১৬. সমস্ত জায়গাটা একেবারে নিস্তব্ধ

হঠাৎ সমস্ত জায়গাটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলেন প্রকাশ সরকারের কাছে। মাথার এক জায়গা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে, প্রকাশ সরকার অজ্ঞান। কাকাবাবু পরে আছেন রাত-পোশাক, সঙ্গে একটা রুমাল পর্যন্ত নেই। ফাঁস করে তিনি। নিজের জামাটা ছিড়ে ফেললেন, তারপর সেটা দিয়ে খুব শক্ত করে বাঁধলেন ওর মাথাটা। নাকের কাছে হাত নিয়ে নিশ্বাসটা অনুভব করে দেখলেন। এখন আর কিছু করার নেই তার।

লাফিয়ে লাফিয়ে দরজার কাছে চলে এলেন কাকাবাবু। রাগে-দুঃখে তাঁর মুখটা অদ্ভুত হয়ে গেছে। তাঁর হাতে রিভলভার, অথচ তিনি কিছুই করতে পারলেন না, ওরা সন্তুকে ধরে নিয়ে চলে গেল!

এবারে বাড়ির বাইরে শোনা গেল ভারী ভারী জুতোর শব্দ। কারা যেন ছুটে ছুটে আসছে।

সিঁড়ি দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এলেন নরেন্দ্র ভার্মা। উৎকণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আর ইউ সেইফ, রায়চৌধুরী? নো হার্ম ডান?

কাকাবাবু একেবারে ফেটে পড়লেন।

অপদার্থ! ওয়ার্থলেস! তোমাদের সামান্য সেন্স অফ রেসপনসিবিলিটি নেই।

আরে শুনো, শুনো। পহলে তো শুনো!

কী শুনব, আমার মাথা আর মুণ্ডু? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। তোমাদের আরও আধঘণ্টা আগে আসবার কথা ছিল—

গাড়ির অ্যাকসিলেটরের তার কেটে গেল যে! এমন বেওকুফ, সঙ্গে একটা একস্ট্রা তার পর্যন্ত রাখে না। ব্যস, গাড়ি বন্ধ!

গাড়ি বন্ধ? সি আর পির গাড়ি খারাপ? এমন গাড়ি রাখে কেন?

বাইরে তো দেখতে নতুন, ভিতরে একদম্ ঝরঝরে। নদীর ধারে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল, সেখান থেকে আমরা ডাব মার্চ করে চলে এলাম!

আর এসে লাভটা কী হল? ওরা সন্তুকে ধরে নিয়ে গেছে! কোন দিকে গেল?

এখন তুমি দৌড়ে দৌড়ে ওদের পেছনে তাড়া করবে? ওদের সঙ্গে ভাল গাড়ি আছে। শোনো, এই লোকটি আহত হয়েছে, ওর এক্ষুনি চিকিৎসা করা। দরকার।

প্রকাশ সরকারের জ্ঞান ফিরে এসেছে এর মধ্যে। আস্তে আস্তে উঠে বসল, তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, কী হল? সবাই পালিয়ে গেল?

কাকাবাবু আবার বললেন, ওরা সন্তুকে নিয়ে গেছে। ডেঞ্জারাস লোক ওরা, সন্তু ওদের কাছে একটু চালাকি করতে গেলেই মহাবিপদ হবে। ওদের মায়াদয়া নেই।

নরেন্দ্র ভার্মা খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু রাজা। তোমার হাতে রিভলভার,তবু ঐ লোকগুলো সন্তুকে ধরে নিল কী করে? তুমি রেজিস্ট করলে না?

কাকাবাবু বললেন, আমি কী করব? লোকগুলোকে গুলি করে মারব! আজ খুব একটা শিক্ষা হল। সাধারণ গুণ্ডা-বদমাসরা অনায়াসে মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু আমরা পারি না। আমরা কি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারি?

ওদের কাছেও আর্মস ছিল?

এটাও তো ওদেরই। আমি এটা কেড়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা দলে ভারী, তাই কোনও লাভ হল না। আমি কথা দিয়ে ওদের ভুলিয়ে রাখবার অনেক চেষ্টা করলাম, খালি ভাবছি তোমরা এসে পড়বে, আর তোমাদের পাত্তাই নেই!

গাড়িটা যে এমন বিট্রে করবে, তা কী করে বুঝব বলো! আই অ্যাম ভেরি সরি! ওদের সদার কে? চিনতে পারলে?

সে সব কথা পরে হবে! এখন এখান থেকে যাব কী করে? পায়ে হেঁটে?

এক জনকে ফেরত পাঠিয়েছি। আর একটা গাড়ি নিয়ে আসবে।

সে গাড়ি আসতে আসতে রাত ভোর হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমি হাঁটব কী করে? আমার ক্রাচ্ নেই। তোমাকে ক্রাচ্‌ আনতে বলেছিলাম, এনেছ?

সেও তো গাড়িতে রয়ে গেছে।

বাঃ!

রাজা, আর দিমাগ খারাপ কোরো না। কোনও উপায় তো নেই। একটু ঠাণ্ডা মাথা করে বোসো?।

এমন সময় নীচে থেকে উঠে এলেন দেববর্মন। কাকাবাবুকে দেখে দারুণ অবাক হয়ে বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন?

কাকাবাবু বললেন, আপনাদের যা ব্যবস্থার ধাক্কা, তাতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ব মনে হচ্ছে।

আপনার মাথার গোলমালমানে…সেটা সত্যি নয়? একবারও বুঝতে পারিনি।

আমার আবার মাথার গোলমাল শুরু হবে এক্ষুনি। সন্তুকে ওরা ধরে নিয়ে। গেছে! আপনারা ওই ছেলেটাকে চেনেন না, ওর দারুণ সাহস। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এখানে বেশি সাহস দেখাতে গেলে কী যে হবে ঠিক নেই। ওদের মধ্যে কর্নেল বলে একটা লোক আছে, সে দারুণ গোঁয়ার। ওই দেখুন না, প্রকাশ সরকারের মাথা কী রকম জখম করে দিয়েছে।

দেববর্মন বললেন, কর্নেল? একজন তো কর্নেল আছে, নামকরা ক্রিমিনাল। জেল ভেঙে পালিয়েছে।

আর রাজকুমার বলে কারুকে চেনেন?

দেখুন, আমাদের এখানে অনেকেই রাজকুমার : আমি নিজেই তো অন্তত কুড়িজন রাজকুমারকে চিনি।

নরেন্দ্র ভার্মা চেয়ারটা নিয়ে এসে কাকাবাবুর কাছে রেখে বললেন, রাজা, তুমি এখানে বোসো। আর কতক্ষণ এক ঠ্যাংকা উপার খাড়া হয়ে থাকবে?

কাকাবাবু বললেন, একটা গাড়ি। একটা গাড়ির জন্য সব নষ্ট হয়ে গেল।

দেববর্মন বললেন, আমাদের আর একটু তৈরি হয়ে আসা উচিত ছিল। দুটো গাড়ি আনলে কোনও গণ্ডগোল ছিল না। ওদের সঙ্গে দুটো গাড়ি ছিল। চাকার দাগ দেখে বুঝতে পারছি। ওরা ডান দিকে গেছে। জঙ্গলের দিকে।

কাকাবাবু বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আগরতলায় ফিরে যাওয়া দরকার। কাল সকালেই একটা মিটিং ডাকতে হবে।

এমন সময় একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল। নরেন্দ্র ভামা উৎসাহিত হয়ে বললেন,ওই তো আমাদের গাড়ি এসে গেল বোধ হয়!

দেববর্মন বললেন, আমাদের গাড়ি? এত তাড়াতাড়ি কী করে আসবে? একজন লোক আগরতলায় যাবে আবার ফিরে আসবে, এত কম টাইমে তো হবার কথা নয়?

নরেন্দ্র ভামা বললেন, তা হলে কি ওরাই আবার ফিরে আসছে? ওদের দলে কত লোক আছে?

নরেন্দ্র ভার্মা তাকালেন কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবু কোনও উত্তর দিলেন না।