১৪. কাকাবাবু বজ্রমুষ্টিতে গলা চেপে ধরায়

কাকাবাবু বজ্রমুষ্টিতে গলা চেপে ধরায় লম্বা লোকটা দুবার মাত্র আঁ আঁ শব্দ করল। একটা হাত কোটের পকেটে ভরে কিছু একটা বার করে আনবার চেষ্টা করেও পারল না। তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

কাকাবাবু ওর অচৈতন্য দেহটা মাটিতে শুইয়ে দিয়ে প্রকাশ সরকারকে বললেন, বললুম যে, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে এসো! এক্ষুনি ওর দলের লোকেরা ফিরে আসবে।

প্রকাশ সরকার এতই অবাক হয়ে গেছে যে, নড়তেই পারছে না যেন। সন্তুরও সেই অবস্থা।

এবার প্রকাশ সরকার দেীড়ে গেল দরজা বন্ধ করতে। কাকাবাবু নিচু হয়ে সন্তুর হাতের বাঁধন খুলে দিতে লাগলেন।

সন্তুর এমন অবস্থা যে, সে যেন কথাই বলতে পারছে না। কথা বলতে গেলেই যেন তার ফুপিয়ে কান্না এসে যাবে। তার এত আনন্দ হচ্ছে।

প্রকাশ সরকার দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে বলল, স্যার, আপনি ভাল হয়ে গেছেন? মিরাকুলাস ব্যাপার! শুনেছি সাড়ন শক্ পেলে এরকম হতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, এই লোকটার কোটের পকেটে রিভলভার আছে। সেটা বার করে আমায় দাও।

প্রকাশ সরকার বেশি তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে এমনই উল্টোপাল্টা করতে লাগল যে, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লোকটার কোটের পকেটই সে খুঁজে পেল না।

কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, শিগগির! যে-কোনও মুহূর্তে ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।

শেষ পর্যন্ত প্রকাশ সরকার রিভলভারটা খুঁজে পেল। কাকাবাবু সেটা হাতে নিয়ে তাতে গুলি ভরা আছে কি না চেক করে দেখলেন।

এবার সন্তু বলল, কাকাবাবু, আসলে তোমার কিছুই হয়নি, তাই না? প্রকাশ সরকার বলল, অভিনয়? মানুষ এরকম অভিনয় করতে পারে? কাকাবাবু মুচকি হাসলেন।

প্রকাশ সরকার বলল, সত্যিই স্যার, আপনার কিছু হয়নি? আপনি আমাদের পর্যন্ত ঠকিয়েছেন?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি ইচ্ছে করে এরকম সেজেছিল, নিশ্চয়ই কোনও ২২৪

উদ্দেশ্য ছিল?

কাকাবাবু বললেন, হাত দুটো কদিনের জন্যে সত্যিই অসাড় হয়ে গিয়েছিল রে! পরশু থেকে হঠাৎ আবার ঠিক হয়ে গেল, তখন ভাবলুম, কিছুদিন ওই রকম সেজে থাকা যাক।

প্রকাশ সরকার জিজ্ঞেস করল, আপনার মাথাতেও তাহলে কোনও গোলমাল হয়নি?

কাকাবাবু নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মাথাটায় খুব ব্যথা করত মাঝে মাঝে। এক এক সময় ভাবতুম, পাগলই হয়ে যাব নাকি! তা সত্যি সত্যি কি আমি পাগল হয়েছি? তোমাদের কী মনে হয়?

স্যার, আপনার হাতের তালুতে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরল, বু আপনি একটুও মুখ বিকৃত করলেন না। এটা কী করে সম্ভব? কাকাবাবু বললেন, ইচ্ছে করলে সবই পারা যায়।

বাঁ হাতটা দেখলেন তিনি। সেখানে একটা বড় ফোস্কা পড়ে গেছে এর মধ্যেই।

এই সময় দরজায় দুমদুম্ করে ধাক্কা পড়ল। বাইরে থেকে সেই কর্নেল উত্তেজিতভাবে ডাকল, রাজকুমার! রাজকুমার।

প্রকাশ সরকার বিবর্ণ মুখে বলল, সাড়া না পেলে ওরা তো দরজা ভেঙে ফেলবে। ওদের দলে অনেক লোক?

কাকাবাবু বললেন, চিন্তার কিছু নেই। নরেন্দ্র ভার্মা পুলিশ নিয়ে এক্ষুনি এসে পড়বে।

সন্তু বলল, নরেনকাকা? তিনি কী করে জানবেন?

কাকাবাবু বললেন, তাকে বলা আছে, আমাকে ধরে নিয়ে আসার পর ঠিক সঙ্গে সঙ্গে যেন না আসে। এদের পালের গোদাটা কে, তা জানা দরকার। আধঘন্টার মধ্যেই ভার্মা আসবে।

প্রকাশ সরকার বলল, কিন্তু, কিন্তু, আপনি এত বড় ঝুঁকি নিলেন? এরা অতি সাঙ্ঘাতিক লোক। আগেই যদি আপনাকে মেরে ফেলত?

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমাকে ওরা মারবে কেন? আমি মরে গেলেই তো ওদের দারুণ ক্ষতি! জঙ্গলগড়ের চাবি কোথায় আছে জানো? আর কোথাও নেই, আছে আমার মাথার মধ্যে। আমাকে মারলে ওদের এত কাণ্ড করা সব ব্যর্থ হয়ে যেত। জঙ্গলগড়ের সন্ধান আর কেউ পেত না।

দরজায় আবার জোরে জোরে ধাক্কা পড়ল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এই রাজকুমার কে? ওকে তুমি আগে চিনতে?

কাকাবাবু বললেন, রাজকুমার না ছাই! এখানে এরকম গণ্ডায় গণ্ডায় রাজকুমার আছে। অনেক রাম-শ্যাম-যদুও নিজেকে রাজকুমার বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে, এ-ও ঠিক পালের গোদা নয়। আর একজন কেউ আছে। আমারই ভুল হল, আমি আর ধৈর্য ধরতে পারলুম না।

দরজায় দমাস-দমাস শব্দ হচ্ছে। ওরা কোনও ভারী জিনিস দিয়ে দরজায় আঘাত করছে। কিন্তু পুরনো আমলের শক্ত কাঠের উঁচু দরজা। ভাঙা সহজ নয়।

কাকাবাবু বললেন, ওই লোকটাকে টেনে আমার কাছে নিয়ে এসো।

সন্তু আর প্রকাশ সরকার লোকটিকে ধরাধরি করে কাকাবাবুর পায়ের কাছে নিয়ে আসতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসল।

কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে এক হাতে তাঁর চুলের মুঠি ধরে অন্যহাতের রিভলভারের ডগাটা তার ঘাড়ে ঠেকালেন। তারপর বললেন, এই যে রাজকুমার, ঘুম ভেঙেছে?

লোকটি হাত তুলে নিজের গলায় বুলোতে যেতেই কাকাবাবু বললেন, উহু, নড়াচড়া একদম চলবে না। পটু করে গুলি বেরিয়ে যেতে পারে। আমি দেখে নিয়েছি, ছখানা গুলি ভরা আছে।

লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী, তা হলে তুমি পাগল হওনি! যাক, সেটাই যথেষ্ট। কিন্তু তুমি কি এরকমভাবে জিততে পারবে? আমার লোক এক্ষুনি দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকবে।

কাকাবাবু বললেন, আসুক না, তাতে কোনও চিন্তা নেই। শোনো, আমি সিগারেট খাই না। না হলে তোমার হাতে আমারও সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া উচিত ছিল।

প্রকাশ সরকার বলল, স্যার, আমার কাছে সিগারেট আছে। ধরাব?

লোকটি কটমট করে প্রকাশ সরকারের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার আমি সর্বনাশ করে দেব।

প্রকাশ সরকার বলল, আপনি যা খুশি করতে পারেন, আর আমি ভয় পাই না!

তারপর সে কাকাবাবুর দিকে চেয়ে কাচুমাচুভাবে বলল, দেখুন, আমি কিন্তু ওদের দলের নই। সেদিন সকালবেলা আমার এক বন্ধুর নাম করে এদের লোক আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর এখানে ধরে নিয়ে আসে। আমার একটা গোপন ব্যাপার এরা জানে, সে কথা বলে ওরা আমাকে ভয় দেখিয়েছে। সব কথা আপনাকে আমি পরে খুলে বলব।

দরজার খিলটা এবার মড়মড় করে খানিকটা ভেঙে গেল। এবার ওরা ভেতরে ঢুকে আসবে।

সন্তু বলল, আমি আর প্রকাশদা দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াব?

কাকাবাবু বললেন, কোনও দরকার নেই। তোরা দুজনে বরং দেয়ালের দিকে সরে দাঁড়া। হঠাৎ গুলি ছুঁড়লে তোদের গায়ে লাগতে পারে।

দরজার খিল ভেঙে প্রথমেই এক হাতে ছুরি আর অন্য হাতে রিভলভার নিয়ে ঢুকল কর্নেল, তারপর আরও চার-পাঁচজন লোক।

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, আর এক পা-ও এগিও না। তা হলে তোমাদের রাজকুমারের মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। ওহে রাজকুমার, তোমার লোকদের বলে পিছিয়ে যেতে!

রাজকুমার নামের লোকটি হেসে উঠল হো-হো করে। তারপর বলল, রায়চৌধুরী, তুমি আমার গলা টিপে অজ্ঞান করে রিভলভারটা কেড়ে নিয়েছ বলেই জিততে পারবে? কর্নেল, এগিয়ে এসো!

কাকাবাবু বললেন, সাবধান! আমি সত্যি গুলি করব। প্রথমে তোমাকে, তারপর ওদের!

রাজকুমার অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, মিথ্যে ভয় দেখালেই আমি ভয় পাব? রাজা রায়চৌধুরীকে আমি ভাল করেই জানি, সে কখনও কোনও মানুষ খুন করতে পারবে না। তুমি আমায় কেমন মারতে পারো দেখি তো! কর্নেল, এ যদি আমায় মেরেও ফেলে, তবু তোমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এদের ধরে ফেললা!

কাকাবাবু বললেন, আমি ঠিক তিন গুনব। তারপর…

রাজকুমার বলল, কর্নেল, ওর কথায় বিশ্বাস কোরো না! ও গুলি করে আমায় কিছুতেই মারবে না আমি জানি। তোমরা এগিয়ে এসো?