১৯. প্রশান্ত মহাসাগর

প্রশান্ত মহাসাগর আমি প্রথম দেখি লস এনজেলেস-এ। বেয়াড়া বেখাপ্পা বিরাট শহর। একা ও শহর ভ্রমণ ভালো লাগে না। আরিজোনা থেকে সানফ্রানসিসকো যাবার পথে নেহাত ও শহরে নেমেছি–একবার হলিউড ঘুরে যাব বলে। একবার ঘুরে যাওয়াই ভালো, নইলে সারাজীবন মনে হবে–হলিউড বুঝি কী এক আশ্চর্য অপরূপ রূপকথার রাজ্য, আমার সেখানে গিয়ে নিশ্বাস নেওয়া হয়নি। বরং ঘুরে গেলে জানতে পারব, সেও সাধারণ, হলিউড আর পাঁচটা জায়গারই মতন, দৃশ্য হিসেবে একঘেয়ে, নিজের কাজ বা বন্ধু না থাকলে বিরক্তিকর–অর্থাৎ বড় সাইজের বোমবাই!

লস এনজেলেসে নেমেই কিন্তু হলিউডের বদলে আমার মনে হল প্রথমেই প্রশান্ত মহাসাগর দেখে আসি। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে এই প্রথম এলাম। এর আগে আটলান্টিক পেরিয়ে এলে কী হয়–প্রশান্ত মহাসাগরে কথা আলাদা। সে জলধিরাজ, তার বুকে হিমালয় ডুবে যায়। প্রশান্ত মহাসাপরকে দেখা, পৃথিবীর বৃহত্তমকে দেখা।

সমুদ্র কোনদিকে তা কখনও খুঁজতে হয় না। সমুদ্র পাড়ের শহরে নেমেই যেন হাওয়ায় পাওয়া যায় সমুদ্রের গন্ধ। আমি বাসে চেপে বসলুম।

আমেরিকার পূর্ব আর পশ্চিম উপকূলের মধ্যে কিছুটা রেষারেষি আছে। পূর্ব উপকূলের নিউ ইয়র্ক শহর সারা পৃথিবীর চোখ এমন টেনে রেখেছে যে, পশ্চিম উপকূলের এ নিয়ে কিছুটা ঈর্ষা আছে। এজন্য লস এনজেলেস মাঝে-মাঝে দাবি করে–সে নিউ ইয়র্কের চেয়ে বড়। কিন্তু নিউ ইয়র্কের প্রাধান্য তো শুধু দৈর্ঘ্যে নয়, নিউ ইয়র্ক ইউরোপের সবচেয়ে কাছে। আর লস এনজেলেস প্রাচ্যের দ্বার–সেখান থেকে সোজা আসা যায় জাপানে। লস এনজেলেসের আয়তন বিপুল, মাইলের পর মাইল বাস চলেছে–কিন্তু কেমন যেন ছন্নছাড়া, মনে হয় যেন কয়েকটা ছোট ছোট শহর জুড়ে একটা বিরাট শহর।

বাস থামার পরও কাউকে কিছু জিগ্যেস করিনি, হাওয়ার গন্ধ শুকে এগিয়ে গেছি। চওড়া রাস্তার পাশে-পাশে বহু বিচিত্র দোকান। গাছের লাইন করা পার্কের মতো বহু বসার আসন। তার পাশে দেয়াল, ওপারে ঝড়ের গর্জন। আমি হাঁটতে-হাঁটতে এসে দেয়াল ধরে উঁকি দিলাম। প্রশান্ত মহাসাগর।

দেয়ালের পাশে সিড়ে বেয়ে নীচে নেমে এলাম বালির পাডে। নরম কাঁকড়া ভরা বালির ওপর দিয়ে হেঁটে-হেঁটে এলাম জলের প্রান্তে, আমার পায়ে জল লাগল সমুদ্রের। কাঠের বিরাট পোল দিয়ে একটা জেটির মতো করা আছে, সেখানে অসংখ্য সমুদ্রমাছের দোকান। জেটির ওপর পর্যন্ত চলে এসে ঝুঁকে দাঁড়ালাম জলের দিকে। আমার পায়ের নীচে বিশাল বাধাহীন সমুদ্র।

আমার উচিত হয়নি প্রশান্ত মহাসাগরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা। কারণ সমুদ্র দর্শনের পর আমি কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে তো পারলুম না। জলধিরাজ প্রশান্ত মহাসাপরকে দেখার জন্য যে উৎকণ্ঠা, সে আমার ব্যক্তিগত এবং দেখার পর যে নৈরাশ্য সেও আমার ব্যক্তিগত। কারণ জেটির ওপর দাঁড়িয়ে অকূল প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমি বললাম, আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল। আগেই বোঝা উচিত ছিল, প্রশান্ত মহাসাগর আর বঙ্গোপসাগর দৃশ্যত একই। একই সমুদ্র, অন্তহীন নীল জল

কোনও তফাত নেই, দীঘা আর লস এনজেলেসের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও তফাত নেই। বিরাটত্ব যা কিছু শুধু মানচিত্রে।

হলিউডের কথাও থাক। লস এনজেলেসে নিগ্রো-সাদায় দাঙ্গা আরম্ভ হয়েছে তখন, সুতরাং আমার অন্য কথা মনে পড়ছে।

গ্রে হাউন্ড বাসে চেপে লস এনজেলেস শহর পৌঁছে প্রথমে আমার একটু অসোয়াস্তি লাগছিল। একবেলা ঘোরাঘুরি করার পরই বুঝতে পারলুম, শহরটা কুৎসিত। আমার পছন্দ হবে না। নিউ ইয়র্কের বিশাল প্রাণ এখানে নেই। এ শহর শুধু ধনী আর দরিদ্রের -সাধারণ মানুষের নয়। এখানেই ফিলম তৈরির সবচেয়ে বড় কারখানা বলেই বোধহয় চলচ্চিত্রভবনগুলি এমন কুৎসিত। চোখের সামনে দিবারাত্র চিত্র-তারকাদের দেখেই বোধহয়–এখানে মানুষের সিনেমা দেখার ইচ্ছে খুব কম। অধিকাংশ সিনেমা হলে এক সঙ্গে দুটো করে বই দেখানো হয়, সেই সঙ্গে ওই একই টিকিটে স্ট্রিপটিজ।

ওই স্ট্রিপটিজ সমেত সিনেমা হলেই আমি শুনেছিলাম কালো লোকদের আলোচনা। মঞ্চে ওই সব দৃশ্য, ওরা তখন ঘাড় নীচু করে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এক সময় কান পেতে শুনলাম, সাদা লোকদের গালাগাল। দুনিয়ার সমস্ত সাদা জাতের উপর ওদের ক্রোধ যেন বিষম এক বিপ্লবের ষড়যন্ত্র আঁটছে। পথে পথেও দেখেছি নিগ্রোদের তিক্ত বিদ্রোহী মুখ। নিউ ইয়র্ক বা অন্যত্রও দেখেছি অনেক কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতকায় বন্ধুর মতো পাশাপাশি গল্প করতে-করতে যাচ্ছে। লস এনজেলেসে একজনও দেখিনি।

আমি শহরের একটা ম্যাপ কিনতে ঢুকেছি দোকানে। দোকানের মালিক শ্বেতকায়, আমাকে নবাগত দেখে জিগ্যেস করল, তুমি স্প্যানিস বুঝি? মেকসিকো না সাউথ আমেরিকার?

আমাকে অতি কষ্টে বোঝাতে হল। আমি তাদের কেউ নেই। লোকটি তখন আমাকে বলল, নতুন এসেছো, সাবধান হয়ে ঘুরো রাত্রে। জায়গাটা ভালো নয়। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে আবার বলল, বিশেষ করে নিগ্রোদের খুব সাবধান।

একদিন একটা দোকানে চুল কাটতে ঢুকেছি। তিনজন বিশালকায় কালো নাপিত। কী যেন এক উত্তেজিত আলোচনা করছিল–আমাকে দেখে খুশি হল না। খরিদ্দার না এলেই যেন ওদের ভালো। অবহেলা আমার চুল কাটতে-কাটতে আবার ওরা আলোচনা চালিয়ে গেল। বুঝতে পারলুম, মালিকের নামে ওরা গালাগাল দিচ্ছে। যেন মালিককে এখনই হাতের সামনে পেলে মুণ্ডুটা ছিঁড়ে নেবে। মাঝে-মাঝে তখন, সকাল বেলাতেই, বোতল থেকে ঢকঢক করে গিলে খাচ্ছে কাঁচা জিন।

একটু পরেই একজন শ্বেতকায় লোক ঢুকলো। লোক তিনটি কথা বন্ধ করে অমনি শান্ত হয়ে গেল। বুঝলুম, ওই লোকটাই মালিক। মালিক বাক্স থেকে টাকা পয়সা হিসেব করে সব নিয়ে আবার চলে গেল। চলে যেতেই আবার রাগে ফেটে পড়ল তিনজন। মালিকের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে উঠল, একজন হাতের খালি বোতলটা দড়াম করে ভাঙল মাটিতে। কাঁচ ছিটকে এসে লাগল আমার পায়ে পর্যন্ত।

সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, ওই লোকগুলো অবিলম্বেই একদিন বোতলটা মালিকের মাথাতেই ভাঙবে। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অশান্তি কম নয়।