১.০৭ বুডাপেস্ট শহরটি অতি মনোরম

বুডাপেস্ট শহরটি অতি মনোরম তো বটেই, সমগ্র হাঙ্গেরিই প্রকৃতির শোভায় নয়ন সুখকর। একটা সুন্দর শহরে এমনি এমনি হেঁটে বেড়াতেই ভালো লাগে। যেমন প্যারিস, রোম, সানফ্রান্সিসকো, কিয়েভ, ক্যান্টন। বুড়াপেস্ট শহরটিও সেই পর্যায়ের, যদিও এখানে পথের ধারের রেস্তোরাঁ বা দোকানপাটের তেমন বাহুল্য নেই।

নদীর ধার দিয়ে হাঁটলেই বহু দূর থেকেও চোখে পড়ে একটা টিলার ওপরে এক নারী মূর্তি। এটাই এই শহরের স্ট্যাচু অব লিবার্টি। টিলার ওপর রয়েছে একটা পুরোনো দুর্গ, অস্ট্রিয়ান আধিপত্যের স্মৃতি। এর স্থানীয় নাম সিটাডেল্লা। আমরা চার বন্ধু মিলে একদিন উঠে গেলাম সেখানে। দু’ হাতে উঁচু করা পাখির পালক, বিশাল পাথরের নারীটি শান্তির প্রতীক। রুচির দিক থেকে এই মর্তিটিই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এর পাদদেশে এক সশস্ত্র সোভিয়েত সৈনিকের মূর্তিও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। শিল্প সৃষ্টিতে বাহুল্যের মতন পীড়াদায়ক আর কিছুই নয়। কোনও শিল্পীই গোটা ক্যানভাসটা রেখা দিয়ে ভরিয়ে দেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সোভিয়েত বাহিনী যে হাঙ্গেরিকে মুক্ত করে, ওই সৈনিকের মূর্তিটি তার স্মারক। শিল্পের বিচারে মূর্তিটি অপ্রয়োজনীয় তো বটেই, তা ছাড়া ওটা হাঙ্গেরিয়ানদের আত্মাভিমানেও ঘা মারে। ধরে নেওয়া গেল যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে সোভিয়েত বাহিনী এসে জার্মানির কবল থেকে হাঙ্গেরিকে উদ্ধার করে তাদের খুবই উপকার করেছিল, কিন্তু বছরের পর বছর কি তা মনে করিয়ে দিতে হবে? অতি উপকারীর প্রতিও ঘৃণা জন্মে যায়। পরোপকার তখনই মহৎ, যখন তার মধ্যে বিনয় থাকে এবং আত্মপ্রসাদের অভিসন্ধি থাকে না। কোনও রাষ্ট্রনীতিই অবশ্য পরোপকারের ধার ধারে না, স্বার্থের ওপর একটা মিষ্টি মানবতা কিংবা আদর্শের প্রলেপ দেয়।

বুলগেরিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার বিভিন্ন শহরে আমি দেখেছি, একটা পাহাড় বা উঁচু জায়গা পেলেই সেখানে সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে একটা শহিদ মিনার বানিয়ে রাখা হয়েছে, যেখানে অ-শিল্পসম্মত এক সোভিয়েত সৈনিকের মূর্তি দণ্ডায়মান, তলায় লেখাও থাকে যে এইসব সৈন্যরা এই দেশ উদ্ধারের জন্য প্রাণ দিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এখন ওইসব মূর্তি নিয়ে হাসাহাসি করে।

হাঙ্গেরির মানুষ অবশ্য শুধু হাসাহাসি করেনি, ছাপান্ন সালের অভ্যুত্থানের সময় সোভিয়েত সৈন্যরা মূর্তিটি উপড়ে ফেলে দিয়েছিল। পরে আবার একটি অবিকল মূর্তি এনে বসানো হয় এবং দিবারাত্র সেটাকে পাহারা দেওরার ব্যবস্থা হয়েছিল।

বাংলাদেশ-যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতা করেছিল ভারতীয় সেনানীরা। পাকিস্তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিল আঠারো হাজার ভারতীয় সৈনিক। অবশিষ্ট ভারতীয় সৈনিকদের সরিয়ে আনার আগে ভারত সরকার যে বাংলাদেশে এরকম কোনও বিকট মূর্তি বসিয়ে আসেননি, সে জন্য আমরা স্বস্তি বোধ করি। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী ছিল তার চুল চেরা বিচার হবে ইতিহাসে, মূর্তি বা স্তম্ভ বানিয়ে বেশি বেশি জাহির করার তো দরকার নেই।

এই সিটাডেল্লার শাস্তি মূর্তির সামনে গোটা গোটা বুড়াপেস্ট শহরটাকে দেখা যায়। সন্ধের সময় যখন সেতুগুলিতে আলো জ্বলে ওঠে, ঝকঝক করে ড্যানিয়ুব নদী, সেই দৃশ্যটি বুকের মধ্যে গেঁথে যায়।

একদিন আমরা ট্রেনে চেপে গেলাম স্যানন্দর নামে একটি গ্রামে। বুড়াপেস্ট থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে এখানে ড্যানিয়ুব নদী বাঁক নিয়েছে। তার তীরে ছোট্ট একটা গ্রাম। তিনশো বছর আগে তুর্কিদের অত্যাচার থেকে পালিয়ে কিছু সার্বিয়ার ব্যবসায়ী এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর থেকে গ্রামটির চেহারা আর বিশেষ বদলায়নি। যত্ন করে এর পুরোনো রূপটি বজায় রাখা হয়েছে। এখন এখানে প্রচুর শিল্পীর বাস। বলা যায় আর্টিস্টদের একটা কলোনি। এখানে নদীর ধারে চুপচাপ বসে কাটাতেই বেশ লাগে।

হাঙ্গেরিতে এলে বালাতন হদ তো অবশ্য দ্রষ্টব্য। বিশেষত আমাদের পক্ষে। এই হ্রদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে আছে।

আমরা একদিন একটা গাড়ি ভাড়া করলাম। ডলারের হিসেব করলে বেশ সস্তাই বলতে হবে। ডলার ভাঙালে এখানকার টাকা ফোরিন্ট পাওয়া যায় প্রচুর। ফোরিন্ট-এর দাম আমাদের টাকার চেয়েও অনেক কম। সেই জন্য খাবার দাবারও বেশ সস্তা মনে হয়। অবশ্য যদি পাওয়া যায়। ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় সব সময় খাবার পাওয়া দুষ্কর। যখন তখন বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও বা বিরাট একটা মেনিউ কার্ড দেবে, যাতে চল্লিশ-পঞ্চাশ রকম খাবারের নাম, কিন্তু যেটাই চাওয়া হবে, সেটাই নেই। একটি বা দুটি পদ মাত্র লভ্য। তবে, এর আগে, অন্য কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশে দেখেছি, পরিচারক-পরিচারিকারা মুখ গোমড়া করে বলে যায় নেই, নেই, নেই, নেই! যেন না-থাকাটাই নিয়ম। এখানে পরিচারক-পরিচারিকারা নেই বলতে গিয়ে লাজুক ভাবে হাসে। আমাদের অবশ্য খাওয়াদাওয়া নিয়ে তেমন কিছু অসুবিধে হয়নি। হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ অতি বিখ্যাত, এই মাংসের ঝোল আমাদের জিভেও সুস্বাদু। আর পাওয়া যায় স্নািটজেল। আইসক্রিমের জন্যও হাঙ্গেরির খ্যাতি আছে, সব জায়গায় দেখি আইসক্রিমের দোকানের সামনে টুরিস্টদের লাইন। আমি আর বাদল আইসক্রিম পছন্দ করি না, অসীম খুবই ভালোবাসে, ভাস্করের মিষ্টি খুব প্রিয়। কিন্তু ওর খাওয়া নিষেধ। তবু লুকিয়ে-চুরিয়ে দু-একবার খেয়ে ফেলবেই। আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই একটা রেস্তোরাঁয় শুধু মাছের নানারকম প্রিপারেশন পাওয়া যায়, বাইরে সেরকমই লেখা থাকে। কিন্তু আমরা সেখানে মাছ খেতে পারিনি, যখনই যাই, তখনই দোকানপাট বন্ধ।

ব্যক্তিগত মালিকানায় কয়েকটি বেশ বড় বড় রেস্তোরাঁ এখন খোলা হয়েছে, তাতে অনেক কিছুই পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ভিড়ের চোটে ঢোকা যায় না, কিংবা টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

বালাতোন হ্রদে আমাদের গাড়িটি যিনি চালিয়ে নিয়ে যাবেন, তাঁর নাম স্টিফেন। হয়তো উচ্চারণ অন্যরকম, কিন্তু তিনি আমাদের স্টিফেনই বললেন। মোটামুটি ইংরিজি জানেন। কী করে ইংরিজি শিখলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি আমাদের অবাক করে উত্তর দিলেন, ইংরিজি শিখেছি ভারতবর্ষে গিয়ে।

স্টিফেনের বয়েস পঁয়ষট্টির ওপরে, নিরীহ, শান্ত ধরনের মানুষ, এক সময় তিনি ছিলেন ক্রেন অপারেটর, সেই চাকরি নিয়েই গিয়েছিলেন ভারতে, বম্বে এবং গোয়া’র বন্দরে কাজ করেছেন ছ-সাত বছর। এখন অবসর-জীবন। গাড়িটা তাঁর নিজের নয়, মাঝে মাঝে কিছু অতিরিক্ত রোজগারের জন্য তিনি অন্যের গাড়ির ড্রাইভারি করেন। সরকারের কাছ থেকে বার্ধক্য ভাতা পান স্টিফেন, তাতে কোনও রকমে জীবনযাত্রা নির্বাহ হতে পারত। কিন্তু এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় বেশ অসুবিধে হয়। বর্তমান সরকার আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং ভাতা বৃদ্ধির কোনও সম্ভাবনা নেই। স্টিফেনের মুখে চোখে কিন্তু সে জন্য কোনও তিক্ততা বা ক্রোধ নেই, সব কিছুই যেন এক দার্শনিক সুলভ নির্লিপ্ততার সঙ্গে মেনে নিয়েছেন।

বুড়াপেস্ট থেকে বালাতেন যেতে ঘণ্টা দু-এক লাগে। মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই মিষ্টি জলের হ্রদটি ৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। ছোট ছোট পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা এই হ্রদটি চোখ জুড়িয়ে দেয়। হাঙ্গেরিয়ানরা তো বটেই, প্রচুর বিদেশিও এখানে আসে সাঁতার, মাছ ধরা ও নৌকা ভ্রমণের জন্য। ধারে ধারে রয়েছে ছোট ছোট গ্রাম, প্রচুর হোটেল ও অতিথিশালা। এখন অবশ্য শীত পড়ে গেছে। অধিকাংশই বন্ধ। বেলাভূমির অনেক অংশই জনশূন্য। আমরা পৌঁছোলাম দুপুরের দিকে, আগে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। ক্ষুধার্ত উদরে ভ্রমণ তেমন জমে না। কিন্তু একটি খাবারের দোকান খুঁজে বার করতে আমাদের ঘণ্টাখানেক সময় ব্যয় করতে হয়, প্রায় সব রেস্তোরাঁই বন্ধ কিংবা খাদ্য নেই। একটি রেস্তোরাঁ পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত, সেটি সদ্য সরকারি থেকে প্রাইভেট হয়েছে, আমাদের আপ্যায়ন করে খাওয়াল এক অল্পবয়েসি পরিচারিকা। তার উৎসাহ ও ছোটাছুটি দেখেই বোঝা যায়, বেশি বিক্রি হলে তারও কিছু বেশি বেতনের সম্ভাবনা আছে। সরকারি দোকানের বিক্রির কম-বেশি নিয়ে কর্মচারীরা মোটেই মাথা ঘামায় না।

খাওয়া শেষ হলে স্টিফেন নিজের খাদ্যগুলির দাম দিতে চাইলে আমরা না না করে উঠলাম। ভাড়া করা গাড়ি নিলেও সবাই তো ড্রাইভারকে নিয়ে এক সঙ্গেই খেতে বসে। কেউ আবার ড্রাইভারের কাছ থেকে পয়সা নেয় নাকি? কিন্তু এইটুকুর জন্যই স্টিফেন এমনভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলেন যে মনে হল, এক বেলার খাবারের খরচ বাঁচানোও তাঁর কাছে অনেকখানি।

এর আগে একদিন এক হাঙ্গেরিয়ান দম্পতি আমাদের একটা বেশ উঁচু দরের রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওঁদের এক মেয়ে থাকে প্যারিসে। সেই সূত্রে অসীমের সঙ্গে যোগাযোগ। পিতা ছিলেন দেশে হাঙ্গেরির রাষ্ট্রদত। ওঁদের গাড়ি আছে। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। আমরা সব নাম জানি না বলে নানারকম মূল্যবান খাদ্য ও পানীয় ওঁরাই বেছে দিলেন, আমি মনে-মনে একটু সঙ্কুচিত বোধ করছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের জন্য ওঁদের অনেক পয়সা খরচ হয়ে যাবে। আমরা বন্ধুরা সংখ্যায় চারজন এবং কেউই কম খাই না। বিল আসবার পর ভূতপূর্ব রাষ্ট্রদূত বললেন, আমার স্ত্রী ও আমার অংশটুকু আমি দিয়ে দিই? কয়েক মুহূর্ত আমরা চুপ করে ছিলাম। তারপরেই ভাস্কর বলে উঠল, না, না, আপনারা দেবেন কেন। আমরা সবটাই দিয়ে দিচ্ছি! ভদ্রলোক সঙ্গে-সঙ্গে তা মেনে নিলেন। ওই দম্পতিকে কৃপণ মনে করার কোনও কারণ নেই, তাঁদের কথাবার্তা যথেষ্ট পরিশীলিত, কিন্তু দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় বোধহয় অতিরিক্ত কিছু ব্যয় করতে তাঁরা সক্ষম নন। আমার বন্ধু জর্জ সামলিও–কে আমরাই ডিনার খাইয়েছিলাম, কিন্তু তার বিনিময়ে সে পরে আমাদের এক কাপ চা খাওয়ারও নেমন্তন্ন করেনি। এমনও কি হতে পারে যে বাড়িতে বিদেশিদের আমন্ত্রণ করার ব্যাপারে এখনও এদের কোনও দ্বিধা আছে?

খাওয়া দাওয়া সেরে, খানিকক্ষণ একদিকে ঘুরে, তারপর আমরা গাড়ি সুষ্ঠু ওপারে চলে গেলাম একটা ফেরিতে।

রবীন্দ্রনাথ এক সময় ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এই হ্রদের তীরে কাটিয়ে গেছেন কিছুদিন। জায়গাটা পছন্দ করেছিলেন চমৎকার। এখানকার শান্ত নির্জনতায় মন আপনা থেকেই প্রসন্ন হয়ে ওঠে।

কবি সেই ১৯২৬ সালে এখানে একটি গাছ পুঁতেছিলেন। কী গাছ কে জানে, মূল গাছটি নিশ্চয়ই এতদিন বেঁচে নেই, সম্ভবত তার থেকে অন্য চারা জন্মেছে, কেন না, এখন সেই গাছটি দেখলে তার বয়েস খুব বেশি মনে হয় না। হাঙ্গেরির সরকার জায়গাটি যত্ন করে ঘিরে দিয়েছেন। পাশে একটি ট্যাবলেটে ঘটনাটির বিবরণ রয়েছে। তাতে অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে বলা হয়েছে হিন্দু পোয়েট’, তখন এরা সব ভারতীয়কেই হিন্দু বলত। এই স্থানটি বেশ প্রসিদ্ধ, সমস্ত টুরিস্ট গাইড বুকেই রবীন্দ্রনাথের এই গাছটির উল্লেখ আছে, কোনও কোনও গাইড বুকে রবীন্দ্রনাথকে বলা হয়েছে ‘হিন্দি কবি’।

এখানে রবীন্দ্রনাথের যে আবক্ষ মূর্তিটি রয়েছে, সেটি সম্পর্কে আমাদের পশ্চিম বাংলার এক মন্ত্রী একবার একটা বেফাঁস মন্তব্য করে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। তিনি জানতেন না যে ওই মূর্তিটির শিল্পী রামকিংকর বেইজ। শিল্পীর পরিচয় কোথাও লেখা নেই। ইদানীং কালে কাছাকাছি আরও কয়েকটি গাছ পুঁতে গেছেন ইন্দিরা গান্ধি, ভি ভি গিরি ও আরও কয়েকজন রাম-শ্যাম-যদু-মধু ধরনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। গাছ পুঁতে এঁরা রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ হতে চেয়েছিলেন নাকি? বরং ভারত সরকারের টাকায় এঁরা এই স্থানটি আর একটু সুসজ্জিত করতে পারলে সুবুদ্ধির পরিচয় দিতেন।

সরকার কিছু করেননি, কিন্তু বছর আষ্টেক আগে এক বাঙালি দম্পতি বাংলা হরফে রবীন্দ্রনাথের চার লাইন কবিতা সমন্বিত একটি শ্বেত মর্মর ফলকে তাঁদের শ্রদ্ধা অর্পণ করে গেছেন। ভাষার টান বড় টান। এই দূর বিদেশে বাংলা লেখা দেখে আমরা বেশ খানিকটা চাপা হর্ষ অনুভব করি। মাত্র চার লাইন কবিতা, তাও পড়ি বারবার। এই বাংলা লেখায় তবু অন্তত ‘হিন্দু কবি’ ও ‘হিন্দী কবি’র বিভ্রান্তি দূর করতে পেয়েছে খানিকটা।

বিদেশে আমাদের বাংলা সাহিত্য তথা গোটা ভারতীয় সাহিত্যের প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক দেশগুলি রবীন্দ্রনাথকে প্রায় ভুলতে বসেছে। আধুনিক লেখকদের মধ্যেও অনেকে রবীন্দ্রনাথের নামটা শুধু জানে, লেখা কিছু পড়েনি। যারা পড়েছে, তায়াও ঠোঁট উলটে বলে, নট মাই কাপ অফ টি। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে রবীন্দ্রনাথ এখনও খুবই সমাদৃত। বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে জনপ্রিয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানে তাঁর রচনাবলি পাঁচ লাখ কপি ছাপা হলেও অবিলম্বে শেষ হয়ে যায়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেও রবীন্দ্র-অনুরাগীর সংখ্যা অনেক। আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম চিনেদের রবীন্দ্র-প্রীতি দেখে। বাষট্টি সালের পর চিনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন, তারপর একটি প্রজন্ম পার হয়ে গেছে, চিনের যুবক-যুবতীরা ভারত সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। কিন্তু চিনের যেসব লেখক সমাবেশে আমি গেছি, প্রত্যেক জায়গায় আমি রবীন্দ্র-বন্দনা শুনেছি। কোনও কোনও চিনা লেখক বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ চিনা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছেন! এঁরা কেউ শরৎচন্দ্রেরও নাম জানেন না, জীবনানন্দ-তারাশঙ্করের তো প্রশ্নই ওঠে না। রবীন্দ্রনাথ ওদের কাছে কতটা পরিচিত তার উদাহরণ স্বরূপ একটা ঘটনা বলি। ওখানকার সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে একদিন আমাদের মোলাকাত হয়েছিল। বৈঠকি মেজাজে গল্প করতে করতে তিনি এক সময় বললেন, বয়েস হয়ে গেছে, এখন কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। কলম নিয়ে বসলেও কলম কামড়াতে হয়, বার্ধক্যে মানুষের লেখার ক্ষমতা কমে যায়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন মহামানবের কথা আলাদা, তিনি আশি বছর বয়সেও কী বিপুল উদ্যমে লিখে গেছেন।

সাংহাইয়ের এক লেখকদের সভায় আমাকে যখন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন আমি খানিকটা উদ্ধতভাবেই বলেছিলাম, তোমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক প্রশস্তি করছ বটে, কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথকে মোটেই গুরুঠাকুর মনে করি না। তোমাদের কি ধারণা, বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই শেষ কথা। আমি নিজে একজন লেখক হিসেবে এটাকে মোটেই সম্মানজনক মনে করি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের অনেক সমালোচনা করি, তাঁর অনেক লেখা নস্যাৎ করে দিই! রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ না করেও আমাদের দেশে জীবনানন্দ দাশের মতন কবিরা মহৎ কবিতা রচনা করেছেন।

আমার সহযাত্রী হিন্দী লেখক কমলেশ্বর বেশ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। সভা শেষে একজন চিনা লেখক আমার পিঠে হাত দিয়ে বন্ধুর মতন আপন-করা সুরে বললেন, তুমি অন্য দেশে এসে তোমাদের দেশের এত বড় লোক সম্পর্কে এরকম উক্তি করলে কেন? আমি তো বিদেশে গিয়ে আমাদের জাতীয় লেখক লু সুন সম্পর্কে এরকম কোনও মন্তব্য প্রকাশের চিন্তাই করতে পারি না। আমি তাঁকে বলেছিলাম, লু সুন বড় লেখক আমরাও জানি, যেমন তোমরা জানো রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু তুমি কি বিদেশে গিয়ে এই ধারণা দেবে যে লু সুনের পর চিনা সাহিত্য থেমে আছে? সেটা চিনা সাহিত্যের পক্ষে মোটেই গৌরবের কথা নয়।

রবীন্দ্রসাহিত্য বারংবার পাঠ, উপভোগ ও উপলব্ধি ছাড়া বাংলা সাহিত্যে কারুর পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কলম হাতে নেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রাখাই তো স্বাভাবিক। কলম যখন হাতে থাকে না তখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের মন অনেকটা জুড়ে থাকেন এখনও। আমি মাঝে-মাঝে রবীন্দ্রনাথকে স্বপ্ন দেখি, তাঁর সঙ্গে কথা বলি। সেদিন বালাতোন হ্রদের তীরে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির সান্নিধ্যই ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। হ্রদের অন্যান্য অঞ্চলে আর না গিয়ে সেখানেই রয়ে গেলাম অনেকক্ষণ। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমরা সকলেই বেশ খানিকটা আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা কৌতুক গল্পও চালু আছে হাঙ্গেরিতে। হাঙ্গেরিয়ানদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পুরো নামটা উচ্চারণ করা বেশ শক্ত। ওদেশে কেউ যখন খুব মাতাল হয়ে যায়, তখন তার বন্ধুরা তার নেশার পরিমাণ পরীক্ষা করার জন্য জিগ্যেস করে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বানান কর তো। পারবি? এই গল্প শুনে রবীন্দ্রভক্তদের ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত না, কারণ এই গল্পেও প্রমাণ হয় যে ওদেশে সাধারণ মানুষের মনে রবীন্দ্রনাথ কতখানি জড়িয়ে আছেন! মাতাল সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর ওইসব দেশের দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক তফাত। আমাদের দেশের মাতালরা রবীন্দ্রনাথের ধার ধারে না।

বালাতন হ্রদ থেকে ফিরতে-ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। বাড়ির কাছে এসে গাড়ি ভাড়া মেটাবার জন্য আমরা নিজেদের মধ্যে খুচরো খোঁজাখুঁজি করতে লাগলাম। দিতে হবে ছত্রিশ ডলার। কিন্তু আমাদের কোষাধ্যক্ষ বাদলের কাছে খুচরো ঠিক মিলছে না। তখন গাড়ির চালক স্টিফেন খুব মৃদু ও বিনীত স্বরে বললেন, যদি চল্লিশ ডলারই দিয়ে দাও, তা হলে তোমাদের চারজনকে মাত্র এক ডলার করে বেশি দিতে হবে, এমন কিছু গায়ে লাগবে না, কিন্তু ওই চার ডলার আমি পেতে পারি।

বাদল তৎক্ষণাৎ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে, চল্লিশ ডলারই দিচ্ছি।

অসীম আমাকে মৃদু স্বরে বলল, দ্যাখো, এই স্টিফেন যখন ভারতে চাকরি করতে গিয়েছিল, তখন সে ছিল প্যান্ট-কোট-টাই পরা এক শ্বেতাঙ্গ সাহেব, তাই না! আমাদের দেশের লোকেরা নিশ্চয়ই ওকে সাহেব বলে খাতির করত। অথচ ও এখন আমাদের কাছে মুখ ফুটে মাত্র চার ডলার বকশিশ চাইছে। ব্যাপারটা খুব করুণ না!

এখানে বিদেশি সিগারেট খুব দুর্লভ, অনেকের কাছেই লোভনীয়। ভাস্কর স্টিফেনকে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট উপহার দিল। তারপর জিগ্যেস করল, আচ্ছা স্টিফেন, তোমাদের দেশে এই যে কমুনিস্ট রেজিম বদলে গেল, গণতন্ত্র আসছে, এটা তোমার মতে ভালো না খারাপ হল?

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন স্টিফেন। তারপর সংক্ষেপে বললেন, বোধহয় আগেরটাই ভালো ছিল।

ভাস্কর বলল, তাই নাকি? তুমি বুঝি কমুনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলে?

স্টিফেন বললেন, না, আমার সঙ্গে পার্টির কোনও যোগ ছিল না। আমি সাধারণ চাকরি করতাম, কখনও সাতে পাঁচে থাকিনি। তবু আমার মতে, হুট করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বদলের কোনও প্রয়োজন ছিল না।

আমি কৌতূহলী হলাম। এমন স্পষ্টভাবে আগের আমলের সমর্থনে কথাবার্তা আর কারুর মুখে শুনিনি। যারা কট্টর পার্টি মেম্বার ছিল তায়া এখন প্রকাশ্যে নিজেদের পূর্ব পরিচয় দিতে চায় না, উলটো হাওয়ার স্রোতে কথা বলার সাহস নেই। সারাদিন ধরে স্টিফেনের সঙ্গে ঘুরে বুঝেছি, তিনি সরল, সাদাসিধে, ভালো মানুষ, তিনি কারুর মন জোগানো কথা বলবেন না। মিথ্যে কথাও বলবেন না। সুতরাং তাঁর যুক্তিটা শোনা দরকার।

স্টিফেন আবার বললেন, আমি বুদ্ধিজীবীও নই, অর্থনীতিবিদও নই। ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা নিয়ে মাথা ঘামাই না। কলকারখানা ও সব ব্যাবসা সরকার পরিচালনা করবেন, না ব্যক্তিগত মালিকানায় ভালো চলবে, তাও আমি বুঝি না। আমি শুধু ভাবছি, ভবিষ্যতে কী হবে? জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, ট্যাক্স বাড়ছে, সেই তুলনায় উপার্জন বাড়বে কি? আমাদের মতন মানুষরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে তো? আগেকার আমলে খেয়ে পরে বেঁচে তো ছিলাম! কিছু-কিছু কষ্ট হয়েছে বটে, তবু…। এখনকার তরুণ তরুণীরা গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছে। ওদের পক্ষে ওটা মানায়। কিন্তু আমার তো বয়েস হয়েছে, অনিশ্চয়তা দেখলে ভয় হয়।

একটু থেমে স্টিফেন আবার বললেন, সত্তরের দশকে কাদার-এর আমলে আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। তারপর অবস্থা একটু একটু খারাপ হতে লাগল, জিনিসপত্রের অভাব দেখা দিল…

আমার মনে পড়ল, জানোস কাদার অনেকদিন আগে এমন একটা উক্তি করেছিলেন, যা সেই সময়ের সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় ছিল সম্পূর্ণ অভিনব।

আজ যিনি জাতীয় বীর হিসেবে পূজিত, সেই ইমরে নেগিকে বিশ্বাসঘাতক অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলা হয় ১৯৫৮ সালে। সোভিয়েত ট্যাংক এসে গুড়িয়ে দিয়েছিল হাঙ্গেরির গণঅভ্যুত্থান। সেই ট্যাংকবাহিনী আর ফিরে গেল না। হাঙ্গেরিকে বাধ্য করার জন্য সোভিয়েত ব্লক থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হল নানারকম। বুড়াপেস্টে একটি পুরো কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হল, যার প্রধানমন্ত্রী করা হল জানোস কাদার-কে।

কাদার সোভিয়েত ব্লকের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার জন্য সব রকম চেষ্টা করে গেলেও তিনি বুঝেছিলেন, হাঙ্গেরির যুবসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও কৃষকদের মধ্যে যে ক্ষোভ রয়ে গেছে, তা শুধু জোর জবরদস্তি দিয়ে দমন করা যাবে না। কাদারও ছিলেন অনেকটা ‘জাতীয়তাবাদী কমিউনিস্ট’। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে খনি ও কলকারখানায় পরিচালনার ব্যাপারে শ্রমিক কাউন্সিলগুলিকে অনেকটা অধিকার দেওয়া হবে না। অনিচ্ছুক কৃষকদের কৃষি-সমবায়ে যোগ দিতে বাধ্য করা হবে না। নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এইসব প্রতিশ্রুতি তিনি অবশ্য শেষ পর্যন্ত মাটির চাপে রক্ষা করতে পারেননি। তবু চেষ্টা করেছিলেন।

অভ্যুত্থান দমনের পর সাধারণত চলে প্রতিশোধের পালা। কাদার আন্তর্জাতিক যে কোনও ঘটনায় সোভিয়েত লাইন পুরোপুরি মেনে চললেও স্বদেশে বিক্ষুব্ধদের হত্যা, নির্যাতন বা কারাদণ্ডের প্রতি প্রবণতা দেখালেন না। দেশকে গড়ার জন্য সব ধরনের যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোকদের সাহায্য চাইলেন, শুধুমাত্র পার্টির সদস্য হওয়াই যাদের যোগ্যতার মানদণ্ড নয়। দেশের সাধারণ মানুষ যাতে ভয় কাটিয়ে উঠে নিজের নিজের পেশায় মন দিতে পারে, ওপর মহলের খবরদারি ছাড়াও ইচ্ছে মতন পড়তে, লিখতে, ছবি আঁকতে বা কথা বলতে পারে, সেইজন্য তিনি ঘোষণা করলেন, ‘যারা আমাদের বিরুদ্ধে নয়, তারা সবাই আমাদের পক্ষে’ (He who is not against us is with us)।

এটা কমিউনিস্ট দুনিয়ায় এক সম্পূর্ণ নতুন কথা। রুশ বিপ্লবের আগে লেনিন একবার বলেছিলেন, ‘যারা আমাদের পক্ষে নয়, আমাদের শত্রু’। পৃথিবীর সমস্ত কমিউনিস্ট এটাকেই ধ্রুব বাক্য বলে বিশ্বাস করে এসেছে এতদিন। অ-কমিউনিস্ট মাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল। আমরা অল্প বয়েসে যখন স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তখন আমাদেরও এই কথাই শোনানো হয়েছিল। এমনকি কেউ যদি নির্ঝঞ্ঝাট, নির্দল হয়, কেউ যদি নিজেকে মানবতাবাদী বলে, তাকেও প্রতিক্রিয়াশীল বলে ছাপ মেরে দেওয়া হবে। কিছু কিছু মানুষের স্বভাবই এই, তারা কোনও দলে যেতে চায় না। মিছিলে যেতে চায় না। তারা নিরালায় নিজেদের কাজ করে যেতে চায়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, লেখক, শিল্পীদের মধ্যে অনেকে এই স্বভাবের, তারা এক ধরনের উদার মানবতায় বিশ্বাসী, বার সঙ্গে সাম্যবাদের প্রত্যক্ষ কোনও বিরোধ নেই। মানুষের এই নিরালা থাকার স্বভাবটাকে উপেক্ষা করে তাদের দলে টানবার চেষ্টা করে সাম্যবাদীরা, যারা তবুও দলে আসে না তাদের নানা বিড়ম্বনা, গালাগালি ও বাধা সহ্য করতে হয়।

এই গোঁড়ামির কুফল হয়েছে দুটি। কিছু লোক, যাদের জীবনযাত্রায় কিংবা চিন্তাধারায় সাম্যবাদের কিছুমাত্র চিহ্ন নেই, তারা মুখে পার্টির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে অনেক রকম সুবিধে ভোগ করে। এরকম বহু দেখা যায়। একজন অযোগ্য শিক্ষক অন্য অনেক যোগ্য শিক্ষককে সরিয়ে দিয়ে ওপরে উঠে যায় নিছক পার্টি সম্পর্কে গলাবাজির জোরে। এই অভিযোগ বহু শোনা যায়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে এরকম দৃষ্টান্ত ভুরিভুরি হওয়াতেই সাধারণ মানুষের এত ক্ষোভ জমেছিল।

অন্য কুফল হল, পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখানোটাই প্রধান যোগ্যতা হওরার ফলে সমস্ত রকম সমালোচনার পথ বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হল এক দলীয় স্বৈরতন্ত্র। পার্টির নেতাদের যে-কোনও নির্দেশই অলঙ্ঘনীয়। বাইরের লোক পার্টির কোনও সমালোচনা করলে তাদের বলা হবে সি আই এ’র এজেন্ট, ধনতন্ত্রের চাকর ইত্যাদি। আর পার্টির কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে দেওয়া হবে শান্তি। পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্য এমনই চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছোয় যে স্টালিন যখন কোটি কোটি মানুষকে হত্যার আদেশ দেয় তখনও কেউ প্রতিবাদ করে না। রুমানিয়ায় চাউসেস্কু যখন একটি খুদে হিটলার হয়ে ওঠে, তখনও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় তাকে অপসারণের কথা উচ্চারণ করে না কেউ!

প্রায় সব ক’টি সমাজতান্ত্রিক দেশেই বহু লেখক পার্টির নির্দেশে নির্যাতিত হয়েছে। যে-কোনও ব্যাপারেই অন্ধ বিশ্বাস সৃষ্টিশীল শিল্পের অন্তরায়। লেখক-শিল্পীদের চরিত্র গঠনই এই যে তারা কারুর নির্দেশ মেনে চলতে পারে না। এক ধরনের বেপরোয়া ভাব কিংবা ক্ষ্যাপামিই তাদের সৃষ্টির প্রেরণা। যে-কোনও সমাজ ব্যবস্থায় যে-কোনও গলদ দেখালেই তাদের প্রতিবাদ বেরিয়ে আসে। তারা প্রবল রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, সমাজতন্ত্রের কোনও কোনও হাস্যকর দিকের প্রতিবাদ করতে তারা বাধ্য। কিন্তু পার্টির সুরে সুর মিলিয়ে কথা না বললেই কিংবা কিছু লিখলেই সেই লেখককে বলা হবে লোভী, ধনতন্ত্রের উপাসক কিংবা বুর্জোয়াদের দালাল কিংবা আরও বাছা বাছা সব গালাগাল। কেন সেই লোকরা প্রতিবাদ করছেন না বা সুরে সুর মেলাচ্ছেন না, তা ভালো করে বুঝে দেখার চেষ্টা না করেই তাঁর স তো সম্পর্কে সন্দেহ করা হয়। অথচ লেখকরাই তো সমাজের বিবেক! তাদের সমস্তরকম দল মতের ঊর্ধ্বে রাখতে পারলেই সমাজ ও শিল্পের পক্ষে মঙ্গল।

পাস্তেরনাক, সোলঝেনিৎসিন, মিলান কুন্দেরার মতন লেখকরা অযথা নির্যাতিত হয়েছেন। পাস্তেরনাক ক্ষুণ্ণ মনে লেখাই ছেড়ে দিলেন, একজন বিশিষ্ট কবি হয়েও জীবনের অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিলেন অকিঞ্চিকের অনুবাদ কর্মে। নোবেল পুরস্কার পেয়েও নিতে গেলেন না, তারপর তার মৃত্যু অনেকটা দুঃখিত, নীরব প্রস্থানের মতন। এখন আবার মস্কোতে পাস্তেরনাকের রচনা নিয়ে খুব নাচানাচি চলেছে। একদা যাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, এখন তাঁর রচনাই বিশেষ সমাদৃত।

সোলঝেনিৎসিনের রচনা ‘ইভান দেনিশোভিচ-এর জীবনের একদিন’ অনুবাদ করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, যখন কমিউনিস্ট পার্টি এখানে দ্বিধাবিভক্ত হয়নি। সোলঝেনিৎসিন ছিলেন আদর্শ লেখক। পরে যখন তিনি গুলাগ আর্চিপেলেগো লিখলেন, অমনি তিনি অচ্ছুৎ হয়ে গেলেন। দেশান্তরী হতে বাধ্য সোলঝেনিৎসিন, তবু তিনি কখনও স্বদেশের নিন্দে করেননি। অতি সম্প্রতি সেই গুলাগ-কেই একটা বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এবং সোলঝেনিৎসিনকে স্বদেশে ফেরার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যারা তখন সোলঝেনিৎসিনকে অপবাদ দিয়েছিলেন তাদের বিচার কে করবে? সোলঝেনিৎসিন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন এই পুরস্কার।

চেকোশ্লোভাকিয়ায় মিলান কুন্দেরাও খুব বড় মাপের লেখক। আগামী যে-কোনও বছরের মধ্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন। চেক সরকার এঁকেও সহ্য করতে পারেননি, মিলা কুন্দেরা দেশ ছেড়ে চলে যান। তাঁর ‘জোক’ বা ঠাট্টা নামের উপন্যাসটি পড়লেই বোঝা যায় পার্টির নেতাদের হামবড়াই কোন নির্বুদ্ধিতার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এই উপন্যাসের কাহিনিতে একটি কলেজের ছাত্র তার এক বান্ধবীকে একটি পোস্ট কার্ডে চিঠি লেখে, যাতে শুধু লেখা ছিল, ‘লং লিভ ট্রটস্কি’। পোস্টকার্ডটি পৌঁছে যায় ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারির কাছে। তার মতে এটা একটা সাংঘাতিক প্রতিক্রয়াশীল দলিল, কমিউনিস্ট দেশের এক ছাত্র এখনও ট্রটস্কির দীর্ঘজীবন কামনা করছে! আসলে কিন্তু ট্রটস্কি শব্দটার সঙ্গে স্টালিনের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং মেস্কিকোতে নির্বাসিত অবস্থায় স্টালিনপন্থীদের হাতে নিহত বোলশেভিক নেতা ট্রটস্কির কোনও সম্পর্ক নেই। ওটা একটা ঠাট্টা, একটা আদিরসাত্মক ইয়ারকি। ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক গোপন কোড ওয়ার্ড থাকে। ওটাও সে রকম, ট্রটস্কি একটি গোপন অঙ্গ। ছাত্র ইউনিয়নের কট্টর সেক্রেটারি কিংবা লোকাল কমিটির কেউ সেই ঠাট্টা বুঝল না, তারা এটাও বুঝল না যে সত্যিকারের ট্রটস্কিপন্থী হলে কেউ পোস্ট কার্ডে ওভাবে লিখে নিজেকে জাহির করত না। ওই সামান্য ঠাট্টার জন্য ছেলেটির পড়াশুনো বন্ধ হয়ে গেল, তাকে পাঠানো হল কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে, মেয়েটিরও জীবন নষ্ট হয়ে গেল। পার্টির কর্তাদের ওপর কোনও আপিল চলে না। তাদের নির্বোধ জেদে অপচয়িত হল দুটি জীবন।

সেইসব পার্টির কর্তারা আজ পলাতক কিংবা আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে।