১.০৫ দুই জার্মানি এক হওয়ার মূলে

দুই জার্মানি এক হওয়ার মূলে হাঙ্গেরির একটা বিরাট ভূমিকা আছে। সব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই পশ্চিমি দেশগুলির সীমান্তে কঠিন প্রহরায় কাঁটা তারের বেড়া ছিল, এতকাল তারই নাম ছিল ‘আয়রন কারটেইন’। হাঙ্গেরিই প্রথম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অর্গল খুলে দেয় গত বসন্তে। তার জন্যই পূর্ব জার্মানির হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ হাঙ্গেরিতে ঢুকে পড়ে, অস্ট্রিয়া ঘুরে পশ্চিম জার্মানিতে চলে আসতে থাকে।

সাম্প্রতিক সমাজতান্ত্রিক পালাবদলের ইতিহাসে হাঙ্গেরির কাহিনি একেবারে আলাদা ধরনের। হাঙ্গেরিয়ান ক্যুনিস্ট পার্টিই বিশ্বে প্রথম, যারা কোনও বড় রকম আন্দোলন কিংবা চাপের মুখে না পড়েও আত্মসমালোচনা করেছে। নিজেদের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করেছে এবং জোর জবরদস্তির শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছে।

জার্মানি থেকে আমরা চলে এলাম হাঙ্গেরিতে।

ফ্রাংকফুর্টের বিশ্ব বইমেলা সাঙ্গ হয়ে গেছে, এর পরে বাদল ও আমি কয়েকটি দেশ বেড়াবার কথা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। ইউরোপে আমাদের দুই ভ্রমণসঙ্গী ভাস্কর দত্ত ও অসীম রায়। এর আগে আমরা এক সঙ্গে অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছি। এবারেও খবর পেয়ে ওরা দু’জন ছুটি নিয়ে চলে এল হাঙ্গেরিতে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। অসীম অনেক কিছু জানে শোনে, তার স্বভাবটা সাবধানি ধরনের। আর ভাস্কর অতিশয় এলোমেলো ও বেপরোয়া। এই দুই পরস্পরবিরোধী চরিত্রের জন্য আমাদের ভ্রমণ-আড্ড খুব জমে যায়।

বুড়াপেস্ট এয়ারপোর্টে আমাদের রাঁদেভু। বাদল ও আমি ফ্রাংকফুর্ট থেকে। অসীম ও ভাস্করের প্যারিস ও লন্ডন থেকে আলাদা ফ্লাইটে পৌঁছবার কথা। বাদল ও আমি যথা সময়ে পৌঁছে গেলাম, ভাস্করের আরও আগে পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার দেখা নেই। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, লন্ডনের ফ্লাইট এসে গেছে বটে, কিন্তু সেটা অন্য এয়ারপোর্টে। সেটা এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। প্যারিসে যেমন ওলি আর শা দ্যগল নামে দুটি এয়ারপোর্ট আছে, এখানেও সেইরকম। তা হলে ভাস্করের সঙ্গে যোগাযোগ হবে কী করে? একটুক্ষণ চিন্তা করার পর আমি ইনফরমেশন কাউন্টারে গিয়ে অনুরোধ করলাম, শহরের অন্য এয়ারপোর্টটিতে টেলিফোন করে সেখানে একটা ঘোষণা করিয়ে দিতে পারবেন? লন্ডন থেকে আগত যাত্রী ভাস্কর দত্তকে জানিয়ে দিতে হবে যে অন্য এয়ারপোর্টে তার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।

প্ৰথমত ইংরিজিতে এই কথাটা বোঝাতেই অনেকটা সময় লেগে গেল। আগেই জেনে এসেছিলাম হাঙ্গেরিতে ইংরাজি ভাষা প্রায় চলে না। কিন্তু এয়ারপোর্টেও ইংরেজি জানা কর্মী থাকবে না! ইনফরমেশন কাউন্টারের এক তরুণী ডেকে আনল অন্য একজনকে, যে আবার আর একজনকে, তৃতীয়জন আমার কথা বুঝল বটে, কিন্তু এই অনুরোধ তার উদ্ভট মনে হল। অনেক পীড়াপিড়ি করার পর সে বেজার মুখে টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর দায়সারা ভাবে জানাল যে অন্য এয়ারপোর্টে এ নামে কোনও যাত্রী নেই।

কথাটা আমার বিশ্বাস হল না। কিন্তু আর কিছু করার উপায় নেই। আমরা রাত্তিরে কোথায় থাকব তা ভাস্কর জানে না, এই অচেনা শহরে একবার যোগাযোগ হারিয়ে ফেললে খোঁজ পাওয়া খুব মুশকিল হবে। তবু আমার মনে হল, ভাস্কর কিছু একটা ব্যবস্থা করবেই। অসীম পৌঁছে গেল প্যারিস থেকে আমাদেরই এয়ারপোর্টে, যথা সময়ে। তারও খানিক বাদে ভাস্কর এল বীরের ভঙ্গিতে, প্রথমে দুই এয়ারপোর্টের ব্যাপারটা সেও বুঝতে পারেনি বটে, তারপর সে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। এই শহরের অনেক কিছুর হদিশ জেনে নিয়েছে এর মধ্যে।

ট্যাক্সি ড্রাইভারটি অত্যন্ত ভদ্র। এর পরের কয়েকটি দিন আমরা বুড়াপেস্ট শহরে যতবার ট্যাক্সি নিয়েছি, প্রত্যেক ড্রাইভারের ব্যবহার ভালো, কেউ ঠকাবার চেষ্টা করেনি, কেউ বেশি পথ ঘুরিয়ে নিয়ে যায়নি। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডগুলিতে অপেক্ষমাণ ট্যাক্সির ড্রাইভার বই পড়ে সময় কাটায়, একজনের হাতে দেখেছি টমাস মান-এর ‘ম্যাজিক মাউন্টেন’, আর একজনের হাতে এফ ডালি’র লেখা ‘রিট অ্যান্ড রিভোল্ট ইন হাঙ্গেরি’। অধিকাংশ ড্রাইভার

উচ্চশিক্ষিত। পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে একজন ট্যাক্সি চালকের পরিচয় জেনেছিলাম, তিনি নিউক্লিয়ার ফিজিকস-এর ডক্টরেট। ট্যাক্সি ড্রাইভার বলতেই যে বিশেষ শ্রেণির কথা আমাদের মনে আসে, তাদের সঙ্গে এদের কোনও মিলই নেই। উচ্চশিক্ষিতদের ট্যাক্সি চালাবার মতন স্বাধীন পেশা গ্রহণ করার প্রধান কারণ, সরকারি চাকরির তুলনায় এতে উপার্জন অনেক বেশি। যদিও এতে শিক্ষার অপচয় হয়। ট্যাক্সি চালাবার জন্য নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর জ্ঞানের কোনও প্রয়োজন নেই।

ভিসা পাওয়ার জন্য আজকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচিত্র সব নিয়ম। আমরা চারজনেই বঙ্গ সন্তান, কিন্তু ভাস্কর ও অসীম যেহেতু হার্ড কারেন্সির দেশ থেকে আসছে, তাই তাদের ভিসা পেতে কোনও অসুবিধে নেই। আর আমাকে আর বাদলকে দামি হোটেল বুক করার শর্তে ভিসা যোগাড় করতে হয়েছে। অসীম প্যারিস থেকেই ফোন করে একটা থাকার জায়গা ঠিক করে এসেছে, বাদল ও আমাকে নির্দিষ্ট হোটেলে নামিয়ে সে ভাস্করকে নিয়ে চলে গেল।

নাম রয়াল গ্র্যান্ড হোটেল। এটাকে অনায়াসে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন বলা যেতে পারে। অতি সাধারণ হোটেল, অযত্নের ছাপ সর্বত্র, ডাবল বেডেড রুম হলেও আমাদের দেওয়া হয়েছে ছোট্ট একটি ঘর, বিকট বিছানা, বাথরুমে নড়াচড়া করার জায়গা নেই। এরই ভাড়া প্রায় একশো ডলার। নিয়ম রক্ষার জন্য কোনও মতে সেখানে এক রাত কাটিয়ে সকালেই বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে আমরা দুজনে যোগ দিলাম অসীমদের সঙ্গে। ওদের থাকার জায়গাটি চমৎকার। ওরা এক বুড়ির অ্যাপার্টমেন্টে পেয়িং গেস্ট হয়েছে। বেশ বড় বড় দুটি ঘর, আলাদা একটি প্রকাণ্ড বসবার ঘর, পুরোনো আমলের সোফাসেট দিনে সাজানো, ঘর গরম করার জন্য অ্যান্টিক চিমনি। সব মিলিয়ে একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম আছে। দু’জন অতিরিক্ত অতিথি পেয়ে বৃদ্ধা খুব খুশি। কারণ ভাড়া দেওয়া হবে মাথাপিছু। সত্তরের ওপর বয়েস। এককালে বেশ সুশ্রী ছিলেন, আমাদের মায়ের বয়সি, আমাদের সঙ্গে তিনি সস্নেহ ব্যবহার করতে লাগলেন সর্বক্ষণ। আমরা যাতে আরামে থাকতে পারি, আমরা যাতে শহরে পথ না হারিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক দেখতে পারি, সেজন্য তাঁর আগ্রহের অন্ত নেই। কিন্তু মুশকিল এই তিনি ইংরেজি কিছুই বোঝেন না, অসীম ফরাসি চালাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল।

হাঙ্গেরিয়ান ভাষার সঙ্গে শুধু আমাদের কেন, অধিকাংশ ইউরোপিয়ানেরই কোনও পরিচয় নেই। ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই, ফিনোউগ্রিক-এর অন্তর্গত এই ভাষার খানিকটা আত্মীয়তা আছে ফিনিশ আর এস্তোনিয়ান ভাষার সঙ্গে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের লোকেরা বলে, হাঙ্গেরিয়ান ভাষা শুধু হাঙ্গেরিয়ানরাই বোঝে। যদিও এটা বেশ ধনী ভাষা। সাধারণ হাঙ্গেরিয়ানরা ইংরিজি না জানলেও, অস্ট্রিয়া-জার্মানির সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে, অনেকে কিছু কিছু জার্মান বোঝে। অসীম কিছুদিন জার্মানিতে কাজ করেছিল, তাই একটু একটু জার্মান জানে, ক্রিয়াপদহীন বাক্য দিনে বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও পুরো অসুবিধে ঘুচল না। আমরা বাকি তিনজন আকারে-ইঙ্গিতে ও বাংলায় কথা বলা শুরু করতে দেখা গেল মোটামুটি কাজ চলে যাচ্ছে।

একদিন দুপুরে বেশ মজা হল। আমরা অলসভাবে আড্ডা দিচ্ছি, বৃদ্ধা আমাদের বারবার তাড়া দিচ্ছেন বাড়ি থেকে বেরুবার জন্য। অবোধ্য ভাষায় তিনি কী যে বলে যাচ্ছেন কিছুই বুঝি না, আমরা ঘর ভাড়া নিয়েছি, যখন খুশি আসব–যাব এই দুপুরবেলা আমাদের ঘরছাড়া বারবার উদ্দেশ্য কী?

অসীম বলল, ট্যুরিস্টরা সক্কালবেলা উঠেই চান-টান করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে সারাদিনের জন্য বেড়িয়ে পড়ে। আর তোমরা ভেতো বাঙালির মতন পাজামা পরে দুপুর একটা পর্যন্ত শুয়ে বসে আড্ডা মেরে যাচ্ছ, এটা বুড়ির সহ্য হচ্ছে না!

ভাস্কর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, বাজে বকো না। আমরা বেড়াতে এসেছি বলে সর্বক্ষণ পায়ে চাকা বেঁধে দৌড়তে হবে নাকি? দেখার জিনিসগুলো তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না!

আমাদের চারজনের মধ্যে অসীমই বৃদ্ধার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছে দুটি কারণে। সে কিছু কিছু জার্মান শব্দ জানে, সকালে উঠেই সে প্যান্ট শার্ট পরে নেয়। আমি আর ভাস্কর বাড়িতে পাজামা পাঞ্জাবি পরেই থাকি আর বাদলের লুঙ্গি না হলে তো চলেই না। এই পোশাকেই আমরা ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসি, সেটা বদ্ধার পছন্দ নয়, প্রত্যেক সকালে তিনি আমাদের তিনজনকে ভর্ৎসনা করেন আর অসীমের শার্ট-প্যান্টের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, এলিগাঁস! এলিগাঁস!

ভাস্করের পাঞ্জাবিটা অত্যন্ত সুদৃশ্য কাজ করা, আর পাজামাও ধপধপে ফরসা, সেই পাঞ্জাবি পাজামার তুলনায় সাধারণ শার্ট-প্যান্ট কেন বেশি এলিগ্যান্ট হবে তা বোঝা দুষ্কর। বৃদ্ধা পুরোনো ইউরোপীয় আদব-কায়দায় বিশ্বাসী। কিন্তু তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে এমন এলোমেলোভাবে সব কিছু ছড়ানো যে এখানে আদব-কায়দা মানার প্রশ্নটাও কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয়।

সেই দুপুরে আমাদের বাইরে যার করবার জন্য বৃদ্ধা এত বেশি উত্যক্ত করতে লাগলেন যে আমরা বাধ্য হয়েই পোশাক পালটে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের বাড়িওয়ালা কোনও পুরুষ হলে কিংবা অল্পবয়সি মেয়ে হলে ভাস্কর নিশ্চিত তাকে ধমক লাগাত, ইনি মায়ের বয়সি মহিলা বলেই কিছু বলা যায় না। আমরা তাঁকে ডাকি মাদাম। মাদামও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেন একটা ছাতা হাতে নিয়ে। রাস্তায় নামার পর তিনি আমাদের একজনের হাত ধরে টানলেন, অর্থাৎ তাঁর পিছ-পিছ যেতে বলছেন। কোথায় নিয়ে যেতে চান তা কিছুই না বুঝে অনুসরণ করলাম। দু’তিনটে বাঁক ঘোরার পর একটা পাহাড়ের গায়ে লম্বা সিঁড়ির কাছে এসে থেমে মাদাম আঙুল দিয়ে ওপরের দিকটা দেখিয়ে দিলেন।

এবার বোঝা গেল। এই বুড়া হিলের ওপর রয়েছে ম্যাগডোলেন টাওয়ার। এটা এ শহরে একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান। ম্যাপ দেখে গেলে হয়তে আমাদের অনেক ঘোরাঘুরি করে যেতে হবে। তাই মাদাম আমাদের কিছুটা সংক্ষিপ্ত সিঁড়ি-পথ দেখাতে চাইছিলেন। পেয়িং গেস্ট টুরিস্টদের জন্য এতখানি যত্ন ও ব্যক্তিগত উদ্যম নেওয়ার নজির খুবই দুর্লভ!

বুডাপেস্ট অতীব মনোহর নগর। সবাই জানে যে বুড়া আর পেস্ট মানে দুটি আলাদা শহরকে এক সঙ্গে জোড়া হয়েছে। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ড্যানিয়ুব নদী। সেই নদী,

যার নাম শুনলেই একটা সঙ্গীতের ঝঙ্কার মনে আসে। নদীর দু দিকের দুটি শহরের বহিরঙ্গের বেশ তফাত। বুড়া শহরটি প্রাচীন, ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর গথিক ও বারোক স্টাইলের গির্জা ও প্রাসাদ রয়েছে অনেক, রাস্তাগুলো ঢেউ খেলানো। আর পেস্ট একেবারে সমতল, আধুনিক কালের দেশলাইয়ের বাক্স মার্কা বাড়িই বেশি।

আমাদের বাড়িটি নদীর খুব কাছেই। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার নদী সন্দর্শন হয়। ড্যানিয়ুব এখানে বেশ চওড়া, আমাদের কলকাতার গঙ্গার চেয়ে সামান্য কম হবে। নদীর দু’ধারেই প্রশস্ত, সুসজ্জিত রাস্তা, সেখান দিয়ে শুধু হাঁটতেই ভালো লাগে। অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান এমপায়ারের সময় এখানে প্রচুর ধনী ব্যক্তিদের সমাবেশ হয়েছিল। সেই চিহ্ন রয়ে গিয়েছে বড় বড় গির্জা ও বিলাসী হর্মে। আমাদের দিকে নদীর পাড়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে অন্য পারে এক বিশাল নিও গথিক প্রাসাদ। এটা এখানকার পার্লামেন্ট। নদী পারাপারের সময় বহু দূর থেকেও এটা চোখে পড়বেই। এত বড় এবং জমকালো এই পার্লামেন্ট ভবন কিন্তু গণতান্ত্রিক লোকসভা হিসেবে বিশেষ ব্যবহৃত হয়নি।

আয়তন ও লোকসংখ্যায় বুড়াপেস্ট শহর কলকাতার থেকে ছোট, কিন্তু কলকাতার গঙ্গায় বালি ব্রিজ ধরে দুটি মাত্র সেতু। তৃতীয় নির্মীয়মান সেতুটি দীর্ঘসূত্রতায় গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে স্থান পেতে চলেছে, অথচ এখানে ড্যানিয়ুবের ওপর আটটি সেতু। এই সব কটিই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকটিকেই আগের মতন পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এসব আমাদের কল্পনাতীত।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হাঙ্গেরি এক দারুণ দোটানার মধ্যে পড়েছিল। যুদ্ধ যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন হাঙ্গেরি কোন পক্ষ নেবে তা ঠিক করতে পারেনি। হাঙ্গেরির সৈন্য অস্ত্র যৎসামান্য, অস্ত্রশস্ত্রও অধিকাংশই জার্মানি থেকে আসে। হিটলারের জার্মানির মতন প্রবল প্রতিবেশীকে চটাবার সাধ্য হাঙ্গেরির নেই। তা ছাড়া এখানেও নাতসি চিন্তাধারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এক শ্রেণির মধ্যে, তারা রাশিয়ার বোলশেভিকদের পছন্দ করে না। স্বদেশের ইহুদিদের প্রতিও বিদ্বেষী, সুতরাং এই শ্রেণি জার্মানদের সমর্থক। আবার বামপন্থী ও মধ্যপন্থীরা হিটলারের নীতি ঘৃণা করে, উল্লেখযোগ্য ইহুদি জনসাধারণও হিটলারবিরোধী। আরও একটি শ্রেণির সমর্থন পশ্চিমি দেশগুলির প্রতি।

কিন্তু হাঙ্গেরির শাসকশ্রেণি ও সেনাপতিদের ধারণা হয়েছিল যে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না এবং জার্মানিরই জয় হবে। সেইজন্য তারা জার্মানিকে মৌখিক সমর্থন জানিয়ে ভেতরে-ভেতরে পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হাঙ্গেরি গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেছিল কিছুদিন। কিন্তু এই সুবিধাবাদ অচিরেই বুঝে গিয়েছিল হিটলার। বারবার সে হাঙ্গেরিকে যুদ্ধে টানতে লাগল। যুগোশ্লাভিয়া আক্রমণ করার পর নাতসি হাঙ্গেরিকে বলল সৈন্য পাঠাতে। এদিকে যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে হাঙ্গেরি ‘চির বন্ধুত্ব’ চুক্তি করে বসে আছে। একদিকে চুক্তি পালন, অন্যদিকে হিটলারের চোখ রাঙানি, এর মধ্যে মনঃস্থির করতে না পেরে হাঙ্গেরির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টেলোকি আত্মহত্যা করে বসলেন।

হিটলার যখন সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করে তখন হাঙ্গেরি ভেবেছিল প্রবল জার্মান বাহিনীর কাছে স্টালিনের ফৌজ দু-দশ দিনে বশ্যতা স্বীকার করবে। হাঙ্গেরি অল্প কিছু সৈন্য পাঠিয়ে হিটলারকে খুশি করতে গেল, কিন্তু যুদ্ধ চলতে লাগল দীর্ঘকাল। জার্মানি এবার হাঙ্গেরিকে বাধ্য করাল তার সমস্ত যুদ্ধ উপকরণ এবং সমর্থ ব্যক্তিদের সোভিয়েত ফ্রন্টে লড়াই করতে। অর্থাৎ হাঙ্গেরি এখন পুরোপুরি হিটলার-মুসোলিনির তল্পিবাহক। দেশের সরকার অবশ্য তখনও হিটলারের রোষ থেকে ইহুদি ও বামপন্থীদের রক্ষা করে চলেছিল এবং মনে মনে আশা ছিল, ইংরেজ-আমেরিকানদের যদি এ যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তা হলেই হাঙ্গেরি নাতসিদের পরিত্যাগ করে পশ্চিমি শক্তির সঙ্গে যোগ দেবে। দেশের প্রেসিডেন্ট হার্থি গোপনে বেশ কয়েকবার ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর কাছে খবর পাঠালেন যে তারা হাঙ্গেরির সীমান্তে পৌঁছলেই হাঙ্গেরি বিনা শর্তে আত্মসমর্পন করবে।

কিন্তু যুদ্ধের গতি অনেক জটিল হয়ে গেল। হাঙ্গেরির পশ্চিম সীমান্তে ইঙ্গ-মার্কিন ফৌজ এলই না, বরং পূর্ব সীমান্তে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে হাঙ্গরির বাহিনী সাঙ্ঘাতিক মার খেল। হাঙ্গেরির সামরিক শক্তি এমন কিছু আহামরি ছিল না। এই আঘাতে তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্যসংখ্যা প্রায় নিঃশেষ হবার মতন অবস্থায় পৌঁছোলো। সোভিয়েত বাহিনী এগিয়ে আসছে। হিটলারও প্রেসিডেন্ট হার্থির দু’মুখো নীতি ধরে ফেলেছে। হিটলার হার্থিকে ডাকিয়ে এনে খুব একচোট ধমক দিয়ে দুটি শর্ত দিল। হয় জার্মান ব্যবস্থাপনায় পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে, নয়তো হাঙ্গেরি পুরোপুরি জার্মানির অধিকারে চলে আসবে এবং শত্রু দেশের মতন ব্যবহার পাবে। দ্বিতীয়টি যে কী রকম তা পোল্যান্ডেই দেখা গেছে, সেই মতো প্রেসিডেন্ট মেনে নিল প্রথমটি। এবার জার্মান গেস্টাপোরা এসে সারা দেশে দাপট দেখাতে লাগল। বামপন্থী দলগুলি তছনছ করে নেতাদের গ্রেফতার করল। ইহুদিদের ধরে ধরে পাঠাতে লাগল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কিংবা গ্যাস চেম্বারে। হাঙ্গেরিয়ানদের কার্যত কোনও স্বাধীনতা রইল না এবং মুক্ত বিশ্বের চোখে তারা নাতসিদের পদলেহী বলে গণ্য হল।

অগ্রসরমাণ সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে জার্মানদের মুখোমুখি লড়াই হয় হাঙ্গেরির ভূমিতে। সে লড়াই বেশিদিন চলেনি। জার্মান-হাঙ্গেরিয়ান যৌথ ফৌজ পিছু হঠতে লাগল। তারপর সোভিয়েত ট্যাংক-বাহিনীর সামনে হাঙ্গেরিয়ানদের ফেলে রেখে এক সময় জার্মানরা পালাল।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরাজিত হাঙ্গেরিয়ানদের মেনে নিতে হল অনেক অপমানজনক শর্ত। দেশের কিছুটা অংশ কেটে দিয়ে দেওয়া হল চেকোশ্লোভাকিয়াকে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির জন্য তাদের অর্থদণ্ড দেওয়া হল তিরিশ কোটি ডলার। ইচ্ছেমতো সেনাবাহিনী গড়ার আর অধিকার রইল না। এই সব শর্ত ঠিক মতন পালিত হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব মিত্রশক্তির চুক্তি অনুযায়ী বর্তাল দখলদার বিরাট সোভিয়েত বাহিনীর ওপর। বছরের পর বছর সোভিয়েত বাহিনী যে দেশের বুকে চেপে বসে আছে, সেখানে যে কমিউনিস্ট পার্টিই শাসন ক্ষমতা পেয়ে যাবে, তা খুবই স্বাভাবিক। এর মধ্যে বহু লোক দেশত্যাগী হয়েছে, নাৎসী সংসৰ্গদোষের জন্য বহু লোককে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হয়েছে, নিছক সন্দেহে বহু লোক কারারুদ্ধ। বছর চারেক ধরে নানা রকম বিশৃঙ্খলার পর কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ণ ক্ষমতায় এসে গেল। সোভিয়েত সংবিধানের অনুকরণে এখানে জারি হল নতুন সংবিধান, হাঙ্গেরিয়ান রিপাবলিকের নতুন নাম হল হাঙ্গেরিয়ান পিপলস রিপাবলিক।