চৌদ্দ
আকবর চড়া গলায় ডাকছিল, কবীর, এই কবীর!
কবীর দোতলার জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, কী রে?
নেমে আয়। কথা আছে। শিগগির!
নিচের ঘরের দরজা খুলে কবীর বলল, আয়।
না—শোন।
আকবরের কণ্ঠস্বরে কী ছিল, কবীর উদ্বিগ্ন মুখে নেমে এল। সামনের বটগাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল দু’জনে। কবীর বলল, কী ব্যাপার?
কাল সন্ধ্যায় তোকে দীপুরা মেরেছে?
কবীর চমকে উঠল। …আরে না, না। মারবে কেন? এমনি—সামান্য তর্কাতর্কি হয়েছিল। তারপর সুনীল, মৃগেন, লঙ্কাদা এসে গেল। মিটিয়ে দিল। যাঃ, তেমন কিছু নয়।
লুকোস নে কবীর। আমি সব শুনেছি। যখন তুই খেলার মাঠে এলি, ঝুনু তোর সঙ্গে ছিল? সত্যি বলবি।
কবীর নার্ভাস হয়ে বলল, ছিল। বারণ করলুম—ওখানে দীপুরা আছে—আমার সঙ্গে দেখলে খেপে যাবে। ঝুনু শুনল না। তারপর…
আকবর ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলল, তারপর?
খেলার মাঠের ধারে আমি বসলুম। ঝুনুও কাছে বসল। তখন দীপুরা সব খেলা শেষ করে জটলা করছিল। বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। উঠতে যাচ্ছি—হঠাৎ দীপু, রত্নেশ, কাজল আরও ক’জন এসে জাত তুলে গাল দিতে লাগল।
ঝুনু কিছু বললে না?
হ্যাঁ—ওর মুখ তো জানিস। ভীষণ প্রতিবাদ করল। তখন ওরা তাকে কুৎসিত কথা বলতে লাগল।
তারপর, তারপর?
আমি বললুম, ওকে যা—তা বলছ কেন? আমাকে যা বলার বলো। হঠাৎ দীপু জামার কলার ধরে মাথায় ঘুঁষি মেরে বসল।
আর তুই শালা মার খেয়ে গেলি!
আরে না! শোন না! আমিও ঘুঁষি মারলুম—কিন্তু ওরা দলে বেশি। তাছাড়া সঙ্গে সাইকেল আছে। ওদিকে ঝুনু চেঁচিয়ে তখন সুনীলকে ডাকতে লেগেছে। মাঠের ওদিক থেকে সঙ্গে সঙ্গে ওরা এসে গেল। লঙ্কাদাকে তো জানিস! কবীর হেসে ফেলল। …ভয়ে ওরা শাসাতে শাসাতে পালিয়ে গেল। সামান্য ব্যাপার!
সামান্য ব্যাপার? জাত তুলে গাল দেবে, সামান্য ব্যাপার?….আকবর ফুঁসে উঠল। কই, সুনীল মঞ্জুকে নিয়ে মাথা খারাপ কারও হয় না। তুই মুসলমান বলে…
কবীর বলল, আকবর! প্লিজ, তুই এটা কম্যুনাল বলে নিসনে।
আকবর গর্জে উঠল। শালা—এর নাম ইন্ডিয়া। ভারতবর্ষ। সেকুলার রাষ্ট্র। হিন্দুর যেমন অধিকার, মুসলমানেরও তেমনি অধিকার। সব শালা খাজনা দিয়ে বাস করি। কী ভেবেছে রে ওরা? আয়, আমার সঙ্গে!
কবীর বলল, আঃ আকবর! ভুলে যাস নে—সুনীল, লঙ্কাদারাও ছিল—তারা আমার হয়ে ওদের বকেছে!
ওটা মুখেই! নেহাত তুই রবিয়ুল কাজীর ছেলে—তাই। তুই সুনীল হলে লঙ্কা কী করত ভেবে দেখেছিস? সবকটা স্ট্যাব করে খুনের বান ডাকত না?
প্লিজ, প্লিজ আকবর। এটা রটলে ঝুনুর ক্ষতি হবে।
আরে যা যা! ক্ষতি হবে বলে জাতের অপমান সইতে হবে নাকি?
না, আকবর। তুই যা।
তাহলে তুই যাবি নে?
কবীর গোঁ ধরে বলল, না।
ঠিক আছে। বলে আকবর সাইকেল চেপে বোঁও করে চলে গেল।
কবীর দুঃখিত মনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাড়ি ঢুকল। ওপরের ঘরে গিয়ে অভ্যাসমতো চিত হয়ে শুল সে। এমুহূর্তে যদি মহাকাশযাত্রী হওয়া যেত, কত সুখেরই না হত! পৃথিবীটা ভুল মানুষে ভুল ব্যাপারে ভুল কথাবার্তায় দিনে দিনে ভরে উঠছে। শ্বাসরোধকর অবস্থা। ভাবতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। এই একটা মুহূর্তের কথা যদি ধরি—এইমাত্র কত লক্ষ লক্ষ জন্ম ঘটল, মৃত্যু ঘটল। কাদের মধ্যে ভালোবাসা জাগল, কাদের ভালোবাসার বাতিগুলো গেল নিভে। হয়তো এই মুহূর্তেই কে কোথায় কার গলাটা পেঁচিয়ে—পেঁচিয়ে কাটছে—হয়তো ঠিক এখনই কার সময় হয়েছে বলার—তোমাকে ভালোবাসি! আশ্চর্য, অদ্ভুত, বিচিত্র। এক—একটা মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ঘটনা—লক্ষ ভাবনার মালা গাঁথা। এই গভীর রহস্য আর সম্ভাবনা আর সত্য আর বাস্তবতা আর মায়া নিয়ে যার অস্তিত্ব—তার নাম সময়। সে একটি গতি। তবে বের্গসঁ থাক—আইনস্টাইন বলেছেন—সময় চিরবর্তমান। ছিল—আছে—থাকবে বলে আপেক্ষিক হিসেব মানুষের কাছে দরকারি—তার জীবনের জন্যে বা স্মৃতির জন্যে জরুরি; কিন্তু আসলে—সবই ‘আছে’। কল্পনা করা যেতে পারে একই মুহূর্তের মধ্যে আদিম মানুষ আর আজকের সভ্য মানুষ ঘর—গেরস্থালি করছে। ভাবতে পারো তুমি? একালের বিজ্ঞানী বলেছেন—সময়ের বাস্তব অস্তিত্ব আছে। আছে বইকি। অনুভূতি নিয়ে তাকে পাওয়া যায়। এদিক থেকে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের অনেক সিদ্ধান্তে চমকে যেতে হয়! কোটি কল্প—কল্পান্ত যুগের কথাও ঋষিরা ভেবেছিলেন! সময়ের ওই বিশালতার ব্যাপ্তির ধারণা তো মানুষের চেতনাতেই বাস্তব ব্যবহার ব্যতিরেকে ধরা পড়েছিল! হ্যাঁ, অনুভূতির জানালা দিয়েও সত্যের আলো এসে পৌঁছতে পারে। প্রাচীন হিন্দুরা এব্যাপারে অসম্ভব বুদ্ধিমান। …আকবর—আকবরটা হঠাৎ অত খেপল কেন? রুবির প্রতিক্রিয়া? সে হিন্দুকে ভালোবাসে বলে ওর হিন্দুদের ওপর এত রাগ? সাইকলজি এর ব্যাখ্যা দিতে এখনও পারছে না। এখনও এ বিদ্যাটা অনেকখানি অপজ্ঞানের বুড়ি ছুঁয়ে ঘুরছে। মন অঙ্কের নিয়ম মানে না। রোবোট সবকিছুই করতে পারুক, হাসতে পারবে কি? হুঁঃ হুঁঃ হুঁঃ! আকবর একটা আস্ত রোবট। কতকগুলো ছকবাঁধা অভ্যাসে বন্দি। কান্ট বলেছেন, আমাদের মনে কতকগুলো বস্তুনিরপেক্ষ ছাঁচ আছে—আমরা যা কিছুই দেখি বা জানি অর্থাৎ আমাদের জ্ঞান ওই ছাঁচের মধ্যেই রূপ নেয়। কাজেই প্রকৃত বাস্তবতা বা থিং—ইন ইটসেলফ মানুষের চেতনার পক্ষে দুর্জ্ঞেয়।..মরুকগে!…আরে! সেই কবিতাটা পুরো লিখিনি যে! একটা লাইন মাথায় এল। সম্ভবত দুর্জ্ঞেয় শব্দটার অনুষঙ্গে—সো দিস ইজ কলড দি অ্যাসোসিয়েশন অফ আইডিয়াজ—সরি—অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়ার্ডস! শব্দব্রহ্ম। উঃ ভাবা যায়! ভারতীয়রা সে যুগে কীসব ভাবতেন! দূর ছাই! আমিও তো ভারতীয়। পূর্ববাংলার বরুদ্দীনের ওমরের ‘সংস্কৃতির সঙ্কট’ বইটা কী সাংঘাতিক! ‘বাঙালী মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ চ্যাপটারটা দারুণ! হ্যাটস অফ বদরুদ্দীন সায়েব! ভাগ্যিস বইটা সেবারে নুরুভাই এনেছিল। নুরুভাইটা পাকিস্তানে গিয়েই এত বাঙালি হয়ে গেছে সম্ভবত। বাঙালি! মুসলমানকে হিন্দুরা বাঙালি বলে না কুসুমগঞ্জে। অথচ আমি—আমি তো হাড়ে হাড়ে বাঙালি। বাংলা দেশের…এই রে! লাইনটা গুলিয়ে গেল যে! কী এসেছিল যেন—হ্যাঁ, ‘লাইন আসে’ শক্তি সুনীলরা কোথায় যেন ব্যাপারটা লিখেছিলেন! মুসলমান বলে? আচ্ছা, এত যে কবিতা পাঠাচ্ছি, ওরা ছাপছে না কেন? উঁহু! কলকাতায় রায়ট হোক আর যাই হোক, সাহিত্যে কোনো হিন্দু মুসলমান নেই। এক ধরনের রাজনীতি ব্যাপারটা বাধিয়ে দ্যায়। মনের ভিতর থেকে খুঁচিয়ে ধর্মটাকে জাগায়—খাঁচায় গুঁতিয়ে সিংহ বের করার মতো। বাপস, ধর্ম জিনিসটে কী ভয়ানক! তাই ভারি দুঃখ হয়, ভারতবর্ষে এমন তেজি পুরুষ নেই—যে গর্জে সবাইকে চুপ করিয়ে দ্যায়—ধর্ম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার! খবরদার, কেউ এ নিয়ে গেঁজিয়ো না। একটা শক্ত মানুষ দরকার ছিল। হ্যাঁ—সুভাষচন্দ্রের মতো। অবশ্য নেহরু—না নেহরু খুব বেশি কালচার্ড মানুষ, কাজেই ভীতু, দোনামনা করেই মারা গেলেন! রাজনীতি করা দুধ দিয়ে পোষা সাপের মতো—পাকা বেদে না হলে তার হাতেই মৃত্যু ঘটে। আমার কি রাজনীতি করা উচিত হচ্ছে? আমার মধ্যে ভীষণ দোনামনা ভাব আছে। ঝুনু বলে।…আরে! একবার নুরুভাইকে দেখা করে আসা দরকার ছিল। তাছাড়া ওদের এই বিপদ গেল। যাই, উঠে পড়ি। কবিতাটা…
কবীর ধুড়মুড় করে উঠল। টেবিলে কবিতাটার দিকে তাকাল।
এখনও তুমি দাঁড়িয়ে আছ শূন্যে/নীল
আকাশ থেকে ডাক শুনবে দিনান্তে
হারিয়ে যাওয়া পয়রা এসে যেমন বসে
কিন্তু তোমার নেই তো কোন অট্টালিকা
…মাথা খারাপ! কে কাকে ডাকে! ডাকতে বয়ে গেছে! কেই বা ফিরে আসে সেখানে যেখান থেকে যাত্রা শুরু!
পায়ে চটি গলিয়ে নেমে এল কবীর। নুরুদের বাড়ি আজ শোকের ঝড় বইছে। এই একটা মুশকিল! কিছু শোকপ্রকাশ করতেই হবে। অবশ্য রুবির মা চমৎকার মানুষ ছিলেন। বেচারা হঠাৎ মারা গিয়ে কী কষ্টে ফেললেন রুবিকে!
কথা বলতে বলতে নুরু হঠাৎ গলা চড়িয়ে ডাকল, ঝুনু শুনে যাও তো।
ঝুনু বেরিয়ে বলল, ডাকছ নুরুদা?
হ্যাঁ, আয়। আমরা গল্প করি।…বলে নুরু একটু হাসল সুনন্দর দিকে তাকিয়ে।
ঝুনু কাছে এসে দাঁড়াল।
নুরু বলল, মোড়াটা আন—ঘরে রয়েছে। এনে আরাম করে বোস। তারপর সুনন্দকে বলল, সুনু—দ্যাখ তো রুবি কী করছে! তুই ওকে একটু বললে টললে মনে জোর পাবে। যা শিগগির!
সুনন্দ ভিজে চোখ দুটো মুছে বলল, আমি—যাব?
ঝুনু মোড়া আনতে আনতে একটু হাসল মাত্র।
নুরু ধমক দিল, যা না বাবা। তোরাই এ বাড়ির সুখে দুঃখে চিরকাল সঙ্গে সঙ্গে থেকেছিস! আজ পর ভাবছিস কেন? যা।
সুনন্দ আস্তে আস্তে চলে গেল। রুবির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল সে। দেখল, রুবি উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। সে ফের নুরুর দিকে একবার তাকিয়ে মরীয়া হয়ে ঘরে ঢুকল। ডাকল, রুবি!
রুবি চমকে উঠেছিল। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যেমন শুয়ে ছিল, তেমনি থাকল। তারপর বলল, সান্ত্বনা দিতে এসেছ সুনুদা? দরকার হবে না—কারণ, নেবার জায়গা নেই। কুসুমগঞ্জের সবাই মিলে অত বেশি সান্ত্বনা দিলে আমাকেও মায়ের কবরে ঢুকতে হবে।
সুনন্দ বসল না—দাঁড়িয়ে রইল। বলল, আজ তোমার রাগ করতে নেই রুবি।
রুবি কিছু বলল না। তার পিঠটা সামান্য কাঁপল।
সুনন্দ একটু এগোল। একবার ভাবল—ঠিক সতর্কতা নয়, হয়তো আড়ষ্টতা—বিপত্তির সংশয়, তবু আজ ভিতরের চাপা আবেগটুকু বেরিয়ে আসার জন্য ছটপট করছে এবং একটি মৃত্যু তাকে এই সুযোগটা দিয়েছে—সে হাত বাড়িয়ে ছুঁল রুবির কাঁধটা। তারপর বলল, যে যাই বলুক রুবি—আমি যা ছিলুম, তাই আছি। অন্তত তোমার কাছে না থাকি, মাসিমার কাছে তো ছিলুমই। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। কেন তোমাকে সান্ত্বনা দেব? বরং তোমার কাছেই আজ সান্ত্বনা পেতে এসেছি।…সুনন্দর চোখ ভিজে গেল। সে ধরা গলায় আরও বলল, নুরুর কাছে শুনলুম—মরার সময় মাসিমা বারবার আমার নাম করছিলেন। জানিনে, নিজের মা মারা গেলে আমি কতখানি সইতে পারব—মাসিমা আমাকে সত্যি সত্যি অনাথ করে গেলেন।
রুবি মুখ ফেরাল না। বলল, কাল দুপুরে যখন খাবার দিতে গেলুম, মা তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। বলছিল, ও তো এল না একবার! ছেলেটাকে কদ্দিন দেখিনি—বড় সাধ হচ্ছে দেখতে।
সুনন্দ মুখ নামিয়ে বলল, কাল থেকে বাইরে ছিলুম—এইমাত্র ফিরেছি। কিন্তু সত্যি এ আমার অপরাধ রুবি। দেখতে যাওয়া আমার উচিত ছিল। পারিনি—ভয় হত—পাছে মাসিমা আমাকে ঘৃণা করেন।
রুবি একটু চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা সুনুদা, মা আমাকে এত ভালোবাসত—শুধু ভালোবাসত বলে নয়—সে তো আমারই মা! ছেলেবেলা থেকে অ্যাদ্দিন ধরে তাকে মনে হত, আমার পায়ের নিচের মাটি—হয়তো সবারই এরকম মনে হয়। অথচ কাল সন্ধ্যায়—হঠাৎ দেখলুম, মাকে আমি ঘৃণা করছি, ঘৃণা করেই এসেছি জ্ঞান হওয়া অব্দি। আশ্চর্য লাগল। পায়ের মাটিটা হঠাৎ সরে গেল যেন! আমার কী মনে হল জানো? আসলে কোনোদিনই পায়ের নিচে মাটি ছিল না আমার—ওটা একটা ভুল অভ্যাস। নিছক ধরে নিয়েছিলুম যে আমি দিব্যি দাঁড়িয়ে আছি। অথচ কাল সন্ধ্যার পর জানলুম, আমি চিরদিন ভেসে বেড়াচ্ছি শূন্যে। আমার কেউ ছিল না—আমিও হয়তো কারও ছিলুম না। বিশ্বাস করো সুনুদা—তুমি তো আমাকে ভাবুক মেয়ে বলতে—এ কি আমার মিথ্যে কল্পনা? মা আমার শত্রু ছিল—সবচেয়ে বড় শত্রু।
সুনন্দ অবাক হল।…এঁর আত্মা কষ্ট পাবেন একথা শুনলে। কেন তোমার মা তোমার শত্রু হবেন? তা কি কেউ হয়? মা ছাড়া—
রুবি বাধা দিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলল, তুমি টের পাওনি, তাই। পৃথিবীর সব মা স্বার্থপর—সব মা তার মেয়ের সঙ্গে শত্রুতা করে। ওরা নিজেদের মনের সাজানো বাগানে মেয়েকে মালি বসিয়ে রেখে যেতে চায়। কোনো মেয়ে যেন মা হতে না চায়। আমি—আমি কোনোদিন মা হবো না, তুমি দেখে নিয়ো!
সুনন্দ ওর কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, চুপ করো রুবি। ছিঃ, ওকথা বলতে নেই।
রুবি বালিশে গাল রেখে মুখটা ওপাশে ফিরিয়ে রইল। তার চোখের জল চুইয়ে পড়ছিল। আস্তে আস্তে বলল, তবে একটা জিনিস মা হয়তো শিখিয়ে দিয়ে গেল। যাকে মেয়েরা ভালোবাসে তার চেয়েও মহৎ মানুষ দুনিয়ায় আছে। থাকে। দাদার কথাই বলছি।
হ্যাঁ, নুরু খুব ভালো। নুরুকে আমি বরাবর শ্রদ্ধা করি।
রুবি কান্নার মধ্যে হাসবার চেষ্টা করল। আচ্ছা, তুমিই বলো তো সুনুদা—মহৎ মানুষকে শ্রদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায় নাকি? মেয়েরা কি পারে? কিংবা কেউ যদি বলে—ওই লোকটা মহৎ, আমিও জানি সে মহৎ—ওকে ভালোবাস—বলো, ভালোবাসা সম্ভব?
সুনন্দ চমকে উঠেছিল। বলল, কী বলছ, বুঝতে পারছিনে। তবে শুনেছি, শ্রদ্ধা থেকেই নাকি ভালোবাসা আসে।
মিথ্যে, মিথ্যে! রুবি ফুঁসে উঠল।…আমি তো জানি! যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি, তাকেই আমি ভালোবাসি। যাকে ভালোবাসিনে, তার ওপর ঘৃণা হয় না—তার আদিখ্যেতা দেখলে রাগ হয়। দুঃখ হয়। করুণা করতে ইচ্ছে করে।
সুনন্দ একটু ঝুঁকে বলল, রুবি—খুলে বলবে কথাটা?
দাদার কাছে শুনে নিয়ো।
তুমি বলবে না?
পারতুম। কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়বে। সইতে পারব না। খুব কষ্ট হবে, সুনুদা।
রুবি, এ সুযোগ হয়তো আর পাব না—একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে। বলবে?
কী?
তুমি কি নুরুর সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যাবে?
হয়তো।
সুনন্দকে চুপচাপ দেখে রুবি এদিকে মুখ ফেরাল। ফের বলল, তারপর?
এমনি জিগ্যেস করলুম।
খুব স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল মনে হচ্ছে!
কে জানে। সুনন্দ দেয়ালের দিকে তাকাল।…তুমি তো বললে, যে আমাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করো। হ্যাঁ—করা উচিত, রুবি। ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন যে দ্যাখে, সে সত্যি আহাম্মক। তাকে ঘৃণাই কোরো! যে নিঃসম্বল ভিখারি, তার ঘোড়ারোগ থাকা কি ভালো? তার মুখে থুথু ছিটানো উচিত।
তুমি এসো, সুনুদা। আমি একলা থাকতে চাই।
রুবি!
বলো।
আর তোমার সাথে আমার দেখা হবে না—হতে পারে না?
কেন?
আমার প্রশ্নটার জবাব দাও রুবি।
দাদাকে জিগ্যেস কোরো।
ও, আচ্ছা।…বলে সুনন্দ উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এল। বাইরে ঝুনুর সাথে নুরু তখনও কথা বলছে।
সুনন্দ নুরুর দিকে তাকিয়ে বলল, আসি নুরু। পরে দেখা হবে। আজ আছিস তো?
নুরু মাথা দোলাল।
সুনন্দ বাড়ি ফিরল না। বাজারের দিকে চলল। মন তেঁতো হয়ে গেছে এতক্ষণে। জীবনটা বিস্বাদ লাগছে। তাই ভাবল, কিছুক্ষণ রমেনের চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে আসা যাক।
আজ হাটবার। বড্ড ভিড়। যদিও বরাবর সকালবেলায় তরিতরকারি ইত্যাদির বাজার বসে প্রতিদিন—প্রাচীন কালের কুসুমগঞ্জের সেই সনাতন ব্যাপারটা এখনও চালু আছে। সপ্তায় দু’দিন হাটবার। ওই দু’টো দিন কেনাবেচা এবং ভিড়টা বেশি হয়—কারণ এলাকার সব গ্রামের লোকেরাই চলে আসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি চওড়া হাইওয়ের দু’পাশটা ভরে যায় হাটুরেদের জিনিসপত্রে। দু’ধারে স্থায়ী দোকানগুলো গমগম করে সারাক্ষণ। এই ভিড় কেনাবেচা হইচইয়ের একটা অদ্ভুত অর্কেস্ট্রা আছে। দুপুরবেলায় যখন সবচেয়ে জমজমাট আসর—মনে হয়, কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই—এক সংঘবদ্ধ সুশৃঙ্খল প্রাণবত্তা এখানে আত্মপ্রকাশ করেছে। হাটবার নামক পুরনো কঠিন একটা আধারে একটা সুব্যক্ত চঞ্চলতা—অথচ অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবির মতো—যা দেয়ালে স্থিরভাবে টাঙানো। দরজিদের সেলাইকলের শব্দ সমবেত মানুষের সরগরমের ওপর আশ্চর্য নিপুণ মূর্ছনার মতো লাগে। কখনও বেজে ওঠে ডুমুর গাছের নিচে মাদারির ডুগডুগি। বেজে ওঠে বেলুন ওয়ালার হাতে নাগিন বাঁশির সুর। ভিড় ভেদ করে চলে যায় দূরগামী বিশাল সব ট্রাক আর বাস—ভেঁপু বাজে বারবার। কে কাকে ডেকে ওঠে। ফের ঘরররররর খটখটখটখটখট চলে সেলাইকল। ধানভানা যন্ত্রে ভটভটভটভট একটানা আওয়াজ ওঠে। সাঁওতাল যুবতী ছায়ায় দাঁড়িয়ে ঝুরিভাজা খায়—তার একটি নির্জন স্থানে তাকিয়ে থাকে পানওলা নবীন বোরেগী। দূর গ্রামের মুসলিম বালিকা সালোয়ার ফ্রক পরে আইসক্রিম খায়—বেগুনওলা বাপ তার খদ্দের ফেলে তেড়ে ওঠে, দিলি জামাটা লষ্ট করে তো! হরিশবাবু চেঁচিয়ে ওঠেন, ওইটুকু মাগুর মাছের দর হাঁকছ পাঁচ টাকা? যতীনবাবু তাই কিনতে থাকলে সরে এসে মকবুল দরজিকে বলেন, দেখছ কাণ্ড? এই করে তো দর বাড়াচ্ছে! দাঁওমারা টাকা কি না!…সেই সময় বুকে মস্ত পোস্টার লাগিয়ে ঠেলতে ঠেলতে আসছে টকিঘরের বিজ্ঞাপন। কুমোরবউ ফিসফিস করে ছোট জাকে বলে, অ খেন্তি, এই পয়সাগুলো নুকিয়ে রাখ গে তো! শাশুড়ি তো হাতে তুলে দেবে না। হুঃ, কষ্টের পয়সা! ইটের দালান বানাবে সেও ভালো। বউ মানুষেরা একটু সাধ—আহ্লাদ করবে না!….শাশুড়ি হঠাৎ এসেই দেখে ফেলেছে।….আবার, আবার আঁটকুড়ে বেটি! লজ্জা নেই?….চিলশকুন উড়ছে ওখানটায়। তা উড়ুক। এটা সুর—হাটবারের একটা মোটা তার বাজছে। ফের সেলাইকল কেঁপে ওঠে উচ্ছ্বাসে। ঘরররররর….খটখটখটখট খট….সব মিলিয়ে কোনো ছন্দপতন নেই! কোনোটাই বেসুরে বাজে না। আজ সেই হাটবার।
রমেনের দোকানে বসে সুনন্দ এসব অনুভব করেছে দিনের পর দিন। হঠাৎ কোনোদিন তার মনে হয়েছে, দিনের সব বেচাকেনার শেষে হয়তো তারও কী একটা লাভ এসে যাবে। একটা কিছু ঘটবেই। এই প্রাণবত্তা আর চাঞ্চল্যের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে তার কোনো পাওনা।
কে জানে এমন মনে হয় কেন তার! হয়তো বা মানুষের ভিড় দেখেই সে প্রচ্ছন্নভাবে আশাবাদী হয়ে ওঠে। জীবনের প্রতি বিশ্বাস আর আনন্দ আর নির্ভরতা বেড়ে ওঠে হুঁ হুঁ করে। নির্জনতা তাকে যে বিষাদ দ্যায়, নির্লিপ্ততা তার মধ্যে যে হতাশা আনে—মানুষের ভিড় মুহূর্তে তা সব মিথ্যে করে তোলে। এই তো জীবন! এ শুধু ভিড় নয়—জীবনের খরস্রোত।
রমেনের দোকানে আসতেই দেখা হয়ে গেল রত্নেশ্বরের সঙ্গে। রত্নেশ তাকে দেখামাত্র ডাকছিল, দীপু, ওরে দীপু, দেখে যা—হিরো এসে গেছে।
দীপু কোত্থেকে এসে গেল তক্ষুনি। কেমন অস্বাভাবিক চেহারা তার। সুনন্দের হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল ভিতরে। সে দেখল, ভিতরে আরও ক’জন বসে আছে।
দীপু বলল, দ্যাখ সুনু, অনেকদিন থেকে তোকে কথাটা বলব—বলব ভাবছিলুম। বলিনি। কিন্তু আজ বলছি। শুধু বলছি নয়, তুমি কী করছ—তাও দেখছি।
সুনন্দ একটু বিস্মিত হল।…কী ব্যাপার রে?
রত্নেশ বলল, ভ্যানতারা ছাড় দীপু। সুনু, খালেকের পুত্রের এত স্পর্ধা কোত্থেকে হল রে যে আমাদের সঙ্গে মারামারি করতে আসে?
সুনন্দ চমকে উঠল।…তার মানে?
ন্যাকামি করছিস? ধিক তোকে! নিজে জাত দিয়ে বসে আছিস, আবার বোনেরও জাত দেওয়াচ্ছিস, ছোটলোক কোথাকার! …দীপু তেড়ে এল।
বাইরে দাঁড়িয়ে রক্ষাকর সেই সময় পান নিচ্ছে হাত বাড়িয়ে। মুখ ঘুরিয়ে দেখল সুনন্দকে। তারপর পিচ ফেলে বিকৃত মুখে এগিয়ে এল।….সুনন্দ না? হেমবাবুর ছেলে বটে তো?
সুনন্দ হাসবার চেষ্টা করল।
আবার হাসছ? লজ্জা করে না দাঁত বের করতে? তোমাদের জন্যেই আর কুসুমগঞ্জে আমাদের মান—সম্মান ধুলোয় লুটাচ্ছে—আর এখনও হাসছ? কলমা পড়িয়েছে খাঁসাহেব? জাতনাশা কুলাঙ্গার কোথাকার! শেষঅব্দি বোনটাকেও তুলে দিলে ওদের হাতে?
সুনন্দ বলে উঠল, এসব কী বলছেন আপনি!
দীপু গম্ভীর মুখে বলল, আমরা আকবরকে পিট্টি দিয়েছি। ফের দেব। আর আজ দুপুরের মধ্যেই রবিয়ুল কাজীর ব্যাটার মুড়োটা মাটিতে রগড়ে দেব। শুধু তোকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে। ব্যস!
সুনন্দ চেঁচিয়ে উঠল, না!
না? শালা জাতনাশা কায়েত!
খবরদার, জাত তুলে গাল দিবিনে দীপু! সুনন্দ উঠে দাঁড়াল।
রত্নেশ বলল, মাকালীর দিব্যি করে বল, গোমাংস খাসনি?
সুনন্দ কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বাইরে থেকে কে চাপা গলায় বলল, এই, খালেক চৌধুরী লোক নিয়ে আসছে—তোদের মারবে! ওর ছেলেকে মেরেছিস তোরা!
ওরা লাফিয়ে উঠল। সুনন্দর কান ভোঁ ভোঁ করছিল। তার চারদিকে কী ঘটছিল—কিচ্ছু বুঝতে পারল না সে। শুধু অনুভব করল—চারপাশে একটা ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে! বাইরের কোলাহলটা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। কে প্রচণ্ড চিৎকার করে বলছে, মার মার শালাদের! রমেন সুনন্দর হাত ধরে বলল, শিগগির বাড়ি চলে যাও সুনুবাবু। এখানে থেকো না।
সুনন্দ বাইরে এসে দেখল—হঠাৎ কী মন্ত্রবলে সমুদ্রভাগের মতো দু’দিকে ফুঁসছে দু’টো জনতা। তাহলে এতদিনের দেখা মিলটা সত্যি ছিল, না বিদ্বেষটা? কিচ্ছু বুঝে ওঠা যায় না। মিল যদি সত্যি ছিল, তাহলে হঠাৎ তুচ্ছ একটা ঘটনায় এ ভয়ঙ্কর বিদ্বেষ ফেটে বেরিয়ে এল কোত্থেকে? আর বিদ্বেষ যদি সত্যি হয়—চাপা থাকে গোপনে—তাহলে ওই মিলের মিথ্যাটা কেন গ্রহণ করছিল মানুষ? রাগে দুঃখে অসহায় সুনন্দর চোখ ফেটে জল এল। তার ইচ্ছে করল সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে—মানুষ, মানুষ, এ তুমি কী করছ?
ঈশ্বরের কুসুমগঞ্জে তখন কোনো মানুষ ছিল না।
সবার অলক্ষ্যে একটা বিষফোঁড়া বেড়ে উঠেছিল ক্রমশ—তাতে কোনো ভুল নেই। সেটা ফেটে গেল। ছড়িয়ে পড়ল পচা পুঁজরক্ত। ঈশ্বর লজ্জায় দুঃখে ঘৃণায় মুখ ঢাকলেন। আর দগ্ধ হল প্রকৃতি। কত প্রাচীন গাছগুলো—শিরীষ অশ্বত্থ বট—সেই ইলেকটিরি পরিশোভিত তেঁতুল গাছটাও পুড়ে গেল। দাউ দাউ জ্বলে উঠল শান্ত শুকনো ঘর বাড়িগুলো। বিস্ফোরণের শব্দে উচ্চকিত হয়ে দূর পালিয়ে যেতে থাকল পাখিরা। প্রকৃতি যন্ত্রণায় ছটফট করল। প্রকৃতি—যার মহান জঠর থেকে নাকি পরম অমৃত প্রাণের আবির্ভাব! এবং যে—প্রাণ বিশ্বজগৎকে ভয়ংকরতম উদ্দেশ্যহীনতা থেকে বাঁচিয়েছে। শূন্যতাকে ভরিয়ে দিয়েছে ইচ্ছাবাসনা আর কান্নাহাসিময় এক পরিপূর্ণতায়।
গোরস্থান থেকে দু’টি মানুষ—তখনও বিদ্বেষ তাঁদের নাগাল পায়নি—দৌড়ে বাড়ি চলে এলেন। দেখলেন আপন—আপন ছাই হয়ে ওঠা বাড়ি দু’টো এবং তক্ষুনি বিদ্বেষ তাঁদের ধরে ফেলল। আফজল চিৎকার করে বলে উঠলেন—শালা কাফের!
হেমনাথ গলা ফাটিয়ে ওদিক থেকে গর্জন করলেন—শালা নেড়ে!
দু’জনেই দু’টো ইট হাতে নিয়েছিলেন—কোনদিকে ছুঁড়তেন কে জানে—তাঁদের দুই ছেলে পরস্পরকে ধরে ফেলল। ওখানে সুনন্দ—কপালের পাশ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে তার—হেমনাথকে ধরে চেঁচিয়ে উঠল—বাবা, কী করছ!
নুরুও আহত—রক্ত ঝরছে মাথা থেকে—আফজলকে ধরে বলল, আপনি কি পাগল হয়েছেন?
ঝুনু তখনও রুবিদের বাড়ি ছিল। হঠাৎ আক্রমণের সময় দু’জনকেই উঠোনের পায়খানা ঘরে ঠেলে দিয়েছিল নুরু। এতক্ষণে ঝুনু দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। রুবি বেরোল।
পুলিশ এসে গেছে এতক্ষণে।
তারপর শান্তি। শান্তি কমিটি। রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিল বেরোবে বিকেলে। কেউ অবশ্য খুন হয়নি—আহত হয়েছে প্রচুর। কিন্তু ঘরবাড়ি জ্বলেছে আর বাজারের দিকে লুঠপাট হয়েছে বেশি।
কোনো বাড়িতে সেবেলার মতো রান্না চাপল না। আক্রান্তরা অভুক্ত রইল। আফজল রুবিকে সারাটি দিন কথা বলেননি। রুবিও বলেনি। সন্ধ্যায় নুরু কোত্থেকে কিছু মুড়ি নিয়ে এল। রুবি ছুঁল না। আফজল বললেন, তাহলে নুরু?
বলুন?
কী হবে?
কী আবার হবে? চলে যাব। আপনারাও সঙ্গে যাবেন।
পাসপোর্ট?
লাগবে না। বর্ডারে জানাশোনা আছে।…
ওবাড়ি হেমনাথ শুকনো চিড়ে চিবুতে চিবুতে বলছিলেন, ইয়ে সুনু—তোরা দাদার এখানে দিনকতক ঘুরে আয়। আমি একা থাকছি। ঘরটা মেরামত করতে হবে। তাছাড়া….
একটু ভেবে বললেন, ঝুনুকে ওখানেই রাখতে হবে। দাদার কাছেই থেকে পড়াশোনা করবে।
প্রভা কিছু বলল না। সে পোড়া ঘরের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছে। নক্ষত্র দেখছে। ঝুনু তার বুকে তেল মালিশ করছে। হার্টের অসুখটা হঠাৎ বেড়ে গেছে প্রভার।
হেমনাথ আবার বললেন, এখানটা ছেড়ে আর কোথায় যাব? সারা বিকেল তো ভাবলুম। সবখানেই এক রকম।….
তারপর রাত গভীর হয়েছে। খর হাওয়ায় পোড়া গাছে গাছে তখনও আগুন ঝিলিক দিচ্ছে। স্ফুলিঙ্গ উড়ছে। কুসুমগঞ্জ আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেছে।
ওরা তিনটি মানুষ চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ল। প্রায় নিঃসম্বল। ছাদবিহীন খড়ের ঘর। কোনোকিছু বাঁচানো যায়নি।
পরের স্টেশন অব্দি হেঁটে গিয়ে ট্রেন ধরবে রাত বারোটায়। রেললাইনের ডিসট্যান্ট সিগনালের কাছে পৌঁছে হঠাৎ আফজল বিড় বিড় করে উঠলেন—তোমরা সব মাফ দিয়ো ভাই সকল। তোমাদেরও মাফ দিলুম।
রুবি একবার ঘুরে দেখে নিল। কোনখানটায় তাদের বাড়িটা রয়ে গেল? ওই যেখানে শিরীষ গাছের মাথায় আগুনের স্ফুলিঙ্গ এতদূর থেকে দেখা যাচ্ছে? একজন দেখা করতে চেয়েছিল—হল না। কিছু কথা ছিল হয়তো। কী সে কথা? তার চোখ ফেটে জল এল।…ভীতু, কাপুরুষ, স্বার্থপর! আমি তোমাকে চিনি নে। তুমি বলে কেউ ছিল না কুসুমগঞ্জে।
রুবি যেন একটা মৃতদেহকে অসীম দুঃখে কিংবা ঘৃণায় মাড়িয়ে যেতে থাকল। আসলে ওই মৃতদেহটা বরাবর তার সামনে ছিল। সে লক্ষ্য করেনি এতদিন। সেই বেনামী চিঠি পড়ার দিনই তার ভালোবাসারূপী এক নবজাতকের জন্ম এবং অকুণ্ঠ আঙুলে তার গলা টিপে মৃত্যুও ঘটেছিল সঙ্গে সঙ্গে। এতদিন যা ছিল, তা শুধু তার স্মৃতিটুকু মাত্র। রুবি জানল। সামনে বিশাল নক্ষত্রময় আকাশ। প্রসারিত প্রান্তরে হাওয়া বইছে উদ্দাম। এক নিষিদ্ধ প্রান্তর থেকে পালিয়ে এসে এইসব হাওয়া আকাশ নক্ষত্র অন্ধকার মুক্তির মতন মনে হয়।…
এখানেই আমার কাহিনির শেষ।
প্রাজ্ঞ পাঠিকা, আপনি কি ক্ষুব্ধ হলেন? মনঃপূত হল না এই পরিণতি? আমি দুঃখিত। জীবনের বাস্তব কথাগুলো মেনে নেওয়াই উচিত। প্রেমিক প্রেমিকাদের মিলন হওয়া ভালো—তাদের সুখের ঘরকন্নায় আমাদের মনও সুখে ভরে ওঠে। কিন্তু তাহলে তো জীবনের প্রতি মিথ্যাচার করা হয়—অন্তত যে জীবনের কাহিনি আমি আপনাকে এইমাত্র শোনালাম। না—এই অ—মিলনের পিছনে কোনো হিন্দু—মুসলমান ব্যাপার নেই। আমার এক হিন্দু বন্ধু পরমেশ খাঁটি হিন্দু মেয়ে শুভ্রাকে ভালোবাসত। শুভ্রাও ভালোবাসত তাকে। কিন্তু পরে জানলাম, শুভ্রা বিয়ে করেছে কোনো কেন্দ্রীর সরকারের বড় অফিসারকে। আর পরমেশ—সে এক অধ্যাপকের মেয়েকে বিয়ে করে দিব্যি সুখে স্বচ্ছন্দে ঘরকন্না করছে। স্মৃতির কষ্ট? পাগল! স্মৃতি নিয়ে থাকলে তো এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকাই যায় না।
অবশ্য একটা উপসংহার আমি দিতে পারি।
কবীর এখন কানাডায় এঞ্জিনিয়ার। ঝর্ণা মফঃস্বলের এক স্কুলে দিদিমণি। সুনন্দর বরাতটা মন্দ। চাকরিবাকরি জোটাতে পারেনি এখনও। শুনে হাসবেন না—সে এখন এক রাজনৈতিক দলের মফঃস্বলি নেতা। পুরোদমে রাজনীতি নিয়ে আছে। সে পৃথিবীটা বদলে দিতে চায়।
আর রুবি?
আপনার যদি কোনোদিন করাচি যাবার দরকার হয় কলকাতা থেকে বোম্বে হয়ে করাচি—পাকিস্তান এয়ার লাইনসের কোনো প্লেনে হয়তো বা দীর্ঘাঙ্গী, ফরসা, অসম্ভব সুন্দর এবং ববছাঁট চুল কোনো এয়ার হোস্টেস আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। হ্যাঁ—সেই মিস রুবি খান। কিন্তু তাকে আপনার করুণা করা ভালো।
ওদের মনে সেই নিষিদ্ধ প্রান্তরে ছোটাছুটির স্মৃতি এখনও কতখানি টিকে আছে আমি জানিনে। তবে—হয়তো বা—স্মৃতি দুর্মর। আমি না টের পেলেও সে হয়তো থাকে। সে হয়তো আছে। কিন্তু তাতে তো কিছু আসে যায় না!
__