বার
দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়িতে পৌঁছিয়া পাণ্ডেজি তিওয়ারীকে বলিলেন, ‘তুমি এবার থানায় ফিরে যাও, তোমাকে এখানে আর দরকার নেই।’ তিওয়ারী প্রস্থান করিলে তিনি ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন, ‘অতঃ কিম্?’
ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া বলিল, ‘আসুন, সেরেস্তার দিকে যাওয়া যাক। মনে হল যেন ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়ে সুট করে দপ্তরখানায় ঢুকে পড়লেন।’
ফটক অতিক্রম করিয়া আমরা সেরেস্তার দিকে চলিলাম। পথে জমাদারের সঙ্গে দেখা হইল; সে পাণ্ডেজিকে স্যালুট করিয়া জানাইল, সব ঠিক আছে।
সেরেস্তার ঘরগুলি কাল আমরা বাহির হইতে দেখিয়াছিলাম। এক সারিতে গুটি তিনেক ঘর; প্রত্যেক ঘরে তক্তপোশের উপর জাজিম পাতা। কয়েকজন কেরানি বসিয়া কাজ করিতেছে। ম্যানেজার গঙ্গাধর যখন দেখিলেন আমাদের এড়াইতে পারিবেন না, তখন তিনি সেরেস্তা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। তাঁহার হাতে এক তাড়া বহির্গামী চিঠি। আমাদের যেন এই মাত্র দেখিতে পাইয়াছেন এমনিভাবে মুখে একটি সচেষ্ট হাসি আনিয়া বলিলেন, ‘এই যে!’
ব্যোমকেশ চিঠিগুলি লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘দেওয়ানজি, আপনার সেরেস্তা থেকে রোজ কত চিঠি ডাকে যায়?’
দেওয়ানজি চিঠিগুলি একজন পিওনের হাতে দিলেন, পিওন সেগুলি লইয়া খিড়কির দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল; বাড়ির কোণে যে ডাক-বাক্স আছে তাহাতেই ফেলিতে গেল সন্দেহ নাই। দেওয়ানজি বলিলেন, ‘তা কুড়ি-পঁচিশখানা যায়। অনেক লোককে চিঠি দিতে হয়—উকিল মোক্তার খাতক প্রজা—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বাড়ির কোণে যে ডাক-বাক্সটা আছে তাতেই সব চিঠিপত্র ফেলা হয়?’
গঙ্গাধর বলিলেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। ও ডাক-বাক্সটা আমরা ডাক বিভাগের সঙ্গে লেখালেখি করে ওখানে বসিয়েছি। হাতের কাছে একটা ডাক-বাক্স থাকলে সুবিধা হয়।’
‘তা তো বটেই। ক’বার ক্লিয়ারেন্স হয়?’
‘একবার ভোর সাতটায়, একবার বিকেল চারটেয়। কিন্তু কেন বলুন দেখি? ডাক-বাক্সের সঙ্গে আপনাদের তদন্তের কোনও সম্পর্ক আছে নাকি?’
‘থাকতেও পারে। দেওয়ানজি, আমাদের ভাষায় এক বয়েৎ আছে—যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পার লুকানো রতন। কিন্তু যাক ওকথা। এদিকের খবর কি?’
গঙ্গাধর হাত উল্টাইয়া বলিলেন, ‘খবর আমি তো কিছুই জানি না। এমন কি মালিকের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পর্যন্ত এখনও জানতে পারিনি। সত্যিই কি ইন্জেকশনে বিষ ছিল?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ডাক্তারেরা তো তাই বলেছেন। ভাল কথা, ডাক্তার পালিতের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?’
গঙ্গাধর বংশীর মুখখানি হঠাৎ যেন চুপসিয়া গেল, চক্ষু দুটি কোটরের মধ্যে অন্তর্হিত হইল। তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া ঈষৎ স্খলিত স্বরে বলিলেন, ‘দেখা হয়েছিল। তিনি টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করছেন।’
‘আপনি কি নিজের হাতে টাকা দিয়েছিলেন?’
গঙ্গাধর আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, শেষে বলিলেন, ‘না, অ্যাসি্ট্যান্ট ম্যানেজার টাকা দিয়েছিল।’
‘অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মানে—আপনার ছেলে লীলাধর বংশী?’
গঙ্গাধর বুজিয়া যাওয়া কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ। মুশকিল হয়েছে, রসিদ নেওয়া হয়নি। ডাক্তার পালিত যে এ রকম করবেন—‘
‘সত্যিই তো—ভাবাও যায় না।—তা লীলাধরবাবু এখন কোথায়?’
‘সে—সে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে।’
‘তাই নাকি! কাল সন্ধ্যে পর্যন্ত এখানে ছিলেন, দেবনারায়ণের ঘরে বসে তাড়ি খাচ্ছিলেন, আজ একেবারে শ্বশুরবাড়ি।’
গঙ্গাধর অস্পষ্ট জড়িতস্বরে বলিলেন, ‘তার স্ত্রীর অসুখ…হঠাৎ খবর পেয়ে চলে গেছে।’
‘হুঁ’—ব্যোমকেশের চোখে দুষ্ট-বুদ্ধি নাচিয়া উঠিল, সে তখন চিন্তা-মন্থর ভঙ্গীতে বলিল, ‘টাকা তো কম নয়—বারো হাজার। স্টেটের এতগুলো টাকা মারা যাবে, দেওয়ানজি, আপনার উচিত পুলিসে এত্তেলা দেওয়া। রসিদ না দিলেও টাকা যে ডাক্তার পালিত নিয়েছেন তা পুলিস অনুসন্ধান করে বার করতে পারবে।—কি বলেন পাণ্ডেজি?’
পাণ্ডেজি দৃঢ়স্বরে বলিলেন, ‘নিশ্চয়। ম্যানেজার সাহেব বলুন, আমরা এখনি তদন্ত আরম্ভ করছি। দপ্তরের সমস্ত কাগজপত্র আমরা পরীক্ষা করে দেখব; যদি কোথাও গরমিল থাকে ধরা পড়বেই। ডাক্তার পালিত এবং লীলাধরকেও জেরা করব, তাঁদের তল্লাসী নেব—’
ব্যোমকেশ ও পাণ্ডেজি মিলিয়া ম্যানেজার সাহেবকে কোন অতট প্রপাতের কিনারায় ঠেলিয়া লইয়া যাইতেছেন তাহা অনুমান করা তাঁহার মত গভীর জলের মাছের পক্ষে কঠিন নয়। তিনি উদাসভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘না, ডাক্তার পালিত যখন অস্বীকার করছেন তখন আমিই ও-টাকা পুরিয়ে দেব। আমার লোকসানের বরাত, গচ্ছা দিতে দিতেই জন্ম কেটে গেল।’ বলিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিলেন।
ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিল। পাণ্ডেজি গলার মধ্যে একটা আওয়াজ করিলেন, কিন্তু আওয়াজটা সহানুভূতিসূচক নয়।
দেওয়ানজিকে সেরেস্তায় রাখিয়া আমরা বাড়ির সদরে উপস্থিত হইলাম। বাহিরের হল-ঘরে একজন সিপাহী পাহারায় ছিল; তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল, বাড়ির সবাই উপরতলায় আছে। আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিলাম।
সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াইয়া আছে চাঁদনী; চক্ষু দুটি রক্তবর্ণ, মাথার চুল এলোমেলো। তাহার চেহারা যদি স্বভাবতই মিষ্ট এবং নরম না হইত তাহা হইলে বলিতাম, রণরঙ্গিনী মূর্তি। সে আমাদের দেখিবামাত্র কোনও প্রকার ভূমিকা না করিয়া আরম্ভ করিল, ‘আপনারা নাকি চাচিজির কাছে আমার যাওয়া বারণ করে দিয়েছেন! কী ভেবেছেন আপনারা? আমি চাচিজিকে বিষ খাওয়াব?’
অতর্কিত আক্রমণে আমরা বিমূঢ় হইয়া পড়িলাম। ব্যোমকেশ অসহায়ভাবে পাণ্ডেজির পানে চাহিল, পাণ্ডেজি মাথা চুলকাইয়া অপ্রস্তুতভাবে বলিলেন, ‘দেখুন, শুধু আপনাকেই বারণ করা হয়নি, ওঁর কাছে এখন কারুরই যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আর দু’চার দিনের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখন আবার আপনারা ওঁর কাছে যেতে পারবেন।’
চাঁদনী আবেগভরে বলিল, ‘কিন্তু কেন? আমি ওঁর যেমন সেবা করতে পারব আর কেউ কি তেমন পারবে? তবে কেন আমাকে ওঁর কাছে যেতে দেওয়া হবে না? উনি অসুস্থ, এতবড় শোক পেয়েছেন—’
চাঁদনীর চোখ দিয়া দরদর ধারায় জল পড়িতে লাগিল। এবার পাণ্ডেজি অসহায়ভাবে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন।
ব্যোমকেশ এতক্ষণে সামলাইয়া লইয়াছে, সে শান্তকণ্ঠে বলিল, ‘আপনি বোধহয় জানেন না, শকুন্তলা দেবী অন্তঃসত্ত্বা। তার ওপর এতবড় আঘাত পেয়েছেন। ওঁর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ, তাই মিস্ মান্নাকে ওঁর কাছে রাখা হয়েছে। আপনারা ওঁর নিজের লোক, আপনারা ওঁর কাছে বেশি যাওয়া-আসা করলে ওঁর মন আরও বিক্ষিপ্ত হবে, তাতে ওঁর শরীরের অনিষ্ট হতে পারে। তাই ওঁর কাছ থেকে কিছুদিন আপনাদের দুরে থাকাই ভাল।’
ব্যোমকেশ কথা বলিতে আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদনী সম্মোহিতের ন্যায় স্থির চক্ষু হইয়া গিয়াছিল। ব্যোমকেশ থামিলে সে তন্দ্রাহতের মত অস্ফুট স্বরে বলিল, ‘অন্তঃসত্ত্বা—’ তারপর তেমনই মোহাচ্ছন্নভাবে নিজের মহলের দিকে ফিরিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শুনুন। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে—‘ চাঁদনী ফিরিয়া দাঁড়াইল—‘দীপনারায়ণবাবুকে যখন ইন্জেকশন দেওয়া হয় তখন আপনি উপস্থিত ছিলেন?’
প্রশ্নটা চাঁদনী পুরা শুনিতে পাইল কিনা বলা যায় না, অস্পষ্টভাবে বলিল, ‘ছিলাম।’
‘সেখানে আর কেউ ছিল?’
‘জানি না। লক্ষ্য করিনি।’
‘মন দিয়ে আমার প্রশ্ন শুনুন। ডাক্তারবাবু কি কি করলেন মনে করবার চেষ্টা করুন।’
‘ডাক্তারবাবু ইন্জেকশন দিতেই চাচাজি এলিয়ে পড়লেন। তখন ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি আর একটা ইন্জেকশন দিলেন। আমি ছুটে গেলাম চাচিজিকে খবর দিতে। ফিরে এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে।’
‘ফিরে এসে সেখানে আর কাউকে দেখেছিলেন?’
‘মনে নেই। বোধহয় দেওয়ানজি ছিলেন, আর কাউকে লক্ষ্য করিনি।’—চাঁদনী আর প্রশ্নের অপেক্ষা না করিয়া নিজের মহলে চলিয়া গেল।
ব্যোমকেশ মাটির দিকে তাকাইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, শেষে মুখ তুলিয়া বলিল, ‘চলুন, এবার শকুন্তলা দেবীর ঘরে যাওয়া যাক।’
আগে আগে ব্যোমকেশ, পিছনে আমরা চলিলাম। বসিবার ঘর শূন্য, আসবাবগুলির উপর সূক্ষ্ম ধূলার আস্তরণ পড়িয়াছে। পরের ঘরটিও তাই। তৃতীয় কক্ষে, অর্থাৎ শকুন্তলার গানবাজনার ঘরের সম্মুখে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘দাঁড়ান, ছবিটা আর একবার দেখে নিই।’
ব্যোমকেশ ঘরে প্রবেশ করিল। আমরা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিলাম, ছবি দেখিবার বিশেষ আগ্রহ আমাদের ছিল না।
যে দেয়ালে দুষ্মন্ত শকুন্তলার পূর্বরাগ চিত্রটি আঁকা ছিল ব্যোমকেশ সেইদিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। পাঁচ মিনিট আর তাহার দেখা নাই। আমি দরজা দিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিলাম সে মগ্ন-সমাহিত হইয়া ছবি দেখিতেছে। আমি একটু শ্লেষ করিয়া বলিলাম, ‘কি হে, একেবারে তন্ময় হয়ে গেলে যে! কী দেখছ এত?’
ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে ফিরিল। দেখিলাম তাহার চোখের দৃষ্টি কেমন একরকম হইয়া গিয়াছে, যেন একটা অভিভূত বিস্ময়াহত ভাব। সে আমার কথার উত্তর দিল না, মখমলের বিছানায় আসিয়া বসিল, উত্থিত হাঁটু দুটাকে বাহু দিয়া জড়াইয়া শূন্য পানে চাহিয়া রহিল।
তাহার ভাবভঙ্গী দেখিয়া পাণ্ডেজি ও আমি ঘরে প্রবেশ করিলাম। পাণ্ডেজি ঈষৎ উদ্বিগ্নভাবে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, কি হয়েছে? ছবিতে কি দেখলেন?’ ব্যোমকেশ এবারও উত্তর দিল না; পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিয়া অতি যত্নে ধরাইল, তারপর সুদীর্ঘ টান দিয়া আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়িতে লাগিল।
আমি পাণ্ডেজির সহিত দৃষ্টি বিনিময় করিলাম, তারপর দু’জনে একসঙ্গে গিয়া ছবির সম্মুখে দাঁড়াইলাম। ছবি কাল যেমন দেখিয়াছিলাম, আজ দিনের আলোয় তাহার কোনও তফাৎ দেখিলাম না। শকুন্তলা তেমনি তরু-আলবালে জল সেচন করিতেছেন, দুষ্মন্ত তেমনি গাছের আড়াল হইতে উঁকি মারিতেছেন। তবে ব্যোমকেশ হঠাৎ এমন বোবা হইয়া গেল কেন?
আমরা ফিরিয়া গিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে বসিলাম এবং একদৃষ্টে তাহার পানে চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিলাম। সে সিগারেট সম্পূর্ণ শেষ করিয়া জানালা গলাইয়া ফেলিয়া দিল, তারপর পাণ্ডেজির হাত ধরিয়া গাঢ় স্বরে বলিল, ‘একটি অনুরোধ রাখতে হবে।’
‘কি অনুরোধ?’
‘আমি একা শকুন্তলার ঘরে গিয়ে তাঁকে জেরা করব, সেখানে আর কেউ থাকবে না।’
‘বেশ তো। কিন্তু কী পেলেন?’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, ‘সব পেয়েছি। আপনারাও তো ছবি দেখলেন, কিছু পেলেন?’
পাণ্ডেজি ক্ষুব্ধভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘কৈ আর পেলাম। কাল রাত্রেও ছবি দেখেছি, আজও দেখলাম, কিন্তু রহস্যের চাবি তো পেলাম না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কাল রাত্রে নিওন-লাইটের নীল আলোতে দেখেছিলেন, কিন্তু আজ দিনের আলোয় দেখেছেন। আজ দেখতে না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। যাহোক, আপনারা সামনের ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।’
ব্যোমকেশ গিয়া শকুন্তলার দ্বারে টোকা দিল, দ্বার খুলিয়া মিস্ মান্না বাহিরে আসিলেন। ব্যোমকেশ নিম্নস্বরে তাঁহাকে কিছু বলিল, তিনি ঘাড় নাড়িয়া আমাদের কাছে চলিয়া আসিলেন। ব্যোমকেশ শকুন্তলার ঘরে প্রবেশ করিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।