২২. সামনে একটা টানা বারান্দা

সামনে একটা টানা বারান্দা। কোথাও কেউ নেই। তবে কিসের একটা শব্দ যেন পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমে মনে হয়েছিল মেঘের গর্জন। কিন্তু একটু আগেই সন্তু জানলা দিয়ে দেখেছে যে আকাশ একেবারে নীল, কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। তারপর মনে হল, কেউ যেন পাথরের ওপর একটা পাথর ঘষছে। আরও একটু মন দিয়ে শোনবার পর সন্তু বুঝতে পারল, আসলে ওটা কারুর নাক ডাকার আওয়াজ।

আওয়াজটা পাশের একটা ঘর থেকে আসছে। সন্তু পা টিপে টিপে সেদিকে এগোল। সে-ঘরের দরজা বন্ধ। সন্তু হাত দিয়ে একটু ঠেলল, তবু সেটা খুলল না।

সন্তু আর একটু এগিয়ে গিয়ে আর একটা ঘর দেখতে পেল। এ ঘরের দরজা ভোলা। কোনও বিছানা-টিছানা নেই, খালি মেঝের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে কর্নেল আর দুজন লোক। কর্নেল-এর মাথার কাছে রয়েছে রিভল্ডার। বোধহয় ওদের পাহারা দেবার কথা ছিল।

সন্তুর একবার লোভ হল চুপি চুপি গিয়ে টপ্ করে রিভল্‌ভারটা তুলে নেয়। তারপর নিজেকে সামলে নিল। যদি হঠাৎ জেগে ওঠে ওরা কেউ, তা হলে মুশকিল আছে। কর্নেল লোকটা বড় নিষ্ঠুর ধরনের।

সন্তু এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। তার বুন্দ্রে ভেতরটা ছমছ করছে। তাকে যে কেউ বাধা দিচ্ছে না, এটাতেই ভয় লাগছে বেশি। খালি মনে হচ্ছে, আড়াল থেকে কেউ যেন তাকে লক্ষ করছে। হঠাৎ ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

একতলাতেও কারুকে দেখা গেল না। সেই মেজর-ই বা গেল কোথায়? একতলায় সবকটা ঘর তালাবন্ধ। অনেক দিন সেইসব তালা খোলা হয়নি মনে। হয়। মাঝখানে একটা উঠোন। তার এক পাশে একটা ছোট দরজা, সেটা দিয়ে বোধহয় বাড়ির পেছনটায় যাওয়া যায়।

সন্তু সেই দরজার কাছে এসে উকি মারল। কাছেই একটা কুয়ো। বেশ উঁচু করে পাড় বাঁধানো। দুটো খরগোশ সেখানে ঘুরঘুর করছে। সন্তু কোনও শব্দ করেনি, শুধু তার ছায়া পড়তেই ওরা টের পেয়ে গেল। দুএক পলক কান খাড়া করে খরগোশ দুটো দেখল সন্তুকে। তারপরই পেছন দিকটা উঁচু করে মারল লাফ। প্রায় চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা।

সন্তু কুয়োটার কাছে এসে এদিক-ওদিক তাকাল। খরগোশ দুটোর গায়ের রং পুরো সাদা নয়, খয়েরি-খয়েরি, তার মানে ওরা বুনো খরগোশ। একটু দূরে একটা করমচা গাছের নীচে আর একটা খরগোশ বসে আছে। এবারেও এর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই দৌড় মারল। বেশ মজা লাগল সন্তুর। এখানে তো অনেক খরগোশ। সেইজন্যই কাল রাত্রে মেজর লোভ দেখাচ্ছিল খরগোশের মাংস খাওয়াবার।

বাড়ির পেছন দিকটায় এক সময় নিশ্চয়ই বেশ বড় বাগান ছিল। এখন ফুলগাছ-টাছ বিশেষ নেই, আগাছাই বেশি। বাউণ্ডারি দেওয়ালের পাশে পাশে রয়েছে অনেকগুলো কাঁঠাল গাছ। তাতে কত যে কাঁঠাল ফলে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। অনেকগুলো পাকা কাঁঠাল মাটিতে পড়ে আছে, কেউ খায় না বোধহয়। সন্তুও কাঁঠাল খেতে ভালবাসে না। কিন্তু এঁচোড়ের তরকারি তার ভাল লাগে। এত কাঁঠালে কত এঁচোড়ের তরকারিই না হতে পারে!

শিশির ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সন্তু যেন হঠাৎ ডাকাতফাকাত, গুপ্তধন, মারামারির কথা সব ভুলে গেল। মাথার ওপর নীল আকাশ, ঝকঝকে রোদ উঠেছে, বাতাসও ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। সন্তুর মনে হল সে যেন কোথাও বেড়াতে এসেছে। টিলার ওপর এইরকম একটা বাড়ি, কাছাকাছি মানুষজন নেই। এই রকম জায়গা বেড়াবার পক্ষে খুব চমৎকার। মা বাবা আর সবাই মিলে এলে কী ভাল হত।

হাঁটতে হাঁটতে সন্তু বাড়িটার সামনের দিকে চলে এল। গেটের কাছে তিনটে ঘোড়া এখনও বাঁধা আছে। ঘোড়াগুলোকে দেখে সন্তুর কালকের রাতের কথা মনে পড়ল। বাব্বাঃ, এক রাতের মধ্যে কত কী কাণ্ডই না ঘটেছে! যাই হোক, শেষ পর্যন্ত এই ডাকাতরা সন্তুকে ধরে আনলেও সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই যে, কাকাবাবুর আর অসুখ নেই, তিনি ভাল আছেন।

কাকাবাবু কি তার চিঠিটা পেয়ে গেছেন এতক্ষণে?

সন্তু একবার মুখ ফিরিয়ে বাড়িটার দিকে তাকাল। কই, কেউ তো জাগেনি। কেউ তো তার ওপর নজর রাখছে না। সন্তু এখন স্রেফ একটা দৌড় মেরে পালিয়ে গেলে কে তাকে ধরবে? ·

ঘোড়াগুলোর কাছে এসে সন্তু দাঁড়াল। এগুলো বেশি বড় ঘোড়া নয়। পাহাড়ি টাট্ট ঘোড়া। এই একটা ঘোড়ার পিঠে চেপে পালালে কেমন হয়?

সন্তু কখনও ঘোড়ায় চড়া শেখেনি। তবু তার ধারণা হল, টাটু-ঘোড়ার পিঠে চাপা সহজ। যে-কেউ পারে। একটা ঘোড়ার পিঠে হাত রাখল সন্তু, ঘোড়াটা শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল, সন্তুকে লাথি-টাথি কিছু মারার চেষ্টা করল না।

ঘোড়ায় চাপার ইচ্ছেটা সন্তুর একেবারে অদম্য হয়ে উঠল। একটা ঘোড়ার বাঁধন খুলে দিয়ে লাগামটা হাতে নিল সে। পিঠে কিন্তু জিন নেই। লাফিয়ে কী করে পিঠে উঠবে, ভাবতে ভাবতে সন্তুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। লোহার গেট বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠে তারপর ঘোড়ার পিঠে চাপা যেতে পারে।

সেইভাবে ঘোড়াটায় উঠে সন্তু বলল, হ্যাট হ্যাট!

কিন্তু ঘোড়াটা নট নড়নচড়ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সন্তু তার হাঁটু দিয়ে কয়েকটা গোঁত্তা দিলেও কোনও লাভ হল না।

কিন্তু একবার ঘোড়ায় চেপে পালাবার প্ল্যান করে আবার সেটা বদলাবার কোনও মানে হয় না। এখন যদি কেউ এসে পড়ে তা হলে সন্তুকে দেখে নিশ্চয়ই হাসবে। ঘোড়ায় চড়া বীরপুরুষ, অথচ ঘোড়া ছোটাতে জানে না!

মরিয়া হয়ে সন্তু টু দিয়ে গোঁত্তাও মারতে লাগল, আর লাগামটা ধরেও টানতে লাগল খুব জোরে।

তাতে ঘোড়াটা চি-হি-হি-হি আওয়াজ করে শূন্যে দুপা উঁচু করল একবার। তারপর ছুটতে লাগল।

প্রথম ঝাঁকুনিতে সন্তু প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, কোনও রকমে সামলে নিল নিজেকে। কিন্তু বঙ্গটা আর ধরতে পারল না কিছুতেই।

ঘোড়াটা যখন বেশ জোরে টিলার নীচের দিকে নামতে লাগল, তখন সন্তুর মনে হল, সে আর কিছুতেই ব্যালান্স রাখতে পারবে না। এই অবস্থায় ছিটকে পড়ে গেলে হাত-পা ভাঙবে নিশ্চয়ই। আর কোনও উপায় না দেখে সন্তু ঘোড়াটার গলাটা জড়িয়ে ধরল প্রাণপণে।

ঘোড়াটাও বেশ অবাক হয়েছে নিশ্চয়ই। কারণ সে মাঝে মাঝেই চি-হি-হি-হি করে ডাক ছাড়ছে। সে ছুটছেও এলোমেলোভাবে। টিলাটার নীচেই জঙ্গল, সেখানে ঢুকে ঘোড়াটা ফাঁকা জায়গা ছেড়ে বড় বড় গাছের ধার ঘেঁষে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সন্তুর গা ঘষটে যাচ্ছে। এক একবার সে ভাবছে কোনও গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়বে কি না। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না।

কোনদিকে যে ঘোড়াটা যাচ্ছে তাই বা কে জানে! জঙ্গল ক্রমেই ঘন হচ্ছে। কাল রাত্তিরে এই পথ দিয়েই গিয়েছিল কি না তা সন্তুর মনে নেই। অন্ধকারের মধ্যে ভাল করে কিছু দেখতেই তো পায়নি সে।

প্রায় আধঘণ্টা বাদে ঘোড়াটা একটা নদীর সামনে থামল। কাল রাতেও সন্তুরা একটা নদী পার হয়েছিল। এটা কি সেই নদী? তাই বা কে জানে!

যা থাকে কপালে ভেবে সন্তু লাফিয়ে নেমে পড়ল নদীর ধারের নরম মাটিতে। আসলে ওইভাবে ঘোড়ার গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওরকমভাবে আর যাওয়া যাবে না।

যাই হোক, সন্তু মোটামুটি তার সার্থকতায় বেশ খুশি হয়েছে। বিনা বাধাতেই সে পালিয়ে আসতে পেরেছে। এখন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে তার কোনও আপত্তি নেই। ঘুরতে ঘুরতে ঠিক কোনও এক সময় সে একটা কোনও শহরে পৌছে যাবে।

এতক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে সন্তু কোনও মানুষজন দেখেনি। এবারে নদীর ধারে সে যেন কাদের কথাবাতার শব্দ শুনতে পেল।

একটা কী যেন বড় গাছ নদীর ওপরে অনেকখানি ঝুঁকে আছে। কথা শোনা যাচ্ছে তার ওধার থেকেই। সন্তু আস্তে আস্তে গিয়ে গাছটার কাছে দাঁড়াল। পাতার ফাঁক দিয়ে দেখল দুজন জেলে মাছ ধরছে। একজন বয়স্ক লোক, একজন প্রায় সন্তুর সমান।

সন্তু ভাবল, যাক, ভয়ের কিছু নেই। তবে তক্ষুণি সে লোকগুলোর কাছে গেল না। এদিকেই একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসল। ওদের কথাবার্তা সে শুনতে পাচ্ছে। একটু পরেই ওদের কয়েকটা কথা শুনে সে উৎকর্ণ হয়ে উঠল।

বয়স্ক জেলেটি ছোট ছেলেটিকে বলছে, সবই কপাল, বুঝলি? আমিও মাছ ধরি আর তোর সুবলকাকুও মাছ ধরত। সেই ছোটবেলা থেকে আমরা সমানে এই কাজ করেছি। মাছ ধরা ছাড়া আমরা আর কিছু জানি না। অথচ, আজ আমি কোথায় আর তোর সুবলকাকু কোথায়!

ছেলেটি বলল, সুবলকাকুকে তো সাপে কামড়েছে!

জেলেটি বলল, সাপে কী আর এমনি এমনি কামড়েছে। নিয়তি যে ওরে টেনে নিয়ে গেছে। আমি বারণ করেছিলুম।

ছেলেটি বলল, মাছধরা ছেড়ে সুবলকাকু জঙ্গলে খরগোশ মারতে গিয়েছিল।

খরগোশ না হাতি! আমরা জলের মাছ মারতে জানি, ডাঙার শিকারের কী জানি! আসল কথা কী জানিস, একদিন হাট থেকে সুবল আর আমি ওই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফিরতেছিলাম, এমন সময় কী যেন একটা জিনিস চকচক করে উঠল। একটুখানি মাটি খুঁড়ে সুবলই সেটা টেনে তুলল। সেটা একটা সোনার টাকা। আগেকার রাজা মহারাজাদের আমলে ওই রকম টাকার চল ছিল। তা সেই টাকাটা পেয়ে সুবলের কী আহ্লাদ। লাফাতে লাগল একেবারে। আমি বললুম, ওরে সুবল, এসব বড় মানুষদের জিনিস, গরিবের ঘরে রাখতে নেই। ও টাকাটা তুই থানায় জমা দিয়ে দে। তা সে কথা সে কিছুতেই শুনবে না। সোনার টাকা পেয়ে একেবারে পাগল হয়ে গেল। অন্য কাজকম্ম সব ছেড়েছুড়ে দিনরাত জঙ্গলে পড়ে থাকত। লোককে বলত খরগোশ মারতে যায়, কিন্তু আমি তো জানি! ও সেখেনে যত গর্ত আছে আর পাথরের ফোঁকর আছে, সব জায়গায় হাত ভরে ভরে খুঁজত। সেইরকম একটা গর্তে হাত ঢুকিয়েই তো সাপের কামড় খেলে!

ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, জঙ্গলের মধ্যে একখানা সোনার টাকা এল কী করে?

বয়স্ক লোকটি বলল, ও জায়গাটারে কয় জঙ্গলগড়। এককালে ওখানে ত্রিপুরার এক মহারাজা এসে লুকিয়ে ছিলেন। তাই লোকে এখনও বলে, ওখানকার মাটির নীচে অনেক সোনাদানা পোঁতা আছে।

জঙ্গলগড়ের নাম শুনেই সন্তু উঠে দাঁড়িয়েছে। এই বয়স্ক লোকটি তা হলে জানে জঙ্গলগড় কোথায়? তা হলে তো এক্ষুণি ওর সঙ্গে ভাব করা দরকার।

কিন্তু সন্তু ওদের সঙ্গে কথা বলতে যাবার আগেই অন্য একটা শব্দ শুনতে পেল। টগ্‌বগ্‌ টগ্‌বগ্‌ করে ঘোড়া ছুটিয়ে কারা যেন এদিকেই আসছে।