২৩. পুলিশরা যে লোকটিকে ধরে নিয়ে এসেছে

পুলিশরা যে লোকটিকে ধরে নিয়ে এসেছে, কাকাবাবু তার আপাদমস্তক দেখলেন কয়েকবার। ধুতি আর নীল রঙের শার্ট-পরা সাদামাটা চেহারার একজন মানুষ। মুখে একটা ভয়ের ছাপ।

কাকাবাবু বললেন, ওকে ছেড়ে দেওয়া হোক। এ লোকটাকে ধরে রেখে কোনও লাভ নেই। কই, চিঠিটা কই?

শিশির দত্তগুপ্ত উঠে লোকটির মুখখামুখি দাঁড়িয়ে কটমট করে তাকিয়ে বললেন,এই, তুই এই চিঠি কোথায় পেয়েছিস?

লোকটি বলল, আমি বাজারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলুম একজন লোক এসে বলল, এই চিঠিটা রাজার অতিথিশালায় পৌছে দিলে আমায় ইয়ে মানে একটা টাকা দেবে, তাই আমি—

শিশির দত্তগুপ্ত ধমক দিয়ে বললেন, সবাই এই এক গল্প বলে! যদি জেলে যেতে না চাস তো সত্যি কথা বল্!

লোকটি বলল, এক টাকা নয়, ইয়ে, মানে, পাঁচ টাকা!

অ্যাঁ?

সত্যি কথা বলছি স্যার, দশ টাকা দিয়েছে। আমি দিব্যি কেটে বলছি, তার বেশি দেয়নি।

একটা চিঠি পৌঁছে দেবার জন্য দশ টাকা দিল?

হ্যাঁ, স্যার। ফস্ করে টাকাটা আমার পকেটে খুঁজে দিল। আমি ভাবলুম, ডাকে চিঠি যেতে পয়তিরিশ পয়সা লাগে, আর আমি পাচ্ছি দশ টাকা! মোটে তো দু পা রাস্তা। তাই ওদের কথায় রাজি হয়ে গেলুম।

ওদের মানে? এই যে বললি একটা লোক? ফের মিথ্যে কথা!

মানে, একজন লোকই আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। আর একটা লোক পাশে দাঁড়িয়েছিল।

তারা তোর চেনা?

না স্যার। কোনওদিন দেখিনি।

অচেনা লোক এসে তোকেই চিঠি দেবার কথা বলল কেন?

আমি এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলুম কি না, পকেটে একটাও পয়সা নেই, ভাবছিলুম কী করে কিছু রোজগার করা যায়, তাই বোধহয় ওরা ঠিক বুঝেছে?

লোকদুটোকে দেখতে কেমন?

খুব ভাল দেখতেও নয়, আবার খুব খারাপ দেখতেও বলা যায় না।

ভাল খারাপের কথা হচ্ছে না। লোকদুটোকে দেখলে কী মনে হয়, চোর-ডাকাতের মতন?

একটু চিন্তা করে লোকটি বলল, আজ্ঞে না?

তবে কি ভদ্রলোকের মতন?

আজ্ঞে না।

চোর-ডাকাতের মতনও না। ভদ্রলোকের মতনও না। তবে কিসের মতন?

আজ্ঞে, পুলিশের মতন!

অ্যাঁ?

খুব গাঁট্টাগোট্টা চেহারা আর লম্বা গোঁপ আছে।

তুই যে বাজারের সামনে একলা একলা দাঁড়িয়ে ছিলি, তার কোনও সাক্ষী আছে?

স্যার, সাক্ষী রেখে কি একলা একলা দাঁড়িয়ে থাকা যায়?

ফের মুখে মুখে কথা বলছিস? যা জিজ্ঞেস করছি, তার জবাব দে।

পান্নাদার পাশের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলুম, পান্নাদা নিশ্চয়ই দেখেছে আমাকে।

শিশির দত্তগুপ্ত একজন পুলিশকে বললেন, অবিনাশ, একে বাজারের কাছে নিয়ে যাও! লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, এ সত্যি কথা বলছে কি না?

পুলিশ দুজন লোকটিকে নিয়ে টানতে টানতে বেরিয়ে গেল।

কাকাবাবু সন্তুর চিঠিটা দুতিনবার পড়লেন, কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখলেন ভাল করে। তারপর সেটা এগিয়ে দিলেন নরেন্দ্র ভার্মার দিকে।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, এটা সনটুর হ্যান্ডরাইটিং ঠিক আছে তো?

কাকাবাবু বললেন, হাঁ। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যে-জায়গায় সন্তুকে আটকে রেখেছে, সেখানে তো কাগজকালি-কলম কিছু পাওয়া যায় না। জঙ্গলের মধ্যে কোনও গোপন আস্তানা মনে হচ্ছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এরা খুব কুইক কাজকাম করে তো! বহোত জলদি চিঠি চলে এল! তার মানে খুব বেশি দূরে নেই! ঠিক কি না? এখন কী করা যাবে?

শিশির দত্তগুপ্ত চিঠিটা নিয়ে দুবার পড়লেন। তারপর বললেন, এবারে সব কটাকে জালে ফেলা যাবে! আপনি ওদের সঙ্গে একলা দেখা করবেন। আমি পুলিশ ফোর্স নিয়ে দূরে অপেক্ষা করব। আপনার হাত থেকে ওরা জঙ্গলগড়ের ম্যাপটা যেই নিতে যাবে, অমনি আমরা ক্যাঁক করে চেপে ধরব ওদের!

কাকাবাবু বললেন, দেখা করব মানে? কোথায় দেখা করব? সে রকম কোনও জায়গার কথা তো লেখেনি?

তাই তো! আসল কথাটাই লিখতে ভুলে গেছে!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সনটু তো জঙ্গলগড়ের প্ল্যান এঁকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে।

কাকাবাবু বললেন, সেটাই বা পাঠাব কোথায়?

নরেন্দ্র ভামা বললেন, সনটু ছোকরা বহোত দুষ্ট আছে। ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট চিঠি লিখেছে, যাতে কি না আরও টাইম পাওয়া যায়।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু তো আর নিজের ইচ্ছেতে এই চিঠি লেখেনি, ওকে দিয়ে জোর করে লেখানো হয়েছে। এই দ্যাখো কাগজের ওপর এক ফোঁটা রক্ত। এ কার রক্ত বলে মনে হয়?

শিশির দত্তগুপ্ত বললেন, ইশ! একটা ছোট ছেলের ওপর অত্যাচার করেছে। ওরা। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। একদিন সব কটাকে ধরে চাক্কাব!

কাকাবাবু বললেন, আমার খালি ভয় হচ্ছে, সন্তু আবার পালাবার চেষ্টা না করে! ও যা ছটফটে ছেলে। চুপচাপ বন্দী হয়ে থাকবে না নিশ্চয়ই। পালাতে গিয়ে ধরা পড়লে আরও বিপদ হবে। ওরা সাঙ্ঘাতিক লোক।

শিশিরবাবু উত্তেজিতভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বললেন, আমি একটা জিনিস ভাবছি, ওদের কাছে একটা টোপ দিলে কেমন হয়?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, টোপ? টোপ কী?

শিশিরবাবু বললেন, বেইট! কিংবা ডিকয়! ধরুন, আমরা আর একটা লোককে অবিকল মিস্টার রায়চৌধুরীর মতন সাজিয়ে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হল। ওরা নিশ্চয়ই তাকে ফলো করবে। তারপর তাকে ধরবে। তখন পেছন পেছন গিয়ে আমরা ওদের সব কটাকে ধরব!

কাকাবাবু বললেন, আমার মতন একজনকে সাজাবেন? তা আবার হয়। নাকি? সে তো ওরা চিনে ফেলবে!

শিশিরবাবু বললেন, না, না, অত সহজ নয়। আমাদের পুলিশ লাইনে ছদ্মবেশের এক্সপার্ট আছে। দেখবেন একজনকে এমন আপনার মতন সাজিয়ে আনব যে, আপনি নিজেই চিনতে পারবেন না। একেবারে ক্রাচ-ট্রাচ সব থাকবে।

কাকাবাবু বললেন, ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, আমার একজোড়া ক্রাচ চাই, আর দুপুরের মধ্যেই পাঠিয়ে দেবেন। আমার মতন একজনকে সাজাবার দরকার কী, আমি নিজেই তো জঙ্গলে একা যেতে পারি।

শিশিরবাবু বললেন, না, না, আপনাকে আর আমরা বিপদের মধ্যে পাঠাতে চাই না। আপনার শরীর খারাপ, তার ওপর অনেক ধকল গেছে এর মধ্যেই!

নরেন্দ্র ভার্মার দিকে ফিরে তিনি বললেন, আপনিই বলুন মিঃ ভার্মা, মিঃ রায়চৌধুরীকে কি আবার বিপদের মধ্যে পাঠানো উচিত?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রায়চৌধুরীকে ত্রিপুরায় পাঠাবার যে এরকম রেজাল্ট হবে, তা তো বুঝিনি আগে। বিলকুল সব কিছু অন্যরকম হয়ে গেল কি না! আমাদের প্ল্যান সব গড়বড় হয়ে গেল!

শিশিরবাবু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা মিঃ রায়চৌধুরীকে প্ল্যান করে ত্রিপুরায় পাঠিয়েছেন? কেন?

নরেন্দ্র ভামা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা দিল্লি থেকে প্ল্যান করা হয়েছিল। আমার বস্ মিঃ রাজেন্দ্র ভার্গবের মাথা থেকে এটা বেরিয়েছে। আপনি যেমন বললেন না, সেইরকম আগেই আমরা রাজা রায়চৌধুরীকে এখানে টোপ ফেলেছি।

বলেই নরেন্দ্র ভার্মা হাসতে লাগলেন।

কাকাবাবুও হাসতে হাসতে বললেন, বাঃ, বেশ মজা! আমাকে তোমরা টোপ ফেলবে, আমার জীবনের বুঝি কোনও দাম নেই? গৌহাটি এয়ারপোর্ট থেকে যখন আমায় আবার প্লেনে তোলা হল, তখনই আমি বুঝেছি আমাকে আগরতলা নিয়ে আসা হচ্ছে বিশেষ উদ্দেশ্যে। সেইজন্যই তো আমি তখন থেকে পাগল সেজে গেলাম!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমার জীবনের দাম? তোমাকে মারতে পারে, এমন বুকের পাটা হোল ইন্ডিয়াতে কিসিকো নেহি হ্যায়! বন্দুকের গুলি খেলেও তুমি মরো না?

কাকাবাবু বললেন, আমি সত্যিকারের বন্দুকের গুলি কখনও খাইনি! খেলে ঠিকই মরে যাব! খেয়েছি তো ঘুম পাড়ানো গুলি?

শিশির দত্তগুপ্ত তখনও কিছুই বুঝতে পারছেন না দেখে কাকাবাবু বললেন, ব্যাপারটা কী জানেন, কলকাতার পার্কে আমায় ঘুম পাড়াবার গুলি মারা হয়েছিল তো! এরকম গুলি তো বাজারে বিক্রি হয় না! তা হলে যে আমাকে মেরেছে, সে এই গুলি পেল কোথায়? আপনি পুলিশের লোক, আপনি জানবেন নিশ্চয়ই, কয়েক মাস আগে একটা হিংস্র ভাল্লুককে ধরবার জন্য দিল্লি থেকে ওইরকম ছটা গুলি আনা হয়েছিল ত্রিপুরায়। ভাল্লুকটাকে দুটো গুলিতেই বশ করা গিয়েছিল। তারপর বাকি চারটে গুলি আর পাওয়া যায়নি!

শিশিরবাবুর মুখে একটা লজ্জার ছায়া পড়ল। তিনি বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। সে গুলি চারটে কীভাবে হারাল তা কিছুতেই বোঝা গেল না। অনেক খোঁজ করা হয়েছিল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রায়চৌধুরীকে ত্রিপুরায় পাইনো হল দু একটা কারণে। সে অনেক বড় ব্যাপার। একটা ইন্টারন্যাশনাল গ্যাংকে পাকড়াতে চেয়েছিলাম। এখন এখানে এসে শুনছি, জঙ্গলগড়, গুপ্তধন, ফলানা ফলানা সব লোকাল ব্যাপার! ধুত! চলো, কালই ফিরে যাই?

কাকাবাবু বললেন, তুমি ভুলে যাচ্ছ, সন্তুকে এখনও একদল সাঙ্ঘাতিক হিংস্র লোক আটকে রেখেছে। দশটা ইন্টারন্যাশনাল গ্যাঙের চেয়েও সন্তুর জীবনের দাম আমার কাছে অনেক বেশি।

শিশিরবাবু বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার ভাইপোকে ঠিক আমি উদ্ধার করে দেব।

এই সময় একজন পুলিশ এসে খবর দিল শিশির দত্তগুপ্তের ফোন এসেছে নীচে।

শিশিরবাবু ফোন ধরতে চলে গেলেন আর কাকাবাবু আর নরেন্দ্র ভার্মা ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলেন।

শিশির দত্তগুপ্ত ফিরে এলেন দারুণ উত্তেজিতভাবে। দরজার কাছ থেকে বেরিয়ে বললেন, ধরা পড়েছে! রা পড়েছে!

কাকাবাবু মুখ তুলে বললেন, কে?।

ওদের তিনজন। জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। কাল রাতে যারা আপনাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, এই তিনজন ছিল সেই দলে। নিজেরাই স্বীকার করেছে। এখন ওদের চাপ দিলে বাকি সব কটার সন্ধান পাওয়া যাবে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, গুড ওয়ার্ক!

শিশিরবাবু বললেন, বলেছিলুম না, পালাতে পারবে না। জাল ছড়িয়ে রেখেছি। ওরা ঠিক ধরা পড়বে! লোক তিনটে লক আপে আছে। এখন ওদের জেরা করব, চলুন আমার সঙ্গে।

নরেন্দ্র ভার্মা যাবার জন্য পা বাড়ালেও কাকাবাবু বিশেষ উৎসাহ দেখালেন। তিনি বললেন, আপনারা ঘুরে আসুন, আমার আর যাবার দরকার নেই! আমি ততক্ষণ রং জঙ্গলগড়ের ম্যাপটা এঁকে ফেলি।

শিশির দত্তগুপ্ত বললেন, ঠিক আছে। সেই ভাল। চলুন, মিঃ ভার্মা!

ওরা দরজার বাইরে যেতেই কাকাবাবু আবার ডেকে বললেন, শিশিরবাবু, আমার জন্য দুটো ক্ৰাচ্‌  পাঠাতে ভুলবেন না! আমি এবারে একটু নিজে নিজে হাঁটতে চাই।