১.১০ ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি

বুখারেস্টে রাস্তায় বেরুলেই একটা ধ্বনি শোনা যায়। সেটা অনেকটা গানের গানের ধুয়োর মতন। ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি? চেইঞ্জ মানি? যে এক বর্ণও ইংরিজি জানে না, সেও এই গানের লাইনটা জানে!

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রথম প্রথম এই ডলার-লোভ দেখে বিস্মিত হয়েছি, পরে মন খারাপ লেগেছে। যেবারে বুলগেরিয়া গিয়েছিলাম, সেবারে হোটেলে পৌঁছেই লিফট দিয়ে উঠছি, দুজন পোর্টার দু-দিক থেকে বলতে শুরু করেছিল, ডলার, ডলার? চেইঞ্জ মানি? চেকোশ্লোভাকিয়ায় কোনও দোকানে দিনার দিয়ে কিছু কিনতে গেলেই কাউন্টারের লোকটি ফিসফিসিয়ে বলেছে, ডলার, থ্রি টাইমস! ফোর টাইমস। হাঙ্গেরিতে, প্রাক্তন পূর্ব জার্মানিতে এরকম বহুবার শুনেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের কোথাও আমার এ অভিজ্ঞতা হয়নি। সেখানে আমার সঙ্গে সব সময় একজন সরকারি প্রতিনিধি থাকত। চিনে আমাদের সঙ্গে প্রতিনিধি থাকত দুজন। কিন্তু কখনও একলা হোটেল ছেড়ে বেড়াতে বেরুলেই অমনি কয়েকজন লোক ঘিরে ধরে সেই ধুয়ো তুলেছে, ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি? এইসব দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চরম শত্রু মনে করে, আমেরিকান অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে প্রতিনিয়ত প্রচার চলে, তবু ডলারের প্রতি এই কাঙালপনা কেন? জার্মান মার্ক ও জাপানি ইয়েন খুব দৃঢ় কারেন্সি, ব্রিটিশ পাউন্ড তার ক্রম হ্রাসমান সম্মান অনেকটা পুনরুদ্ধার করেছে, তবু সবাই ডলার চায়। পাউন্ড ও মার্কেরও চাহিদা আছে হাঙ্গেরি-রুমানিয়ায়, কিন্তু প্রথমে সকলেই ডলারের গানটি গায়। এইসব দেশগুলিতে পুলিশ ও গুপ্তবাহিনী যথেষ্ট সক্রিয়, তবু তায়া প্রকাশ্য রাস্তায় এরকম চোরাকারবারিকে ধরতে পারে না? এটা অবিশ্বাস্য! কাগজে-কলমে সরকারি ব্যাংক ছাড়া বিদেশি মুদ্রা ভাঙানো নিষিদ্ধ, অথচ হাজার-হাজার লোক দিনের বেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে টুরিস্টদের কাছ থেকে অনেক গুণ বেশি দামে ডলার কিনছে, অথচ তাদের পুলিশে ধরে না। নিশ্চয়ই সরকারিভাবে এই চোরা কারবারের প্রতি প্রশ্রয় আছে। এটা যে অর্থনীতির কোন কূটকৌশল তা আমার বোধগম্য হয় না! মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদরাও এর কোনও ব্যাখ্যা দেননি, অনেকে এই ব্যাপারটার উল্লেখই করেন না, যেন এর কোনও অস্তিত্ব নেই!

আর একটা ব্যাপারও আমার খুবই বিসদৃশ মনে হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বড় বড় শহরে কিছু কিছু দোকান থাকে বিদেশিদের জন্য। এদের চলতি নাম ‘ডলার শপ’। সেইসব দোকানে ভালো ভালো জিনিসপত্র সাজানো থাকে। স্কচ হুইস্কি, আমেরিকান সিগারেট থেকে শুরু করে ফরাসি পারফিউম, সুইস ঘড়ি, শৌখিন জামা-কাপড় পর্যন্ত। সেগুলি শুধু ডলার কিংবা হার্ড কারেন্সি দিয়ে কেনা যাবে, অর্থাৎ বিদেশিদের জন্য। দেশের মানুষ দোকানের শো উইন্ডোর সামনে দাঁড়িয়ে সেইসব জিনিসপত্র লোভর মতন দেখে! দোকানে জিনিসপত্র সাজানো হয়েছে, অথচ তারা নিজেদের টাকায় কিনতে পারবে না, এ কী অপমানজনক ব্যবস্থা। ওইসব দোকান একেবারে না রাখলে কী ক্ষতি ছিল? বিদেশি পর্যটকরা সমাজতান্ত্রিক দেশে বেড়াতে গিয়ে ফ্রেঞ্চ পারফিউম কিনতে যাবে কেন? দেশের মানুষদের এইসব জিনিস কেনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ফলে তায়া যে কোনও উপায়ে ডলার সংগ্রহ করতে চাইবে, এতে আর আশ্চর্য কী! আমাদের ভারতে এরকম কোনও দোকান নেই, সেজন্য ধন্যবাদ!

চিনে আর একটা ব্যাপার দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। দু’রকম টাকা! সরকারিভাবে ডলার ভাঙালে একরকম চিনা টাকা দেওয়া হবে, যার চেহারা সাধারণ চিনা টাকার থেকে আলাদা। বিদেশিরা ওই টাকা দিয়ে যে-কোনও দোকান থেকে যে-কোনও জিনিস কিনতে পারে। সেই নোটের চেহারা আলাদা হলেও অন্য চিনা নোটের সঙ্গে মূল্যের কোনও তফাত নেই। একই দেশে এই দু’রকম নোট চালু রাখার সুবিধে কী তা জানি না, কিন্তু দেখেছি, কোনও দোকানে গিয়ে আমাদের ওই টাকা দিয়ে কিছু কিনতে গেলে পাশ থেকে অনেকে এসে নিজেদের টাকার সঙ্গে বদলাবদলি করতে চায়। অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও এই টাকা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মূল্যমান সমান, সুতরাং হস্তান্তরে বে-আইনি বোধ হয় না। চিনারা ওই টাকা দিয়ে বিদেশিদের জন্য নির্দিষ্ট দোকানে বিদেশি দ্রব্য কিনতে পারে। চিনে এখন আমেরিকান দ্রব্য এবং জামাকাপড় সম্পর্কে দারুণ ঝোঁক। আমেরিকান সিগারেটের বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেছি। আমাদের দেশে কোথাও এরকম নেই। বড় বড় হোটেলগুলিতে আমেরিকানদের মনোরঞ্জনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। হোটেলের একটা টিভি চ্যানেলে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই আমেরিকান প্রোগ্রাম দেখানো হয়। পোর্টার, লিফটম্যান, রেস্তোরাঁর বয়রা থ্যাংক ইউ-এর উত্তরে আমেরিকান কায়দায় বলে ইউ আর ওয়েলকাম। ষাট-সত্তরের দশকে আমাদের বাংলার যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ পৃথিবীর অন্য দেশগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আদর্শের জন্য চিনের দিকে ব্যাকুল-ভাবে তাকিয়েছিল, তাদের কথা ভেবে আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

চিনের সাধারণ মানুষের ভদ্রতা, বিনয় ও শৃঙ্খলাবোধ দেখে অনবরত মুগ্ধ হতে হয়। গ্রামে ঘোরার সুযোগ হয়নি, বড় বড় শহরগুলির অবস্থা আমাদের দেশের থেকে কিছুটা ভালো। গ্রামে দারিদ্র্যের কথা শোনা যায়, নেশা ও নারীদেহ নিয়ে ব্যাবসা একেবারে লুপ্ত হয়নি, বেকার রয়েছে, জীবিকার ক্ষেত্রে নানা বৈষম্যও রয়েছে, সেটাই তো কত প্রয়োজনীয় ব্যাপার, সেটাও আমাদের সরকার বোঝে না। বোম্বাইয়ের তুলনায় পেইচিং অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। কলকাতার চেয়ে সাংহাইয়ের জনসংখ্যা অনেক বেশি, তবু সাংহাইয়ের কোনও রাস্তাতেই কলকাতার মতন এমন জঘন্য আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে না। সাংহাইয়ের এক জনবহুল জায়গায় সিগারেটের টুকরো ফেলায় এক বৃদ্ধা সরকারি প্রতিনিধি আমার চার ইউয়ান ফাইন করায় বেশ মজা লেগেছিল। আমাদের দেশে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার জন্য কেউ যদি ফাইন করত, আমি খুশি হতাম।

কিন্তু চিনে আমেরিকান উপস্থিতি দেখে বিমূঢ় বোধ করেছিলাম। সরকারি ভাবেও আমেরিকা-তোষণের ঢালাও ব্যবস্থা। চিনাদের যে-জাতীয় পোশাক দেখতে আমরা অভ্যস্ত, তা একেবারে অদৃশ্য। রাস্তার সমস্ত নারী পুরুষ পশ্চিমি পোশাক পরে আছে। আমার সহযাত্রী হিন্দি লেখক কমলেশ্বর একটা চিনা কোট কিনতে চেয়েছিলেন, অনেক খোঁজ করেও পেলেন না। ভারতে কিন্তু আমেরিকা এভাবে এখনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

ডলার-হ্যাংলামি অন্য অনেক দেশে দেখলেও বুখারেস্টের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না। অন্যান্য দেশে হোটেলের সামনে, বাজারে, বাসস্টপে, রেল স্টেশনে এইসব কালোবাজারিরা ঘোরাফেরা করে। বুখারেস্টে এরা সর্বত্র। রাস্তায় যেতে-যেতে কোনও মানুষের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই যদি সে চিনতে পারে যে আমরা বিদেশি, অমনি কাছে এসে বলে ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি? এই একঘেয়ে গানের ধুয়ো শুনতে শুনতে আমাদের তিতিবিরক্ত হওয়ার মতন অবস্থা! রুমানিয়ার টাকার নাম লেই, সরকারি বিনিময় হারের চেয়ে আটগুণ-দশগুণ এক একজন দিতে চায়। টুরিস্টদের ঠকাবারও নানারকম প্রক্রিয়া আছে। ডলারের বিনিময়ে বড় একটা টাকার বান্ডিল হাতে গুঁজে দিয়ে একজন দ্রুত চলে যায়, খুলে দেখা যায়, ওপরে কয়েকখানা মাত্র নোট, ভেতরে বাজে কাগজ!

বেশি টাকা পেয়েও তো লাভ নেই, লেই দিয়ে বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না। রেস্তোরাঁয় গিয়ে পঞ্চাশ রকম খাবারের তালিকার মধ্যে শুধু একরকম যদি পাওয়া যায়, তাহলেই সেটা ভাগ্য বলতে হবে। যদি কোনও দোকানে বিয়ার পাওয়া যাচ্ছে এমন শোনা যায়, তা হলেই সেখানে বিরাট ভিড় জমে। অন্যান্য দোকান থেকেও কিছুই কেনার নেই। আমাদের দেশে আজকাল সমস্ত দোকানদারই জিনিসপত্র কিনলে পাতলা পলিথিনের ব্যাগ দেয়, এমনকি বাজারের মাছওয়ালারাও দেয়। বুখারেস্টে আমাদের হাতের জিনিসপত্র বইবার জন্য সেরকম একটা ব্যাগ খোঁজ করেছিলাম, প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে বহু দোকান ঘোরার পর শেষ পর্যন্ত একটা দোকান থেকে ওইরকম একটা অতি সাধারণ ব্যাগ পয়সা দিয়ে কিনতে হল।

অমিতা বসুর সঙ্গে বুখারেস্ট শহর ঘুরতে বেরিয়ে আমরা চলে এলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। চাউসেস্কুর আমল থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামকে এখানে সবাই বলে দ্বিতীয় বিপ্লব। তার কেন্দ্র ছিল এই এলাকা। বারবার এখানে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে শহিদ বেদি, সেখানে জ্বলছে অনেক মোমবাতি। রাস্তায় যেতে-যেতে অনেকেই হঠাৎ থেমে গিয়ে একটা করে মোমবাতি কিনে জ্বেলে দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কোনও মহিলার বিষণ্ণ থমথমে মুখ দেখে মনে হয়, হয়তো তাঁরই স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা প্রাণ দিয়েছে সেই সময়ে।

অমিতা সেই পুরো সময়টার প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁর কাছে আমরা বিস্তৃতভাবে শুনলাম সব ঘটনা। এসব অমিতা লিখেছেনও। পার্টি অফিসের বারান্দা থেকে চাউসেস্কুর শেষ বক্তৃতা দিতে-দিতে মাঝপথে থামিয়ে, সেই বাড়িরই ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে সস্ত্রীক পালাবার চেষ্টা, ধরা পড়া, দ্রুত বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের কথা এখন অনেকেরই জানা হয়ে গেছে। এখানে ঘুরতে-ঘুরতে আমার চিনের কথা মনে পড়ছিল বারবার, কারণ, রুমানিয়ায় গণঅভ্যুত্থান যখন ঘটে তখন আমি চিনে ছিলাম। সে প্রায় বছরখানেক আগেকার কথা। চিনের কোনও সংবাদপত্রে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ থাকত না। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে যে কী সব পরিবর্তন ঘটছে তার চিন সরকার তাদের দেশবাসীকে জানাতে চান না। কিন্তু আমরা হোটেলে টিভি-র একটা চ্যানেলে আমেরিকানদের দ্বারা পরিবেশিত সমস্ত ছবিই দেখেছি! মজার ব্যাপার, হোটেলে থাকলে সব কিছু দেখা ও জানা যাবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের সে অধিকার নেই। অবশ্য বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর ব্যাপারটাও টের পেয়েছিলাম তখন। সকালবেলা আমাদের গাড়ির ড্রাইভার, ইন্টারপ্রেটাররা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলত, তখন চিনে ভাষা একবর্ণ বুঝতে না পারলেও একটা নাম শুনতাম বারে-বারে, রুমানিয়া! রুমানিয়া! অর্থাৎ তারা ঠিক জেনেছে।

বুখারেস্টের সর্বত্র লাইন। কে যে কীসের জন্য লাইন দিয়েছে তা বোঝবার উপায় নেই। লাইনে যারা দাঁড়িয়ে আছে, সবাই যে গম্ভীর ও বিরক্ত তাও নয়। কেউ কেউ হাসাহাসি করছে। চরম দুঃসাহসের মধ্যেও রসিকতাবোধ নষ্ট হয় না। বছরের পর বছর দুর্ভোগ চলেছে রুমানিয়ায়, তার মধ্যেও রসিকতার সৃষ্টি হয়েছে এবং মুখে মুখে ছড়িয়েছে। মানুষের প্রতিবাদ জানাবার আর কোনও উপায় নেই, খবরের কাগজগুলি শুধু মিথ্যে কথা লেখে, বেতারে দুরদর্শনে শুধু সরকারি প্রচার, সভা-সমিতি নিষিদ্ধ। চতুর্দিকে গুপ্তচর, কোথাও যে সাধারণ মানুষ পাঁচজনে মিলে সুখ-দুঃখের কথা বলবে তারও উপায় নেই, তাদেরই মধ্যে একটা গুপ্তচর কিনা তাই বা কে জানে! এই গুপ্তচর ব্যবস্থা যে এখানে কী সাংঘাতিক ছড়িয়েছিল, তার একটা অবিশ্বাস্য উদাহরণ শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। ইস্কুল থেকে ছেলেমেয়েদের বলা হত, তাদের যাবা-মায়েরা বাড়িতে কী আলোচনা করে তা স্কুলে এসে জানাতে হবে। তার মধ্যে কোনও সরকার-বিরোধী কথা থাকলেই অমনি গ্রেফতার! অর্থাৎ নিষ্পাপ শিশুদেরও গুপ্তচর বানানো হত। তাদেরই যাবা মায়ের বিরুদ্ধে। সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে প্রত্যেক মানুষের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে গিয়ে এ কী হৃদয়হীন বন্ধনেরও ব্যবস্থা করে ছিল!

এই রকম সময়ে রসিকতাগুলোই প্রতিবাদ। রসিকতার স্রষ্টার কোনও নাম থাকে না, মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। অনেক বক্তৃতার চেয়েও একটি রসিকতার আঘাত বেশি মোক্ষম!

অমিতার কাছ থেকে শোনা একটি রসিকতা এখানে বলা যেতে পারে। এই ডাক্তারের কাছে এক যুবতী মহিলা গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। মহিলাটির খুবই শক্ত অসুখ করেছিল, অন্য ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছিল, বাঁচার কোনও আশাই ছিল না। এই ডাক্তারটি প্রায় যমের সঙ্গে লড়াই করে মহিলাটিকে শুধু বাঁচালেন তাই-ই নয়, সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুললেন। প্রায় একটি মিরাকল বলা যেতে পারে। কতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে মহিলাটি ডাক্তারকে বললেন, আপনি আমার জন্য যা করলেন, তা তো শুধু টাকাপয়সা দিয়ে শোধ করা যায় না। আমি আপনাকে অন্য একটা কিছু দিতে চাই। আপনি কি নেবেন বলুন। ডাক্তার এ কথা উড়িয়ে দিলেন, তিনি কিছুই চান না, কিন্তু মহিলাটি ঝুলোঝুলি করতে লাগলেন, কিছু একটা না দিলে তিনি তৃপ্তি পাবেন না! অনেকক্ষণ পরে ডাক্তারটি বললেন, বেশ, ঠিক আছে, যদি কিছু দিতেই চান, তা হলে আপনার জীবনের একটি রাত্রি শুধু আমাকে দিন!

এ কথা শুনে চুপসে গেলেন মহিলাটি। ডাক্তারটিকে তাঁর খুবই ভদ্র ও সভ্য মনে হয়েছিল, কিন্তু এ যে কুপ্রস্তাব। এমন তিনি আশা করেননি।

কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেলেন মহিলাটি। স্বামীকে বললেন সব কথা। ডাক্তারটিকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিছু একটা দিতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ডাক্তার যা চাইলেন, তা দেওয়া যায় না। এমনই নিরাশ হয়ে পড়েছেন মহিলা যে তাঁর প্রায় ভেঙে পড়বার মতন অবস্থা। স্বামী বললেন যে বউ যদি এত কান্নাকাটি করে, তাহলে সে বোধহয় আবার অসুখে পড়বে! তখন স্বামী বললেন, ডাক্তার যা চেয়েছেন, তা দিতেই বা আপত্তির কী আছে? ডাক্তার প্রায় তোমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। ওঁর সাহায্য ছাড়া তুমি বাঁচতেই না। সুতরাং এই নতুন জীবন থেকে মাত্র একটা রাত ওঁকে দিতেই পারো। আমি কিছু মনে করব না।

স্বামীই জোর করে আবার পাঠালেন স্ত্রীকে। মহিলাটি ডাক্তারের কাছে এসে নতমুখে বললেন, আমি রাজি। আজ রাতে আমি নিজেকে আপনার কাছে নিবেদন করলাম।

ডাক্তার সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, রাজি? চলুন তা হলে বেরিয়ে পড়া যাক। ডাক্তার নিজের গাড়িতে মহিলাটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তখন বেশ রাত, রাস্তাঘাট ফাঁকা। খানিকটা দূর যাওয়ার পর ডাক্তার এক জায়গায় গাড়ি থামালেন। তারপর গাড়ি থেকে একটা ছোট্ট টুল বার করে ফুটপাথে পেতে দিয়ে মহিলাটিকে বললেন, আপনি এই টুলের ওপর সারারাত বসে থাকুন!

মহিলাটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললেন, তার মানে? আমি এখানে সারারাত বসে থাকব?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, ওই যে সামনে দোকানটি দেখছেন, কাল সকালে ওর দরজা খুললেই সামনে বিরাট লাইন পড়ে যাবে! তাই আপনি আমার জন্য এখানে জায়গা রাখুন!

রুমানিয়ার লাইনের প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলা যায়। এখানে মাংস, রুটি, চিনি, দুধ, মাখনের জন্য যেমন লোকে লাইন দেয়, তেমনি লোকে লাইন দেয় বইয়ের দোকানেও। বই পড়ার ক্ষুধাও এখানে প্রচণ্ড। আমাদের সামনেই একটি দোকানে বিদেশি কিছু পত্র-পত্রিকা এসে পৌঁছল, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে লম্বা লাইন পড়ে গেল। তরুণ-তরুণী ছাড়া বয়স্করাও রয়েছেন সেই লাইনে। আমি আগেও শুনেছি, বিখ্যাত কবিদের নতুন কবিতার বই বেরুলে এখানে লোকে লাইন দিয়ে কেনে। রুমানিয়ানদের মতন কবিতা প্রেমিক জাত খুব কমই আছে। আমরা বাঙালিরা কবিতা নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে আমরা এখনও শতকরা চল্লিশ জনের বেশি মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে পারিনি। শতকরা চল্লিশ জনের মধ্যেও অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পেরোয় না। সুতরাং এরা কবিতার পাঠক হবে, এমন আশা করা যায় না। শতকরা কুড়ি-পঁচিশজন মোটামুটি শিক্ষিত, তাদেরও অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতা নেই। সেই জন্যই জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের দেশে অতি মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষ কবিতা কিংবা সাহিত্যপাঠ করে। আর এই ছোট দেশ রুমানিয়ায় প্রায় সকলেই সাক্ষর। কবিতার বইয়ের যেমন বিক্রি ছিল এখানে, তাতে একজন কবি শুধু কবিতা রচনা করেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারতেন। এমন সংস্কৃতিসম্পন্ন একটি জাতিকে শুধু পেটে মারা হয়েছে তাই-ই নয়, তাদের সুস্থ সংস্কৃতি থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে বছরের পর বছর। পত্র-পত্রিকায় শুধু ভরা থাকত চাউসেস্কু ও তাঁর পত্নীর জয়গান। চাউসেস্কু ও তার চেলাচামুণ্ডারা এমন তাণ্ডব চালালোই বা কী করে এতগুলি বছর? মার্কসবাদের এমন অপব্যবহারের প্রতিবাদ করেননি কেন প্রকৃত মার্কসবাদীরা? আমাদের দেশের কোনও তাত্বিক কি এর আগে কখনও স্বীকার করেছেন যে, রুমানিয়ায় যা চলছে, তা সমাজতন্ত্রও নয়, মার্কসবাদও নয়? তাঁরা কিছুই জানতেন না?