জাপানে কাব্যপাঠ ও রফিক আজাদের গোঁফ

জাপানে কাব্যপাঠ ও রফিক আজাদের গোঁফ

বোধহয় নাম দেওয়া হয়েছিল নিপ্পন-বাংলা বান্ধব সমিতি বা এই ধরনের কিছু। বেশ কয়েক বছর আগের কথা, আমার সঠিক মনে নেই। মনে না থাকার একটা কারণ, সমিতিটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে বলা যায়।

সেই সমিতির প্রথম অনুষ্ঠান হয় জাপানে। সাহিত্যবাসর ও কবিতাপাঠ। জাপানের প্রখ্যাত রবীন্দ্রপ্রেমী কাজুও আজুমা এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। কাজুও আজুমা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক ও কলকাতা-শান্তিনিকেতনে বিশেষ পরিচিত, প্রায়ই আসেন এবং প্রধানত তাঁর উদ্যোগেই শান্তিনিকেতনে নিপ্পন ভবনের প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

ডাক পেয়েই আমি এক পায়ে খাড়া। কারণ আমি আগে কখনও জাপানে যাইনি। চিন ঘুরে এসেছি। কিন্তু জাপান না দেখলে যে জীবনই অসমাপ্ত হয়ে যায়।

ব্যবস্থাটি অনাড়ম্বর ও সংক্ষিপ্ত। কলকাতা থেকে আশিস সান্যাল, সে একজন উদ্যোক্তা এবং আমি, আর ঢাকা থেকে হায়াৎ মামুদ ও রফিক আজাদ। কোনও হোটেলের ব্যবস্থা নেই, আমাদের আশ্রয় হয়েছে এক-একজনের বাড়িতে, তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশি।

টোকিওতে পৌঁছেই শুনেছিলাম, ওদেশে পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালির সংখ্যা মোটে দুশো, আর বাংলাদেশিদের সংখ্যা দশ হাজার। পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিরা সবাই কাজকর্মে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত আর বাংলাদেশিরা যে-কোনও কাজ করতেই প্রস্তুত। পশ্চিমবাংলার মধ্যবিত্ত বাঙালি, এমনকি বেকার ছেলেরাও জীবিকার সন্ধানে অন্য দেশে পাড়ি দিতে চায় না। যারা যায়, তারা আগে থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতির ব্যবস্থা কিংবা চাকরির নিয়োগপত্র পেলেই তবে যায়। আর সেই তুলনায় বাংলাদেশের ছেলেরা অনেক বেশি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, তারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঝুঁকি নিয়েও অন্য দেশে চলে যায়, এমনকী নিয়মমাফিক সব কাগজপত্র না নিয়েও কোনও কোনও দেশের সীমান্ত পেরিয়ে গোপনে ঢুকে পড়ে।

টোকিও’র পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিরা অনেকে মিলে আমাদের এক দুপুরে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভালো-ভালো খাদ্য পানীয় পরিবেশন করেছিলেন। নাকি কয়েকদিন আমাদের কেটেছে বাংলাদেশীয় সাহচর্যে।

আমার আশ্রয়দাতার নাম ফারুক। সে একটি ছোট কারখানার ফোরম্যান। জাপানে যে বিখ্যাত সব মোটরগাড়ির কোম্পানি আছে, তারা বিরাট কারখানা না বানিয়ে ছোটখাটো অনেক যন্ত্রাংশ অনেক ছোট ছোট কারখানা থেকে গড়িয়ে নেয়। সেইজন্য পাড়ায় নানা এরকম ছোট কারখানা আছে। ফারুকের কারখানাটাও তার বাড়ির খুব কাছেই। এইসব কারখানার মালিকরা তাদের পঞ্চাশটি কর্মীর ব্যক্তিগত জীবনের নাড়িনক্ষত্রও জানে। তার একটা মজার উদাহরণ দেখেছিলাম পরে।

ফারুক ছিপছিপে চেহারার সুদর্শন যুবক। সে তার যোগ্যতার জোরে সাধারণ কর্মী থেকে ফোরম্যান হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স নিয়ে জাপানি ভাষা শিখেছে। ওদেশে স্থানীয় ভাষা না শিখলে কিছুই করা যায় না। ইংরেজির ব্যবহার যৎসামান্য। জাপানে বহু ভ্রমণকারী যায়। কিন্তু তাদের সাহায্য করার জন্য কোনও ইংরেজি গাইড বুক অতি দুর্লভ। আমি খোঁজ করেও পাইনি। জাপান সরকার নাকি পর্যটকদের আকর্ষণ করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়। আসে তো আসুক, না এলেও ক্ষতি নেই, এরকম মনোভাব।

ফারুক বলেছে, তার মাসিক উপার্জন, টাকার হিসেবে এক লক্ষ। তার থেকে সে প্রতি মাসে দেশে পাঠায় পঞ্চাশ হাজার, আর নাকি পঞ্চাশ হাজার নিজের খরচে লাগে। এইরকমভাবে টাকা জমালে চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই ঢাকা শহরে একটা তিন-চারতলা বাড়ি কেনা যায়। ফারুক কিনেও ফেলেছে বোধহয়।

ফারুকের অ্যাপার্টমেন্টটির অবশ্যই বর্ণনা করা দরকার। এত ছোট অ্যাপার্টমেন্ট আমি জন্মে দেখিনি। জাপানে জনসংখ্যার তুলনায় বাসযোগ্য ভূমি খুবই কম। অনেক ধনী ব্যক্তিও খুব ছোট বাড়িতে থাকে। ফারুকের একটিমাত্র ঘর, তারই মধ্যে এত ছোট বাথরুম যে নড়াচড়া করাও যায় না। ঘরের মধ্যেই রান্নার ব্যবস্থা। আর ঘরটিকে কাঠের পাটাতন দিয়ে দেড়তলা করা হয়েছে। একটা ন্যাড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয়। ওপরটাও একদিক একেবারে খোলা। অন্ধকারে একটু নড়াচড়া করতে গেলেই ধপাস করে নীচে পড়ে যাওরার সম্ভাবনা। ওই খাড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় যে কোনওদিন পা পিছলে পড়ে যেতে হতে পারে। বিশেষত মদদ খেয়ে অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরার পর। আমাকে ওই ওপরের জায়গাটিতে শুতে দেওয়া হয়েছিল খাতির করে। কিন্তু আমি যে একদিনও পড়ে যাইনি, সেটা একটা মিরাকল বলা যেতে পারে।

টোকিও একটা বিরাট, ছড়ানো শহর। এক সময় পৃথিবীর এক নম্বর শহর ছিল, এখন জনসংখ্যার নিরিখে সে স্থান নিয়ে নিয়েছে মেক্সিকো সিটি। সে শহরের ধারে কাছে আর কেউ নেই। রফিক আজাদ থাকে আমার কাছাকাছি, এই পাড়াটির নাম ছাইতাম। প্রথম প্রথম মনে রাখার জন্য আমি বলতাম ছাই আর তামা।

রফিক আর আমি একসঙ্গে রাস্তায় বেরুলে সবাই রফিকের দিকে ফিরে-ফিরে তাকায়। আমার চেহারায় দর্শনীয় কিছু নেই, খানিকটা স্থূলকায়, সেরকম তো ওদেশেও অনেকেই। প্রথম-প্রথম বোঝা যায়নি, রফিক কেন বিশেষ দ্রষ্টব্য। পরে বোঝা গেল, তাঁর গোঁফটি অসাধারণ, শুধু পুরুষ্ট নয়, দু’দিকে ঘুরে গেছে, অনেকটা চেঙ্গিস খানের মতন।

টোকিওর ভূগর্ভস্থ মেট্রো ট্রেনের বিভিন্ন শাখা চালায় তিন-চারটি কোম্পানি। সুতরাং পরিসেবার উন্নতির জন্য আছে প্রতিযোগিতা। আর সময় রক্ষার ব্যাপারটা বিস্ময়কর। ছ’টা সতেরোয় একটা ট্রেন আসবে তো আধ মিনিটও এদিক-ওদিক হবে না। ট্রেনের যাত্রীরা কোনও কথা বলে না। এক-একটা স্টেশন থেকে মানুষ উঠেই বসে পড়ে। কোনও বই বা পত্রপত্রিকা খুলে রাখে চোখের সামনে। যারা বসবার জায়গা পায় না, তারাও দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বই পড়ে। ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে এত বই পড়য়া আমি প্যারিস নিউইয়র্কেও দেখিনি। কলকাতায় তো নয়ই। যদিও আমাদের ছেলেবেলায় দেখতাম, কলকাতা থেকে দূরপাল্লার যাত্রীরা প্রায় সবাই বই বা শারদীয় সংখ্যা কিনে নিয়ে উঠতেন। এখন আর তো দেখি না। এখন বড়জোর খবরের কাগজ আর রাজনীতিচর্চা।

ইংরেজি-বাংলা আমরা পড়ি বাঁ দিক থেকে ডানদিকে। উর্দু লেখা ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। আমাদের মতে যেটা বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা, উর্দুতে সেটাই প্রথম পাতা। আর জাপানি ভাষা চেনা হয় ওপর থেকে নীচে। চিনে ভাষারই সংক্ষিপ্ত রূপ জাপানি লিপিমালা। তাও প্রায় দেড় হাজার অক্ষর এবং চিনেরই মতন ছবি-অক্ষর।

চিনে গিয়ে দেখেছি, সেখানে কৰিসম্মেলনের চল নেই। প্রকাশ্যে কবিরা কবিতা পাঠ করে না। কবিতার বই নিভৃতে পাঠ করাই শ্রেয়। রাশিয়ায় আবার এর উলটো। সেখানে অনেক কারখানাতে কবিতা পাঠের আসর বসে। জাপানও অনেকটা চিনের অনুসারী। আমাদের অনুষ্ঠানে কয়েকজন জাপানি কবিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাঁরাও কবিতা পাঠের ব্যাপারে প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখানে প্রধান উদ্যোক্তা বাংলাদেশিরা, সুতরাং অনেকক্ষণ কাব্যপাঠ তো থাকবেই। গল্প-উপন্যাস লেখকদের এই এক দুর্ভাগ্য, তাঁরা এমন সব সমাবেশে আমন্ত্রণ পান না। আমিও যে গল্প-উপন্যাস লিখে থাকি, তা এইসব অনুষ্ঠানে এসে গোপন করে যাই। যেন, গদ্য লেখা একটা গহিত অপরাধ।

অনুষ্ঠানের জন্য একটি হল ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। সরকার কিংবা বড় ধরনের কোনও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। জাপানে সব কিছুই ব্যয়বহুল, টাকাপয়সার অনটন তো ছিলই, অনেকটাই সাহায্য করেছিলেন কাজুও আজুমা সান (সান মানে মহাশয়) এবং বাকিটা বাংলাদেশি ছেলেরা। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা এবং কবিতা পাঠ হল জাপানি ভাষায় এবং বাংলায়, ইংরেজির নামগন্ধ নেই। জাপানের এক প্রখ্যাত লেখিকা কবিতা পাঠ করলেন দাপটের সঙ্গে, তার একবর্ণও বুঝলাম না অবশ্য। আমাদের কবিতাও ওঁদের কাছে তথৈবচ। শুধু ধ্বনিমাধুর্য কি তেমন উপভোগ করা যায় বেশিক্ষণ? দক্ষিণ আমরিকাতেও ইংরেজি একবারেই চলে না। তবে সেখানে অন্য ভাষার কবিরা আমন্ত্রিত হলে তাঁদের আগে থেকেই স্প্যানিশ কিংবা পোর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করিয়ে রাখা হয়। এখানে সেরকম কোনও ব্যবস্থা করা যায়নি। অবশ্য এই অনুষ্ঠানে বাংলাভাষী দর্শকও বেশি। যে কয়েকজন জাপানি দর্শক ছিলেন, তাঁরাও এতক্ষণ ধরে বাংলা কবিতা পাঠ শুনতে-শুনতে অধৈর্য হয়ে উঠে যাননি। এতে ফুটে ওঠে জাতিগত পরিচয়। জার্মানির একটি শহরেও দেখেছি, দীর্ঘক্ষণের ভারতীয় অনুষ্ঠানে হলঘর পূর্ণ ছিল, কোনও দর্শকই বেরিয়ে যাননি বাইরে। অনুষ্ঠানের মধ্যপথে চলে যাওয়াটা ওসব দেশের অসভ্যতা বলে গণ্য হয়। আমরা ওসব শিখিনি। আমরা নিজের কবিতা পাঠ শেষ হলেই, একটুক্ষণ উশখুশ করে চলে যাই বাইরে। অন্যদের কবিতা শোনার তোয়াক্কা করি না।

অবশ্য জাপান ছাড়া আর কোনও দেশে করিলে পর গলাধাক্কাও খেতে হয়নি। এখানে সব কিছু চলে ঘড়ির কাঁটায়-কাঁটায়। অনুষ্ঠান শেষ করে হল ছাড়তে হবে ঠিক ন’টার সময়। আমাদের অনুষ্ঠানগুলি তো শুরু হয় ঢিলেঢালাভাবে। ঠিক সময়ে শুরু হয় না, ঠিক সময়ে শেষও হয় না। দুটো কবিতা পড়ার কথা থাকলে কেউ-কেউ পড়ে পাঁচটি কবিতা, কেউ-বা আর একটি ছোট্ট কবিতা বলে শোনায় একটি পাঁচ পাতার লম্বা কবিতা।

এখানে ন’টা বাজার সঙ্গে-সঙ্গে কারুর কবিতা পাঠের মধ্যপথেই কয়েকটি আলো নিভে গেল, হাজার অনুরোধেও আর এক মিনিটও সময় বাড়ানো হবে না। হল ছাড়তেই হবে। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলেও গটগট করে বেরিয়ে যাওয়া আমাদের অভ্যেস নেই, গুচ্ছ গুচ্ছভাবে নানারকম বিশ্রম্ভালাপ চলে। হলে গার্ডরা তাদের নিজস্ব ভাষায় চেঁচিয়ে বলতে লাগল, এক্ষুনি হল খালি করে দাও। গেট বন্ধ হয়ে যাবে, আমরা তো তাদের ভাষা বুঝছি না, সুতরাং আমাদের শ্লথ গতি। তখন সেইসব গার্ডরা আমাদের ধাক্কা দিয়ে ঠেলে বার করে দিতে লাগল। এতে প্রতিবাদ করার কিছু নেই, যে দেশে যেমন আচার, তা তো মানতেই হবে।

টোকিও শহরে দ্রষ্টব্য স্থান প্রচুর। নবাগতদের পক্ষে সব জায়গায় চিনে-চিনে যাওয়া সম্ভব নয়। ভাষার অসুবিধে তো আছেই। কাজুও আজুমা মহাশয়ের স্ত্রী একদিন বহু সময় ধরে খুব যত্ন করে আমাকে অনেকগুলি জায়গায় নিয়ে গেলেন। শহরের মাঝখানেই বিশাল সিন্টো মন্দির। প্রচুর গাছপালায় ঘেরা, তার মধ্য দিয়ে অনেকখানি হাঁটতে হয়, সেই প্রৌঢ়া মহিলার হাঁটাতেও কোনও ক্লান্তি নেই। তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে।

আমি অবশ্য রেনকোজি মন্দিরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর তথাকথিত ভস্মাধার দেখার জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করিনি। কারুর ছাইটাই দেখে সময় নষ্ট করতে যাব কেন? মস্কোতে গিয়ে আমি লেলিনের শবাধারও দেখিনি। যদিও ঘোরাঘুরি করেছি ক্রেমলিনের আশেপাশে।

জাপানে ধর্ম সম্বন্ধে একটা মজার ব্যাপার আছে। জনগণনার সময় ধর্ম বিশ্বাস উল্লেখ করারও একটা জায়গা আছে। বৌদ্ধ, সিন্টো ও খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীদের সংখ্যা যোগ করে দেখা গেল, যোগফল জাপানের মোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি! তা কী করে হয়? এর অর্থ, অধিকাংশ জাপানিই ধর্ম ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দেন না, অনেক লোকই লিখে দিয়েছে তারা বৌদ্ধধর্মেও বিশ্বাস করে, আবার সিন্টো ধর্মেও কিংবা খ্রিস্ট ধর্মে!

সেই সময়ে আমার ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। তার একটি সংখ্যায় মহেন্দ্রলাল সরকারের একটি উক্তিতে কালীমূর্তিকে বলা হয়েছিল ‘সাঁওতালি মাগী’। এতে সাঁওতালি এবং হিন্দুদের অনেকে আমার ওপর খুব চটেছিল। যদিও উক্তিটি আমার নয়, মহেন্দ্রলাল সরকারের এই উক্তি ছাপা হয়েছিল একশো বছর আগে এবং শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা শুনে হেসেছিলেন। একটি সিনেমার পত্রিকার মলাটে আমাকে নিয়ে এই বিতর্কটার কথা ছিল। একটি বাংলাদেশিদের আড্ডায় সেই পত্রিকাটি পড়েছিল, একজন সেটা এগিয়ে আমাকে জিগ্যেস করল, সুনীলদা, এটা আপনি লিখলেন, এখন আপনাকে যদি কেউ মারধোর করে? আমি বলেছিলাম, এই যে প্রশ্নটা করলে, এরকম প্রশ্ন ওঠে বলেই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটে দেশ জাপানের তুলনায় এত পিছিয়ে আছে!

জাপান সম্পর্কে আর একটি কাহিনিও খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এই দেশ প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। পরমাণু বোমারও আঘাত সহ্য করেছে এই দেশ। চরম অপমানের সঙ্গে আত্মসমর্পণ করতেও বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তার কয়েক বছরের মধ্যেই সব কিছু আবার নতুনভাবে গড়ে ওঠে, জাপান হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ। এটা কী করে হল? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থের অভাব যেমন ছিল, তেমন ছিল লোকজনেরও অভাব। সেই সময় জাপানের সম্রাট জীবিত নাগরিকদের কাছে আবেদন জানালেন। জীবিকার জন্য যার যা কাজ আছে, তা তো তারা করবেই, তা ছাড়াও দেশের জন্য অন্তত দু’ঘণ্টা শ্রমদান করতে হবে বিনা পারিশ্রমিকে। অর্থাৎ অফিস থেকে ফেরার পর সবাই আরও দু’ঘণ্টা রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণের কাজে সাহায্য করবে। জাপানের সম্রাটকে সবাই বিশেষ মান্য করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পরাজিত জাপানবাহিনী যখন আত্মসমর্পণের জন্য কয়েকটি শর্ত দেয়, তার সব কটিই অগ্রাহ্য করে বিজয়ী বাহিনী। তখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাঁচুমাচুভাবে বলেছিলেন, অন্তত একটা শর্ত থাকুক, আমাদের সম্রাটকে যেন কোনওভাবেই অপমানিত করা না হয়!

সম্রাটের সেই আবেদন শুনে দেশের প্রতিটি নাগরিক বিনামূল্যে শ্রমদান করতে লাগল প্রতিদিন। সবকিছু নতুনভাবে গড়ে উঠল খুব দ্রুত। দু’বছর বাদে জাপানের সম্রাট আবার বিবৃতি দিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন এবং বললেন যে আর শ্রমদান করার দরকার নেই। তখন বহু লোক বলল, না, না, আমাদের দু’ঘণ্টা অতিরিক্ত পরিশ্রম করা অভ্যেস হয়ে গেছে। আমাদের টাকাপয়সা চাই না, আমরা এখনও ওই দু’ঘণ্টা শ্রমদান চালিয়ে যেতে চাই।

আশ্চর্যের ব্যাপার এত পরিশ্রমী হয়েও জাপানিরা জুয়াখেলাতেও খুব উৎসাহী। জুয়াখেলা এখানে আইনসম্মত, প্রায় প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে মোড়ে জুয়ার আচ্ছা, যা একটি হলঘরের মতন। এখানে জুয়াকে বলে পাচিংকো। সম্ভবত অত পরিশ্রম করে বলেই এই জুয়াখেলাটা তাদের অবসর বিলাস রিলাক্সেশন! সম্ভবত এইজন্যেই টোকিও শহরে খুনের ঘটনা পৃথিবীর অন্য শহরের তুলনায় সবচেয়ে কম, ধর্ষণের ঘটনা প্রায় ঘটেই না বলতে গেলে! রাত তিনটের সময় কোনও ভদ্রঘরের মহিলাকে আমি একলা একলা হেঁটে যেতে দেখেছি, কেউ তার হাত ধরে টানাটানি করার সাহস পাবে না। এখানে বড়-বড় থানার বদলে আছে অসংখ্য ছোট ছোট থানা, প্রত্যেক পাড়ায়, বড় রাস্তা থেকে একটু দূরে, খানিকটা আড়ালে। কেউ সাহায্য চেয়ে চিৎকার করলে দু’মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে পড়ে

বাংলাদেশিরা অনেকেই জুয়া খেলতে চায়। ফারুক যে বলেছিল, প্রতি মাসে সে পঞ্চাশ হাজার টাকা রাখে নিজের জন্য, তার অনেকটাই যায় জুয়ায়। ওরা খেলে থাকে এই আশায়-আশায় যে একবার ‘জ্যাকপট’ মারতে পারলে পেয়ে যাবে কয়েক কোটি টাকা, তখনই ফিরে যেতে পারবে দেশে।

আমারও বেশ জুয়াখেলার ঝোঁক আছে, ওদের সঙ্গে খেলতে গেছি কয়েকবার। হেরেছি প্রত্যেকবার। পৃথিবীর অনেক দেশেই আমি জুয়া খেলতে গিয়ে শুধুই হেরেছি। তাতে আমার উল্লসিত হওয়ার একটা কারণ আছে। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, প্রেমের ক্ষেত্রে যে ভাগ্যবান, জুয়াতে তার ভাগ্য খোলে না।

আমাকে নিয়ে শহরের বাইরে বেড়াতে যাবে বলে ফারুককে দু’দিন ছুটি নিতে হবে। ওদেশে যখন তখন ছুটি নেওয়া চলে না। তাই ফারুক টেলিফোনে তার মালিককে জানাল, তার হঠাৎ জ্বর এসেছে, সে কারখানায় যেতে পারবে না। মাসিক তাকে বলে দিল, কালকের মধ্যে জ্বর না কমলে কোন ওষুধ খেতে হবে, কোন ডাক্তার দেখাতে হবে। শুধু তাই-ই নয়, ঘণ্টাদুয়েক পরে মালিকের প্রৌঢ় স্ত্রী ফারুকের ফ্ল্যাটে এসে হাজির! সে মিথ্যে কথা বলেছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য নয়। বাবা-মা কাছে নেই, বিয়েও করেনি, একা একটি বিদেশি ছেলে, বেশি জ্বর হলে কে তাকে খাবার দেবে, কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, তাই মহিলাটি এসেছেন তাকে কিছুটা সেবা ও সাহায্য করতে। মালিকপক্ষের এরকম মানবিকতা বোধ খুবই দুর্লভ না?

ফারুক প্রথমে অসুখের ভাব করে মটকা মেরে শুয়ে ছিল, ভদ্রমহিলার আন্তরিকতা দেখে উঠে বসে বলল, সত্যি কথা বলছি, আমার এই দাদা এসেছেন ভারত থেকে, তাঁকে কয়েকটা জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতে চাই, চাই অন্তত দুটো দিন…। ভদ্রমহিলা এতেও ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই, ভারত থেকে তোমার অতিথি এসেছেন, তাঁকে আমাদের দেশটা তো দেখানোই উচিত। অবশ্যই ফুজি পাহাড়ে নিয়ে যাবে, আর একটা লেকে…।

পরদিন সকালে আমরা বেরুবার তোড়জোড় করছি। রফিক ও আরও কয়েকজন আসেনি বলে গড়িমসি চলছে, তার মধ্যে সেই ভদ্রমহিলার ফোন। তিনি ফারুককে বললেন, তোমরা এখনও বেরোওনি? পূর্বাভাসে বলেছে, বেলার দিকে খুব বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালাতে অসুবিধে হবে খুব। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো, আর সাবধানে গাড়ি চালিয়ো। বেলা পড়লে ট্রাফিক জ্যামও বাড়বে! দেখো, তোমার অতিথির যেন কোনও অসুবিধে না হয়!

সত্যি জাপান এক আশ্চর্য দেশ!

রফিক আর আমি একসঙ্গেই ঘোরাঘুরি করি। একদিন সকালে রফিককে দেখে আমি হতবাক। প্রায় চিনতেই পারি না। ‘গোঁফের আমি, গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা!’ রফিকের সেই চেঙ্গিসি গোঁফ অদৃশ্য!

আমার বিস্তিত দৃষ্টি দেখে রফিক লাজুকভাবে বলল, কাল রাত দুটোর সময় হঠাৎ ক্ষুর নিয়ে দিলাম গোঁফটা কেটে। রাস্তায় বেরুলেই লোকে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে থাকে, তারপর দেখি কি এখানে আর একটা মানুষেরও গোঁফ থাকে না। তারপর একজন বলল, জাপানের একমাত্র সম্রাটই গোঁফ রাখতে পারে। তাই অন্য কেউ রাখে না গোঁফ। দূর ছাই, আমিও সেইজন্য…।

গোঁফবিহীন রফিকের ব্যক্তিত্বও যেন কমে গেল খানিকটা। গলার আওয়াজও খানিকটা মিনমিনে। দেশে ফিরে গেলে এই অবস্থায় ওকে ওর বউও চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ! যাই হোক, পরবর্তীকালে ঢাকায় গিয়ে দেখেছি, রফিকের সেই বিখ্যাত গোঁফ আবার স্বস্থানে ফিরে এসেছে।

আমার হিরোসিমা-নাগাসাকি দেখে আসার ইচ্ছে ছিল। জাপানে ট্রেনভাড়া অসম্ভব বেশি আর সেখানে চেনাশুনো কেউ নেই। এইসব কারণে পুরো দেশটার অনেকখানি সেবার দেখা হয়নি।

ওখানে আমি কাজুও আজুমা মহাশয়ের সঙ্গে এমন একটা ব্যবহার করেছিলাম, যার জন্য তিনি আমার ওপর খুব ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন তো বটেই, পরবর্তীকালেও কলকাতায় দেখা হলে আর আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেন না। ব্যবহারটি অন্যায় ঠিকই, কিন্তু আমি জেনেশুনেই সেটি ঘটিয়েছি। কাজুও আজুমা একদিন আমাকে তাঁর বাড়িতে দ্বিপ্রহরের আহারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওদেশে কারুর বাড়িতে আমন্ত্রণ পাওয়া বিশেষ সৌভাগ্যের ব্যাপার এবং সেই আমন্ত্রণ পেয়েও অনুপস্থিত হওয়া অত্যন্ত অভদ্রতা। আমি জাপানি শিষ্টতার নীতি লঙ্ঘন করেছি। নিশ্চয়ই খুব ভালো-ভালো খাবার খাওয়াতেন, তবু আমি যাইনি, তার কারণ, তিনি আমার পাশে রফিক আজাদকে দেখেও তাকে নেমন্তন্ন করেননি। নির্দিষ্ট দিয়ে তিনি দু-বার আমাকে টেলিফোন করেছিলেন, আমি শরীর খারাপ, পেট খারাপ, এইসব মিথ্যে অজুহাত দিতে বাধ্য হয়েছি। কারণ, আমারও তো একটা ভারতীয় রীতি আছে। রফিককে ডাকেননি, আমি ওকে ফেলে রেখে একা যাই কী করে? কোনও প্রলোভনেই বন্ধুকে ত্যাগ করা উচিত নয়, এটা আমাদের শিষ্টতার অঙ্গ।

দ্বিতীয় পর্ব

সে একটা সময় ছিল যখন কলকাতায় বহু বিদেশি বিমান সংস্থা যাওয়া-আসা করত। আমি নিজে প্রথমবার বিদেশে যাই প্যান-অ্যাম কোম্পানির বিমানে, সে কোম্পানিই এখন উঠে গেছে, তার বদলে আর কোনও আমেরিকান বিমান কলকাতার মাটি ছোঁয় না বহুদিন। আরও অনেক দেশের বিমান কলকাতার সংস্রব এড়িয়ে চলে। কিন্তু গত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কলকাতা বিমান বন্দরের যেমন ছিল রমরমা, তেমনই ছিল কলকাতা শহরের সুনাম ও আকর্ষণ। অবশ্য ষাটের দশক থেকেই সেই সুনামে একটু একটু চিড় ধরতে শুরু করে। কিন্তু তা টের পেতে আরও কিছুটা সময় লেগেছিল।

সেই সময় বহু বিদেশিরও আগমন ঘটত এই শহরে নানা প্রয়োজনে, বহু বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়তে আসত কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসতেন বহু পণ্ডিত ও গবেষক এবং অনেক বিখ্যাত লেখক-লেখিকা। নকশাল আন্দোলনের সময় যখন-তখন বনধ, লক-আউট, ট্রামে বাসে আগুন, বোমাবাজি, রাস্তায়-ঘাটে খুনোখুনির অবস্থা যখন চরমে ওঠে তখন থেকেই বড় বড় বিমান কোম্পানিগুলি কলকাতাকে পরিত্যাগ করতে শুরু করে। বিদেশিদের আগমনেও ভাটা পড়ে। এখনকার কলকাতায় মাসের পর মাস নিরুত্তাপ ও রাজনৈতিক সংঘর্ষবিহীন অবস্থা দেখে সেই সময়কার উত্তাল দিনগুলির কথা কল্পনা করাই শক্ত। কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় আমাদের হাঁটতে হত শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তদের মতন দু’হাত উঁচু করে। অর্থাৎ রাস্তার পাশের অপেক্ষমান পুলিশদের দেখাতে হত যে আমাদের হাতে বোমা-পিস্তল কিছু নেই।

বিদেশি প্রবাহ যখন অব্যাহত ছিল, সেই সময় ইংরেজি ভাষা-ভাবী জগতে তকালীন সাড়াজাগানো কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এসে পড়লেন কলকাতায়। তিনি যেমন বিখ্যাত, তেমনই কুখ্যাত। তাঁর ‘হাউল’ নামের কাব্যগ্রন্থটি নাকি একমাসে বিক্রি হয়েছিল দশ লক্ষ কপি, ইংরেজি ভাষারও কোনও কবিতার বইয়ের এমন জনপ্রিয়তা প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনা।

অ্যালেন গিনসবার্গ সম্পর্কে আমরা প্রথমে কিছু কথা জানতে পারি বুদ্ধদেব বসুর একটি রচনা থেকে। সে রচনাটির নাম ‘বিট বংশ ও গ্রিনিচ গ্রাম’। তখন আমেরিকায় কবি-শিল্পীরা একটা আন্দোলন শুরু করেছিলেন, যার নাম বিট, এই আন্দোলনকারীদের বলা হত বিটনিক। এই আন্দোলনেরই পরবর্তী ব্যাপক রূপ হচ্ছে হিপি। এখনকার অনেকে হয়তো হিপি নামটি মনে রেখেছে, বিটদের কথা জানে না। হিপি আন্দোলন সারা পৃথিবীতেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। আমেরিকায় মাঝে-মাঝে এই সব হুজুগ ওঠে, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হিপিদের পরবর্তী রূপকে বলা হত ফ্লাওরার চিলড্রেন, তারপর তারাও মিলিয়ে যায়।

বিট আন্দোলন শুধু সীমাবদ্ধ ছিল কবি-লেখক-শিল্পীদের মধ্যে, হিপিদের মধ্যে ঢুকে পড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা, সব ধরনের তরুণ। হিপিদের নিয়ে অনেক ঠাট্টা-ইয়ার্কি, অবজ্ঞা প্রদর্শন হয়েছে বটে, কিন্তু এরা আমেরিকায় সমাজে একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে। এরা পোশাক-পরিচ্ছদের কৃত্রিম নিয়ম থেকে শুরু করে সমাজের অনেকরকম কৃত্রিমতার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করেছিল এবং এরা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী। আর বিটদের ছিল একটা নিজস্ব জীবনদর্শন। কবিতা লিখতে গেলে বা শিল্পচর্চা করতে গেলে কোনওরকম প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব করা চলবে না, জীবিকা অর্জনের জন্য সময় নষ্ট করা চলবে না, কবিতা লেখা বা শিল্পচর্চাই চব্বিশ ঘণ্টার কাজ। অর্থাৎ ইস্কুলমাস্টারি কিংবা প্রাইভেট টিউশানি করাও নিষিদ্ধ। সেজন্য জামা-জুতো, খাওয়া-দাওরার খরচ কমিয়ে ফেলতে হবে যথাসম্ভব। ছেঁড়া জামা, খালি গা-তেও কিছু যায় আসে না। একেবারে অভুক্ত অবস্থায় এসে পড়লে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কবিতা পড়তে-পড়তে ভিক্ষে করাও ভালো। অর্থাৎ প্রায় সাধু ফকিরদের মতন জীবনযাপন। অবশ্য ওসব দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে-মাঝে কবিদের কাব্যপাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানায় এবং ভালো দক্ষিণা দেয়। আমাদের দেশে সে রীতি নেই।

অ্যালেন গিনসবার্গ ও তার বন্ধুবান্ধবরা এভাবেই জীবনযাপন করত। তা ছাড়াও অ্যালেনের ছিল অতীন্দ্রিয় জীবনদর্শনের প্রতি ঝোঁক। সেইজন্যই তার অতিরিক্ত টান ছিল ভারতবর্ষের প্রতি। আমেরিকায় বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা করে সেই ষাটের দশকের গোড়ায় অ্যালেন বলেছিল, প্লেনের ভাড়া জোগাড় করতে পারব না, তবু আমি একদিন হেঁটে-হেঁটে হলেও ভারতে যাবই যাব, কলকাতায় আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে।

সত্যিই সে একদিন হাজির হল, তার সঙ্গী পিটার অরলভস্কিকে নিয়ে। পুরোপুরি হেঁটে আসা তো সম্ভব নয়। আটলান্টিক পার হতে হয়েছে জাহাজে, তারপর মধ্য প্রাচ্যের মরুভূমির দেশগুলি কখনও পদব্রজে, কখনও হিচ হাইকিং করে এসেছে। কলকাতায় পৌঁছে সে তরুণ কবিদের খোঁজ করতে-করতে পেয়ে যায় কৃত্তিবাসের দলবলকে। তারপর আমাদের এমনই বন্ধুত্ব হল যে প্রায় প্রতিদিনই দেখা না হলে চলবে না।

সেই প্রথম একজন বিদেশি ও বিশ্ববিখ্যাত কবির সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয়। তার আগে সাহেব মেম তো অনেক দেখেছি, কবি-অধ্যাপক পল এঙ্গেল এবং অসম্ভব ধনী এক মহিলা কবি রুথ স্টেফানের সঙ্গেও আমাদের অন্তরঙ্গতা হয়েছিল, কিন্তু অ্যালেন গিনসবার্গ এক মূর্তিমান ব্যতিক্রম। মুখভরতি দাড়ি, ছেঁড়া-ময়লা পোশাক এবং পায়ে রবারের চটি, অথচ উচ্চশিক্ষিত, এরকম আমেরিকায় সাহেব কলকাতা শহরে আগে দেখিনি।

অ্যালেনরা এসে প্রথমে উঠেছিল বাগরি মার্কেটের কাছে আমজাদিয়া হোটেলে। সে অতি নীচু স্তরের শস্তা হোটেল, খুবই অপরিচ্ছন্ন, তেলচিটচিটে বিছানা। আমেরিকানরা পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে খুবই পিটপিটে হয়। একদিন আমি ওই হোটেলের বাথরুম দেখে স্তম্ভিত। অমন নোংরা, কুৎসিত বাথরুমে পা দিয়ে আমাদেরই বমি উঠে আসে। জলের মগটি শ্যাওলা ধরা ও ফটো। সেই বাথরুমই ওরা দুজনে অম্লানবদনে ব্যবহার করছে। এ যেন শরীরকে কষ্ট দেওয়ার এক সাধনা।

দিনের পর দিন অ্যালেন গিনসবার্গের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তার জ্ঞানের পরিধি এবং কবিত্ববোধের সন্ধান পেয়ে আমাদের জীবনদর্শনও অনেকটা পালটে যায়। বেশিরভাগ দিনই আমাদের আড্ডা জমত গঙ্গার ধারে, নিমতলা শ্মশানে নিমতলা শোনে। অ্যালেনের কাছেই আমাদের গাঁজা খাওয়ার দীক্ষা হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, আমাদের দেশে সাধু-সন্ন্যাসীরা হাজার-হাজার বছর ধরে গাঁজার ধোঁয়ার সঙ্গে চিত্তকে জাগ্রত করার সাধনা করে আসছে, আর আমাদের কিনা সেই গাঁজা খাওয়া শিখতে হল এক সাহেবের কাছে! এদেশের মধ্যবিত্তরা মনে করত গাঁজা খাওয়া ঘোটলোকদের ব্যাপার! হিপিদের প্রভাবে পরবর্তীকালে এদেশের উচ্চবিত্ত সমাজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে গাঁজার নেশা চালু হয়। এক বিখ্যাত অধ্যাপক ঘোষণা করেছিলেন, মদ, বিড়ি, সিগারেট এমনকি চা-কফির চেয়েও গাঁজা কম ক্ষতিকর, বরং মনকে সূক্ষ্ম করে। লেখক অলডাস হাকসিলও এই মত সমর্থন করেছেন তাঁর ‘ভোরস অফ পারসেপশন’ গ্রন্থে।

অ্যালেন ও পিটারের সঙ্গে আমাদের এই মেলামেশা অনেকেই পছন্দ করেনি। তখন বামপন্থী আবহাওয়া খুব উত্তপ্ত। অ্যালেনদের প্রধান দোষ, তারা আমেরিকান। আমেরিকার প্রতি অনেকেরই তীব্র ঘৃণা। রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকায় ভূমিকা নিশ্চিত সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষকে একই মানদণ্ডে বিচার করাও মূর্খ। অ্যালেন একজন কবি, কবিদের নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের গণ্ডিতে বাঁধা যায় না। তা ছাড়া, অ্যালেন তার বিভিন্ন লেখায় রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকাকে যে কত তীব্র আক্রমণ করেছে, তাও জানে না কট্টর বামপন্থীরা।

এই সময় জামশেদপুর থেকে এক সাহিত্য সম্মেলনে আমাদের আমন্ত্রণ করা হল। খুবই বিরাট আয়োজন। উদ্যোক্তারা আমাদের মতন একঝাঁক তরুণ কবিদের নামে চিঠি দিলেন, যাওয়া হবে রেলের কামরা সংরক্ষণ করে।

সেই সময় আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল, অ্যালেন ও পিটারকেও সঙ্গে নিয়ে গেলে কেমন হয়! শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সেই ইচ্ছের কথা জানাতেই সেও খুব উৎসাহিত। কিন্তু অ্যালেনরা কি যেতে রাজি হবে? আমাদের সঙ্গে সহজভাবে মিশলেও সে তো পৃথিবীতে অন্যতম অগ্রগণ্য কবি। বিনা আমন্ত্রণে কি সে কোনও সাহিত্যসভায় যেতে পারে?

অ্যালেন কিন্তু প্রস্তাবটি শোনামাত্র সম্মত হয়ে গেল। কলকাতার বাইরে কোথাও ঘোরা হবে। একটা বাংলা কবিসম্মেলনও দেখা হবে। ট্রেনের কামরায় হইহই করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম জামশেদপুর।

একটা কথা মনে পড়েনি, জামশেদপুরের টাটা কোম্পানির বাঙালিদের মধ্যেও তখন উত্তপ্ত বামপন্থী আবহাওয়া!

আমাদের সঙ্গে দুজন সাহেবকে দেখে, তারা আমেরিকান জেনে উদ্যোক্তাদের মুখ ভার হয়ে গেল।

তখন কমল চক্রবর্তী ও কৌরবের দলবল খুবই ছোট। সেখানকার বুদ্ধিজীবীদের নেত্রী ছিলেন পূরবী মুখোপাধ্যায়। এ নামে একজন গায়িকা আছেন, কিন্তু জামশেদপুরের পূরবী ছিলেন একসময় কলকাতার নামকরা ছাত্রী এবং ওখানকার ডাক্তার বিষ্ণু মুখোঁপাধ্যায়ের স্ত্রী। পূরবী ছিলেন যেমন রূপসি, তেমনি বিদুষী, অত্যন্ত তেজস্বিনী এবং সেই কট্টর বামপন্থী। ওখানকার তরুণরাও পূরবীকে খুব মান্য করত।

পরবর্তীকালে পূরবীর সঙ্গে আমার সুন্দর বন্ধুত্ব হলেও সেইসময়ে পূরবী আমাদের কৃত্তিবাসের দলটিকে অপছন্দ করতেন, কারণ তিনি মনে করতেন যে আমরা অশ্লীল কবিতা লিখি। আর আমেরিকানরা তাঁর দু’চক্ষের বিষ।

সেই সম্মেলনে কয়েকজন গল্পকার ও নাট্যকার থাকলেও কবিদেরই ছিল প্রাধান্য। কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে তুমুল কোলাহল হত। উদ্যোক্তারা চেয়েছিলেন, আমরা কে, কী কবিতা পড়ব, তা আগে থেকে দেখাতে হবে। অর্থাৎ আমরা যাতে কোনও অশ্লীল কবিতা পড়ে না ফেলি। কিন্তু এই শর্তে আমরা রাজি হব কেন? আমাদের তীব্র আপত্তিতে গোলমাল শুরু হয়ে গেল। পূরবী জ্বালাময়ী ভাষণে আক্রমণ করলেন আমাদের। আমরাও তীব্র ভাষায় উত্তর দিতে ছাড়িনি। এর মধ্যে আবার শক্তি চট্টোপাধ্যায় মত্ত অবস্থায় হাজির হয়ে পরিস্থিতি সরগরম করে দিল। পূরবী অবশ্য কিছুদিন পরে হাসতে-হাসতে বলেছিলেন, আসলে তিনি আমাদের কবিতা পছন্দই করেন।

যাই হোক, উদ্যোক্তারা প্রথম থেকেই গোঁ ধরে রইলেন। অ্যালেন গিনসবার্গকে কিছুতেই ওই সম্মেলনে কবিতা পড়তে ডাকা হবে না। প্রথমত তিনি অনিমন্ত্রিত, দ্বিতীয়ত তাঁর গায়ের চামড়ার রং সাদা এবং জন্মেছেন আমেরিকান। আমাদের প্রবল দাবিও উপেক্ষিত হল। তখন আমরা কয়েকজন ধুত্তোর ছাই বলে সেই সাহিত্য সম্মেলন দ্বিতীয় দিনেই বর্জন করে চলে গেলাম চাইবাসার দিকে। আর কোনও কবিসম্মেলনে এরকম ঝগড়াঝাঁটির মুখে পড়তে হয়নি আমাদের।

ওখান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে, টাটা কোম্পানির এক ইঞ্জিনিয়ার আমাদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ালেন। তিনি কিছুদিন আগেই আমেরিকা থেকে ফিরেছেন, তাই অ্যালেনের খ্যাতির খবর জানতেন। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় যাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কবিতা পাঠ করবার জন্য ঝুলোঝুলি করে, তিনি জামশেদপুরে অবাঞ্ছিত এবং উপেক্ষিত।

সেই ভদ্রলোকের বাড়ির ঘরোয়া আসরে আমাদের সঙ্গে অ্যালেনও কয়েকটি কবিতা পড়ল। তার মধ্যে আমেরিকা বিষয়ক একটি কবিতার কয়েকটি লাইন এরকম :

America, when will we end the human war?
Go fuck yourself with your atom bomb

নিজের দেশ সম্পর্কে এমন কঠোর কথা ক’জন কবি সাহস করে বলতে পারে?

এই কবিতাটির মধ্যেই স্বীকারোক্তি আছে, অ্যালেনের মা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যা, অ্যালেন নিজের সম্পর্কেও বলেছে :

America I used to a Communist when I was a kid I am not sorry…
you should have seen me reading Marx…

হায়, জামশেদপুরের উদ্যোক্তারা এই সব কিছুই জানতে পারল না।

এরপর আমরা গেলাম সুবর্ণরেখা নদীর তীরে বেড়াতে। অন্ধকার, বালির ওপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ অ্যালেন তার ভরাট সুরেলা গলায় বলে উঠল :

Black magician, Come home.

কেন জানি না, এই লাইনটা সারাজীবন আমার মর্মে গেঁথে আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *