মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসীর ঠিক উনপঞ্চাশ দিন পর আগুন জ্বলে উঠলো। দমদম কিংবা ব্যারাকপুরে নয়, সেখান থেকে বহু দূরে। আম্বালায়। প্রথম প্রথম শুধুই আগুন, মধ্যরাত্রে সিপাহী ব্যারাকের এক একটি ছাউনিতে অকস্মাৎ দপ করে আগুন ধরে যায়, তারপর হুড়োহুড়ি, দৌড়োদৌড়ি। কে বা কারা সেই আগুন লাগায় টের পাওয়া যায় না। তবে বোঝা যায়, যে-সব সিপাহী স্যাঁতসেঁতে চাবির মতন জিনিস মাখানো খোলস সমেত কার্তুজ ব্যবহার করছে, আগুনের শিখা লকলক করে উঠছে শুধু তাদের ছাউনিতেই। প্ৰথম দিন একটি ছাউনিতে, পরদিন পাঁচটি ছাউনিতে। পরদিন আরও।
ইতিমধ্যে চাপা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। চতুর্দিকে। শহরে শহরে নানারূপ গুঞ্জন। দিল্লির জুম্মা মসজিদের গায়ে এই কিছুদিন আগে হঠাৎ দেখা গিয়েছিল এক দীর্ঘ ইস্তাহার ঝুলছে। পারস্যের শাহ হিন্দুস্তানের খাঁটি মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পবিত্র জেহাদে যোগ দেবার জন্য। তিনি শীঘ্রই আসছেন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে কাফের ব্রিটিশ রাজকে উৎখাত করতে। মুসলমানদের ধর্ম নষ্ট করতে চায় যে ইংরেজ, এবার তার পতনের দিন ঘনিয়ে এসেছে। হিন্দুস্তানের মুসলমান, তুমি যদি খাঁটি মুসলমান হও, তবে জাগো, হাতিয়ার উঠাও।
কে দিল। এই ইস্তাহার? এ তো সরাসরি পারস্য থেকে আসেনি, তবে কে লাগালো? দিল্লির ইংরেজ সেনানায়ক সাইমন ফ্রেজার ইস্তাহারটি টেনে ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেললেন সমবেত জনতার চোখের সামনে। কিন্তু ততক্ষণে তা অনেকেরই পাঠ করা হয়ে গেছে। এবং পরদিন অবিকল ঐ রকম আর একটি ইস্তাহার লটকাতে দেখা গেল লালকেল্লার দেয়ালে।
আফগানিস্তানের শাসক দোস্ত মহম্মদও নাকি তাঁর ফৌজ নিয়ে পারস্যের শাহের সঙ্গে যোগ দিয়ে আসছেন ভারতের দিকে। দোস্ত মহম্মদকে তো ইংরেজের মিত্র বলেই সবাই জানতো এতদিন। একটি ইস্তাহারে দেখা গেল, হিন্দুস্তানে ইসলাম বিপন্ন বলে দোস্ত মহম্মদও আর স্থির থাকতে পারছেন না। আর রুশ সম্রাটের বাহিনী যে ভারত আক্রমণ করবে, সে কথা তো অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। এবার বুঝি সময় আসন্ন। রুশী বাহিনীকে ঠেকাতে পারবে ইংরেজ? এই তো কিছুদিন আগে তারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধে প্ৰচণ্ড মার খেয়েছে না?
কানপুরের সন্নিকটে বিঠরে ক্ষুব্ধ, অপমানিত হয়ে রয়েছেন নানা সাহেব। তিনি পুণার বিখ্যাত পেশোয়া দ্বিতীয় বাজী রাও-এর দত্তক পুত্র। ইংরেজ তাঁর জায়গির কেড়ে নেয় এবং বার্ষিক আট লক্ষ টাকার পেনসন বন্ধ করে দেয়। আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে তিনি তাঁর হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন বটে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুসছিলেন। এই সময় নানা লক্ষ্ণৌয়ের রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসে বুঝলেন, আবেদন-নিবেদনের দিন শেষ হয়ে গেছে। লক্ষীয়ের তখন অদ্ভুত অবস্থা। নতুন রাজ্য শাসনের ভার হাতে নিয়ে ইংরেজ-রাজ সর্ব ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। এদিকে হাটে-বাজারে হাজার হাজার সবল সুস্থ চেহারার পুরুষ চাপা রাগে গজরাচ্ছে। এরা প্রাক্তন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের সেনাবাহিনীর কর্মচ্যুত সৈনিক। বংশানুক্রমিকভাবে এরা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো পেশা জানে না। এখন এদের সামনে আর কোনো জীবিকার পথ খোলা নেই, অনেকেই অনাহারের সম্মুখীন, এদের হাত নিসপিস করছে অস্ত্র ধরার জন্য।
হাটে-বাজারে এখন শুধু একটাই আলোচনা। হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ এখন আর পৃথক করে দেখা চলবে না। ইংরেজ এখন যথেচ্ছভাবে হিন্দু ও মুসলমান জায়গিরদার ও ভূম্যধিকারীর সম্পত্তি কেড়ে নিচ্ছে, বনেদী বংশগুলির সম্মান লুটোচ্ছে ধুলোয়, অর্থ-সম্পদ সবই আস্তে আস্তে ভারতবাসীর কাছ থেকে চলে যাচ্ছে ইংরেজদের হাতে। হিন্দুস্তানের হিন্দু-মুসলমান সকলেরই ধর্ম বিপন্ন। এখনো তৈমুর বংশের শিখা, আকবর-সাহজাহানের প্রত্যক্ষ রক্ত-সম্পর্কিত উত্তরাধিকারী বাহাদুর শাহ বেঁচে আছেন। আবার ফিরিয়ে আনা যায় না লুপ্ত গৌরব?
মৌলভী আহমদ উল্লা নগরে নগরে পরিভ্রমণ করে প্রচার করছেন বিদ্রোহের বাণী। দিন ঘনিয়ে এসেছে, দেরি করা চলবে না। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, এক সেনা ছাউনি থেকে অন্য সেনা ছাউনিতে কারা যেন চালাচালি করতে লাগলো হাতে-গড়া রুটি। একখানা রুটি যে পাবে, সে আরও পাঁচখানা রুটি বানিয়ে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেবে। সঙ্গে কোনো চিঠি নেই, ঐ রুটিই গোপন আবেদনপত্র।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটলো মীরাটে।
ব্যারাকপুরের মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল, চর্বি মাখানো খোলস সমেত টোটার ব্যাপারে বুঝি শুধু হিন্দু সিপাহীরাই ক্ষুব্ধ। মুসলমান সিপাহীরা তো সে সময় মঙ্গল পাণ্ডেকে সমর্থন করেনি। কোনো কোনো সেনানায়ক প্রস্তাব দিলেন এনফিল্ড রাইফেলের ঐ নতুন কার্তুজ না হয় বাতিল করা হোক। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন সে প্রস্তাব। একটা গুজবকে প্রশ্রয় দিলে তা দুর্বলতারই পরিচায়ক হবে। কার্তুজের খোলসে তো সত্যিই গোরু-শুকরের চর্বি মিশ্রিত নেই। ও রকমভাবে চর্বি মেশানোর প্রশ্নই ওঠে না।
মীরাটে তৃতীয় লাইট ক্যাভালরি এক অতি বিশ্বস্ত বাহিনী। তাদের মধ্যে থেকেও বেছে বেছে নব্বই জন অতি দক্ষ সিপাহীকে পৃথকভাবে দাঁড় করানো হলো। কর্নেল স্মিথ সংক্ষিপ্ত ভাষণে সেনাবাহিনীকে বোঝালেন যে, কার্তুজের খোলসে চর্বি মেশানোর কথার কোনো ভিত্তিই নেই। এমনকি, ঐ কার্তুজ ব্যবহার করার জন্য মুখে দেবারও দরকার নেই। হাত দিয়ে ছিঁড়ে নিলেই চলে। এই বাছাই করা নব্বই জন সিপাহী তা সকলের সামনে দেখাবে।
মে মাসের প্রথম গরমের মধ্যে সকলে দণ্ডায়মান। আনা হলো কার্তুজ, সেগুলি সিপাহীদের মধ্যে বিলি করার জন্য সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। নব্বই জনের মধ্যে পঁচাশী জন সিপাহীই হাত গুটিয়ে রইলো। তারা গম্ভীরভাবে জানালো, ঐ অপবিত্র কার্তুজ তারা স্পর্শও করবে না। এ ব্যাপারে। আর অনুরোধ করে যেন তাদের সম্মান হানি না করা হয়।
পরদিন কোর্ট মাশলি হলো সেই পঁচাশী জন সিপাহীর। বিচারের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না মোটেই। সমগ্ৰ বাহিনীকে আবার রৌদ্রের মধ্যে দাঁড় করিয়ে শোনানো হলো শাস্তির কথা। ঐ পঁচাশী জন সিপাহী ব্রিটিশ রাজের হুকুম তামিল করতে অস্বীকার করায় গুরুতর অপরাধী, তাদের অধিকাংশকেই যাবজজীবন দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আন্দামানে। বাকি কয়েকজনের দশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড।
পঁচাশীজনের একজনও দয়া ভিক্ষা চাইলো না, একটি কথাও উচ্চারণ করলো না। তৎক্ষণাৎ তাদের উর্দি ও জুতো খুলে ফেলার হুকুম দেওয়া হলো। তারপর কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রচণ্ড রৌদ্র দহনের মধ্যে তাদের প্রায় নগ্ন অবস্থায় রেখে হাতে পায়ে পরানো হলো শিকল। তারপর তাদের যখন নিয়ে যাওয়া হতে লাগলো। কয়েদখানার দিকে, তখন একজন বন্দী সিপাহী তার একপাটি জুতো বিচারকদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, ফিরিঙ্গি রাজ জাহান্নামে যাক। তার সঙ্গীরাও গর্জন করে উঠলো ঐ একই কথা।
এর পর ঐ বন্দীদের দুদিন মীরাট ক্যান্টনমেন্টে রাখা হলো খুব কড়া পাহারায়। কোনো রকম বিক্ষোভের চিহ্ন দেখা গেল না। সব কিছু শান্ত। রবিবার সন্ধার সময় ইংরেজ রাজপুরুষেরা মেম ও শিশুদের সঙ্গে নিয়ে গীজ থেকে ঘুরে এলো নিশ্চিন্তে। সারাদিন অসহ্য দাহের পর এই সময় একটু বাতাস বয়। এখন যথাসম্ভব স্বল্পবাস হয়ে বারান্দায় একটি ছোট পেগ নিয়ে আরাম করার সময়। মীরাট ক্যান্টনমেন্টের জেনারেল হিউট সৈনিকের উর্দি খুলে একটি পাজামা পরে তাঁর আদলিকে হুকুম দিলেন, বোয়, ড্রিঙ্কস, লাও!
অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই ছাউনিতে ছাউনিতে জ্বলে উঠলো আগুন। যেন এক মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত সিপাহী সশস্ত্র হয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। পঁচাশীজন বন্দীকে মুক্ত করা হলো তৎক্ষণাৎ, নিবিচারে তারা গুলি চালাতে লাগলো ইংরেজ অফিসারদের দিকে।
সিপাহীদের সামনে ইংরেজরা দাঁড়াতেই পারলো না। একদিনের মধ্যেই মীরাট ইংরেজ-মুক্ত হয়ে গেল। কিছু ইংরেজ প্ৰাণ দিল, কিছু ইংরেজ কোনোক্রমে খালি পায়ে, অর্ধনগ্ন অবস্থায় প্রাণ নিয়ে পলায়ন করলো। শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয়, সমগ্র মীরাট শহরই সিপাহীদের অধিকারে চলে এলো।
এর পর কী? সিপাহীদের সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দেরি হলো না। একটিই পথ খোলা আছে। এখন থেকে দিল্লি হবে। আবার স্বাধীন ভারতের রাজধানী। সুতরাং, চলো দিল্লি।
দিল্লির লালকেল্লায় বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ প্রতিদিন এখনো দরবার বসান। তাঁর বয়েস এখন বিরাশী, অতি দুর্বল, হ্রস্বকায় পুরুষ, চোখে অহংকারের জ্যোতিটুকুও নেই। সাম্রাজ্য নেই, তবু তিনি এখনো সম্রাট। শুধু লালকেল্লার ভিতরকার ছোট নগরীটিই তাঁর অধিকারে, বাইরের দিল্লি শহরটি পরিচালনার ভার পর্যন্ত ইংরেজের হাতে। বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর তবু এখনো প্রতিদিন একটি লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করে দরবারে আসতে ভালোবাসেন। তিনি এসে বসেন ধূলিমলিন ময়ূর সিংহাসনে। বেশীক্ষণ সোজা হয়ে বসে থাকার ক্ষমতা নেই, তাই তাঁকে একটি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধ-শোয়া হয়ে থাকতে হয়, হাতে থাকে। আলবোলার নল।
রাজত্ব নেই, প্ৰজারা আসে। অভ্যেসবশত প্ৰজারা তাঁর কাছে এসে নানারকম অভিযোগ শোনায়, তিনি নিমীলিত নয়নে শুনে যান। নারীহরণ, জমি দখল, ইংরেজের অত্যাচারের কাহিনী। এসব শুনতে ভালোবাসেন বৃদ্ধ সম্রাট। তিনি মাথা নাড়েন, এবং তাঁরই মতন ক্ষমতাহীন সেনাপতি, আমীর বা মুন্সীদের উদ্দেশ্যে হুকুম দেন, এসব অন্যায়ের প্রতিবিধান করবার জন্য। তারাও দীর্ঘ সেলাম দিয়ে বলে, জো হুকুম, জাঁহাপনা।
এ সভায় সকলেই প্রায় বৃদ্ধ। যেন অতীতের কিছুই হারায়নি, এই রকম মুখ নিয়ে তারা বসে থাকে। সম্রাট প্রায়ই তাদের নানারকম খেতাব বিলি করেন। অথবা তাদের ইনাম দেন। কল্পিত কোনো জায়গীর। তারাও মাথা ঝুঁকিয়ে সৌজন্যের সঙ্গে সব গ্রহণ করে।–
কখনো কখনো সম্রাট আউড়ে ওঠেন কবিতা। তিনি কবি এবং গীত-রচয়িতা। তখন তিনি সম্রাট নন, শুধু জাফর। তিনি একটি একটি কবিতার পদ উচ্চারণ করলেই তাঁর সভাসদরা তারিফ করে বলে ওঠে, বাহাবা, বাহাবা, বোহুৎ খুব!
বাহাদুর শাহ শুধু স্বয়ং কবি নন, কবিদের পৃষ্ঠপোষক। রাজ্য নেই, তবু রাজকবি আছে। প্রসিদ্ধ কবি জোঁক বাহাদুর শাহের গুরু এবং রাজকবি। মীর্জা গালিবকেও তিনি মাসোহারা দিয়ে রাজসভায় রেখেছেন এবং তাঁকে দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরবময় ইতিহাস লেখাচ্ছেন। গালিব আগে লিখতেন ফাঁসীতে, সম্রাট তাঁকে এনেছেন উর্দু ভাষায়। ছোঁকরা গালিবের একটি ছত্র বড় তাঁর মনে গেঁথে গেছে, যে-কোনো সময় তিনি অকারণে সেটা গুন গুন করে ওঠেন। ম্যায়। ই অপনী শিকস্ত কী আওয়াজ-আমি শুধু নিজের ভেঙে যাওয়ার শব্দ!
শুধু প্রজাদের অভিযোগ আর কাব্য আলোচনাই নয়, দরবারে অন্য অন্য পাঁচ রকম কথাও ওঠে। ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডে নামে এক সিপাহীর ইংরেজের বিরুদ্ধে গুলিবর্ষণ কিংবা আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে অগ্নিসংযোগের কথাও তাঁর কানে এসেছে! সভাসদরা এইসব ঘটনার নানারকম ব্যাখ্যা করতে চায়, লোলচর্ম সম্রাট শুধু মাথা নেড়ে ই ই করেন। একদিন তিনি আপনমনে এক বয়েৎ আওড়ালেন : রুশীদের দেশের জার কিংবা বড় বড় সুলতানরা যা পারেনি, চবিমাখা এক কার্তুজ বুঝি তাই করে দিল। পারিষদরা বিস্মিত, একি কথা বলছেন সম্রাট, তাহলে এখনো কি তাঁর নিজীবী শরীরের মধ্যে কোনো উচ্চাকাঙ্খা সুপ্ত রয়েছে?
সম্রাটের পুত্রেরা এবং আত্মীয় পরিজনবর্গ প্রতিদিন সন্ধ্যাকাল থেকেই নানারূপ বল্গাহীন ভোগলীলা এবং নৃত্য-গীত-লাস্যে সারারাত্ৰি আতিবাহিত করে। দিনের অধিকাংশ সময় তারা নিদ্রা যায়। সকালের দিকে তাই লালকেল্লা প্ৰায় স্তব্ধ।
একদিন হঠাৎ খুব গোলমাল শোনা গেল। নগরের লোকজন বাইরে বেরিয়ে এসে হল্লা করছে, দূর থেকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে এক ঘোড়সওয়ারবাহিনী। দিল্লির নাগরিকদের বহু অভিযানের স্মৃতি আছে। তারা সহজে বিস্মিত হয় না। তবু অনেকে ভুরু তুলে ভাবলো, এরা আবার কারা আসছে? দেখতে দেখতে হুড়মুড করে ঢুকে পড়লো অশ্বারোহী সেনাবাহিনী দিল্লির পূর্ব দিকের সড়ক দিয়ে। এরাই মীরাটের তৃতীয় লাইট ক্যাভালরি।
সিপাহীরা মুসলমান বলে চিনতে পারায় দিল্লির নাগরিকরাই তাদের জন্য সাগ্রহে খুলে দিল লালকেল্লার সিংহদ্বার। বিদ্রোহীরা অশ্ব টগবগিয়ে সরাসরি চলে এলো সম্রাটের আবাসের সামনে। বাহাদুর শাহ লাঠি ভর দিয়ে অলিন্দে এসে দাঁড়াতেই তারা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো হিন্দুস্তানের বাদশা বাহাদুর শাহ, আজ থেকে হিন্দুস্তানে আবার আজাদী এসে গেছে!
কম্পিত-বক্ষ সম্রাট প্রথমে দ্বিধান্বিত হয়ে চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। একি সত্যিই সম্ভব? সশস্ত্ৰ সৈনিকরা তাঁকে সম্রাট হিসেবে গ্ৰহণ করতে চায়! ইংরেজ সেনাবাহিনী এখনো দেশে রয়েছে না? কামানের গোলায় তারা ছাতু করে দেবে এই তলোয়ার আস্ফালনকারী সিপাহীদের।
বিদ্রোহীরা তখন উল্লাসে সকলেই চিৎকার করছে একসঙ্গে। অনেকে ঘোড়া থেকে নেমে নৃত্য করতে শুরু করেছে। লালকেল্লার এতখানি অন্দরমহলে তারা কখনো আসেনি, সম্রাটকেও এত কাছ থেকে কখনো দেখেনি। সম্রাট বাহাদুর শাহ যে এত বৃদ্ধ, এত দুর্বল, তা তাদের ধারণা ছিল না। এই মানুষ তাদের নেতৃত্ব দেবে? তবু যাই হোক, সম্রাট বংশের রক্ত তো আছে শরীরে, ঐ নামটিই যথেষ্ট। একজন কৌতুক করে চেঁচিয়ে বললো, বুঢ়া জাঁহাপনা আপ ডরিয়ে মাৎ। আপকো হাম লোগ ফিন সারে হিন্দুস্তানকে বাদশা বনা দেঙ্গে!
বাহাদুর শা। প্রথমে আদেশ দিলেন তাদের চুপ করবার জন্য। কেউ শুনলো না। তারপর তিনি কাতর ভাবে অনুরোধ করতে লাগলেন, এত সিপাহী যেন একসঙ্গে এখানে জমায়েত না হয়। তিনি দু-চারজনের সঙ্গে কথা বলবেন। সিপাহীদের কণ্ঠস্বর আরও তুমুল হলো। তারা এখনি সম্রাটকে তাদের সকলের মধ্যে পেতে চায়। সম্রাট তাদের হয়ে লড়ায়ের ফরমান জারি করুন।
সম্রাটের একটি ছোট দেহরক্ষী দল আছে, তাদের অধিনায়ক এক ইংরেজ, ক্যাপটেন ডগলাস। সম্রাট ক্যাপটেন ডগলাসকে ডেকে তার পরামর্শ চাইলেন। ডগলাস দেখলো, দেহরক্ষীর দলও ইতিমধ্যেই গিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিশেছে। দূরে তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে আরও দলে দলে বিদ্রোহী অশ্বারোহী বাহিনী প্ৰবেশ করছে নগরে। ডগলাস আর দ্বিরুক্তি না করে পেছন ফিরে পালালো এবং একটি প্রাচীর লাফিয়ে লঙ্ঘন করতে গিয়ে পা মাচকালো। কিছুক্ষণের মধ্যে এক সিপাহীর তলোয়ারের এক কোপে তার মুণ্ডটি বিযুক্ত হয়ে গেল শরীর থেকে।
শুরু হলো ধ্বংসলীলা। শুধু ইংরেজ নয়, খ্ৰীষ্টান ধমাবলম্বী যে-কোনো মানুষকেই খুঁজে খুঁজে হত্যা করতে লাগলো সিপাহীরা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই দেওয়াল ঘেরা শহর দিল্লি চলে এলো বিদ্রোহীদের করায়ত্তে। বাহাদুর শাহ জাফর দেখলেন তিনি সত্যি সত্যিই সম্রাট হয়ে গেছেন, তাঁর অধীনে আছে একটি সেনাবাহিনী। এবং প্রতিদিনই বিভিন্ন বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও সৈন্য আসছে। এখন ইচ্ছে করলে তিনি প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করতে পারেন। আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়ে তিনি আবার কবিতা রচনা করতে লাগলেন।
টেলিগ্রাফ যন্ত্রযোগে কলকাতায় গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের কাছে সংবাদ এসে পৌঁছোলো অবিলম্বে। লর্ড ক্যানিং ঠাণ্ডা মাথার অভিজ্ঞ প্রশাসক। তাঁর পূর্ববতী গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি অনেকগুলি যুদ্ধ বিগ্রহ বাধিয়ে গিয়েছিলেন। লর্ড ক্যানিং চান এখন সারা দেশের শাসন ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল ও সুদৃঢ় করে তুলতে। এর মধ্যে আবার যুদ্ধ? দিল্লি দখলের গুরুত্ব অসীম। দিল্লিতে যদি সিপাহীদের একটি বিরাট বাহিনী জমায়েত হয়, তাহলে উত্তর ভারতে ব্রিটিশ শক্তির টিকে থাকাই অসম্ভব হবে। সিপাহীদের জয়ের সংবাদের প্রভাব পড়বে অন্যান্য ক্যান্টনমেণ্টে, যেখানে এখনো বিদ্রোহের ধোঁয়া দেখা যায়নি। দিল্লির কাছেই নবলব্ধ পাঞ্জাব, সেখানে যদি আবার যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে আর সামলানো যাবে না। তৎক্ষণাৎ প্রতি-আক্রমণের ব্যবস্থা না করে তিনি সারা ভারতের সিপাহীদের উদ্দেশে এক বিবৃতি দিলেন যে, ব্রিটিশ সরকার কিংবা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কখনোই ভারতবাসীদের ধমীয় অধিকারে কোনোক্রমেই হস্তক্ষেপ করতে চান না। সুতরাং সিপাহীদের জাতিভ্ৰষ্ট হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এবং তাদের উত্তেজিত হওয়ারও কোনো কারণ নেই।
এ বিবৃতির ফল হলো বিপরীত। দিল্লিতে বাহাদুর শাহের চারপাশে সম্মিলিত সেনানায়করা লাফিয়ে উঠলো আনন্দে। তারা বলে উঠলো, ফিরিঙ্গিরা ভয় পেয়েছে! ফিরিঙ্গিরা ভয় পেয়েছে! তারা এখন সিপাহীদের তোষামোদ করতে চায়।
জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারের বাসগৃহটি এক শনিবারের সন্ধ্যাকালে আলোকোজ্জ্বল। বাড়ির সম্মুখদ্বারের কাছে অনেকগুলি জুড়ি গাড়ি ও পাল্কি। বাবু নবীনকুমার সিংহ প্রবাসের নৌকোবিহার থেকে কিছুদিন আগে সুস্থ ও সমর্থ দেহে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেছেন। আবার পূণোদ্যমে চলেছে বিদ্যোৎসাহিনী সভা, প্রতি শনিবার চলছে বিক্রমোর্কশী নাটকের মহড়া।
বারমহলের ঠাকুরদালানে বাঁধা হয়েছে মঞ্চ। মূল অনুষ্ঠানের আর দেরি নেই। সেইজন্য পর পর কয়েকটি দিন এখন পূর্ণ পোশাকেই মহড়া চলেছে। প্রতিদিন মঞ্চ সাজানো হয় টাটকা ফুল দিয়ে। রাজা পুরুরবার ভূমিকায় দিব্যাকান্তি যুবক নবীনকুমারকে ভারি সুন্দর মানায়। তার কণ্ঠস্বরও সুরেলা। একটি দৃশ্যে সে মঞ্চে প্রবেশ করে অশ্বে আরোহিত হয়, সেইজন্য কিছুদিন ধরে সে অশ্বারোহণ শিক্ষা করেছে।
মঞ্চের উপর উর্বশীর প্রতি প্ৰণয় সম্ভাষণ করছেন রাজা পুরুরবা, সামনে বিদ্যোৎসাহিনী সভার সভ্যেরা দর্শক, এমন সময় দারুণ উত্তেজিত ভাবে সেখানে প্রবেশ করলো যদুপতি গাঙ্গুলী। সে সরাসরি মঞ্চের সামনে উপস্থিত হয়ে বললো, এসব তোমরা কী কচ্চো, নবীন? দেশে একটা রাষ্ট্রবিপ্লব হচ্চে, আর তোমরা এখনো নাটক-নবেল নিয়ে মেতে আচো?
যদুপতির কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে মনোযোগ না দিয়ে উপায় নেই। থেমে গেল অভিনয়ের মহড়া। রাজা পুরুরবা জিজ্ঞেস করলেন, রাষ্ট্রবিপ্লব? সে আবার কী, যদুপতি?
যদুপতি সকলের দিকে ফিরে বললো, আপনারা কেউ কিছু শোনেননি? দেশে ইংরেজ রাজত্ব য যায় যায়! দেশে আবার মোগল রাজত্ব স্থাপন হতে চলেচে। সেপাইরা দারুণ ঠ্যাঙাচ্ছে ইংরেজদেরকে।
মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নিচে নেমে এসে রাজা পুরুরবা বললো, বলো কী, যদুপতি! আবার মোগল শাসন?
Leave a Reply