১৫. যাকে বলে জীবনযুদ্ধ

‘ভুলব না আমি ফ্রান্সের সেই প্রিয় উদ্যানগুলি
ওরা যেন বহু প্রাচীন কালের ভোরে প্রার্থনা গান
নৈঃশব্দ্যের ধাঁধা সন্ধ্যার যাতনা কেমনে ভুলি
ছিল আমাদের যাত্রার পথে গোলাপ যে অফুরান…’
–লুই আরাগঁ

যাকে বলে জীবনযুদ্ধ কিংবা সংসারযাত্রার বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা, তাতে আমি হাবুডুবু খেতে লাগলাম কলকাতায় ফিরে এসে। বিদেশে বসে আমি বাংলা লিখে নিজস্ব খরচ চালাবার একটা মরীচিকা দেখেছিলাম, এর টের পাওয়া গেল, সেটা বড়ই নিষ্ঠুর মরীচিকা।

ফেরার পথে লন্ডন, জেনিভা, রোম ঘুরে আমি শেষ থেমেছিলাম কায়রোতে। ইতিহাস আমার বরাবরের প্রিয়, ভেবেছিলাম আর এ জন্মে কোনওদিন বিদেশে আসার সুযোগ হবে কি না কে জানে, মিশরের পিরামিড় কয়েকটা দেখে যেতেই হবে। কায়রোতে চিনি না কারুকেই, তাতে কী আসে যায়, সুটকেস হাতে নিয়ে ঘুরে-ঘুরে যার করেছিলাম একটা সস্তার হোটেল। স্ফিংকস ও স্টেপ পিরামিড দেখার পর একদিন একলা উট ভাড়া করে মরুভূমির ওপর দিয়ে গিয়েছিলাম দূরের পিরামিডগুলো দেখতে।

একদিন পয়সা-কড়ি হিসেব করে দেখলাম, হোটেলের বিল মেটাবার পর আমার কাছে আর মাত্র দশ ডলার থাকবে। এরপর ডামাস্কাসে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, তা আর হবে না। আমার প্লেনের টিকিটে যে-কোনও জায়গায় যাওয়া যায়, কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদন হবে কী দিয়ে? এবার তা হলে মুসাফির বাড়ি ফেরো।

যেদিন কলকাতা ছেড়ে গিয়েছিলাম, সেদিন তিরিশ-চল্লিশ জন বন্ধু গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। ফেরার সময় কারুকে খবর দিইনি, আমার জন্য উৎকণ্ঠ প্রতীক্ষায় কেউ নেই। প্যান অ্যাম-এর বিমানের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে আমার মনে হল, একটা নতুন দেশে এসেছি।

ট্যাক্সি ধরার ঝামেলার দরকার কী। আমি একটা বাসে চড়ে চলে এলাম নাগের বাজার। সেখান থেকে একটা সাইকেল রিক্সায় বাড়ি।

ষাটের দশকের গোড়াতেও বিলেত-ফেরত লোকদের বেশ খাতির ছিল। তারা বাড়ির মধ্যেও প্যান্টের মধ্যে শার্ট খুঁজে পরে থাকত, দয়া করে বাংলা বললেও তা কেনসিংটনের অ্যাকসেন্টে, কেউ কেউ কাঁটা-চামচ দিয়ে ভাত ও মাছের ঝোল খেত। দৈবাৎ কোনও বিলেত-ফেরতকে যদি দেখা যেত যে হাত দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে, তাহলে ভিড় জমিয়ে ফেলত পাড়ার বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। প্লেন থেকে নেমে রিক্সা চেপে বাড়ি ফেরা কোনও বিলেত ফেরতের পক্ষে ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। আমি মাত্র দিন পনেরো ইংল্যান্ডে ছিলাম, তবু বিলেত-ফেরত তো বটে, সেদিক দিয়ে আমি একটা রেকর্ড করেছি বলা যায়।

দুপুরবেলা মায়ের স্নেহ-মাখা মাছের ঝোল ভাত খেয়ে, ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে সন্ধেবেলা প্যান্ট-শার্ট ও চটি পরে কফি হাউসে হাজির। তখন কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে ছিল আমাদের নিত্য আড্ডা। এই দল থেকে চ্যুত হয়ে আমিই প্রথম আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলাম বলে অনেকেই আমাকে খরচের খাতায় লিখে রেখেছিল। হঠাৎ পাগলা দাশুর মতন আমার প্রত্যাবর্তনে অনেক যেন ভূত দেখেছিল। বন্ধুদের দলের মধ্যে শংকর আজ আর নেই বসেই তার কথা বেশি মনে পড়ে। শংকরই প্রথম উঠে এসে, তুই এসেছিস, বলে বিশালভাবে চেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে।

রাস্তায় ঘাটে চেনাশুনো লোকেরা দেখা হলে জিগ্যেস করত, কবে ফিরলে? আমি উত্তর দিতাম, গত কাল।…তিন দিন আগে…। গত সোমবার…। দিন দশেক কেটে যাওয়ার পর কেউ আর কিছু জিগ্যেস করে না, আমি ঝাঁকের কই, ঝাঁকে মিশে গেলাম। কিন্তু প্রথম প্রথম প্রত্যেক রাতে স্বপ্ন দেখতাম অদ্ভুত ধরনের। আমি কী যেন একটা অতি দরকারি জিনিস ফেলে এসেছি, সেটা আমার আনার জন্য চেপেছি আবার বিমানে। কিংবা আমি কোনও একটা অচেনা শহরে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু মার্গারিটকে স্বপ্নে দেখিনি একবারও। দিনের বেলা প্রায় সর্বক্ষণ মার্গারিটের কথা মনে পড়ে, অথচ তাকে স্বপ্নে দেখি না। স্বপ্নের নিয়ম বোঝা দুষ্কর।

আমি চিঠি লেখার আগেই মার্গারিটের প্রথম চিঠি এসে গেল। পি-এইচ-ডি শেষ করার পরই মার্গারিট চলে আসবে কলকাতায়, তার আগে সে আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে একটা চাকরি নিয়ে নেবে, মাইনে যতই কম হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। পল এঙ্গেল মার্গারিটকে জানিয়েছে, সুনীল ফিরে এলে তার জন্য এখনও সব বন্দোবস্ত করে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু মার্গারিট পল এঙ্গেলকে আমার হয়ে উত্তর দিয়ে দিয়েছে যে, এমনভাবে ফিরে আসার জন্য সুনীল জোর করে দেশে চলে যায়নি। দেশে তার অনেক কাজ আছে।

পল এঙ্গেলকে আমি যা চিঠি লিখতাম, তা আসলে মিথ্যের ফুলঝুরি। পলকে আমি জানাতাম যে দেশে ফেরা মাত্র আমি দু-তিনটে কাগজ থেকে লেখার জন্য অনুরুদ্ধ হয়েছি। টাকা দিচ্ছে বেশ ভালো, আমাদের কবিতার কাগজ দারুণ চলছে, তা ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাচ্ছি, তারা ভালো ফি দেয়, ইত্যাদি। আসল ব্যাপারটা হল, কেউ পাত্তাই দেয়নি আমাকে। তখন নকশাল আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণ, চতুর্দিকে আমেরিকা-বিরোধী হাওয়া। আমি যে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছি, তার কোনও গুরুত্ব নেই, আমি কেন আমেরিকা গিয়েছিলাম, সেই প্রশ্ন তুলে অনেকে চোখ রাঙায় (তাদের কেউ কেউ পরে বিলেত-আমেরিকায় পলায়ন করেছে, সেখানে অহংকার ও গ্লানির মিশ্র জীবন যাপন করছে)।

দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ আমাকে কয়েকদিনের মধ্যেই ডেকে অন্য দেশের কবিতা অনুবাদের সিরিজ চালাতে বলেছিলেন, বলতে গেলে প্রথম বছরে সেটাই ছিল আমার একমাত্র মরুদ্যান।

আমার অনুপস্থিতিতে কৃত্তিবাস পত্রিকা চালাবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন শরৎকুমার ও প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু ও ভাস্কর দত্ত। ফিরে এসে আমি এঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সেই পত্রিকা নিয়ে মেতে উঠলাম, কবিতা নিয়ে হইচই করাই ছিল আমার প্রধান সাধ। কিন্তু নিজের মা-ভাই-বোনদের সাহায্য করতেই দিশেহারা অবস্থা, এর মধ্যে পত্রিকা চালাবার অতিরিক্ত খরচ। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে গদ্য লেখা শুরু করতে হল। সংবাদপত্রের ফিচার। হাওড়া স্টেশনের ভিড়, পোষা বেড়াল, বাড়ির ঝিয়ের শিশু, হিটলারের ছবি আঁকার নেশা, বেনারস শহরের বডি বিধবা ইত্যাদি কত বিষয়েই যে আমি লিখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। কিছু বন্ধু-বান্ধব ও বয়স্ক লেখক-শুভার্থীরা বলতেন, ওহে, খবরের কাগজে অত ফিচার লিখলে ভাষা খারাপ হয়ে যায়, ভবিষ্যতে আর কবিতা কিংবা গল্প-উপন্যাস লিখতে পারবে না। আমি বলতাম, দাঁড়ান, আগে খেয়ে তো বাঁচি, পত্রিকাটাকে বাঁচাই, তারপর ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেখা যাবে।

সন্তোষকুমার ঘোষ আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে আমাকে একটা চাকরি দিয়ে দুর্গাপুরের প্রতিনিধি করে পাঠাতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। আমার মনে হয়েছিল, কলকাতা ছেড়ে দুর্গাপুরেই যদি যাব, তা হলে আমেরিকায় থাকলাম না কেন? আরও দু একটা চাকরির প্রস্তাব এসেছিল। তখনও আমার দু-চারটে বিদেশি জামা-প্যান্ট ছিল, আমার বেগুনি গালে ছিল খানিকটা লাল ছোপ, সুতরাং বিদেশি ছাপওয়ালা দু-একটা অফিসে আমার চাকরির সুযোগ ছিল কিছুটা, কিন্তু আমি দাঁতে দাঁত চেপে চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অহংকার বজায় রেখেছিলাম বেশ কয়েক বছর।

বাংলা লেখালেখির জন্য মূলত পয়সা পাওয়া যায় আনন্দবাজার থেকে। আমি তখন তিনখানা ছদ্মনাম সমেত মোট চারটি নামে লিখতাম। আমার কিছু বিদেশ ফেরার অভিজ্ঞতা আছে বলে সন্তোষকুমার ঘোষ কিছুদিন পর আমাকে আনন্দবাজারে ‘দেশে দেশে’ নামে একটি সাপ্তাহিক পৃষ্ঠা চালাবার ভার দিলেন। সেজন্য ওই অফিসে আমার জন্য একটা চেয়ার-টেবিলেরও ব্যবস্থা হল। বাইরের লোকের ধারণা, আমি আনন্দবাজারে তখন চাকরি করি, আসলে তা নয়, দিন আনি দিন খাই-এর মতন লিখলে টাকা, না লিখলে কিছুই না। এমনও হয়েছে, আমি ‘দেশে দেশে’র পুরো পৃষ্ঠা লিখে ও পেজ মেকআপ করে বাড়ি চলে গেলাম, পরদিন দেখি সে জায়গায় বাটা কোম্পানির এক পাতা বিজ্ঞাপন, আমার ভাগ্যে লবডঙ্কা! এই ভাবে টানা পাঁচ বছর চালিয়েছি।

কিন্তু এসবও তুচ্ছ মনে হত। গায়ের জোরটাকেই মনে হতো মনের জোর। এই পথ আমি নিজে বেছে নিয়েছি, সুতরাং হার স্বীকার করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কেউ বেশি অপমান করলে আমার উপকারই করত আসলে, সেই রাত্রেই একটা কবিতা লিখে ফেলতাম। অপমান কিংবা অবজ্ঞা বরাবরই আমায় কবিতা লেখার প্রেরণা দিয়েছে।

মার্গারিটের দু-তিনটে চিঠি পেলে আমি উত্তর দিতাম একটা। চিঠি লেখার ব্যাপারে আমার আলস্যের কথা মার্গারিট জানত, সে বসেই দিয়েছিল, তোমাকে বেশি লিখতে হবে না। ওর পি-এইচ-ডি শেষ হল দু-বছরে, কিন্তু তারপরেই কলকাতায় আসা সম্ভব হল না মাঝখানে ও একটা গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে পড়েছিল, তাই একটা সেমেস্টার বাদ গেছে। শেষ বছরটায় ও অ্যাসিস্টেন্টশিপ না নিয়ে শুধু পড়াশুনো করেছে, সেজন্য অনেক ধার হয়ে গেছে, চাকরি করে সেই ধার শোধ না দিলে ওর পক্ষে আমেরিকা থেকে বেরুনো সম্ভব নয়।

আমার পরে মীনাক্ষী ও জ্যোতির্ময় দত্ত গেলেন আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার পরে শঙ্খ ঘোষ। এঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মার্গারিটের, আমার বন্ধুদের মার্গারিট তার বন্ধু করে নিয়েছিল।

এরপর কেটে গেল প্রায় তিন বছর। সময় ও দূরত্বে অনেক দৃঢ় বন্ধনই ক্রমশ আলগা হতে থাকে। মার্গারিটের কলকাতায় আসা হল না, তার জন্য বুক টনটন করে কখনও কখনও, আবার অনেক সময় তার কথা ভুলেও যাই। কলকাতার উত্তাল জীবনে আয়ওয়ার দিনগুলির স্মৃতি ক্রমশ ফিকে হতে থাকে।

এর মধ্যে ফরাসি জানা এক বাঙালি যুবতী, আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ-এর এক ছাত্রী স্বাতীর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। কয়েক মাসের মধ্যেই আমার জীবন ঘুরে গেল অন্যদিকে।

আমি স্বাতীকে তাঁকে জানালাম মার্গারিটের সব কাহিনি। মার্গারিটকেও চিঠিতে জানালাম স্বাতীর কথা। ওরা পরস্পরকে চিঠি লেখা শুরু করল। মার্গারিটের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল গাঢ় বন্ধুত্বের, খানিকটা বিচিত্র বন্ধুত্ব মনে হতে পারে ঠিকই, আমরা পরস্পরের খুবই কাছাকাছি গিয়েছিলাম, কিন্তু বিয়ে বা একনিষ্ঠতার প্রতিশ্রুতি কেউ কারুকে দিইনি। আমি মাঝে মাঝে ইয়ার্কির ছলে জানতে চাইতাম, ও কোনও খাঁটি ক্যাথলিক বন্ধু পেয়েছে কি না, যে ওর মা-বাবাকে খুশি করতে পারবে! মার্গারিট জানাত যে এখন ওর অনেক বন্ধু, কিন্তু একজনও সেরকম বন্ধু নেই।

আমাদের বিবাহের সময় মার্গারিট কলকাতায় আসবেই ঠিক করেছিল, কিন্তু এই সময় ওকে আয়ওয়া ছেড়ে অন্য একটি শহরে পড়াবার চাকরি নিয়ে যেতে হল। নতুন চাকরিতে ছুটি পাওয়া যায় না। মার্গারিটের প্রত্যেক চিঠিতে ফুটে ওঠে কলকাতার জন্য ব্যাকুলতা। এই শহর সম্পর্কে সে অনেক কিছু শুনেছে। এখানে এসে সে আমার বাড়ি দেখবে, স্বাতীর সঙ্গে ভাব করবে, কবির দলের সঙ্গে আড্ডা দেবে, কিন্তু ক্রমশই তার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এক বছরের মধ্যে আমাদের পুত্র সন্তানের জন্মের খবর পেয়ে মার্গারিট আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে চিঠি দিল, খামের মধ্যে ভরে পাঠিয়ে দিল কিছু টাকা। সে টাকা আমাদের নিতেই হবে, কেন-না, মার্গারিট হয়েছে ওই ছেলের গড় মাদার, গির্জায় গিয়ে সে শিশুটির শুভ ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা করেছে।

এরপর মার্গারিট হঠাৎ নীরব হয়ে গেল। তিন-চার মাস কোনও সাড়া শব্দ নেই। আমি চিঠি দিয়েও কোনও উত্তর পাই না। একটা ক্রিসমাস পার হয়ে গেল, তবু মার্গারিটের কাছ থেকে কোনও কার্ড এল না দেখে আমি রীতিমতন চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মার্গারিট কাজে-কর্মে যতই ব্যস্ত হয়ে পড়ুক, কিংবা এর মধ্যে যদি কোনও যুবকের সঙ্গে তার সত্যিকারের প্রেম হয়েও থাকে, তাহলেও সে তার পুরোনো বন্ধুকে ক্রিসমাসের কার্ড পাঠাবে না, এ তো হতেই পারে না। চিঠি লিখতে ও খুব ভালোবাসে, এমনও হয়েছে যে আমি একই দিনে ওর দু-খানা খামের চিঠি পেয়েছি। শেষ চিঠিতে ও আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছে বলে জানিয়েছিল, তারপর কী হল?

মার্গারিটের খবর জানবার জন্য আমি পল এঙ্গেলকে চিঠি দিলাম। মার্গারিট কখনও পল এঙ্গেলের ডিপার্টমেন্টে যোগ দেয়নি, তবু পল এঙ্গেল তাকে ভালোই চিনতেন। পল এঙ্গেল উত্তরে আমাকে আয়ওয়া সম্পর্কে অনেক খবর দিলেন, কিন্তু তাতে মার্গারিটের নাম একেবারে উহ্য।

তবে কি মার্গারিট কোনও কারণে আমেরিকা ছেড়ে ফ্রান্সে ফিরে গেছে। মোনিকের নতুন বাড়ির ঠিকানা আমি হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু মার্গারিটের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা আমার কাছে লেখা আছে। খুব বিনীতভাবে মার্গারিটের বাবাকে একটা চিঠি লিখলাম, তাঁর মেয়ে এখন কোথায় আছে সেটুকু জানতে চেয়ে। কিছুদিনের মধ্যেও উত্তর না পেয়ে মনে হল, ওঁর বাবা-মা বোধহয় ইংরেজি বোঝেন না। তখন আমার ফরাসি ভাষাবিদ বন্ধু বুঢ়াকে দিয়ে চিঠিখানা অনুবাদ করে পাঠালাম আবার। এবারেও কোনও উত্তর নেই।

মার্গারিটের সঙ্গে আমার যোগাযোগের সমস্ত সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।

মার্গারিট আমাকে ভুলে গেছে মনে করে অভিমান হত মাঝে মাঝে, আবার ঠিক বিশ্বাসযোগ্যও মনে হত না। মার্গারিটের মতন মেয়ে কোনও বন্ধুকে এমনভাবে পরিত্যাগ করতে পারে না।

ততদিনে গদ্য ফিচার লিখতে লিখতে আমাকে গল্প-উপন্যাসের জগতেও বাধ্য হয়ে প্রবেশ করতে হয়েছে। লেখালেখির ব্যস্ততা, তুমুল আড্ডা এবং যখন তখন কলকাতার বাইরে চলে যাওয়ার মধ্যে অভিমান কিংবা মন খারাপেরই বা সময় কোথায়? কখনও পঞ্চাশ-একশো টাকা জুটলেই চলে যাই বন-জঙ্গলে, শক্তির সঙ্গে, সন্দীপদের সঙ্গে, শরকুমারের সঙ্গে। একবার বেলপাহাড়ির এক কাঠ গুদামের মধ্যে রাত্তিরে খোলা আকাশের নীচে একটা খাঁটিয়ায় আর এক বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে শুয়ে থাকতে-থাকতে মনে হয়েছিল, আমেরিকায় আমি গাড়ি চালানো শিখছিলাম, আর একটু হলেই গাড়িটা কিনে ফেলতে হত, তারপর গাড়ির সঙ্গে বাড়ি কিনে আমি ওদেশেই যদি থেকে যেতাম, তা হলে জীবনটা কি এর চেয়ে ভালো কাটত? নাঃ, কিচ্ছু আসে যায় না, বেশ আছি!

ফরাসি ভাবা যেটুকু শিখেছিলাম, তাও ভুলে যেতে লাগলাম আস্তে-আস্তে। মার্গারিট আমাকে একটা ছোট তেরঙা ফরাসি পতাকা দিয়েছিল, সেটা শুধু অনেকদিন রেখে দিয়েছিলাম আমার পড়ার টেবিলে। পশ্চিমি জগতে আর কোনওদিনও আমার যাবার সম্ভবনা ছিল না। তখন বিদেশ বলতে আমার দৌড় নেপাল ও বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ যুদ্ধের বছরে গিনসবার্গ একবার কলকাতা ঘুরে গেল। আগে থেকে চিঠিপত্র না লিখে সে হঠাৎ আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাটে হাজির। বাড়িতে তখন আর কেউ নেই, শুধু আমাদের রাঁধুনি গোপালের মা ছাড়া। অ্যালেন তাকেই আমার মা ভেবে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করায় গোপালের মা সারাদিন ধরে হেসে-কেঁদে অস্থির। একমুখ দাঁড়ি ভর্তি সেই গৌরবর্ণ পুরুষটিকে গোপালের মা মনে করেছিল কোনও দেবতা।

অ্যালেনকে আমি নিয়ে গেলাম সীমান্তের শরণার্থীদের দুর্দশা দেখাতে। সে বছর বন্যা হয়েছিল এমন যে যশোর রোড ডুবে গিয়েছিল অনেকটা। গাড়ি ছেড়ে আমরা নৌকো করে গিয়েছিলাম বনগাঁ পেরিয়ে। তারপরেই অ্যালেন লেখে তার বিখ্যাত কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তার কয়েকটা লাইন এরকম :

Millions of souls nineteen seventy one
Homeless on Jessore Road under gray sun
A million are dead, the millions who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan…
Wet Processions families walk
Stunted boys big heads don’t talk
Look bony skulls & silent round eyes
starving balck angels in human disguise…

অ্যালেন এই দীর্ঘ কবিতাটিতে সুর দিয়ে গান করেছিল ফিরে গিয়ে। তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়করা অনেক টাকা চাঁদা তুলেছিল এই শরণার্থীদের জন্য।

কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার সময় অ্যালেন আমাকে জিগ্যেস করেছিল, তুমি আর নিউ ইয়র্ক আসবে না?

আমি বলেছিলাম, পাগল নাকি! পয়সা কোথায় পাব? তোমার বাড়িতে থাকার জায়গা দিলেও প্লেন ভাড়ার অত টাকা আমায় কে দেবে? আমার এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোবার মতন অবস্থা।

তখন আর ইউরোপ-আমেরিকা ফিরে যাওয়ার কোনেও ইচ্ছেও আমার হয়নি।

অ্যালেন চিনত না মার্গারিটকে, সুতরাং তার কাছে ও প্রসঙ্গও তুলিনি।

আরও কয়েক বছর পর পল এঙ্গেল আবার এলেন কলকাতায়। সস্ত্রীক, কিন্তু এ স্ত্রী অন্য। মেরির সঙ্গে ইতিমধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেছে, দুঃখে, অভিমানে মেরি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সে কথা শুনেই আমার মধ্যে অপরাধ বোধ জাগল। মেরি আমাকে মাতৃবৎ স্নেহ করতেন, দুঃসময়ে আমাকে সাহায্য পাঠিয়েছিলেন, সেই টাকা না পেলে আমার রোম-ইজিপ্ট দেখাই হত না, তবু মেরির সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখিনি, একখানার বেশি চিঠি লিখিনি!

পল এঙ্গেলের দ্বিতীয় স্ত্রী বেশ সুন্দরী, মধ্যবয়স্কা এক চিনা রমণী। হুয়া লিং একজন বিশিষ্ট লেখিকাও বটে, আধুনিক চিনা সাহিত্যে তাঁর বিশেষ স্থান আছে। হুয়া লিং আগে ছিলেন তাইওয়ানের মেয়ে, পরে মেইন ল্যান্ড চায়নার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তখন কিসিংগার-নিকশনের তৎপরতায় এবং চৌ-এন লাইয়ের ব্যগ্রতায় আমেরিকার সঙ্গে চিনের বেশ দহরম মহরম শুরু হয়ে গেছে, চলছে ব্যাবসা-বাণিজ্য, টুরিস্ট ও সাংস্কৃতিক বিনিময়। পল এঙ্গেল কলকাতায় এসেছেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু তাঁর আসল গন্তব্য বেইজিং-এর দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ি।

পল এঙ্গেলের বয়েস তখন সত্তর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু বয়েস তাকে স্পর্শ করেনি। তাঁর চোখ-মুখ নব বিবাহিত যুবকের মতন উদ্ভাসিত, আর হুয়া লিং-এর আগের পক্ষের দুটি বড় বড় সন্তান থাকলেও তাঁকে তরুণী বলে মনে হয়।

দমদম এয়ারপোর্টে জ্যোর্তিময় দত্ত অনেক বাজি পুড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন এই দম্পতিকে। পল মহা উৎসাহে তাঁর স্ত্রীকে বোঝাতে লাগলেন, কলকাতা কত গ্রেট সিটি, এখানেই জন্মেছেন রবীন্দ্রনাথ।

আমাদের দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন, নিমতলা ঘাটে রবীন্দ্রনাথের সেই ‘সমাধি স্থানটিতে’ গতবার গিয়েছিলাম, মনে আছে, গঙ্গা নদীর কী অপূর্ব রূপ। হুয়া লিংকে এই সব দেখতে হবে! হুয়া লিং চিনে হলেও জীবনে এই প্রথম রিকশা দেখবো।

নানান গল্পের ফাঁকে প্রথম একটু সুযোগ পেয়েই আমি ওঁকে নিভৃতে জিগ্যেস করলাম, পল, তুমি কি মার্গারিট ম্যাথিউ নামে মেয়েটির কোনও খবর জানো? ওকে তোমার মনে আছে?

চিঠিতে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন পল এঙ্গেল, কিন্তু আমার সামনাসামনি মিথ্যে কথা বলতে পারলেন না। আমার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীরভাবে বললেন, হ্যাঁ, জানি!

আমি আবার জিগ্যেস করলাম, কী হয়েছে তার? আমার চিঠির উত্তর দেয় না, সে এখন কোথায় আছে?

পল আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, সামথিং হ্যাজ হ্যাপনড! সে ঘটনা তোমার না শোনাই ভালো, সুনীল, তুমি সহ্য করতে পারবে না। আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে কিছু জানাইনি।