১৮. রিভলভার

কাকাবাবু রিভলভারটা তুলেই দেয়ালের দিকে সরে গেলেন। তারপর রিভলভারটা টিপ করে রাখলেন লোকটির মাথার দিকে।

পড়ে যাবার পর লোকটি কোনও শব্দও করল না, একটুও নড়ল না। একই জায়গায় পড়ে রইল, উপুড় হয়ে। কাকাবাবু ভাবলেন, পাথরে মাথা ঠুকে কি অজ্ঞান হয়ে গেল লোকটি? কিন্তু অত জোরে তো পড়েনি! ও অন্য কোনও কায়দা করার চেষ্টায় আছে?

কাকাবাবু কঠোরভাবে বললেন, আপনি উঠে বসুন, তারপর আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিন। কোনওরকম ছেলেমানুষি করতে যাবেন না, আমার টিপ খুব ভাল, এক গুলিতে আপনার মাথাটা ছাতু করে দিতে পারি।

লোকটি তবু নড়ল না।

কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, তিনি এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে টেনে তোলার চেষ্টা করলেই সে তখন তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

কাকাবাবু কুকুরটাকে ছুঁড়ে দেবার পরই সেটা ভয় পেয়ে পালিয়েছে। খানিকটা দূরে গিয়ে কুঁই-কুঁই করে ডাকছে। কাকাবাবু সেদিকে মনোযোগ দিলেন না। লোকটির উদ্দেশে আবার বললেন, আমি এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনব। তার মধ্যে উঠে না বসলে আমি আপনার গায়ে গুলি করব! এক-দুই-

সঙ্গে-সঙ্গে দারুণ জোরালো সার্চ লাইটের আলোয় ভরে গেল সুড়ঙ্গটা। এতই জোর আলো যে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল কাকাবাবুর। তিনি এক হাত দিয়ে চোখ আড়াল করলেন।

লোকটি এবার উঠে বসিল আস্তে-আস্তে।

কাকাবাবু তাকে হুকুম দিলেন, আলোর দিকে পেছন ফিরে বসুন। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করবেন না।

এবার গাম-গম করে উঠল মাইক্রোফোনের আওয়াজ। কে যেন একজন বলল, অ্যাটেনশন প্লীজ! মিঃ রায়চৌধুরী, ক্যান ইউ হীয়ার মি? মিঃ রায়চৌধুরী, আপনার হাতের পিস্তলটা ফেলে দিন! প্লীজ।

কাকাবাবুঘাড় ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করলেন, সুড়ঙ্গের মধ্যে কোথায় লাউড স্পীকার ফিট করা আছে। কিছু দেখতে পেলেন না। ভাল করে পারছেন না তো!

মাইক্রোফোনের আওয়াজে আবার সেই কথাটা ভেসে এল।

কাকাবাবু এবার উত্তর দিলেন, হু এভার ইউ আর-সামনে এসে কথা বলুন, আমি এখন পিস্তল ফেলব না।

মাইক্রোফোনের আওয়াজটা থেমে গেল। হঠাৎ দারুণ স্তব্ধ মনে হল জায়গাটা। মুখোশপরা লোকটিকাকাবাবুর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোন দেশের লোক?

লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে হাসল।

কাকাবাবু বললেন, উত্তর না দিলে আমি গুলি করব?

লোকটি তবু অবাধ্য ভঙ্গিতে ঝাঁকাল তার কাঁধ দুটো।

এইসময় গটগট শব্দ হতেই কাকাবাবু চমকে তাকালেন। ঠিক একইরকম হলদে মুখোশপরা তিনজন লোক অনেকটা মার্চ করার মতন একসঙ্গে হেঁটে আসছে এদিকে। তাদের হাতে বেশ লম্বা রিভলভারের মতন কোনও অস্ত্ৰ।

তারা কাছাকাছি আসতেই কাকাবাবু বললেন, সাবধান, আর এগোবেন না! তাহলে আমি এই লোকটিকে মেরে ফেলব।

লোকগুলো তবু থামল না, তাদের মধ্যে একজন ইংরেজিতে বলল, মারুন! ওকে মারুন!

চোখ-ধাঁধানো আলোর মধ্যে মুখটা একপাশে ফিরিয়ে কাকাবাবু রিভলভারের নলটা উঁচু করে ট্রিগারে হাত দিলেন।

লোক তিনটি কাকাবাবুর একেবারে পাশে এসে দাঁড়াল। একজন বলল, কই, ওকে মারলেন না? ট্রিগার টানলেন না?

কাকাবাবু বললেন, মানুষ মারা আমার পেশা নয়। বিশেষত কোনও নিরস্ত্ৰ লোককে অস্ত্ৰ দিয়ে আমি আক্রমণ করি না কখনও

সেই লোকটি বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, দয়া করে এখানে গোলমালের সৃষ্টি করবেন না। আপনার ওপর আমরা কোনও অত্যাচার করতে চাই না-

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কে?

আপনার কোনও প্রশ্ন করাও চলবে না এখানে। আমরাই প্রশ্ন করব। আপাতত আমরা আপনার চোখ বেঁধে দিতে চাই।

না!

আমাদের জোর করতে বাধ্য করবেন না।

আপনারা দেখছি ভদ্রতার প্রতিমূর্তি! শুনুন, আমি মানুষ মারার জন্য গুলি চালাই না ঠিকই, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য কারুর পা খোঁড়া করে দিতে পারি। আপনারা আমার গায়ে হাত দিলেই আমি এই লোকটির পায়ে গুলি করব।

ঠিক আছে, ওকে গুলি করুন না? খোঁড়া করে দিন। ওর একটু শাস্তি পাওয়া দরকার!

আগের লোকটি এবার ভয় পাবার ভঙ্গিতে বলে উঠল, ওরে বাপ রে, না না! আমার মাথায় খুব জোর লেগেছে, উনি এত জোর ল্যাং মেরেছেন?

দুজন লোক কাকাবাবুর কাঁধে হাত রাখতেই তিনি ওদের ভয় দেখাবার জন্য গুলি চালালেন। আমনি তাঁর রিভলভারের মধ্যে ঘর-র ঘর-র শব্দ হল আর মুখটায় এক ঝলক আলো জ্বলে উঠল। কিন্তু গুলি বেরুল না।

লোকগুলি হেসে উঠল। হা-হা শব্দে। মাটিতে বসা লোকটিও যোগ দিল সেই হাসিতে।

কাকাবাবু একই সঙ্গে অবাক ও বিরক্ত হয়ে রিভলভারটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন।

একজন মুখোশধারী বলল, এবার বুঝেছেন নিশ্চয়ই যে, ওটা একটা খেলনা পিস্তল?

কাকাবাবু সেটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, একটা খেলনা পিস্তল দিয়ে আর ইয়েতির পোশাক পরিয়ে এই ক্লাউনটিকে আপনারা আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন কেন? আপনারা কি ভেবেছিলেন, আমার মতন মানুষ এতে ভয় পাবে?

তিনজন মুখোশধারীর মধ্যে একজনই সব কথা বলছিল। সে বলল, আমাদের এখানকার জীবনে কোনও বৈচিত্র্য নেই, তাই আপনার সঙ্গে একটু মজা করা হল। আমাদের হাতের এগুলো কিন্তু খেলনা নয়! দেখবেন?

লোকটি সেই রিভলভারের মতন অস্ত্রটা কাঁধের ওপর রেখে পেছন দিকে গুলি চালাল। সাধারণ রিভলভারের থেকে শব্দ হল অনেক বেশি, দেয়ালে গুলি লেগে পাথরের চলটা ছিটকে পড়ল নানান দিকে, তার একটা কাকাবাবুর গায়েও লাগল।

লোকটি। এরপর বলল, নাম্বার সেভেন, উঠে দাঁড়াও, মিঃ রায়চৌধুরীর চোখ দুটো ভাল করে বেঁধে দাও!

কাকাবাবু বললেন, কেন, আপনারা আমার চোখ বাঁধতে চাইছেন কেন?

ছিঃ ছিঃ রায়চৌধুরী, ভুলে গেলেন এরই মধ্যে? বললুম না যে আপনার কোনও প্রশ্ন করা চলবে না।

দুজন লোক কাকাবাবুকে দুপাশ থেকে ধরে দাঁড় করাল। কাকাবাবু শক্তভাবে বললেন, আপনারা চারজন মিলে জোর করে যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু আমি চোখ খোলা রাখতে চাই। আর আমার ক্রাচ দুটো ফেরত পেলে খুশি হব।

আপনি চোখ খোলা রাখতে চান? আচ্ছা, দেখা যাক, আপনি চোখ খোলা রাখতে পারেন কি না, আমরা জোর করব না!

লোকগুলি তাদের প্যান্টের পকেট থেকে ঠুলির মতন বিশেষ ধরনের চশমা বার করে নিল। তারপর একজন চেঁচিয়ে বলল, লাইট!

তখন আলোটা আরও জোর হয়ে গেল। কাকাবাবু চোখ বুজে ফেললেন। লোকগুলি হেসে উঠল। তাদের দলপতি বলল, দেখলেন তো, চোখ খোলা রাখতে পারলেন না।

কাকাবাবু উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, এবার চোখ চাইতে পারছি।

কিন্তু আমরা যদি সব সময় এতটা আলো জেলে রাখি, তাহলে আপনি কি শুধু একদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকবেন? তা কি হয়?

আপনারা আমার চোখ বেঁধে কোথায় নিয়ে যেতে চান?

উঁহু, প্রশ্ন নয়, কোনও প্রশ্ন নয়।

একজন একটা কালো রঙের বালিশের ওয়াড়ের মতন জিনিস গলিয়ে দিল কাকাবাবুর মাথায়। তারপর পেছন দিকটা টেনে ফাঁস বেঁধে দিল।

কাকাবাবু ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলেন, এবার আমার হাত দুটো বাঁধবেন না?

না। তার দরকার নেই।

তা হলে এটা তো আমি যে-কোনও সময় গিঁট খুলে দিতে পারি।

চেষ্টা করে একবার দেখুন তো। পরশিয়ান নটের কথা শুনেছেন? স্বয়ং আলেকজান্দার পর্যন্ত যে গিঁট খুলতে পারেননি, এ হচ্ছে সেই ধরনের গিঁট।

হুঁ, কিছু লেখাপড়া জানা আছে দেখছি। আপনারা শিক্ষিত লোক, অথচ মুখোশ পরে রিভলভার হাতে নিয়ে থাকেন, অথাৎ গুণ্ডা, বদমাইসদের মতন কোনও বে-আইনি কাজ করছেন?

আপনি অরণ্যদেবের কমিকস পড়েন? অরণ্যদেবও তো মুখোশ পরে থাকেন, তাঁর কাছে রিভলভারও থাকে, কিন্তু তিনি কি গুণ্ডা?

ডোনট বি রিডিকুলাস! কোথায় যেতে হবে চলুন! আপনারা আমার সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছেন, কিন্তু আজ থেকে তিনদিনের মধ্যে আপনারা সবাই ধরা পড়বেন এবং জেলে যাবেন।

সত্যি, মিঃ রায়চৌধুরী? আপনি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন?

আমি কারুকে মিথ্যে ভয় দেখাই না! ভালুকের ছাল দিয়ে তৈরি ইয়েতির মতন একটা পোশাক পরে লোকদের ভয় দেখান আর খড়মের মতন কোনও জিনিস দিয়ে বরফের ওপর পায়ের ছাপ একে আসেন। এসব ভেলকি বেশিদিন চলবে না!

তিনদিন পরেই তাহলে আমরা ধরা পড়ে যাব বলছেন? কে ধরতে আসবে?

মিলিটারি পুলিশ। আপনাদের এখানে যত বড় দলবলই থাক, তবু কোনও সরকারের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই আপনাদের নেই।

কিন্তু মিলিটারি পুলিশ কী করে আমাদের সন্ধান পাবে?

ইয়েতি যখন-তখন অদৃশ্য হয়ে যায়, এক পলক দেখা দেবার পরই মিলিয়ে যায়—এসব শুনে আমি বুঝেছিলুম যে, এখানে মাটির নীচে কোনও কাণ্ডকারখানা আছে।

সেকথা বোঝা স্বাভাবিক! বিশেষ করে আপনার মতন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তো বুঝবেনই। কিন্তু মিলিটারি পুলিশ বুঝবে কী করে যে মাটির নীচে ঠিক কোন জায়গায় আমরা আছি? তারা তো সারা হিমালয়টা খুঁড়ে ফেলতে পারে না?

কাকাবাবু চুপ করে গেলেন।

দলপতি বললেন, অৰ্থাৎ সেকথা। আপনি আমাদের বলে দিতে চান না। তাই না? আমি যদি বলি, আপনি আমাদের মিথ্যেই ভয় দেখাচ্ছেন! আমাদের সন্ধান বাইরের লোকের পাওয়ার কোনও উপায়ই নেই।

কাকাবাবু বললেন, উপায় নিশ্চয়ই আছে। ধরে নিন যে, আমার একটা অলৌকিক ক্ষমতা আছে। আমি মনে-মনে খবর পাঠাতে পারি। আমি যেখানেই থাকি, আমার বন্ধুরা তা ঠিক টের পেয়ে যায়। আমাকে উদ্ধার করার জন্যই তারা এখানে এসে পড়বে।

মুখোশধারীরা একসঙ্গে অট্টহাসি করে উঠল।

দলপতি আবার বলল, আপনার যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে, তাও আমি জানি। সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে! এবার চলুন, অন্য জায়গায় গিয়ে কথাবার্তা হবে।

দুজন দুপাশ থেকে ধরে কাকাবাবুকে হটিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। কাকাবাবুর একবার মনে হল, ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাবার সময় আসামীদের এইভাবে চোখমুখ ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এরা তাঁকে মেরে ফেলতে পারে একথা তাঁর বিশ্বাস হল না।

একজন মুখোশধারী বলল, ইস, সত্যিই মিঃ রায়চৌধুরীর ক্রাচ দুটোর কথা খেয়াল করা উচিত ছিল। ওঁর হাঁটতে খুব অসুবিধে হচ্ছে!

অন্য একজন বলল, ওঁকে উঁচু করে তুলে নিয়ে যাওয়া যাক!

কাকাবাবু আপত্তি করার আগেই ওরা সবাই মিলে কাকাবাবুকে শূন্যে তুলে নিয়ে দৌড়তে লাগল। বাধা দেওয়া নিস্ফল বলে কাকাবাবু চুপ করে রইলেন।

বেশ খানিকটা যাবার পর ওরা এক জায়গায় এসে থামল, কাকাবাবুকে নামিয়ে দিল মাটিতে। অন্য একজন কেউ বেশ গম্ভীর গলায় বলল, মিঃ রায়চৌধুরীকে ঐ চেয়ারটায় বসিয়ে দাও। তারপর খুলে দাও মুখের ঢাকনাটা।

কাকাবাবু অনুভব করলেন, ওরা পেছনের দিকে ফাঁসটা খোলার চেষ্টাই করল না, একটা ছুরি দিয়ে চচ্চড় করে চিরে দিল কাপড়টা। পরশিয়ান নটই বটে!

সামনে তাকিয়েই কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, এ কী?