০৮. কাঠমাণ্ডু শহর একেবারে নিঝুম

রাত একটার সময় কাঠমাণ্ডু শহর একেবারে নিঝুম, ঘুমন্ত। অন্যদিন এ-সময়ে, যাও বা দু-চারটে ট্যাক্সি বা দু-চারজন মানুষ দেখা যায়, আজ তাও নেই। কারণ, রাত দশটা থেকেই একটানা বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ অন্ধকার।

একটা বাজবার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে একটা হোটেলের গাড়ি কাকাবাবুকে নিউ রোডের একটা কাপড়ের দোকানের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল।

দোকানপাট সব বন্ধ। রাস্তায় আলো আছে বটে, কিন্তু তাও বৃষ্টির জন্য ঝাপসা।

বৃষ্টির জন্যই হঠাৎ এখানে বেশ শীত পড়ে গেছে। কাকাবাবু সুটের ওপর একটা লম্বা রেইন কোট পরে আছেন। তাঁর সঙ্গে দুখানা বেশ বড় চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগ দুটিই বেশ ভারী, কারণ গাড়ি থেকে তাঁকে দুবারে দুটো ব্যাগ নামাতে হয়েছে।

কাকাবাবু কাপড়ের দোকানের নামটা একবার পড়লেন, তারপর ঘড়ি দেখলেন।

একটা বেজে গেল, তারপরেও পাঁচ-দশ মিনিট। কেউ এল না। কাকাবাবু ব্যস্ত হলেন না। আমাদের দেশে কজন লোকই বা সময়ানুবর্তী হয়?

আরও পাঁচ মিনিট কাটল। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ইউ আর ফ্রম?

কাকাবাবু দেখলেন, যেন মাটি খুঁড়ে দুটো লোক তাঁর দুপাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

এরা বাংলা জানে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য কাকাবাবু প্রথমে বললেন, আমি ভারত সরকারের কাছ থেকে এসেছি।

একটু থেমে আবার বললেন, ফ্রম দ্য গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া।

ওদের একজন জিজ্ঞেস করল, টাকা এনেছেন?

কাকাবাবু বললেন, এই যে দুটি ব্যাগ।

এতে সব টাকা আছে?

হ্যাঁ। সব একশো ডলারের নোট।

আপনাকে তো আমরা এখন ছাড়তে পারব না। সব টাকা গুনে নিয়ে ঠিকঠাক থাকলে তারপর আপনি ছাড়া পাবেন।

আমি তো ছাড়া পাওয়ার জন্য ব্যস্ত নই। টাকা আপনারা গুনে নেওয়ার পর সাইমন বুবুম্বাকে সঙ্গে নিয়ে আমি ফিরব।

তাকে তো ছাড়া হবে কাল সকাল সাতটায়।

আমি ততক্ষণই থাকব।

না, সেটা সম্ভব নয়। যাক, চলুন এখন আমাদের সঙ্গে।

লোক দুটিই বেশ লম্বা-চওড়া, ওভারকোট পরা। মাথায় টুপি। একজন কথা বলছে ভাঙা বাংলায়। দন্তের স আর ছ-এর উচ্চারণ অন্যরকম। খুব সম্ভবত অসমের লোক। অন্যজন চুপ করে আছে। একজনের গালে অনেকখানি দাড়ি-গোঁফ, দুজনেরই চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা।

চামড়ার ব্যাগ দুটো ওই দুজনই তুলে নিল।

একটুখানি এগোবার পর একটা গলি। তার মুখে এসে ওদের একজন বলল, আপনার সঙ্গে আর কেউ নেই? কেউ ফলো করবে না? তা হলে কিন্তু আপনার মরণ নিশ্চিত!

কাকাবাবু বললেন, আমি যতদূর জানি, আমাকে একাই পাঠানো হয়েছে। কেউ কাছাকাছি আছে কি না আপনারাই দেখে নিন।

লোকটি বলল, আমরা পনেরো মিনিট ধরে আপনাকে ওয়াচ করেছি। আর কেউ নেই। ঠিক আছে, তবে আপনার সঙ্গে কোনও অস্ত্র আছে কিনা একবার সার্চ করে দেখতে চাই।

কাকাবাবু বললেন, আমার কাছে অস্ত্র থাকবে কেন? আমি তো মোটবাহক মাত্র। বাংলায় যাকে বলে চিনির বলদ। আপনারা একথাটার মানে জানেন কিনা জানি না।

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, ওসব বাজে কথা বন্ধ করুন। হাত তুলে দাঁড়ান।

দুটি লোকই কাকাবাবুর সারা গা থাবড়ে পরীক্ষা করল। কিছুই পেল না। কাকাবাবু ইচ্ছে করেই আজ রিভলভারটা সঙ্গে আনেননি।

লোক দুটি বলল, ঠিক আছে।

কাকাবাবু বললেন, হয়ে গেছে তো? আমার শীত লাগছে। বোতামগুলো আটকে নিই।

কাকাবাবুর ব্রেইন কোর্টের বোতামগুলো বড় বড়। তিনি ওপরে গলার কাছের বোতামটা পর্যন্ত আটকে দিলেন।

গলির মধ্যে একটা স্টেশান ওয়াগন দাঁড় করানো। কাকাবাবু তাতে উঠতে যাচ্ছেন, তাঁকে বাধা দিয়ে অন্য লোকটি বলল, আপনার ক্রাচ দুটো, ও দুটোও পরীক্ষা করব। ক্রাচ এনেছেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি খোঁড়া মানুষ, ক্রাচ লাগবে না? এ দুটো শুধুই কাচ, এর মধ্যে গুপ্তি-টুপ্তি কিংবা পাইপগান কিছুই নেই।

লোকটি ক্রাচ দুটো নিয়ে উলটে-পালটে-মুচড়ে দেখল। সন্দেহজনক কিছুই পেল না।

এবার গাড়িটা স্টার্ট দিল। একজন নেপালি ড্রাইভার সেটা চালাচ্ছে।

শহর ছাড়িয়ে গাড়িটা চলল বাইরের দিকে। নেপালে কাকাবাবু অনেকবার এসেছেন, মোটামুটি সব রাস্তাই চেনা। তাঁর মনে হল, গাড়িটা যাচ্ছে। ধূলিখেল-এর দিকে।

কাকাবাবুকে দেখে মনেই হয় না, তাঁর কোনও ভয় কিংবা উদ্বেগ আছে। শান্তভাবে চেয়ে আছেন সামনের দিকে, আর নিজের বুকে একটা হাত বুলোচ্ছেন।

এক জায়গায় কী কারণে গাড়িটা একটু আস্তে হতেই কাকাবাবু জানলার কাচে মুখ লাগিয়ে বাইরেটা দেখতে গেলেন।

অমনই একজন লোক রুক্ষভাবে তাঁর মুখটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, ওদিকে কী দেখছেন? চুপটি করে মুখ নিচু করে বসে থাকুন। টাকা পেয়ে গেছি, আপনাকে আমরা মেরে রাস্তায় ফেলে দিতে পারি তা জানেন?

কাকাবাবু বললেন, এমনই-এমনই মারতে ইচ্ছে হয় তো মারুন। সরকারি চাকরি করি। সরকার আমাকে পাঠিয়েছে এই দায়িত্ব দিয়ে, তাই বাধ্য হয়ে এসেছি।

অন্য লোকটি বলল, আগে টাকাগুলো গুনে দেখতে হবে।

কাকাবাবু হালকা গলায় বললেন, অনেক টাকার ব্যাপার। গুনতে-গুনতেই রাত কাবার হয়ে যাবে।

দাড়িওয়ালা লোকটি জিজ্ঞেস করল, আপনি সরকারের কী কাজ করেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি নিতান্ত চুনোপুঁটি। বড় বড় অফিসাররা কেউ আসতে রাজি হননি, তাদের প্রাণের দাম অনেক বেশি।

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, তা হলে চুপ করে বসে থাকো!

বাকি রাস্তা কেউ কোনও কথা বলল না। কাকাবাবু নিজের বুকে হাত বুলিয়ে যেতে লাগলেন।

গাড়িটা এসে থামল একটা টিলার কাছে। এর পর সিঁড়ি, গাড়ি আর যাবে। টিলার ওপরে একটা বাড়ি।

লোক দুটি তাদের কোটের পকেট থেকে দুটো বিদঘুটে অস্ত্র বার করল। ঠিক রিভলভার নয়, মনে হয় যেন রাইফেলের নল কেটে ছোট করা হয়েছে।

সেই অস্ত্র হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে তারা চারপাশ দেখল। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। চতুর্দিক এমনই শান্ত যেন একটা গাছের পাতা পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। খুব মিহি বৃষ্টিপাতও হচ্ছে নিঃশব্দে।

একজন কাকাবাবুকে বলল, নেমে এসো! কাকাবাবু নেমে এসে খানিকটা আতঙ্কের সঙ্গে বললেন, ওরে বাবা, কতগুলো সিঁড়ি? আমার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হয়!

লোকটি বলল, তোমাদের গভর্নমেন্ট একটা খোঁড়াকে পাঠাল কেন? আর কোনও লোক পায়নি?

কাকাবাবু বললেন, ছিঃ! কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলতে নেই। ছোটবেলা কেউ আপনাদের এটা শেখায়নি?

দাড়িওয়ালা লোকটি তার অস্ত্র দিয়ে কাকাবাবুর পিঠে বেশ জোরে একটা খোঁচা মেরে বলল, শাট আপ! তুমি আমাদের জ্ঞান দিচ্ছ? ওঠো!

কাকাবাবু খোঁচা খেয়ে উঃ শব্দ করে বললেন, উঠছি, উঠছি। একটু আস্তে, বেশি জোরে জোরে পারব না!

ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে লোক দুজনের একজন কাকাবাবুর সামনে, একজন পেছনে উঠতে লাগলেন। ক্রাচ বগলে নিয়ে কাকাবাবু কয়েক ধাপ উঠে-উঠে হাঁফ নেওয়ার জন্য একটু করে থামতে লাগলেন।

লোক দুটোর আর ধৈর্য থাকছে না। কাকাবাবুকে ধাক্কা মারতে মারতে বলতে লাগল, তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো।

প্রায় ষাট-সত্তর ধাপ ওঠার পর একটা চাতাল। একটা অসমাপ্ত বাড়ি। মনে হয় যেন একটা হোটেল, এখনও চালু হয়নি, চাতালটায় পাথর, সিমেন্ট, গ্রিল ছড়ানো রয়েছে। এখান থেকে দিনের বেলা নিশ্চয়ই অনেক বরফমাখা পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়।

দোতলার একটা ঘরে শুধু আলো জ্বলছে।

ওদের একজন টর্চ জ্বেলে সামনের দরজাটা খুলে ফেলল। তারপর কাকাবাবুকে নিয়ে উঠে এল ওপরে। কাকাবাবু একজন বাতিকগ্রস্ত বুড়োর মতন বলতে লাগলেন উফ, উফ, আর পারি না! আর পারি না!

আলো-জ্বলা ঘরটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এদের একজন সেই দরজায় টোকা মারতেই ভেতর থেকে প্রশ্ন এল, হু ইজ ইট?

দাড়িওয়ালা লোকটি বলল, সেম পার্টি।

এবার দরজা খুলে দিল একজন বেঁটেমতন লোক।

ঘরে অন্য কোনও আসবাব নেই, একটা ছোট টেবিল আর দুটি চেয়ার। টেবিলের ওপর একটা দাবার ছক পাতা। দুজন লোক বসে এখানে দাবা খেলে সময় কাটাচ্ছিল। বেঁটে লোকটি ছাড়া অন্য লোকটি বেশ লম্বা-চওড়া, সুট-টাই পরা, মুখে চাপ-দাড়ি ও গোঁফ, এর চশমা নেই। মাথায় শিখদের মতন পাগড়ি, হাতে লোহার বালা। এই লোকটিকেই নেতা গোছের মনে হয়।

সে জিজ্ঞেস করল, মিশান কমপ্লিট?

অন্য লোক দুটি হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল।

পাগড়ি-পরা লোকটি চেয়ারে বসেই হাত বাড়িয়ে দিল, সকলে তাকে করমর্দন করল।

প্রথম দাড়িওয়ালা লোকটি এবার তার সঙ্গী আর ঘরের বেঁটে লোকটিকে বলল, তোমরা বাইরে গিয়ে পাহারা দাও।

কাকাবাবু ভেবেছিলেন, এখানে আরও অনেক আতঙ্কবাদীদের দেখতে পাবেন। কিন্তু সব মিলিয়ে মাত্র চারজন। এত টাকা পয়সার ব্যাপার বলেই বোধ হয় অতি বিশ্বস্ত সঙ্গী ছাড়া আর কাউকে এরা সঙ্গে রাখে না। অনেক সময় বেশি টাকা দেখে মাথা খারাপ হয়ে এরা নিজেরাই মারামারি শুরু করে দেয়।

ওরা দুজনে চেয়ারে বসল। আর বসার জায়গা নেই, দাঁড়িয়ে থাকতে হল কাকাবাবুকে।

পাগড়ি-পরা লোকটি গম্ভীরভাবে বলল, কাউন্ট দা ডো! কুইক!

দুটো চামড়ার ব্যাগই তালা দেওয়া। প্রথম দাড়িওয়ালা লোকটি কাকাবাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, চাবি?

কাকাবাবু এ-পকেট ও-পকেট খুঁজতে লাগলেন। ওপরে রেইন কোট, তার তলায় জ্যাকেট, তার তলায় শার্ট। অনেক পকেট, চাবি আর খুঁজে পাওয়াই যায় না।

অতি কষ্টে একটা চাবি শেষপর্যন্ত পেয়ে কাকাবাবু সেটা এগিয়ে দিলেন।

প্রথম দাড়িওয়ালা তাড়াতাড়ি সেই চাবি দিয়ে ব্যাগ খুলতে গেল। চাবি লাগল না। দু-চারবার চেষ্টা করার পর বোঝা গেল, সেটা ভুল চাবি।

কাকাবাবু লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে বললেন, এই রে, ওটা আমার বাড়ির আলমারির চাবি। এই চাবি দুটো গেল কোথায়? ফেলে এলাম নাকি?

প্রথম দাড়িওয়ালা এবার উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে কাকাবাবুর গালে একটা চড় কষিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কুত্তার বাচ্চা, তুমি আমাদের সঙ্গে ইয়ার্কি করতে এসেছ এখানে?

কাকাবাবু বললেন, মারবেন না, আর মারবেন না। এবার ভাল করে খুঁজছি। আমার কি এত লক্ষ-কোটি টাকা নিয়ে চলাফেরা করার অভ্যেস আছে? দেখুন না, আমার হাত কাঁপছে।

এবার কয়েকটা পকেট খুঁজে কাকাবাবু অন্য একটা চাবি বার করলেন।

সেটা লাগাতেই একটা ব্যাগ খুলে গেল। প্রথমেই একটা সাদা কাগজ। প্রথম দাড়িওয়ালা লোকটিকে দ্রুত সেটা সরিয়ে ফেলতে দেখা গেল, ভেতরেও দিস্তে-দিস্তে সাদা কাগজ। একটা টাকাও নেই।

দুজন লোকই কাকাবাবুর দিকে রক্তচক্ষে তাকাল।

কাকাবাবু ফ্যাকাসে মুখে বললেন, এই রে? ভুল ব্যাগ দিয়ে দিল নাকি? আমি তো কিছু জানি না, আমি তো আর ব্যাগ খুলে দেখিনি।

প্রথম দাড়িওয়ালা তার অস্ত্র তুলে কাকাবাবুকে মারতে আসতেই তিনি বললেন, আগেই অত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? অন্য ব্যাগটা খুলে দেখুন হয়তো ওটার মধ্যেই সব টাকা আছে।

প্রথম দাড়িওয়ালা এবার দ্বিতীয় ব্যাগটা খুলে ফেলল।

সেটার মধ্যেও শুধু সাদা কাগজ। ওপরের কাগজটায় বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে, টিট ফর ট্যাট!

কাকাবাবু হা-হা করে হাসতে গিয়ে ওদের রাগে গনগনে মুখ দেখে চেপে গেলেন।

পাগড়ি-পরা শিখটি বলল, উই আর ডিউণ্ড! এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে হবে।

প্রথম দাড়িওয়ালা লোকটি বলল, এই খোঁড়াটাকে নিয়ে কী করব? একে শেষ করে দিই?

কাকাবাবু বললেন, না, না, আমাকে মেরে কী করবে? আমি তো সামান্য একজন দূত মাত্র। দূত অবধ্য, তা জানো না?

পাগড়ি-পরা লোকটি বলল, এই খোঁড়াটাকেও আমাদের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চলো বরং। আবার চিঠি পাঠাও যে, টাকা না পেলে একেও ছাড়া হবে না।

কাকাবাবু বললেন, আমার জীবনের কোনও দাম নেই। আমাকে বন্দি করলে কেউ এক টাকা দিয়েও ছাড়াতে যাবে না।

পাগড়ি-পরা লোকটি বলল, এর হাত দিয়েই চিঠি পাঠানো যাক। আর তিনদিন সময় বাড়িয়ে ফাইনাল আলটিমেটাম। টাকা না পেলে সাইমন বুবুম্বার চর খুন হবে?

কাকাবাবু বললেন, তাতেও বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হয় না। ভারত সরকারের টাকার টানাটানি চলছে। এক কোটি ডলার দিতে পারবেনা!

পাগড়ি-পরা লোকটি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তবে সাইমন বুবুম্বা খুন হবে। তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি যাও, গিয়ে তোমার সরকারকে এই কথাটা জানিয়ে দাও।

কাকাবাবু বললেন, সাইমন বুবুম্বা তো সোনার হাঁস। তাকে খুন করলে কি আর টাকা পাওয়ার কোনও আশা থাকবে? তা ছাড়া, সাইমন বুবুম্বা খুব চালাক লোক। তাকে খুন করা সহজ নয়। কে তাকে খুন করতে যাবে?

পাগড়ি-পরা লোকটি বলল, আমি। আমি নিজের হাতে তাকে খুন করব।

কাকাবাবু বললেন, অসম্ভব! তোমার পক্ষে সাইমন বুবুম্বাকে খুন করা অসম্ভব। তুমি বড়জোর আত্মহত্যা করতে পারো। কিন্তু তুমি তাকে কিছুতেই খুন করতে পারবে না। কারণ, তুমি নিজেই মহামান্য সাইমন বুবুম্বা। ভারত সরকারের বিশিষ্ট অতিথি!

একটুক্ষণের জন্য দুজনেই থ হয়ে গেল।

কাকাবাবু বললেন, তুমি যতই পাঞ্জাবি শিখের ছদ্মবেশ ধরে থাকো, তোমার উচ্চারণই তোমাকে চিনিয়ে দিয়েছে। খাঁটি অক্সফোর্ডের ইংরেজি। তুমি টাকাকে বললে ডো (Dough)। এখানে সবাই মানি বলে। এই লোকটি অসমের। অন্য যে-লোকটি ছিল সে অন্ধ্রপ্রদেশের। উচ্চারণ শুনে কে কোথাকার লোক আমি বুঝতে পারি।

প্রথম দাড়িওয়ালা বলল, এই লোকটা বড্ড বেশি জেনে গেছে। একে খতম করে দিতেই হবে!

সাইমন বুবুম্বা বলল, ফিনিশ হিম?

প্রথম দাড়িওয়ালা তার ওভারকোটের পকেট থেকে অস্ত্রটা বার করতে লাগল।

কাকাবাবু যেন সত্যিই এবার ঘাবড়ে গেলেন। তাঁর আত্মরক্ষার কোনও অস্ত্র নেই। তাঁর সারা শরীর বাঁশপাতার মতন কাঁপতে লাগল। তিনি অসহায়ভাবে বুকের কাছে হাত এনে রেইন কোটের একটা বোতাম ঘোরাতে লাগলেন।

প্রথম দাড়িওয়ালা তার দিকে অস্ত্রটা তুলতেই কাকাবাবুর মুখটা আবার বদলে গেল। জ্বলে উঠল দু চোখ। ঠাণ্ডা কঠিন গলায় তিনি বললেন, ব্লাড়ি ফুল, তুমি কাকে মারতে যাচ্ছ? এই লোকটা বিদেশি, কিন্তু তুমি তো আমাদের দেশের লোক। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। তুমি আমাকে চেনো না? আমাকে মারা অত সহজ? ভেবেছ আমি তৈরি হয়ে আসিনি!

কাকাবাবুর দৃষ্টিতে সম্মোহন আছে। প্রথম দাড়িওয়ালার মাথাটা একবার বোধ হয় ঝিমঝিম করে উঠল। মাথাটা দুবার ঝাঁকিয়ে সেটা কাটিয়ে বলল, কে রাজা রায়চৌধুরী? আমি চিনি না। তখন থেকে কথা বাড়িয়ে তুমি আমাদের ভাঁওতা দিচ্ছ।

সাইমন বুবুম্বা বলল, কিল হিম!

কাকাবাবু রেইন কোটের ওপরের বোতামটায় জোরে চাপ দিলেন। সেটা থেকে বিপ, বিপ, বিপ শব্দ হতে লাগল।

কাকাবাবু বললেন, এটা কী জানো না? এটা একটা অত্যন্ত পাওয়ারফুল ট্রান্সমিটার। অন্তত তিনটে ওয়ারলেস ভ্যান এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে, তারা জানে আমি ঠিক কোন জায়গাটায় আছি। আর পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে এই জায়গাটা কমান্ডো ফোর্স ঘিরে ফেলবে। তার মধ্যে আমাকে মেরে পালাতে পারবে?

প্রথম দাড়িওয়ালা কাকাবাবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রেইন কোটের বোতামটা এক র্যাচকা টানে ছিঁড়ে নিল। তারপর মাটিতে সেটাকে ফেলে নিজের অস্ত্রের কুঁদো দিয়ে দুমদুম পিটতে লাগল।

বোতামটা ভেঙে বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট ব্যাটারি দেওয়া যন্ত্র।

লোকটি মুখ তোলার আগেই কাকাবাবু একটা ক্রাচ ঘুরিয়ে দারুণ জোরে মারলেন তার হাতে। তার অস্ত্রটা ছিটকে চলে গেল ঘরের কোণে।

কাকাবাবু অবশ্য সেটা ধরতে পারলেন না। লোকটাই ঝাপিয়ে পড়ল সেটার ওপর।

তখনই বাইরে শোনা গেল সাব মেশিনগানের গুলির শব্দ।

কাকাবাবু বলে উঠলেন, যান, সাত মিনিটও লাগল না। ওরা এসে গেছে!

প্রথম দাড়িওয়ালা অস্ত্রটা তুলে এবার আর কাকাবাবুকে মারতে গেল না। সে চট করে অস্ত্রের মুখটা সাইমন বুবুম্বার গলায় চেপে ধরল।

তারপর হিংস্রভাবে বলল, আমাকে ধরতে পারবে না। আমি এই সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে যাব। আমাকে ধরার চেষ্টা করলেই একে আমি গুলি করব।

সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ শোনা গেল। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন নরেন্দ্র ভার্মা, তাঁর পাশে সাব মেশিনগান হাতে একজন কমান্ডো সেনা।

নরেন্দ্র ভার্মা দাড়িওয়ালা লোকটিকে ওই অবস্থায় দেখে বললেন, কটা গুলিতে ওর বডিটা ছুঁড়ে দেব? দশটা, না পনেরোটা?

লোকটা খ্যাপার মতন চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার, আমাকে মারার চেষ্টা করা হলেই আমি একে আগে মারব। পথ ছেড়ে দাও, আমাদের বেরিয়ে যেতে দাও।

কাকাবাবু কড়া গলায় বললেন, না! তুমি ওকে গুলি করতে চাও, করো। ওকে মারো। তাতে এখন আর আমাদের কিছু যাবে-আসবে না। সাইমন বুবুম্বা নিজেই আমাদের সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে পালিয়েছে। তারপর রটিয়ে দিয়েছে যে বিপ্লবীরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। আসলে মুক্তিপণের এক কোটি ডলার ও নিজেই নেওয়ার মতলবে ছিল। তোমাদের মতন কয়েকটা বিপ্লবী দলের সাহায্য নিয়েছে, এখানে-ওখানে দু-একটা নকল সাইমন বুবুম্বা সাজিয়ে পুলিশের চোখকে ধুলো দিতে চেয়েছে। এখন ও মারা গেলেও আমরা প্রমাণ করব, নিজের দোষে মরেছে।

সাইমন বুবুম্বা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। কোনও কথা বলতে পারছে না।

কাকাবাবু প্রথম দাড়িওয়ালাকে ধমকে দিয়ে বললেন, দেরি করছ কেন, ওকে মারো। তাতে আমাদের অনেক ঝামেলা চুকে যায়। তারপর কিন্তু তুমি আর কাল সকালের সূর্যের আলো দেখতে পাবে না। এখনও ধরা দিলে তবু প্রাণে বাঁচতে পারো।

কমান্ডোটি নিজের সাব মেশিনগান তুলে বলল, কে আগে গুলি করবে?

প্রথম দাড়িওয়ালাটি এবার তার হাতের অস্ত্র ফেলে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে পেছন থেকে আর-একজন এসে বেঁধে ফেলল তার হাত।

নরেন্দ্র ভার্মার পাশ দিয়ে সন্তু ঠেলেঠুলে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তোমার কিছু হয়নি তো? ওরা তোমাকে মারেনি তো? ওঃ, এতক্ষণ ধরে..।

কাকাবাবু বললেন, না রে, আমার কিছু হয়নি। আমার চোখের দিকে তাকালে কেউ আর আমাকে গুলি করতে পারে না, আমি লক্ষ করেছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, চেহারায় তো মিলছে না। সাইমন বুবুম্বার দাড়ি-গোঁফ নেই। এদের দুজনেরই দেখছি ঘন দাড়ি। ছদ্মবেশ? কোনজন আসল সাইমন বুবুম্বা?

কাকাবাবু বললেন, নকল দাড়ি-গোঁফ বোঝাই যাচ্ছে। আমি দেখছি।

তারপর তিনি হঠাৎ প্রথম দাড়িওয়ালাটির দাড়ি ধরে এক টান দিলেন। সে আঁ-আঁ করে চিৎকার করে বলে উঠল, আমারটা নকল না, নকল না..

কাকাবাবু তবু ছাড়লেন না। লোকটার আসল দাড়ি হলেও এক মুঠো উপড়ে তুলে আনলেন। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগল।

কাকাবাবু তেতো গলায় বললেন, এ আমাকে চড় মেরেছিল। আমাকে খুন করার জন্য অস্ত্র তুলেছিল। আমার প্রতিজ্ঞা আছে, যে আমার দিকে অস্ত্র তুলবে, তাকে আমি কিছু না কিছু শাস্তি দেবই! এরা সামান্য টাকার জন্য একজন বিদেশির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। এরা:তো পাঁচ-দশ লাখ টাকা পেলেই খুশি। সাইমন বুবুম্বা এক কোটি ডলার আদায় করার তালে ছিল, তার থেকে বিশ-পঁচিশ লাখ খরচ করাও কিছুই না।

তারপর তিনি সাইমন বুবুম্বার দিকে চেয়ে বললেন, কী, তোমার দাড়ি-গোঁফও টেনে খুলতে হবে নাকি?

সাইমন বুবুম্বা এবার নিজেই দাড়ি-গোঁফ খুলে ফেলল।

একজন কমান্ডো অমনই তার পাশে গিয়ে কোটের পকেটে হাত ঢোকাতে গেল।

সাইমন বুবুম্বা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, খবর্দার, আমার গায়ে কেউ হাত দেবে। আমার ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি আছে। আমি আমার দেশের প্রতিনিধি।

কাকাবাবু বললেন, ফের বড়-বড় কথা! তুমি বাধা দিলে তোমাকে পিটিয়ে অজ্ঞান করে সার্চ করা হবে।

সাইমন বুবুম্বা নিজেই কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট কোল্ট রিভলভার বার করে বলল, এটা ছাড়া আমার কাছে কিছু নেই।

কমান্ডোটি তবু অন্য পকেটটাও দেখল। সেখানে রয়েছে শুধু একটা চকোলেট বার।

কাকাবাবু বললেন, এবার চেহারা মিলেছে তো?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, উফ বাবা! পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত!

কাকাবাবু বললেন, কী রে সন্তু, এর আবার টিকিফিকি নেই তো? ভাল করে দেখে নিয়েছিস?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমি একবার সাইমন বুবুম্বাকে সার্চ করে দেখতে পারি? কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, কেন? ওর কাছে আরও অস্ত্র লুকনো আছে নাকি?

সন্তু বলল, তবু আমি একবার দেখতে চাই। আমার একটা সন্দেহ। হচ্ছে।

কাকাবাবু নরেন্দ্র ভার্মার দিকে তাকালেন। নরেন্দ্র ভার্মা মাথা নেড়ে বললেন, গো অ্যাহেড, সনটু!

সন্তু এগিয়ে যেতেই সাইমন বুবুম্বা চিৎকার করে উঠল, না, না, আমাকে ছোঁবে না। আমার ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি আছে। তোমাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে!

নরেন্দ্র ভার্মা দুজন কমান্ডোকে ইঙ্গিত করলেন, তারা দুদিক থেকে সাইমন বুবুম্বার হাত চেপে ধরল শক্ত করে।

সন্তু ওর সারা শরীর থাবড়ে-থাবড়ে দেখতে লাগল। পেটের কাছে শক্ত কিছুতে হাত ঠেকতেই সাইমন বুবুম্বা দুর্বোধ ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল আর-একবার। সন্তু ওর ওভারকোটের বোম খুলে, ভেতরের জামা খুলে একটা ছোট ভেলভেটের বাক্স টেনে বার করল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সাবধান, ওর মধ্যে বোমা-টোমা আছে নাকি?

কোনও দ্বিধা না করে সন্তু বাক্সটা খুলে ফেলল, ভেতরের জিনিসটা দেখে হাসিতে ভরে গেল তার মুখ। সে বলল, এই নাও, চাঁদের পাথর!

কাকাবাবু বিরাট বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, অ্যাঁ?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হোয়াট?

দুজনেই দেখলেন, ওরকম একটা দামি বাক্সের মধ্যে রয়েছে একটা সাধারণ চেহারার পাথর। তার একটা কোণ সদ্য ভাঙা হয়েছে!

কাকাবাবু বললেন, এর সাইজ আর শেপ তো চাঁদের পাথরের মতনই। কলকাতা থেকে যেটা চুরি গেছে। তুই এটা কী করে আন্দাজ করলি রে, সন্তু? চাঁদের পাথরটার ব্যাপার তো আমার মাথাতেই ছিল না। সাইমনের সঙ্গে ওই চুরির কোনও যোগ থাকতে পারে, তাও আমি একবারও ভাবিনি।

সন্তু বলল, ওর হাতের আংটিটা দ্যাখো?

সাইমনের হাতে একটা মাত্র আংটি। তার মাঝখানে একটা এবড়ো-খেবড়ো সাধারণ পাথর বসানো।

সন্তু বলল, জোজোর কাছে শুনেছি, ইনি যাতে তাড়াতাড়ি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, সেইজন্য জোজোর বাবা এঁকে একটা মুনস্টোনের আংটি ধারণ করতে দিয়েছিলেন। মুনস্টোন তো হলদে-বাদামি, চকচকে পাথর। এঁর আংটির পাথরটা সেরকম নয়। তাইতে আমার সন্দেহ হল। ইনি বোধ হয় ভেবেছেন, আসল চাঁদের পাথর দিয়ে আংটি পরলে আরও বেশি কাজ হবে।

কাকাবাবু বললেন, সেইজন্য চাঁদের পাথরটা নিজে চুরি করেছে কিংবা টাকা দিয়ে চুরি করিয়েছে! তুই ঠিক ধরেছিস তো, সন্তু! তোর তো সাঙ্ঘাতিক চোখ হয়েছে। আমরা কেউ লক্ষই করিনি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ব্রাভো, সন্তু, ব্রাভো। চাঁদের পাথরটা পাওয়া গেল, আমেরিকার কাছে আমাদের মুখরক্ষা হবে। এ যে দারুণ ব্যাপার। রাজা, সন্তুর যেরকম চোখ আর বুদ্ধি হয়েছে, তাতে কালে কালে ও তোমাকেও ছাড়িয়ে যাবে!

কাকাবাবু বললেন, তাই তো দেখছি!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ওঃ, যা আনন্দ হচ্ছে আমার! কাল সকলেই এঁকে দিল্লি নিয়ে যেতে হবে স্পেশ্যাল প্লেনে!

সাইমন বুবুম্বা এবার বলে উঠল, আমাকে এখানকার কোনও হোটেলে নিয়ে চলো। আমি এখন দিল্লি যাব না। এখানে বিশ্রাম নেব।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, দিল্লি গিয়ে চুক্তিটা সই করবেন, তারপর যত খুশি বিশ্রাম নেবেন।

সাইমন বুবুম্বা বলল, আমি তোমাদের দেশের সঙ্গে চুক্তিতে সই করব।

নরেন্দ্র ভার্মা হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, সই করবেন না মানে? আপনাকে আমি ঘাড় ধরে দিল্লি নিয়ে যাব। সেখানে গিয়ে চুক্তিটা সই করবার পর আমার। শান্তি হবে!

সাইমন বুবুম্বাও তেজের সঙ্গে বলে উঠল, আমি সই না করলে, আমাকে দিয়ে জোর করে সই করাবে? দেখি কেমন পারো!

কাকাবাবু বললেন, না, জোর করে সই করানো যায় না! দশ মিলিয়ান ডলার ফসকে গেল বলে বুঝি আর সই করতে চাও না? ঠিক আছে, সই কোরো না! কিন্তু তা হলে তুমি দেশে ফিরতেও পারবে না। চাঁদের পাথর চুরি করাটাই একটা বিরাট অপরাধ। তা ছাড়া ভারত সরকারকে দশ মিলিয়ন ডলার ঠকাবার ষড়যন্ত্রের জন্যও তোমার বিচার হবে। অন্তত দশটি বছর জেল হবে নির্ঘাত। তোমার দাদা, প্রেসিডেন্ট বুবুম্বাকে জানানো হবে সব কথা। তোমাকে জেলে পাঠালে আশা করি তিনি খুশিই হবেন। তোমার আর পরের বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানো হবে না।

সাইমন বুবুম্বা এবার লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এখন চলুন। আপনাকে আর কী বলব। দু বছর আগে টার্কিতে আপনি এই একই কায়দায় দু কোটি ডলার আদায় করেছিলেন, ইচ্ছে করে এক জায়গায় লুকিয়ে থেকে মুক্তিপণ নিয়ে নিয়েছেন নিজেই। টার্কিতে তো রাজা রায়চৌধুরী নেই। এখানে আপনার জারিজুরি কিছুই খাটল না শেষপর্যন্ত। রাজা রায়চৌধুরী সব বানচাল করে দিল।

কাকাবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন, আরে যাঃ, আমি আর এমন কী করেছি! চাঁদের পাথরটা তো বার করল সন্তুই। তারপর তুমি দলবল নিয়ে ঠিক সময়ে এসে গেলে, নেপাল সরকার সবরকম সাহায্য করল, সেইজন্যই তো এদের প্ল্যান ভেস্তে গেল!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা ঠিক। তুমি কিছুই করোনি! তুমি একা এদের কাছে এলে, ব্যাগের মধ্যে সাদা কাগজ ভরে… অন্তত আমার তো এত সাহস হত না!

 

এর দুদিন পরে টিভিতে দেখানো হল যে মুরুণ্ডির সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই হল দিল্লিতে। সই হওয়ার পর সাইমন বুবুম্বা আর আমাদের অর্থমন্ত্রী করমর্দন করে হাসি-হাসি মুখে তাকালেন ক্যামেরার দিকে। পটাপট অনেক ছবি উঠল। এই চুক্তি সইয়ের পেছনে যে কত কাণ্ড ঘটেছে, তা কেউ জানল না, খবরের কাগজেও কিছু ছাপা হল না।

এরও এক মাস পরে কাকাবাবু একটা চিঠি পেলেন দিল্লির এক দূতাবাস থেকে। মুরুন্ডির রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন যে, তিনি তার দেশের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে এই চিঠি লিখছেন। প্রেসিডেন্ট জানাতে বলেছেন যে, তার ভাই সাইমন বুবুম্বা ভারতে এসে কী কী অপকীর্তি করেছে, তা ভারত সরকার না জানালেও তিনি জানতে পেরেছেন অন্য সূত্র থেকে। সেজন্য তিনি মর্মান্তিক দুঃখিত। সাইমন বুবুম্বার কাছ থেকে সমস্ত সরকারি ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে পাঁচ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এও জেনেছেন যে, প্রধানত মিঃ রাজা রায়চৌধুরীর চেষ্টাতেই সাইমন বুবুম্বার ওইসব অপচেষ্টা, নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য প্রেসিডেন্ট মিঃ রাজা রায়চৌধুরীকে ব্যক্তিগত ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। মিঃ রাজা রায়চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট তার দেশে আমন্ত্রণ জানাতে চান। মিঃ রাজা রায়চৌধুরী যদি সপরিবারে এক মাসের জন্য মুরুণ্ডিতে এসে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে থেকে যান, তা হলে প্রেসিডেন্ট খুব খুশি হবেন।

সন্তু আর জেজো তখন পাশের ঘরে ক্যারাম খেলছে।

কাকাবাবু চিঠিখানা ওদের পড়ে শোনালেন। তারপর বললেন, শেষের প্রস্তাবটা মন্দ না। শুনেছি মুরুন্ডি দেশটা ছোট্ট হলেও খুব সুন্দর। ওদের পয়সায় ওখানে কিছুদিন বেড়িয়ে এলে বেশ হয়। এবার আর কোনও চোর-ছাঁচোড় কিংবা খুনে-গুণ্ডার পেছনে ছোটাছুটি নয়। শুধু ভ্ৰমণ আর বিশ্রাম। কী রে, যাবি নাকি সন্তু?

সন্তু প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, হ্যাঁ, যাব। তুমি ওদের শিগগির লিখে দাও।

জোজোও বলে উঠল, আমিও যাব। আমাকেও নিয়ে চলুন কাকাবাবু। আমি কখনও আফ্রিকায় যাইনি?

সন্তু অবাক হয়ে, বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল জোজোর দিকে।