২.০৬ মানুষকে শোষণ ও বঞ্চনা করা

মানুষকে শোষণ ও বঞ্চনা করা যেন অন্যায়, মানুষকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়াও একই রকমের অন্যায়। মানুষকে দুর্দশায় ঠেলে দেওয়া যেমন অমানবিক, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে কপট আশ্বাস দেওয়াও একইরকম অমানবিক। যে সমাজ সমস্ত মানুষকে খাদ্য-বস্ত্রের অধিকার দেয় না, সেই সমাজ যেমন অপরাধী, তেমনই যে সমাজ সমস্ত মানুষকে সমান খাদ্য-বস্ত্রের অধিকার দেওরার নামেই গড়ে ওঠে ও এক শ্রেণির সুবিধাভোগীকে প্রশ্রয় দেয়, সেই সমাজও অপরাধী।

পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখেছি, শাসনব্যবস্থা কিংবা সমাজব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত নয়। এক শ্রেণির ওপর আর এক শ্রেণির আধিপত্য চলতেই থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগ আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কারের বাধা তো আছেই, ধনী-নির্ধনের সমান অধিকারও অবাস্তব। আজকের পৃথিবীতে কোনও গরিব মানুষের পক্ষে সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া অসম্ভব। দলীয় রাজনীতিতে দলনেতাই যে দেশের সেরা মানুষ হবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময়েই দেশের সমস্ত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেন না। গণতন্ত্রে শাসক দলের পরিবর্তনের সুবোগ আছে, এটাই প্রধান কথা।

মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র শুধু আধুনিক চিন্তাই নয়, তাতে প্রকৃত পক্ষেই অনেক আশার বাণী আছে। শ্রেণি বিলোপ, উৎপাদনের সমবন্টন, দেশের সম্পদের অধিকার থাকবে রাষ্ট্রের হাতে, রাষ্ট্রই সব মানুষের জীবিকা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে, এসব প্রতিশ্রুতি তো আছেই, তা ছাড়া ধর্মীয় প্রভেদ একেবারে মুছে দিতে চেয়েছে। সমাজ জীবনে ধর্মের ভূমিকা একেবারে মুছে দেওরার এই চেষ্টা পৃথিবীর ইতিহাসে অভিনব। ধর্মীয় মূর্খতার জন্য মানুষের যে কত ক্ষতি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ধর্ম তো নিছক একটা রূপকথা, তা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হয়েছে বিশ্বের কোটি-নিযুত-অবুদ সংখ্যক মানুষকে। আমাদের ভারতে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম-রেষারেষি না থাকলে সাধারণ মানুষের উন্নতি যে অন্তত দ্বিগুণ হতো, তাতে কোনও সন্দেহ আছে কী? সীমান্তের বিপুল প্রহরা, গ্রাসাচ্ছাদনের বদলে কামান-বন্দুকের উৎপাদন এবং মাঝে-মাঝে ছেলেমানুষি যুদ্ধে আমরা যে বিপুল অর্থব্যয় করেছি, সবই আসলে গেছে ধর্মের আগুনে।

মাকর্সবাদী সমাজতন্ত্রের এই উচ্চ আদর্শ মানুষের ওপর প্রয়োগ করা যায় কি না এবং ঠিক কোন পথে প্রয়োগ করা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে অনেক নিদারুণ বিপর্যয় ঘটে গেছে। যাদের ওপর প্রয়োগের ভার, তারা ধরেই নিয়েছে যে মানুষ হচ্ছে ভেড়ার পাল। দেশে একটিই পার্টি থাকবে, যার নাম কমিউনিস্ট পার্টি, সেই পার্টির রাখালরা লাঠি উঁচিয়ে তাড়ালেই ভেড়ার পাল এদিকে ছুটবে।

সমাজতন্ত্রের এই দুঃখজনক ব্যর্থতার প্রধান কারণ হল ব্যর্থতার কথা গোপন করার চেষ্টা। মাঝে-মাঝে ভুল-ত্রুটি স্বীকার এবং সংশোধনের পথে গেলে হয়তো গতিটা মন্থর হত, কিন্তু এমন বিপর্যয় ঘটত না। তার বদলে তৈরি করা হল মিথ্যার বাতাবরণ।

সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি সম্পর্কে মস্কোতে একটা প্রতীকী গল্প প্রচলিত আছে। ধরা বাক, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে একটা ট্রেন। লেনিন এই ট্রেনটা চালাতে চেষ্টা করলেন। এত বড় একটা ট্রেন চালাবার জন্য প্রচুর জ্বালানি দরকার, লেনিন বললেন, মানুষের বাড়ির দরজা-জানলা ভেঙে আনো, বন-জঙ্গল কাটো, যে-ভাবে হোক এ ট্রেন চালাতেই হবে। এরপর স্তালিন হলেন সেই ট্রেনের চালক। তখন লোকের বাড়ির দরজা-জানলা আর নেই, বন-জঙ্গলও সাফ হয়ে গেছে, স্তালিন বললেন, মানুষ ধরে ধরে এনে ইঞ্জিনে ভরে দাও। মানুষ বেশ ভালো জ্বালানি। কয়েক কোটি মানুষকে সমাজতন্ত্রের শত্রু বলে দেগে দিলেই হবে। তারপর এল ক্রুশ্চেভের আমল। তখন দেখা গেল, ট্রেন যে চলবে, সামনের দিকে আর লাইন পাতা নেই, লাইন পাতার মতন ইস্পাতও নেই। তবু সমাজতন্ত্রের ট্রেন চালাতেই হবে। ক্রুশ্চেভ বললেন, পেছন দিককার রেল লাইন উপড়ে এনে সামনের দিকে পাত, এইভাবে পাততেই থাক। এরপর এলেন ব্রেজনেভ। তখন জ্বালানি নেই, লাইন পাতা যাচ্ছে না তো বটেই, তা ছাড়াও সামনে এক বিশাল পাহাড়। ট্রেন এগুবে কী করে? ব্রেজনেভ বললেন, এক কাজ করা বাক। সমস্ত কামরার দরজা জানলা বন্ধ করে দাও, ভেতরে সারা দেশের মানুষ থাকুক, পার্টি মেম্বাররা শুধু নেমে দাঁড়াও। তারপর পার্টি মেম্বাররা সবাই মিলে ট্রেনটাকে ঝাঁকাতে থাক, তা হলে ভেতরের লোকগুলো ভাববে, ট্রেন ঠিকই চলছে। এরপর গরবাচেভ এসে বললেন, ভেতরে অন্ধকারে লোকগুলো যে কাতরাচ্ছে। দরজা-জানলা সব খুলে দাও। ভেতরের লোকগুলো বাইরের আসল চেহারাটা দেখুক। তারপর যা হওরার হোক!

এটা একটা মর্মান্তিক রসিকতা! সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থা নিশ্চয়ই এতটা খারাপ হয়নি, কিন্তু দেশের অবস্থা কতটা খারাপ হলে সাধারণ মানুষ নিজের দেশ সম্পর্কে এরকম গল্প ছড়াতে পারে?

কী পরিমাণ প্রচার চালানো হয়েছে সমাজতন্ত্রের সার্থকতার সপক্ষে! প্রচারের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশ-বিদেশে যত খরচ করেছে, ততটা কি করছে উৎপাদন বাড়াবার জন্য? পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্তের আগে পর্যন্ত অনেকের ধারণা ছিল, পশ্চিমের দেশগুলি সব নরক, আর সমাজতান্ত্রিক জোট একেবারে স্বর্গরাজ্য।

অনেকেই এখন বলছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্য সব ইন্ড্রাস্ট্রি (আমরা ইন্ড্রাস্ট্রির বাংলা করেছি শিল্প, কিন্তু সব জায়গায় শিল্প কথাটা খাটে না) উন্নত হতে না পারলেও একমাত্র যে ইন্ড্রাস্ট্রি খুব সার্থক হয়েছিল, তার নাম মিথ্যে প্রচারের উৎপাদন।

কিছুদিন আগেও অনেকের ধারণা ছিল, সোভিয়েত দেশ পৃথিবীর দুই বৃহত্তম শক্তির অন্যতম। কে প্রথম, কে দ্বিতীয় বলা দুষ্কর। আমেরিকা যত অণু-পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে, সোভিয়েত দেশও তা বানাচ্ছে, এদের মিসাইল আছে, ওদেরও আছে। এরা মহাকাশযান পাঠাচ্ছে, ওরাও পাঠাচ্ছে। দু’দিকে চলেছে সমান টক্কর, তাহলে সোভিয়েত দেশ দুর্বল হবে কেন? কিন্তু এর মধ্যেও প্রচুর মিথ্যে আছে। আমেরিকা কতবার রকেট পাঠাতে ব্যর্থ হয়, কোনটা ভেঙে পড়ে, তা জানতে কারুর বাকি থাকে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন কত বার ব্যর্থ হয় তা কেউ জানে? আমেরিকা তারকা-যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার খরচ করে। কিন্তু সে জন্য কি সে দেশের মাংসের উৎপাদন কম পড়ে? আমেরিকা চাঁদে রকেট পাঠায় কিন্তু সে জন্য দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্যে টান পড়ে না। আর সোভিয়েত দেশে? এখন জানা যাচ্ছে যে, অস্ত্র কিংবা মহাকাশযানের কোনও যন্ত্র বানাতে গিয়ে আমেরিকা যদি তিনবারের পরীক্ষায় সার্থক হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের লাগে কুড়িবার। আমেরিকার কোনও টেকনিশিয়ান দু-তিনবারের বেশি ব্যর্থ হলে তাকে চাকরি ছাড়িয়ে দেওয়া হবে, আর সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনও সরকারি কর্মী কুড়িবার ভুল করলেও তার কোনও শাস্তি নেই। এর ফলে, একই ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমে আমেরিকার তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের খরচ হয়েছে অনেক গুণ বেশি। অস্ত্র ও মহাকাশযান নির্মাণে এই বিপুল অপচয়ে সেখানকার অর্থনীতি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সাধারণত পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনের কল-কারখানাগুলি পুরোনো, ঝরঝরে অবস্থা, অথচ সে দেশের সরকার মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার রকেট বানিয়েছে। দেশের মানুষকে খাদ্য, বস্ত্র, পেস্ট, সাবান না দিয়ে এই সব খেলনা বানানোর উদ্দেশ্যও নিছক মিথ্যে প্রচার। বাইরের পৃথিবীকে জানানো যে সে দেশ কত শক্তিমান! এ যেন আধখানা জানলার কাছে দাঁড়ানো কোনও সুসজ্জিত মানুষ, যে কোমরের তলা থেকে উলঙ্গ।

পশ্চিমি দেশগুলির অবস্থাও এমন কিছু আহামরি নয়। নিখুঁত ব্যবস্থা কোথাও নেই। আমেরিকা যতটা সর্বশক্তিমানের ভাব দেখায়, ততটা শক্তিমান নয় সে দেশ। এত শক্তি নিয়েও তো আমেরিকা কানমলা খেয়েছে ভিয়েতনামের কাছে উপসাগরীয় যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে জব্দ করে জিতেছে বটে, আর কোনও দেশ থেকে বাধা আসেনি, মনে হয় যেন আমেরিকা এখন পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি, তা আসলে নয়, আমেরিকার অর্থনীতি একটা বিপুল ধাক্কা খেয়েছে। উনিশশো একানব্বই সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় আমেরিকার লাভ হয়নি কিছুই। ভুতপূর্ব সোভিয়েতের বিভিন্ন স্বাধীন দেশগুলিতে ছড়িয়ে থাকা সাতাশ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে আমেরিকাকে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। ধনতান্ত্রিক দেশের বাণিজ্য এক এক সময় যেমন উত্তুঙ্গ হয়, তেমনি এক এক সময় ঝাঁপ করে পড়েও যায়। আমেরিকান এত বড় জেনারেল মোটরস কোম্পানি পুঁকছে আই বি এম লোকসান করছে। প্যানাম-এর মতন বিশাল বিমান সংস্থা বন্ধ হয়ে গেল। বহু সহস্র মানুষ বেকার। আমেরিকার বাজারে এমন হতাশার অবস্থা বহুদিন দেখা যায়নি। ও দেশের মানুষ সঞ্চয় শেখে না। ভোগ্যপণ্যের এমনই তীব্র আকর্ষণ ও প্রচার যে অধিকাংশ মানুষই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে। হঠাৎ উপার্জন বন্ধ হয়ে গেলে তাদের বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়। ব্যাংকের কাছ থেকে উদার ঋণ নিয়ে সবাই বাড়ি কেনে, কিন্তু ঋণ শোধের কিস্তি বন্ধ হলেই ব্যাংক টুটি চেপে ধরে। ওদেশের পথে পথে এখন বেকারের ভিড়। সবচেয়ে শক্তিশালী ধনতান্ত্রিক দেশ এখন একা আমেরিকা নয়, জাপান। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় আমেরিকা এখন জাপানের থেকে পিছিয়ে। ওদিকে সংযুক্ত জার্মানি গোকুলে বাড়ছে। ইউরোপের দেশগুলি জোটবদ্ধ হয়েছে। পৃথিবীতে আমেরিকার একাধিপত্যের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।

অনেকে এখন ঠাট্টা করে বলছে যে, এরপর আমেরিকা হয়ে যাবে কমিউনিস্ট দেশ, আর রাশিয়া হবে ক্যাপিট্যালিস্ট। রাজনীতির খেলায় কিছুই অসম্ভব নয়।

আমাদের দেশে অনেকে বলেন যে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে যতই গণ্ডগোল থাক, ওসব দেশের সমস্ত মানুষ মোটামুটি খেতে পরতে পেত এবং কিছু না কিছু জীবিকার নিশ্চয়তা ছিল, এখন সেই ব্যবস্থা বদলের পর সকলকেই ঠেলে দেওয়া হল অনিশ্চয়তার দিকে।

এই কথার মধ্যে অনেকখানি যুক্তির ফাঁক আছে। চোখে ধূলো দেওয়ার ব্যাপার আছে। আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা আছে। আমাদের দেশের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মানুষই সারা বছর দু’বেলা খেতে পায় না। কোটি কোটি শহুরে বেকার তো আছেই, তা ছাড়া গ্রামের ভূমিহীন, কৃষক-মজুররা বছরের কিছু সময় কাজ পায়, অন্য সময় তাদের কোনও ক্রয় ক্ষমতাই থাকে না। বহু মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা নেই। এই ব্যবস্থার তুলনায় যেখানে মানুষ দু’বেলা কিছু না কিছু খেতে পাচ্ছে, যে-কোনও রকম একটা বাসস্থান আছে এবং সরকার প্রত্যেকেরই কিছু একটা জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়, সে দেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত অনেক ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই, আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা করা হবে কেন?

মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ বাদ দিলে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি সবই ইউরোপে। সমাজতন্ত্র বর্জিত বাকি ইউরোপের অবস্থা কী? সোভিয়েত দেশের সঙ্গে আমেরিকার তুলনা দেওরার প্রয়োজন ছিল না। তুলনা দিতে হবে ইউরোপের সঙ্গে। যেমন ভারতের সঙ্গে তুলনা দেওয়া চলে চিনের।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের যে পরিবর্তন ঘটেছে, এর আগে কোনওকালে তেমনটি হয়নি। এককালে ইউরোপেও এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে চরম দারিদ্র্য ও অশিক্ষা ছিল, গৃহহীন-উপবাসীও ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলি গত পঁয়তাল্লিশ বছর যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে, এমন বিশ্রাম তারা আগে কখনও পায়নি। এই সব দেশের অর্থনীতি এমন একটা রূপ নিয়েছে, যাতে অতি ধনী হয়েছে কিছু লোক। আর আছে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আমরা যাকে দরিদ্র শ্রেণি বলি, সেই শ্রেণিটা মুছে গেছে ওইসব দেশ থেকে। দু-বেলা খেতে পায় না কিংবা বাড়িঘর নেই কিংবা শীতবস্ত্র নেই, নিছক পাগল-মাতাল ছাড়া এমন মানুষ নেই ওসব দেশে। বেকারদেরও ওইসব দেশের সরকার না খেয়ে মরতে দেয় না। সোশাল সিকিউরিটির ওপর যারা নির্ভর করে, তাদের অবস্থা আমাদের দেশের অনেক চাকরি পাওয়া লোকের চেয়ে ভালো। কারখানা থেকে যে শ্রমিকটির চাকরি যায়, সে পেট্রোল পাম্পের তেল দেওয়ার একটা কাজ পেয়ে যেতে পারে, এবং তার উপার্জন তুচ্ছ নয়। ওইসব দেশের শতকরা আশিজনের অবস্থা সমাজতান্ত্রিক দেশের মানুষদের তুলনায় অনেক বেশি সচ্ছল। ওইসব দেশ গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অনেকটা ঘুচিয়ে ফেলেছে। আমি ইউরোপের বহু গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছি, প্রকৃত গ্রাম বলতে আর কিছু নেই। সর্বত্রই পাকা রাস্তা, জরাজীর্ণ বাড়ি চোখে পড়ে না, জীবন যাপনের সব রকম উপকরণ সারা দেশে একইরকম ভাবে পাওয়া যায়। ধনতন্ত্রের তুলনায় সমাজতন্ত্র অনেক মহত্তর আদর্শ নিয়েও এইখানে ধাক্কা খেয়েছে।

পোল্যান্ড-হাঙ্গেরি-চেকোশ্লোভাকিয়ার মানুষ কখনও ভাবেনি যে তারা গরিব ভারতীয়দের তুলনায় ভালো আছে। তাদের ক্ষোভ জমা হয়েছে এই কারণে যে তারা ফ্রান্স-জার্মানি-ইংল্যান্ডের চেয়ে কেন খারাপ আছে? প্রতিযোগী রাষ্ট্রের মানুষ যদি ভালো খেতে পরতে পায়, তাদের বাসস্থান যদি উন্নতমানের হয়, তারা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসগুলি যদি নিয়মিত পায়, তাহলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় থাকবে কতদিন? সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান প্রকট। শহরে তবু যা পাওয়া যায়, গ্রামে সেসবও দুর্লভ। লোক দেখানোর জন্য শহরে ঢাউস ঢাউস বাড়ি বানানো হয়েছে, অথচ সেগুলি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সবাইকে চাকরি দেওয়ার নামে মানুষগুলির ইচ্ছে-অনিচ্ছে কিংবা যোগ্যতার মূল্য না দিয়ে যে-কোনও একটা কাজে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। চাকরির ক্ষেত্রে এরকম বহু বিক্ষুব্ধ ব্যক্তির দেখা পেয়েছি আমি ওই দেশগুলিতে। গ্রামের মানুষ শহরে যেতে পারে না ইচ্ছেমতন, দেশের যে-কোনও জায়গায় জীবিকা খুঁজে নেওয়ার অধিকার নেই তার। সমাজতন্ত্রের আসল প্রতিযোগিতা ছিল অন্য ইউরোপের সঙ্গে, কিন্তু সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরাবার জন্য সমাজতন্ত্রের কর্তা ও তাত্বিকেরা আমেরিকা আমেরিকা বলে চিৎকার করেছেন।

এখন সমাজতন্ত্রের এই পতন থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব? এই পতন সাময়িক কিনা সে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। ওই দেশগুলি ঘুরে আমার মনে হয়েছে, অন্তত এই শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপের ভূখণ্ডে ওই ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সম্ভাবনা নেই। সকলেই তো স্বার্থপর বা ভণ্ড নয়, মস্কোতে এমন কিছু কিছু মানুষের দেখা পেয়েছি, যাঁরা প্রকৃত আদর্শবাদী, মার্কসবাদে দৃঢ় বিশ্বাসী, মার্কস-লেনিন প্রদর্শিত সমাজব্যবস্থার পতনে মর্মাহত কিন্তু ঠিক কোথায় কোথায় ভুল হয়েছিল, কিংবা ভবিষৎ রূপ কী হতে পারে সে বিষয়ে বিভ্রান্ত। একজন বেশ উঁচু পদের ব্যক্তি আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, আমরা রাজনীতি নিয়ে যতটা মাতামাতি করেছি, ততটা মন দিয়ে অর্থনীতি বোঝার চেষ্টা করিনি। মানুষের মনস্তত্বও বুঝিনি। আগামী দশ বছর এইসব শিখতে হবে।

আমাদের বিভ্রান্তি আরও বেশি। আমরা ইউরোপ-আমেরিকার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার করি কিন্তু নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে প্রায় অন্ধ। আমাদের অবনতির মূল কারণ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ক্লেদ। বহু বছরের পরাধীনতায় যে সব দূষিত চিন্তা ও আবর্জনা জমেছিল, সে সব সাফ করার উদ্যোগই নেওয়া হল না। সাউথ আফ্রিকাতেও সাদা-কালোর ব্যবধান ঘুচতে চলল, কিন্তু আমাদের দেশে বর্ণবিদ্বেষ ঘোচাবার কোনও চেষ্টা হয়েছে; ধর্মীয় গোঁড়ামি বাড়ছে দিন দিন। বিবাহের নামে মেয়ে কেনাবেচা হয়। নামে ভারতীয় হলেও ভারতীয়ত্ব বলে কিছু নেই। জাতি হিসেবে কী আমাদের পরিচয়? কোন বৈশিষ্ট্যে হবে এই জাতির মর্যাদা? জাতি গড়ার কাজে মনই দেওয়া হল না। বরং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গটাই একটা নিন্দনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। আমরা মনে-মনে বিশ্ব নাগরিক, কিন্তু বিশ্বের কাছে আমরা উপহাসের পাত্র।

এ দেশের দারিদ্র্য দূর করার জন্য সমবন্টন ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখা অসংগত নয়। কেন্দ্রের সরকার সমাজতন্ত্রের পথে এক ধাপ এগিয়ে আবার দু-ধাপ পিছিয়ে যায়। যেহেতু পুরোপুরি সমাজতন্ত্র আসেনি, তাই অনেকের বিশ্বাস ছিল সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বামপন্থীরা এই বিশ্বাসে উস্কানি দিয়ে এসেছেন। তাতে ফল হয়েছে এই যে, অন্য অনেক ব্যাধি, অনেক কুসংস্কার, অনেক জঞ্জাল, অনেক অনুদ্যম ধামা চাপা দিয়ে রাখা গেছে, পুরোপুরি সমাজব্যবস্থা বদলালে ওই সব ঠিক হয়ে যাবে! পানের পিক ফেলে দেওয়াল নোংরা করা উচিত নয়, এই কথাটা বলার জন্যও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বদলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এখন কেউ কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে যে সমাজব্যবস্থা বদলালেই এ দেশের নব্বই কোটি মানুষকে উপযুক্ত খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হবে? ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরলে, খোলা বাজারের অর্থনীতিতে কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র থেকে যাবে নিঃসন্দেহে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও কি এই নব্বই কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। আমার সন্দেহ হয়, এ দেশের বামপন্থীরাও এখন আর তা বিশ্বাস করেন না। সেইজন্য মুখে তারা যতই সমাজতন্ত্রের জয়গান করুন, সেদিকে এগোবার কোনও উদ্যমই আর চোখে পড়ে না। বরং যেন তাঁরা অন্য পথ খোঁজাখুঁজি করছেন।

পূর্ব ইউরোপ আর সোভিয়েত দেশে যাই-ই ঘটুক, আমাদের তাকাতেই হবে চিনের দিকে। অনেক বিষয়েই এই দুই দেশের মিল আছে। এবং চিন আমাদের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে আছে। চিনের শহরগুলি এবং রাস্তাঘাট আমাদের চেয়ে উন্নত। মোটামুটি দু’বেলার অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু চিনের সমাজতন্ত্র বহু সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। গ্রামের লোকদের জীবিকার সংস্থান করতে পারেননি সরকার। যুব সমাজকে বলা হচ্ছে, তোমরা কাজ তৈরি করে নাও! গ্রামের মানুষ শহরে ঢুকতে এলে তাদের জোর করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ দৃশ্য আমি নিজের চোখে দেখেছি। এক শহর থেকে অন্য শহরেও যাতায়াত করা যায় না বিনা অনুমতিতে। ছেলেমেয়ে বিক্রি, বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ হয়নি। সেখানকার সমাজতন্ত্রের রং বদল হচ্ছে অতি দ্রুত, কমিউনিস্ট পার্টি নেহাত নিজেদের নামটা বজায় রেখেছে কিন্তু ধনতন্ত্রের অনেক রীতিনীতি তারা মেনে নিচ্ছে স্বেচ্ছায়। সাম্যের কথা ঘুচে গেছে, কিছুদিন আগে চিনা সরকার ঘোষণা করেছে যে বৈদেশিক সাহায্যে উপকূল অঞ্চলের অগ্রগতি হবে আগে, সেখানকার তুলনায় অন্য অঞ্চলের মানুষকে আপাতত পিছিয়ে থাকতে হবে। চিনেরা আমাদের মতন কথার ফুলঝুরি নয়, তারা অনেক বেশি বাস্তববাদী। চিন দেশে সত্যিই কথা কম, কাজ বেশি।

নব্বই কোটির জায়গায় আমাদের জনসংখ্যা অবিলম্বেই হবে একশো কোটি। মার্কসবাদে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা নেই, তাই আমাদের মার্কসবাদীরা তা নিয়ে মাথা ঘামান না। পূর্ব ইউরোপে বা সোভিয়েত দেশে সে সমস্যাও ছিল না। দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার চাপ সহ্য করতে হয়নি, বহিরাগতদেরও গ্রহণ করা হয়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ভারতের মতন চিনেরও সমস্যা, তাই চিন সরকার এই ক্ষেত্রে মার্কসবাদের তোয়াক্কা না করে কঠোরভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিধি চাপিয়েছে। সাংহাই শহরে আমাদের তরুণী গাইডকে জিগ্যেস করেছিলাম, তোমার ছেলেমেয়ে ক’টি? সে বলেছিল, একটির বেশি হলে আমার চাকরি যাবে এবং জেল খাটতে হবে! ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস সীমাবদ্ধ নিছক কিন্তু পোস্টারে-হোর্ডিংএ। শহরের বস্তিতে এবং গ্রামের গরিব পরিবারেই সন্তানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমাদের পাশের রাজ্যে পৌনে এক ডজন সন্তানের পিতা মুখ্যমন্ত্রী হয়!

আমাদের জনসংখ্যা একশো কোটি ছাড়াবে, দারিদ্র্য এবং সেই অনুষঙ্গের অন্যান্য সমস্যা বেড়েই চলবে। এ যাবৎ অন্য কোনও ব্যবস্থাতেই এই অবস্থার বদল হয়নি। সমাজতন্ত্র নামে চমৎকার একটি স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নে আমাদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির একটা স্থির চিত্র আঁকা ছিল। এখন সেই স্বপ্ন, সেই ছবিও অলীক হয়ে গেল? এটাই খুব বেদনার। পূর্ব ইউরোপের পট পরিবর্তন আসলে এক শোকাবহ ঘটনা। এক মহৎ আদর্শের পরাজয়। আমাদের দেশের সামনে কি তা হলে আর কোনও আশাই রইল না। দিন দিন আমাদের আরও অবনতি হবে এবং জনসাধারণকে মিথ্যে স্তোকবাক্য শুনিয়ে যাওয়া হবে? এ দেশের ভূমি বহু ব্যবহৃত, খনিজ ও বনজ সম্পদ যথেষ্ট নয়, তাহলে একশো কোটি মানুষের ক্ষুধা মিটবে কীসে? একমাত্র বিজ্ঞানই ভরসা। বিজ্ঞানের কোনও নতুন আবিষ্কার হয়তো মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণার সমাধান করে দিতে পারে। ম্যাজিকের মতো চমকপ্রদ কিন্তু বাস্তব সত্য কোনও পথ উপহার দেবে বিজ্ঞান, আমাদের দেশটা উদ্ধার পেয়ে যাবে। আমি আশাবাদী, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এই আশা করে যাব।