০৮. পুলিশ মহলে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে

পুলিশ মহলে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, যেমন ভাবেই হোক, কাকাবাবু আর তার বন্ধুকে উদ্ধার করতেই হবে। কিন্তু ওঁদের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তাও দেখতে হবে।

কলকাতা থেকে অনেক বড় বড় পুলিশ অফিসার এসে গেছেন। ঘন ঘন মিটিং বসছে। জঙ্গলের মধ্যে শঙ্কর রায়বর্মনের ডেরা খুঁজে বার করা হয়তো খুব শক্ত নয়। কিন্তু লোকটা দারুণ নিষ্ঠুর। কাছাকাছি পুলিশ এলেই বন্দিদের হাত-পা কেটে ফেলার ভয় দেখায়। এর আগে সত্যিই একজন সরকারি অফিসারের ডান হাত কেটে পাঠিয়েছিল।

তা ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় শঙ্কর রায়বর্মনের স্পাই আছে। পুলিশ কখন কোন দিকে যাচ্ছে, তা আগে থেকেই তারা শঙ্কর রায়বর্মনকে জানিয়ে দেয়। পুলিশের মধ্যেও তাদের স্পাই থাকতে পারে। গ্রামের লোকেরা ভয়ে শঙ্কর রায়বর্মন সম্পর্কে কোনও কথাই বলতে চায় না।

হলং থেকে আমজাদ আলিকে ডেকে আনা হয়েছে।

শঙ্কর রায়বর্মনকে যে ঠিক কীরকম দেখতে, তা অনেকেই জানে না। সে নাকি নানারকম ছদ্মবেশে থাকে। কখনও সে পুলিশের মতন, কখনও ডিমওয়ালা, কখনও থুথুরে বুড়ো। এরকম ছদ্মবেশে সে মাঝে-মাঝে জঙ্গল ছেড়ে জলপাইগুঁড়ি, শিলিগুঁড়ি শহরেও আসে।

আমজাদ আলি তাকে দুবার দেখেছেন। ঠিক মুখোমুখি নয়, খানিকটা দূর থেকে। আমজাদ আলি হয়তো শঙ্কর রায়বর্মনকে চিনতে পারবেন।

সন্তুর কাছ থেকেও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জানা গেছে। শঙ্কর রায়বর্মন আর তার সঙ্গীদের কাছে দুটো এ কে ফরটি সেভেনের মতন সাঙ্ঘাতিক অস্ত্র আছে বটে, কিন্তু তার গুলি নেই। ও দুটো দিয়ে লোকদের ভয় দেখায়। ওদের আছে শুধু কয়েকটা রিভলভার আর কয়েকটা তলোয়ার, এই দিয়েই এত কাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং একবার ওদের ঘিরে ফেলতে পারলে কাবু করে ফেলা যাবে সহজেই।

কিন্তু তার আগে নিশ্চিত হতে হবে, যাতে কাকাবাবু ও গৌতম হালদারের কোনও ক্ষতি না হয়।

কলকাতা থেকে অতনু সরকার নামে যে ডি আই জি এসেছেন, তিনি বললেন, ওই লোকটা কাকাবাবুর হাত-পা কেটে ফেলবে। তা আমি বিশ্বাস করি না। এ পর্যন্ত কেউ পারেনি। কাকাবাবু ঠিক যেভাবেই হোক ওর চোখে ধুলো দেবেন।

রণবীর গুপ্ত বললেন, এ পর্যন্ত কেউ পারেনি বলে যে এবারেও পারবে না, তার কি কোনও মানে আছে? এই ঝুঁকি নেওয়া যায় না।

এস পি সাহেব জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, কাকাবাবু এই ধরনের অপরাধী অনেক দেখেছেন। কিন্তু ওঁর বন্ধুর তো এসব অভিজ্ঞতা নেই। তা ছাড়া উনি আমেরিকার নাগরিক। ওঁর কোনও ক্ষতি হলে আমাদের দেশেরই দারুণ বদনাম হয়ে যাবে!

রণবীর গুপ্ত বললেন, গৌতমবাবুর স্ত্রী টাকা দিতে রাজি আছেন। কুড়ি-পঁচিশ লাখ উনি এদেশ থেকেই জোগাড় করতে পারবেন। একটু দরাদরি করলে পঞ্চাশ লাখ থেকে কমিয়ে বোধ হয় কুড়ি-পঁচিশ লাখে রাজি করানো যেতে পারে শঙ্কর রায়বর্মনকে।

অতনু সরকার বললেন, আমরা সরকারি লোক হয়ে তো টাকা দেওয়ার ব্যাপারটায় অংশ নিতে পারি না। আমাদের কিছু না-জানার ভান করতে হবে।

রণবীর গুপ্ত বললেন, একবার টাকা পেলে শঙ্কর রায়বর্মন কিছুতেই কাকাবাবুকে এমনি এমনি ছাড়বে না। কাকাবাবুর টাকা কে দেবে?

অতনু সরকার জিজ্ঞেস করলেন, একজন চাবাগানের ম্যানেজারকেও তো ধরে রেখেছে। রায় বর্মনের কাছ থেকে চিঠিপত্র নিয়ে আসে কে?

জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, একজন লোককে পাঠায়। সে বোবা আর কালা। তার কাছ থেকে তো কোনও কথাই জানার উপায় নেই। তাকে অনুসরণ করেও কোনও লাভ হয় না। সে নিউ জলপাইগুঁড়ি রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকে। অত যাত্রীদের মধ্যে কে যে কখন ওর কাছে চিঠি দিয়ে যায়, তা বোঝা যায় না।

অতনু সরকার বললেন, ওই বোবা কালা লোকটাকে একবার দেখলে হয়। অনেক বোবা কালা কিন্তু আসলে কথা বলতে পারে, একটু হুড়কো দিলেই মুখ ছুটবে।

জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, লোকটাকে ধরে আনা যায়, কিন্তু…

রণবীর গুপ্ত বললেন, শঙ্কর রায়বর্মনের প্রত্যেক চিঠিতে লেখা থাকে, আমার দূতের ওপর যদি কোনও অত্যাচার করা হয়, তা হলে আমি সঙ্গে সঙ্গে বদলা নেব। বন্দিদের একজনের হাত কিংবা পা কেটে পাঠাব। একবার যে সত্যি একটা হাত কেটে পাঠিয়েছিল। লোকটা ঠিক খবর পেয়ে যায়।

জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, লোকটা লেখাপড়া জানে। ইংরিজিতে চিঠি লেখে, ভাল ইংরিজি।

অতনু সরকার বললেন, লেখাপড়া-জানা ডাকাত!

জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, ও তো নিজেকে বলে রাজা। কিং অব তরাই!

অতনু সরকার বললেন, হুঁ, রাজা না গজা। ওকে যেদিন ধরব, সেদিন কড়াইতে গরম তেলে ভাজব! এখন এক কাজ করুন, সরাসরি পুলিশ অ্যাকশান শুরু না করে আট-দশজন ইনফরমার ছড়িয়ে দিন চতুর্দিকে। তারা ওর গতিবিধির সন্ধান জানুক। ও তো মাঝে-মাঝে শহরে আসে বললেন, সেই অবস্থায় ওকে ধরতে হবে। এর মধ্যে টাকা নিয়ে দরাদরি শুরু করুন, তাতে ও ভাববে ভয় পেয়ে আমরা ওকে টাকা দিতেই চাই। ফরেস্ট অফিসার আমজাদ আলিকেও কাজে লাগান। সে-ই তো লোকটার আসল চেহারাটা চেনে। আর একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছি। ওই যে কাকাবাবুর ভাইপো সন্তু, ওকে চোখে চোখে রাখবেন। ও যে কখন দারুণ দুঃসাহস দেখিয়ে কী কাণ্ড করে বসবে, তার ঠিক নেই।

সন্তু আর জোজো তখন সার্কিট হাউজের দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করছে আমজাদ আলির সঙ্গে।

আমজাদ আলির মতন সন্তুও তো দেখেছে শঙ্কর রায়বর্মনকে। কিন্তু দুজনের বর্ণনা মিলছে না।

শঙ্কর রায়বর্মন পুলিশের ছদ্মবেশে কাকাবাবুদের ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল। উঁদরেল পুলিশ অফিসারের মতন তার মুখে মস্ত বড় গোঁফ।

আমজাদ আলি বললেন, আমি যখন ওকে দেখেছি, তখন ওর কোনওরকম গোঁফই ছিল না।

সন্তু বলল, থুতনির কাছে একটা কাটা দাগ।

আমজাদ আলি বললেন, আমি থুতনিতে কাটা দাগ দেখিনি, ঠোঁটে ছিল শ্বেতির মতন সাদা সাদা দাগ, আর নাকের ওপর আঁচিল।

সন্তু বলল, একবার মাথার টুপি খুলেছিল। মাঝখানে গোল টাক।

আমজাদ আলি বললেন, আমি দেখেছি, কপালের দিকে একটুখানি টাক, কিন্তু মাঝখানে তো অনেক চুল ছিল।

জোজো বলল, যেমন টাকের ওপর পরচুলা পরে অনেকে, তোমনই টাকওয়ালা পরচুলাও কিনতে পাওয়া যায়। থিয়েটারের লোকেরা পরে। আসল কথা হল নাক। বেশ খাড়া নাক নয়, বোঁচা নাক। নাক দিয়েই তোক চেনা যায়।

সন্তু বলল, খাড়া, টিকলো নাক।

আমজাদ আলি বললেন, আমি তো দেখেছি, খাড়াও নয়, বোঁচাও নয়, মাঝারি।

জোজো বলল, এই মাঝারি নাক নিয়েই খুব মুশকিল। মেক আপ দিয়ে মাঝারি নাককে টিকলো করা যায়, আবার বোঁচা বোঁচাও দেখানো যায়। কিন্তু সত্যিকারের টিকলো নাককে বোঁচা করা যায় না। ভুরু কীরকম?

সন্তু বলল, প্রায় যেন জোড়া। আমজাদ আলি বললেন, আমি তো দেখেছি ফাঁক ফাক। আমাদেরই মতন।

জোজো বলল, সাদা কিংবা কালো রং দিয়ে দুরকমই করা যায়। আমজাদ আলি বললেন, সন্তু, তোমাদের কাছে শঙ্কর রায়বর্মন এসেছিল। পুলিশের ছদ্মবেশে। তখন নিশ্চয়ই গোঁফ লাগিয়ে নানারকম মেক আপ নিয়ে এসেছিল। আমি জঙ্গলের মধ্যে যখন দেখেছি, তখন ওর ছদ্মবেশ ধরার কথা নয়। সেটাই ওর আসল চেহারা।

জোজো বলল, তার কোনও মানে নেই। সবসময়েই ও অনেকরকম ছদ্মবেশে ঘোরাঘুরি করতে পারে। যাতে ওর নিজের লোকও ওর আসল চেহারাটা জানতে পারবে না। কেউ ওকে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দিতে পারবে না।

আমজাদ আলি বললেন, তাও হয়তো ঠিক। আমার ধারণা, লোকটা সবসময় জঙ্গলে থাকে না। মাঝে-মাঝে সাধারণ লোকের মতন শহরে এসে থাকে। হয়তো শহরে ওর বাড়িও আছে। আমার একটা সন্দেহ হয়, সে-কথা কাউকে বলিনি, কারণ সেটা ভুলও হতে পারে।

সন্তু বলল, আমাদের বলুন!

আমজাদ আলি বললেন, জলপাইগুঁড়ি শহরে একজন ভদ্রলোক আছেন, তাকে দেখলেই আমার শঙ্কর রায়বর্মনের কথা মনে পড়ে। অথচ চেহারা কিংবা মুখের মিল নেই। তবু কিছু একটা যেন মিল আছে।

জোজো বলল, ভদ্রলোকের কী নাম? কী করেন তিনি?

আমজাদ আলি বললেন, ওঁর নাম নীলকণ্ঠ মজুমদার। একটা বইয়ের দোকানের মালিক। শান্তমতন লোক। আমি বই কিনতে গিয়ে কয়েকবার দেখেছি। কেন যে ওঁকে দেখলে শঙ্কর রায়বর্মনের কথা মনে পড়ে, তা আমি নিজেই বুঝি না!

সন্তু বলল, হয়তো ওঁরা দুই ভাই। নামের তো মিল আছে, শঙ্কর আর নীলকণ্ঠ তো একই। দুটোই শিবের নাম। আর পদবিটা ইচ্ছে মতন পালটে ফেলা যায়।

জোজো বলল, চলুন তো, লোকটাকে আমায় একবার দেখিয়ে দিন। আমি দেখলেই বুঝতে পারব সে-ই আসল লোক কি না!

আমজাদ আলি বললেন, তুমি কী করে বুঝবে? তুমি তো একবারও আসল লোকটিকে দেখোইনি।

জোজো অবহেলার সঙ্গে ঠোঁট উলটে বলল, এসব আমার কাছে জলভাত। আমার একটা স্পেশ্যাল পাওয়ার আছে। কেউ মিথ্যে কথা বললেই আমি তার গন্ধ পাই। ওর আসল নাম নীলকণ্ঠ মজুমদার কি না, তা আমি একবার শুনলেই বুঝতে পারব। একবার কী হয়েছিল জানেন?

সন্তু বলল, তোর গল্পটা পরে শুনব। চল, বেরিয়ে পড়ি। লোকটাকে দেখে আসি।

আমজাদ আলির জিপে ওরা সার্কিট হাউসের গেট দিয়ে বাঁ দিকে চলে গেল। একটু পরেই অন্যদিক দিয়ে পুলিশের লোক ডাকতে এল আমজাদ আলিকে। দেখা পেল না।

জিপে যেতে যেতে জোজো বলল, আলিসাহেব, আপনি চার্লস শোভরাজের নাম শুনেছেন?

আমজাদ আলি বললেন, সে তো একজন মহাধুরন্ধর খুনি আর ঠকবাজ।

জোজো বলল, সেবারে আমরা গোয়ায় বেড়াতে গেছি, সন্ধেবেলা একটা রেস্টুরেন্টে গন্দা চিংড়ি খাচ্ছি। ওখানকার চিংড়ি খুব বিখ্যাত। একজন লোক আমাদের পাশের টেবিলে বসে কয়েকজন মহিলার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছিল, লোকটির যেমন সুন্দর চেহারা, তেমনই শৌখিন পোশাক। দেখলে মনে হয় সাহেব, অথচ কথা বলছে হিন্দিতে, এক প্যাকেট তাস নিয়ে ম্যাজিক দেখাচ্ছে নানারকম।

হঠাৎ কয়েকজন পুলিশ এসে রেস্টুরেন্টটা ঘিরে ধরল।

কীসের জন্য তারা এসেছে তা তো আমরা জানি না। একজন পুলিশ অফিসার খুব ভদ্রভাবে বললেন, আপনাদের আমরা ডিসটার্ব করতে চাই না। শুধু এখানকার প্রত্যেকের নামগুলো লিখে নিয়ে যেতে চাই। আর কে কোন হোটেলে উঠেছেন। কেউ যদি পরিচয়পত্র দেখাতে পারেন, তবে তো ভালই। না হলে পরে আমরা গিয়ে দেখে আসব।

সবাই নাম বলছে, আর পুলিশরা একটা খাতায় লিখে নিচ্ছে। সকলে তো আর কোনওরকম আইডেনটিটি কার্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। শুধু নাম, অনেকেই তো ইচ্ছে করলে অন্য নাম বলতে পারে, তাই না?

আমজাদ আলি বললেন, তা তো পারেই। হোটেলের নামও ভুল বলতে পারে।

জোজো বলল, আমি তখন বাবাকে বললাম, আমাদের পাশেই একটা বাজে গন্ধ পাচ্ছি। আগে তো এই গন্ধটা ছিল না! বাবা বললেন, ঠিক বলেছিস তো জোজো। একটা কিছু গণ্ডগোল আছে। বাবা তখন পুলিশ অফিসারটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বিশেষ কাউকে খুঁজছেন? আমি বোধ হয় আপনাকে সাহায্য করতে পারি। প্রত্যেককে আর একবার বেশ জোরে জোরে নিজের নাম বলতে বলুন তো!

পুলিশের অনুরোধে সবাই আবার নাম বলতে লাগল। আমাদের পাশের সেই সুন্দর চেহারার লোকটির নাম মোহন দারুওয়ালা। সে যেই নিজের নাম বলল, অমনই তার গা থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ বেরুতে লাগল। আমি তখন লোকটার দিকে আঙুল দেখাতেই সে ফস করে একটা রিভলভার বার করে ফেলল। কিন্তু সেটা ওপরে তোলবার আগেই দুজন পুলিশ জাপটে ধরল তাকে। তারপর তাকে সার্চ করে দেখা গেল, সে-ই পলাতক আসামি চার্লস শোভরাজ!

আমজাদ আলি বললেন, তুমিই চার্লস শোভরাজকে ধরিয়ে দিয়েছ! দারুণ ব্যাপার!

জোজো বলল, আমি যে মিথ্যে কথার গন্ধ পাই।

সন্তু বলল, গন্ধটা ঠিক কীরকম রে? আমরা তো নানারকম গন্ধ পাই, তার মধ্যে কোনটা মিথ্যে কথার গন্ধ বুঝব কী করে?

জোজো বলল, পচা মাছের গন্ধের সঙ্গে ভালুকের হিসির গন্ধ মিশলে যেমন হয়।

সন্তু হঠাৎ হাসতে শুরু করে দিল। জোজো গম্ভীরভাবে বলল, হাসছিস যে? এতে হাসির কী আছে? সন্তু হাসতে হাসতেই বলল, ভালুকের হিসির গন্ধ! চিনব কী করে? আমজাদসাহেব, আপনি চেনেন?

আমজাদ আলি বললেন, না, আমিও চিনি না! আমাদের এখানে ভালুক নেই।

জোজো বলল, আমরা যখন গাংরিপোতায় থাকতাম, সেখানে রাশি রাশি ভালুক। বেড়াল কুকুরের মতন ঘুরে বেড়াত রাস্তা দিয়ে আর আমাদের বাংলোর পাশে হিসি করে যেত!

সন্তু বলল, এইবার আমি যেন সেই গন্ধটা পাচ্ছি। জিপটা এসে থামল বইয়ের দোকানের সামনে।

দোকানটা বেশ বড়ই। অনেকরকম গল্পের বই। স্কুল-কলেজের বই ছাড়াও কলম, পেনসিল, প্যাড সবই পাওয়া যায়।

ভেতরে বেশ কয়েকজন খদ্দের রয়েছে, তিনজন কর্মচারীও আছে। পেছন দিকে একটা টেবিল ও চেয়ার, সেখানে কেউ নেই।

আমজাদ আলি বললেন, ওইখানে মালিক বসেন। কিন্তু এখন তো দেখছি না।

সন্তু আর জোজো ঘুরে ঘুরে বই দেখতে লাগল। বাংলা বই আর কিছু ইংরেজি গল্পের বইও আছে। হ্যারি পটারের বইও এখানে পৌঁছে গেছে।

জোজো একটা বই খুলে নাকের কাছে নিয়ে বলল, নতুন বইয়ের গন্ধ ভারী ভাল লাগে।

আমজাদ আলি বললেন, কিন্তু ভাই, সব গল্পের বইতেই তো অনেক মিথ্যে কথা থাকে।

জোজো বলল, মোটেই না। কোনও বইতেই মিথ্যে কথা থাকে না। যা থাকে, তাকে বলে কল্পনা। কল্পনা আর মিথ্যে কথা এক নয়।

আমজাদ আলি বললেন, তা ঠিক। তা ঠিক।

সন্তু বলল, জোজো যেমন মিথ্যে কথা বলে না, সবই ওর কল্পনা!

আমজাদ আলি একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই, নীলকণ্ঠবাবুর সঙ্গে দেখা হতে পারে কি? উনি কখন আসবেন?

কর্মচারীটি এক কোণের একটা দরজা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওই ঘরে রয়েছেন। চলে যান!

আমজাদ আলি ফিসফিস করে জোজোকে বললেন, কী ছুতোয় দেখা করব? কিছু একটা মিথ্যে কথা তো বলতেই হবে।

জোজো বলল, আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি ম্যানেজ করব।

কোণের দরজাটা ঠেলে একটু ফাঁক করে জোজো জিজ্ঞেস করল, ভেতরে আসতে পারি?

সেখানে আর একটা ছোট ঘর। একটা টেবিলে অনেকখানি ঝুঁকে একজন লোক কী যেন লিখছে মন দিয়ে। লোকটি মাঝবয়েসি, নাকের নীচে মোটা গোঁফ, মাথার মাঝখানে অল্প একটু টাক। ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি পরা।

লোকটি মুখ তুলে বলল, কী চাই?

জোজো বলল, আপনি কি নীলকণ্ঠবাবু? লোকটি বলল, হ্যাঁ, আমি নীলকণ্ঠ মজুমদার।

জোজো সন্তুর দিকে তাকিয়ে একদিকের ভুরু কাঁপাল। তার ঠিক মানে সন্তু বুঝল না। ঘরে কোনও গন্ধও সে পেল না।

ভেতরে এসে জোজো বলল, অনির্বাণ সরকার আমাদের পাঠিয়েছেন। আপনি তার নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?

নীলকণ্ঠ মজুমদার বলল, অনির্বাণ সরকার, মানে, লেখক? তার তো অনেক বই আমার দোকান থেকে বিক্রি হয়।

জোজো বলল, হ্যাঁ, আমরা রিপোর্ট পেয়েছি, উত্তরবঙ্গেই তার বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। তার বেশিরভাগই আপনার দোকান থেকে। তাই তিনি আপনার কাছে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।

নীলকণ্ঠ মজুমদার কৌতূহলী চোখে বললেন, অত বড় নামকরা লেখক, আমার কাছে প্রস্তাব পাঠাবেন? কী ব্যাপার শুনি?

জোজো বলল, ব্যাপারটা এখনও গোপন। অনেকেই জানে না। অনির্বাণ সরকার ঠিক করেছেন, তিনি তার বই আর কোনও পাবলিশারকে দেবেন না। এখন থেকে তাঁর সব বই নিজেই প্রকাশ করবেন। তিনি উত্তরবাংলার বিক্রির সব দায়িত্ব আপনাকে দিতে চান।

ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে আমজাদ আলি বললেন, আপনি কমিশন অনেক বেশি পাবেন।

নীলকণ্ঠ মজুমদার ফঁকা চেয়ার দেখিয়ে বলল, আপনারা বসুন। এ তো খুব ভাল প্রস্তাব।

জোজো বলল, তিনি নিজেও উত্তরবঙ্গে একবার আসতে চান। আপনার দোকানে বসে পাঠকদের জন্য বই সই করবেন।

সন্তু বলল, এখানে ওঁর একজন বন্ধু আছে। শঙ্কর রায়বর্মন।

নীলকণ্ঠ মজুমদার বলল, শঙ্কর রায়বর্মন? সে আবার কে?

সন্তু বলল, আপনি তার নাম শোনেননি। তিনি তো এখানকার রাজা। অনির্বাণ সরকারের পরের উপন্যাসটা শঙ্কর রায়বর্মনকে নিয়েই তো লেখা হচ্ছে।

নীলকণ্ঠ মজুমদার বলল, তাই নাকি? এখানকার রাজা? আজকাল অনেকেই নিজেদের রাজা বলতে শুরু করেছে!

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, অনির্বাণ সরকার একবার আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটা বোধ হয় এই আলমারিতে আছে।

দেওয়ালের গায়ে একটা আলমারি খুলে চিঠির বদলে টপ করে টেনে বার করল একটা অদ্ভুত ধরনের অস্ত্র।

ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, অনির্বাণ সরকার পাঠিয়েছে? অনির্বাণ সরকার মারা গেছে এক বছর আগে। শঙ্কর রায়বর্মন তার বন্ধু? ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখোনি! তোমরা নিজেরা এসে ফাঁদে পা দিয়েছ!

সন্তু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, এবার একটা চেয়ারে বসে পড়ে হেসে বলল, আপনার কাছেও একটা এ কে ফরটি সেভেন আছে দেখছি! বইয়ের দোকানে অস্ত্র? কিন্তু ওটা দিয়ে তো আমাদের ভয় দেখাতে পারবেন না। আমি জানি, ওটাতে গুলি নেই!

নীলকণ্ঠ মজুমদার বলল, গুলি নেই? দেখবে তোমাদের ঝাঁঝরা করে দেব?

সন্তু বলল, গুলি থাকলেও তা পারতেন না। দিনের বেলা, দোকানে কত লোক, রাস্তায় কত লোক, প্রচণ্ড শব্দ হবে, আপনি পালাবেন কী করে?

নীলকণ্ঠ মজুমদার বলল, সে চিন্তা তোমায় করতে হবে না। এই লোকটা তো আমজাদ আলি, তাই না? ওকে আমাদের দরকার ছিল।

হাতের বড় অস্ত্রটা নামিয়ে রেখে তিনি ড্রয়ার থেকে বার করলেন একটা লম্বা ধরনের রিভলভার।

সেটা তুলে বলল, আগেরটা দেখে ভয় পাওনি, এটা সম্পর্কে কিন্তু ভুল কোরো না। এতে সত্যি গুলি আছে, আর সাইলেন্সর লাগানো। কোনও শব্দ হবে না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আপনি কে? আপনি কি সত্যিই নীলকণ্ঠ মজুমদার?

লোকটি বলল, আমি আপাতত তোমাদের যম। এ আমজাদ আলিকে আজ রাত্তিরের মধ্যেই খতম করে দেওয়ার কথা ছিল, ও একজন সাক্ষী। ওকে এখানেই শেষ করব।

জোজো বলল, আমরা কিন্তু শঙ্কর রায়বর্মনের লোক!

লোকটি হেসে বলল, তাই নাকি? তা হলে আমি কার লোক? আমি আমার নিজেরই লোক। তোমরা সরে দাড়াও!

আমজাদ আলির মুখোনা বিবর্ণ হয়ে গেছে।

সন্তু আর জোজো একসঙ্গে উঠে এসে আমজাদ আলিকে আড়াল করে দাড়াল।

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, বললাম না, সরে দাড়াও। আমরা ছোট ছেলেদের মারি না!

জোজো বলল, ছোট মানে? আমরা মোটেই ছোট নই, কলেজে পড়ি।

সন্তু বলল, আমাদের না মেরে কিছুতেই ওঁকে মারতে পারবেন না।

লোকটি বলল, আমি ঠিক তিন গুনব। এক… দুই…

তক্ষুনি দরজাটা খুলে গেল।