২৪. ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ

ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনেই সন্তু তরতর করে সেই ঝাঁকড়া গাছটায় চড়তে শুরু করে দিল। বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠে লুকিয়ে রইল পাতার আড়ালে। তার শরীরের সমস্ত শিরা যেন টানটান হয়ে গেছে। সে আবার ধরা পড়তে চায় না কিছুতেই।

প্রথমে মনে হয়েছিল অনেকগুলো ঘোড়া আসছে। তারপর বোঝা গেল একটাই ঘোড়র পায়ের শব্দ। ঘোড়াটা ঠিক এই দিকেই আসছে। সন্তু যে-ঘোড়াটার পিঠে এসেছিল, সেটা শব্দ শুনে মুখ ফিরিয়ে আছে।

একটু বাদেই দেখা গেল একটা ঘোড় এসে দাঁড়াল সন্তুর ঘোড়াটার পাশে। তার পিঠে যে বসে আছে, তাকে চিনতে সন্তুর প্রথমে একটু অসুবিধে হয়েছিল। খাকি প্যান্ট আর একটা ছাই রঙের হাফশার্ট পরা গাঁট্টাগোট্টা লোক। ঘোড়া থেকে নেমে লোকটি এই গাছের দিকে মুখ ফেরাতেই তার সিন্ধুঘোটকের মতন ঝোলা গোঁফ দেখেই সন্তু চিনতে পারল এ তো সেই মেজর।

একটু দূরে জেলে দুজনের কথাবার্তা তখনও শোনা যাচ্ছে। মেজর নদীর ধারে এসে উকি দিয়ে দেখল একবার। তারপর মুখ উঁচু করে বলল, কই হে সন্তুবাবু, কোথায় লুকোলে? চলে এসো, ভয় নেই।

সন্তু একেবারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল, যাতে কোনও শব্দ না হয়। কিন্তু পাতার আড়ালে তার সম্পূর্ণ শরীরটা আড়াল হয়নি। এখানে বেশিক্ষণ আত্মগোপন করে থাকা যাবে না।

মেজর আবার বলল, কোন্ গাছে উঠে বসে আছে? ও সন্তুবাবু, শিগগির নেমে এসো! সময় নষ্ট করে লাভ নেই।

সন্তু বুঝতে পারল, সত্যিই সময় নষ্ট হচ্ছে। মেজর সবকটা গাছ ভাল করে দেখতে শুরু করলেই সে ধরা পড়ে যাবে। তাছাড়া তাড়াহুড়ো করে ওঠার সময় তার একপাটি চটি পড়ে আছে গাছের নীচে।

সন্তু ডালপালা সরিয়ে বলল, আসছি!

তারপর সরসরিয়ে নেমে পড়ল। মেজর তার সামনে এসে দাঁড়াতেই সন্তু একটুও অবাক হবার কিংবা ভয় পাবার ভাব না দেখিয়ে খুব সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমায় কী করে খুঁজে পেলেন?

মেজর সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, এ তো খুব সহজ! তুমি আমাদের এই সব ঘোড়া চালাতে পারবে না তা জানি! ঘোড়া তোমাকে যেখানে নিয়ে যাবে, সেইখানেই তোমায় যেতে হবে! এই ঘোড়াগুলো নদীর ওপারের একটা গ্রামে থাকে। সেইজন্য ছাড়া পেলে ওরা সেইদিকেই যায়!

সন্তু বলল, বিচ্ছিরি ঘোড়া! আমি নেপালে এর চেয়ে অনেক ভাল ঘোড়ায় চেপেছি!

মেজর বলল, সে যাই হোক! শেষ পর্যন্ত সেই পালালে তা হলে? এখন কী হবে? তুমি আমায় ফাঁসাবার ব্যবস্থা করে এসেছ! রাজকুমার ঘুম থেকে উঠে যদি দেখে যে, তুমি নেই, অমনি সঙ্গে সঙ্গে আমার পেটে একটা গুলি চালাবে না? এখন তোমায় যদি আমি আবার ধরে নিয়ে যাই, তাহলে আমি হয়তো বকশিস পাব, কিন্তু তোমার কী অবস্থা করে ছাড়বে বলে তো?

সন্তু বলল, দোষ তো আপনারই। আপনি ভাল করে পাহারা দেননি কেন? দরজা সব সময় খোলা। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ঘোড়ায় চড়লুম! কেউ আমায় দেখতেই পেল না!

মেজর মুচকি হেসে বলল, আমি কিন্তু দেখেছি! রান্নাঘরের জানলা দিয়ে সব লক্ষ করছিলুম!

সন্তু এবার লোকটির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। কাল রাত্তির থেকেই এ লোকটির ব্যবহার সে ঠিক বুঝতে পারছে না। লোকটা কি ভালমানুষ, না মিচকে শয়তান?

লোকটি বলল, শোনো, সম্ভুবাবু, তোমায় সব কথা খুলে বলি। আমার নাম নরহরি কর্মকার। একটা গভর্নমেন্ট অফিসে সিকিউরিটির ডিউটি করতুম। একবার লোভের বশে হিরে চুরি করেছি। সেজন্য আজ আমার বড় লজ্জা। কিন্তু নিজের দোষে তারপর আমি ক্রমশই চোর-ডাকাতের দলে জড়িয়ে পড়েছি। এ আমি চাই না। শেষে দাগি আসামি হয়ে সারা জীবন কাটাতে হবে? তাই আমি ইচ্ছে করে তোমার পালাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এসো, তোমাতে আমাতে দুজনেই এখন পালাই। তোমার কাকাবাবুর সঙ্গে অনেক বড় বড় লোকের চেনা আছে। তাঁকে বলে আমার একটু ব্যবস্থা করে দিও। আমি দুএক বছর জেল খাটতে রাজি আছি, তার বেশি শান্তি যেন না হয়!

সন্তু কথাগুলো শুনে গেল, কিন্তু বিশ্বাস করবে কি করবে না, তা এখনও ঠিক করতে পারল না।

নরহরি কর্মকার বলল, এখানে আর থাকা ঠিক নয়। ওরা খুঁজতে শুরু করলে প্রথমে এখানেই আসবে! চলল, এক্ষুনি আগরতলা যাই! তুমি আমার সঙ্গে এক-ঘোড়ায় চেপে যেতে পারবে?

সন্তু বলল, আমি এখন আগরতলায় যাব না!

নরহরি কর্মকার চোখ প্রায় কপালে তুলে বলল আগরতলায় যাবে না? তোমার কাকাবাবু তো সেখানেই আছেন?

সন্তু বলল, তা হোক। এখানে কাছেই জঙ্গলগড়। আমি সেখানে যেতে চাই।

নরহরি বলল, এখানে জঙ্গলগড়? কে বলো তোমাকে? সন্তু দূরের জেলে দুজনের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, ওই ওরা জানে। ওরা বলাবলি করছিল।

নরহরি অবজ্ঞার হাসি দিয়ে বলল, দূর! ওসব বাজে কথা! ওরকম কত জঙ্গলগড় আছে! কোথাও জঙ্গলের মধ্যে দুএকটা ভাঙা বাড়ি-টাড়ি থাকলেই লোকে তার নাম দেয় জঙ্গলগড়! সেরকম জায়গার তো অভাব নেই এ দেশে!

সন্তু বলল, তবু আমি এই জঙ্গলগড়ে একবার যেতে চাই!

নরহরি বলল, কী ছেলেমানুষি করছ! আসল জঙ্গলগড়ের খবর তোমার কাকাবাবু ছাড়া আর কেউ জানে না। এই রাজকুমার আর অন্যরা কী কম খোঁজাখুঁজি করেছে।

সন্তু বলল, ওরা যে জঙ্গলগড়ের কথা বলছে, সেখানে একটা সোনার মুদ্রা পাওয়া গেছে!

নরহরি চমকে উঠে বলল, মুদ্রা, মানে টাকা? সোনার টাকা? চলো তো? দুপা গিয়েই নরহরি আবার থেমে গেল। মুখে ফুটে উঠল একটা অসহায় ভাব। ডান হাত দিয়ে গোঁফ চুলকোতে চুলকোতে বলল, না, না সন্তুবাবু, আমায় আর লোভ দেখিও না। সোনার টাকা শুনেই আমার মনটা চমকে উঠেছিল! একবার হিরে চুরি করে আমি হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি যে আমাদের মতন লোকদের হিরে মুক্তো সোনাদানা সহ্য হয় না! ওসবে একবার হাত দিলেই বিপদ! জঙ্গলগড়ের সোনায় যদি আমি হাত দিই, তা হলে রাজকুমারের দলবল আমায় একেবারে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে!

সন্তু আর কোনও কথা না বলে এগিয়ে গেল জেলে দুজনের দিকে। নরহরি তার পেছন পেছন এসে কাতরভাবে বলল, কোথায় যাচ্ছ, সন্তুবাবু। আমি ভাল কথা বলছি, আগরতলায় চললা!

সন্তু সে কথায় কর্ণপাত করল না।

জেলে দুজন এখন কথা থামিয়ে মন দিয়ে মাছ ধরছে। একটা জাল ফেলে সেটা টেনে তুলছে খুব আস্তে আস্তে। জাল টেনে তোলার সময় তারা একেবারে চুপ করে থাকে।

সন্তু আর নরহরি ওদের কাছে যখন পৌছল, তখনও জালটা পুরো টেনে তোলা হয়নি। বড় জেলেটি ওদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শুধু, কোনও কথা বলল না।

জালটা তোলার পর দেখা গেল তার গায়ে কয়েকটা ছোট ছোট মাছ লেগে আছে। চকচকে রুপোলি রঙের।

ছোট জেলেটি জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খালুইতে রাখতে লাগল। বড় জেলেটি গম্ভীরভাবে বলল, এ মাছ বিকিরি নেই, মহাজনকে দিতে হবে।

নরহরি লোকটার ঘাড় চেপে ধরে হুঙ্কার দিয়ে বলল, তোর মাছ কে চাইছে? জঙ্গলগড়ের সোনার টাকা কে নিয়েছে, আগে বন্!

লোকটি ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, সোনার টাকা! আমি তো সোনার টাকা নিইনি! মা কালীর দিব্যি বলছি!

তবে কে নিয়েছে?

সে তো সুবল!

কোথায় সেই সুবল? এক্ষুনি আমাদের নিয়ে চল তার কাছে?

ছোট জেলেটি এবারে বলল, সুবলকাকা তো মরে গেছে। তাকে সাপে কামড়েছে।

নরহরি প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, মরে গেছে? মিথ্যে কথা বলছিস আমার কাছে? এক্ষুনি থানায় নিয়ে যাব?

সন্তু বলল, ওরা আগেই বলছিল সুবলকে সাপে কামড়েছে। ঠিক আছে, সেই জঙ্গলগড় জায়গাটা কোথায়, আমাদের একটু দেখিয়ে দেবে চলো তো!

নরহরি বলল, যেখানে সোনার টাকা পাওয়া গেছে, সেই জায়গাটা আর কে দেখেছে? তুই দেখেছিস?

বড় জেলেটি বলল, বাবু, সেখানে যেও না। সেখানে খুব সাপখোপের উপদ্রব। জায়গাটা ভাল না?

নরহরি বলল, সাপ থাক আর যাই থাক, সে আমরা বুঝব। শিগগির সেখানে আমাদের নিয়ে চল্।

বড় জেলেটি কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল, সে যে অনেক দূরের পথ। সেখানে তোমাদের নিয়ে গেলে আমার যে আজকের দিনটার রোজগার নষ্ট হয়ে যাবে।

নরহরি বলল, মনে কর তোর জ্বর হয়েছে। তা হলেও কি মাছ ধরে রোজগার করতে পারতি?

জেলেটি বলল, আমার জ্বর হয়নি, তবু শুধু শুধু মনে করতে যাব কেন? মনে করো, তুমি রাজা, তা হলেই কি তুমি রাজা হয়ে যাবে?

সন্তু বলল, ঠিক আছে, সবটা পথ তোমায় যেতে হবে না। খানিকটা দূর এগিয়ে দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দাও ঠিক কোনদিকে যেতে হবে।

ছোট্ট জেলেটিকে সেখানেই বসিয়ে রেখে ওরা তিনজন চলল, নদীর ধার ঘেঁষে ঘেঁষে। তার আগে নরহরি ঘোড়া দুটোকে ঠেলে ঠেলে নদীতে নামিয়ে দিয়ে এল। ঘোড়া দুটো সাঁতরাতে সাঁতরাতে চলে গেল নদীর ওপারে।

খানিকটা দূরে গিয়েও নরহরি থেমে গিয়ে ফিসফিসিয়ে সন্তুকে বলল, উঁহুঃ ঐ ছোঁড়াটাকে ওখানে বসিয়ে রেখে আসা ঠিক হল না। কেউ আমাদের খুঁজতে এলে ওর কাছ থেকে সব কথা জেনে যাবে।

সে বড় জেলেটিকে বলল, এর পর সারাদিন মাছ ধরলে তোর আর কত রোজগার হত?

জেলেটি বলল, মাছ ধরতে পারি না পারি, রোজ মহাজনকে দশ টাকা শোধ দিতে হয়। এখন তো মাছ ওঠেই না।

নরহরি তার পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে দিয়ে বলল, এই নে। এখন ওই ছেলেটাকেও ডাক। ছেলেটাও আমাদের সঙ্গে চলুক। আমাদের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে তোরা আজ গাঁয়ে ফিরে যাবি। খবরদার, কারুকে কিছু বলবি না! এসব পুলিশের কাজ, খুব গোপন রাখতে হয়!

সন্তু বলল, ওদের আরও দশটা টাকা দিন। আমি পরে আপনাকে শোধ করে দেব।

প্রায় এক ঘন্টা চলার পর ওরা নদীর ওপর একটা সাঁকো দেখতে পেল। খুব নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। সেটার ওপর দিয়ে খুব সাবধানে ওরা এক এক করে চলে এল অন্য ধারে।।

আবার নদীর ধার দিয়েই হাঁটতে হল প্রায় দেড় ঘণ্টা। এদিকটায় বেশ ঘন জঙ্গল। অনেক গাছের ডালপালা ঝুঁকে পড়েছে নদীর জলে।

আসবার পথে গোটা দুয়েক গ্রাম চোখে পড়েছে, কিন্তু এই জায়গাটা একেবারে জনমানবশূন্য। কয়েকটা পাখির তীক্ষ্ণ ডাক শোনা যাচ্ছে। নদীটাও ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। সামনেই পাহাড় আছে মনে হয়।

এক জায়গায় বড় জেলেটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এবারে আপনারা যান, আমরা আর যাব না!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, জঙ্গলগড় আর কতদূর?

সামনে আর একটুখানি গেলেই দেখতে পাবেন। একেবারে নদীর ধারেই।

নরহরি জিজ্ঞেস করল, তোমাদের গাঁ ছেড়ে এত দূরের জঙ্গলে এসেছিলে কেন শুনি? তোমাদের নিশ্চয়ই কোনও মতলব ছিল।

বড় জেলেটি বলল, নিয়তি, বাবু, নিয়তি! এইদিকে এক গাঁয়ে সুবলের শ্বশুরবাড়ি। একটু আগের ফাঁকা মাঠ দিয়েও যাওয়া যায়, আর এই জঙ্গলের মধ্য দিয়েও যাওয়া যায়। তা সুবলের কী দুবুদ্ধি হল। বলল, এই জঙ্গলের মধ্য দিয়েই যাই, যদি দুএকটা খরগোশ মারতে পারি। সেই ললাভেই তার কাল হল।

নরহরি বলল, ঠিক আছে, তোমরা এবারে ফিরে যেতে পারো!

বড় জেলেটি বলল, অনেক বেলা হয়ে গেল, আপনারা এখন জঙ্গলে যাবেন, তারপর ফিরবেন কখন? জায়গাটা ভাল না। তাছাড়া দুপুরে খাওয়া-দাওয়াই বা করবেন কোথায়?

নরহরি বলল, সে আমরা বুঝব। তোমরা এখন যাও তো!

ওরা চলে যাবার পর সন্তু আর নরহরি খুব সাবধানে এগোতে লাগল। একটু বাদেই তাদের চোখে পড়ল, মাটিতে নানারকম গর্ত, আর এখন সেখানে পাথর আর কাঠের টুকরো ছড়িয়ে আছে।

তারপর দেখা গেল একটা লম্বা পাথরের দেওয়াল। তার মধ্যে কয়েকখানা পাথরের ঘর, কিন্তু কোনওটারই ছাদ নেই। একটা কারুকার্য করা কাঠের দরজাও পড়ে আছে মাটিতে।

পাথরের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে সন্তু ভাবল, এই কি তবে সেই জঙ্গলগড়?