১৬. ছিল একটা রুমাল

‘হে বন্ধু, তোমাকে ফিরতে হবে
আমি তোমার প্রতীক্ষায় থাকব–কেইসড্রাট গাছের নীচে
জলপাতের অধিপতির কাছে আমি এই গোপন কথা বলেছি
অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে তুমি ফিরে আসবে। সূর্য ডুবে গেলে
ম্লান রাত্রি যখন ভর করে বাড়ির ছাদে
…সেই কি তোমার ফিরে আসার চিহ্ন?’
–লেওপোল্ড সেঙ্খর

ছিল একটা রুমাল, হয়ে গেল একটা বিড়াল!

ছিল একজন বাসনা-লঘু তরুণ কবি, হয়ে গেল এক উপন্যাস লেখক। শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস, ধারাবাহিক উপন্যাস। গদ্য লেখা একবার শুরু করলে যেন পায়ের তলায় রোলার স্কেটার লেগে যায়, থামার উপায় নেই।

সেই বিদেশ থেকে ফেরার পর এক যুগ কেটে গেছে। তারপর হঠাৎ আবার একবার প্যারিস নগরী, যেন নদীর স্রোতে রূপালি মাছের মতন, আমার চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে গেল!

তখন আমি পুরোপুরি ভেতো বাঙালি হয়ে গেছি। বিশ্ব ভ্রমণের শখ মেটাই অন্য লেখকদের ভ্রমণ-কাহিনি পাঠ করে এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার পাতা উলটে। অনেকে বলে, বর্তমানের তুলনায় সদ্য অতীত কিংবা যে-কোনও অতীতের দিনগুলোই ভালো ছিল। কিন্তু আমার মতে এখনকার তুলনায় সপ্তম দশকটি ছিল খুবই দুর্যোগপূর্ণ, খুবই কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা কোনওক্রমে পার হয়ে এসেছি!

সেইরকমই একটি দিনে, আনন্দবাজার পত্রিকার অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের বড় কর্তা গণেশ নাগ একদিন আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে পাঠালেন। অফিসের কোনও কাজে গণেশবাবুর সঙ্গে আমার কখনও কোনও কথা হয়নি, তার দরকারও হয়নি, তবে অফিসের বাইরে অনেক নেমন্তন্নে ও আচ্ছায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, গল্প-গুজব হয়েছে, এক সঙ্গে তাসও খেলছি। তিনি সজ্জন, বন্ধুবৎসল। বাঙালিদের মধ্যে কে কতখানি মাছের ভক্ত, তা নিয়ে যদি কখনও কোনও প্রতিযোগিতা হয়, তাহলে গণেশ নাগ নিশ্চিত প্রথম স্থান অধিকার করবেন। একবার ডায়মন্ডহারবার গিয়ে তিনি বত্রিশটা ইলিশ মাছ কিনেছিলেন। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বিলোবার জন্য। আর একবার ঢাকা থেকে প্লেনে ফেরার সময় তিনি হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে ভরে এনেছিলেন কই মাছ।

নিজের চেম্বারে তিনি গোপন কথার ভঙ্গিতে বললেন, সুনীলবাবু, আপনি প্যারিস যাবেন?

আমি হকচকিয়ে গেলাম একেবারে। এমন প্রস্তাব গণেশবাবু দেবেন, ভাবতেই পারা যায় না। অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের কর্তা হঠাৎ আমাকে প্যারিস পাঠাতে চাইবেন কেন?

আরও রহস্য করে তিনি বললেন, আপনি যদি প্যারিসে কোনও থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে পারেন, তা হলে আপনাকে আমি বিনা ভাড়ায় ওখানে পাঠিয়ে দিতে পারি।

তখনই আমার মনে হল, কয়েক মাস আগের ঘটনা। সেদিন দুপুরে অফিসে আমার টেবিলে বসে আছি। এমন সময় এক লম্বা মতন, অপরিচিত যুবকের প্রবেশ। সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, মুখখানা খানিকটা গাম্ভীর্য মাখানো। হাত তুলে বললেন, নমস্কার, আমার নাম অসীমকুমার রায়, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।

এরকম অনেকেই আসে, আমি বলেছিলাম, বসুন, আপনি কোনও লেখা দেবেন তো?

অসীমকুমার য়ায় বললেন, না, আমি লেখা দিতে আসিনি। অসীম য়ায় নামে অন্য একজন লেখক আছে আমি জানি। আপনার সঙ্গে শুধু আলাপ করতেই এসেছি। আমি প্যারিসে থাকি, ওখানে আমার একটা বাড়ি আছে। আপনাকে নেমন্তন্ন করতে এসেছি, একবার চলে আসুন না ওদিকে, আমার বাড়িতে কিছুদিন থেকে যাবেন।

আমি বললাম, থাকায় জায়গা তো দিতে চাইছেন, কিন্তু প্যারিস যাওয়া কি মুখের কথা! ভাড়া জুটবে কোথা থেকে!

অসীম রায় বললেন, চেষ্টা করলেই যাওয়া যায়। লেখকদের তো ভ্রমণের নেশা থাকে। তা ছাড়া, বাঙালি লেখকদের পশ্চিম জগৎটা একবার ঘুরে দেখে আসা উচিত। ওদিকটার লেখকরা পৃথিবীর কত বিচিত্র জায়গায় যায়, ওদের লেখার জগতটাও সেজন্য অনেক বিস্তৃত হয়!

আমি বললাম, তারা তো আর বাংলা ভাষায় লেখে না! বাঙালি লেখকদের সংসার চালাতেই হিমসিম খাওয়ার মতন অবস্থা। এদেশে লেখকদের সাহায্য করার মতন কোনও ফাউন্ডেশনও নেই।

অসীম রায়ের সঙ্গে আরও নানা বিষয়ে গল্প হল। যুবকটি বহু বছর প্রবাসী। পেশায় টেলিফোন-বিশারদ, কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি টান-ভালোবাসা আছে। প্যারিসে কিছু বন্ধু-বান্ধবী মিলে বাঙালি ক্লাব করেছেন। তাদের একটি বাংলা বইয়ের লাইব্রেরিও আছে। সে বইগুলি থাকে অসীম রায়েরই বাড়িতে।

আমি যে এক সময় প্যারিসের রাস্তা পায়ে হেঁটে চষে বেড়িয়েছি, তার উল্লেখ করলাম না একবারও। অনেককাল আগের কথা। বলেই বা লাভ কী?

বিদায় নেওয়ার সময় অসীম রায় তার ঠিকানা রেখে বলে গেলেন, আমার নেমন্তন্নটা মনে রাখবেন, কখনও প্যারিসে গেলে আমার বাড়িতে উঠবেন।

গণেশ নাগের প্রস্তাব শুনে আমার মনে হল, এ তো ভারী আশ্চর্য যোগাযোগ। গণেশবাবু বলছেন, তিনি বিনা ভাড়ায় আমায় প্যারিস পাঠাবেন। আর অসীম রায়ের বাড়িতে বিনা খরচ থাকা যাবে। তা হলে তো আর কোনও সমস্যা নেই। এক্ষুনি যেতে চাই।

বিনা ভাড়ায় প্যারিস যাওয়ার রহস্যটা গণেশবাবু একটু পরে ভেঙে বুঝিয়ে দিলেন।

ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের বড় বড় উড়ো জাহাজগুলো কেনা হয় ফ্রান্স থেকে। সেই সব এয়ার বাস এক বছর দু-বছর অন্তর প্যারিসে পাঠাতে হয় সংস্কারের জন্য। সেরকমই একটি এয়ার বাস শিগগির যাচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী এই ধরনের ফ্লাইটে টিকিট-কাটা যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু এয়ার লাইনসের কর্মী বা অতিথিরা যেতে পারে। সেইজন্য ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনস ঠিক করেছে, কিছু গায়ক-শিল্পী-লেখকদের নিয়ে যাবে, দিন পনেরো পরে ফিরিয়ে আনবে।

গণেশ নাগের দাদা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের একজন খুব উঁচু অফিসার। তিনি আমাকে ওই দলটির অন্তর্ভুক্ত করে দিতে পারেন।

সেদিন প্রায় হাওয়ায় উড়তে-উড়তে বাড়ি ফিরলাম। গণেশবাবু বলেছেন, ইচ্ছে করলে আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিতে পারি। সুতরাং খবরটা এক্ষুনি স্বা তাঁকে জানানো দরকার।

আমি তো শুধু বাঙালি নই, খাঁটি বাঙাল, গরম ভাত, ডাল আর বেগুন ভাজা আমার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। স্বাতী ভালোবেসে স্যান্ডুইচ। কাঁচা স্যালাড কোনওদিনই আমার পছন্দ নয়, স্বাতীর বিশেষ প্রিয়। স্বাতী ইলিশ মাছে আঁশটে গন্ধ পায়, আদর করে পুড়িং খায়। আমি মিষ্টি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। ভাগ্যিস সে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বিভূতিভূষণের লেখা বিশেষ ভালোবাসে, না হলে এ মেয়ের সঙ্গে বেশিদিন ঘর করা কি আমার পক্ষে সম্ভব হত?

স্বাতী প্রায়ই বলে যে আগের জন্মে ও ফরাসি ছিল। কলেজ জীবনে সে পয়সা জমিয়ে ফরাসি শিল্পীদের ছবির বই কিনেছে, শখ করে ফরাসি ভাষা শিক্ষার ক্লাসে ভরতি হয়েছে। আমার মুখে আমেরিকা ভ্রমণের গল্প শুনে ও বলত, আমেরিকায় আমার বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় সব কিছুই বড় বড় বড়, কিন্তু একবার ইউরোপ যেতে খুব ইচ্ছে করে, বিশেষ করে ফ্রান্সে। আমি মাঝে মাঝে প্যারিসের স্বপ্ন দেখি।

ওর স্বপ্নকে সম্ভব করার এই তো সুবর্ণ সুযোগ। কিছুদিন আগে আমরা বাংলাদেশ ঘুরে এসেছি, তাই দু জনেরই পাসপোর্ট চালু আছে। আর কোনও অসুবিধেই নেই!

আগেকার দিনের গল্প-উপন্যাসে প্রায়ই এরকম একটি লাইন থাকত, ‘তখন নিয়তি দেবী অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া হাসিলেন!’ আনন্দবাজারে গণেশবাবু যখন প্রস্তাবটি দেন, তখন তাঁর চেম্বারের দরজায় কান দিয়ে নিয়তিদেবী নিশ্চিত খিলখিল করে অনেকটা হেসে নিয়েছিলেন। আমার জীবনে যেমন অকস্মাৎ কিছু কিছু সৌভাগ্যের উদয় হয়েছে, তেমনি ভাগ্যের অনেক ঠাট্টা-মস্করাও সহ্য করতে হয়েছে আমাকে।

ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের সেই খালি জাহাজে জায়গা পাওয়ার জন্য গোপনে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। উৎসাহী হয়ে উঠলেন সরকারি আমলারা। তারপর রাজনীতির নেতারা। এ কালে নেতাদেরই গায়ের জোর বেশি, তাঁরা ধাক্কা দিয়ে অন্যদের ঠেলে ফেলে দিতে লাগলেন। তারপর নেতাদের সংখ্যাও এত বেশি হয়ে গেল যে তাঁরা ধাক্কাধাক্কি করতে লাগলেন নিজেদের মধ্যে। বিনা পয়সায় প্যারিস ঘোরার অনেক ক্যান্ডিডেট।

এই বিষয় নিয়ে হঠাৎ একদিন পার্লামেন্টে পশ্ন উঠে গেল। সব শুনেটুনে ইন্দিরা গান্ধী রাগ করে বললেন, কারুকেই নিতে হবে না। উড়োজাহাজ খালিই যাবে প্যারিসে।

সব ব্যাপারটাই যেন শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল কাটামুণ্ডের দিবাস্বপ্নের মতন।

এরপর আবার কেটে গেল বছর দেড়েক।

একদিন শুনতে পেলাম আমাদের সহকর্মী ও লেখক বন্ধু সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আমেরিকা যাচ্ছেন। এবং আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সিরাজের কাছ থেকে সব বৃত্তান্তটা জানা গেল। তিনি যাচ্ছেন পল এঙ্গেলেরই আমন্ত্রণে। তবে সেখানকার রাইটার্স ওয়ার্কশপ এখন অনেক বিস্তৃত ও নিয়ম-কানুনবদ্ধ হয়েছে। আগেকার মতন পল এঙ্গেল নিজে আর বিশ্বময় ঘুরে-ঘুরে লেখক নির্বাচন করেন না। এখন বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাস এক একজন লেখককে পাঠান। সিরাজ এবার সেই সুযোগ পেয়েছেন। আমি খুব খুশি হয়ে সিরাজকে আমার অভিজ্ঞতার কাহিনি শোনালাম কিছু কিছু।

পল এঙ্গেল আমার সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রেখেছিলেন অনেক দিন। আমারই উত্তর দেওয়া হয়ে উঠত না। একেই চিঠি লেখাতে আমার খুব আলস্য, তাও আবার ইংরিজিতে! সিরাজ আয়ওয়াতে গেলে পল নিশ্চয়ই তাঁকে জিগ্যেস করবেন আমার কথা, সেইজন্য আমি দ্রুত খসখস করে কয়েক লাইনের একটা চিঠি লিখে দিয়ে দিলাম সিরাজের হাতে।

সেই ছোট্ট চিঠির একটা মস্ত বড় উত্তর এল। পল এঙ্গেল চিঠি লেখার জন্য বিখ্যাত। লাইফ ম্যাগাজিনে একবার তাঁর এক ইন্টারভিউতে পড়েছিলাম। তিনি বছরে তিন হাজারের বেশি চিঠি লেখন। সবই নিজের হাতে টাইপ করা। অসাধারণ তাঁর স্মৃতিশক্তি। পল ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামের বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে আমার ব্যক্তিগত খবরাখবর জানতে চেয়েছেন। তারপর একটা আমন্ত্রণ। সুনীল, তোমাকে অনেকদিন দেখিনি। তুমি আর একবার চলে এসো আয়ওয়াতে। সস্ত্রীক এসো। যদি কোনওক্রমে চলে আসতে পার, এখানে তোমাকে তিন-চার মাসের জন্য রেখে দেব। তোমার থাকা-খাওয়া নিয়ে কোনও চিন্তা করতে হবে না।

এই আমন্ত্রণ সরকারি নয়, ফর্মাল নয়, পল এঙ্গেলের ব্যক্তিগত। তিনি আয়ওয়াতে আমাকে আতিথ্য দিতে প্রস্তুত, কিন্তু যেতে হবে নিজের উদ্যোগে। অত ভাড়ার টাকা পাব কোথায়? মার্কিন দূতাবাস আমাকে সাহায্য করবে না।

তখন আমি একটি উপন্যাস লেখার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রচুর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বইটি শেষ করার পর মনে হয়েছিল, আর এক বছর কিছু লিখব না। কিন্তু কলকাতায় থাকলে কিছু না কিছু লিখে যেতেই হবে। একমাত্র উপায় পালিয়ে যাওয়া। আমেরিকার মতন খরচের দেশে তিন-চার মাসের আতিথ্য পাওয়ার প্রলোভনও কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা, আমেরিকার টিকিট কাটলে ইউরোপে থেমে যাওয়া যায়। এর আগে স্বা তাঁকে প্যারিসে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা করতে পারিনি। নিজের স্ত্রীর কাছে হৃতসম্মান পুনরুদ্ধার করারও এই এক সুযোগ। অসীম রায়ের ঠিকানাটা এখনও হারাইনি।

আবার গেলাম গণেশ নাগ-এর কাছে। বললাম, সেবারে আপনি আমাকে বিনা ভাড়ায় প্যারিস পাঠাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন, সেটা শেষ পর্যন্ত হল না। এবারে আমি নিজেই প্যারিস যেতে চাই, আপনাকে ভাড়ার ব্যবস্থা করে নিতে হবে।

গণেশ নাগ তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে অফিস থেকে আমার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে দিলেন, খুব সুবিধেজনক শর্তে, অনেকদিন ধরে একটু একটু করে শোধ দিলেই চলবে।

ঠিক সতেরো বছর পর, দ্বিতীয়বার আমি ফিরে এলাম প্যারিসে। যেন অন্য একজন মানুষ। বয়েস বেড়েছে, চেহারা বদলে গেছে। প্লেনের যাত্রীরাও অন্যরকম। সেই ষাটের দশকে পশ্চিম আকাশের বিমানে ভারতীয় দেখা যেত কদাচিৎ। এখন সর্বত্র ভারতীয়। সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশের ফলে এখন যে-কোনও ভারতীয়ই পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকারী। ফরেন এক্সচেঞ্জের কড়াকড়িও হ্রাস হয়েছে। আগেকার দিয়ে ভারত মাতা তাঁর সন্তানদের মাত্র আটটি ডলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদেশে পাঠাতেন, এখন পাঁচশো কুড়ি ডলার অনায়াসে নেওয়া যায়; তাই ইওরোপ-আমেরিকা যাওয়া এখন অনেকের কাছে জলভাত। আমি আর স্বাতী যাচ্ছি শুনে শিবাজী রায় নামে আমাদের এক প্রতিবেশি যুবক সঙ্গী হতে চাইল, সে পাসপোর্ট ভিসা ফরেন এক্সচেঞ্জ পেয়ে গেল ঝটাপট। আর সেই ষাটের দশকে শুধু পাসপোর্ট বার করতেই জিভ বেরিয়ে গিয়েছিল আমার।

অসীম রায়ের কথাবার্তার ধরনটি একটু রুক্ষ ও চাঁছাছোলা। মাঝে মাঝে ভুরু কুঁচকে যায়। আগেরবার আমি নেমেছিলাম ওর্লি বিমান বন্দরে, এখন শার্ল দ্যগলের নামে বিশাল নতুন বিমান বন্দর হয়েছে। সেখান থেকে অসীম রায়ের বাড়ি বেশ দূরে। গাড়ি করে সে আমাদের নিয়ে গেল; বাড়িতে পৌঁছোবার একটু পরেই বলল, শুনুন, একটা ব্যাপার আগেই পরিষ্কার করে দিই আপনাদের কাছে। আমার বাড়িতে এসেছেন বলেই যেন ভাববেন না, আমি আপনাদের রান্না করে খাওয়াব, আপনাদের বাসন মাজব! দেশের লোকরা নিজেরা কিছু কাজ করে না, ঝি-চারকদের খাটায়, এখানে এসেও মনে করে সেরকম সব কিছুই অন্যরা করে দেবে। আপনাদের রান্না ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি, কী করে গ্যাস জ্বালাতে হয় বুঝিয়ে দিচ্ছি, নিজেদের সব কিছু করে নিতে হবে।

আমরা সদলবলে তার সঙ্গে রান্না ঘরে ঢুকে একটি নাতিক্ষুদ্র লেকচার শুনলাম। আমি যে পুরো একটি বছর আমেরিকায় ছিলাম, এই রকম চার উনুনের গ্যাস স্টোভে নিজের হাতে রান্না করে খেয়েছি, সে অভিজ্ঞতার কোনও মূল্যই দিল না সে। তার সামনে গ্যাস জ্বালানো ও নেভানোর পরীক্ষা দিয়ে দেখাতে হল।

রান্নাঘর পর্ব শেষ করার পর সে বসবার ঘরে এসে আমার হাতে তুলে দিল একটি টুরিস্ট গাইড বই এবং একটি মেট্রো ট্রেনের শাখা-প্রশাখার মানচিত্র। তারপর তার দ্বিতীয় লেকচার। তাকে প্রত্যেকদিন অফিস যেতে হবে, সন্ধের পর সে ক্লান্ত থাকে, সুতরাং সে আমাদের প্যারিস ঘুরিয়ে দেখাতে পারবে না একেবারেই। ঘুরতে হবে নিজেদেরই। এইভাবে মেট্রোর টিকিট কাটতে হয়, সাতদিনের টিকিট একসঙ্গে কাটলে অনেক সস্তা হয়, কোথায় কোথায় ট্রেন বদল করতে হয়, ইত্যাদি।

তারপর সে শুরু করল এক গল্প। কিছুদিন আগেই একজন বিখ্যাত, প্রবীণ বাঙালি লেখক এসেছিলেন প্যারিসে, তিনি নানা রকম ছেলেমানুষি আবদার করে এখানকার বাঙালিদের জ্বালিয়ে খেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত রাগ করে একজন কেউ তাকে কোনও হোটেলে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল…।

আমি ও স্বাতী ত্রস্তভাবে চোখাচোখি করলাম। এ কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা! এই লোকটি তো আমাদের নেমন্তন্ন করেছিল, চিঠিতেও অনেক উৎসাহ দেখিয়েছে। এখন যেন মনে হচ্ছে আমরা ওর কাঁধের ওপর বোঝা হয়ে পড়েছি!

পরদিন সকালে কিন্তু আমরা জাগবার আগেই অসীম রায় চা বানিয়ে আমাদের ডেকে তুলল। একটু পরে ব্রেকফ্রাস্টেরও ব্যবস্থা করে ফেলল সে। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে সে আমাদের সারাদিনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত শুনে বলল, চলুন, আপনাদের অন্য একটা জায়গা দেখিয়ে আনি। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করল তক্ষুনি।

দু-তিন দিন পরেই বোঝা গেল, সে আমাদের রান্না করেও খাওয়াবে, নিজের গাড়িতে নানা জায়গায় নিয়েও যাবে, কিন্তু তার ভাবখানা এই, তার কাছে কিছু প্রত্যাশা করা চলবে না। একটা বেশ গেরেমভারি ভঙ্গি নিয়ে থাকতে সে খুব পছন্দ করে। এই ব্যাপারটা বুঝে যাওয়ার ফলে তার সঙ্গে ওঠা-বসা করতে কোনও অসুবিধে হয় না।

অসীম রায় বিবাহ করেনি, প্যারিস শহরের প্রান্তে তার নিজস্ব একটি দোতলা বাড়ি, দেশ থেকে অনেকেই গিয়ে তার ওখানে ওঠে। এই সব অতিথিদের মধ্যে কেউ কেউ খুবই অবুঝ। বিদেশের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যাদের কোনও ধারণা নেই, তাদেরও কিছুটা অন্তত খোঁজখবর নিয়ে যাওয়া উচিত। এ তো সবারই জানার কথা যে ওসব দেশ থেকে ঝি-চাকর প্রথা উঠে গেছে। বাসন বাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার করা, এ সবই করতে হয় নিজেদের। সুতরাং অতিথিদেরও তাতে অংশ নিতে হবে সমানভাবে। নইলে গৃহস্বামী যে অতিথিদের গৃহভৃত্য হয়ে যায়! ওখানে সারা সপ্তাহ যন্ত্রের মতন খাটতে হয়। যখন তখন ছুটি নেওয়ার কোনও উপায় নেই, তবু অনেকে আশা করে, যিনি আতিথ্য দিয়েছেন, তিনিই তাদের সর্বক্ষণের ভ্রমণ গাইড হবেন! কোনও এক ধনী-দুলাল নাকি নিজের গেঞ্জি-আন্ডারওয়ার বাথরুমে ফেলে রেখে যেত, তার ধারণা, অসীম রায় ওগুলো কেচে দেবে!

প্রথমবার যখন আসি, তখন প্যারিসে একজনও বাঙালিকে চিনতাম না। এখন পেয়ে গেলাম বেশ কয়েকজনকে। বিপ্লবী বাঘা যতীনের নাতি পৃথীন্দ্রনাথ মুখোঁপাধ্যায়ের সঙ্গে দেশে থাকতেই দেখা হয়েছিল। আমাদের কফি হাউসের এক কালের বন্ধু, কবি ও শিল্প সমালোচক সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায় এক ফরসি রমণীর পাণিগ্রহণ করে এখানে থাকেন; অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না তার সঙ্গে, এবার দেখা হল। দেশ পত্রিকার নিয়মিত লেখেন প্রীতি সান্যাল, তাঁর স্বামী বিকাশ সান্যাল ইউনেস্কোর শিক্ষা বিভাগের এক হোমরা-চোমরা, দুজনেই খুব আড্ডা-প্রিয়। শিল্পী শক্তি বর্মণ এখানে রয়েছেন বহুকাল; এসেছেন তরুণ শিল্পী সম্বিৎ সেনগুপ্ত। অসীম রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভুপেশ দাস একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, তিনি কথাবার্তা বলেন কম, কিন্তু প্রতিটি মন্তব্যই সরস ও বুদ্ধিদীপ্ত। আর শুভেন্দু চৌধুরী সব সময়েই নিঃশব্দ শ্রোতা। আমরা সারাদিন প্যারিস শহরে ঘুরে বেড়াই, সন্ধের পর অসীমের বাড়ি কিংবা অন্য কারুর বাড়ি খাওয়া দাওয়া ও আড্ডা বসে।

প্রথম দিন বেড়াতে বেরিয়েই স্বাতী জিগ্যেস করেছিল, তোমার খুব মার্গারিটের কথা মনে পড়ছে, তাই না?

না মনে পড়লে ধরে নিতে হত যে আমার মন বলে কিছু নেই।

কিন্ত সতেরো বছর বড় দীর্ঘ সময়। এতদিন পর হঠাৎ মার্গারিটকে দেখলে কি আমি চিনতে পারতাম? কিংবা সে আমাকে?

এই প্যারিস শহরেই তো এক মাস ধরে কত রাস্তা হেঁটেছি, কত দ্রষ্টব্য স্থান তন্নতন্ন করে দেখেছি, কিন্তু এখন সব কিছুই যেন অচেনা লাগছে। মেট্রো ট্রেন ও স্টেশনগুলো পালটে গেছে কত! সাতলে লে আল স্টেশনের কী চোখ ধাঁধানো রূপ। এক সময় ওই লে আল অঞ্চলে এক বিশাল, লোক গিসগিসে বাজার ছিল। মেট্রো ট্রেনগুলোর চেহারাও ছিল বেশ লঝঝরে, লন্ডনে এখনও অনেক টিউব ট্রেন যেমন। কিন্তু এবার এসে দেখি মেট্রো একেবারে ঝকঝকে। আগে যে সময় এসেছিলাম, তখনও ফ্রান্স যুদ্ধ-পরবর্তী ডিপ্রেশান কাটিয়ে উঠতে পারেনি, এখন সেই ফ্রান্স যেন অনেক সমৃদ্ধ।

মার্গারিটের কথা যখন তখন মনে পড়ে বটে, কিন্তু সেই স্মৃতির মধ্যে বিষাদ কিংবা কাতরতা নেই। বরং যেন স্মৃতিটাকে কম্বলে মুড়ে রাখা হয়েছে, আমার বুকের খানিকটা অবশ লাগে। মার্গারিটের প্রসঙ্গ উঠলেই আমি অন্য কথায় চলে যেতে চাই।

এবারের প্যারিস আসা যেন স্বা তাঁকেই সব কিছু দেখাবার জন্য। ওর মুগ্ধতা দেখে আমার আনন্দ হয়। ও ছবি দেখতে ভালোবাসে, এ শহরে রয়েছে ছবির স্বর্ণভাণ্ডার। আসবার পথে আমরা অ্যামস্টারডামে নেমে ভ্যান গঘ ও রেমব্রান্ডট দেখে এসেছি দু-চোখ ভরে; এখানে দেখছি ওঁদের সমসাময়িকদের। শিল্প সমালোচক সুপ্রিয়কে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে ওর সঙ্গে স্বাতীর বেশ ভাব জমে গেল। সুপ্রিয় আমাদের নিয়ে যায় বাছাই করা ছবির জায়গায়।

আমি আগের বার অতদিন ছিলাম, তবু ইফেল টাওরারে চাপিনি আর মোনালিসা দেখিনি শুনে সবাই হাসে। এবারে ওই স্তম্ভচূড়াতেও ওঠা হল, ওই ইতালীয় গর্ভিণীকেও দেখা হল। লুভর মিউজিয়ামে ঘুরতে-ঘুরতে রেনোয়া’র একটি ছবির সামনে স্বাতী অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বড় আকারের স্নানরতাদের ছবি। প্রকৃতি ও নগ্ন নারী, রেনোয়ার প্রিয় বিষয় ছিল। এই ছবিটা রেনোয়া’র মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে আঁকা। যখন রেনোয়া বাতের ব্যথায় খুব কষ্ট পেতেন, আঙুল নাড়াতে পারতেন না, আঙুলের ফাঁকে ব্রাশ বেঁধে নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও বিশুদ্ধ সৌন্দর্য আঁকতেন।

স্বা তাঁকে এইসব কথা বোঝাতে-বোঝাতে হঠাৎ আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। সতেরো বছর আগে, ঠিক এই ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে মার্গারিট আমাকে এই কথাগুলোই বলেছিল। তা হলে আমি সেসব ভুলিনি, কিছুই ভুলিনি!