২০. গলা ফাটিয়ে চিৎকার

মিংমার মনে হল যেন তার শরীরটা কোমরের কাছ থেকে কেটে দু টুকরো হয়ে যাচ্ছে। দারুণ যন্ত্রণায় সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। মাথার ওপর দিয়ে হেলিকপটারটা ঘুরছে, সেদিকে সে একটা হাত নাড়তে লাগল প্ৰাণপণে, কিন্তু হেলিকপটার থেকে তাকে কেউ দেখতে পেল না।

একেবারে মৃত্যুর মুখোমুখি এসে গেলে মানুষ অনেক সময় এক-একটা অসম্ভব কাজ করে ফেলে। দুদিকের লোহার পাত মিংমার কোমরের কাছে কেটে বসে যাচ্ছে, সেই অবস্থাতেও কোনওক্রমে এক ঝাঁকুনিতে সে ওপরে উঠে এল। সঙ্গে সঙ্গে আবার জুড়ে গেল লোহার পাতটা।

ওপরে উঠে আসার পরই কিন্তু মিংমার আর কথা বলার ক্ষমতাও রইল না, নড়াচড়ার সাধ্যও রইল না। সে দুতিন পা মাত্র গিয়েই ধপাস করে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

হেলিকপটারটা কয়েক চক্কর ঘুরে তারপর নামল বেশ খানিকটা দূরে। তার থেকে তিনজন লোক নেমে এগিয়ে গেল গম্বুজটার দিকে। ভার্মা আর রানার সঙ্গে এবার এসেছেন টমাস ত্ৰিভুবন। ইনি নেপালি খ্রিস্টান, এক সময় বিদেশি অভিযাত্রী দলগুলির স্থানীয় ম্যানেজারের কাজ করতেন, এইসব জায়গা। তাঁর নখদর্পণে। এখন বেশ বুড়ো হয়েছেন, সিয়াংবোচিতেই থাকেন। মাথার চুলগুলো সব সাদা।

গম্বুজের মধ্যে কেউ নেই দেখে ওঁরা অবাক হলেন। ভার্মা বললেন, আরেঃ, ছেলেটা আর শেরপাটা গেল কোথায়?

রানা বললেন, ওদের তো গম্বুজের মধ্যেই থাকতে বলেছিলাম। ওরা আবার কোনও বিপদে পড়ল নাকি?

ভার্মা বললেন, ঐ কাকাবাবু, মানে মিঃ রায়চৌধুরী একটা পাগল! নিজের তো প্ৰাণের মায়া নেই-ই, তাছাড়া, এরকম দুৰ্গম জায়গায় কেউ একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে আসে।

টমাস ত্ৰিভুবন বললেন, রানা, একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছ? গম্বুজের বাইরে মুর্গির পালক?

ভার্মা বললেন, কাল ওরা দুজনে এখানে পিকনিক করেছে মনে হচ্ছে।

রানা বললেন, কিন্তু ওরা মুগা পাবে কোথা থেকে? এই জায়গায় জ্যান্ত মুগ? ষ্ট্রেঞ্জ! ভেরি ষ্ট্রেঞ্জ। আরো এদিকে দেখুন। পায়ের ছাপ। কত বড় পায়ের ছাপ!

ভার্মা বললেন, ইয়েতি! এখানে ইয়েতি এসেছিল।

বলতে-বলতে ভার্মা কেটের পকেট থেকে রিভলভার বার করলেন। তাঁর মুখে দরুণ ভয়ের ছাপ!

টমাস ত্ৰিভুবন পায়ের ছাপগুলোর কাছে বসে পড়লেন। বিড়বিড় করে বললেন, এরকম ছাপ আমি আগেও দেখেছি। দু বছর আগে শেষ যোবার এসেছিলাম, তখন আরও অনেক আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছি। এখানে–এই জায়গাটায় কিছু একটা রহস্য আছেই।

রানা গম্বুজের মধ্যে ঢুকে কাকাবাবুর একটা ক্যামেরা নিয়ে এলেন, তারপর পটাপট ছবি তুলতে লাগলেন সেই পায়ের ছাপের।

টমাস ত্ৰিভুবন বললেন, সেবার এসে দেখেছিলাম, এরকম ইয়েটির পায়ের ছাপের পাশে-পাশে একটা ছোট কুকুরের পায়ের ছাপা! ইয়েটি আছে কি না। আমি জানি না, কিন্তু কোনও কুকুর কি এরকম জায়গায় থাকতে পারে? ইমপসিবল ব্যাপার নয়? এখানেই কোথাও আমি দেখেছিলাম একটা লোহার পাত। রাত্রে খুব বরফ পড়ার পর সেটাকে আর খুঁজে পাইনি।

ভার্মা বললেন, লোহার পাত? হা-হা-হা-হা! এটা কিন্তু ইয়েতির পায়ের ছাপের চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার! কোনও অভিযাত্রী টীম কি পাহাড়ের এত উঁচুতে লোহার পাত বয়ে আনবে? আর কেনই বা আনবে

রানা বললেন, সন্তু নামের ঐ ছেলেটিও কিন্তু লোহার পাতের কথা বলেছিল! দুজনের কথা মিলে যাচ্ছে!

ভার্মা বললেন, সে ছেলেটিও তো বাজে কথা বলেছিল। শুধু শুধু কতখানি জায়গা খুঁড়ে দেখা হল, কিছু পাওয়া গিয়েছিল? এই সব পাহাড়ি জায়গায় অনেক রকম চোখের ভুল হয়।

টমাস ত্ৰিভুবন বললেন, আমি আর একটা কথা বলব? আমার এ কথা অনেকে বিশ্বাস করে না। আমি এই জায়গা দিয়ে অনেকবার গেছি। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, এই গম্বুজটা থেকে কয়েক শো গজের মধ্যে একটা খাদ আর গুহার মতন ছিল। কয়েক বছর ধরে সেই খাদ কিংবা গুহা কিছুই দেখতে পাই না, সমস্ত জায়গাটা প্লেন হয়ে গেছে। অথচ সেরকম কোনও ভূমিকম্প-টম্পও হয়নি যে, একটা গুহা বুজে যাবে।

ভার্মা বললেন, গুহা শুধু নয়, খাদও বুজে গেল বলছেন?

ভার্মা রানার দিকে চেয়ে চোখ টিপলেন আর মাথার কাছে একটা আঙুল নাড়িয়ে বোঝালেন যে, বুড়ো বয়েসে টমাস ত্ৰিভুবনের মাথাটি একেবার খারাপ হয়ে গেছে।

টমাস ত্রিভুবন আপন মনে মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, এখান থেকে যে প্রায়ই লোকে অদৃশ্য হয়ে যায়, তার সঙ্গে ঐ গুহা আর খাদ বুজে যাবার কোনও সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে। দরকার হলে আমি ম্যাপ একে আপনাদের বুঝিয়ে দিতে পারি যে, কোন জায়গায় গুহাটা ছিল?

রানা বললেন, কাঠমাণ্ডুতে আমি খবর পাঠিয়েছি। একটা বড় সার্চ পার্টি কালকের মধ্যেই এসে পৌঁছবে  ওদের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আজ রাতটা আমরা এখানে কাটিয়ে দেখব, ইয়েটির কোনও সন্ধান পাওয়া যায় ਵਿ

ভার্মা বললেন, এখানে রাত কটাব? আমি মশাই রাজি নই! ওরে বাপ রে বাপ। পটাপট লোকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে! ইয়েতিকে আমন হালকা ভাবে নেবেন না।

রানা চমকে উঠে বললেন, তার মানে?

ভার্মা বললেন, আসবার ঠিক আগেই আমি আর টি-তে খবর নিয়েছিলাম। কাঠমাণ্ডুর দিকে ওয়েদার খুব খারাপ। প্লেন উড়তে পারবে না। দু তিনদিনের মধ্যে ওদের এদিকে আসাবার কোনও সম্ভাবনা নেই।

টমাস ত্ৰিভুবন চারদিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছিলেন। এবার বললেন, একজন লোক আসছে!

সবাই সেদিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। রানা পকেট থেকে বাইনোকুলার বার করে চোখে লাগিয়ে দেখে বললেন, এই তো সেই শেরপা কী যেন ওর নাম?

মিংমা প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে। তার কোমরের দুদিকে অনেকখানি কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে অঝোরে। সে ব্যথা সহ্য করছে দাঁতে দাঁত চেপে।

কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, সাব–উধার চলো-লোহাকা দরওয়াজা!–সন্তু সাব অন্দর গির গিয়া-হামকে চোট লাগা!

ভার্মা বললেন, লোকটা কী বলছে পাগলের মতন! এই সন্তু কোথায় গেল? ঠিক করে বলে।

মিংমা বলল, অন্দর গির গিয়া.বহুত বড়া লোহাক দরওয়াজা…

ভার্মা বললেন, লোকটার একেবারেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে! বললুম, ভুতুড়ে জায়গা!

রানা নেপালি ভাষায় মিংমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা গম্বুজ থেকে বেরিয়েছিলে কেন? কোথায় গিয়েছিলে? এখানে মুর্গির পালক এল কী করে?

মিংমা খুব জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে উত্তর দিতে গেল। কিন্তু আর একটা কথাও বেরোল না তার মুখ দিয়ে, আবার সে মাটিতে পড়ে গেল।

রানা তক্ষুনি তার পাশে এসে বসে পড়ে বললেন, অজ্ঞান হয়ে গেছে! এ কী, এর সারা গায়ে রক্ত!

ভার্মা বললেন, ও সন্তুকে খুন করেনি তো?

রানা এবার মুখ তুলে কঠোরভাবে বললেন, এখন তো মনে হচ্ছে, আপনিই পাগল হয়ে গেছেন, মিঃ ভার্মা! ও সন্তুকে খুন করবে কেন? কী ওর স্বাৰ্থ? ও একবার প্রালিয়ে গিয়েও ফিরে এসেছিল। ওদের টানে।

ভার্মা বললেন, সেইজন্যই তো সন্দেহ হচ্ছে। ওর কোনও মতলব আছে। বলেই হয়তো ফিরে এসেছে।

টমাস ত্ৰিভুবন বললেন, একটু গরম দুধ বা চা খাওয়াতে পারলে ওর জ্ঞান ফিরবে, তখন ওর কাছ থেকে সব খবর নেওয়া যেতে পারে! শুনলেন তো, এও লোহার দরজার কথা বলছে!

ভার্মা বললেন, পাহাড় আর বরফের রাজত্বে লোহার দরজা! এ যে রূপকথা! আর বেশিক্ষণ এখানে থাকলে আমাদের সবারই মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

টমাস ত্ৰিভুবন বললেন, গম্বুজের মধ্যে চা তৈরি করার ব্যবস্থা নেই?

রানা বললেন, আছে। ভেতরে ওষুধ-পত্তরও আছে কিছু কিছু। আপনার তো। এসব ব্যাপারে কিছু জ্ঞান আছে, দেখুন তো কোনও ওষুধ একে খাওয়ানো যায় কি না। এর জ্ঞান ফিরিয়ে আনা খুবই দরকার।

ভার্মা বললেন, তার চেয়ে একটা কাজ করলে হয় না? এই লোকটা যখন এত অসুস্থ, তখন ওকে হাসপাতালে দেওয়া উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। চলুন ওকে নিয়ে আমরা সিয়াংবোচি ফিরে যাই এক্ষুনি।

রানা অবাক হয়ে বললেন, সে কী, সন্তুর খোঁজ করব না?

ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, ফিরে এসে করব। কিন্তু এই লোকটাকেও তো বাঁচানো দরকার। এর আর বেশিক্ষণ আয়ু নেই বলে মনে হচ্ছে। দেখুন, সমস্ত পোশাক রক্তে ভিজে যাচ্ছে একেবারে। ওর ক্ষতিটা কোথায় দেখেছেন?

রানা বললেন, কোমরের কাছে। আশ্চর্য!

ভার্মা বললেন, আশ্চর্য নয়? এখানকার সব ব্যাপারটাই অদ্ভুত! মানুষের কোমরের কাছে কাটে কী করে? বুকে-পিঠে, হাতে-পায়ে চোট লাগতে পারে, কিন্তু কোমরের কাছে এক যদি ভালুক বা ইয়েতি কামড়ে ধরে…

রানা বললেন, লোহার দরজা হোক আর যাই হোক, ও বলছে, সন্তু কোনও একটা জায়গায় পড়ে গেছে। আমরা এখনও গেলে সন্তুকে উদ্ধার করতে পারি। কিন্তু সে-জায়গাটা ও ছাড়া তো আর কেউ দেখাতে পারবে না।

টমাস ত্ৰিভুবন গম্বুজ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, গরম জল চাপিয়ে দিয়েছি। এই নিন, এই ওষুধটা ওকে খাইয়ে দিলে ও অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠবে, তাতে শিগগির ওর জ্ঞান ফিরতে পারে।

রানা বললেন, ওকে আমি তুলে নিয়ে গম্বুজের মধ্যে শুইয়ে দিচ্ছি। কোমরে এক্ষুনি একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা দরকার।

রানা যেই মিংমাকে তো।লবার জন্য নিচু হয়েছেন, অমনি ভার্মা বললেন, তার আর দরকার নেই। মিঃ ত্ৰিভুবন, ওষুধটা ফেলে দিন।

ওঁরা দুজনে চমকে তাকাতেই দেখলেন ভার্মার রিভলভারটা ওঁদের দিকে তাক করা।

রানা বললেন, এ কী! এর মানে কী?

ভার্মা বললেন, আপনারা দুজনেই গম্বুজের মধ্যে ঢুকুন! চটপট! এক মুহূর্ত দেরি করলেই আমি গুলি চালাব।

রানা বললেন, আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? না, আপনি সত্যিই আমাদের সঙ্গে শত্ৰুতা করছেন?

রিভলভারটা সামনে রেখে ভার্মা এগোতে এগোতে বললেন, আর একটাও কথা নয়, ভেতরে ঢুকে পড়ো-বারবার বললাম ফিরে যেতে-এখন মরো। তোমরা যতটুকু জেনেছ, তার বেশি আর জানতে দেওয়া যায় না।

রানা আর টমাস ত্ৰিভুবন বাধ্য হয়েই গম্বুজের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। টমাস ত্ৰিভুবন বিড়বিড় করে বললেন, আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল, এই লোকটা বারবার অন্য কথা বলে আমাদের সময় নষ্ট করতে চাইছিল। এর কোনও মতলব আছে।

ওঁরা দুজনে ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভার্মা লোহার দরজাটা বাইরে থেকে টেনে তালা লাগিয়ে দিলেন। চিৎকার করে বললেন, এখানে তোমরা নিবাসনে থাকে! ভেতরের ওয়্যারলেস সেটটা আমি আগেই খারাপ করে দিয়ে গেছি, এখান থেকে খবর পাঠাবারও কোনও উপায় নেই!

তারপর ফিরে ভার্মা তাকালেন মিংমার দিকে। একবার ভাবলেন, ওকে ঐ অবস্থাতেই ফেলে চলে যাবেন। তারপর আবার ভাবলেন, ঝুঁকি না নিয়ে ওকে একেবারে খতম করে দেওয়া যাক।

রিভলভারটা পকেটে রেখেছিলেন, আবার বার করে গুলি করতে গেলেন মিংমাকে।

মৃত্যুর ঠিক মুখোমুখি এসে মানুষ যে অসম্ভব কাজ করতে পারে দ্বিতীয়বার প্রমাণ দিল মিংমা। একটু আগেই তার জ্ঞান ফিরেছিল, সে সব দেখেছিল। ভার্মা আবার পকেট থেকে রিভলভার বার করতেই সে বিদ্যুৎবেগে একটা লাথি কষাল ভার্মার পেটে। আচমকা সেই আঘাতে ভার্মা মাটিতে পড়ে যেতেই মিংমা তার বুকের ওপর চেপে বসল। একখানা প্রবল ঘুষিতে প্ৰায় থেতলে দিল ভার্মার নাকটা।