১২. আবিদ খান দেখা করতে এলেন

আবিদ খান দেখা করতে এলেন দুদিন পরে সন্ধেবেলা। বেশ হৃষ্টপুষ্ট মানুষ। মস্ত বড় গোঁফ, মাথার চুল সব সাদা। পাজামা আর ঘি রঙের পাঞ্জাবি পরা।

কাকাবাবুকে আদাব জানিয়ে বললেন, রায়চৌধুরীসাব, আপনার সঙ্গে আমার আগে পরিচয় হয়নি বটে, কিন্তু আপনার বুদ্ধিতেই যে ভীমবেটকায় অনেক ক্রিমিনাল ধরা পড়েছিল, তা আমি জানি। আপনি যে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছেন, তাতেই আমি খুব আনন্দিত হয়েছি।

কাকাবাবু তাঁর হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে বললেন, খানসাব, আমার পক্ষে হোটেল থেকে বেরোনোর একটু অসুবিধে আছে। আপনি নিজেই যে এসেছেন, তাতে আমি ধন্য হয়েছি।

আবিদ খান বললেন, না, না, আমি তো শুনেছি, আপনার তবিয়ত ভাল নেই। আমি আসব না কেন? অনেকদিন জেলখানার মধ্যে ছিলাম। এখন রোজ বাইরে ঘুরে বেড়াই, গান-বাজনা শুনতে যাই। আর কোনও কাজ নেই।

কাকাবাবু বললেন, জেলখানার মধ্যে কতরকম ঘটনা ঘটে। আপনার নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। একটা বই লিখে ফেলুন না!

আবিদ খান হেসে বললেন, লেখার ক্ষমতা থাকলে লিখতাম। সকলের কি আর সে ক্ষমতা থাকে? আপনি কী জানতে চান, হুকুম করুন।

কাকাবাবু বললেন, ভীমবেটকায় যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের একজনের নাম সুরজকান্ত। কিন্তু পুলিশ-রিপোর্টে তার নাম নেই। তাতে আছে রামকুমার পাধির নাম। তাই না?

আবিদ খান বললেন, রামকুমার পাধির নাম ছিল। কিন্তু সে আসলে ধরা পড়েনি। পুলিশ ভুল করে অন্য একজন রামকুমার পাধিকে ধরেছিল।

কাকাবাবু বললেন, সেই অন্যজনই সুরজকান্ত।

আবিদ খান বললেন, না তো। পরে জানা গিয়েছে, তার নাম ছিল ছোটেলাল। অন্য আসামিরাই তাকে চিনিয়ে দিয়েছে। সে ছিল একজন স্মাগলার। একটা ডাকাতির কেস ছিল তার নামে।

কাকাবাবু বললেন, ছোটেলাল আর সুরজকান্ত, একই লোকের দুই নাম। কিন্তু পুলিশের কেসে তার নাম তো বদলানো হয়নি। রামকুমার পাধিই ছিল।

আবিদ খান বললেন, আসল ব্যাপার কী জানেন, যে-পুলিশ অফিসার তাকে আইডেন্টিফাই করেছিল, তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ওই লোকটাই রামকুমার পাধি। একটা ফোটো এনে দেখিয়েছিল, রামকুমার পাধির সঙ্গে ছোটেলালের চেহারারও কিছুটা মিল আছে। সুতরাং পুলিশের সন্দেহ হয়নি।

কাকাবাবু বললেন, ওই সুরজকান্ত কিংবা ছোটেলাল নামে লোকটা কেমন ছিল, আপনার মনে আছে?

আবিদ খান বললেন, জি, মনে আছে। বেশি বছর আগের তো কথা নয়। লোকটা এমনিতে চুপচাপ থাকত। তবে খুব বদরাগী আর গোঁয়ার। হঠাৎ হঠাৎ রেগে উঠত। একদিন একজন ওয়ার্ডারের নাকে হঠাৎ ঘুসি মেরে রক্ত বের করে দিয়েছিল। আর-একদিন অন্য একজন আসামির সঙ্গে মারামারি করেছিল। অথচ তাকে দেখলে বোঝা যাবে না। মনে হত, ভাল বংশের ছেলে। অনেক ভাল বাড়ির ছেলে বখাটে হয়ে যায়, এ ছিল সেই ধরনের।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সুলতান আহমেদ কে ছিল?

আবিদ খান বললেন, সুলতান? সে ছিল ডেপুটি জেলর।

সে সুরজকান্তকে জেরা করার সময় খুব মারধর করত?

না, না। আসামিদের জেরা করার জন্য তো সি আই ডি অফিসে নিয়ে যাওয়া হত। জেলের মধ্যে তো জেরা হয় না। জেলে আসামিরা কখনও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে, তা সামলানোর ভার ছিল সুলতান আহমেদের উপর।

সুরজকান্ত কি আত্মহত্যা করেছিল? প্লিজ, সত্যি কথাটা বলবেন?

না, আত্মহত্যা করেনি।

কিন্তু পুলিশ-রিপোর্টে আত্মহত্যার কথাই আছে।

আত্মহত্যার মতোই দেখিয়েছিল। একদিন সকালবেলা দেখা গেল, সে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে। রিপোর্টেও তাই আছে।

অথচ আপনি বলছেন, সে আত্মহত্যা করেনি। তা হলে কেউ তাকে মেরে ফেলেছিল। সুলতান আহমেদ নয়? না হলে, পরে সুলতান আহমেদের জেল হল কেন?

রায়চৌধুরীসাব, সুলতান আহমেদের জেল হয়েছে, তার কারণ, সে কয়েদিদের খাবারের বরাদ্দ থেকে রেগুলার টাকা চুরি করত। আমিই তাকে ধরিয়ে দিয়েছি।

শুধু টাকা চুরির জন্য দশ বছরের জেল হয়?

লোকটা মারকুটেও ছিল। একটু গন্ডগোল দেখলেই কয়েদিদের ধরে ধরে পেটাত। একটা উনিশ বছরের ছেলে তার মার খেয়ে হঠাৎ মারা যায়। সেই অপরাধেই তার লম্বা জেল হয়। কিন্তু সে সুরজকান্তকে মারেনি। এটা আমি ভাল করেই জানি।

আপনি ভাল করেই জানেন? তার মানে কি আপনিই সুরজকান্তকে মেরে ফেলেছিলেন?

একগাল হেসে আবিদ খান বললেন, আমি যদি মারতাম, তা হলে আজ আপনার সামনে তা স্বীকার করতেও আমার অসুবিধে ছিল না। অত পুরনো ঘটনার জন্য তো এখন আমার শাস্তি হবে না। আমি কখনও মারধর করিনি। জীবনে কোনওদিন কাউকে একটা থাপ্পড়ও মারিনি। ওসব নোংরা কাজ করত আমার নীচের অফিসাররা। সুরজকান্তকে মারে অন্য আসামিরা।

কাকাবাবুর বললেন, জেলের মধ্যে অন্য আসামিরা একজনকে মেরে ফেলল! এটা কী করে সম্ভব?

আবিদ খান বললেন, আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সব আসামিই তো আলাদা আলাদা খুপরিতে থাকে না। কিছু কিছু আসামিকে বড় একটা হলঘরে রাখা হয়। সেখানে একসঙ্গে দশ-বারোজন থাকে। ভীমবেটকার আসামিরা সকলে এইরকম একটা ঘরে ছিল। আপনি তো জানেনই, ওই দশ জন আসলে এক দলের নয়, আলাদা আলাদা দলের। ওদের মধ্যে প্রায়ই মারামারি হত। একদিন রাতে ওরা দু-তিনজনে ঘুমের মধ্যে সুরজকান্তের গলা টিপে মেরে ফেলে। তারপর ওরই জামাটা গলায় বেঁধে লোহার গরাদে ঝুলিয়ে দেয়। রাতে গার্ডরা কিছু টের পায়নি, সকালে দেখা গেল ওই অবস্থা।

আপনারা বুঝেছিলেন, ওটা আত্মহত্যার কেস নয়?

আমাকে সকালবেলাতেই কোয়ার্টার থেকে ডেকে এনেছিল। দেখলেই বোঝা যায়, ওভাবে আত্মহত্যা করা যায় না। গলায় আঙুলের দাগ। কোনও মানুষই নিজের গলা টিপে মারতে পারে না।

রিপোর্টে সেকথা লেখেননি কেন?

তা হলে অনেক ঝামেলা হত। এনকোয়ারি হত আমাদের নামে। গাফিলতির অভিযোগ উঠত। আসামিদের ঠিক কে কে সুরজকান্তকে মেরেছে, কী জন্য মেরেছে, তা জানার কোনও উপায় ছিল না। কেউ কিছু স্বীকার করেনি। আমরা কিছুই প্রমাণ করতে পারতাম না। তাই আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়াই সহজ ছিল।

পুলিশের মারে কোনও কোনও আসামির মরে যাওয়ার মতো ঘটনাও তো ঘটে?

কখনও কখনও ঘটে, আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সুরকান্তের মৃত্যু সেভাবে হয়নি। তা আমি হলফ করে বলতে পারি।

অর্থাৎ সুরজকান্ত বা ছোটেলাল নিজেও ছিল একজন ক্রিমিনাল। অন্য ক্রিমিনালদের মধ্যে দু-একজন তাকে খুন করেছে। কারা খুন করেছে তা জানা যায়নি। আপনারাও রিপোর্টে তা চেপে গিয়েছেন।

ঠিক তাই!

কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ। আমার এটুকুই শুধু জানার দরকার ছিল। আবিদ খানসাহেব, আমি কথা দিচ্ছি, এতদিন পর এসব নিয়ে আমি খবরের কাগজটাগজে কিছু জানাব না। আমি জানতে চেয়েছি ব্যক্তিগত কারণে।

আবিদ খানসাহেব বললেন, ক্রিমিনালদের মধ্যে এরকম প্রায়ই ঘটে। দেশের মধ্যে হোক, বাইরে হোক, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে দু-একজন মরে।

কাকাবাবু বললেন, অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। আসুন, এবার চা খাওয়া যাক। আজ কোথায় গান শুনতে যাচ্ছেন?

 

আবিদ খান চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তাঁর ব্যাগটা নিয়ে গিয়েছে কর্নেলের লোকেরা। ফেলে দিয়েছে নদীতে। তাতে তাঁর জামাকাপড়, কিছু কাগজপত্র আর বই ছিল। টাকাপয়সা অবশ্য ছিল না। আজকাল ক্রেডিট কার্ডের যুগ। হোটেলের নীচেই অনেক দোকান আছে। সেখানকার একটা দোকান থেকে কাকাবাবু দুসেট জামাপ্যান্ট আর একটা স্লিপিং সুট কিনে এনেছেন। কাগজ-কলম কিছুই নেই সঙ্গে। তবে এইরকম বড় হোটেলের ড্রয়ারে কিছু লেখার কাগজ আর সস্তার কলম রাখা থাকে। কাকাবাবু সেই একটা কাগজ নিয়ে লিখতে লাগলেন।

বিমলাপ্রসাদ খুনের অভিযোগে পাঁচ বছর জেল খেটেছে।

তার দুই ছেলে জগমোহন আর সুরজকান্ত।

জগমোহন আর্মি অফিসার হয়। সেখানে তার সুনাম ছিল। তবে স্বভাবে কিছুটা বদরাগী।

সুরজকান্ত প্রথমে বিশেষ কিছু করত না, শখের ইতিহাসের গবেষক সেজে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত। পরে বদলোকদের পাল্লায় পড়ে সে স্মাগলার ও ডাকাতদের দলে যোগ দেয়।

ভীমবেটকায় সে গুহার ছবি তোলাও যায়নি সে রাতে। সে অন্য ক্রিমিনালদের মতো গুপ্তধনের লোভেই গিয়েছিল। রামকুমার পাধির নামে ভুল করে ধরা হলেও, সেও একজন ক্রিমিনালই ছিল।

জগমোহন সম্ভবত তার এই ভাইয়ের পরিবর্তনের কথা কিছুই জানত না। সে ভেবেছিল যে, তার ছোট ভাইটি সরল, ভালমানুষ।

সে তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চায়। রক্তের বদলে রক্ত।

তার ভাইকে খুন করেছে জেলের মধ্যে অন্য অপরাধীরা। সেসব ঠিকঠাক জেনে সে প্রতিশোধ নিতে চায় রাজা রায়চৌধুরীকে খুন করে।

অদ্ভুত না?

যদি বা সে রাজা রায়চৌধুরীকে কোনওক্রমে খুন করতেও পারে, তারপর যে তাকে পুলিশে ধরবে, তার ফাঁসিও হতে পারে, সে কথা সে ভাবছে না?

জঙ্গলের মধ্যে রাজা রায়চৌধুরীর গুলিতে সে নিশ্চিত আহত হয়েছে। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে পালিয়েছে।

এরপর সে কী করবে?

সামনাসামনি লড়াই করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এখন সে তা ভুলে গিয়ে দলবল জুটিয়ে রাজা রায়চৌধুরীর উপর আক্রমণ চালাতে চাইবে? সেটা

খুবই সম্ভব। দেখা যাক, কী হয়!

লিখতে লিখতে কাকাবাবুর ঘুম এসে গেল।

 

পরদিন তিনি ঠিক করলেন, কলকাতায় ফিরে যাবেন। এখানে তিনি যা জানতে এসেছিলেন, তা জানা হয়ে গিয়েছে। এখন আর এখানে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। কিন্তু কাকাবাবু সবসময় বিপদের ঝুঁকি নিতে ভালবাসেন। অসীম তাঁর আত্মবিশ্বাস। তার ধারণা হয়ে গিয়েছে, নিজের বাড়ির বিছানায় শুয়ে কোনও অসুখে ভুগে তাঁর মৃত্যু হবে না। একদিন না-একদিন তিনি কোনও পাহাড়ে বা জঙ্গলেই মরবেন। সেটাই তিনি চান।

এত দূর এসে আর-একবার ভীমবেটকা দেখে যাবেন না? একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি চলে এলেন সেখানে। বিকেলবেলা। গাড়িটাকে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। চতুর্দিকে ছোট ছোট পাহাড়। এর মধ্যে কোথায় কোথায় যে গুহাগুলো রয়েছে, তা বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। অনেকদিন পর এসে কাকাবাবু দেখলেন, ঢোকার জায়গাটার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। সামনে একটা গেট, কিছুটা অংশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাহারাদারও রয়েছে দুজন। রোজই কিছু লোক দেখতে আসে জায়গাটা। আজও রয়েছে কয়েকটা গাড়ি। কেউ কেউ খাবারদাবার নিয়ে এসে এখানে পিকনিক করে। ছটা বেজে গেলেই সকলকে বের করে দেওয়া হবে, সেকথা লেখা আছে একটা বোর্ডে।

কাকাবাবু সোজা চলে এলেন সাধুবাবার আখড়ায়। সবচেয়ে ভাল গুহাটি দখল করে আছেন সাধুবাবা। আগে এখানে কোনও মূর্তিটুর্তি ছিল না। এখন চার হাতওয়ালা একটা পিতলের লম্বা মূর্তি বসানো হয়েছে। সেটা কোন দেবতার মূর্তি, তা ঠিক বোঝা গেল না। সাত-আটজন নারী-পুরুষ ভক্তের সঙ্গে কথা বলছেন সাধুবাবা। শুধু একটা গেরুয়া লুঙ্গি পরা। খালি গা। মুখভরতি দাড়ি-গোঁফ, মাথার চুলে জটা। বেশ সাধু-সাধুই চেহারা।

কাকাবাবুকে দেখেই তিনি অন্যদের সঙ্গে কথা থামিয়ে বললেন, আরে, রাজাজি, আপ কব আয়া?

কাকাবাবু বললেন, দু-তিন দিন আগে। আপনি কথাবার্তা সেরে নিন। আমি অপেক্ষা করছি।

সাধুবাবা বললেন, বৈঠিয়ে, বৈঠিয়ে।

কাকাবাবু একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসলেন এক পাশে। ছবছর আগের সেই রাতে যে দশ জন ধরা পড়েছিল, তাদের মধ্যে একজন সাধুও ছিল। তবে সে সাধু ইনি নন। ইনি তখন তীর্থ করতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতে। একজন চেলার উপর ভর দিয়ে গিয়েছিলেন এই আখড়া দেখাশোনার। সেই চেলাটিরও গুপ্তধন পাওয়ার লোভ হয়েছিল। সাধু হলেও অনেকের লোভ যায় না। সেই চেলাটির জেল হয়েছিল মাত্র তিন বছর। ছাড়া পাওয়ার পর সে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে।

এই সাধুবাবার অবশ্য কোনও দোষ বা লোভের কথা জানা যায় না। সন্ধে হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে বিদায় নিল সকলে! এখান থেকে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। পশ্চিম আকাশে অস্ত সূর্যের লাল রেখা। সেদিকে বেশ মেঘ জমেছে। কাকাবাবু ঠিক করেই এসেছেন। আজ আর ফিরবেন না, রাতটা এখানেই কাটাবেন। এই জায়গাতেই কাকাবাবু এক রাতে দশ জন ক্রিমিনালকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিল কর্নেলের ভাই সুরজকান্ত। কর্নেল যদি প্রতিশোধ নিতে চায়, এটাই তো সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। সে-রাতে কাকাবাবু পুলিশকে খবর দিয়ে রেখেছিলেন। আজ তিনি পুলিশের কোনও সাহায্য চাননি। সুদর্শনও কিছু জানেন না।

অন্য লোকজন সব বিদায় নেওয়ার পর সাধুবাবা জিজ্ঞেস করলেন, বলিয়ে রায়চৌধুরীসাব, কেয়া খবর?

কাকাবাবু বললেন, সাধুজি, আপনি রাতে কী খান?

সাধুবাবা বললেন, দো-তিন রোটি, থোড়া ডাল, অউর এক চামচ মধু। দিনের বেলা ফল ছাড়া কিছু খাই না।

কাকাবাবু বললেন, মধু? সাধুবাবা বললেন, এক চেলা মধু দিয়েছে। শিষ্যরাই সবকিছু দেয়।

কাকাবাবু বললেন, আজ আর দুখানা রুটি বেশি বানাবেন? আপনার সঙ্গে খাব। রাতে এখানেই থাকব। একটা এক্সট্রা খাটিয়া আছে নিশ্চয়ই।

সাধুবাবা বললেন, আপনি আমার মেহমান। আপনি আমার সঙ্গে অন্ন ভাগ করবেন, এতে আমার পুণ্য হবে। কিন্তু রাজাজি, একটা কথা আছে। বাইরের মানুষরা চলে গেলে আমি পূজায় বসি। ধ্যান করি। তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়। তারপর রুটি পাকাই। আপনি কি অতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাতে কোনও অসুবিধে নেই। আমিও বেশি রাতে খাই। আচ্ছা সাধুজি, এখানে কি এখনও রাতে কেউ আসে?

সাধুবাবা বললেন, মাঝে মাঝে আসে। আওয়াজ শুনতে পাই। তবে কাউকে দেখতে পাই না।

কাকাবাবু বললেন, এখানে তো সারা রাত দুজন গার্ডের পাহারা দেওয়ার কথা।

সাধুবাবা বললেন, কথা তো আছে। কিন্তু কাজ নেই। গার্ড দুজন একটু রাত হলেই ভেগে যায়। পাহাড়ের নীচের গাঁওয়ে গিয়ে আরামসে শুয়ে থাকে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে কি এখনও গুপ্তধনের লোভে কেউ কেউ আসে? এখানে গুপ্তধন কিছু নেই, আমি জানি। তবু গুপ্তধনের কথা একবার রটে গেলে লোকের মনে সেটা গেঁথে যায়। যাই হোক, যারা আসে, তারা আপনাকে বিরক্ত করে না তো?

সাধুবাবা বললেন, নাঃ! শুধু এক রাতে আমি খাটিয়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছি, একসময় মনে হল, কেউ আমার খাটিয়াটা ঠেলছে। ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, কী একটা জানোয়ার দৌড়ে পালাল। মনে হল, জংলি শুয়োর।

কাকাবাবু বললেন, এখানে শুয়োর আছে নাকি?

সাধুবাবা বললেন, আছে। সেই থেকে আমি ধুনি জ্বালিয়ে রেখে তার পাশে শুই। আগুন দেখলে কোনও জানোয়ার কাছে আসে না।

একটু পরে সাধুজি পুজোয় বসলেন।

কাকাবাবু হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলেন সামনের খোলা জায়গাটার দিকে। সাধুবাবা ঠিকই বলেছেন, পাহারাদার দুজনই নেই। তারা হাওয়া হয়ে গিয়েছে। লোহার গেটটা তালাবন্ধ। তবে সেই গেট টপকে আসা খুবই সহজ। কর্নেল আর লায়লা কি এখানে কোথাও লুকিয়ে আছে! ওরা কি হোটেলটার উপর নজর রাখেনি? তার ট্যাক্সিটা অনুসরণ করলেই এখানে পৌঁছে যেতে পারে। দিনেরবেলা দেখা জায়গাগুলোই রাতে রহস্যময় মনে হয়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সত্যিই যেন কেউ লুকিয়ে আছে।

কাকাবাবু ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, এসো, কর্নেল! এসো ধ্যানচাঁদ ওরফে জগমোহন, আমাকে মারতে চাও তো এসো, লড়ে যাও! রাজা রায়চৌধুরীকে এ পর্যন্ত অনেকেই মারতে চেয়েছে, তুমি পারো কিনা দেখি! তোমার সঙ্গে লড়াইয়ে যদি হেরে যাই, তবে মরব। তার জন্য আমি রেডি। আর আমায় যদি মারতে না পারে, তা হলেও তোমাকে আমি ছাড়ব না। সন্তুকে তুমি প্রায় মেরে ফেলেছিলে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে!

কোথাও একটু খসখস শব্দ হলেই কাকাবাবু চট করে সেদিকে ফিরে। তাকাচ্ছিলেন।

আজ বোধহয় পূর্ণিমা, এর মধ্যেই আস্ত একখানা চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে আকাশে। গরম কমে গিয়ে স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা তারা। কী সুন্দর এই সময়টা। চতুর্দিক একেবারে শান্ত।

পিছন দিকে একটা খসখস শব্দ হলেও কাকাবাবু আর ফিরলেন না সেদিকে। না, তিনি আর মৃত্যুর কথা ভাববেন না। এমন শান্ত, সুন্দর জায়গায় খুনোখুনি কিংবা মৃত্যুর কথা চিন্তা করার কোনও মানে হয় না। বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে আনন্দের। মানুষ কেন নিজে বেঁচে থেকে অন্যদেরও বাঁচতে দেয় না!