[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১৬. হাজির হলুম কাফে মেট্রোতে

ঠিক ন’টার সময় হাজির হলুম কাফে মেট্রোতে। ওখানে অনেকে কবিতা পড়বে। কাফে মেট্রো অনেকটা আমাদের কলকাতার সুতৃপ্তি বা বসন্ত কেবিনেরই মতো, আয়তনে একটু বড়। নড়বড়ে চেয়ার টেবিল, মিটমিটে আলো, কফি ছাড়া অন্য কোনও পানীয় পাওয়া যায় না। রাস্তার থেকে সিঁড়ি নেমে নীচু ঘর, যে-দিন কবিতা পড়া থাকে সেদিন আগে থেকেই তরুণ কবি বা ভাবী কবির দল টেবিল দখল করে থাকে। দু-একজন নিরীহ পথচারী–শুধু কফি খাওয়ার জন্যই যে ওখানে ঢুকে পড়ে না তা নয়, কিন্তু ওসব কবিতা শোনার পর একজনকে আমি দাম না দিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে দেখেছি। কাফের মালিক নিশ্চিত খুবই কবিতা অনুরাগী–যেহেতু এসব সহ্য করেন, এবং আর্থিক লাভের কোনও সম্ভাবনা নেই। একটি অল্প বয়সি মেয়ে কফি সার্ভ করে, নিঃশব্দে টেবিলে ঘুরে যায় সে, মুখে কোনও বিকার নেই। একটি কবিতা ওই মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করেই পড়া হল বুঝতে পারলুম–কিন্তু মেয়েটির তবু কোনও হৃদয় দৌর্বল্য ঘটল মনে হল না! একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘আইরিন, কবিতাটি তোমাকে নিয়েই লেখা হয়েছে, বুঝতে পারছ?’ মেয়েটি কাপে কফি ঢালতে-ঢালতে চোখ না তুলে বললে, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কবিতাটা ভালো হয়নি।’

আমেরিকায় কাফে রেস্টুরেন্টে কবিতা পড়ার রেওয়াজ উল্লেখযোগ্যভাবে শুরু হয় সানফ্রান্সিসকো শহরে। তারপর অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এখন নিউইয়র্কই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। গ্রিনইচ ভিলেজ–যেটা নিউইয়র্কের কবি-শিল্পীদের পাড়া, অর্থাৎ প্যারিসের যেটা এক কালের মার্ত, লন্ডনের কিছুটা সোহো স্কোয়ার, কলকাতার কলেজ স্ট্রিট–সেখানে অনেক কাফে বা বারে কবিতা পড়া হয় নিয়মিত, জ্যাজ বা মেয়েদের নাচের মতোই–শুধু কবিতা শোনার জন্যই অনেক ভ্রমণার্থী টিকিট কেটে ঢোকে। তবে সেসব জায়গায় কবিতা পড়া হয় অনেকটা ফ্যাশানের সঙ্গে কিছুটা প্রতিষ্ঠিত বা কিছুটা অতি বাজে কবিরা পড়েন। টাকা পান সে জন্য। একমাত্র কাফে মেট্রোতেই টিকিট কেটে ঢুকতে হয় না, এককাপ কফি নিয়ে চেয়ার দখল করে বসতে পারলেই হল–ওখানেই সত্যিকারের উৎসাহী তরুণ কবিরা কবিতা পড়েন। একজন মোটামুটি পরিচালনা করে, কোন কবি পড়বেন–তার নাম ঘোষণা করে, দু-চার লাইনে কবির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে দেয়। একজনের পড়া শেষ হলে কিছুটা গুঞ্জন, কথাবার্তা, তারপরই, কাফের মধ্যে একটা পুরোনো পিয়ানো আছে, তার সবগুলো রিডে চাপ দিলে ঘং করে একটা গম্ভীর শব্দ হয়, সব চুপ, আবার একজনের নাম ঘোষণা হল। ছেলেদের সঙ্গে-সঙ্গে মেয়ে কবিদের সংখ্যাও প্রায় সমান সমান। অনাহুত, রবাহুত হয়েও কেউ কেউ দাঁড়িয়ে বলে, আমি একটা কবিতা পড়ব। সেও সুযোগ পায়। আমাকেও একদিন কবিতা পড়ার জন্য খুব পেড়াপেড়ি করা হয়েছিল। অগত্যা আমি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা পড়েছিলাম। প্রথমে খাঁটি বাংলায়।

কবিতা পড়ার বর্ণনা দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। কবিদের ব্যবহার সবদেশেই সমান। কেউ অহংকারী গলায় পড়তে-পড়তে ‘রাজ্যজয় করছি’–এই ভঙ্গিতে ঘন-ঘন তাকায় মেয়েদের দিকে। কেউ লাজুক গলায় মিনমিনে সুরে পড়ে। কেউ ভাবগম্ভীর, উদাত্ত ভঙ্গিতে পড়ে একটা অতি ওঁচা পদ্য। কেউ বা একটা পড়ার নাম করে পাঁচ-ছ’টা না পড়ে ছাড়ে না। কেউ-কেউ ‘আমায় কেন আগে পড়তে দেওয়া হল না’–এই বলে খোনা গলায় খুঁতখুঁত করে। অবিকল বাংলাদেশের মতো। দু-একটা ভালো কবিতা, বাকি অনেক ভ্যাজাল ও ভঙ্গি। কিন্তু এক সন্ধ্যেবেলা–অন্তত একটি ভালো কবিতা শুনতে পাওয়াও কম নয়। এর মধ্যে নিগ্রো কবিরাও আছে। একজন নিগ্রো কবির একটি লাইন মনে আছে : আমেরিকা, মাই সুইট মাদারল্যান্ড অব শ্লেভারি।

আসর ভাঙে রাত বারোটা একটায়। গলা ভেজাবার জন্য এক এক দল যায় তখন এক এক বারে, সেখানে হই-হুল্লোড়, তর্কাতর্কি, আড্ডা, অশ্লীল গল্পের কমপিটিশন–ইত্যাদির পর বাড়ি ফিরতে রাত তিনটে-চারটে। আমার বরাবরই একটা কথা জানতে কৌতূহল হচ্ছিল। এইসব ছেলে-মেয়েগুলো বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরছে দিনরাত এদের চলে কী করে, এরা টাকা পায় কোথায়। ওসব পদ্য-দ্য লেখার জন্য তো এক পয়সাও পায় না, জানি। আমার পাশে একটি মেয়ে বসেছিল, সেদিন সেই মদের দোকানে, মেয়েটি সে সন্ধেবেলা কবিতা পড়েছিল। ভারী সুন্দর দেখতে মেয়েটি, বয়েস কুড়ি-চব্বিশ, গায়ের রং কর্কশ লালচে নয়…বরং যেন গৌর, সোনালি চুল। নাম লিন্ডা। লিন্ডাকে জিগ্যেস করলুম, তুমি কোথায় থাকো? আঙুল দিয়ে ওপাশের একটি ছেলেকে দেখিয়ে বলল, আমি পলের সঙ্গে একসঙ্গে থাকি।

–বিয়ে করেছ?

–না।

এসব প্রশ্ন-ইওরোপ-আমেরিকায় করা খুবই অভদ্রতা হয়তো, কিন্তু এসব ছেলেমেয়েরা কোনও রীতিনীতি মানে না। এদের জিগ্যেস করা যায়, জানি। এদের মধ্যে একজন আমাকে একবার দুম করে প্রশ্ন করেছিল, আমি কখনও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছি কি না। ছেলেটিকে নিরাশ করে আমি উত্তর দিয়েছিলুম, না।

যাই হোক, আমি লিন্ডাকে জিগ্যেস করলুম, পল কি কোনও চাকরি-টাকরি করে?

–না, না, ও কবিতা লেখে। চাকরি করলে ওর অসুবিধে হয়।

–ও, আচ্ছা, তাই নাকি। ঢোঁক গিলে আমাকে বলতে হল। তবুও ওখানে না থেমে মেয়েটিকে আবার জিগ্যেস করলুম, কবিতা লেখা সত্বেও, তোমাদের দু’বেলা কিছু খাবার খেতে হয়, আশা করি। কোথা থেকে পাও। তুমি চাকরি-টাকরি করো?

লিন্ডা খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর বললে, না। তবে মাঝেমাঝে কিছু উপার্জন হয়।

–কী করে? আশা করি তুমি কিছু মনে করছ না।

–না, না। খুব শক্ত। আমি মাঝেমাঝে মডেলের কাজ করি। তাতে যা পাই, চলে যায়। আগে আর্টিস্টদের মডেল হতাম, কিন্তু ওটা বড় কষ্টকর, একভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকতে খুব বিরক্ত লাগে। তা ছাড়া ওরা পয়সা কম দেয়। এখন ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে কাজ করি। খুব কম সময়ে হয়ে যায়, পয়সাও ভালো।

মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। কী সরল মুখ ওর। আর একটা প্রশ্ন বুকের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করছে। কিন্তু আর জিগ্যেস করতে ভরসা হচ্ছে না। অথচ এদের ব্যবহারে কোনও আড়ষ্টতা বা লজ্জা নেই। শেষকালে বললুম, তোমার ওসব ফটোগ্রাফ কি কাগজে ছাপা হয়?

–হ্যাঁ, হয়। তবে ফ্যাশান ম্যাগাজিনের ছবি নয়। নতুন পোশাকের ডিজাইন নিয়ে মডেলের ছবি–তা নয় কিন্তু, আমার কোমরটা, এই দ্যাখো, তেমন সরু নয়, সেইজন্য ফ্যাশান ম্যাগাজিনে আমার ছবি তোলে জামা কাপড় সব খুলে–

–তোমার একটুও লজ্জা করে না।

–না! তবে, আমার মা-বাবা যদি দেখতে পান–তবে ওঁদের লজ্জা হবে–তাই আমি মুখের ওপর চুলগুলো ফেলে মুখটা ঢেকে দিই প্রায়। অনেক সময় ওই অবস্থায় আমি কবিতার লাইন ভাবি। কাল একটা লিখেছি…

কবিতার জন্য এ কী জীবন-মরণ পণ এদের। কিন্তু তবু বড় দুঃখ হয় ভেবে, কবিতার জন্য জীবন-মরণ পণ করাও কিছু নয়। আত্মদান করলেও অনেকের কবিতা হয় না। অন্তত ওই পল বলে ছোঁকরার যে জীবনে এক লাইনও কবিতা হবে না, এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত।

আর একটি ছেলের কাছে জানলুম–সে একটা হোটেলে ঘরভাড়া নিয়ে থাকে। দিনের বেলা সেই হোটেলেই চাকরের কাজ করে! কেউ-কেউ মিউজিয়াম বা লাইব্রেরিগুলোয় ক্যাটালগ তৈরির কাজ করে মাঝে-মাঝে। দু-একটা আছে বোকা অহংকারী। অশ্লীল নামে একটি পত্রিকা বার করে একটি ছেলে সেও কোনও কাজকৰ্ম্ম করে না। জিগ্যেস করলুম, কাগজ চালাবার পয়সা পায় কোথা থেকে। ভুরু উলটে উত্তর দিল, জুটে যায়। সত্যিই জুটে যায় এদিক-সেদিক থেকে। অল্প আয়াসে। তাই কবিতা লেখা বা ছবি আঁকার নাম করে বাউণ্ডুলে সেজে থাকে কত ছেলেমেয়ে–তাদের মধ্যে ক’জন সত্যিকারের শিল্পী বাছতে গেলে গ্রিনউচ গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে।

দোকান থেকে বেরিয়ে এলুম রাত তিনটেয় আকাশের নীচে। তখনও দোকানগুলি আলোয় ঝলমল। ভেসে আসছে ছেলেমেয়েদের মিশ্রিত দুর্বোধ্য শব্দ। শোঁ-শোঁ করে দু-একবার আসে সমুদ্রের বাতাস। পাথরের মূর্তির মতো এখানে-ওখানে পুলিশ। মনের মধ্যে সামান্য একটা গ্লানির সুতো যেন টের পাচ্ছি। আজ সন্ধেবেলায় অমন উত্তেজিত কবিতার আসরের পর–এদের সবার সঙ্গে আমি টাকা পয়সার আলোচনা করতে গেলুম কেন! একজন কবির সঙ্গে আরেকজন কবি কী নিয়ে কথা বলে? ক্রিয়েটিভ প্রসেস নিয়ে কোনও আলোচনা হয় না, করা যায় না, অসম্ভব। তাও দুজনের ভাষা যদি আলাদা হয়। ভাষা ছাড়া কবিতার আর কী আছে? আর কিছু নেই, নইলে বাংলা ভাষা এমন দাসত্বের শিকল কেন পরিয়েছে আমার গলায়। তা ছাড়া ওদের কাছ থেকে শেখার কিছুই নেই। আমারও কিছু নেই ওদের শেখাবার। শুধু কথা আসে জীবন সম্বন্ধে, জীবনকে টেনে বাঁচিয়ে রাখা শুধু। তোমাদের অনেকেরই কবিতা অতি অখাদ্য, একেবারেই ভালো লাগেনি আমার–তবু কফির দোকানে ওই কবিতা পাঠ উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা, গৌরব ও লাজুকতা, সারা সন্ধে ও রাত্রি কবিতার কথায় ভরে রইল, ‘শিল্পের জন্য ইহজীবনে কিছু আত্মত্যাগ’ করেছ তোমরা, সেজন্য তোমাদের মনে হল এক পরিবারের লোক।