[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২০. দিল্লি পৌঁছে শুনলাম

দিল্লি পৌঁছে শুনলাম, সফরসূচি বদলে গেছে। আগে ঠিক ছিল যে মে মাসের তিন তারিখ রওনা হওয়া হবে সদলবলে। বিকেলের দিকে ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়া দফতরে টেলিফোন করে জানা গেল যে তিন তারিখের বদলে চার তারিখে যাত্রা ঠিক হয়েছে। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে আমাকে তা জানানো হয়নি। সবাই মিলে একসঙ্গে যাওয়া হবে বলেই আমার দিল্লিতে আসা। দলের সদস্য সংখ্যা ছয় অমৃতা প্রীতম (পাঞ্জাবি ভাষার কবি) গোপালকৃষ্ণ আদিগা (কন্নড় ভাষা), কেদারনাথ সিং (হিন্দি), শামসুর রহমান ফারুকি (উর্দু, অরুণ কোলাটকর (মারাঠি) এবং আমি। এবং দলটির তত্বাবধায়ক হিসেবে যাবেন ভূপালের ভারত ভবনের পরিচালক অশোক বাজপেয়ী।

আমার পক্ষে তখন টিকিট বদল করার অনেক ঝামেলা। সুতরাং একাই যেতে হবে। একলা ভ্রমণ আমার ভালো লাগে, অভ্যেসও আছে। কিন্তু পুরো দলটিকে নিউ ইয়র্কে ভারতীয় উপ দূতাবাসের কর্তৃপক্ষের অভ্যর্থনা করার কথা। আমার একার জন্য নিশ্চয়ই কেউ আসবে না, হোটেল ইত্যাদি কে ঠিক করবে তাই-বা কে জানে। যাই হোক, একটা কিছু হবেই। দিল্লিতে সারাসন্ধে আড্ডা দেওয়ার পর রাত দুপুরে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে গেল মিহির রায়চৌধুরী, সমরেশ দাশগুপ্ত ও ভারতী। আজকাল এমনই সিকিউরিটির কড়াকড়ি যে সঙ্গী সাথীদের গেটের বাইরে থেকেই বিদায় জানাতে হয়। বিমানে ওঠার আগে পেছন ফিরে প্রিয়জনদের আন্দোলিত করতল আর দেখার উপায় নেই!

ইন্দিরা গান্ধির নামে নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি খুলেছে মাত্র দুদিন আগে। চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা। কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। নতুন বলেই মনে-মনে সব কিছু ক্ষমা করা যায়, হয়রানি সত্বেও মনকে সেইভাবে শান্ত রাখি। রাত্তিরে ঘুমের কোনও আশা নেই। কারণ এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি বোম্বাই ছুঁয়ে যাবে, সেখানে ঘণ্টা দুয়েকের অপেক্ষা, তারই মধ্যে আবার নতুন করে সিকিউরিটি চেক, নিজের সুটকেসটি খুঁজে অঙ্গুলি নির্দেশের দায়িত্ব। কতিপয় উগ্রপন্থী শিখ যাত্রী ভরতি বিমান আকাশপথে ধ্বংস করার বায়না ধরেছেন, তারই জন্য এত সব ঝকমারি, তবু সকৌতুকে লক্ষ করলুম, যাত্রীসংখ্যা একটুও কমেনি, বিমানটি প্রায় টইটম্বুর।

পশ্চিম গোলার্ধে যাত্রায় মজা এই যে তাতে অতিরিক্ত সময় অর্জন করা যায়। এই আকাশ পথে দীর্ঘ যাত্রায় সন্ধে এবং রাত্রির পর ভোর হয় না, আবার বিকেল ফিরে আসে। আমার ইওরোপে থামার কোনও পরিকল্পনা নেই, সুতরাং আটলান্টিকের অন্তরীক্ষে মিশমিশে কালোরাত দেখার পর নিউ ইয়র্কে যখন পৌঁছলুম, তখন ফটফটে বিকেল।

কেনেডি এয়ারপোর্টের অবস্থা যাচ্ছেতাই। মুহুর্মুহু প্লেন ওঠা-নামা করছে, গিসগিস করছে যাত্রী-যাত্রিণী, ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের সামনে লম্বা লাইন। আমি যখন প্রথমবার এদেশে আসি তখন এই বিমানবন্দরটির নাম ছিল আইডেলওয়াইল্ড, তখন প্লেন থেকে বাইরে বেরুতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগত না, এখন নাকি দু-আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। কোন পুণ্যবলে জানি না, আমাকে তেমন ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হল না। আমি কবিতা পাঠ করতে এসেছি শুনে দুটি জায়গাতেই ঈষৎ হাস্য পরিহাস করে আমাকে ছেড়ে দিল। সুটকেস ঠেলতে ঠেলতে আমি চিন্তা করছি কোথায় যাব, কোন হোটেলে উঠব, কোন বন্ধুকে টেলিফোন করব, এমন সময় দেখি অনেকগুলি উজ্জ্বল পরিচিত মুখ। বিদেশের এয়ারপোর্টে যদি কোনও চেনা মানুষকে দেখতে পাওয়া যায়, তাও আবার যদি অচিন্ত্যপূর্ব হয়, তাহলে তার তুলনা দেওয়া যায় অল্প পড়াশুনো করে পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার সঙ্গে। আমি ভেবেছিলুম, আমার জন্য কেউই থাকবে না, দেখলুম অপেক্ষা করছেন মোট সাতজন। আমাদের বুধসন্ধ্যার ধ্রুব কুণ্ডু, নিউ ইয়র্কের অনেককালের অধিবাসী যামিনী মুখার্জি এবং তাঁর স্ত্রী সুমিত্রা মুখার্জি, হোয়াইট প্লেইনসের চন্দন সেনগুপ্ত এবং তার গুজরাটি পত্নী প্রীতি, এবং কমিটি ফর ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রির দুজন প্রতিনিধি মার্ক নেসডর এবং স্যাম শার্প। এঁরা সবাই এসেছেন আলাদা-আলাদা ভাবে এবং আমাদের দূতাবাসের পক্ষ থেকে কেউই আসেননি। মার্কিন যুবক দুটি জানাল যে আমার জন্য হোটেল ঠিক করা আছে।

যে-কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে আমি এসেছি, তা ভারত উৎসবেরই অন্তর্গত। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পর, দেড় বছর ধরে খণ্ড খণ্ড ভাবে এই অনুষ্ঠান চলবে। উৎসবের উদ্যোক্তা ভারত সরকার বটে কিন্তু আমেরিকার বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠানগুলির আয়োজন করেছে কমিটি অফ ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রি। নিউ ইয়র্কের একদল কবি এই কমিটি গড়েছেন, সেই কবিদের প্রধান হচ্ছেন অ্যালেন গিনসবার্গ। এই কমিটি বিভিন্ন দেশের কবিদের আমন্ত্রণ জানান এদেশে কবিতা পাঠের জন্য। এবারে ভারত সরকারের সঙ্গে সহযোগিতায় তাঁরা ভারতীয় কবিদের কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করেছেন। এদের সঙ্গে আমেরিকান সরকারের কোনও সম্পর্ক নেই।

হোটেলটির নাম লেক্সিংটন, এটি ম্যানহাটানের লেক্সিংটন অ্যাভিনিউ ও ৪৮নং রাস্তার মোড়ে। এককালে নামকরা হোটেল ছিল নিশ্চয়ই, শুনলুম সম্প্রতি কোনও ভারতীয় এটি কিনেছেন। সামনের দিকে মেরামতের কাজ চলছে, অব্যবস্থার একেবারে চূড়ান্ত। রুম সার্ভিস বলে কিছু নেই, ঘরে বসে এককাপ চা কিংবা কফিও পাওয়া যায় না। ভারতীয় মালিকানায় গেছে বলেই এই অবস্থা, এরকম মন্তব্য অনেকেই করেছেন বারবার। যদিও হোটেলটির কর্মচারীরা ভারতীয় নয়।

হোটেলে পৌঁছে একটি চিরকুট পেলুম, তাতে লেখা আছে গিনসবার্গ এক রেস্তেরাঁয় উইলিয়াম বারোজ-এর সঙ্গে ডিনার খাবেন, সেখানে তিনি আমাকেও নেমন্তন্ন করেছেন। কিন্তু সুদীর্ঘ বিমানযাত্রা এবং ঘুমহীনতায় আমি অবসাদ বোধ করছিলাম, আবার বাইরে বেরুতে বা কিছু খেতে ইচ্ছে করল না একেবারেই। নিজের ঘরে বসে বন্ধুদের সঙ্গে খানিকটা আড্ডা দেওয়ার পর আমি টিভি চালিয়ে দিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিলুম। আমেরিকান টিভি খুব ভালো ঘুমের ওষুধ।

পরদিন সন্ধ্যায় পুরো দলটি এসে পৌঁছবার পর জানা গেল, শ্রীমতী অমৃতা প্রীতম আসতে পারেননি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রায় শেষ মুহূর্তে যাত্রা বাতিল করেছেন। যাই হোক, ভারতীয় কবির দলটির সংখ্যা-হানি অবশ্য হল না, কারণ সেইদিনই এসে পৌঁছেছেন নবনীতা দেবসেন। আর একটি ভ্রাম্যমাণ ভারতীয় লেখকদের দল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বক্তৃতা ও আলোচনাচক্রে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্য থেকে দুজন নবনীতা দেবসেন এবং বোম্বাইয়ের ইংরিজি ভাষার কবি-সম্পাদক নিসিম ইজিকিয়েল নিউ ইয়র্কের কাব্য পাঠের আসরে যোগদান করবেন, এরকম আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। এ ছাড়া, শিকাগোতে অধ্যাপনা করেন দক্ষিণ ভারতীয় কবি এ কে রামানুজন, ডেকে আনা হয়েছে তাঁকেও।

নিউ ইয়র্কের কবিতা পাঠের ব্যবস্থা হয়েছে দু-জায়গায়। প্রথম তিনদিন অনুষ্ঠান হবে মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টস-এ, সংক্ষেপে যার নাম মোমা। মিউজিয়াম কথাটি শুনলেই আমাদের প্রাচীন হাড়-পাথরের কথা মনে পড়ে, কিন্তু পশ্চিমের মিউজিয়ামগুলি সব সময়েই সমসাময়িক সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখে। ছবির প্রদর্শনী তো থাকেই তা ছাড়া দেশ বিদেশের শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্যেরও স্বাদ পাওয়া যায় এখানে এসে। মোমাতে প্রায়ই তো কবিতা পাঠের ব্যবস্থা থাকে।

মে মাসের পাঁচ তারিখ থেকে তিনদিন ধরে যে কবিতা পাঠের আসর, তাতে আমেরিকান ও ভারতীয় দু-দল কবিই পড়বেন। এই সম্মিলিত কাব্য পাঠের ব্যবস্থাটি অভিনবই বলতে হবে।

দ্বিতীয় দিন সকালেই হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল অ্যালেন গিনসবার্গ। তার সঙ্গে আমার পনেরো বছর বাদে আবার দেখা। পাঁচ বছর আগে আমি যখন এদেশে এসেছিলাম, তখন অ্যালেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তি যুদ্ধের সময় হঠাৎ একদিন কলকাতায় আমার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল অ্যালেন। সেসময়ে আমাদের বাড়ির বয়স্ক রাঁধুনি গোপালের মা ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিল না, অ্যালেন গোপালের মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করায় সে হেসে-কেঁদে অস্থির!

সেবার অ্যালেন এসেছিল বাংলাদেশ যুদ্ধের শরণার্থীদের অবস্থা নিজের চোখে দেখতে। তার সঙ্গে জন জিয়োনো নামে আর একজন তরুণ কবি ও ফটোগ্রাফার। আমরা তিনজন যশোর রোড ধরে গিয়েছিলাম বনগাঁর সীমান্তের দিকে। দু’পাশের উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে ঢুকে-টুকে লক্ষ-লক্ষ শিশু বৃদ্ধ-নারীর মানবেতর জীবনযাপন নিজের চোখে দেখে অ্যালেন চোখের জল ফেলেছিল। সেটা ছিল সেপ্টেম্বর মাস, কয়েকদিন আগেই প্রবল বর্ষায় এইসব অঞ্চলে বন্যা হয়ে গেছে, শেষ পর্যন্ত আমরা গাড়িতে যেতে পারিনি, একটা নৌকো ভাড়া করে এগিয়ে যেতে যেতে দেখেছিলুম অনেক ভাসমান সংসার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অ্যালেন লিখেছেন তার বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। কিছুদিন পরে পপ সঙ্গীতের সম্রাট বব ডিলান যখন বাংলাদেশের দুর্গতদের সাহায্য করা জন্য এক বিরাট সঙ্গীতানুষ্টানে টাকা তোলেন, সেখানে ওই কবিতাটি সুর করে গাওয়া হয়েছিল।

অ্যালেন গিনসবার্গের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় এরও অনেকদিন আগে, বাষট্টি সালে। সেবারে অ্যালেন ও তার সহচর পিটার অরলভস্কি এসেছিল মধ্যপ্রাচ্যের মধ্য দিয়ে হিচ হায়কিং করে। তখনও হিপি আন্দোলন শুরুই হয়নি, ছেঁড়া জামা, ধুলো-কাদা মাখা সাহেব দেখা এদেশের মানুষের অভ্যেস হয়নি। কেরুয়াক-করসো-গিনসবার্গ প্রমুখ কবি সাহিত্যিকরা নিজেদের বলত বিট জেনারেশান, ওদের নীতি ছিল যতদূর সম্ভব কম খরচে জীবন যাপন করা, যাতে কোনওক্রমেই প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পাততে না হয়, শিল্পী-সাহিত্যিকরা চব্বিশ ঘণ্টার জন্যই স্বনিযুক্ত, কোনও রকম চাকরি-বাকরি করায় ওঁরা বিশ্বাসী নন।

কবি হিসেবে অ্যালেন গিনসবার্গকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তার আমেরিকায় আলাপ হয়েছিল, সেই সূত্রে কলকাতায় এসে সে কৃত্তিবাসের আড্ডায় জুটে পড়ে। তারপর দিনের পর দিন এক সঙ্গে কাটানো, কখনও শ্মশানঘাটে, কখনও মাহেশে রথের মেলায়, কখনও ডায়মন্ডহারবারে, কখনও আমরা বা উৎপলকুমার বসু বা তারাপদ রায়ের বাড়িতে, আচ্ছা তুমুল আড্ডা। তারপর জামসেদপুর, চাইবাসা, কাশীতে ভ্রমণ। শক্তি অ্যালেনদের সঙ্গে চলে গিয়েছিল তারাপীঠ, সেখানে তান্ত্রিকদের সঙ্গে কাটিয়ে এসেছে কয়েকটা দিন। অ্যালেনের ঝোঁক তখন অতীন্দ্রিয় সাধনার দিকে, ভারতে সে প্রধানত এসেছিল গুরু খুঁজতে। আমাদের ধর্মের দিকে বা যোগসাধনার দিকে কোনও ঝোঁক ছিল না। আমরা তখন নিমজ্জিত হয়ে আছি কবিতায়, শুধু কবিতায়। অ্যালেন গিনসবার্গের মতন একজন জোরালো কবির সান্নিধ্যে আমরা অনুপ্রাণিত বোধ করতাম। মানুষ হিসেবেও সে চমৎকার, নরম, ভদ্র, অন্যের কথা মন দিয়ে শোনে, নিজের মতামত জোর করে খাটাবার চেষ্টা করে না। তার কবিতা বর্ণনামূলক হলেও শব্দ ব্যবহারের জাদু আছে, এই পৃথিবীর প্রতি তার নিজস্ব কিছু কথা বলার আছে, এই কবিতা আমাদের নতুন স্বাদ দেয়।

সেই অ্যালেন গিনসবার্গের সঙ্গে কতকাল পরে আবার দেখা। আমার বর্তমান চেহারা সে চিনতে পারবে কি না এ ব্যাপারে কিছু সন্দেহ ছিল, কিন্তু আমাকে দেখামাত্র সে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করার পর ফটাফট চুমো খেল দুই গালে। দুবার বলল, লং টাইম, আফটার আ লং টাইম। তারপর সে জিগ্যেস করল, কত বছর বাদে? পনেরো; কুড়ি পঁচিশ? সে বহুদেশ ঘুরে বেড়ায়, তার সঠিক মনে থাকার কথা নয়, আমি তাকে সঠিক তারিখগুলি স্মরণ করিয়ে দিলাম।

এতগুলি বছরে, পোশাকে ছাড়া তার শরীরের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। তার বয়েস ষাট, কিন্তু বার্ধক্যের চাপ পড়েনি, মাথার চুল ঈষৎ পাতলা, দাড়িতে পাক ধরেছে। সে পরে আছে কোট ও টাই, তেমন কিছু ফ্যাশনদুরস্ত বা দামি নয়, তবে ভদ্রস্থ। এর আগে আমি কিছু পত্র-পত্রিকায় পড়েছি যে এককালের সেই বিদ্রোহী কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এখন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করেছে, সে এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে, সে এখন অনেক টাকা রোজগার করে। এমনকী এখন তার প্রাইভেট সেক্রেটারি আছে। অবশ্য কবি হিসেবে তার খ্যাতিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, এখন আমেরিকার সে প্রধান কবি বললে অত্যুক্তি হয় না।

আমি দেখলুম, এত খ্যাতি সত্বেও অ্যালেন আগের মতনই নিরভিমান, বন্ধুত্বের ব্যাপারে উষ্ণ। আমার কাছে সে কলকাতার অনেক খবরাখবর নিল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, তারাপদ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কথা তার স্পষ্ট মনে আছে, বারবার জিগ্যেস করল তাদের কথা।

পরদিন দুপুরে অ্যালেনের বাড়িতে আমাদের সবার নেমন্তন্ন। সে এখন থাকে ম্যানহাটনের ১২ নম্বর রাস্তায়, ঠিকানা জানাবার সময় সে আমার দিকে চোখ টিপে সকৌতুকে বলল, আমি আপ টাউনে উঠে এসেছি! এ শহরে রাস্তার নম্বর শুনলেই অনেকটা বোঝা যায় যে কেমন অবস্থাপন্ন পাড়ায় থাকে। অ্যালেনরা আগে থাকত গ্রিনইচ ভিলেজের একটেরেতে লোয়ার ইস্ট সাইডে, প্রায় বস্তির মতন এক লম্বাটে বাড়িতে, গ্রিনইচ ভিলেজ এখন অনেকটাই ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড করা হয়েছে, বাকিটা টুরিস্টদের ভিড়ে ভরা।

অ্যালেনের বর্তমান অ্যাপার্টমেন্টটিও তেমন কিছু সচ্ছল এলাকায় নয়, রাস্তায় ছেলে মেয়েরা চ্যাঁচামেচি করছে, বাড়িটি পুরোনো, লিফট নেই, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হল চারতলায়। পিটার ওরলভস্কি এখন তার সঙ্গে থাকে না, সে অসুস্থ অবস্থায় আছে কোনও বৌদ্ধ আশ্রমে। এখানে রয়েছে অ্যালেনের প্রাইভেট সেক্রেটারি বব রোসেনথাল, আর একটি মেয়ে অ্যালেনের বই-এর সংগ্রহ ও পাণ্ডুলিপি গোছগাছ করার কাজ করে। এসব সত্বেও বাসস্থানটি দেখলে মনে হয় কোনও গৃহী সন্ন্যাসীর। একটি ঘরের কোণে আমাদের দেশের মা-ঠাকুমাদের ঠাকুর ঘরের মতন কয়েকটি ঠাকুর-দেবতার ছবি ও মূর্তি সাজানো, সামনে আসন পাতা, সেখানে অ্যালেন প্রতিদিন ধ্যানে বসে। নবনীতা মহা উৎসাহে ছবি তুলতে লাগল এইসব কিছুর।

অ্যালেন আমাকে তার সমগ্র কাব্য সংগ্রহ উপহার দেওয়ার সময় ছেলে-মানুষের মতন নানারকম ছবি এঁকে আঁকিবুকি কেটে আমার নাম লিখে দিল। এ ছাড়া সেদিন তার কবিতার গানের লং প্লেয়িং রেকর্ড, তার নিজের গলায় গাওয়া ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার ক্যাসেট। আমাদের বাংলা বই তাকে দিয়ে কোনও লাভ নেই, আমি একটি ছোট্ট প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, আমার স্ত্রী তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি পাঠিয়েছে। অ্যালেন ক্ষুণ্ণভাবে বলল, কেন তুমি পাঞ্জাবি এনেছ? কলকাতায় আমি একটা লাল পাঞ্জাবি গায়ে দিতুম তোমার মনে আছে? সেটা আমি সঙ্গে এনেছি, তুলে রেখে দিয়েছি, ওসব আমি আর পরি না। এখন আমি পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় বেরুলে লোকে আমাকে হিপি বলবে। ওসব আমি এখন চাই না। দ্যাখো, এক সময় আমি অনেক অনিয়ম-অনাচার করেছি, ঢের হয়েছে, এখন বয়েস তো হল, এখন আমি চুপচুপ শান্তভাবে কবিতা লিখতে চাই।

আমি বললুম, ঠিক আছে, এটা পরে তোমায় রাস্তায় বেরুতে হবে না। ঘুমোবার সময় এটাকে নাইট শার্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারো।

অ্যালেন প্যাকেটটি না খুলে রেখে দিল একপাশে।

অ্যালেনের সেক্রেটারি বব রোজনথাল বললো, অ্যালেন আজ নিজে রান্না করেছে। চলো, খাবার ঠান্ডা করা ঠিক হবে না।

আমরা সবাই চলে এলুম রান্নাঘরে। মোটামুটি সাত্বিক আহার, তরমুজ-কলা-আম-স্ট্রবেরি ইত্যাদি নানারকম ফল, রুটি-মাখন, চিজ কয়েকপ্রকার, গরম সাদা ভাত, পেঁপের তরকারি, ডাল ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে কয়েকজন নিরামিষাশী, তাদের পছন্দ হল খুব। অবশ্য একটি প্লেটে হ্যাম ও স্যালামির টুকরোও রাখা আছে, তবে সেদিন অশোক বাজপেয়ি, নবনীতা ও আমি ছাড়া কেউ বোধহয় হাত বাড়ায়নি।

সন্ধেবেলা মোমাতে কবিতা পাঠের আসরে দেখি অ্যালেন সেই পাঞ্জাবিটা পরে এসেছে। বব আমাকে বলল, দেখেছ, অ্যালেন আজ কীরকম সেজেছে! অনেকদিন আমি ওকে এরকম এক্সটিক পোশাকে দেখিনি! আমি অ্যালেনকে জিগ্যেস করলুম, তুমি শেষ পর্যন্ত হিপি সাজলে যে? অ্যালেন হেসে বলল, তখন খুলে দেখিনি, এই ডিজাইনটা খুব সুন্দর, আর আজকের আবহাওয়ায় এই মেটেরিয়ালটিই লাস্ট রাইট!

ভারতীয় কবিদের মধ্যে কেদারনাথ সিং, অশোক বাজপেয়ী ও আমি প্রতি আসরেই পাজামা পাঞ্জাবি পরে গেছি, অন্যদের অবশ্য প্যান্টকোটই বেশি পছন্দ। আর বর্ণময় শাড়িতে ও ঝলমলে ব্যবহারে নবনীতা সব সময়েই দৃষ্টি আকর্ষণীয়।

প্রতি সন্ধ্যায় তিনজন ভারতীয় কবি ও তিনজন আমেরিকান কবি কবিতা পড়বেন, এই রকম ঠিক ছিল। ভারতীয় কবিরা কবিতাপাঠ করবেন মাতৃভাষায়। সেই কবিতাগুলিরই ইংরেজি কবিতা পড়ে দেবেন কোনও আমেরিকান কবি। এই ব্যবস্থাটি আমার খুব পছন্দ। কোনও রুশ কবি বা কোনও ফরাসি কবি যখন মার্কিন দেশ সফরে আসেন, তখন তাঁরা মাতৃভাষাতেই কবিতা পড়েন। ইংরেজিতে নয়। তাঁদের কবিতা ইংরিজিতে বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব অন্যের। তাহলে আমরা ভারতীয়রাই বা আমাদের নিজস্ব উচ্চারণে ইংরিজি পড়তে যাব কেন? এর ব্যতিক্রম ঘটল শুধু নিসিম ইজিকিয়েল আর নবনীতা দেবসেন-এর ক্ষেত্রে। নিসিম ইজিকিয়েল ইংরিজিতেই লেখেন, তিনি নিজের কবিতা নিজেই পড়লেন। আর নবনীতা বিলেত-আমেরিকায় দশ কুড়িবার ঘুরে গেছে, এইসব দেশে সে দীর্ঘদিন থেকেছে, পড়াশুননা করেছে, তার ইংরিজি উচ্চারণ অনেক আমেরিকানের চেয়েও ভালো, সে কোনও অনুবাদ-পাঠকের সাহায্য নেয়নি, নিজের কবিতা আগে বাংলায় পাঠ করে সে সেই কবিতার অনুষঙ্গ তার নিজস্ব ভাষায় বুঝিয়ে তারপর অনুবাদ পড়ে একেবার জমিয়ে দিল। নবনীতার কবিতা পাঠের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যেন এক অনবদ্য একক অনুষ্ঠান, তা অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে।

কবিতা পাঠের আসরটি বসেছিল মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্টসের গার্ডেন হলের কাছাকাছি ঢাকা বারান্দায়। শ্রোতারা সব বসেছেন চতুর্দিকে ছড়ানো আলাদা আলাদা টেবিল। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ও বিরতির সময় বিনামূল্যে লাল ও সাদা সুরা ও কোমল পানীয় বিতরিত হচ্ছিল, অনেকটা যেন রেস্তোরাঁয় আড্ডার মেজাজ, কিন্তু কবিতা পাঠের সময় পিন-পতন নৈঃশব্দ্য। শ্রোতার সংখ্যা দুশো-আড়াই শো’র বেশি নয়, অল্প কিছু সংখ্যক ভারতীয়, তাদের মধ্যেও বাঙালিই বেশি!

আমেরিকান কবিদের মধ্যে যাঁরা নিজস্ব কবিতা পড়লেন, তাঁদের মধ্যে খ্যাতিমান ও তরুণ মেলানো মেশানো। খ্যাতিমানদের মধ্যে অবশ্যই অ্যালেন গিনসবার্গ শীর্ষে, তা ছাড়া ছিলেন জেমস লকলিন, বিল জাভাটস্কি ও ডেভিড র্যাটরে। জেইন করটেজ নামে একজন কালো রঙের মহিলা কবি পড়লেন দারুণ রাগি, চ্যাঁচামেচির কবিতা, এদেশের বহু পাঠকের কাছেই যা কবিতা বলে মনে হবে না। একজন বর্ষীয়ান কবি পড়লেন ভারতবর্ষ বিষয়ক কবিতা। টম উইগেল নামে এক তরুণ কবি নানারকম কায়দা কানুন করতে লাগলেন, মাঝে-মাঝে ঘাড় বেঁকানো, তাচ্ছিল্যের প্রকাশ, উলটোপালটা মন্তব্য, হাত থেকে কাগজ পড়ে যাওয়া, হঠাৎ পড়া থামিয়ে সিগারেট ধরানো। এসবই আমার চেনা, আমাদের দেশেও এমন অনেকবার দেখেছি। এ আর কিছুই না, অ্যালেন গিনসবার্গের মতন একজন প্রখ্যাত কবি সামনে বসে আছে বলে তার বিরুদ্ধে খানিকটা বিদ্রোহের প্রকাশ। আমি তাকিয়ে দেখি, অ্যালেন মুচকি-মুচকি হাসছে। ছেলেটি অবশ্য তেমন ভালো লেখে না, ভালো লিখলে এসব মানিয়ে যেত।

দর্শকদের মধ্যে প্রধান দ্রষ্টব্য হচ্ছে গ্রেগরি করসো। এই প্রখ্যাত কবিটি প্রতি সন্ধেবেলাতেই হাজির, কিন্তু তাকে কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গ্রেগরি ঠিক আগের মতনই রয়ে গেছে, সব সময় মাতাল কিংবা গাঁজার ধোঁয়ায় টইটম্বুর, টলমলে পায়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্রেগরিকে কবিতা পড়তে দেওয়া হয়নি বলে আমি বেশ ক্ষুব্ধ বোধ করেছিলুম। আমেরিকায় প্রকাশ্যে মাতালামি কেউ সহ্য করে না।

এতবড় একজন কবি বিনা আমন্ত্রণে প্রতিদিন আসছে, এটাও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। কিন্তু গ্রেগরি নাকি অ্যালেনের সঙ্গ ছাড়তে চায় না, ছায়ার মতন ঘোরে। অ্যালেন বলল, গ্রেগরি একটি আট বছরের শিশু, আমি দেখাশুনো না করলে ও নিজেকে সামলাতে পারে না।

গ্রেগরির ভাবভঙ্গি ঠিক একটি দুষ্টু ছেলের মতনই। বারবার টেবিল বদলে সে এর ওর মদের গেলাস কেড়ে নিচ্ছে, জ্বলন্ত সিগারেট তুলে নিচ্ছে অন্যের আঙুল থেকে, ওখানে বসেই গাঁজা টানছে। একটি মেয়ের কবিতা পাঠের সময় সে চেঁচিয়ে উঠল, হানি, তুমি আমার লেখা থেকে চারলাইন চুরি করেছ।

চৌষট্টি সালে নিউ ইয়র্কে অ্যালেনের অ্যাপার্টমেন্টে যখন আমি দিন কতক কাটিয়ে গিয়েছিলাম, তখন গ্রেগরিকে এইরকমই দেখেছি। তখন তার কোনও রোজগার ছিল না, সে ছিল অ্যালেনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। অ্যালেন অবশ্য খাওয়া-দাওয়া থাকার বিনিময়ে তাকে দিয়ে ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজার কাজ করাত। গ্রেগরি একদিন আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে পালিয়েছিল। এবারে তার সঙ্গে অ্যালেন যখন নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিল তখন দেখা গেল তার সেই ঘটনাটা ঠিক মনে আছে। সে বলল, ও তুমিই সেই ভারতীয় ছোকরা কবি যার কাছ থেকে আমি টাকা ধার নিয়েছিলাম? তারপর সে আমার কাঁধ চাপড়ে বলল, দেব, দেব, একদিন না একদিন তোমার ধার আমি ঠিক শোধ দেব! আমি বললুম, না, গ্রেগরি আমি তোমাকে সারা জীবন ঋণী রাখতে চাই!

ভারতীয় কবিদের মধ্যে এ কে রামানুজন-এর অনুষ্ঠান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইনি ইংরিজি ভাষাতে লেখেন। কিন্তু যেহেতু এখানে তামিল কবিতার কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই, তাই তিনি নিজের কবিতা পাঠ করার আগে আগে প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত তামিল কবিতার ধারার নির্বাচিত কিছু কিছু অংশ পাঠ করে তার ইংরিজি অনুবাদ শোনালেন। আমি মনে মনে ভাবলুম, আমাদের বাঙালিদের মধ্যে যারা সব ইংরিজিওয়ালা, যারা শুধু ইংরিজিতে লেখে, তাদের কারুর এরকম মাতৃভাষা প্রীতি তো দেখি না! অবশ্য, আমার এই ধারণাটি মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে, ক’দিন পরেই আমি এরকম বাঙালি দেখেছি! সব কিছুরই ব্যতিক্রম আছে।

আমার কবিতার অনুবাদগুলি অ্যালেন গিনসবার্গ নিজে পাঠ করছে শুনে প্রথমে আমি বেশ বিব্রত বোধ করেছিলাম। সে এখন এত খ্যাতিমান কবি, সে কেন অন্যের কবিতা পড়তে যাবে? এ যেন বন্ধুত্বের খাতিরে অতিরিক্ত দাবি। আমি তাকে বললুম, অ্যালেন, তোমার পড়বার দরকার নেই, অন্য যে-কেউ পড়ে দিক না। কিন্তু অ্যালেন তা শুনল না। সে তার ভরাট, সুন্দর কণ্ঠস্বরে আমার দুর্বল কবিতাগুলি সুখশ্রাব্য করে দিল।

অ্যালেন নিজের কবিতা পড়বার আগে হারমোনিয়াম বাজিয়ে জুড়ে দিল গান। এই ছোট হারমোনিয়ামটি সে ভারত থেকে নিয়ে গেছে। ইদানীং গানের দিকে খুব-ঝোঁক গেছে তার, অবশ্য গায়কদের মতন তার গলা যে সুরেলা তা নয়, কিন্তু তালজ্ঞান আছে। বৈদিক মন্ত্র যেমন গাওয়া হয়, সে তার কোনও-কোনও কবিতা সেইভাবে উচ্চারণ করতে চায়। প্রথম একটি গানের পর বাকি কবিতাগুলি সে পড়ল স্বাভাবিক কবিতা পাঠের ভঙ্গিতে। সে তার আশু প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি থেকে নতুন কবিতা পাঠ করে শোনাল, কবিতাগুলির মধ্যে তার মায়ের কথা ঘুরে-ঘুরে এসেছে। অনেক আগে সে তার কাব্যগ্রন্থ ‘কাদিস’ মূলত তার মা নাওমি-কে নিয়েই লিখেছিল। এখন তার কবিতার ভাষা অনেক সংহত, আগে সে মাঝে-মাঝেই চমকে দেওয়ার জন্য দু-একটি কাঁচা গালাগালির শব্দ ব্যবহার করত, এখন তা একেবারেই নেই। এখন তার লাইনগুলিতে ফুটে ওঠে ছোট ছোট ছবি এবং সেই সব ছবি ছাপিয়েও যা ফুটে ওঠে, তা হল একটি বিশ্ব-নাগরিক মন। তার কবিতা একেবারেই দুর্বোধ্য নয়। নিছক শব্দ নিয়ে খেলা, কিংবা বিনি সুতোর মালার মতন কবিতা ওদেশে অচল হয়ে গেছে। অ্যালেনের কবিতায় স্পষ্ট বোঝা যায় এক কবির ক্ষোভ ও বিষাদ চার পাশের বাস্তব জীবন সম্পর্কে কবির অভিমত এবং মাঝে মাঝেই বাস্তবতা থেকে উত্তরণ।

কবিতা পাঠের পর প্রতিদিনই আমরা অনেক রাত পর্যন্ত কোথাও না কোথাও আড্ডা দিতাম। কোনওদিন কোনও ভারতীয় রেস্তোরাঁয়, কোনওদিন চিনা খাবারের দোকানে, কোনওদিন আমার হোটেলের ঘরে। আমার কাছে একটি উপহার-পাওয়া শ্যাম্পেনের বোতল ছিল। প্রথম দিনই সেটা খুলে ফেলা হল। অ্যালেন মদ ছোঁয় না আর গ্রেগরির বোতল ফুরিয়ে ফেলার জন্য খুবই ব্যস্ততা। ভারতীয় কবির দলের মধ্যে দু’তিনজন কট্টর নিরামিষাশী, কিন্তু মদ্যপানে তাঁদের কারুর অনীহা নেই। কয়েকজন শিল্পীও এসে জুটে গিয়েছিলেন দলে, ছোট ঘরে সকলের বসার জায়গা হয় না, যে-সেখানে পারে একটু স্থান করে নেয়, আড্ডা রাত দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত গড়িয়ে যায়।

একদিন আমরা খবর পেলাম যে হিন্দি ভাষায় বিশিষ্ট কবি শ্রীকান্ত ভার্মা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন নিউ ইয়র্কেরই হাসপাতালে। কবিতা পাঠের পর তাড়াতাড়ি এক পার্টি সেরে আমরা কয়েকজন দেখতে গেলাম তাঁকে। অ্যালেনের সঙ্গে শ্রীকান্তের পরিচয় নেই, তবু সে-ও যেতে চাইল। ছিপ ছিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, তারই মধ্যে আমরা হাঁটতে-হাঁটতে গেলুম সাত আট ব্লক; শ্রীকান্ত তখন অচৈতন্য, আমরা দেখা করে এলুম তাঁর স্ত্রী ও আত্মীয়দের সঙ্গে। আমরা যখন কথা বলছিলুম তখন অ্যালেন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল একপাশে। শ্রীকান্ত জানতেও পারল না যে আমেরিকার প্রধান কবি এসেছিল তাকে শুভেচ্ছা জানাতে।

মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্টসে তিনরাত্রি কবিতা পাঠের আসরের পর তিনদিন বাদ দিয়ে আবার কবিতা পাঠের ব্যবস্থা শনিবার দুপুরে সেন্ট্রাল পার্কে। দৈত্যাকার নিউ ইয়র্ক শহরের ফুসফুস এই সেন্ট্রাল পার্ক। আমাদের কলকাতার ময়দানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, তবে অনেকগুণ বড় এবং ভেতরে নানারকম উদ্যান ও জলাশয় রয়েছে। মুক্তাঙ্গনে কবিতাপাঠ এদেশে অভিনব, এই আইডিয়াটিও অ্যালেনের।

শনিবারের দুপুরটি চমৎকার। ঝলমল করছে রোদ, শীত কমে গেছে। এ দেশে সবাই এমন দিনের জন্য মুখিয়ে থাকে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। আজকের কবিতাপাঠ পুরোপুরি ভারতীয় কবিদের। এমন দিনটিতে কিন্তু শ্রোতার সংখ্যা আশানুরূপ নয়। এসব উপভোগ্য দিনে কার আর কবিতা শোনার দায় পড়েছে। আজ শ্রোতাদের মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যাই বেশি, বিদেশি বলতে অবশ্যই ভারতীয়, তাদের মধেও বেশ কিছু সুন্দরী বঙ্গললনাদের দেখতে পাওয়া গেল। আর কিছু আমেরিকান এসেছেন, যাঁদের সঙ্গে ভারতের কিছু না কিছু যোগাযোগ আছে, নানা কাজে ভারতে গেছেন, কেউ কেউ বাংলা বাহিন্দিও জানেন।

প্রথমে পার্ক সমূহের পরিচালক আমাদের প্রতি স্বাগত ভাষণ দিলেন। অ্যালেনের পরিচয় জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, অ্যালেন গিনসবার্গ এযুগের ওয়াল্ট হুইটম্যান!

অ্যালেনের আজ নিজস্ব কবিতা পাঠ নেই, সে শুধু আমার অনুবাদগুলি পড়বে। তার আগে সেও আমাদের স্বাগত জানাল চমকপ্রদ উপায়ে। সঙ্গে রয়েছে সেই ছোট হারমোনিয়ামটি, সেটি বাজাতে বাজাতে সে একটি গান জুড়ে দিল। তার ভাষা অনেকটা এইরকম–

মার্কিন দেশ সারা দুনিয়ায়
পাঠায় অস্ত্র এবং খাদ্য
অস্ত্রই বেশি খাবার দু-মুঠো
যদিও রয়েছে অনেক সাধ্য…
ভারতবর্ষ থেকে এসেছেন
বন্ধুরা, কিছু শোনাবেন আজ
ক্রোধের কবিতা, প্রেমের কবিতা,
ইতিহাসে মেশা মায়া কারুকাজ…

লম্বা গানটি শেষ করার পর প্রচুর হাততালি পড়ল। আমি অ্যালেনকে জিগ্যেস করলুম, তুমি কি গানটি আগে থেকে বানিয়েছিলে? অ্যালেন হেসে বলল, না এই মাত্র বানালুম। শুকনো বক্তৃতার থেকে গান ভালো না? কোথাও কিছু বলবার থাকলে আমি আজকাল গান গেয়ে বলি, আগে থেকে কিছু ভাবি না, যা মনে আসে, প্রথম লাইনটি গাইতে গাইতেই দ্বিতীয় লাইনেই মিল ঠিক এসে যায়। আমার বৌদ্ধ গুরু শিখিয়েছেন যে স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে যা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে সেইটাই খাঁটি।

এদিনের কবিতা পাঠে অংশ নিলেন মোট ছ’জন। সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য হল দুজনের। নবনীতা আগের দিনের মতনই তার সহাস্য উপস্থিতিতে কবিতাগুলি পড়তে-পড়তে শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে মুগ্ধ করে দিলেন সকলকে। আর শেষ কবি ছিলেন গোপালকৃষ্ণ আদিগা, তিনি প্রবীণ মানুষ, তাঁর কবিতাগুলিও দীর্ঘ, অনুষ্ঠান বেশ দেরিতে শুরু হওয়ায় তিনি যখন কবিতা পড়তে এলেন তখন বিকাল গড়িয়ে এসেছে, শ্রোত-দর্শক কম। কবিতা পাঠের সময় তাঁর তন্ময়তা সত্যি দেখবার মতন! যারা চলে গেল, তারা বঞ্চিত হল।

নিউইয়র্ক ছেড়ে আমাদের দলটি বেরিয়ে পড়ল অন্যান্য শহর সফরে। দুটি গাড়িতে যাত্রা, সদস্য সংখ্যা মোট ন’জন, শ্রীযুক্ত আদিগা তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে এনেছেন, এবং কমিটি ফর ইন্টারন্যাশন্যাল পোয়েট্রির দু’জন প্রতিনিধি মার্ক নেসডর এবং জো সুলেমান নামে একজন প্রাক্তন টার্কিস যুবক, ওই দু’জনই গাড়ির চালক। ঢাউস গাড়ি, জায়গার কোনও অকুলান নেই। আমাদের প্রথম গন্তব্য বলটিমোর, প্রায় চার ঘণ্টার পথ।

এইসব দেশের হাইওয়েগুলি অত্যন্ত একঘেয়ে। এমনভাবে তৈরি করা যাতে কোনও শহরের বিন্দুবিসর্গও চোখে না পড়ে, শহরগুলির নাম দেখা যায় শুধু ট্রাফিক সাইনে। দুপাশে শুধু মাঠ বা জঙ্গল, গাড়ির গতি পঞ্চান্ন মাইলে বাঁধা, দৃশ্যবৈচিত্র্য নেই বলে খানিকবাদে ঘুম পেয়ে যায়, কিন্তু গাড়ির ড্রাইভারেরও যাতে ঘুম না আসে সে চিন্তাও মাথায় থাকে!

বলটিমোরে আমরা উঠলুম একটি নিরিবিলি ছোট হোটেলে, যার লিফটখানা বোধহয় সিভিল ওয়ারের আমলের। বৃদ্ধ মালিকটির সৌজন্য খুব আন্তরিক মনে হয়। এখানকার তরুণ-তরুণী কবিরা অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য, এঁরা আমাদের কবিতার অনুবাদগুলি পড়বেন। কবিতার মধ্যে বিভিন্ন স্থানের উল্লেখ কিংবা ভারতীয় নামের উচ্চারণ নিয়ে খানিকটা আলোচনা হল। আমার একটি কবিতার মধ্যে, ময়দান, চৌরঙ্গি, বড়বাজার এইসব শব্দ ছিল, সেগুলির উচ্চারণ বুঝতে আমার অনুবাদ-পাঠকের বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। অ্যালেন গিনসবার্গের সে অসুবিধে হয়নি, কারণ সে কলকাতা এসে অনেকদিন থেকে গেছে। এই যুবকটি দিনের বেলা একটি গাড়ি-কোম্পানিতে সেলসম্যানের কাজ করে, রাত্তিরবেলা কবিতা লেখে ও একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনায় সাহায্য করে। উর্দু কবিতার অনুবাদ পাঠ করবে একটি কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী, সে স্কুল-শিক্ষিকার কাজ করে। অন্যান্যদের সঙ্গেও মৃদু আলাপ হল।

এখানে অনুষ্ঠান হবে দুদিন, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে। এখানকার ভারতীয়দের একটি প্রতিষ্ঠান এর সহ-উদ্যোক্তা। দর্শকদের মধ্যেও ভারতীয়দের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি। চেনাশুনো কিছু বাঙালির সঙ্গে দেখা হল, তাদের মধ্যে রয়েছেন রমেন পাইন ও তাঁর স্ত্রী জুলি। ওঁরা এসেছেন একশো মাইলের ওপর গাড়ি চালিয়ে। আমার কবিতা পাঠ প্রথম দিনেই, তা শেষ হওয়ার পরই রমেন ও জুলি ধরে নিয়ে গেলেন তাঁদের বাড়িতে, রাত বারোটার পর সেখানে পৌঁছে প্রায় শেষ রাত্তির পর্যন্ত আড্ডা হল।

আমেরিকায় ভারত উৎসব হচ্ছে দেড় বছর ধরে, বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন সময়ে। তবে ভারত সরকারের পক্ষে অন্য দেশে, বিশেষ করে মার্কিন দেশের মতন খরচ সাপেক্ষ দেশের নানান শহরে অনুষ্ঠান-উৎসব-প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা দুঃসাধ্য সেইজন্য আমেরিকার বিভিন্ন সমিতি, মিউজিয়াম ও অন্যান্য বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে হয়েছে। কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানগুলির দায়িত্ব নিয়েছে কমিটি ফর ইন্টারন্যাশন্যাল পোয়েট্রি, কিন্তু তাদের বেশি টাকা নেই, সুতরাং তারাও সহযোগিতার জন্য আবেদন জানিয়েছিল নানান শহরের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে। কবিতার ব্যাপার সবাই সাড়া দেয় না। বলটিমোরের পাশেই আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সি, সেখানে ভারতীয় কবিতা পাঠের কোনও ব্যবস্থা হয়নি। শিকাগো কিংবা সানফ্রান্সিসকোর মতন বড় শহর থেকেও কোনও ডাক আসেনি। আবার নেমন্তন্ন এসেছে কয়েকটি অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে। যেমন নিউ মেক্সিকোর সান্টা ফে। আমাদের পরবর্তী আসর সেখানে।

আমেরিকার এক প্রান্তবর্তী রাজ্য নিউ মেক্সিকোর রাজধানী আলবুকার্কি, সেখান থেকে ষাট সত্তর মাইল দূরে সান্টা ফে শহর। শহরটি ছোট, কিন্তু উচ্চাঙ্গের নিসর্গচিত্রের মতন সুন্দর। এখানে আমি আগে কখনও আসিনি।

বলটিমোর থেকে আমরা আলবুকার্কি এলাম বিমানে। আমেরিকার মধ্যে এক শহর থেকে অন্য শহরে বিমান যাত্রা এখন বেশ মজার হয়েছে। অনেকগুলি বেসরকারি বিমান কোম্পানি পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মত্ত। সেই জন্য তারা পাল্লা দিয়ে ভাড়াও কমাচ্ছে। অনেক সস্তার ফ্লাইটের নাম হয়েছে পিপলস এক্সপ্রেস। আগে থেকে টিকিট ফিকিট কাটার দরকার নেই। ফ্লাইটের দশ-পনেরো মিনিট আগে বিমান বন্দরে এসে টিকিট কেটে চড়ে বসলেই হয়। এমনকী এক মিনিট আগে এসে, টিকিট না কেটেও দৌড়ে এসে উঠে পড়া যায়। মাঝপথে ভাড়া নিয়ে নেবে। বিমানযাত্রা ব্যাপারটা এরা প্রায় জল-ভাত করে ফেলেছে।

আলবুকার্কি শহরে আমাদের অভ্যর্থনার জন্য বিরাট কোনও দল ছিল না, ছিল একটিমাত্র রোগা-পাতলা, প্যান্ট-শার্ট পরা নিরীহ চেহারার, লাজুক-লাজুক তরুণী। তার নাম লিন্ডা। সেই মেয়েটি যে একাই একশো তা বুঝেছিলুম কিছু পরে।

লিন্ডা আমাদের জন্য একটা পেল্লায় স্টেশান-ওয়াগান ভাড়া করে রেখেছে এবং সে সঙ্গে এনেছে তার নিজস্ব একটি ছোট ট্রাক। তার ট্রাকে চাপানো হল আমাদের মালপত্র, যাত্রীরা চাপল স্টেশান ওয়াগনটিতে। লিন্ডা আগে আগে তার ট্রাক চালিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।

পথে যেতে-যেতে দেকা যায় দূরের পাহাড়। আমরা এসে পড়েছি রকি মাউন্টেনের এলাকায়। এক জায়গায় দেখি লেখা আছে যে পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রাম লাইন এই দিকে। এখানে ট্রাম লাইন? আমাদের সারথিকে প্রশ্ন করে জানা গেল যে, এই ট্রাম চলে শূন্যপথে, অর্থাৎ আমরা যাকে রোপওয়ে বলি, সেইরকম ঝোলানো ডুলি বসানো রোপওয়ে চলে গেছে পাহাড়ের ওপর দিয়ে।

আমরাও যে ক্রমশ উঁচু দিয়ে উঠছি তা বোঝা যায় একটু একটু শীতে। সান্টা ফে শহরটির উচ্চতা প্রায় সাত হাজার ফিট, অর্থাৎ দার্জিলিং-এর চেয়েও উঁচুতে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তেমন ঠান্ডা নেই।

এই শহরে আমাদের থাকার জায়গাটি এতই সুন্দর যে অবিশ্বাস্য মনে হয়। ঠিক যেন সিনেমা-সিনেমা। একটা টিলার ওপরে অনেকগুলি বাড়ির গুচ্ছ, একে হোটেলও বলা যায়, হোটেলের মতন নয়ও। এগুলির নাম কনডিমিনিয়াম। প্রত্যেকটি স্বয়ং সম্পূর্ণ আলাদা বাড়ি, একতলায় সুসজ্জিত বসবার ঘর, দোতলায় দুটি শয়নকক্ষ, সংলগ্ন দু’টি বাথরুম। রান্নাঘরে বৈদ্যুতিক উনুনের পাশে অতি আধুনিক মাইক্রো ওয়েভ যন্ত্রও রয়েছে। ওপরের তাকে সাজানো রয়েছে সাতরকম চা, তিনরকম কফি, দুরকম চিনি, দুরকম দুধ, কয়েকরকম বিস্কুট এবং অনেক রকম মশলা। কেউ এখানে সপরিবারে ছুটি কাটাতে এসে সাতদিন, দশদিন, এক মাসও থেকে যেতে পারে। খরচ নিশ্চয়ই সাংঘাতিক। বসবার ঘরের আসবাবগুলি পুরোনো-পুরোনো, মস্ত বড় সোফা, নড়বড়ে কাঠের আলমারি, পোর্সিলিনের অ্যাশট্রে, দেখলেই বোঝা যায় এগুলি অ্যান্টিক, অর্থাৎ খুব দামি। আমাদের প্রত্যেকের জন্য এরকম এক একটি বাড়ি, কোনও লোকজন নেই, দরজায় চাবি নেই, দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম, তারপর সব কিছু নিজস্ব।

পরে জেনেছিলুম, ওই লিন্ডা নামের রোগা টিংটিংয়ে মেয়েটি এই কনডিমিনিয়াদের মালিকের কাছে কবিতার নাম করে বুঝিয়েসুঝিয়ে এগুলি আমাদের জন্য বিনা পয়সায় আদায় করেছে।

সান্টা ফের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালিকা এই লিন্ডা থর্প। লোকের কাছে চেয়েচিন্তে, চাঁদা তুলে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে। অনেকখানি জমির ওপরে বাড়ি, ভেতরে রয়েছে মাঝারি আকারের একটি রঙ্গমঞ্চ ও দোতলা প্রদর্শনী কক্ষ। এখানে নিয়মিত কবিতা পাঠ, সাহিত্য আলোচনা, পরীক্ষামূলক নাটক, ছবি ও ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী হয় নিয়মিত, লিন্ডার সহকারী রয়েছে তিন-চারটি ছেলেমেয়ে। তরুণ লেখক-শিল্পী-নাট্যকর্মীরা প্রায়ই আসে এখানে আড্ডা জমাতে। এখানে আমাদের কবিতা পাঠের আসরে ভারতীয় শ্রোতার সংখ্যা নগণ্য। তিন চারজনের বেশি নয়, বাকি সবাই আমেরিকান, তারা প্রায় সকলেই লেখা বা অনুবাদের ব্যাপারে জড়িত। এখানে একজনও বাঙালি দেখিনি। সান্টা ফে-ই একমাত্র আমেরিকান শহর যেখানে কোনও বাঙালির সঙ্গে আমার পরিচয় হল না। যদিও আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর এমন কোনও জায়গা থাকতে পারে না, যেখানে বাঙালি নেই।

সান্টা ফে শহরটি দৃশ্যতই অন্যান্য শহরের থেকে আলাদা। অধিকাংশ বাড়ির সামনেই উঁচু মাটির দেয়াল, সেই মাটি গেরুয়া রঙের। কোনও-কোনও বাড়ির সামনের বাগানে কঞ্চির বেড়া। এসবই পুরোনো স্প্যানিশ কায়দা। বাড়িগুলির মধ্যে আধুনিকতম আরামের ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতি সবই রয়েছে। এগুলিকে অ্যাডোবি স্টাইলের বাড়ি বলে, বেশ খরচসাধ্য ব্যাপার, যদিও হঠাৎ যেন আমাদের রাঁচি-হাজারিবাগের কিছু কিছু বাড়ির সঙ্গে মিল খুঁজে পাই।

শহরটি ছোট, কেন্দ্রীয় বাজারের ফুটপাথে এখানকার ইন্ডিয়ানরা পশরা সাজিয়ে বসে থাকে, নানারকম পাথরের মালা, অলঙ্কার, পুতুল ও জামা-কাপড়। দর করতে গিয়ে দেখি আগুন দাম, দার্জিলিং-এ যেরকম ঝুটো পাথর পাওয়া যায়, সেইরকম একটি মালার দাম হাজার টাকা। এসবই বড়লোক টুরিস্ট-ভোগ্য জিনিস।

কাছাকাছি পঞ্চাশ-একশো মাইলের আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের রিজার্ভ আছে। একদিন সকালে সেদিকে বেরিয়ে পড়া গেল সদলবলে। সুন্দর পাহাড়ি পথ, পাশ দিয়ে দিয়ে একটি নদী চলেছে, সেই নদীটিই ঢুকে গেছে মেক্সিকোতে। এখানেই ব্রিটিশ লেখক ডি এইচ লরেন্সের একটি র্যাঞ্চ আছে। লরেন্সের এক আমেরিকান প্রেমিকা তাঁকে এই র্যাঞ্চটি উপহার দিয়েছিল। অঞ্চটি এখনও লরেন্সের নামেই আছে, যদিও বর্তমানে সেটির মালিকানা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের।

আমরা প্রথমে রওনা দিলুম সেদিকে। পথের দুপাশে আরও অনেক র্যাঞ্চ পড়ল, দৃশ্যগুলি খুব পরিচিত মনে হয়। জন ওয়েন, গ্যারি কুপার অভিনীত অনেক ওয়েস্টার্ন ছবিতে আমরা এইসব দৃশ্য দেখেছি। শোনা গেল সত্যিই অনেক ওয়েস্টার্ন ছবির শুটিং হয়েছে এখানে।

লরেন্সের অঞ্চটি আহামরি কিছু নয়। এখনও সেখানে পশু পালন ও চাষবাস চলছে, কিন্তু বিস্ময়কর লাগল লরেন্সের সমাধি মন্দির দেখে। লরেন্সের মৃত্যু হয় প্যারিসে, কিন্তু কবর দেওয়ার বদলে তাকে পোড়ানো হয়েছিল, তাঁর ছাই এনে রাখা হয়েছে এখানে, তার ওপরে মন্দিরের মতন একটা ঘর বানানো হয়েছে। লরেন্সের এই স্মৃতি-মন্দিরের অস্তিত্বের কথা আমার জানা ছিল না। ফারুকি এবং অশোক বাজপেয়ী দুজনেই লরেন্সের খুব ভক্ত, মাঝে-মাঝেই লরেন্সের কবিতার লাইন বলতে লাগল।

সেখান থেকে ফেরার পথে আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের রিজার্ভ দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে লিন্ডা খুঁতখুঁত করতে লাগল। সে মৃদু স্বরে কথা বলে, টুরিস্টরা দলে-দলে গিয়ে ওদের বিরক্ত করে। এই ব্যাপারটা লিন্ডার পছন্দ নয়। ওরা কি চিড়িয়াখানার জীবজন্তু? আমি সঙ্গে-সঙ্গে লিন্ডার সঙ্গে একমত হলাম। এইভাবে গাঁকগাঁক করে গাড়ি হাঁকিয়ে আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে উৎপাত করা অত্যন্ত অরুচিকর। সুতরাং সেদিকে না গিয়ে আমরা পথের পাশে একটি ছোট শহরে মধ্যাহ্ন ভোজন করে অলসভাবে পায়ে হেঁটে ঘুরে খানিকটা সময় কাটিয়ে দিলাম।

সান্টা ফে-তে পৌঁছেই শুনেছিলাম এখানে একটি ভারতীয় দম্পতি আমাদের অগ্রিম নৈশভোজের নেমন্তন্ন করে রেখেছেন। দুই সন্ধ্যার কবিতাপাঠের আসরে কিন্তু সেই দম্পতির একজনেরও দেখা পাইনি। এইরকম নেমন্তন্ন গ্রহণ করতে আমার দ্বিধা লাগে। কিন্তু সকলেই যাচ্ছে বলে আমাকেও যেতে হল। উপস্থিত হয়ে দেখলাম, তারা বিচিত্র ভারতীয়। ভদ্রমহিলাটি আফগানিস্তানের মেয়ে, তবে বেশ কয়েক বছর দিল্লিতে থেকে নাচ শিখেছেন, এখানে ভারতীয় নাচের ইস্কুল খুলেছেন। স্বামীটি পুরো দস্তুর আমেরিকান, যদিও সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, পায়ে কোলাপুরি চটি, সে সেতার বাজায়, ভারতে অনেকবার এসেছে, কলকাতায় থেকে গেছে এক বছর, কিছুদিন নিখিল ব্যানার্জির কাছে নাড়া বেঁধেছিল। স্ত্রীর তুলনায় স্বামীটিকে অনেক কমবয়স্ক মনে হয়। এই যুবকটির মতন এমন বুদ্ধিদীপ্ত ও অহংকারী মুখ আমি কমই দেখেছি। আমি এখন তার বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকছি, আমাদের নাম শুনেই সে বলে দিতে লাগল আমরা কে কোন ভাষায় লিখি। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে সে পুরো বাক্যটি শেষ করতে দেয় না, মাঝপথেই বুঝে নিয়ে সে টক করে উত্তর দিয়ে দেয়। এরকম লোকের সঙ্গে কথা চালানো মুশকিল। অবশ্য সে কীরকম সেতার বাজায় তা জানা গেল না।

এ বাড়িতে খাবারের ব্যবস্থা অভিনব। প্রথমে সুরা পরিবেশন করা হল আমেরিকান কায়দায়, কিন্তু ডিনারের স্টাইলটি সম্ভবত আফগানি। ডাইনিং রুমের দরজার কাছে ওই দম্পতির একমাত্র কন্যা, ষোলো-সতেরো বছর বয়েস বয়েস, তার হাতে একটি জলের ঝারি ও তোয়ালে। সে প্রতিটি অতিথির হাত ধুইয়ে-মুছিয়ে দিচ্ছে। ঘরে কোনও চেয়ার টেবিল নেই। কার্পেটের ওপর বড় বড় পেতলের পরাত, তার কোনওটাতে বিরিয়ানি-গোস্ত, কোনওটাতে রুটি, স্যালাড, আচার ইত্যাদি। প্রত্যেকের হাতে একটি করে প্লেট তুলে দেওয়া হল, কাঁটা-চামচের কোনও বালাই নেই, ওইসব পরাত থেকে যার যা ইচ্ছে খাবার তুলে খেতে হবে, দ্বিতীয়বার তুলতে হলে এঁটো হাতেই চলবে। এই ব্যবস্থায় আমাদের কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু সাহেব-মেমদের কারুর হাত দিয়ে খেতে গিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়তে হল। আমার পাশেই একজন একজন দীর্ঘকায় প্রবীণ ব্যক্তি বসেছিলেন, তিনি একজন খ্যাতনামা অনুবাদক, বললেন, কী আশ্চর্য কথা, আমরা কাঁটা-চামচে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এমনকী চাইনিজদের মতন চপস্টিক দিয়েও খেতে পারি, কিন্তু হাত দিয়ে খেতে ভুলে গেছি।

আমি ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে, মনে-মনে বললুম, ন্যাকামি! আমাদের প্র পূর্বপুরুষ বাঁদরদের অনেক দোষ-গুণ এখনও আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে, এমনকী সাহেবদের মধ্যেও রয়েছে, শুধু হাত দিয়ে খাওয়াটাই ওরা ভুলে গেছে, তা কি বিশ্বাসযোগ্য?

সান্টা ফে ছাড়ার সময় মনে হল, এই শহরটিতে আরও দু-চারদিন থেকে যেতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু উপায় নেই। এর পরেই থেকে যেতে হবে লস এঞ্জেলিসে। আবার প্লেন ধরতে হবে।

রকি পর্বতমালার ওপর দিকে উড়ে আমরা লস এঞ্জেলিসে এসে পৌঁছলুম বিকেলের দিকে। আমাদের জন্য হিলটন হোটেলে জায়গা ঠিক করা আছে, কাছেই দক্ষিণ ক্যালিফের্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়ানো ক্যাম্পাস। সারা সন্ধে কিছুই করার নেই, ঘরে বসে টিভি দেখা ছাড়া।

আমাদের দলের বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্য শ্রীযুক্ত আদিগা এত ঘোরাঘুরিতে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তা ছাড়া দক্ষিণ ভারতীয় খাবার ছাড়া অন্যকিছু তাঁর মুখে রোচে না। তাঁর স্ত্রী হয় ইংরিজি জানেন না অথবা খুবই লাজুক, তাঁর মুখ দিয়ে আমরা একটা-দুটোর বেশি শব্দ শুনিনি। আদিগা এক সময় ইংরিজির অধ্যাপক ছিলেন, একটি কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে রিটায়ার করেছেন। এমনিতে বেশ রসিক মানুষ, কিন্তু উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে কাতর হয়ে আছেন বলে তাঁকে আড্ডায় পাওয়া যায় না।

অশোক বাজপেয়ীর সঙ্গে ভারত সরকারের কয়েকজন কর্মচারী দেখা করতে এল, তারপর ওরা একসঙ্গে কোথায় যেন গেল, অরুণ কোলাটকর গেল ওদের সঙ্গে। শামসুর রহমান। ফারুকিও পেশায় রাজ কর্মচারী, আই এ এস, ভারত সরকারের কোনও দফতরের যুগ্ম সচিব, তার স্বভাবটি ঠিক আড্ডাবাজ ধরনের নয়, সে গেছে তাদের সঙ্গে দেখা করতে।

বাকি রইল কেদারনাথ সিং। তার জীবিকা যদিও অধ্যাপনা, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি পড়ায়, কিন্তু মানুষটি লাজুক প্রকৃতির, এই প্রথম তার বিদেশ সফর। একা একা সে রাস্তায় বেরুতে চায় না, তা ছাড়া কে যেন আগে থেকেই তাকে সাবধান করে দিয়েছে যে লস এঞ্জেলিসের পথেঘাটে গুন্ডা ঘুরে বেড়ায়, সন্ধের পর মোটেই নিরাপদ নয়।

এই হোটেলের ব্যবস্থাপনা এমনিতে ভালো হলেও, এখানে এখন আংশিক ধর্মঘট চলছে, তাই ঘরে বসে এক কাপ কফি পাওয়ারও উপায় নেই। কেদারনাথ বলল, খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কাছাকাছি কোথাও কি হেঁটে যাওয়া যেতে পারে? ভয়ের কিছু আছে? তুমি তো আগে এসেছ, তুমি এখানকার রাস্তা চেনো, একটু যাবে আমার সঙ্গে?

আমি লস এঞ্জেলিসে আগে দুবার এসেছি বটে কিন্তু এখানকার রাস্তা চিনি না, এই প্রকাণ্ড শহরের দিশে পাওয়া খুব শক্ত। তবে খানিকটা হেঁটে আসা যেতে পারে।

কেদার জিগ্যেস করল, এখানকার রাস্তা দিয়ে হাঁটা নিরাপদ তো?

আমি হেসে বললুম, তা বলে কি সব সময় ছুরি মারামারি হচ্ছে?

কলকাতা-দিল্লির রাস্তায় কি গুন্ডামি হয় না? এখানে তার চেয়ে একটু বেশি হয় হয়তো! রাস্তা যথারীতি পথচারী বর্জিত। চলন্ত গাড়ি ছাড়া মানুষের মুখ দেখা যায় না। শন শন করে বইছে ঠান্ডা হাওয়া, বেড়াবার পক্ষে সময়টা তেমন উপযোগী নয়। খানিক দূর গিয়েই ফিরতে হল। ফেরার পথে এক রাস্তার মোড়ে দুটি লোক হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে উঠে এসে ভুরু নাচিয়ে জিগ্যেস করল, লাগবে? লাগবে?

আমি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাতে তারা খুব অবাক। কোকেন বা গাঁজার অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য ছাড়া দুটি ব্যাটাছেলে শুধু শুধু রাস্তা দিয়ে হাঁটছে কেন?

এর পরে একটা কফির দোকানে বসে সময় কাটানো গেল কিছুক্ষণ। সেই দোকানে ভাত পাওয়া যায় শুনে কেদার খুব খুশি। সে নিরামিষ খায়, ম্লেচ্ছ খাদ্যে তার খুব অসুবিধে।

পরের দিন আবহাওয়া খুব ভালো হয়ে গেল। ঝকঝকে রোদ, শীতের চিহ্নমাত্র নেই। এমন দিনে সাহেব-মেমরা বাইরে বেরিয়ে পড়ে, সমুদ্রের ধারে গিয়ে শুয়ে থাকে, সেইজন্যই বোধহয় সন্ধেবেলা কবিতা পাঠের আসরে আশানুরূপ শ্রোতা হল না। কিন্তু ছোট আসরে কবিতা পাঠ বেশ জমে গেল।

সে রাত্রে আমার আর হোটেলে ফেরা হল না, একশো মাইল দূর থেকে এসেছে ডাক্তার মদন মুখোপাধ্যায় ও তার স্ত্রী ডলি, তাদের সঙ্গে চলে গেলুম বেকারস ফিলডে। মদন মুখোপাধ্যায় এদেশে আছে অনেকদিন, প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, এমন ভদ্র ও সজ্জন খুব কম দেখা যায়। তার স্ত্রী ডলিও যেমন হাসিখুশি, তেমনই কাজের মেয়ে ও অতিথিপরায়ণ, এই চমক্কার দম্পতির বাড়িতে আমি আগেও এসে থেকে গেছি।

লস এঞ্জেলিসে দ্রষ্টব্য জিনিস বহু আছে, কিন্তু আমার সেদিকে মন ছিল না। এখানে দ্বিতীয় দিনটা সারাদিনই ফাঁকা পাওয়া গিয়েছিল, আমাদের দলের অন্য কবিরা বেড়াতে গেলো, আমি রয়ে গেলুম হোটেলে, আমার মাথায় ধারাবাহিক উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিমের’ ইনস্টলমেন্ট লেখার চিন্তা। না পাঠাতে পারলে সম্পাদকের কাছে বকুনি খেতে হবে। বেড়াতে না গিয়ে আমি হোটেলে বসে বসে উপন্যাসের কিস্তি লিখব শুনে অন্যান্য কবিরা অবাক। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি কাগজ কলম নিয়ে বসে, মনটাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলুম দুই বাংলায়।

সুতরাং মদনের বাড়ি গেলুম বেশ হালকা মনে, লেখা শেষ হয়ে গেছে। মদন নিজেও দেশ পত্রিকায় নিয়মিত লেখে, ওর ওপরেই ভার দিলুম আমার লেখা ডাকে পাঠাবার। তারপর ওর সঙ্গে বেড়াতে গেলাম পাহাড়ে। সেখানে তার একটি শৈলাবাস আছে, যেটি সারা বছর প্রায় খালিই পড়ে থাকে।

মদন ও ডলি আমাকে লস এঞ্জেলিসে ফিরিয়ে নিয়ে এল সরাসরি এক রেস্তোরাঁয়। এটির নাম ইচি ফুট, এখানে মধ্যাহ্নভোজের সঙ্গে কবিতা পাঠের ব্যবস্থা রয়েছে। শ্রোতারা টিকিট কেটে এসেছে, ভোজন ও কবিতা শ্রবণ একসঙ্গে। আধুনিক ভারতীয় কবিতা সম্পর্কে প্রত্যেককে কিছু বলার জন্যও অনুরোধ। কিন্তু এখানে, কবিতা পড়তে বা কিছু বলতে আমার মন লাগল না। অনেকটা দায়সারাভাবে চুকিয়ে দিলুম, কেন যেন মনে হচ্ছিল, শ্রোতাদের আগ্রহ কম।

বোলডারে আমাদের আলাদা-আলাদা থাকার ব্যবস্থা, বব রোজেনথাল আমাকে আগেই বলে রেখেছিল যে একটি বাঙালি পরিবার আমাকে রাখতে আগ্রহী। ওখানে পৌঁছবার খানিকটা আগে শুনলুম, সেই বাঙালিটির নাম শুভেন্দু দত্ত। আমি চমৎকৃত ও খুশি। শুভেন্দু আমার ছাত্র বয়সের বন্ধু, বহুদিন দেখা নেই তার সঙ্গে, এখন সে এদেশের খ্যাতিমান অধ্যাপক, সাহেবদের ইঞ্জিনিয়ারিং শেখায়! তার সঙ্গে এরকম অকস্মাৎ যোগাযোগ সত্যি আনন্দের ব্যাপার। শুভেন্দুর এক শ্যালিকাও আফ্রিকা থেকে এ বাড়িতে অতিথি হয়ে আছে। বিশাখা ও বিপাশা নাম্নী দুই তরুণীর সাহচর্যে যেন চোখের নিমেষে কেটে গেল দুটি দিন।

শুভেন্দুদের বাড়িটি পাহাড়ের গায়ে। হিমালয় বেড়াতে গেলে আমরা যেরকম ডাকবাংলোতে থাকি, সেইরকম মনোহর পরিবেশে ওদের বাড়ি। শুভেন্দু আবার একদিন আমাকে নিয়ে গেল কলোরাডোর বিখ্যাত অরণ্যপর্বত নিসর্গ দেখাবার জন্য। সে দৃশ্য বর্ণনা করবার জায়গা এটা নয়। তবে একটা বিস্ময়ের কথা বলতেই হয়। তুষার-ঢাকা এক একটা পাহাড় চূড়ার দিকে এগোতে এগোতে ক্রমশ উঠে গেলাম এগারো হাজার ফিট উচ্চতায়। এত উঁচুতে হাইওয়ে রয়েছে, দুপাশে জমাট বরফের দেয়াল। গাড়ি থেকে নেমে ঘোরাঘুরি করলুম, বরফের গায়ে হাত রাখলুম, আমার গায়ে শুধু একটা হাফ শার্ট, অথচ শীত করল না! এটা কীরকম ভৌগোলিক ধাঁধা কে জানে!

বোলডারে এসে আবার দেখা পেলুম অ্যালেন গিনসবার্গের।

এখানে নরোপা ইনস্টিটিউট নামে একটি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান আছে। সংস্কৃতি কেন্দ্র বলা যায়, যেখানে রয়েছে আধুনিক, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন একটি বৌদ্ধ গুম্ভা, ধ্যান ও যোগ সাধনার ছোট ছোট কক্ষ, বৌদ্ধ দর্শন এবং সাহিত্য শিল্প শিক্ষার ব্যবস্থা। অ্যালেন এই প্রতিষ্ঠানের শিষ্যও বটে, গুরুও বটে। এখানে সে সন্ধান পেয়েছে তার গুরুর, এখানে যে যোগ ও দর্শনের পাঠ নিয়েছে আবার অনেক বছর ধরে এখানে সাহিত্য পড়িয়েছে। এই জুনে তার শিক্ষকতা শেষ হল, এর পরে সে ব্রুকলিন কলেজে সম্মানিত অতিথি অধ্যাপকের পদ পাচ্ছে।

এই নরোপা ইনস্টিটিউট-ই আমাদের কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ জানিয়েছে কলোরাডোতে। দিনের বেলা অ্যালেন নিজেই আমাদের সমস্ত প্রতিষ্ঠানটি ঘুরিয়ে দেখাল। বৌদ্ধ গুস্তাটিতে আমি কয়েকটি বাঁধানো ফটোগ্রাফ দেখলাম, এর আগে আর কোনও গুস্তায় আমি তা দেখিনি। প্রত্যেক গুম্ভাতেই অনেক পাণ্ডুলিপি থাকে, আমার ধারণা হল, কিছুদিন পর পাণ্ডুলিপির জেরক্স কপিও দেখতে পাব। ধ্যান কক্ষগুলি কোনওটি গোলাপি, কোনওটি নীল, কোনওটি বাদামি রঙের। এক এক রকম মানসিক অবস্থার জন্য এক এক রঙের কক্ষ নির্দিষ্ট। একটি ক্লাসরুমে দেখলুম, রীতিমতন সংস্কৃত ভাষা শেখানো হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রী সাত-আট জন। ব্ল্যাক বোর্ডে লেখা অক্ষরগুলি আমি একবর্ণ বুঝতে পারলুম না, কারণ, এই সংস্কৃত দেবনাগরি হরফে নয়, তিব্বতি হরফে।

অ্যালেনের দৃষ্টান্তেই সম্ভবত সারাদেশ থেকে সাহিত্যমনস্ক অনেক তরুণ-তরুণী এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে আসে। কেউ কেউ বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে, কারুর কারুর পোশাক ও চুল পাংকদের মতন। আমেরিকার ছেলেমেয়েরা যখন যে-জিনিসটা ধরে, তখন গভীরভাবে ধরে। একটি বাড়ির সবুজ ঘাস ভরা লনে মনোরম রোদ্দুরে মধ্যাহ্নভোজের সময় একটি আন্দাজ বছর তিরিশেক বয়েসের যুবক কবি অ্যালেনের সঙ্গে তিব্বতি দর্শন ও সিদ্ধাচার্যদের বিষয়ে আলোচনা জুড়ে দিয়েছিল। আমি তিব্বতী দর্শন বিষয়ে কিছুই জানি না, চুপ করে শুনছিলুম, এক সময় নিছক কথার কথা হিসেবে সেই যুবকটিকে বললুম, জানো, এক সময় উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু বৌদ্ধ হিন্দুদের অত্যাচারে লুকিয়ে থেকে সাংকেতিক ভাষায় কিছু দোহা বা বা গান লিখেছিল…। আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে সে বলল, হ্যাঁ জানি চর্যাপদ তো? সান্ধ্য ভাষায় লেখা, লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ…। আমি যাকে বলে স্তম্ভিত!

এখানে কবিতা পাঠের আসর বেশ জমজমাট হল। শ্রোতাদের আগ্রহ ও অভিনিবেশে একটা পরিবেশ গড়ে ওঠে, তাতে কবিতার শব্দগুলি সঠিক সুরে বাজে। তখন মনে হয়, সব মিলিয়ে একজনই শ্রোতা।

ইংরিজি অনুবাদগুলি যিনি পাঠ করলেন তারাও সকলেই কবি। অ্যান ওয়াল্ডমান নামে এক বিদ্যুৎশিখাময়ী নারীর উৎসাহটি সবচেয়ে বেশি, এই নরোপা ইসস্টিটিউট যেন তারই রাজ্য। অ্যালেনের একটি কবিতা আছে এই মেয়েটিকে নিয়ে। সে কবিতা পাঠ করে প্রায় নাচের ভঙ্গিতে।

এখানেও অ্যালেন পড়ে দিল আমার কবিতার অনুবাদগুলি। অনুষ্ঠান শেষে অ্যালেন হেসে বলল, আমরা দু’জনে বেশ একটা টিম হয়ে গেছি, এইভাবে আমরা শহরে-শহরে ঘুরলে পারি!

বোলডার ছেড়ে যেতেও একটু একটু মনোকষ্ট হচ্ছিল। এমন সুন্দর জায়গায় আরও কয়েকটা দিন থাকতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমাদের যেন যাত্রা পার্টির মতন অবস্থা। যেতে হবে, যেতেই হবে। এখান থেকেই অ্যালেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম, এ যাত্রায় আর বোধহয় দেখা হবে না।

সাময়িকভাবে আমাদের ফিরে আসতে হল নিউ ইয়র্কে। আবার উলটোদিকে ফিরে আসতে হবে ডেট্রয়েটে। পুরো দলটির নেমন্তন্ন নেই, শুধু হিন্দি, মারাঠি ও বাংলার তিনজন এবং অশোক বাজপেয়ী তো আছেই।

একদিন পরেই আমরা চারজন ডেট্রয়েটে এসে পৌঁছলুম দুপুরের দিকে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা আমাদের নিয়ে আসা হল একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয়। এইসব রেস্তোরাঁর মালিক পাকিস্তানি বা বাংলাদেশিও হতে পারে। বিদেশে প্রাক্তন ভারতীয় উপমহাদেশের সবাই এখনও ভারতীয় হিসেবেও পরিচিত। এক্ষেত্রে দোকানটির মালিক বাংলাদেশি, একগাল হেসে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছেন, দাদা?

এই রেস্তোরাঁতেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিল তনুশ্রী ও প্রভাত দত্ত, এরা দুজনেই কবি। তনুশ্রী তার বিবাহ পূর্ব নাম তনুশ্রী ভট্টাচার্য নামেই লেখে, আর প্রভাত বিদেশে থেকেই প্রচুর নিষ্ঠার সঙ্গে ‘অতলান্তিক’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা বার করে আসছে অনেকদিন। ওরা এসেছে ওহায়োর কলম্বাস শহর থেকে, চার ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে কবিতা পাঠ শুনতে তো বটেই, তারপর আমাকে নিয়ে যাবে ওদের বাড়িতে।

ওদের এই প্রস্তাব শুনে অশোক বাজপেয়ী কৃত্রিম কোপের সঙ্গে বলে উঠল, এ কী ব্যাপার হচ্ছে, সুনীল? যেখানেই যাচ্ছি, যেখানেই একটি সুন্দরী মহিলা ও একজন ঝকঝকে পুরুষ এসে তোমাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। আমরা ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখি না বলেই কি আমাদের কেউ ডাকে না?

প্রভাতের কাছে ‘দেশ’ দু-একটি টাটকা সংখ্যা ছিল, সবাই আগ্রহের সঙ্গে দেখতে লাগল। সকলেই মত প্রকাশ করল যে ‘দেশ’-এর মতন পত্রিকা অন্যকোনও ভাষাতে নেই। কেদারনাথ সিং বাংলা পড়তে পারে, সে পাতা উলটে দেখে রায় দিল যে আমার উপন্যাসের ইনস্টলমেন্ট লেখার কাহিনিটি আজগুবি নয়।

ডেট্রয়েটের কবিতা পাঠের আসর অন্যান্য কয়েকটি জায়গার তুলনায় বেশ জমজমাট হল, বলটিমোর বা লস এঞ্জেলিসের তুলনায় তো অনেক সার্থক বটেই। আমেরিকার কোনও কবিতা পাঠের আসরেই ‘আর একটা পড়ুন’ বলে কেউ চ্যাঁচায় না। সব কিছুই পূর্বনির্দিষ্ট। তবে, এখানে কবিদের সংখ্যা কম বলে আমাদের বেশি করে কবিতা পড়তে হয়েছিল, বেশ রাত হয়ে যাওয়াতে শ্রোতারা কেউ উঠে গেল না তো!

মাধুরী হাজরা এখানকার অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা। তাঁর বাড়িতে রাত্রির নেমন্তন্ন এবং সেখানেই রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। প্রভাত-তনুশ্রীর ইচ্ছে রাত্তিরের নেমন্তন্ন খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ি মাঝ রাত্তিরে, তারপর সারারাতের ড্রাইভ। কিন্তু সেটা একটু বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। মাধুরী হাজরার স্বামী-পুত্র ছাড়াও তাঁর মা-বাবা, দেওর, ভাই-বোন সবাই কাছাকাছি থাকেন। আরও অনেকে এসেছেন, সব মিলিয়ে বিরাট হইচই, প্রচুর খাওয়াদাওয়া। রাত দুটোর সময় শুতে গিয়ে ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে পড়া।

পরের রাতে প্রভাত-তনুশ্রীদের বাড়িতেও আবার পার্টি। আবার রাত্রি জাগরণ। এক একটা শহরে বিছানা গরম হতে না হতেই আমি চলে যাচ্ছি অন্য শহরে। একদিন অন্তরই নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ। তার মধ্যে এই বাড়িতে এসেই অনেকটা কলকাতার ছোঁওয়া পাওয়া গেল। তনুশ্রীর বাবা, দুই ভাই, এক ভাইয়ের স্ত্রী সদ্য এসেছে কলকাতা থেকে, গায়ে এখনও কলকাতার গন্ধ লেগে আছে, তাঁদের দেখে আমার যেমন ভালো লাগল, তাঁরাও আমাকে বেশি বেশি যত্ন করতে লাগলেন। ব্যস্ততার জন্য আমাকে অবিলম্বে চলে যেতে হয়, যাওয়ার সময় মনে হয় আবার ফিরে আসব এমন সুন্দর জায়গায়।

আমাদের শেষ অনুষ্ঠান হার্ভার্ডে। দলের অন্যান্যরা আবার নিউ ইয়র্ক ছুঁয়ে আলাদাভাবে সেখানে চলে গেছে। আমাকে যেতে হল কলম্বাস থেকেই সোজা। বস্টন এয়ারপোর্টে একটি রোগা পাতলা যুবক এসে বলল, আমার নাম রাহুল রায়। আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন!

মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আবার অন্য পরিবেশ, অন্য মানুষ।

চার্লস নদীর একপাশে বস্টন অন্যপাশে কেম্ব্রিজ। রাহুলরা থাকে কেম্ব্রিজে। তার স্ত্রী চন্দ্রা ও একটি স্বাস্থ্যবান সুন্দর শিশুকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। তাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে সুটকেস খোলার আগেই তিনটি যুবক এসে হাজির হল।

নিউ ইয়র্কে থাকার সময় আমার হোটেলে একদিন তিন গৌতম আড্ডা মারতে এসেছিল, গৌতম রায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও গৌতম দত্ত। তিনজনই সুদর্শন, বুদ্ধিমান, চৌকোশ ও হাস্য পরিহাস প্রবণ। এদের মধ্যে গৌতম রায়ের ভালোনাম ডঃ কল্যাণ রায়, সে নিউইয়র্কের কোনও কলেজে ইংরিজি পড়ায়, তার লেখা ইংরিজি কবিতা ওদেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার প্রবল টান, বাংলা কবিতা যখন তখন কোট করে। কিছু আধুনিক বাংলা কবিতা ইংরিজিতে অনুবাদও করেছে।

ছুটির দিন বলে এই তিন গৌতম নিউইয়র্ক থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা বস্টনে উপস্থিত, পাঁচ ছ’ ঘণ্টার ড্রাইভ বোধহয়। আমি কোথায় উঠব, তা আগে এখানে টেলিফোন করে জেনে নিয়েছিল। জমে গেল তুমুল আড্ডা।

সন্ধেবেলাতেই কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। হার্ভার্ডের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা করেছে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান, কল্যাণ চক্রবর্তী নামে একজন আই এ এস অফিসার হার্ভার্ডে গবেষণারত, তিনিই যোগাযোগটি ঘটিয়েছেন। কিন্তু কবি-সম্মলনের পক্ষে দিনটি সুবিধেজনক নয়, এখানে এখন লং উইক এন্ড চলছে, অর্থাৎ শনি-রবির সঙ্গে সোমবারটাও ছুটি, এরকম লম্বা ছুটির সুযোগ পেলে অনেকেই শহর ছেড়ে বাইরে চলে যায়। বিকেল থেকে আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এসব সত্বেও এত শ্রোতা সমাগম সত্যি বিস্ময়কর, দেখতে-দেখতে হল প্রায় অর্ধেক ভরে গেল। এদেশের কবিতাপাঠের আসরে আড়াইশো-তিনশো শ্রোতাই যথেষ্ট বলে গণ্য করা হয়, এই সন্ধ্যায় শ্রোতার সংখ্যা তার চেয়ে কিছু বেশিই মনে হল।

বড় গৌতম ওরফে ডঃ কল্যাণ রায় আমার দু-একটি কবিতা অনুবাদ করেছে, তার ইচ্ছে অনুবাদগুলি সে-ই পাঠ করে। এখানকার প্রত্যেকটি কেন্দ্রেই আমাদের কবিতার অনুবাদের কপি আগে থেকে পাঠানো ছিল, নির্দিষ্ট এক একজন স্থানীয় কবি এক একজনের অনুবাদ পাঠ করার জন্য আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকছেন। হার্ভার্ডে যিনি আমার অনুবাদ পড়বেন বলে ঠিক করা আছে তিনি একজন বয়স্ক ব্যক্তি। তাঁকে যখন বললুম, আমার দু’একটি কবিতা অন্য একজন পড়তে চান, তিনি ঠিক খুশি হলেন না মনে হল। তিনি ক্ষুণ্ণভাবে বললেন, আমি এগুলো আগে থেকেই অনেকবার পড়ে রেডি হয়ে এসেছি…। আমি তখন বললুম, আপনি এগুলো পড়ুন, আর একটি নতুন কবিতার অনুবাদ পড়বেন আমার বাঙালি বন্ধুটি। তিনি তাতে রাজি হলেন। কল্যাণ অনুবাদ করেছে ‘কবির মৃত্যু : লোরকা স্মরণে’, সেটি একটি দীর্ঘ কবিতা, তাই সেটার বাংলাটা আর আমি পড়লুম না সময় বাঁচাবার জন্য।

এই ভারতীয় কবির দলটিতে প্রত্যেকের কবিতার সুরই আলাদা। হিন্দি কবি কেদারনাথ সিং এর লেখাগুলি বর্ণনামূলক নয়, উপমাবহুলও নয়, বাস্তব ঘটনার সঙ্গে অ্যাবস্ট্রাকশান মেশানো, এবং গভীর চিন্তার ছায়া আছে। মহারাষ্ট্রের অরুণ কোলাটকারের কবিতাগুলি আবার খুবই বর্ণনামূলক। কখনও মজার, কখনও শ্লেষপূর্ণ, শুনলেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়, শ্রোতারা হাসে, তার কবিতার সমসাময়িক ভারতীয় বাস্তবতার বিদ্রূপমাখা ছবি ফুটে ওঠে। উর্দু কবি শামসুর রহমান ফারুকির কবিতাগুলি ছোট-ছোট, সূক্ষ্ম রসের, কোনও-কোনওটি গজল, শুনতে ভালো লাগে, তবে এইসব কবিতা অনুবাদে মার খায়। গোপালকৃষ্ণ আদিগার কবিতাগুলি আবার ঠিক বিপরীত, তাঁর কবিতাগুলি লম্বা লম্বা, সামাজিক অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমূলক, একটু উচ্চকণ্ঠ। তাঁর কবিতাগুলির মধ্যে তথাকথিত কিছু-কিছু অশ্লীল শব্দও আছে পাকা চুল মাথায় এই প্রবীণ কবির মুখে সেইরকম শব্দ শুনে কেউ-কেউ চমকে-চমকে ওঠেন। এমার্জেন্সি ও ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে তাঁর একটি চড়া সুরের কবিতা শুনে কলোরাডোর কিছু ভারতীয় আপত্তি জানিয়েছিল।

অমৃতা প্রীতম না এলেও সফরের সময় কবির সংখ্য ছ’জনই ছিল। অশোক বাজপেয়ী নিজেও হিন্দি ভাষার একজন উল্লেখযোগ কবি, সে-ও কবিতা পাঠে অংশ নিয়েছে, তার ছোট ছোট নিটোল প্রেমের কবিতাগুলি বেশ সুখশ্রাব্য।

হার্ভার্ডের শ্রোতারা অত্যন্ত মনোযোগী। কবিতা পাঠ শেষ হওয়ার পরেও অনেকে থেকে গিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলেন, খোঁজ নিলেন সাম্প্রতিক ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে, কেউ কেউ আমাদের কবিতার অনুবাদের কপি চেয়ে নিলেন। একজন প্রৌঢ়া মেমসাহেব কল্যাণ রায়কে বললেন, তোমার কবিতা পাঠ সুন্দর হয়েছে, কিন্তু তোমার ইংরিজিতে একটু যেন স্কটিশ অ্যাকসেন্ট আছে! শুনে আমরা অবাক। কল্যাণ সলজ্জভাবে জানাল, আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন, আমার ওপর প্রভাব থাকতে পারে, আমি বিয়ে করেছি একটি স্কটিশ মেয়েকে!

হার্ভার্ডের শ্রোতারা অন্য একটি দিক থেকে আলাদা। এর আগে আমরা অন্যান্য যে সব শহরে কবিতা পড়ে এসেছি, সেখানে দেখেছি, এদেশি শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেরই ভারতীয় কবিতা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। কেউ-কেউ বেদ-উপনিষদের কথা জানে, কারুর-কারুর ধারণা ভারতীয় কবিতা সবই ধর্ম-বিষয়ক। আধুনিক ভারতীয় কবিদের কবিতা শুনে তারা অবাক হয়ে গেছে। হার্ভার্ডে অবশ্য বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় কবিতার বিবর্তন সম্পর্কে কেউ কেউ কিছু জানেন বোঝা গেল। ভারতীয় কবিদের এই আমেরিকা সফরে এখানকার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আধুনিক ভারতীয় কবিতা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণার সৃষ্টি করা গেছে, এইটুকুই যা লাভ। প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানের পরই দু-চারজন আগ্রহের সঙ্গে জিগ্যেস করেছেন, তোমাদের কবিতার অনুবাদ বই নেই? কোথায় পাওয়া যায়? এদেশে পাওয়া যায় না কেন?

সেই রাতে চন্দ্রা ও রাহুলের আতিথেয়তায় ওদের ফ্ল্যাটে প্রচুর খাদ্য পানীয় সহযোগে আর একটি কবিতা পাঠের আসর বসল। এখানে শুধু নির্ভেজাল বাংলা কবিতা। তিন গৌতমের মধ্যে দুজন তাদের কবিতা শোনাল, গৌরী দত্ত নামে একজন মহিলা ডাক্তার তিনিও লাজুক লাজুক গলায় শোনালেন তাঁর নিজের কবিতা, আমাকেও পড়তে হল কয়েকটি। যেহেতু সন্ধেবেলা আমি ‘কবির মৃত্যু’ পড়িনি, সেইজন্য ওদের সকলের অনুরোধে পড়তে শুরু করলুম সেটা। পড়তে পড়তে আমার ভালো লেগে গেল, তারপর আমি স্বেচ্ছায় পড়ে যেতে লাগলুম একটার পর একটা। কবিতার প্রায় প্রতিটি শব্দই যাদের বোধগম্য, তাদের সামনে কবিতা পাঠের আনন্দই আলাদা।

মধ্যরাত পেরিয়ে আমাদের আড্ডা গড়িয়ে চলল ভোর রাতের দিকে।

হার্ভার্ডে সন্ধেবেলার অনুষ্ঠানের শ্রোতাদের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলাম আমার পূর্ব পরিচিতা চিত্রিতা ব্যানার্জি-আবদুল্লা ও তাঁর বান্ধবী এলিজাবেথ ভোগলোকে, এই মার্কিন তরুণীটি ইংরিজি সাহিত্যের ছাত্রী, এর সঙ্গেও একবার পরিচয় হয়েছিল কলকাতায়। এরা দুজন বলেছিল, তুমি কি একদিন এখানে থেকেই পালাবে? তা চলবে না। আরও কয়েকদিন থেকে যেতে হবে হার্ভার্ডে।

সুতরাং পরদিন আমাদের দলের আর সবাই এখান থেকে প্রস্থান করলেও আমি আরও কয়েকদিন রয়ে গেলুম কেম্বিজে।

কিন্তু সে তো অন্য গল্প!