০৩. নিউ জলপাইগুঁড়ি স্টেশনে ট্রেন পৌঁছল

নিউ জলপাইগুঁড়ি স্টেশনে ট্রেন পৌঁছল সকালবেলা।

কলকাতার তুলনায় এখানে শীত একটু বেশি। মেঘ নেই, ঝকঝক করছে নীল আকাশ।

স্টেশনের বাইরে এসে গৌতমকাকু জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললেন, বাঃ, এখানকার বাতাস অনেক টাটকা। পলিউশান ফ্রি!

পুরু বলল, ড্যাড, টুমি ইংরাজি বলছ?

গৌতমকাকু বললেন, ওঃ হো। পলিউশানের বাংলা কী হবে রে, রাজা?

কাকাবাবু বললেন, পলিউশান, সবাই তো পলিউশানই বলে। বাংলা আছে। কী বল তো সন্তু?

সন্তু বলল, দূষণ।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, দূষণ। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ।

মিলিকাকিমা বললেন, বাবা, রে বাবা! আমি অত শক্ত শক্ত বাংলা বলতে পারব না।

আগেই ঠিক হয়েছে, এখানে যে-কটা দিন থাকা হবে, তখন কেউ ইংরেজি বলতে পারবে না। পুরুকে বাংলা শেখাতে হবে তো! একটা ইংরেজি শব্দ বললেই জরিমানা হবে। ছোটদের দশ পয়সা, বড়দের এক টাকা।

গৌতমকাকু বললেন, ঠিক আছে, আমার এক টাকা জরিমানা হল। সন্তু, হিসেব রাখিস। আর পুরু, তোরও দশ পয়সা।

পুরু অবাক হয়ে বলল, কেন, আমার কেন?

গৌতমকাকু বললেন, তুই যে ড্যাড বললি! এখানে বাবা বলতে হবে!

একজন গাড়ির ড্রাইভার হাতে একটা বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাতে লেখা, রাজা রায়চৌধুরী।

সেই গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে কাকাবাবু বললেন, প্রথমে আমাদের যেতে হবে জলপাইগুঁড়ি সার্কিট হাউসে। এই রে, সার্কিট হাউসের বাংলা তো জানি না। এটা বাদ দাও। যেমন, হোটেলেরও বাংলা করার দরকার নেই, এখানকার ইয়ে, মানে জেলাশাসক আমার এক বন্ধুর ছেলে। সে বিশেষ অনুরোধ করেছে, দুপুরে ওখানে খেয়ে যেতে হবে। তারপর বন বাংলোয় পৌঁছে দেবে।

গৌতমকাকু বললেন, তা বেশ তো! সারারাত ট্রেনজার্নি করে এসে ওখানে স্নানটানও করে নেওয়া যাবে!

সন্তু বলল, আপনার দু টাকা।

গৌতমকাকু বললেন, কেন? ও, ট্রেনজার্নি বলেছি। কী হবে, ট্রেনযাত্রা?

মিলিকাকিমা বললেন, বাবা রে বাবা! সবাই ট্রেনজার্নি বলে!

গাড়িতে উঠে কাকাবাবু বললেন, আর একবার বিজয়নগরে যাওয়ার পথে আমরা এই বাংলা-বাংলা খেলেছিলাম, ওই যে রঞ্জন আর রিঙ্কু আমাদের সঙ্গে ছিল, সেবারে কে জিতেছিল রে সন্তু?

সেবারে সন্তই জিতেছিল। কিন্তু সে কথা না জানিয়ে সে বলল, ঠিক মনে নেই। সার্কিট হাউজে পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগল। মস্তবড় বাড়ি। সামনে চমৎকার বাগান। অনেকগুলি বড় বড় ঘর। গৌতমকাকু যা দেখেন, তাতেই খুশি হয়ে ওঠেন। তিনি বললেন, বাঃ, বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তো।

ঘরে গিয়ে বসতে না বসতেই চা-জলখাবার এসে গেল। আর একটু পরেই এলেন জেলাশাসক রণবীর গুপ্ত। বয়েস খুব বেশি নয়, অত্যন্ত সুপুরুষ। তিনি প্রথমেই কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন, কাকাবাবু, আমার বাবাকেও সঙ্গে নিয়ে এলেন না কেন?

কাকাবাবু বললেন, তোমার বাবা সোমনাথকে টেলিফোন করেছিলাম। সে বলল, তার হাঁটুতে ব্যথা, তাই আসতে পারবে না।

রণবীর বললেন, বাবা কিছুতেই আসতে চান না। কলকাতা থেকে বেরুতেই চান না।

কাকাবাবু বললেন, তোমার বাবা পড়াশুনো নিয়েই ব্যস্ত থাকে। একবার জোর করে ধরে নিয়ে এসো।

তারপর তিনি অন্যদের সঙ্গে রণবীরের আলাপ করিয়ে দিলেন।

রণবীর সন্তুর পিঠ চাপড়ে বললেন, কী হে সন্তু মাস্টার, এখানেও কোনও অ্যাডভেঞ্চার হবে নাকি? অন্ধকার গুহার মধ্যে গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে ময়াল সাপ, দস্যু সর্দার মোহন সিং, হাতির পাল গাড়ি উলটে দিল!

সন্তু লাজুকভাবে বলল, না, এখানে তো শুধু বেড়াতে এসেছি।

রণবীর বললেন, এখানেও কিন্তু ওরকম অনেক কিছু আছে। পরশুই তো জঙ্গল থেকে মস্ত বড় একটা পাইথন ধরে এনেছে, প্রায় দশ হাত লম্বা!

মিলিকাকিমা বললেন, ওরে বাবা, এখানে পাইথন আছে?

কাকাবাবু বললেন, অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পাইথন তেড়ে এসে মানুষকে কামড়ায় না।

মিলিকাকিমা বললেন, হরিণ গিলে ফেলে শুনেছি।

কাকাবাবু বললেন, চেষ্টা করে, সবসময় পারে না। বেচারারা বোকা হয়। আমি মধ্যপ্রদেশে একবার দেখেছিলাম, একটা বড় পাইথন একটা শিংওয়ালা মস্ত হরিণকে গেলার চেষ্টা করছিল। শিং-এর কাছে এসে আটকে গেছে। বড় ধারালো শিং তো আর গিলতে পারে না, ওগরাতেও পারছে না। দেখে মনে হচ্ছিল একটা শিংওয়ালা সাপ! সে বেচারা মরেই গেল শেষ পর্যন্ত।

মিলিকাকিমা বললেন, আমি পাইথন সাপ দেখতে চাই না, আমি চা-বাগান দেখতে চাই।

রণবীর বললেন, চা-বাগান অনেক দেখতে পাবেন। যাওয়ার পথেই। কোনও চা-বাগানের ম্যানেজারকে বলে দিতে পারি, আপনাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে।

পুরুকে তিনি বললেন, তুমি চুপ করে বসে আছ। ইজ দিস ইয়োর ফার্স্ট টাইম ইন নর্থ বেঙ্গল?

পুরু বলল, ইয়েস, ফার্স্ট টাইম।

কেউ ইংরেজিতে কিছু জিজ্ঞেস করলে স্বাভাবিকভাবেই তার মুখ দিয়ে ইংরেজি বেরিয়ে আসবে।

তবু বলে ফেলে সে অপরাধীর মতন অন্যদের দিকে তাকাল।

কাকাবাবু হেসে মাথাটা একটু ঝোঁকালেন। অর্থাৎ বুঝিয়ে দিলেন, ঠিক আছে।

রণবীর আরও কিছুক্ষণ ইংরেজি বললেন পুরুর সঙ্গে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাদের জন্য কোন বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করেছ, রণবীর?

রণবীর বললেন, আপনারা তো নিরিবিলিতে থাকতে চান। এখানকার সবচেয়ে নামকরা বাংলো হচ্ছে হলং। কিন্তু সেখানে খুব লোকজনের ভিড়, প্রতিদিন অনেক লোক আসে। আমার খুব ভাল লাগে চাপড়ামারি। একেবারে নির্জন। চতুর্দিকে জঙ্গল। বাংলোটাও সুন্দর। বারান্দায় বসে বসেই অনেক

জন্তু-জানোয়ার দেখতে পাবেন।

কাকাবাবু বললেন, গোরুমারা বাংলোটাও তো বেশ ভাল।

রণবীর বললেন, হ্যাঁ, ওটাও ভাল। কিন্তু একটা সিনেমা পার্টি ওখানে শুটিং করছে, আরও দিনসাতেক থাকবে।

গৌতমকাকু বললেন, না, না, আমরা সিনেমা পার্টির ধারেকাছে যেতে চাই না।

মিলিকাকিমা বললেন, আমরা শুটিং দেখতে পারব না?

রণবীর বললেন, হ্যাঁ, তা দেখতে পারেন, গিয়ে আবার ফিরে আসবেন।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে চাপড়ামারিই ভাল।

রণবীর বললেন, ওখানে পুরো বাংলোটাই আপনাদের থাকবে। কেউ বিরক্ত করবে না। তবে, কয়েকজন পুলিশকে আপনাদের সঙ্গে দিয়ে দেব।

কাকাবাবু বললেন, পুলিশ? পুলিশ যাবে কেন?

রণবীর বললেন, কাকাবাবু, আপনার তো শত্রুর অভাব নেই। পুলিশ আপনাদের পাহারা দেবে সবসময়।

কাকাবাবু বললেন, না, না, কোনও দরকার নেই। আমরা যে এখানে এসেছি, তা তো কেউ জানেই না।

গৌতমকাকু বললেন, জঙ্গলে বেড়াতে যাব পুলিশ সঙ্গে নিয়ে? এ কী অদ্ভুত কথা।

কাকাবাবু বললেন, রণবীর, তুমি বরং একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়ে। এখানে-সেখানে ঘুরতে যাব।

রণবীর বললেন, গাড়ি তো থাকবেই। একজন অন্তত আর্মড গার্ড দিয়ে দিই, আপনাদের প্রোটেকশানের জন্য।

কাকাবাবু বললেন, তাও লাগবে না। আমরা পাঁচজন, ড্রাইভার থাকবে, গাড়িতে আর জায়গা হবে কী করে?

রণবীর বললেন, আপনাদের কিছু খাবারদাবার সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি। জঙ্গলে কিছু পাওয়া যাবে না। অনেক দূরে দোকান, বাংলোয় অবশ্য রান্না করার লোক আছে।

রণবীর সব ব্যবস্থা করতে উঠে গেলেন।

পুরু সঙ্গে-সঙ্গে বলল, এই ভদ্রলোক অনেক ইংরাজি শব্দ বলেন। আর্মড গার্ড, প্রোটেকশান।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমরা অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। তা আর কী করা যাবে।

গৌতমকাকু বললেন, যারা লেখাপড়া জানে না, তারাও অনেক ইংরেজি বলে। আমার মামাবাড়িতে যে মেয়েটি বাসন মাজে, সেও বলে, আমার টাইম নেই, ট্রেন লেট ছিল।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর যাত্রা শুরু হল। গাড়ির ড্রাইভারের নাম রতন, সে জঙ্গলের রাস্তাটাস্তা সব চেনে।

শহর ছেড়ে খানিকটা যাওয়ার পরই চোখে পড়ল, রাস্তার দুধারে চা-বাগান।

মিলিকাকিমা বললেন, ওমা, চা গাছ এরকম হয় বুঝি? ছবিতে দেখে ঠিক বুঝিনি। যতদূর দেখা যায়, সব গাছ সমান। চা গাছ বড় হয় না?

কাকাবাবু বললেন, সমান করে হেঁটে রাখে। চায়ের পাতা তো হাত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঝুরিতে ভরতে হয়, বেশি লম্বা হয়ে গেলে হাত পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া গাছ বড় হলে বোধ হয় চায়ের স্বাদও ভাল হয় না। সব পাতা দিয়ে চা হয় না। শুধু ডগার কচি পাতা।

সন্তু বলল, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি।

গৌতমকাকু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই নামে একটা বই পড়েছিলাম ছেলেবেলায়, চা-বাগানের কুলিদের নিয়ে লেখা। চা-গাছ ঠিক গাছের মতন দেখতে নয়, ঝোপ বলাই উচিত।

পুরু জিজ্ঞেস করল, বাবা, ঝোপ মানে কী?

গৌতমকাকু বললেন, ঝোপ মানে, ঝোপ মানে, ইয়ে, সন্তু, বুঝিয়ে দে তো! সন্তু পুরুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমেরিকার প্রে…প্রে..প্রে… রাষ্ট্রপতির নাম কী?

পুরু বলল, জর্জ বুশ।

সন্তু বলল, ঝোপ হচ্ছে ওই রাষ্ট্রপতির যা পদবি!

গৌতমকাকু হেসে বললেন, সন্তুর সঙ্গে আমরা পারব না। ও নিজের মুখে ইংরেজি কথাটা উচ্চারণ করল না। মহা চালু!

কাকাবাবু বললেন, অনেক সময় ইংরিজি শব্দ দিয়ে বাংলা মানে বোঝাতে

হয়।

মিলিকাকিমা বললেন, মাঝে-মাঝে এক-একটা গাছ যে লম্বা হয়ে গেছে?

কাকাবাবু বললেন, ওগুলো চা গাছ নয়। ওগুলো রেখেছে ছায়ার জন্য।

মিলিকাকিমা বললেন, কুলিরা ওই গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নেয়?

কাকাবাবু বললেন, না, না, কুলিদের আরামের কথা কেউ ভাবে না। চায়ের ঝোপেরই ছায়া দরকার। কটকটে রোদ চায়ের পক্ষে ভাল নয়।

রতন বলল, ওগুলো স্যার শেড ট্রি।

কাকাবাবু বললেন, ছায়া-গাছ।

মিলিকাকিমা বললেন, সব বাগান খালি। কেউ তো কাজ করছে না।

কাকাবাবু বললেন, এখন বোধ হয় পাতা তোলার সময় নয়। রতন হাত দিয়ে ডান দিকটা দেখিয়ে বলল, এই গার্ডেনটায় গত শনিবার ডাকাতি হয়ে গেছে।

মিলিকাকিমা চমকে উঠে বললেন, আঁ, ডাকাতি! এখানেও ডাকাতি?

 

গৌতমকাকু বললেন, ডাকাতি কোথায় না হয়? আমেরিকাতে হয় না? রতন বলল, ডাকাতরা একজন গার্ডকে গুলি করে মেরেছে। আর ম্যানেজারবাবুকে ধরে নিয়ে গেছে! ওরা দশ-বারোজন ছিল।

মিলিকাকিমার মুখোনা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি আস্তে-আস্তে বললেন, আমরা জঙ্গলের মধ্যে একলা একলা থাকব।

কাকাবাবু বললেন, একলা কোথায়? আমরা পাঁচ-ছজন। তা ছাড়া ডাকাতরা আমাদের কাছে আসবে কেন? আমাদের সঙ্গে তো টাকাপয়সা বেশি নেই। ওরা আগে থেকে খবর নিয়ে আসে।

গৌতমকাকু বললেন, রাস্তাটা তো বেশ ভালই দেখছি। ভাঙা নেই, গর্ত নেই। দুপাশের চা-বাগান একেবারে সবুজ, ভারী সুন্দর, মনে হয় কী পিসফুল জায়গা। এর মধ্যেও চোর-ডাকাত!

সন্তু বলল, গৌতমকাকু, তোমার এক নম্বর বাড়ল।

গৌতমকাকু বললেন, ও, পিসফুল বলে ফেলেছি। শান্তিময়, শান্তিময়।

কাকাবাবু বললেন, গৌতম, তুইও ডাকাতির কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলি নাকি? ওরকম ভয় পেলে তো কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়াই যায় না।

গৌতমকাকু বললেন, না, না, ভয় পাইনি। সিনসিনাটিতে তো একদিন আমার চোখের সামনেই ব্যাঙ্ক-ডাকাতি হয়ে গেল। সন্তু, ব্যাঙ্ক বলতে পারি তো?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, ব্যাঙ্কের বাংলা নেই। আপনি ডাকাতদের দেখতে পেলেন?

গৌতমকাকু বললেন, হ্যাঁ, আমিও তো তখন সেই ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গেছি। ওরা মাত্র তিনজন, কালো মুখোশ পরে ছিল, বন্দুক তুলে আমাদের সবাইকে হাত তুলে দাঁড়াতে বলল। তারপর দু মিনিটের মধ্যে টাকাফাকা সব নিয়ে বেরুতে যাবে, এর মধ্যে এসে পড়ল পুলিশ, দুদিক থেকেই গুলি চলতে লাগল, আমি তো ভয়ে একেবারে কাঁটা। ওরা কিন্তু পালিয়ে গেল ঠিকই। ওরা ব্যাঙ্কের একটা মেয়েকে ধরে সামনে দাঁড় করিয়ে পুলিশকে বলল, গুলি চালানো বন্ধ করো, নইলে মেয়েটা আগে মরবে। পুলিশরা থেমে গেল। ওরা মেয়েটাকে সুষ্ঠু একটা গাড়িতে চেপে ভোঁ-ভাঁ।

সন্তু বলল, সিনেমায় এরকম দেখা যায়।

রতন বলল, ফালাকাটাতে একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছিল, সেখানে কিন্তু একজন ডাকাত ধরা পড়ে গেছে।

মিলিকাকিমা বললেন, বাবা রে বাবা! থাক, আর ডাকাতের গল্প করতে হবে না।

গৌতমকাকু বললেন, ফালাকাটা। অদ্ভুত নাম। আরও কত নাম শুনেছি, গোরুমারা, চাপড়ামারি—

কাকাবাবু বললেন, আর একটা জায়গার নাম আরও অদ্ভুত। রাজা-ভাতখাওয়া!

গৌতমকাকু বললেন, বাংলাতে এগুলিকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে না?

কাকাবাবু বললেন, কী জানি, আমি অত গ্রামার জানি না। সন্তু বলতে পারবে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, তোমার এক নম্বর বাড়ল। গ্রামার নয়, ব্যাকরণ।

পুরু আপনমনে হেসে উঠল।

মিলিকাকিমা বললেন, হাসলি কেন রে? পুরু বলল, টোমরা সবাই ইংরাজি বলো। আমি বললেই ডডাস?

মিলিকাকিমা বললেন, ডোস নয়, দোষ?

সন্তু বলল, এই তো একটা তেঁতুল গাছ। গাড়িটা একটু থামান তো। পুরুকে দেখাব।

রতন গাড়িটা থামিয়ে দিল।

গৌতমকাকু বললেন, তেঁতুল গাছ আবার দেখবার কী আছে?

সন্তু বলল, তেঁতুল কেমন দেখতে হয়, তা পুরু জানে না। এ-গাছটায় অনেক তেঁতুল হয়ে আছে। ওকে একটা কাঁচা তেঁতুল খাইয়ে দিলে ও আর কখনও ভুলবে না।

মিলিকাকিমা বললেন, তেঁতুলের টক আমার খুব ফেভারিট। রাস্তার ধারের গাছ। এ গাছ থেকে কয়েকটা তেঁতুল পেড়ে নিলে কেউ কিছু বলবে?

গৌতমকাকু বললেন, ফেভারিট? ফেভারিট জিনিস খেতে হলে দিতে হবে এক টাকা। সন্তু, লিখে রাখ।

মিলিকাকিমা বললেন, বাবা রে বাবা, সবসময় কি মনে থাকে! দেব এক টাকা ফাইন।

সন্তু বলল, এক টাকা নয়, দু টাকা। ফাইন বলেছেন। আমরা বলছি। জরিমানা।

গাছটায় অনেক তেঁতুল ফলে আছে বটে, কিন্তু হাতের নাগাল পাওয়া যায় না। রতন ঢিল ছুড়ে ছুড়ে তেঁতুল পাড়ার চেষ্টা করল।

সন্তু বলল, ওভাবে হবে না। আমি গাছে উঠতে পারি।

সন্তু তরতর করে গাছের গুঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। একটা ডালে দাঁড়িয়ে পটাপট করে তেঁতুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল নীচে।

মিলিকাকিমা বললেন, সন্তু পড়ে যাবে না তো? আরও ওপরে উঠছে কেন?

কাকাবাবু বললেন, না, কেন? ব্যস, ব্যস, অনেক হয়েছে, এবার নেমে আয় সন্তু।

সন্তু নেমে এসে পুরুকে বলল, এই দ্যাখো, তেঁতুল পাতা। খুব ছোট ছোট হয়।

গৌতমকাকু বললেন, বাংলায় একটা কথা আছে না, যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নজন। ভারী সুন্দর কথাটা।

সন্তু বলল, তেঁতুল পাতাও খাওয়া যায়, বেশ টক টক লাগে।

তারপর একটা তেঁতুল ভেঙে আধখানা পুরুকে দিয়ে বলল, তুমি টক খেতে পারো তো? চেখে দ্যাখো!

মিলিকাকিমা খুশিমনে বললেন, বিনি পয়সায় এত তেঁতুল পাওয়া যায়? আজ আমি তেঁতুলের টক রান্না করব।

পুরু তেঁতুলের ভাঙা দিকটায় জিভ ছুঁইয়ে বলল, ভাল খেটে। এটা টেটুল?

সন্তু বলল, টেটুল নয়, তেঁতুল। পুরু বলল, টেনটুল?

সন্তু বলল, উঁহু হল না। টেনটুল নয়, বলল, ত, ত, তেঁতুল! পুরু বলল, ট, ট।

কাকাবাবু বললেন, আর দেরি কোরো না, সবাই গাড়িতে ওঠো!

সন্তু বলল, একবার যদি ও তেঁতুল বলতে পারে, তা হলে অনেক কিছু শিখে যাবে। তুমিকে টুমি বলবে না। খেতে-কে খেটে বলবে না।

গাড়ি চলতে শুরু করার পর পুরু বারবার বলতে লাগল, টেনটুল, টেটুল। আর তাকে শুধরে দিতে লাগল সন্তু।