১৭. একটা গাড়ি এসে থামল

একটা গাড়ি এসে থামল বাড়িটার সামনে। তার থেকে নামলেন পুলিশের কতা শিশির দত্তগুপ্ত।

নরেন্দ্র ভার্মা দোতলার সিঁড়ির কাছে রিভলভার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, শিশির দত্তগুপ্তকে দেখে বললেন, আমাদেরই লোক! কী আশ্চর্য, আপনি?

টকটক করে জুতোর শব্দ তুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে আসতে শিশিরবাবু বললেন, আপনাদের গাড়ি মাঝরাস্তায় খারাপ হয়ে আছে দেখলাম! আপনারা ঠিক সময়ে পৌঁছতে পেরেছিলেন? ওরা ধরা পড়েছে তো?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, না, আমরা বহুত দেরি করে ফেলেছি। সব ব্যাটারা ভেগেছে। সন্তুকে পাকাড়কে লিয়ে গেছে। কিন্তু আপনার তো শরীর খুব খারাপ। একশো পাঁচ ফিভার হয়েছে শুনলাম।

দেববর্মন বললেন, আপনার স্ত্রী বললেন, আপনার ম্যালেরিয়া হয়েছে—

শিশিরবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার হাই ফিভার হয়েছিল, তাই আপনাদের সঙ্গে আসতে পারিনি। কিন্তু থাকতে পারলাম না। এখনও জ্বর আছে, যাক গে, সে এমন কিছু নয়, এখানে কী হল বলুন!

কাকাবাবু দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বললেন, সেসব কথা পরে হবে। এখানে একজন ইনজিওরড হয়ে আছে, আগে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার।

শিশির দত্তগুপ্তও কাকাবাবুকে সুস্থ মানুষের মতন কথা বলতে শুনে নরেন্দ্র ভামার মন খুব অবাক হয়ে গেলেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি তা হলে–

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, হ্যাঁ, এখন সুস্থ হয়ে গেছি। চলুন, আগরতলায় ফেরা যাক্।

প্রকাশ সরকার এগিয়ে এসে বললেন, আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমার ইনজুরি মারাত্মক কিছু না।

কাকাবাবু বললেন, এখানে আর থাকবার কোনও দরকার নেই। কাকাবাবু সিঁড়ির রেলিং ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করলেন। শিশিরবাবু তাড়াতাড়ি কাছে এসে বললেন, আমি ধরছি। আপনি আমার কাঁধে ভর দিন।

কাকাবাবু বললেন, কোনও দরকার নেই। আমার অসুবিধে হচ্ছে না। শিশিরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ভাইপোকে ধরে নিয়ে গেল? ওরা কতজন এসেছিল বলুন তো?

পাঁচ-ছজন হবে। তার মধ্যে একজনের নাম রাজকুমার, বেশ লম্বা, মজবুত স্বাস্থ্য, নস্যিরঙের সুট পরা। আর একজনকে ওরা কর্নেল বলে ডাকছিল।

কর্নেল? ওর চেহারাটা কী রকম বলুন তো? মুখখানা বুলডগের মতন?

তা খানিকটা মিল আছে বটে। নাকটা থ্যাবড়া। মনে হয় নাকের ওপর দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেছে।

সে তো একজন সাঙ্ঘাতিক খুনি! টাকা নিয়ে মানুষ খুন করে।। কিন্তু-কিন্তু ওই রকম একজন ভাড়াটে খুনি আপনাকে মারতে আসবে কেন? আপনার ওপর কার এত রাগ থাকতে পারে?

কার রাগ আছে, তা আমি জানি না। তবে মনে হচ্ছে, কারুর কারুর কাছে।

আমি খুব দামি হয়ে গেছি। যে-কোনও উপায়ে তারা আমার মাথাটা চায়।

আপনার মাথা?

হ্যাঁ। কাটা মুণ্ডু নয়। জ্যান্ত মাথা। কেন জানেন? আমি কিছুদিন আগে ত্রিপুরায় এসে এক জায়গায় একটা খুব পুরনো মুদ্রা খুঁজে পেয়েছিলাম। রাজা মুকুট-মাণিক্যের মুদ্রা, তাতে একটা ঈগল পাখির ছবি আঁকা। ত্রিপুরার রাজাদের মুদ্রায় সিংহের মূর্তি থাকত, শুধু ওই একজনের মুদ্রাতেই ঈগলের ছবি ছিল। সেই জন্যই ওই মুদ্রা খুব দুর্লভ আর দামি।

হাঁ, এরকম একটা মুদ্রা আবিষ্কারের কথা কাগজে বেরিয়েছিল বটে। আপনিই সেই লোক? আপনি আগে ত্রিপুরায় এসেছিলেন?

অনেকবার। তবে বেসরকারিভাবে। সেইজন্যই আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। আপনি কি ত্রিপুরার লোক?

আমাদের পূর্বপুরুষরা ত্রিপুরাতেই ছিলেন বটে, তবে আমার জন্ম কুমিল্লায়। সেইখানেই পড়াশুনো করেছি।

অমরমাণিক্যের গুপ্তধন? সে তো একটা গুজব! সেরকম কিছু আবার আছে নাকি?

আছে কি না তা আমিও জানি না। না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তবে কারুর কারুর বোধহয় ধারণা হয়েছে, আমি অমরমাণিক্যের জঙ্গলগড়ের সন্ধান জেনে ফেলেছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, গুপ্তধন, মানে হি ট্রেজার? এই যুগে? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

শিশিরবাবুও হেসে বললেন, আমারও ধারণা, এসব একেবারে বাজে কথা। ওই গুপ্তধনের গুজব এখানে অনেকদিন ধরেই চালু আছে! এ-সম্পর্কে দেববর্মন ভাল বলতে পারবেন।

দেববর্মন বললেন, রাজা অমরমাণিক্য সম্পর্কে অনেক রকম গল্প আছে, গান আছে। তাঁর ওই গুপ্তধনের কথাটা অনেকেই বিশ্বাস করে। এখনও কেউ কেউ ওই গুপ্তধনের খোঁজে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।

প্রকাশ সরকার বললেন, ত্রিপুরায় আমার মামার বাড়ি। ছোটবেলায় আমিও এই গুজবের কথা শুনেছি।

কথা বলতে বলতে বাড়ির বাইরে চলে এসেছেন ওঁরা। শিশিরবাবুর জিপগাড়িটার হেডলাইন দুটো জ্বালানো হয়েছে। রাত্রির অন্ধকার চিরে সেই আলোর রেখা চলে গেছে অনেক দূরে।

দেববর্মন শিশিরবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ড্রাইভার কোথায়?

শিশিরবাবু বললেন, ড্রাইভার আনিনি। আমার অসুখ বলে আমার ড্রাইভার রাত্রে বাড়ি চলে গিয়েছিল। আমি নিজেই চালিয়ে নিয়ে এলাম।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এত হাই ফিভার নিয়ে, এই রাত্তিরে জঙ্গলের রাস্তায় একা একা এলেন, না, না, এটা আপনার বিলকুল অন্যায় হয়েছে।

শিশিরবাবু বললেন, কী করব! মিঃ রায়চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গেছে শুনে বিছানায় ছটফট করছিলাম। আমারই এরিয়ার মধ্যে এইরকম কাণ্ড। তাই আর থাকতে পারলাম না।

কাকাবাবুর দিকে ফিরে দৃঢ় স্বরে শিশিরবাবু বললেন, আপনার ভাইপোকে আমি কালকের মধ্যেই খুঁজে বার করব। ত্রিপুরা ছোট জায়গা। যাবে কোথায়!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এই কোঠিটা কার? জঙ্গলের মধ্যে এরকম ফাঁকা কোঠি পড়ে আছে?

দেববর্মন বললেন, সেটা জানা শক্ত হবে না। সকালেই বার করে ফেলব। তবে ত্রিপুরায় এরকম বাড়ি অনেক পাবেন। রাজপরিবারের লোকরা জঙ্গলের মধ্যে এরকম বাড়ি বানিয়ে রেখেছেন অনেক জায়গায়।

কাকাবাবু বললেন, আমাকে গাড়িতে উঠতে একটু সাহায্য করতে হবে।

নরেন্দ্র ভার্মা আর দেববর্মন দুদিক থেকে ধরে কাকাবাবুকে গাড়িতে তুলে দিলেন।

সবাই গাড়িতে ওঠবার পর স্টার্ট দিলেন শিশিরবাবু। নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমি ত্রিপুরার হিস্ট্রি ঠিক জানি না। এই রাজা অমরমাণিক কোন্ টাইমের? ইনি কোথায় গুপ্তধন রেখেছিলেন?

দেববর্মন বললেন, অমরমাণিক নয়, অমরমাণিক্য। ত্রিপুরায় সব রাজাদের নামই মাণিক্য দিয়ে হত। এমন কী অন্য কোনও লোক রাজাকে মেরে রাজা হয়ে বসলেও তিনি কিছু-একটা মাণিক্য হয়ে যেতেন।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, এই অমরমাণিক্যের হিস্ট্রিটা আমায় একটু শোনাবে?

কাকাবাবু বললেন, আজ নয়, কাল। এখন আমি একটু ঘুমোতে চাই। সারা রাত জেগে থাকলে কাল সকালে আর কিছু চিন্তা করতে পারব না।

একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, কী জানি সন্তুকে নিয়ে ওরা কী করছে।