নীল ঘরের নটী – ১২

।। বারো।।

তুষ্টুরাম ক্লাউন তার জুয়াড়ি রাজার কাছে বিচার চেয়েছিল। পায়নি। তখন সে জনতার কাছে বিচার প্রার্থনা করল। পেল না। সে জানত না, জনতাও তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী।

হয়তো সে দেখেছিল, কোনো উদ্ধারই সম্ভব নয় পৃথিবীতে। নিতান্ত মানুষ হিসেবে কোনো মূল্য দাবি করা তার বৃথা। দুর্গামোহনের কাছে সে ওই খাঁচায়—পোরা ওসমান খাঁ—যে এক টুকরো মাংসখণ্ডের বিনিময়ে মালিকের উদ্দেশ্য সার্থক করে—আর জনতার কাছে সে ভাঁড় ছাড়া কিছু নয়।

নয়নতারা তাকে অনেক কিছু দেবার দাবি করেছিল। তা তো শুধু ওই মাংসখণ্ডটা। তুষ্টুময় যে—নটীকে চেয়েছিল, সে কি এই মর্তের মেয়েমানুষ? সে তো একটা মায়া। দুর্গামোহনের জাদুদণ্ডসঞ্চালনে তার জন্ম ও লয়।

এবং একই আলেয়ার প্রতি আমার ক্ষুধার্ত হৃদয় ধাবিত। শিউরে উঠেছিলাম। নিয়তি যেন আঙুল তুলে নিঃশব্দে চিৎকার করে বলছিল—তুমি, নন্দ, এবার তুমি!

তুষ্টুরামের মৃতদেহের সম্মানে মাত্র একটি শো বন্ধ রেখেছিল দুর্গামোহন। আমরা এই দিনটিকে শোকদিবস রূপে পালনের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমরা মৌন থাকলাম? দুর্গামোহন তার ভাগ্যের ঘরে শুয়ে রইল সারাটি দিন। জানোয়ারগুলিকে খাবার দিয়ে এল নয়নতারা নিজে। তার নির্বিকার মুখে কোনো শোকের চিহ্ন নেই। সিঁথির সিঁদুর সে মোছেনি। বাঁ—হাতের একটি মাত্র শাঁখা ও নোয়াটি শুধু মৃতের আত্মাকে সুখী করার জন্য খুলে রেখেছিল।

অথচ আমি চেয়েছিলাম, সে যথার্থ বিধবার ন্যায় শোকবাস পরুক। বিলাপ করুক। তুষ্টুরামের মৃতশরীরের সংলগ্ন হয়ে বারবার মূর্ছা যাক। এবং আমার এ—ইচ্ছা খাঁটি সংসারী পুরুষের ইচ্ছা ছাড়া কিছু নয়।

তার নির্লিপ্ততা তবু আমাকেই সাহসী করতে পারল। তীব্র বিবেকদংশন থেকে ক্রমে মুক্তি পেলাম। তুষ্টুরাম স্বেচ্ছায় আমার ভোগের পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে—এ—ধরনের সেকেলে মহত্ত্ব অবশেষে তার চরম পর্যায়ের এক ক্লাউনপনা হয়ে দাঁড়াল।

অতিশয় গুণী খেলোয়াড় ও সংগীতপ্রেমিক তুষ্টুরাম এক নটীনারীর প্রেমের জন্যে নিজ মৃত্যুকেও ভাঁড়ামিরূপে ব্যবহার করে হাসির খোরাক জোগাল মাত্র।

ভাগ্যের ঘরে গিয়ে দুর্গামোহনকে ডেকেছিলাম, ‘দাদা, বেলা নেই আর, উঠুন। আজ শো দেবেন বলছিলেন?’

দুর্গামোহন উঠে বসেছিল হুড়মুড় করে ‘আরে তাই তো নন্দ!’

‘সব রেডি করে ফেলেছি। শুধু আপনার অপেক্ষা।’

‘এই তো চাই!’ দুর্গামোহন আমার হাত ধরে নাড়া দিয়েছিল। ‘নন্দ, এ—লাইনে এমন অনেক হয়।’ অনেক দেখেছি। ওতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।’

‘নাঃ। ঘাবড়াইনি মোটে।’

‘কোনোদিন যদি দ্যাখো আমিও অমনি একটা কিছু করে ফেলেছি অবাক হোয়ো না।’ হাসছিল সে।

‘কী যে বলেন!’

‘হ্যাঁ রে ভাই। মরণ এই তাঁবুতে পুষে রেখেছি। কখন কার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক নেই। হঠাৎ হয়তো দেখলে, ওই নয়নও দাঁত ছর কুটে পড়েছে….’

‘চলুন, সময় নেই আর।’

‘কিংবা তুমিও, নন্দ, তুমিও।’ নিঃশব্দ হাসিতে কাঁপতে থাকল দুর্গামোহন। ঠিক নিয়তির মতো।

সত্যই আমি ত্রাসে উদ্বেগে থরথর করে কাঁপছিলাম। আমার চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল।

‘আহা ডরো মাৎ বাচ্চা।’ আমার হাত ধরে বেরোল দুর্গামোহন। ‘যতক্ষণ আছি, ততক্ষণের থাকাটা তো মিছে নয়।’

নয়নতারাকে সাজতে বলতে পারিনি মুখোমুখি। তবু দেখলাম সে যন্ত্রের নিয়মে হ্যাসাগের আলোয় গালে তুলি ঘষছে। ভ্রূ আঁকছে নিপুণ হাতে। কপালের চিহ্নটা ঘিরে চন্দ্রকলা রচনা করতেও দ্বিধা নেই তার। তারপর সে মুখ তুলে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নটীর হাসি হাসল। মুহূর্তে সবকিছু বদলে গেছে। আলোকময় শব্দোচ্ছল মেলা গভীর অর্থে আকীর্ণ হয়েছে। আমবাগানের অন্ধকার, বাঘের চিৎকার, পাশাক্রীড়া, মঞ্চ, সমবেত দর্শক নৃত্যগীতময় হয়ে পড়ছে ক্রমান্বয়ে। নটীত্বের সর্বগ্রাসে সবকিছু নিক্ষিপ্ত। নয়নতারাময় সন্ধ্যার পৃথিবীতে ঠিক তখনই অনভ্যস্তকণ্ঠে চাপাটিকে চিৎকার করতে শুনলাম তাঁবুর দরজার ওপর। ….’আসুন, আসুন, দেখে যান, দেখে যান আপনার আঁখো কা তারা…’

তুষ্টুরামকে নিখুঁতভাবে অনুকরণ করার চেষ্টা তার। হাসি পেল? ওই চ্যাপটা—শরীর চাপাটিটাও গোপনে দীর্ঘকাল একটা সাধনার মগ্ন ছিল তা হলে!

মেলার সমবেত মানুষ এবং আমরা এইবার নিজেদের ইচ্ছার দ্বারা সৃষ্ট জগতে পরম সুখে বিচরণ করতে পারি।

খাঁচা খুলে নিজের হাতে শেকল টেনে জন্তুদের বের করল নয়নতারা। সাপিনীর গায়ে চুমু খেয়ে ফিস ফিস করে বলল, ‘কী রে ছুঁড়ি, আজ আবার দুষ্টুমি করবি নে তো? সতিন যেন!’

দুর্গামোহন অনেকগুলি ম্যাজিক দেখাল। শেষে দুঃখের সঙ্গে তুষ্টুরামের মৃত্যুসংবাদ ও শেষ খেলাদুটি প্রদর্শনের অক্ষমতা ঘোষণা করল। জনতা শান্তভাবে শুনছিল।

শেষের দিকে কে চিৎকার করে উঠল ভিড় থেকে। ‘তবে শুধু নাচগান চলুক।’

আরও কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ‘টপ্পা, টপ্পা!’

হট্টগোল বাড়ছিল ক্রমাগত। নানাকণ্ঠে নানা দাবি। ‘না, না, কীর্তন! ‘ঝুমুর!’ ‘ফিল্মি গানা’ ও ‘আধুনিক’ শব্দদুটিও একাংশ থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল। সেদিকে কিছু ভদ্র যুবক। অন্যান্য দিনের প্রদর্শনীতে এদের একটু চুপচাপ থাকতে দেখেছি।

তুষ্টুরামের মৃত্যু যেন হঠাৎ একটা পর্দা সরিয়ে দিয়েছে আমাদের ওপর থেকে। ‘অগ্নিবলয়’ ‘ত্রিশুল’, আর ক্লাউনপনা ইত্যাদি আইটেম বাদ পড়ে আমরা নিছক একটি নাচগানের দল হয়ে গেছি। বাঘ সজারু সাপ দারুণভাবে উদ্ভট ও অর্থহীন হয়ে গেছে। তুষ্টুরামের অভাবে দুর্গামোহনের সেই নাটিকাটি অভিনয়ের কিছু ঝুঁকি আছে। নয়নতারা কি একাই মঞ্চে পর—পর দু—বার জন্তুগুলিকে টেনে আনার সাহস রাখে?

চুপিচুপি প্রশ্ন করলাম। সত্যই সে ইতস্তত করছিল। বললাম, ‘থাক তা হলে।’

গণ্ডগোল খুবই বেড়ে গেল।

হঠাৎ নয়নতারা উঠে দাঁড়াল। মঞ্চে প্রবেশ করল। ফিল্মের গান শুনতে পেলাম তার কণ্ঠে। দুর্গামোহন বড়ো—বড়ো চোখে তাকিয়ে আছে। মঞ্চে ঘুঙুরের ধ্বনি উঠেছে…..ঝুম—ঝুম….ঝুম—ঝুম….

ঝুঁকে এসে নয়নতারা চাপা গলায় বলে গেল, ‘কার্ফা। কোমর ভাঁজ করে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। হাত দুটি তুলল। মাথা পেছনে হেলিয়ে দিলে। বুকের দিকে চাইতে গিয়ে মুখ নামালাম। যেন এক যথার্থ বেশ্যাকে দেখছি। দেহ ছাড়া যার বেঁচে থাকার মতো কোনো পুঁজি নেই।

অস্ফুট কণ্ঠে দুর্গামোহন বলে উঠল, ‘এইবার মেয়েটা সব খুইয়ে বসল নন্দ।’ তারপর ক্ষিপ্র আঙুলে কার্ফার বোল তুলতে থাকল সে। ধেগে না কে না কে ধিন….ধেগে না কে না কে ধিন…

‘বোম্বে ঠেকা!’ নয়নতারা ইঙ্গিত করছে আবার।

দুর্গামোহন কি জানে? জানতো তুষ্টুরাম।

ভাগ্যের ঘরের খেলা শেষ হতে চৈত্রের রাত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। নগ্ন পরিব্যাপ্তি দিনের বুকে যেন একটা জ্যোৎস্নাময় অন্ধকারময় বিচিত্র সতরঞ্জ বিছিয়ে দিয়ে আমাদের জাদুর তাঁবু গড়ে ওঠে। একসময় শেষ হয়ে যায় সব খেলা। উজ্জ্বল রোদের প্রান্তরে আবার প্রতীক্ষার পালা।

দুর্গামোহন সে—রাতে অনেক জিতেছিল। বলছিল, ‘এমন আসর কোনোদিন দেখিনি।’

অথচ তাকে বড়ো ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। অল্প একটু নেশা করে আমিও কিছু ক্লান্তি বোধ করছিলেন। তারপর সে শান্তভাবে তার প্ল্যানগুলি আমাকে শোনাল। জন্তুদের বিক্রি করে ফেলবে শিগগির। লোকজনও কিছু ছাঁটাই করবে। শুধু নাচগানের একটা দল রাখবে। আরও কিছু মেয়ে সংগ্রহ করবে। গ্রীষ্মের শেষদিকে নিজের ডেরা মল্লারপুরে ফিরে গেলে ঝুমুরদলের মেয়েগুলিকে সে বলবে। সেখানে মেয়েগুলি দিনের বেলা চালকলে মজুরির কাজ করে। রাতের দিকে দেহ—বিক্রয়ার্থে প্রস্তুত হয়। এবং মরশুমে মেলায়—মেলায় ঝুমুর দল গড়ে ঘুরে বেড়ায়।

বিস্ময়ের কারণ থাকলেও আমি বিস্মিত হইনি।

‘মোটামুটি মন্দ হবে না এটা। কী বলো?’ আমার মত জানতে চেয়েছিল সে। ‘নাকি তোমার এখনও কিছু শুচিবাই রয়েছে নন্দ?’

‘নাঃ।’

আমি দেখেছিলাম কী ভীষণভাবে ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’ স্খলিত হচ্ছে নীচের দিকে। পতনশীল দুর্গামোহনের মুখ দেখে দুঃখ হচ্ছিল। ওসমান খাঁ, আমিনা আর বুঢ়ুয়াকে এনে রতন মাস্টার তার কুৎসিত দ্যুতক্রীড়াকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তুষ্টুরাম দিয়েছিল আরও সূক্ষ্ম বর্ণপ্রলেপ। তখন দুর্গামোহন একজন প্রকৃত রাজার ভূমিকা অর্জন করে। নয়নতারা—বাঈজি হয়ে ওঠে রাজসভার উর্বশী নটী।

কিন্তু আমি কী ‘নতুন খেলা’ দিলাম? কি সেই উল্লেখযোগ্য সংযোজন?

আজ দেখছি এক অতি চতুর অথচ সাধারণ এক জুয়াড়িকে, তার তাঁবুর জগতের দিকে বাইরের জগতের কোনো বিস্ময় অগ্রসর হচ্ছে না। যা আসছে সর্বগ্রাসী কুয়াশার মতো ঘিরে ধরতে, তা লালসার বিস্মৃত রসনা।

তারপর দুর্গামোহন আমার হাত ধরে টানল। নয়নতারার তাঁবুতে নিয়ে এল সে। ডাকল, ‘নয়ন, ও নয়নমণি!’

নয়নতারা ঘুমোয়নি। উঠে বসল।

‘নন্দ মাস্টার আজ থেকে তোর এখানে শোবে।’ আমাকে ঠেলে দিয়ে দ্রুত চলে গেল দুর্গামোহন। নয়নতারা কিছুসময় চুপ করে ছিল। নিবু—নিবু হ্যাসাগটা দপ করে নিবে গেল একেবারে। একটা ঘোর লাল বর্তুল মুহূর্তেই শ্বাস ছেড়ে ধূসর হয়ে গেল।

‘কই, এসো ছোটোবাবু।’ নয়নতারা আমাকে ডাকছিল। তার সরে গিয়ে জায়গা দেবার শব্দ শুনছিলাম। এবং সেই সময় অত্যন্ত হঠাৎ ওসমান খাঁ তীব্র গর্জন করে উঠল। সজারুর ডানার শব্দ শুনলাম। সাপের খাঁচাটা ভীষণ নড়ে—চড়ে উঠল। ভাগ্যের ঘরে নীলাভ আলোয় একা—একা দুর্গামোহন শূন্য ছকের ওপর পাশার গুটিগুলি ছাড়িয়ে দিল। ‘কী হল ওদের?’ আমি অস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।

‘কিছু না। শেয়াল—টেয়াল এসেছে বোধহয়।’ নয়নতারা ফের ডাকল। ‘তুমি এসো। ঘুম পাচ্ছে।’

আমি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম।

‘পেটে খিদে, মুখে লজ্জার কোনো মানে হয় না নন্দ।’

নয়নতারা আমাকে একটার পর একটা চাবুক মারছিল। আস্তে—আস্তে আমি সরে গেলাম। নিজের তাঁবুতে গিয়ে গড়িয়ে পড়লাম।

কী একটা স্বপ্ন দেখছিলাম যেন। বাবার হাত ধরে বিস্মৃত বিরাট তাঁবুর দরজায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। তুষ্টুরাম ক্লাউন চিৎকার করছে। আসুন……আসুন, দেখে যান, দেখে যান……আপনার আঁখো কা তারা……….

বুকের ওপর স্পর্শ। লাফিয়ে উঠে বসলাম। ‘কে, কে তুমি?’

নয়নতারা আমার মুখে হাত রাখল। তারপর সে আমার পায়ের দিকে সরে এসে পা—দুটো ধরে ঝুঁকে পড়ল।

‘নন্দ, দোহাই নন্দ, তুমি অমন কোরো না।’

‘কেন নয়ন?’

‘বাবু আমাকে মেরে ফেলবে। সে ভাববে, তোমাকে আমি ঘৃণা করছি।’

‘আমি বুঝিয়ে বলব তাকে।’

‘না, না। সে তোমার মতো শিক্ষিত লোক নয়। সে জানে সব মানুষই এক ছাঁচে তৈরি। সকলেই জন্তু—জানোয়ার।’

‘কিন্তু আমি তো তোমাকে এভাবে চাইনে।’

‘অবুঝ হোয়ো না লক্ষ্মীটি। পার্টিতে থাকতে গেলে আমাদের স্বামী—স্ত্রী সাজতেই হবে। বাবুর হুকুম মানতে হবে নন্দ।’

‘আমি পার্টি ছেড়ে দেব।’

‘তা হলেও আমার রেহাই নেই।’ নয়নতারা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ‘বাবু ভাবতে তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছি।’

‘তুমি মরতে পারবে না নয়ন?’

‘পারতাম। কিন্তু—’ নয়নতারা হাঁফাচ্ছিল। ‘কিন্তু আমার ছেলে—’

‘আমার সঙ্গে পালিয়ে যাবে?’ তাকে সোজা বসিয়ে মুখোমুখি বললাম। ‘যাবে তুমি? এখনই?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘আমার ভালোবাসায় তুমি সুখী হবে না। নন্দ, আমার আর কোনো ভালোবাসা বেঁচে নেই।’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি নয়ন।’

‘না। তুমিই বলেছিলে নন্দ, সে অন্য মেয়ে। সে ওই স্টেজের নাচওয়ালি। দুর্গাবাবুর দল ছেড়ে গেলে তাকেও তো আর দেখতে পাবে না তুমি।’

আবার অনেক সময় আমরা চুপ করে ছিলাম। বড়ো তাঁবুর শীর্ষে একটা নক্ষত্র উজ্জ্বল হয়েছিল। ভাগ্যের ঘরে নীল আলোটা অনির্বাণ জ্বলছিল।

‘নয়ন, তোমার বাবা কে জানো?’

অন্ধকারে তার মুখ দেখি না। নয়নতারা কাঁপছে একটু একটু। নিঃশব্দে কাঁদছে হয়তো।

‘বলবে না?’ ফের বললাম।

‘কী হবে শুনে? আর সে কথা এখন জানতে চাচ্ছো কেন?’

‘আমার খুবই সন্দেহ….’

‘কী?’

‘দুর্গামোহন তোমার বাবা।’

নয়নতারা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। ‘বাসর সাজিয়ে তোমায় ডাকতে এসেছি। তুমি খুব ছেলেমানুষ বর নন্দ। এসো……’ হাত ধরে টানল সে। ‘আঃ এসো না!’

ভাগ্যের ঘর থেকে দুর্গামোহনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল—’কী রে এখনো তোরা শুলি নে?’

‘এই যে, যাচ্ছি বাবু।’

‘বরং ওখানেই থাক তোরা। আমি ডিব্বুটার পাশে যাচ্ছি।’

ভাগ্যঘরের আলো নিবে গেল দপ করে। হ্যাসাগটার দীর্ঘশ্বাস কানে এল।

এ একটা অদ্ভুত রাত। এ আমার চারপাশ থেকে রক্ত শোষণ করছিল—অথচ প্রতিটি শোষণে যে শিহরণ অনুভব করছিলাম—তা আমাকে জানিয়ে দিচ্ছিল : এই তোমার প্রাপ্য ছিল—যে পথে তুমি যাত্রা করেছিলে, তার শেষে এই ছিল নির্ধারিত। তোমার ভালোমন্দ বোধের বাইরে নিয়তির এটা উপহার। এর আনন্দ তোমার গ্রহণ করা উচিত।

ওসমান খাঁ বাঘটার মতো আমি কি ক্ষুধার্ত থেকেছি? এবং ঠিক তারই মতো আমবাগানের নির্জন নিঃশব্দ অন্ধকারে হঠাৎ হঠাৎ আমার গর্জন করে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল। শোষণকারী রাতের কবল থেকে মুক্তি পাবার ইচ্ছায় হিংস্র হতে চাচ্ছিলাম। তখন আস্তে আস্তে কনুই ভর করে উঠে নয়নতারার মুখ দেখছি।

খুবই নিশ্চিন্তভাবে সে ঘুমিয়ে গেছে। জীবজগতের আদিম নিরাপত্তার চিহ্ন তার শ্বাসপ্রশ্বাসে, স্তব্ধ শরীরে, নিদ্রায়। আত্মাবর্জিত তার নারীশরীর সাপের খোলসের মতো পথের ওপর পড়ে রয়েছে। ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল তার সর্পিণী আত্মা কোথায় কোন প্রাকৃতিক ফাটলের খাঁজ পেরিয়ে কোনো গুহাহিত অন্ধকারে এখন ভ্রমণ করছে—হয়তো প্রতিচ্ছবিরা এখনও তার অনুসরণকারী—যে প্রতিচ্ছবি এই পরিত্যক্ত খোলসের জগতের—যে প্রতিচ্ছবি এখন আমার কাছে খাঁটি ছবি মাত্র। আমার সাধ হচ্ছিল ওই সর্পিণী যদি আমায় সঙ্গে নিত! আমি যদি তার সাক্ষাৎ পেতাম—ওই অলৌকিক ভ্রমণের সঙ্গী হতাম! হয়তো তার ভ্রমণের জগতে আমি এখন আছি—কিন্তু সে তো ঠিক আমি নই—সে আমার প্রতিচ্ছবি মাত্র। সে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো বীভৎস ক্লান্ত অথচ কাপুরুষ—সে অজানা কারণেই বশ মেনে খাঁচায় বসে থাকে, খাঁচা খোলা পেলেও পালাতে পারে না।

ছেলেবেলায় দেখেছিলাম রঘু ঠাকুরমশাই প্রতিমার একখানি হাত ভেঙে গেলে কী কান্না না কেঁদেছিলেন হাউমাউ করে। আমি মনে মনে বলেছিলাম—’রঘুজ্যাঠা, তুমি কাঁদছ কেন বাপু? হাত ভেঙেছে তো কী? জগা মেকদারকে ডাকলে ফের সে বানিয়ে দেবে…’

রঘু ঠাকুর শুধু কেঁদেছিলেন—একটানা কেঁদেছিলেন।

‘ঈশ্বরের হাত কি ভাঙে? মানুষ কী অবুঝ।’ বাবা বলেছিলাম। ‘তুই ঠিকই বলেছিস খোকা—প্রতিমার হাত ভাঙলে জগা মেকদার ফের বানিয়ে দিতে পারে। রঘু একেবারে পাগলা।’

ইষ্টদেবী তো মানুষের মনে। প্রতিমা বানায় তার কাঠ খড় মাটি এইসব তুচ্ছ উপাদানে—এ সবই তো বিসর্জনের। তবু মানুষের মন রঘু ঠাকুরের মতো এই তুচ্ছকেই সার ভেবে বসে। এই তুচ্ছকে সে ভালোবেসে ফেলে। এর মোহে সে বিভ্রান্ত হয়। তখন ইষ্টদেবীর চেয়ে প্রিয়তম এই সব বস্তুখণ্ডগুলি।

নটী নয়নতারার প্রতিমার ন্যায় যে—আকৃতি—যে তুচ্ছ নশ্বর বস্তুখণ্ডগুলি আমি বানিয়েছি, তারা বিসর্জিত হবে—তবু রঘুজ্যাঠার মতো আমার কান্না পাচ্ছিল। আমি আমার সৃষ্টির প্রতি বিহ্বল হচ্ছিলাম ক্রমে—ক্রমে। নিজের মনের মাধুরী দিয়ে বানানো উজ্জ্বল একটা প্রতিমার রূপ আমাকে ক্রমান্বয়ে মুগ্ধ করছিল। এবং পুরোপুরি তাকে নিবিড়ভাবে পাওয়ার ক্ষুধা আমার চোখদুটি অন্ধ করে দিচ্ছিল। নটীমেয়েকে পেতে চেয়ে আমি আমার সৃষ্ট প্রতিমাকে আঁকড়ে ধরছিলাম। তারপর দেখলাম—যা আমার আয়ত্তে—সে তার শরীর—নারী শরীর। যুগপৎ দুঃখ শোক আনন্দ আবেগে উদভ্রান্ত হয়ে হাতের কাছে তার শরীরটাকেই আঁকড়ে ধরলাম অবশেষে। তার শরীরের পাহাড়ে মাথা ঠুকে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল—নয়ন, ও নয়ন, তুমি কোথায়?

তার দেহের পাথুরের পাহাড়ের পথ বেয়ে ক্লান্ত হতে হতে যাত্রা শুরু হল আমার। তাকে খুঁজছি তার রক্তমাংসে ফুসফুসে ঠোঁটে বুকে—উষ্ণ রক্তস্রোতের মধ্যখানে ভেসে। প্রতিমার উজ্জ্বলতায় রূপে বর্ণসম্ভারে যাকে পাচ্ছি নে—সে যদি মেলে অভ্যন্তরীণ কাঠ খড় বাঁশের তুচ্ছতার মধ্যে!

ঠিক এরূপ একটা অসহায় বিশ্বাস আমাকে পেয়ে বসেছিল ততক্ষণ। আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম উষ্ণ প্রবহমান রক্তের নদীতে। জীবজগতের উদ্দামতা আমাকে সব বিশ্বাস অবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছিল। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল নয়নতারাকে আমি পেয়েছি, পেয়েছি তাকে দারুণ ঘর্মাক্ত শারীরিক শ্রমের মুখোমুখি জৈব আনন্দের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে—অতি কাছে অতি সহজ সে, অনায়াসে তাকে পাওয়া যায়—এই তো সে, এই তো!

শেষমুহূর্তে হঠাৎ নয়নতারা ঘুম থেকে জেগে উঠল। তারপরই অস্ফুট একটা আর্ত চিৎকার করল সে—কিছু বিস্ময় কিছু বেদনা তার চিৎকারে মিশছিল—’নন্দ, নন্দ তুমি…’

আমি দানবের ন্যায় হাসছিলাম। তাকে ধরে ফেলার জয়োল্লাস আমার আচরণে প্রকট হচ্ছিল। ‘কী হল নয়ন, কী হল তোমার?’

‘নন্দ, আমি ভাবতে পারিনি।’ নয়নতারা ধড়মড় করে উঠে বসল। সে হাঁফাচ্ছিল। মাথা নিচু করে পা ঝুলিয়ে বসে সে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ‘তুমি শিক্ষিত মানুষ হয়েও শেষে….’

‘কী ভাবতে পারোনি তুমি?’

নয়ন চুপ করে থাকল।

‘কোনো দোষ করিনি….’ সিগ্রেট জ্বেলে বাইরে এলাম বলতে বলতে। ঘাসের ওপরে বসে থাকলাম। একটা উদ্ধত ব্যঙ্গ আমার জিভে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। নয়নতারার সতীপনা! যতবার ভাবছিলাম, ঘোরতর ঘৃণা ওই ব্যঙ্গের সঙ্গে মিশে আমাকে ক্রুদ্ধ করছিল। যেন—হয়তো বা—দারুণ কায়িক ও মানসিক শ্রমের যা মূল্য পেয়েছি—তা অতি অকিঞ্চিৎকর—ঠিক এরূপ কোনো দরকষাকষি চলছিল ক্লান্ত মনের ভেতর।