০৩. নরেন্দ্র ভার্মার শত অনুরোধ

নরেন্দ্র ভার্মার শত অনুরোধেও কাকাবাবু তখনই হোটেলে ফিরে যেতে রাজি হলেন না। তিনি তাঁর বন্ধু ভার্গবের সঙ্গে দেখা করতে যাবেনই।

অধ্যাপক ভার্গবের বাড়ি শহর ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে। ঋষিকোণ্ডা বিচে যাওয়ার পথে একটা ছোট টিলার ওপারে ছবির মতন বাগানঘেরা সুন্দর বাড়ি। একেবারে বাড়ির গেট পর্যন্ত গাড়ি উঠে আসার রাস্তা আছে। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়।

 

সন্ধে হয়ে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, আহা, কী চমৎকার হাওয়া এখানে! দেখছ নরেন্দ্র, সমুদ্রের ঢেউয়ের। মাথায় ফসফরাস রয়েছে, অন্ধকারে মালার মতন দেখাচ্ছে। আমাদের কবি মাইকেল লিখেছেন, কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে প্রচেতঃ… অবশ্য এখানে মালা মানে অন্য মালা। প্রচেতঃ মানে সমুদ্র, জানো তো?

নরেন্দ্র ভামা বললেন, আশ্চর্য, একটু আগে একজন তোমায় খুন করতে এসেছিল, আর এর মধ্যে তোমার কবিতা মনে পড়ছে?

কাকাবাবু বললেন, কেউ আমার দিকে ছুরি বা গুলি ছুড়লে আমি তেমন গ্রাহ্য করি না। এরকম তো কতবার হয়েছে। কিন্তু বিনা দোষে পুলিশ যে আমাকে জেলে ভরে দিয়েছিল, সেটাতেই খুব রাগ হয়েছিল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, যাক, সেটা তো মিটে গেছে। পুলিশ আর তোমাকে বিরক্ত করবে না, বরং যা সাহায্য চাইবে তাই পাবে।

কাকাবাবু বললেন,  জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন, এটা কার লেখা বলতে পারো? ওঃ, তুমি তো বাংলা পড়ো না। এটা রবীন্দ্রনাথের।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমায় দেখছি কবিতায় পেয়েছে। রাজা, তোমার জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। আমি থাকতে পারব না, কাল সকালে আমাকে চলে যেতেই হবে।

কাকাবাবু হাসিমুখে বললেন, যাও না, অত চিন্তা কীসের? তুমি থাকলেও সবসময় আমাকে পাহারা দিতে নাকি? আমার কিছু হবে না।

বাগান পেরিয়ে এসে বাড়ির সদর দরজায় কলিং বেল টিপলেন নরেন্দ্র ভার্মা। তিন-চারবার বাজাবার পরেও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সারা বাড়িটা বড় বেশি নিস্তব্ধ।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, বাড়িতে কেউ নেই মনে হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, দোতলায় একটা আলো জ্বলছে।

দুজনে মিলে কয়েকবার ডাকলেন, প্রোফেসর ভার্গব! প্রোফেসর ভার্গব!

তাও কেউ সাড়া দিল না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, বোধ হয় ভুল করে একটা ঘরে আলো জ্বেলে চলে গেছেন।

কাকাবাবু বললেন, এত বড় বাড়ি, কোনও দরোয়ান বা ভৃত্য থাকা উচিত ছিল না? বাড়ি ফেলে সবাই কি চলে যেতে পারে? দরজার বাইরে তালা নেই, ভেতর থেকে বন্ধ, ওপরে আলো জ্বলছে, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আছে।

নরেন্দ্র ভার্মা কাকাবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, দেওয়ালে একটা জলের পাইপ রয়েছে, ওটা বেয়ে দোতলার বারান্দায় ওঠা যেতে পারে। কিন্তু আমি খোঁড়া মানুষ, ওই কাজটা তো পারব না!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু অপরিচিত লোকের বাড়িতে এইভাবে ওঠা কি ঠিক হবে? তার চেয়ে বরং ফিরে গিয়ে থানায় খবর দেওয়া যাক। পুলিশ যা হোক ব্যবস্থা করবে।

কাকাবাবু বললেন, আসবার আগে একটা টেলিফোন করা উচিত ছিল। চলো তো বাড়িটার চারপাশটা একবার ঘুরে দেখা যাক।

সব দিকেই ফুলের বাগান, নানান রকম ফুলের গাছ। বাগানটার বেশ যত্ন করা হয় বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এখন ফুল দেখার সময় নেই।

কাকাবাবু ক্রাচ ঠকঠকিয়ে বেশ জোরে-জোরে হেঁটে পৌঁছলেন বাড়িটার পেছন দিকে। সেদিকেও রয়েছে একটা বারান্দা। একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি রয়েছে বারান্দা পর্যন্ত।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখা যেতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও!

সিঁড়ির নীচে একটা ছোট দরজাও রয়েছে।

কাকাবাবু একটা ক্রাচ তুলে সেই দরজাটা ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে গেল। সেটা ভেজানো ছিল।

সেই দরজা দিয়ে দুজন ঢুকলেন ভেতরে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কয়েক পা এগোতেই উ-উ শব্দ শোনা গেল, মানুষের গোঙানির মতন। দুজনে থমকে দাঁড়ালেন। দুজনেই রিভলভার বার করে ফেলেছেন।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, একটা টর্চও আনিনি ছাই। ফিরে গিয়ে দেখব গাড়ির ড্রাইভারের কাছে টর্চ আছে কিনা?

কাকাবাবু বললেন, দেওয়ালে হাত বুলিয়ে দেখো তো। আলোর সুইচ থাকতে পারে।

গোঙানির শব্দটা বেড়ে যাচ্ছে। খানিকটা খোঁজাখুঁজির পরে আলোর সুইচ পেয়ে জ্বালাতেই দেখা গেল, মেঝেতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটা লোক পড়ে আছে, তার মুখে কাপড় গোঁজা, তাই সে কথা বলতে পারছে না।

নরেন্দ্র ভার্মা লোকটির মুখ থেকে কাপড়টা টেনে বার করতেই সে ভয়ার্ত গলায় কী যেন বলে উঠল, তেলুগু ভাষা, বোেঝবার উপায় নেই।

নরেন্দ্র ভামা তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, পুলিশ, পুলিশ।

তাকে বন্ধনমুক্ত করতেই সে ছুটে গেল ভেতরের সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির কয়েক ধাপ ওপরে ওইরকম একই অবস্থায় পড়ে আছে আর-একজন লোক। সেও গোঙাচ্ছে। আগের লোকটিই এর বাঁধন খুলে দিল।

সবাই মিলে দোতলায় উঠতে-উঠতে আরও গোঙানির শব্দ শুনতে পেল।

এবারে দেখা গেল একজন মহিলাকে। এরও হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড় গোঁজা।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, এ কে? ভার্গবের স্ত্রী?

কাকাবাবু বললেন, ওকে অন্যরা খুলে দেবে। শিগগির ভেতরে চলল, প্রফেসর ভার্গবকে আগে খুঁজে বার করা দরকার। ভার্গব আমারই মতন বিয়ে করেননি। একলা থাকেন। এরা সবাই খুব সম্ভবত বাড়ির কাজের লোক।

 

দোতলায় পরপর কয়েকটি ঘর।

কাকাবাবু দ্রুত এগোতে লাগলেন আলো-জ্বলা ঘরটির দিকে। সে-ঘরের দরজা খোলা।

দরজার সামনে এসেই কাকাবাবু শিউরে উঠে বললেন, এঃ!

ঘরের মধ্যে একটা কুকুর মরে পড়ে আছে। বেশ বড় আকারের অ্যালসেশিয়ান, কেউ তাকে গুলি করেছে।

রক্ত থক থক করছে মেঝেতে।

সেটা লাইব্রেরি ঘর, সমস্ত দেওয়াল জুড়ে বইয়ের র‍্যাক।

ছোট-বড় অনেক মূর্তিও সাজানো রয়েছে, কয়েকটা মূর্তি কেউ ছুড়ে ছুড়ে ভেঙেছে।

কিছু বইপত্রও মাটিতে ছড়ানো।

প্রোফেসর ভার্গবকে দেখতে পাওয়া গেল ঘরের এককোণে। একটা রকিং চেয়ারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে, শরীরে কোনও স্পন্দন নেই।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, মাই গড!

ডেড? কাকাবাবু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ভার্গবের থুতনিটা ধরে উঁচু করলেন, তারপর বললেন, নাঃ, অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

তাঁর বাঁধন খুলে, মুখের কাপড়টা বার করা হল।

কাকাবাবু তাঁর গালে আস্তে-আস্তে চাপড় মেরে ডাকতে লাগলেন, ভার্গব। ভার্গব!

তবুও ভার্গবের জ্ঞান ফিরল না।

নরেন্দ্র ভার্মার নির্দেশে বাড়ির একজন লোক ছুটে এক জাগ জল নিয়ে এল। সেই জলের ছিটে দেওয়া হতে লাগল ওঁর মুখে।

একটু পরে ভার্গব চোখ মেলে বললেন, কে? তোমরা আমাকে মারছ। কেন? আমি কী দোষ করেছি?

কাকাবাবু মুখটা ঝুঁকিয়ে বললেন, ভার্গব, আর কোনও ভয় নেই। আমি রাজা রায়চৌধুরী। ভাল করে তাকিয়ে দেখো।

ভার্গব তবু ফিসফিস করে বললেন, আমাকে মারতে চাও মারো। কিন্তু আমার মূর্তিগুলো ভেঙো না! ওগুলোর দাম আমার প্রাণের চেয়েও বেশি!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, একটু সময় দাও, রাজা। এরকম অবস্থায় নাভাস ব্রেক ডাউন হতে পারে। কথা বলার জন্য জোর কোরো না, নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যাবেন।

সারা ঘরে অনেক ছোট-ছোট টুল রয়েছে, বইয়ের র্যাকের ওপরের তাক থেকে বই পাড়ার জন্য। কাকাবাবু একটা টুল টেনে নিয়ে ভাৰ্গবের মুখোমুখি বসলেন। তারপর বললেন, ওঁকে গরম চা কিংবা কফি খাওয়ানো দরকার। আমারও তখন মুখের চা-টা নষ্ট হয়ে গেছে।

বাড়ির লোকরা হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু মুখের কাছে কাপ ধরার ইঙ্গিত করে বললেন, টি? কফি?

মহিলাটি ছুটে চলে গেল। বোঝা গেল সে-ই এ বাড়ির রাঁধুনি। নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে ব্যাপারটা জানানো দরকার।

ভার্গব আপন মনে কীসব বিড়বিড় করে বলে চলেছেন, একটু বাদে হঠাৎ যেন তাঁর পুরো জ্ঞান ফিরে এল। তিনি স্পষ্ট চোখ মেলে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী? আমাকে বাঁচাবার জন্য তুমি ঠিক এই সময় কী করে এলে?

কাকাবাবু বললেন, কী হয়েছিল কী খুলে বলো তো?

ভার্গব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।

 

কাকাবাবুর তুলনায় ভার্গবের ছোটখাটো চেহারা। টুকটুকে ফরসা রং, মাথায় টাক, মুখে সাদা দাড়ি। সারাজীবন পড়াশুনো নিয়েই কাটিয়েছেন, কখনও খেলাধুলো করেননি। তাঁর বাবা বেশ ধনী লোক ছিলেন, সেইজন্য টাকা-পয়সা নিয়েও চিন্তা করতে হয়নি কখনও।

পাশের ঘরে একটা কর্ডলেস ফোন খুঁজে পেয়ে সেটাতে কথা বলতে বলতে নরেন্দ্র ভার্মা ফিরে এলেন এ-ঘরে।

কাকাবাবু বললেন, ভার্গব, ইনি আমার বিশেষ বন্ধু, নরেন্দ্র ভার্মা, দিল্লি থেকে আজই ছুটে এসেছেন। উনি সি বি আই-এর একজন হর্তাকর্তা।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, প্রোফেসর ভার্গব, আপনি এতবড় বাড়িতে একা থাকেন? যে-কোনও দিনই তো চোর-ডাকাতরা হামলা করতে পারে।

ভার্গব আস্তে-আস্তে বললেন, একা তো নয়। দরোয়ান আছে, মালি আছে, আর আমার কুকুর টোবি, কোনওদিন কিছু হয়নি, ওঃ ওরা টোবিকে মেরে ফেলল, আমার চোখের সামনে, ওঃ ওঃ।

ভার্গব কেঁদে ফেললেন।

নরেন্দ্র ভার্মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে হাত তুলে চুপ করার ইঙ্গিত করলেন কাকাবাবু।

তিনি জানেন যে, যারা কুকুর পোষে, তাদের প্রিয় কুকুর মারা গেলে তারা কত কষ্ট পায়। ঠিক নিজের ছেলেমেয়ের মৃত্যুর মতন শোক। এ শোকে কোনও সান্ত্বনাও দেওয়া যায় না। কাঁদতে দেওয়াই ভাল।

একটু পরে তিন কাপ কফি এল।

কাকাবাবু বললেন, ভার্গব, একটু কফি খাও, ভাল লাগবে।

নরেন্দ্র ভার্মা এবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে যারা বেঁধে রেখে গেছে, তারা কারা? একজনকেও চিনতে পেরেছেন?

ভার্গব দু দিকে মাথা নেড়ে বললেন, না। জীবনে দেখিনি। কথা শুনলেই বোঝা যায়, বিশেষ লেখাপড়া জানে না। এই ধরনের লোক তো আমার বাড়িতে আসে না। এখানে ছাত্রছাত্রী বা অধ্যাপক দু-একজন আসেন। আমি নিরিবিলিতে থাকতে ভালবাসি। তবু কেন এই উপদ্রব?

কাকাবাবু বললেন, যারা এসেছিল তারা সাঙ্ঘাতিক লোক। এ-বাড়ির দরোয়ান, মালি আর রাঁধুনির হাত-পা-মুখ বেঁধে ভেতরে ফেলে রেখে গেছে। ভার্গবেরও একই অবস্থা। আমরা এসে না পড়লে দিনের পর দিন ওরা এই অবস্থায় পড়ে থাকত। সদর দরজা বন্ধ করে পেছনের দরজা দিয়ে চলে গেছে। অন্য লোক ডাকতে এলে হয়তো সদর দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যেত।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, একটা ঘরের আলো জ্বেলে রেখে গেছে।

ভার্গব বললেন, ওরা এসেছিল দুপুরে। তবু ইচ্ছে করে আলো জ্বালল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কুকুরটা ছাড়া আর কাউকেই প্রাণে মারেনি। উদ্দেশ্য কী, ডাকাতি? আপনি একটু সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর দেখুন, কী কী নিয়ে গেছে। পুলিশকে খবর দিয়েছি, কমিশনার সাহেব নিজেই হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন।

ভার্গব বললেন, কী আর নেবে ডাকাতরা? আমার বাড়িতে সোনাদানা বা ওই ধরনের দামি জিনিস কিছু নেই। টাকা-পয়সা থাকে ব্যাঙ্কে। শুধু এই মূর্তিগুলো আর বই, এগুলোই দামি। ওরা কতকগুলো মূর্তি আছড়ে-আছড়ে ভেঙেছে ইচ্ছে করে, এসব মূর্তির দাম ওরা বোঝে না। আমি কিছু নিতে দেখিনি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওরা তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলেনি?

ভার্গব বললেন, হঠাৎ দুজন লোক এই ঘরে ঢুকে এল। আমি বই পড়ছিলাম। টোবি বসে ছিল আমার পায়ের কাছে। অচেনা লোক দেখে টোবি ডাকতে-ডাকতে ছুটে গেল ওদের দিকে। অমনই। একজন গুলি করে টোবিকে মেরে ফেলল। তারপর আমার কাছে এসে আমাকে বেঁধে ফেলতে লাগল, আমি কী করেই বা ওদের বাধা দেব? কোনওদিন কারও গায়ে হাত তুলিনি। ওদের একজন মূর্তি ভাঙতে লাগল, আর-একজন আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, যদি বাঁচতে চাও তো ব্যাঙ্গালোর চলে যাও। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে।

নরেন্দ্র ভার্মা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাঙ্গালোর? হঠাৎ ব্যাঙ্গালোর কেন?

ভার্গব বললেন, ব্যাঙ্গালোরে আমার পৈতৃক বাড়ি, ওরা সেটা জানে বোধ হয়। আমি আসলে কনাটকের লোক, যদিও অন্ধ্রপ্রদেশে আছি অনেক বছর। ওরা আমাকে ভয় দেখিয়ে এখান থেকে তাড়াতে চায়।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ননসেন্স! কনাটকের লোক অন্ধ্রপ্রদেশে থাকতে পারবে না? আপনার মতন একজন পণ্ডিত মানুষকে পেয়ে এদের ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা।

বাইরে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ হল। নরেন্দ্র ভার্মা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বললেন, পুলিশ কমিশনার এর মধ্যে এসে গেলেন?

সিঁড়ি দিয়ে পায়ের আওয়াজ করে উঠে এলেন একজন। সাদা প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরা। বেশ সুদর্শন পুরুষ। গোঁফ নেই, দেখলে পুলিশ বলে মনেই হয় না।

ঘরে ঢুকে নমস্কার করে বললেন, আমার নাম সুধীর রাজমহেন্দ্ৰী, কমিশনার সাহেব খুব ব্যস্ত আছেন। উনি ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে আমাকে আসতে বললেন। আমি ডি আই জি, ক্রাইম।

নরেন্দ্র ভার্মা নিজের নাম বলে জানালেন, আমি দিল্লি থেকে এসেছি।

সুধীর রাজমহেন্দ্রী বললেন, আমি প্রোফেসর ভার্গবকে চিনি, মানে কাগজে ছবি দেখেছি, ওঁর লেখা বইও পড়েছি। উনি নিশ্চয়ই রাজা রায়চৌধুরী? এবাড়িতে ডাকাতি হয়েছে?

নরেন্দ্র ভার্মা সব ব্যাপারটা সংক্ষেপে জানালেন। রাজমহেন্দ্ৰী ভুরু কুঁচকে বললেন, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কর্নাটকের মানুষদের তাড়াবার জন্য কোনও দল তৈরি হয়েছে, এমন শুনিনি। খোঁজ নিতে হবে। এবাড়ির সামনে দুজন পুলিশ পোস্টিং করে দিলে আর তারা হামলা করতে সাহস করবে না!

তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বললেন, আপনার কী ঝঞ্ঝাট হয়েছে, তাও আমি শুনেছি। মনে হচ্ছে আপনার ব্যাপারটা আর প্রোফেসর ভার্গবের ব্যাপারটা দুটো আলাদা দলের কাজ। আপনারটাই বেশি সিরিয়াস।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমারও মনে হয়, দুটো আলাদা দলের কাজ।

রাজমহেন্দ্ৰী বললেন, সবটা আপনাদের বুঝিয়ে বলি। ভাইজাগ এমনিতে শান্তিপূর্ণ শহর। খুনোখুনি বিশেষ হয় না। চোর-ডাকাত যে একেবারে নেই তা নয়, তবে অন্য শহরের চেয়ে কম। বাইরে থেকে বহু লোক এখানে বেড়াতে আসে, কাজে কর্মেও আসে, তাদের কোনও ক্ষতি হয় না। গণ্ডগোল হয় পোর্ট এলাকায়। সব পোর্টেই নানারকম স্মাগলিং চলে, মাঝে-মাঝে কিছু ধরা পড়ে, আবার বেড়ে ওঠে। এই স্মাগলিং চালায় নানান রাজ্যের লোক। অন্ধ্রের লোকই বড় কম। যারা ধরা পড়ে তারা মরাঠি, তামিল, পঞ্জাবি, বাঙালি, এমনকী কিছু কিছু চিনেও আছে। সুতরাং সেই স্মাগলাররা নিশ্চয়ই প্রোফেসর ভার্গবের মতো নিরীহ লোককে নিয়ে মাথা থামাবে না, কনাটকের লোককে অন্ধ্রপ্রদেশ ছেড়ে যাওয়ার কথাও বলবে না। কিন্তু রাজা রায়চৌধুরীকে নিয়ে তাদের চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। আপনি অনেক বড়-বড় ক্রিমিনালকে ঘায়েল করেছেন আমি জানি। একবার আন্দামানের খুব বড় একটা স্মাগলারদের গোটা দলকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এখানকার স্মাগলাররা ভাবছে, আপনি ভাইজাগে এসেছেন সেরকমই কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে।

কাকাবাবু বললেন, সত্যিই কিন্তু আমি সেজন্য আসিনি। আমি থাকি কলকাতায়, এত দূর ভাইজাগ শহরের স্মাগলিং নিয়ে মাথা থামাব কেন? কেউ আমাকে এ কাজের দায়িত্বও দেয়নি। আমি এসেছি প্রোফেসর ভার্গবের মূর্তিগুলো দেখার জন্য। এটা আমার শখ।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, মুশকিল হচ্ছে কী জানো, রাজা, তুমি নিছক শখের জন্য কোথাও যাবে, এটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। তুমি যেখানেই যাও, সেখানকার অপরাধীরা তোমার গতিবিধি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।

রাজমহেন্দ্ৰী প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার নজর বুলিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, আমরা এখন খুবই সাঙ্ঘাতিক একটা ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। আপনারা বিশিষ্ট ব্যক্তি, আপনাদের কাছে বলা যেতে পারে। বন্দরে জাহাজ থেকে নানারকম জিনিসপত্র, যেমন ধরুন ঘড়ি, রেডিয়ো, ভি সি আর, সিগারেট, সোনা এইসব স্মাগলিং হয়। সব বন্দরেই হয়। কিন্তু গোপন রিপোের্ট পাওয়া গেছে যে এখন ভাইজাগ বন্দর দিয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পাচার হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। সেগুলো কিনছে ওখানকার তামিল টাইগার বিদ্রোহীরা। আপনারা জানেন, ভারত সরকার ওখানকার বিদ্রোহীদের কোনওরকম অস্ত্র সাহায্য করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অথচ স্মাগলাররা অস্ত্র পাচার করছে। এতে দু দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে পারে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমরাও এই রিপোর্ট পেয়েছি। দিল্লিতে এই নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রীও চিন্তিত।

রাজমহেন্দ্রী বললেন, যে-কোনও উপায়েই হোক এই স্মাগলিং বন্ধ করতেই হবে। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে হ্যান্ড গ্রেনেড বা হাত-বোমাই যাচ্ছে বেশি। কোথায় এই বোমাগুলো বানানো হচ্ছে, কোন পথে এই বন্দরে আসছে, তা কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না।

রাজমহেন্দ্ৰী কাকাবাবুর দিকে জিজ্ঞাসুভাবে চেয়ে রইলেন।

কাকাবাবু বললেন, এটা গুরুতর ব্যাপার ঠিকই। কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি কথা বলছি, এই স্মাগলারদের ধরার জন্য দিল্লি থেকে আমার কাছে সাহায্য চাওয়া হয়নি। সেজন্য আমি আসিনি। এরকম কাজের দায়িত্বও আমি নিতে পারব না। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার সে-ক্ষমতাও নেই।

রাজমহেন্দ্রী বললেন, তা হলে আমি অনুরোধ করব, মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী, আপনি কিছুদিনের জন্য গা-ঢাকা দিন। আজ দুপুরেই আপনাকে ছুরি মারার চেষ্টা হয়েছে। ওরা আবার আপনার ওপর আক্রমণ করবে। আপনি কি পুলিশ পাহারায় চুপচাপ বসে থাকতে পারবেন? আপনার কলকাতায় ফিরে যাওয়াই উচিত। আমরা আপনাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেব। প্রোফেসর ভার্গবের বাড়ির সামনে দুটি পুলিশ পোস্টিং করিয়ে দিলেই চলবে, ওরা এখানে আর আসতে সাহস করবে না।

নরেন্দ্র ভার্মা একবার গলাখাঁকারি দিলেন। তাঁর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে গেল।

তিনি বললেন, মিস্টার রাজমহেন্দ্ৰী, আপনি যা পরামর্শ দিলেন, তা কি রাজা রায়চৌধুরী লক্ষ্মী ছেলের মতন শুনবেন? ওঁকে আমি ভাল করেই চিনি। দারুণ একরোখা মানুষ। যারা ওঁকে ষড়যন্ত্র করে জেলে পাঠিয়েছে আর ছুরি মারার চেষ্টা করেছে, তাদের অন্তত একজন না একজনকে কঠিন শাস্তি না দিয়ে উনি এখান থেকে নড়বেন না। হয়তো দেখবেন, কালই উনি একা-একা বন্দর এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বন্দর এলাকাটা একটু ভাল করে ঘুরে দেখা দরকার। রস হিলের ওপর সুন্দর একটা গিজা আছে, সেটাও আমার দেখা হয়নি।

রাজমহেন্দ্রী বললেন, পরে আর-একবার এসে দেখবেন। এখানে আর একদিনও থাকা আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়। হোটেলে যে-কোনও লোক যে-কোনও সময়ে ঢুকে পড়তে পারে।

কাকাবাবু বললেন, হোটেল ছেড়ে আমি প্রোফেসর ভার্গবের বাড়িতে এসে থাকলেই তো পারি, এখানে অনেক ঘর আছে। জায়গাটাও সুন্দর।

ভার্গব বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি এসে থাকুন না। খুব ভাল হয়। দুজনে অনেক গল্প করা যাবে।

রাজমহেন্দ্ৰী খুব জোরে-জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না, না,, সেটা আরও বিপজ্জনক হবে। আপনি যেখানেই যাবেন, ওরা আপনাকে অনুসরণ করবে। এখানেও ধেয়ে আসবে। দু-একটা পুলিশ থাকলেও ওদের আটকানো যাবে না। ওরা সাঙ্ঘাতিক নিষ্ঠুর। কোটি-কোটি টাকার ব্যাপার, তার জন্য দু-চারটে খুন করতে ওদের একটুও হাত কাঁপবে না। আপনি কি প্রোফেসর ভার্গবকেও বিপদে ফেলতে চান?

কাকাবাবু বললেন, না, আমি অন্য কাউকে বিপদে ফেলতে চাই না। তারপর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের র্যাকের কাছে একটা মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভার্গব, এটা কোথাকার? আরাকু ভ্যালির?

ভার্গব বললেন, না। আরাকু ভ্যালি থেকে একটাই মোটে মূর্তি এনেছিলাম। ওরা সেটাও ভেঙে ফেলেছে।

জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে কাকাবাবু বললেন, মানুষ যা গড়তে পারে না, তা ভাঙে কেন?

মেঝেতে বসে পড়ে কয়েকটা ভাঙা টুকরো জোড়া দেওয়ার চেষ্টাও করতে লাগলেন।

রাজমহেন্দ্ৰী বললেন, আমাকে এবার বিদায় নিতে হবে। রায়চৌধুরী সাহেব, আজকের রাতটা ভেবেচিন্তে ঠিক করুন আপনি কী করবেন। কাল। সকালে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। প্রোফেসর ভার্গব, আপনাকে আর কেউ বিরক্ত করবে না। পুলিশ পাহারা দেবে।

ভার্গব ফ্যাকাসেভাবে বললেন,

বিরক্ত? হাত-পা বেঁধে রেখে গেল। এঁরা দুজন এসে না পড়লে কতদিন থাকতে হত কে জানে। হয়তো মরেই যেতাম!

রাজমহেন্দ্ৰী চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ভার্গব, আরাকু ভ্যালিতে যে মূর্তিগুলো দেখেছেন, তা কতদিনের পুরনো হবে মনে হয়?

ভার্গব বললেন, অন্তত হাজার বছর তো হবেই। গুহার মধ্যে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা। একটা খসে পড়ছিল, আমি শুধু সেটাই নিয়ে এসেছি।

কাকাবাবু বললেন, ত্রিপুরার ঊনকোটি পাহাড়ের ওপর খোদাই করা অনেক মূর্তি দেখেছি, অনেকটা সে-ধরনের মনে হচ্ছে।

ভার্গব বললেন, ত্রিপুরার উনকোটির কথা আমি জানি। আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে এই মূর্তিগুলো বাইরে থেকে দেখা যায় না। গুহার মধ্যে। সেখানে খুব অন্ধকার।

কাকাবাবু বললেন, অন্ধকারে অত মূর্তি গড়ল কী করে? সর্বক্ষণ মশাল জ্বেলে রাখতে হয়েছে। ধোঁয়ায় তো দম আটকে যাওয়ার কথা।

ভার্গব বললেন, হাওয়া চলাচলের নিশ্চয়ই ব্যবস্থা আছে। জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা।

নরেন্দ্র ভার্মা বলে উঠলেন, আরে, আরে, তোমরা যে হঠাৎ মূর্তি আলোচনায় মেতে উঠলে! আমার এখন শহরে ফেরা দরকার।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, চলো, যাওয়া যাক। ভার্গব, আপনার এখানে থাকতে ভয় করবে না তো?

ভার্গব বললেন, ভয় তো করবেই। আমি আপনার মতন অত সাহসী নই। বাপরে বাপ, বিকেলে আপনাকে একজন ছুরি মারতে এসেছিল, তারপরেও আপনি হেসে কথা বলছেন? আমার তো এখনও বুক কাঁপছে।

কাকাবাবু বললেন, শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটকের একটা সংলাপ আমার খুব ভাল লাগে। টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন!

ভার্গব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ এই কথাটা কেন?

কাকাবাবু বললেন, এমনিই। মনে পড়ল।

সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখলেন, দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। ওঁদের জন্য গাড়িটা অপেক্ষা করছে, ড্রাইভারের মুখে বিরক্তির ভাব।

গাড়িতে উঠে কাকাবাবু বললেন, নরেন্দ্র, তুমি সরষের মধ্যে ভূত কাকে বলে জানো?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমাদের অতশত খুঁটিনাটি বাংলা আমি জানি।

কাকাবাবু বললেন, আগেকার দিনে মানুষকে ভূতে ধরলে ওঝা ডাকা হত। সেই ওঝারা মন্ত্র পড়া সরষে ছিটিয়ে-ছিটিয়ে দিলে ভূত পালাত। কিন্তু কোনও ভূত যদি সরষে দানার মধ্যেই ঢুকে বসে থাকে, তা হলে আর তাকে তাড়াবে কী করে?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হঠাৎ এই ভূতের ধাঁধাটা আমাকে জিজ্ঞেস করলে কেন?

কাকাবাবু বললেন, চোর, ডাকাত, স্মাগলারদের ধরার জন্য আছে। পুলিশবাহিনী। এখন পুলিশের মধ্যেই যদি চোর-ডাকাতরা ঢুকে বসে থাকে, তা হলে তাদের ধরা যাবে কী করে? স্মাগলারদের ধরার জন্য একটা পুলিশবাহিনী যায়, আর ওই পুলিশের মধ্যে ওদের কোনও চর আগে থেকে খবর দিয়ে দেয়। তারা পালাবার সময় পেয়ে যায়।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, দুঃখের বিষয়, তুমি যা বললে তা মিথ্যে নয়। বড়বড় অপরাধীদের ধরা যায় না, তারা টাকা পয়সা দিয়ে পুলিশের কিছু লোককে হাত করে রাখে। তবে, এই রাজমহেন্দ্ৰী লোকটাকে বেশ সৎ মনে হল।

কাকাবাবু বললেন, কিছু-কিছু সৎ অফিসার তো আছে নিশ্চয়ই। না হলে দেশটা আর চলছে কী করে?

গাড়িটা টিলা থেকে নামতেই কাকাবাবু মুখটা ঝুঁকিয়ে বললেন, ড্রাইভার সাহেব, আমরা যদি আর এক ঘণ্টা এখানে থাকি, আপনার কি খুব অসুবিধে হবে?

ড্রাইভারটি সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠল, না, না। সার, আমার ওপর অর্ডার আছে, আপনারা যতক্ষণ চাইবেন, ততক্ষণ আমায় থাকতে হবে।

কাকাবাবু নরেন্দ্র ভার্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এখন শহরে কী কাজ আছে?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কয়েকটা জরুরি টেলিফোন করতে হবে দিল্লিতে।

কাকাবাবু বললেন, সে এক ঘণ্টা বাদে করলেও চলবে। এখন মোটে আটটা বাজে।

এখানে তুমি কোথায় যাবে? চতুর্দিক অন্ধকার। এসোই না আমার সঙ্গে।

কাকাবাবু গাড়িটা থামাতে বললেন। রাস্তার ধারে ঝাউবন। মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা। আকাশে বেশ জ্যোৎস্না। কাকাবাবু আগে-আগে চললেন।

একটু বাদেই পৌঁছে গেলেন বেলাভূমিতে। সেখানে মানুষজন কেউ নেই।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এলে কেন? কী আছে?

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, সামনে এত বড় একটা জিনিস রয়েছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ না?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এত বড় জিনিস? তার মানে সমুদ্র?

এখানে সমুদ্রের ধারটা কী সুন্দর! রাত্তিরবেলা সমুদ্র আরও সুন্দর দেখায়। এখানে কিছুক্ষণ না থেকে চলে যাওয়ার কোনও মানে হয়?

এই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখব? কেউ যদি আমাদের অনুসরণ করে থাকে, পেছন থেকে যে-কোনও সময় এসে আক্রমণ করতে পারে। তুমি কি পাগল হয়েছ?

আঃ নরেন্দ্র, তুমি সবসময় চোর-ডাকাতদের কথা ভাব কেন? এমন সুন্দর জ্যোৎস্না ফুটেছে, আকাশে ঝকঝক করছে কত তারা, কী চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে। এই সময়েও ওদের কথা ভাবতে হবে? একটুক্ষণ চুপ করে বসে থাকো। দেখো মনটা কেমন পরিষ্কার হয়ে যাবে।

তিনি নিজেই আগে বসে পড়লেন বালির ওপর।