১৪. পুরুষের বেশে অশ্বারোহিনী

পুরুষের বেশে অশ্বারোহিনী, কোমরবন্ধে তলোয়ার ও পিস্তল, দীপ্ত যৌবনবন্ত রানি ক্রিসটিনা মাত্র সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজত্ব করে গেলেও, তাঁর জীবনচরিত রূপকথার রানির মতো। সুইডেনের রাজা গুসটাভাস এডোলাস চেয়েছিলেন, তাঁর পুত্র সন্তান হয়নি বলে, একমাত্র মেয়ে ক্রিসটিনাকেই পুরুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। শৈশব থেকেই ক্রিসটিনাকে যুদ্ধ বিজয়, অশ্বারোহণ এবং রাজনীতি শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন। যে দশ বছর ক্রিসটিনা সুইডেনে রাজত্ব করেছেন, কখনও দুর্বলতা দেখাননি।

বাবা তাঁকে পুরুষ করতে চেয়েছিলেন, ক্রিসটিনা পুরুষের বহু গুণই আয়ত্ত করেছিলেন। শুধু যুদ্ধ নয়, পাঁচটি ভাষা তিনি শিখেছিলেন, জ্ঞান ও শিল্পকলায় ছিল আন্তরিক অভিরুচি। দেশ-বিদেশের দার্শনিকদের ও গুণীদের আমন্ত্রণ করেছিলেন নিজ সভায়, প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক দেকার্তকে নিযুক্ত করেছিলেন নিজের শিক্ষক। প্রত্যেকদিন ভোর পাঁচটায় উঠে তাঁর কাছে পাঠ নিতেন। (সুইডেনের চরম শীতের মধ্যে অত ভোরে, ঘুম ভাঙার জন্যই বোধ হয় সর্দি জ্বরে, দেকার্ত মারা যান)।

বিক্ষুব্ধ সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপে একটি তরুণী মেয়ের পক্ষে রাজ্য চালনা করা শক্ত, তা অনুমান করা যায়। এজন্য ক্রিসটিনা অন্যান্য পুরুষসুলভ মানসিক জোরের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর সমসাময়িকরা বলেছেন ক্রিসটিনা একাই একশোটি নারীর সমান! আর একজন বলেছেন অন্য মেয়েদের কাছে সূচ-সূতো যেমন স্বাভাবিক, ক্রিসটিনার কাছে নানান বিদ্যাশিক্ষা তেমনি স্বাভাকি। সারাজীবনে বিয়ে করেননি ক্রিসটিনা কিন্তু সুকুমারবৃত্তির দিকে তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। পাঁচ বছর বয়সে, তাঁর বাবা যখন একবার যুদ্ধে যান, ক্রিসটিনা বাবাকে বলেছিলেন, বাবা, যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় আমার জন্য একটা সুন্দর জিনিস এনো। সাজিয়ে রাখার মতো সুন্দর। ক্রিসটিনা নিজে যখন রানি হলেন ১৮ বছর বয়সে, তখন তিনি তাঁর সমস্ত কর্মচারী, সৈন্যাধ্যক্ষদের হুকুম দিয়েছিলেন, যেখানে যত ছবি, ভাস্কর্য, শিল্প সামগ্রী পাওয়া যাবে–সবই যেন তৎক্ষণাৎ তাঁকে এনে দেখানো হয়। ১৬৪৮ সালে যখন একবার প্রাগ শহর প্রবল ঝড়ের মুখে তছনছ হয়ে যায়, তখন ক্রিসটিনা তাঁর সেখানকার সমর দূতকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, ঝড়ের তান্ডবের মধ্যে আর যা কিছু বাঁচাতে পারো আর নাই পারো, ওখানকার লাইব্রেরি আর শিল্প সামগ্রী যেন একটাও নষ্ট না হয়। জানো তো, এইগুলিই চিরকাল বেঁচে থাকার যোগ্য, এবং আমি এদেরই বেশি মূল্য দিই।

এইভাবে ক্রিসটিনা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প-সংগ্রাহক হয়েছিলেন। তাঁর রাজত্বকালের দশ বছরের মধ্যেই অবশ্য দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে। প্রোটেস্টান্টদের দেশ সুইডেন, কিন্তু ক্রিসটিনা ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন, ফলে তাকে সিংহাসন ও দেশ ছাড়তে হয়। ক্রিসটিনার জীবন এর পরবর্তী ঘটনা অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। শিল্পপ্রীতির জন্যই ক্রিসটিনা ধর্মান্তর গ্রহণ করেন এবং তাঁর সমস্ত দুর্লভ শিল্প সংগ্রহ তিনি গোপনে আগেই রোমে পাঠিয়ে দেন। সুইডেন থেকে গোপনে বেরিয়ে এসে তিনি জারমানিতে প্রবেশ করলেন পুরুষ নাইটের ছদ্মবেশে। তার দেড় বছর পর, তিনি রোমে প্রবেশ করলেন। রানির সম্মানে স্বয়ং পোপ সপ্তম আলেকজান্ডার সুসজ্জিত কোচ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর জন্য, রাস্তার দুপাশে প্রহরীদের অভিবাদন, ভ্যাটিকান থেকে কামান গর্জে উঠেছিল তার সম্মানে। রাজ্যহীনা রানির বয়স তখন তিরিশের কাছাকাছি, পূর্ণযুবতী, কুমারী।

রোমে আসার পর, কিছু সম্রান্তদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তিনি নেপলসের সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর ইটালিয়ান প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতায় তা ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন সেই প্রেমিকের শিরচ্ছেদ করিয়ে, এরপর আর প্রেম বা সিংহাসনের জন্য লোভ করেননি। বাকি ত্রিশ বছর তিনি রোমের শিল্পী-সমাজের শিরোমনি হয়ে বিরাজ করেন। ভ্যাটিকানের কাছেই তাঁর শিল্প সংগ্রহশালায় একবার আসেননি, সে যুগে এমন শিল্পপ্রেমিক প্রায় ছিলই না। নিজ রাজ্য থেকে বহু দূরে অসংখ্য চিত্র, ভাস্কর্য গ্রন্থ প্রাচীন সংগ্রহের মধ্যে বিরাজমান একা বিদুষী রানির মূর্তি সমগ্র ইওরোপের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ধর্মান্তর ও পলায়নের জন্য তাঁর নিজের দেশ সুইডেন অবশ্য কখনও আর তাঁকে হৃষ্টচিত্তে স্বীকার করতে পারেনি। কিন্তু সুইডিশরা এখনও দুঃখ করে বলে ক্রিসটিনা রোমে চলে না গেলে বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালা থাকতো সুইডেনেই, প্যারিসের লুভর মিজিয়ামের সুনামও খর্ব হয়ে যেত। ৬১ বছর বয়সে মৃত্যু হবার পর পোপ সমস্ত নিয়মভঙ্গ করে ক্রিসটিনাকে ভ্যাটিকানের মধ্যে কবরস্থ করার অনুমতি দেন। বহুবছর পরে ভলট খুলে দেখা গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত ক্রিসটিনার মুখে রানির মহিমা ও অভিমান লেপ্টে ছিল।

মৃত্যুকালে ক্রিসটিনার সংগ্রহের মধ্যে ছিল ১৫০০ ছবি ও বহু ভাস্কর্য পাণ্ডুলিপি দুর্লভ বই প্রভৃতি। তাঁর মৃত্যুর পর এগুলি ইটালির সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে নেয়। পরবর্তী যুগে সেগুলি আরও নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

একবার কাউনসিল অফ ইউরোপের উদ্যোগে স্টকহলমে রানি ক্রিসটিনার শিল্প সংগ্রহ বিভিন্ন দেশ থেকে আহরিত করে একটি অভিনব প্রদর্শনী হয়। উদ্যোক্তরা এজন্য নানা দেশের সংগ্রাহকদের কাছে আবেদন জানান, ভারতবর্ষের বরোদার মহারাজাও ক্রিসটিনার কিছু সংগ্রহ প্রদর্শনীতে পাঠিয়েছেন। ক্রিসটিনার নিজস্ব তালিকা অনেক সংগ্রহই পাওয়া যায়নি, অনেক মিউজিয়াম হারাবার বা নষ্ট করার ভয়ে পাঠাতে চাননি, অনেকগুলির কোনও পাত্তাই নেই, কিছু আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যা সংগৃহীত হয়েছিল সেই সমস্ত শিল্পসম্ভারে প্রদর্শনী ভবনের ৩৬টি ঘর ভরে গিয়েছে। এটাই ইওরোপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিল্প প্রদর্শনী।

প্রদর্শনীতে ইটালিয়ান মার্থারদের মধ্যে যফায়েল টিমিয়ান, ভেরোনিজের বহু ছবি আছে, প্রখ্যাত ভাস্কর বারনিজির বহু সংখ্যক দান এবং উত্তর ইওরোপের রেনেসাঁসের শিল্প উপহার দেখতে পাওয়া যায় আরও অনেকের। এ ছাড়া আছে বহু শিল্পীর আঁকা ও তৈরি করা ক্রিসটিনার খুব আগ্রহ ছিল, গ্রিক ও রোমান ভাস্কর্যের বিপুল নগ্ন মূর্তির সমারোহ স্থান পেয়েছিল এই প্রদর্শনীতে। এই সব মুর্তির সামনে নিঃসঙ্গ ও রাজ্যহীনা রানি ক্রিসটিনা বসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।