোঁতা হবার। সবিনয়ে যেন গলবস্ত্র হয়ে বললাম, আপনার মতো খাঁটি নির্ভেজাল শয়তানের সে দুর্দশা আমায় দিয়ে করাবেন না।
চমৎকার! আপনার গলায় যেন মধু ধরে পড়ছে। ক্যাপেলা করুণ স্বরে বললে, আসুন, আপনার গলাটা একটু টিপে দিয়ে দেখি অত মধু কোথায় আছে।
ক্যাপেলা যেন আলিঙ্গন করতে এগিয়ে এল।
বার তিনেক একটু কষ্ট করতে হল। শেষবার ঘাড়মুড় গুঁজড়ে পড়ল প্রায় প্লেনটার চাকার তলায়।
হ্যাভারস্যাকটা আবার কুড়িয়ে নিয়ে চাবিটা তার পকেট থেকে তুলে বললাম, ঘণ্টা কয়েক এখন খোলা হাওয়ায় বিশ্রাম করতে পারবেন মনে হচ্ছে। ভাববেন না, হাত-পা খুঁজে নিয়ে আপনি ওঠবার আগেই ফিরে আসছি। দড়ি দড়ায় বেঁধে আপনার সম্মানটা তাই আর বাড়ালাম না।
সেই একটিমাত্র ভুলেই সর্বনাশটা হল।
গুহার ভেতর গিয়ে লার্বোকে পেলাম প্রায় সসেমিরে অবস্থায়। অনেক চেষ্টায় সুস্থ করে তোলবার পর তার মুখে যা শুনলাম তা ইতিমধ্যেই কল্পনা করে নিয়েছিলাম। মান্দারা পাহাড়ের এই অঞ্চলে আসবার কিছুদিন বাদেই ক্যাপেলার ভাবগতিক দেখে লার্বোর সন্দেহ হয়। গুপ্তধনের খোঁজ করবার হদিস লার্বো তাই কিছুতেই জানায়নি। এমনকী সে-গুপ্তধনভাণ্ডার একা একা নানা সুযোগে খুঁজে বার করবার পরও ক্যাপেলার কাছে তা লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু যত দিন গেছে ক্যাপেলা তত অস্থির হয়ে উঠেছে। লার্বোকে চোখে চোখে রেখেছে সারাক্ষণ। লার্বো ঠিক করেছিল কোনওমতে লুকিয়ে পালিয়ে গিয়ে তার দাবি পাকা করবে। কিন্তু ক্যাপেলা সে সুযোগ দেয়নি। ওই দিনটিতে সে কিন্তু আরও গভীর শয়তানি বুদ্ধি খাটিয়েছিল। ক্যাপেলার পাহারা সেদিন যেন আলগা মনে হয়েছিল লার্বোর। সেই সুযোগে পালাবার চেষ্টা কয়বার সময়েই লার্বোকে চাবি সমেত সে ধরে ফেলেছিল এই তক্কেই ছিল বলে। তারপর লার্বোর মতো একটা ক্ষীণজীবী মানুষের কাছে চাবি কেড়ে নিতে কতক্ষণ। চাবি নিয়ে জিপে করে ক্যাপেলা যখন রওনা হচ্ছে ঠিক সেই সময়েই এসে পড়েছি আমি।
লার্বোকে সুস্থ করে তার সমস্ত কাহিনী শুনতে প্রায় ঘণ্টা চারেক তখন কেটে গেছে। ক্যাপেলার অবস্থা দেখবার জন্যে একবার যাওয়া দরকার মনে করে উঠতে যাচ্ছি—এমন সময়ে গুহামুখে একটা ছায়া পড়ল।
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, ক্যাপেলাই টলতে টলতে গুহার বাঁকটার মুখে ঢুকে দাঁড়াল।
আরে, আসুন, আসুন, সেনর ক্যাপেলা! আপনি এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন ভাবতে পারিনি। ভেতরের দুর্ভাবনা যথাসাধ্য চেপে হাসিমুখে বললাম, কিন্তু সুস্থ হয়েই আবার কষ্ট করে এখানে এলেন কেন?
একটা দরকারি কাজ বাকি ছিল বলে আসতে হল।ক্যাপেলার করুণ সুরটা একটু বেশি চড়া মনে হল।
কী কাজ? আমাদের কাছে মাপ চাওয়া?
না। একটা ছুঁচো আর একটা ইঁদুরকে জ্যান্ত কবর দেওয়া। এগোবার চেষ্টা করিস। , আমার হাতে এই হ্যান্ড গ্রেনেড দেখছিস। এটা ছুঁড়ে তোদের এখুনি শেষ করে দিয়ে যেতে পারি। কিন্তু অত সহজে মেরে আমার আশ মিটবে না। যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেখানকার ওপরের পাথর আলগা। এই গ্রেনেড ফাটলেই সে সব পাথর পড়ে এ গুহার মুখ এমন বন্ধ হয়ে যাবে, অন্তত একশো জোয়ান না হলে সে পাথর সরানো অসম্ভব। একশো জোয়ান দূরে থাক, একটা মাছিও এখানে আসবে না খোঁজ করতে।
না-ই আসুক, মাছি এখান থেকে উড়ে যেতে তো পারবে!
এই জ্যান্ত কবরে পচে মরতে মরতে ও-রকম রসিকতা ভাববার অনেক সময় পাবি। এখনও শুধু শেষ একটা সুযোগ দিচ্ছি প্রাণে বাঁচবার। চাবিটা আর গুপ্তগুহার হদিস যদি এখনই পাই তো ছেড়ে দিতে পারি তোদের।
কিন্তু চাবি আর গুপ্তগুহার হদিস পেলেই কিছু লাভ হবে কি আর? হেসে বললাম, সময় তো ক্রমশই ফুরিয়ে আসছে।
সময় যথেষ্ট আছে এখনও। সে ভাবনা তোদের নেই। এখনও আট ঘণ্টা তেইশ মিনিট আটাশ সেকেন্ড। তোর প্লেনে চড়ে বড় জোর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই রেই-বৌবায় পৌঁছে যাব। তারপর ট্রাস্টিদের অপিসে পৌছোতে বড় জোর আধ ঘন্টা।ক্যাপেলা আমাদের যন্ত্রণা দিতেই যেন করুণ স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে শোনালে।
এবার হেসে উঠলাম, বললাম, হিসেবে আপনার যে একটু ভুল হচ্ছে, সেনর ক্যাপেলা। ও-প্লেনে একটু কারসাজি না করে কি আর আমি নেমেছি! এরোপ্লেনের কলকবজার ব্যাপারে ওস্তাদ না হলে সে কারসাজি ধরে প্লেন চালাতে কেউ পারবে না।
এবার ক্যাপেলাই হেসে উঠে বললে, সেই ওস্তাদই আমি। প্লেনের মিস্ত্রি হয়ে দুবছর তোর ওই ফক্কার প্লেনের কারখানাতেই কাজ করেছি। ও-প্লেন খুলে ফেলে আবার জুড়তে পারি।
শুনে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলেও বাইরে হাসিমুখে বললাম, কিন্তু যত বড় মিস্ত্রিই আপনি হন, আপনার এই শরীরে একা একা ও-প্লেন পাঁচ ঘণ্টার আগে চালু করতে পারবেন না যে!
তাতেও যা সময় থাকবে তা যথেষ্ট। কিন্তু সে ভাবনা তোদের নয়। এখন যা চাইছি তা দিবি কি না।
এত করে চাইছেন, আর না দিয়ে পারি! তবে আপনাকে একটু কষ্ট করে কাছে এসে হাতে হাতে নিতে হবে!
হুঁ, ক্যাপেলার মিহি গলা যেন ছুরির ডগা হয়ে উঠল, জ্যান্ত কবরই তোরা চাস বুঝলাম।
ক্যাপেলা টলতে টলতে চলে গেল। তারপর তার ছুঁড়ে-ফেলা গ্রেনেড ফাটার সঙ্গে গুহার ছাদের বিরাট সব পাথরের চাঁই ধসে পড়ে সত্যিই আমাদের জীবন্ত কবর।
আমরা অবশ্য তখন গুহার পেছন দিকে যতদূর সম্ভব সরে গেছি।
পাথর পড়া বন্ধ হবার পর এগিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখে বুঝলাম বড় বড় পাথরের চাঁইয়ের মধ্যে সামান্য যা ফাক কোথাও কোথাও আছে তা মাছি গলবার বেশি সত্যিই নয়। সে সব পাথর আমাদের দুজনের পক্ষে সরানোও অসম্ভব।
হ্যাভারস্যাক থেকে মিহি জালের ঢাকনি দেওয়া কৌটোটা এবার বার করলাম।
তারপর পাথরের একটা ফাঁকে কৌটোর মুখটা ধরে জালের ঢাকনিটা নিলাম সরিয়ে।
লার্বো আমার কাণ্ড দেখে হতাশ স্বরে বললে, তোমার মাথা কি এর মধ্যেই খারাপ হয়ে গেল, দাস। তিলে তিলে এই কবরে মরতে হবে জেনেও তুমি খেলা করছ। এসময়ে!
হেসে বললাম, আর কিছু যখন করবার নেই তখন খেলাই তো ভাল। এই খেলাই ভানুমতীর খেল হয়ে উঠতে পারে তো।
কিন্তু ভানুমতীর খেলের কোনও লক্ষণই আর দেখা যায় না। এক ঘণ্টা দু ঘণ্টা করে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা কেটে যাবার পর পাথরের ফাঁকে কান লাগিয়ে যে ক্ষীণ আওয়াজ পেলাম তাতে বুকটা আরও দমে গেল।
ক্যাপেলা সত্যিই আমার প্লেনের কারসাজি ধরে সারিয়ে সেটা চালিয়ে চলে যাচ্ছে।
আরও আধ ঘণ্টাটাক যাবার পর যখন সব আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি তখন হঠাৎ পাথরের দেয়াল ভেদ করেও বাইরে বন্যার গর্জনের মতো একটা প্রচণ্ড আওয়াজ কানে এল। সমুদ্রের বন্যা নয়, মানুষের।
হুইসিলটা হ্যাভারস্যাকেই ছিল। সেটা বার করে পাথরের ফুটোয় ঢুকিয়ে সজোরে বাজালাম।
তারপর দুশো জোয়ানের শাবলে আর গাঁইতিতে পাথরের চাঁই সরিয়ে ফেলতে ঘন্টা দুয়েক লাগল মাত্র।
আমার হাউসা মোড়ল তাদের প্রবাদের মান রেখেছে। আফ্রিকার আশ্চর্য আদ্যিকালের বেতার-ডাক তাদের টমটম ঢাক বাজিয়ে খবর দিয়ে মান্দার পাহাড়ের কাছের এক গাঁ থেকে দুশো জোয়ান পাঠিয়েছে আমার সাহায্যে।
ওই হিজিবিজি প্রবাদের এত দাম! শিবু হঠাৎ বেয়াদবি করে বসল।
ঘনাদার ভুরু কুঁচকোতে গিয়ে করুণাতেই যেন ক্ষান্ত হল। না, হিজিবিজি নয়, ও প্রবাদের মানে হল দুশমন যদি শয়তানির বীজ বোনে তাহলে কাস্তে লাগাও তার বিষ ঝাড় কাটতে। বলে বুঝিয়ে ঘনাদা আবার শুরু করলেন, জ্যান্ত কবর থেকে বেরিয়ে এসে ড লার্বো কিন্তু খুশি হওয়ার বদলে একেবারে ভেঙে পড়ল। হতাশ ভাবে বললে, প্রাণে বাঁচলাম বটে, দাস, কিন্তু মনে হচ্ছে ওই গুহার মধ্যে মরাই উচিত ছিল। বাবার গুপ্তধন আর উদ্ধার হল না। উড়ে গেলেও আর রেই-বৌবায় পৌঁছে চুক্তির শর্ত রাখতে পারব না।
এর মধ্যেই অত হতাশ হচ্ছেন কেন? যে উড়ে গেছে সেই পৌছোতে পারে কিনা, দেখুন। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই তো জানতে পারবেন।
কী করে? হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলে লার্বো।
এই আফ্রিকারই বেতার টেলিগ্রামে। সে-ই ব্যবস্থাই করে এসেছি। আর তো কয়েক মিনিট মাত্র। কানটা শুধু খাড়া করে রাখুন।
ড. লার্বো নিজের হাতের ঘড়িটা দেখে বললেন, একটা বছর পূর্ণ হতে আর তো মাত্র উনিশ মিনিট আটাশ সেকেন্ড বাকি।
হেসে বললাম, সেই হিসেব ধরেই ওইটুকু সময় ধৈর্য ধরে থাকুন না। টমটমের খবর আসতে অবশ্য মিনিট কয়েক দেরি হতে পারে।
দেরি বিশেষ হল না। মিনিট পঁচিশ বাদেই এক টমটম থেকে আর এক টমটমে হাত ফেরতা হয়ে সংকেত ধ্বনি আমাদের কাছে পৌছে গেল।
ভাল করে কান পেতে শুনে বললাম, ক্যাপেল ট্রাস্ট সেরেস্তায় পৌঁছেছে ঠিক তিনশো পঁয়ষট্টি দিন পাঁচ ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট একুশ সেকেন্ডের মাথায়।
তাহলে তো সব আশা-ভরসা শেষ। ডা. লার্বোর গলা যেন কান্নায় ধরে গেল।
না, ড. লর্বো। চুক্তির শর্ত রাখতে পারেনি বলে ক্যাপেলার দাবি গ্রাহ্য হয়নি।
তার মানে? আমরাই এবার উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। বছর পূর্ণ হবার বেশ কয়েক সেকেন্ড আগেই তো ক্যাপেলা পৌঁছেছে।
আমাদের দিকে চেয়ে ঘনাদা অনুকম্পার হাসি হেসে বললেন, ড, লার্বোও ওই প্রশ্নই করেছিল অবাক হয়ে। তাকে তখন বলেছিলাম, চুক্তির আসল শর্তটা ভুলে যাচ্ছেন কেন ড. লার্বো। ১৯০৩ সালের ইজারা। পুরো বছরের হিসাবটা ১৯০৩ সালের মাপ ধরেই হবে।
তাতে হয়েছে কী! লার্বো তোমাদের মতোই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিল।
১৯০৩ আর ১৯৪৫-এর হিসাব এক নয়, হয়েছে শুধু এই বলে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম ব্যাপারটা, ১৯০৩ সালে পুরো বছরের মাপ তিনশো পঁয়ষট্টি দিন পাঁচ ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট আটাশ সেকেন্ড ছিল না।
আটাশ সেকেন্ড কী বলছেন! গৌর প্রতিবাদ জানালে, দিন ঘণ্টা মিনিট সব ঠিক আছে, কিন্তু আটাশ নয়, ওটা ছেচল্লিশ সেকেন্ড।
ঘনাদার চোখে সেই অনুকম্পার দৃষ্টি। হেসে বললেন, ছেচল্লিশ সেকেন্ড এই আজ ১৯৬৩ সালে। ১৯৪৫-এ ছিল আটাশ সেকেন্ডের কিছু কম বেশি, আর ১৯০৩ সালে ছিল তিনশো পঁয়ষট্টি দিন পাঁচ ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট এগারো সেকেন্ড মাত্র। পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণের সময় প্রতি বছরই প্রায় এক সেকেন্ড করে বাড়ছে, কখনও একটু-আধটু আবার কমেও যায় কোনও অজানা কারণে। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯৬৩-এর মধ্যে সময়টা ৩৫ সেকেন্ড বেড়ে গেছে।
একটু থেমে আমাদের হাঁ করা মুখগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ঘনাদা আবার বললেন, সব শুনেও লার্বো তেমনই হতাশ ভাবে বললেন, ক্যাপেলার দাবি গ্রাহ্য হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাতে আমাদের কী লাভ! আমাদের দাবি তো তাতে সাব্যস্ত হয়নি!
তা-ও হয়েছে!আশ্বাস দিয়ে বললাম, আমার বন্ধু ড. ব্রান্ট সে ব্যবস্থাও করেছেন
বলে জানাচ্ছেন।
ড. ব্রান্ট! জীববিজ্ঞানের সেই পণ্ডিত! কিন্তু তিনি কী করে ব্যবস্থা করবেন। এ খবর তাঁর কাছে ক্যাপেলার প্লেনেরও আগে পৌঁছোবে কী করে।
পৌঁছেছে মাছির পাখায়!
মাছির পাখায়! লার্বো অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, এটা কি ঠাট্টার বিষয়, দাস।
ঠাট্টা নয়, ড. লার্বো! সত্যি কথাই বলছি। আমার ওই জাল ঢাকা কৌটোয় এক জাতের মাছিই ছিল। তার নাম Cephenomya। শব্দের চেয়ে দ্রুত তাদের গতি। ঘণ্টায় ৮১৭ মাইল। সেই মাছি ছাড়া মাত্র দিগ্বিদিকে বিদ্যুৎ বেগে উড়ে গেছে। ড. ব্রান্টকে আমি সব বুঝিয়ে সজাগ থাকতে বলে এসেছিলাম। এ জাতের কোনও মাছি তাঁর এলাকায় নেই। সুতরাং একটা চোখে পড়লেই যেন তিনি আপনার নামে ট্রাস্টের সেরেস্তায় দাবি পেশ করেন। তিনি তা-ই করেছেন যথাসময়ে।
ঘনাদা তাঁর কথার ওজন বাড়াবার জন্য একটু চুপ করে থেকে গম্ভীর স্বরে বললেন, মাছির ঋণ আমি ভুলতে পারি না বলেই ওসব ফ্লিটটিট আমার দুচক্ষের বিষ।
আচ্ছা, যার জন্য এত কুরুক্ষেত্র, শিবু জিজ্ঞাসা করলে, সেই ইস্পাতের দরজার আড়ালে লুকোনো গুপ্তধনটা কী!
আফ্রিকার সব চেয়ে বড় সম্পদ। না, হিরে-মানিক সোনা-দানা নয়, আফ্রিকার সবচেয়ে বড় শিল্পী বেনিনদের বহু আগেকার লুপ্ত এক শাখা-জাতির আশ্চর্য শিল্পীদের তুলনাহীন ব্রাঞ্জের, হাতির দাঁতের আর খোদাই করা কাঠের সব মূর্তি আর আসবাব। ড, লার্বোর বাবা আঁদ্রে জীবন পাত করে সেসব সংগ্রহ করেছিলেন। ড. লার্বো এখনও সেগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন বলে এখনও বাইরের কেউ সেসব দেখতে পায়নি।
সবই বুঝলাম, শিশির হঠাৎ বেতালা প্রশ্ন করলে, কিন্তু আপনার ওই সেফেনোমিয়া না কি জেট প্লেনের যমজ মাছি গোটা আফ্রিকা থাকতে ঠিক রেই-বৌবায় আপনার বন্ধু ড. ব্রাস্টের কাছেই উড়ে গেল! শেখানো মাছি বুঝি?
ঘনাদা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, ওহে তোমাদের দেবু, থুড়ি মৌলবি সাহেব যে নীচে একা একা বসে থেকে শেকড় গজিয়ে ফেললেন! এতক্ষণে গোঁফদাড়ি খুলে গেল কি না, দেখো গে যাও।
চমকে উঠে একবার ঘনাদার দিকে চেয়েই মাথা আমাদের সব হেঁট।
আর টু শব্দটি না করে সুড়সুড় করে সবাই নীচে নেমে গেলাম।
চালাকিটা যে ঘনাদা আগেই ধরে ফেলেছেন, তা কি জানি!
সত্যিই একটা হাতের লেখা পুরোনো উর্দু পুথি যোগাড় করে পাড়ার শৌখিন থিয়েটারের দল থেকে দেবুকে দাড়ি গোঁফ আর আচকান পরিয়ে মিশরী মৌলবি সাজিয়ে এনেছিলাম।