[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৯. ফরিদপুর জেলার এক গণ্ডগ্রামে আমার জন্ম

অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গে ফরিদপুর জেলার এক গণ্ডগ্রামে আমার জন্ম। কিন্তু বাল্যকালে ফরিদপুর থেকে কলকাতা অনেকবার এসেছি বটে, কিন্তু এদিকে, আরও পুবে কখনও যাওয়া হয়নি, এমনকী ঢাকা শহরও দেখিনি। আমার প্রথম ঢাকা-দর্শন পাকিস্তান আমল শেষ হওয়ার পর, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম মাসে।

তারপর বাংলাদেশে যাওয়া আসা করেছি অনেকবার, কিন্তু প্রায় প্রত্যেকবারই আটকে গেছি ঢাকায়। বার দু-এক চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ভ্রমণ করেছি যদিও কিন্তু অন্য জেলাগুলি দেখার সুযোগ ঘটেনি। ঢাকার বন্ধুরা অন্য অনেক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বটে, কিন্তু আড্ডার নেশায় মেতে প্রতিবারই ঘনিয়ে এসেছে ফেরার দিন।

একবার অপ্রত্যাশিত সুযোগ এসে গেল।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন গণতন্ত্রের দিক থেকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় কি না তা পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথিবীর বহুদেশ থেকে প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছিলেন। সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি থেকেও প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয়েছিল, তার মধ্যে ভারত থেকে দশজন, সেই ভারতীয় দলটির মধ্যে কী করে যেন দৈবাৎ আমাকে অন্তর্ভুক্ত করা হল। এই দলে আরও দুজন বাঙালি ছিলেন বটে, প্রখ্যাত সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী এবং বিশিষ্ট সমাজতাত্বিক আশিস নন্দী, দুজনেই দিল্লি প্রবাসী। পশ্চিমবাংলা থেকে আমিই একমাত্র।

নির্বাচনের পর্যবেক্ষক, তাই সরকারিভাবে দারুণ খাতির-যত্নের ব্যবস্থা। বিমান থেকে নামার সঙ্গে-সঙ্গে কূটনৈতিক বিভাগীয় ব্যক্তিরা ভি আই পি লাউঞ্জে নিয়ে গেলেন, তারপর তুললেন ঢাকার সর্বোত্তম হোটেলে। সর্বক্ষণের ব্যবহারের জন্য ড্রাইভার সমেত গাড়ি। খাওয়া-দাওয়ার বাহুল্যের কথা আর বর্ণনা দিয়ে কাজ নেই। কে বলবে যে এক দরিদ্র দেশে এসেছে আর এক দরিদ্র দেশের মানুষ!

ইউরোপ-আমেরিকা-জাপান থেকেও পর্যবেক্ষকেরা এসেছেন, সকলকে শুধু ঢাকায় বসিয়ে রাখার কোনও মানে হয় না। তাই প্রস্তাব নেওয়া হল যে পর্যবেক্ষকদের ভাগ ভাগ করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বিভিন্ন জেলায়। আমাদের আপ্যায়নের ভার যাঁরা নিয়েছেন, বাংলাদেশের সেই সব কর্তাব্যক্তিদের অনেকের সঙ্গেই আমার আগে থেকে চেনাশুনো, তাঁরা আমাকে জিগ্যেস করলেন, কোনও বিশেষ জেলা আমার পছন্দ কি না, তা হলে তাঁরা সেখানেই আমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবেন। প্রায় কিছু না ভেবেই আমি বললাম, বরিশাল!

তাঁরা বেশ অবাক হয়েছিলেন। অনেকেই জানতেন যে আমার জন্মস্থান ফরিদপুর, তথা মাদারিপুর, আগে মহকুমা ছিল, এখন মাদারিপুর একটি স্বতন্ত্র জেলা। আমি তো ইচ্ছে করলেই মাদারিপুর বেছে নিয়ে সেখানে গিয়ে স্মৃতি রোমন্থনের সুযোগ পেতাম। কিন্তু সেখানে আমার যেতে ইচ্ছে করে না।

আরও যে কত জেলা ছিল, তবু বরিশাল আমি বেছে নিলাম কেন? বরিশালে আমার তেমন চেনাশুনো কেউ নেই, আলাদা কোনও আকর্ষণ নেই। তবে কিছুদিন আগে তপনমোহন রায়চৌধুরীর লেখা স্মৃতি-রম্যকাহিনিতে বরিশাল সম্পর্কে অনেক কিছু পড়েছিলাম, সেই জন্যই কিবরিশাল নামটা প্রথমে মনে এসেছিল?

আর একটি চমৎকার ব্যাপার ঘটল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আর একজন যে পর্যবেক্ষককে আমার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হল, সে আমার পূর্বপরিচিত তো বটেই, আমার প্রিয় ও বিশেষ স্নেহভাজন ইমদাদুল হক মিলন। মিলন বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার, অল্প বয়েস থেকেই সে দারুণ জনপ্রিয়, তা ছাড়াও তার মতন পড়ুয়া আমি খুব কম দেখেছি। বাংলাসাহিত্যের যাবতীয় রচনা তার পড়া, তার স্মৃতিশক্তিও ভালো, মিলনের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। আমাদের তত্বাবধানের জন্য পরারাষ্ট্র দফতরের এক তরুণ অফিসারকেও সঙ্গে দেওয়া হল, তার নাম আনোয়ার। বয়েস বেশ কম, প্রথম প্রথম তার ব্যবহার বেশ আড়ষ্ট মনে হয়েছিল, সে আমাকে মিস্টার গঙ্গোপাধ্যায় বলে সম্বোধন করছিল। কোনও বাঙালির মুখে এরকম সম্বোধন শুনলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এ ছেলেটি মেধাবী ছাত্র, পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছে, কেরিয়ার ডিপ্লোম্যাট হতে চায়, সাহিত্যের ধার ধারে না, আমি যে কিছু লিখি-টিখি তা সে জানেও না। একদিন পরেই ভুল ভেঙেছিল, আনোয়ার আসলে বেশ লাজুক, রোমান্টিক, সাহিত্যপ্রেমিক, নিজেও কিছু-কিছু লেখে। আমি তার তুলনায় অনেক বয়স্ক লেখক বলেই সে প্রথমে স্বাভাবিক হতে পারেনি। এক সময় মৃদু গলায় জিগ্যেস করেছিল, আমি কি আপনাকে সুনীলদা বলে ডাকতে পারি!

নির্বাচনের দুদিন আগে আমরা গাড়িতে যাত্রা করলাম বরিশালের দিকে। গাড়িতে বরিশাল? পুরোনো আমলের মানুষেরা এ কথা শুনলে বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলবেন। বরিশাল অনেক নদী ও জলাভূমি ঘেরা জেলা, ট্রেনলাইন নেই, স্থলপথে যাওয়ার কোনও উপায়ই ছিল না বহুঁকাল। নৌকো বা স্টিমারই ভরসা। পরাধীন আমলে সাহেবরা খুলনা থেকে বরিশাল পর্যন্ত যাত্রীবাহী স্টিমার চালাতেন। তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশি স্টিমার সার্ভিস চালু করে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের পথঘাটের এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। পশ্চিমবাংলার সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। সর্বত্রই মসৃণ রাস্তা। এত নদী, সব জায়গায় এখনও ব্রিজ তৈরি হয়নি, কিন্তু গাড়ি কিংবা বড় বড় যাত্রীবাহী বাস ফেরিতে পার করে দেওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা। ফেরিঘাটে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। মোট ন’ বার ফেরিতে নদী পার হতে হয়েছে, তার মধ্যে এক জায়গাতে সময় লেগেছে পৌনে দু’ঘণ্টা।

ঢাকা থেকে এদিকে আসতে গেলে দুটি ঘাট দিয়ে ঢাকা পার হতে হয়। আরিচা ও মাওয়া। আমরা এসেছিলাম বিক্রমপুরের মধ্য দিয়ে মাওয়া ঘাটে। এই বিক্রমপুরে ইমদাদুল হক মিলনের পৈতৃক বাড়ি। সে হাত তুলে কিছুদূরে তার বাড়িটা দেখাল। আমি এভাবে আমার নিজের বাড়ি দেখাতে পারব না। আমাদের মতন যাদের বাড়ির অস্তিত্ব এখনও ওই অঞ্চলে আছে, সেগুলি নাকি ‘শত্রু-সম্পত্তি’। আমি কী করে আর একজন বাঙালির শত্রু হয়ে গেলাম, তা জানি না।

মাওয়া ঘাট থেকে যে স্টিমারে ওঠা হল, সেটি মস্ত বড়, প্রায় জাহাজের মতন, দিগন্ত বিস্তৃত পদ্মা। এখানকার ক্যান্টিনে খাওয়া হল ইলিশ মাছের ঝোল আর ভাত। খুব যে আহামরি লাগল, তা নয়। সাধারণ রান্না। আজকাল পূর্ব বাংলার রাঁধুনিরাও ঝাল দিতে ভুলে গেছে। পদ্মার ইলিশের চেয়ে এদিককার কোলাঘাটের গঙ্গার ইলিশের স্বাদ যে অনেক বেশি ভালো, তা শুনলে ওদিকে অনেকে চটে যায়। পদ্মায় অনেক বেশি ইলিশ পাওয়া যায়, কিন্তু স্বাদে এদিককার গঙ্গার ইলিশ জিতে যায়।

পদ্মা পার হওয়ার একটু পরেই আবার একটি নদী পার হতে হল। আড়িয়াল খাঁ, আমার ছেলেবেলাকার নদী! ‘সে কেন দেখা দিল রে, না দেখা ছিল যে ভালো!’ আমার চোখ জ্বালা করে উঠেছিল। নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কী এক দুর্দান্ত, গর্জমান, অনবরত পাড়-ভাঙা নদীর ছবি আছে স্মৃতিতে, তার বদলে এখন চুপচাপ চলেছে নিরীহ, সাধারণ এক নদী। হয়তো আগেও এরকমই ছিল, বাল্যকালে সবই বড় বড় লাগে। ইস্কুলের মাঠটাকে মনে হয় প্রকাণ্ড, বাড়ির পাশের দিঘিটার ওপারও যেন ছিল রহস্যময় জঙ্গলে ঢাকা। এক-একটা রাস্তাকে মনে হত অনন্তের পথ। তা ছাড়া আড়িয়াল খাঁ-কে আমি হয়তো স্মৃতিতে ধরে ফেলেছি ভরা বর্ষার সময়কার রূপে। এখন প্রবল গ্রীষ্ম, সব নদীই শীর্ণ। এবং আছে ফরাক্কা বাঁধের সমস্যা, যে-জন্য বাংলাদেশে নদীগুলিতে জল কমে আসে। বাঁধ বেঁধে-বেঁধে পৃথিবীর সব দেশের নদীগুলিই যৌবন হারিয়েছে। কলকাতার গঙ্গার মাঝখানে গ্রীষ্মকালে লোকে হেঁটে বেড়ায়, বেলুড়ের কাছে আমি নিজে দেখেছি।

রাস্তার ধারে-ধারে গ্রাম ও শহরগুলির নাম লেখা। ফরিদপুর-মাদারিপুর পেরিয়ে গেলাম। একটা জায়গার নাম দেখে বুকটা ধক করে উঠেছিল একবার। ট্যাকের হাট! এর খুব কাছেই মা’র মামাবাড়ি আমগ্রাম। ওই মামাবাড়িতেই আমার প্রথম যৌন-উন্মেষ হয়েছিল। ওইখানে সাঁতার শিখি। যখন তখন ইজের আর গেঞ্জি খুলে নিয়ে ন্যাংটো হয়ে এক হাতে উঁচু করে ধরে, আর এক হাতে সাঁতার কেটে খাল পার হয়ে গেছি। ওইখানেই প্রথম সামনাসামনি দেখি মৃত্যু, আমার দাদামশাইয়ের। ওখানেই প্রথম হাতেখড়ি। ওখানেই প্রথম দুর্গাপুজোর সময় পাঁঠাবলি দেখে দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে আমি ছাদের এককোণে বসে কেঁদেছিলাম।

গাড়িটা একটু ঘোরালেই আমার সেই মামার বাড়ি–আমবাগান-আটচালা-পুকুর এখন কী অবস্থায় আছে দেখে আসতে পারি। না, যাব না, কিছুতেই যাব না।

বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বরিশাল।