[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

আন্দামান জায়গাটা আমার ভারী পছন্দের

আন্দামান জায়গাটা আমার ভারী পছন্দের

বয়স যখন কম ছিল, হোটেল-বাংলো কোনও কিছু ঠিক না করেই বেরিয়ে পড়তাম। অনেক সময় এমনও হয়েছে, থাকবার কোনও জায়গা পাইনি, সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছি গাছতলায়। কখনও বা কোনও রেল স্টেশনে। ভিখারি, ভবঘুরের সঙ্গে। মনে আছে, একবার সারা দিন হায়দরাবাদ শহর ঘুরে বেড়িয়ে, রাত্রে শুয়েছি স্টেশনে। খুব শীত করছিল। বেশি রাতে আর। থাকতে না পেরে, শেষে স্টেশনের এক ভিখারির কাছ থেকে কম্বল নিয়ে গায়ে দিয়েছিলাম।

সেভাবে এখন আর বেড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়। এখন নানা জায়গা থেকে আমন্ত্রণ আসে। তাঁরাই থাকবার যথাযথ ব্যবস্থা করে রাখেন। তবে কোনও আমন্ত্রণ ছাড়া এখনও বেড়াতে যাই বছরে দুবার। একবার বিদেশে, একবার স্বদেশে। এবং কোনও না কোনও কারণে প্রতি বছরই বিদেশ যাওয়াটা আমার ঘটেই যায়। আমরা কয়েক বন্ধু গাড়ি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার দু একটা দেশ ঘুরে আসি। এ দলে রয়েছে অসীম (ফ্রান্স), কান্তি (কানাডা), দীপ্তেন্দু (কানাডা), ভাস্কর আর ভিক্টোরিয়া (লন্ডন), প্রীতি (ফ্রান্স) এবং আমি, স্বাতী।

এ দেশেও বছরে একবার বাইরের বন্ধুরা আসে। ফলে তাদের নিয়েও চলে কোথাও না কোথাও আমাদের বেরিয়ে পড়া। দিন কয়েকের জন্য। যেমন দু বছর আগেই গেছিলাম আন্দামান। যদিও তার আগে আমার দুবার ঘোরা হয়ে গেছে। যার জন্য আমাকে ‘আন্দামান এক্সপার্ট’ বলা যেতে পারে। বন্ধুদের অনুরোধে আবার যেতে হল। তবে আমার কোনও আপত্তি ছিল না। কেননা সত্যি বলতে, জায়গাটা আমার ভারী পছন্দের। ফলে ওদের পথপ্রদর্শক হয়ে আবার গেলাম সেখানে। সঙ্গে ছিল বিদেশি বন্ধু দীপ্তেন্দু, অসীম, এখান থেকে বাদলবাবু আর আমি।

গত বছর বিদেশে ‘বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব’-এ গেছিলাম। ওই ভ্যাঙ্কুভারেই আমন্ত্রিত হয়ে গেছিল আমার বাল্যবন্ধু, চিত্রতারকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমাদের সঙ্গে শুধু আড্ডা মারার জন্য সেখানে উড়ে এল অসীম আর কানাডা থেকে কান্তি, রবীন। একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। দলে একমাত্র মহিলা সদস্য বলতে স্বাতী। কানাডার বিখ্যাত রকি মাউন্টেনের পাশ দিয়ে শুরু হল সেই যাত্রা। টানা পাঁচ দিন। আমরা ওই পর্বতমালার কখনও অন্দরে, কখনও বাইরে ঘুরেছি। সন্ধের পর ছোট ছোট সরাইখানায় রাত্রিবাস। বলাই বাহুল্য, ও দেশে ওই সব সরাইখানাতেও আরামদায়ক শয্যা এবং আধুনিকতার সমস্ত সরঞ্জামই মজুত! রকি মাউন্টেনের বৈশিষ্ট্য এই যে, এই সব পাহাড়ে কখনও গাছপালা গজায় না! নগ্ন, রুক্ষ তার চেহারা। তবু তার সৌন্দর্য অসাধারণ। এক-একটা চূড়াকে মনে হয় যেন এক-একটা ভাস্কর্য। তবে পাঁচ দিন আমরা কখনও হিমালয়ে ঘুরিনি। কারণ সেখানে ভালো রাস্তা নেই। ও দেশেরও পাহাড়ের ওপর দিয়ে রাস্তা অতি মসৃণ। এক জায়গায় দেখলাম এক গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ লক্ষ লক্ষ বছরের পুরনো। সেই হিমবাহের ওপরেও মানুষকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে!

প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চাকাওয়ালা গাড়ি অতি দুর্গম পথ দিয়ে সহজেই চলে যায়। সত্যিকারের একটি গ্লেসিয়ারের ওপর দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা এই প্রথম। প্রকৃতির এমনই বিচিত্র খেয়াল। চতুর্দিকে তুষারময় সেই অঞ্চলের অদূরেই এক উষ্ণ প্রস্রবণ। সেখানে বড় বড় স্নানাগারও আছে। দেখা মাত্র তো আমরা সব্বাই খালি গায়ে, জাঙ্গিয়া পরে নেমে গেলাম সেই উষ্ণ জলে।

পাঁচ দিন ধরে গিরিপথে সেই যে যাত্রা, তাতে আমরা একটুও ক্লান্ত বোধ করিনি। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা-গল্পগুজব করেই কাটিয়েছি। সৌমিত্র নানা গল্প-গানে মাতিয়ে রেখেছিল সারাটা ক্ষণ। অভিযানের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য ছিল কান্তি হোড় (৭৪)। আর ওর উৎসাহই ছিল যেন সবচেয়ে বেশি! কান্তির কোনও ক্লান্তি নেই! অদ্ভুত! তবে সে টিমে সকলেই ছিল অদ্ভুত। রবীন, বহুঁকাল প্রবাসী। এক মনে গাড়ি চালাল টানা পাঁচ দিন! অসীম হাজার হাজার ছবি তুলল, কিন্তু তার একটাও আমরা দেখতে পাব কি না সন্দেহ। কারণ, ও মানুষের ছবি তোলে না। প্রকৃতির মধ্যে কী যে খুঁজে বেড়ায়, কে জানে!

গত বছরটা আমাকে যেন পাহাড়ই টেনেছে। পাঁচ দিনের সেই অভিযানের পর আমরা গেছিলাম আর একটা আশ্চর্য পাহাড়ে। বস্টন থেকে কয়েক শো মাইল দূরের ওয়াশিংটন মাউন্টেনসে। তার একটা চূড়া অতি বিস্ময়কর। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। পাহাড়ের তলা রীতিমতো গরম। গায়ে মোটে একটা জামা। কিন্তু মাত্র মিনিট কুড়ি গাড়ি চড়ে শিখরে উঠলেই অসম্ভব ঠান্ডা! আর সব সময় দারুণ জোরে হু হু করে হাওয়া। সে হাওয়ার এতই জোর, দাঁড়িয়ে থাকা শক্ত। ওখানে যে ঠিক কী কারণে হাওয়ার এত প্রাবল্য, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সেই হাওয়ায় ওই কুড়ি মিনিটের গাড়ি চালানোটাও বেশ কঠিন। কিন্তু আমার ছেলে শৌভিক গাড়িতে বসিয়েই উপরে নিয়ে গেল আমায়, স্বা তাঁকে আর চান্দ্রেয়ীকে।

গত নভেম্বরে আমরা আবার বেরিয়ে পড়েছিলাম পাহাড়ের টানে। প্রথমে গ্যাংটক, সেখান থেকে পেলিং। পেলিং জায়গাটার দুপাশের প্রকৃতি খুউব সুন্দর, কিন্তু রাস্তাগুলো দুর্বিষহ। আর সেই রাস্তায় যেতে-যেতে গাড়ির লম্ভঝম্প দেখলে ভয় হয়। যদিও একবার পেলিং পৌঁছে গেলে চোখ, মন জুড়িয়ে যায়। ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ধবল চূড়া মনে হয় যেন খুব কাছে। হোটেলের বিছানায় শুয়েও দেখা যায় কিছু দূরের কাঞ্চনজঙ্া। ভোরবেলা স্বাতী আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। আর তখন আর এক চমক। কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই ধবল রূপ আর নেই! চারদিকে যেন ছড়িয়ে সোনা আর সোনা। কে ছড়াল ভোরবেলায় এত সোনা! এই কাঞ্চনবর্ণ তো আমি আগে কখনও দেখিনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *