০২. কাকাবাবুর চেয়ে সন্তুর বাবা মাত্র দুবছরের বড়

কাকাবাবুর চেয়ে সন্তুর বাবা মাত্র দুবছরের বড়। কিন্তু দুজনের চেহারার অনেক তফাত। কাকাবাবু যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া কাঁধ, চওড়া কব্জি। আর পুরুষ্টু গোঁফটার জন্য কাকাবাবুকে মিলিটারি অফিসারের মতন দেখায়। সন্তুর বাবাও বেশ লম্বা হলেও রোগা-পাতলা চেহারা, কোনওদিন গোঁফ রাখেননি, মাথার চুলও একটু-একটু পাতলা হয়ে এসেছে। কাকাবাবু যেমন অল্প বয়েস থেকেই পাহাড়-পর্বতে আর দেশ-বিদেশে ঘোরাঘুরি করতে ভালবাসেন, বাবার স্বভাব ঠিক তার উল্টো। উনি বাড়ি থেকে বেরুতেই চান না, অফিসের সময়টুকু ছাড়া। জীবনবীমা সংস্থায় উনি অ্যাকচুয়ারির কাজ করেন, খুব দায়িত্বপূর্ণ পদ, দারুণ অঙ্কের জ্ঞান লাগে।

দুই ভাইয়ের সম্পর্ক ঠিক বন্ধুর মতন। সব রকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি করেন দুজনে।

কাকাবাবুর ডাকনাম খোকা!

সন্তুদের কাছে অভ্যোস হয়ে গেছে বটে, কিন্তু বাইরের কেউ এসে এই নাম শুনে অবাক হয়ে যায়। অনেকে হোসে ফেলে। অতবড় একজন জাঁদরেল চেহারার মানুষের নাম খোকা হতে পারে? কিন্তু কাকাবাবুও তো একদিন ছোট ছিলেন, তখন ঐ নাম তাঁকে মানাত। বড় হলেও তো আর ডাকনাম বদলায় না।

সন্তুর রেজাল্টের খবর শুনে কাকাবাবু বললেন, অ্যাঁ, পাশ করেছে? কী আশ্চর্য কথা! সন্তু তো তাহলে খুব গুণের ছেলে। কখন পড়াশুনো করে দেখতেই পাই না?

বাবা বললেন, যা-ই বলে। ফার্স্ট হলে আমি খুশি হতুম। পাশ তো সবাই করে!

মা কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে দুঃখ করে বললেন, দেখেছ, দেখেছি! বছরের মধ্যে কমাস বাইরে কাটিয়ে এসেও সন্তু যে এত ভাল রেজাল্ট করেছে, তাতে ওর বাবার আনন্দ নেই!

বাবা বললেন, তুই-ই বল খোকা, যখন ফিফথই হল, তখন চেষ্টা করলে ফার্স্ট হতে পারত না? ফার্স্ট আর ফিফ্‌থের মধ্যে হয়তো বড় জোর কুড়ি-পঁচিশ নম্বরের তফাত।

কাকাবাবু বললেন, আমি তো জীবনে কোনওদিন স্ট্যান্ড করিনি! সন্তুর তবু কাগজে নাম উঠেছে…অবশ্য দাদা তুমিও…বলে দেব, দাদা, বলে দেব সেই কথাটা?

বাবা অমনি কথা ঘোরাবার জন্য বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, সন্তু যা করেছে যথেষ্ট। এখন কোন কলেজে ভর্তি হবে সেটা ঠিক করে।

মা জিজ্ঞেস করলেন, কী, কী? কী বলবে বলছিলে? চেপে যাচ্ছ কেন?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, দাদা, বলে দিই?

বাবা বললেন, আঃ খোকা, তুই কী যে করিস! ওসব পুরনো কথা—

কাকাবাবু তবু বললেন, জানো বৌদি, দাদা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করেছিল।

মা চোখ কপালে তুলে বললেন, অ্যাঁ?

সন্তু এতক্ষণ লজ্জায় মুখ গুঁজে বসেছিল, সে-ও মুখ তুলে তাকাল। ছোড়দিও অবাক হয়ে যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গেল।

মা বললেন, সত্যি? এ-কথা তো আমি কোনওদিন শুনিনি।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, সত্যি! আমাদের সময় তো ইস্কুল ফাইনাল ছিল না। তখন ছিল ম্যাট্রিক। দাদাকে সবাই এখন পণ্ডিত মানুষ হিসেবে জানে, শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না, দাদা কিন্তু সত্যিই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করেছিল।

ছোড়দি জিজ্ঞেস করল, তখন দাদু কী করেছিলেন? দাদু, তো খুব রাগী ছিলেন, মেরেছিলেন বাবাকে?

দাদু অর্থাৎ ঠাকুর্দাকে সন্তু চোখেই দেখেনি, তিনি মারা গেছেন সন্তুর জন্মের আগে। দাদু সম্পর্কে অনেক গল্প সে শুনেছে। বাবা আর দাদুর এই নতুন কাহিনীটি শোনবার জন্য সে উদ্‌গ্ৰীব হল।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের বাবা খুব রাগী ছিলেন ঠিকই। আমরা কেউ পড়াশুনোয় একটু অমনোযোগী হলেই উনি বলতেন, আর কী হবে, বড় হয়ে চায়ের দোকানে বেয়ারার চাকরি করবি। আমার খেলাধুলোয় বেশি ঝোঁক ছিল বলে পড়াশুনোয় মাঝে-মাঝে ফাঁকি দিতুম, সেইজন্য বাবার কাছে খুব বকুনি খেতুম, কিন্তু,…

বাবা অ-খুশি মুখ করে কাকাবাবুর কথা শুনছিলেন, এবার বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, তুই অনেক মারও খেয়েছিস বাবার হাতে। সে-কথা বলছিস না। কেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমি মারও খেয়েছি অনেকবার। কিন্তু দাদা বরাবরই পড়াশুনোয় খুব ভাল। সেই দাদা যে ম্যাট্রিকে ফেল করবে, তা কেউ ভাবেইনি। আসলে হয়েছিল কী, অঙ্ক পরীক্ষার দিন দাদা আইনস্টাইনের মতন নতুন থিয়োরি দিয়ে সব কটা অঙ্ক করেছিল। প্রত্যেকটা অঙ্কের উত্তর লিখেছিল প্রথমে, তারপর প্রসেস দেখিয়েছে-একজামিনার রেগে-রেগে জিরো দিয়ে দিয়েছে। অঙ্কে ফেল মানেই একদম ফেল! রেজাল্ট বেরুবার দিন মা আর আমাদের এক পিসি দারুণ ভয় পেয়ে গেলেন। ওঁরা ভাবলেন, বাবা রোগে-মেগে বোধহয় রক্তারক্তি কাণ্ড বাধাবেন। সেই জন্য দাদাকে লুকিয়ে রাখা হল ঠাকুর ঘরে। বাবা কিন্তু দাদাকে খুঁজলেনও না। সারাদিন মন খারাপ করে শুয়ে রইলেন। তারপর সন্ধেবেলা মাকে বললেন, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আমার খরচ বেঁচে গেল। ও ছেলেকে আর আমি পড়াব না। ওকে চায়ের দোকানের চাকরি খুঁজে নিতে বলে তোমরা! বাবা সাঙ্ঘাতিক জেদি আর এক-কথার মানুষ। কিছুতেই আর তাঁর মত ফেরানো গেল না। আমাদের ইস্কুলে চিঠি পাঠিয়ে দিলেন যে তাঁর ঐ ছেলেকে আর ফেরত নেবার দরকার নেই।

ছোড়দি জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কী হল?

দাদা তখন ঠিক করল মনুমেণ্টের ওপর থেকে ঝাঁপ দেবে!

বাবা বললেন, কী বাজে কথা বলছিস, খোকা? মোটেই আমি ওরকম…

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ দাদা, আমার আজও মনে আছে। তুমি আমাকে ঐ কথা বলেছিলে। আমি তো বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। ভাবছিলুম মাকে জানিয়ে দেব। যাই হোক, দাদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল চন্দননগরে আমাদের মামাবাড়িতে। সেইখান থেকেই পরের বছর পরীক্ষা দেয়। পরের বছর কী হয়েছিল বলো তো!

ছোড়দি বললেন, জানি। বাবা ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হয়েছিল!

মা বললেন, আমরা এতদিন জেনে এসেছি যে, তুমি সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া ছাত্র। কিন্তু তোমারও যে এসব কলঙ্ক আছে তা তো আমাদের কোনওদিন বলোনি!

কাকাবাবু বললেন, একবার ফেল করে ভালই হয়েছিল দাদার পক্ষে। দাদা ভাল ছাত্র ছিল বটে, কিন্তু ফার্স্ট হবার মতন ছিল না! ফেল করে অভিমান হল বলেই–

বাবা বললেন, না। মোটেই না। প্ৰথমবারই আমার ফার্স্ট হওয়া উচিত ছিল, একজামিনার আমার অঙ্ক বুঝতে পারেননি!

ছোড়াদি জিজ্ঞেস করল, পরের বার বাবা যে ফার্স্ট হলেন, সে খবর পেয়ে দাদুকী বললেন?

কাকাবাবু বললেন, তোমার বাবা ফার্স্ট হওয়ায় আমার বাবা হঠাৎ উল্টে আমার ওপর চোটুপটু শুরু করে দিলেন। আমায় ডেকে বললেন, পারবি? তুই তোর দাদার মতন পারবি? তোর দাদার পা-ধোওয়া জল খা, তবে যদি পাশ করতে পারিস!

সবাই হেসে উঠল এক সঙ্গে।

এইরকম ভাবে আড্ডায় সকালটা কেটে গেল। সন্ধেবেলা সন্তুর নেমন্তন্ন এক বন্ধুর বাড়িতে।

সন্তুর বন্ধু আজিজের বোন রেশমা গত মাসে জলে ড়ুবে গিয়েছিল। সে এক সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার।

আজিজরা কলকাতায় পার্ক সার্কাসে থাকলেও ওরা প্রায়ই যায় জলপাইগুড়িতে। সেখানে ওদের একটা চা-বাগান আছে। গত মাসে সেই চা-বাগান থেকে ওরা অনেকে মিলে গিয়েছিল ডায়না নদীর ধারে পিকনিক করতে। রেশমার বয়েস মাত্ৰ সাত বছর, সে যে কখন চুপি চুপি খেলা করতে করতে জলে নেমেছে, তা কেউ লক্ষও করেনি। ডায়না নদীতে যখন জল থাকে, তখন বড় সাঙ্ঘাতিক নদী, খুব স্রোত। রেশমা সেই স্রোতে ভেসে যাবার পর আজিজের মামা প্ৰথমে দেখতে পান। তিনি চোঁচামেচি করে উঠলেন, সবাই তখন নদীর ধার দিয়ে দৌড়োতে লাগলেন। কাছেই একটা জেলে দাঁড়িয়ে মাছ ধরছিল, সে রেশমাকে দেখে জাল ছুঁড়ে আটকে ফেলে। আর একটু দূরেই ছিল একটা বড় পাথর। সেখানে ধাক্কা লাগলেই রেশমার মাথা একেবারে ছাতু হয়ে যেত!

প্ৰায় অলৌকিকভাবেই বেঁচে গেছে। রেশমা। সেইজন্যই এবারে তার জন্মদিন করা হচ্ছে খুব ধুমধামের সঙ্গে।

খুব ফুর্তির সঙ্গেই সন্তু গেল নেমন্তন্ন খেতে!

আজিজদের বাড়িটা মস্ত বড়। আর ওদের আত্মীয়-স্বজনও প্রচুর। তারা অনেকেই সন্তুকে চেনেন। সন্তুর কয়েকজন বন্ধুও এসেছে। আজিজের বাড়ির লোকরা কেউ-কেউ জিজ্ঞেস করছেন, সন্তু, কী রকম রেজাল্ট হল? সন্তুকে নিজের মুখে কিছু বলতে হয় না। আজিজ কিংবা অন্য কোনও বন্ধু আগে থেকেই বলে ওঠে, জানো না, ও ফিফথ হয়েছে। কাগজে আমাদের ইস্কুলের নাম বেরিয়েছে এই সন্তুর জন্য।

তখন তাঁরা সবাই বাঃ বাঃ বলে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন সন্তুর।

সন্তুর একটু-একটু গর্ব হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু লজ্জাও হচ্ছে খুব। যেন এই বিষয়টা নিয়ে কেউ আলোচনা না করলেই ভাল হয়। ফিফথ হওয়াটাই বা এমন কী ব্যাপার!

কালকের সন্ধের সঙ্গে আজকের সন্ধের কত তফাত। আজি কত আনন্দ আর হৈ হৈ, আর কালকে সে ফেল করার দুশ্চিন্তায় একেবারে চুপসে কচু হয়ে ছিল। মানুষের জীবনের পর পর দুটো দিন যে ঠিক এক রকম হবেই, তা কেউ বলতে পারে না।

এক সময় সন্তু ভাবল, কেন মিছিমিছি। অত ভয় পাচ্ছিল কাল? ফেল করলেই বা কী হত? তার বাবাও তো ফেল করেছিলেন। ফেল করলেই জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যায় না। মনের জোর রাখাটাই আসল ব্যাপার।

আজিজদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার আগে অনেক রকম খেলা হল। তার মধ্যে শেষ খেলাটা হল বেলুন ফাটানো।

অন্তত দুশোটা বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। সারা বাড়িটা। লাল টুকটুকে ভেলভেটের ফ্রক পরা রেশমকে দেখাচ্ছে ঠিক একটা পরীর মতন। জন্মদিনের কেক কাটার পর ফুঁ দিয়ে যখন মোমবাতিগুলো নেভানো হচ্ছে, ঠিক সেই সময় ওপর থেকে আপনা-আপনি একটা বেলুন খসে পড়ল সেখানে। জ্বলন্ত মোমবাতির কাছাকাছি আসতেই দুম করে ফেটে গেল সেটা।

রেশমা হাততালি দিয়ে বলে উঠল, কী মজা! কী মজা?

তারপরই সে আবদার ধরল, কী মজা! কী মজা! আরও বেলুন ফাটিয়ে দাও! সব কটা বেলুন ফাটিয়ে দাও!

রেশমার বাবা সুলেমান সাহেব বললেন, না, না, এখন ফাটিও না, সুন্দর সাজানো হয়েছে, কাল সকালে…

রেশমা তবু বলল, না, ফাটিয়ে দাও! সব কটা ফাটিয়ে দাও!

আজকের দিনে রেশমার আবদার মানতেই হয়। সেইজন্য অন্যরা হাতের কাছে যে যে-কটা বেলুন পেল, ফটাস ফটাস করে ফাটাতে শুরু করে দিল।

কিন্তু বেশির ভাগ বেলুনই ওপরে ঝোলানো, হাতের নাগাল পাওয়া যায় না। অনেকে লাফিয়ে লাফিয়ে সেগুলো ধরার চেষ্টা করতে লাগল আর খিলখিল করে হাসতে লাগল রেশমা।

আজিজ টুক করে নিয়ে এল ওর এয়ারগানটা।

সেটা উঁচিয়ে তুলে বলল, এবার দ্যাখা রেশম, সব কটা কী রকম ফাটিয়ে দিচ্ছি।

কিন্তু আজিজের অত ভাল টিপ নেই। সে চার-পাঁচটা গুলি ছুঁড়লে একটা বেলুন ফাটে।

তখন শুরু হয়ে গেল কমপিটিশন। পরপর দশটা গুলি ছুঁড়ে কে সবচেয়ে বেশি বেলুন ফাটাতে পারে। কেউই তিন চারটের বেশি পারল না। আজিজের মামা ফাটালেন পাঁচটা।

সন্তু এয়ারগানটা হাতে নিয়ে একটু হাসল। তারপর বলল, সবাই এক এক করে গুনুক! আমি দশটায় ঠিক দশটা ফাটাব।

এ-ব্যাপারে গর্ব করতে সন্তুর কোনও লজা নেই। সে আসল রিভলভারে গুলি ছুঁড়েছে। এ তো সামান্য একটা এগারগান!

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, এক!

সন্তু সত্যি-সত্যি পরপর দশটা বেলুন ফাটাতে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল একসঙ্গে। সন্তু বীরের মতন এয়ারগানটা তুলে দিল পাশের বন্ধুর হাতে।

খুব মজা হল অনেক রাত পর্যন্ত।

পরদিন সকালটা আবার একেবারে অন্য রকম।

সন্তু সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। কাকাবাবু এখনও মর্নিং ওয়ার্ক থেকে ফেরেননি। বাবা যথারীতি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খবরের কাগজের অপেক্ষায় বারান্দায় পায়চারি করছেন।

এই সময় পাড়ার দুটি ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে পাগলের মতন দুম দুম করে ধাক্কা দিতে লাগল সন্তুদের বাড়ির দরজায়।

বাবা বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? এই যে, তোমরা ওরকম করছ, কেন।

ছেলে দুটি বলল, শিগগির আসুন। পর্কে কে যেন কাকাবাবুকে গুলি করেছে!