১২. যদি যাও বঙ্গে

গাড়িটা গেস্ট হাউসের গেট ছাড়িয়ে বাইরে পড়বার পর লোকগুলো দুটো কালো কাপড় দিয়ে কাকাবাবু আর সন্তুর চোখ বেঁধে দিল। কাকাবাবুর তো বাধা দেবার কোনও ক্ষমতাই নেই, সন্তুও বুঝল বাধা দেবার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই।

নার্স সুনীতি দত্ত ওদের সঙ্গেই এসেছে আর লোকগুলোর সঙ্গে বেশ গল্প জুড়ে দিয়েছে। এই নার্স তাহলে শত্রুপক্ষেরই লোক। কাকাবাবুর মাথার গোলমাল হলেও এটা তো ঠিকই বুঝেছিলেন। এই জন্যই তিনি বলেছিলেন যে, এই নার্স হচ্ছে চামেলির দিদি।

সন্তু কাকাবাবুকে কোনওদিন গান গাইতে শোনোনি। কিন্তু এখন এই চলন্ত গাড়িতে কাকাবাবু গুনগুন করে গান ধরেছেন। মেশিনগান ও রিভলভারধারী কয়েকজন দস্যুর সঙ্গে যে তিনি বসে আছেন সে ব্যাপারে যেন তাঁর কোনও দুশ্চিন্তাই নেই। অথচ সন্তুর বুকের মধ্যে ধকধক করছে। কাকাবাবু যে গান গাইছেন, তার সুরও যেমন বেসুরো, কথাগুলোও অদ্ভুত।

কাকাবাবু গাইছেন :

যদি যাও বঙ্গে
কপাল তোমার সঙ্গে।
ত্রিপুরায় যারা যায়
তারা খুব কাঁঠাল খায়।
ধর্মনগর উদয়পুর
কোনদিকে আর কতদূর…

এই রকম আরও কী সব যেন কাকাবাবু একটানা গেয়ে যেতে লাগলেন, সন্তু সব কথা বুঝতে পারল না গাড়ির আওয়াজে। গাড়িটা যে খুব জোরে ছুটছে, তা বোঝা যায়। সন্তু মনে-মনে আন্দাজ করার চেষ্টা করল। ঘণ্টায় কত মাইল? ষাট? রাত্তিরবেলা রাস্তা ফাঁকা, আরও বেশিও হতে পারে।

এই রকম বিপদের মধ্যেও মানুষের ঘুম পায়? কাকাবাবু অনেকক্ষণ চুপচাপ। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। সন্তুরও ঝিমুনি এসেছিল খানিকটা, হঠাৎ আবার ধড়ফড় করে উঠে বসল।

আর অমনি একজন কেউ তার মাথায় একটা চাপড় মেরে বলল, চুপ করে বসে থাক। অত ছটফটানি কিসের?

অন্যান্যবারে সন্তু এর চেয়েও অনেক বেশি বিপদের মধ্যে পড়েছে। কিন্তু আগে সব সময়ই মনে হয়েছে, কাকাবাবু কিছু না কিছু একটা উপায় বার করবেনই। কিন্তু এবারে কাকাবাবুরই তো মাথার ঠিক নেই। এবারে আর উদ্ধার পাওয়া যাবে কী করে?

কাকাবাবুর মতন একজন অসুস্থ লোককে ধরে নিয়ে যাবার জন্য এই লোকগুলো এত ব্যস্ত কেন, তাও সন্তু বুঝতে পারছে না। পুরনো কোনও শত্রুতা?

গাড়ির গতি কমে এল আস্তে আস্তে। তারপর থামল এক জায়গায়। সন্তুর চোখ বাঁধা। তাকে এখন কী করতে হবে সে জানে না।

একজন লোক সন্তুর হাত ধরে ট্রেকার থেকে নীচে নামল।

একজন কেউ হুকুমের সুরে বলল, ছেলেটার চোখ খুলে দাও; কিন্তু হাত বেঁধে রাখো ওর। খেয়াল রেখো, ও কিন্তু মহা বিচ্ছু ছেলে!

সন্তুর চোখের বাঁধন খুলে দেবার পর সে দেখল অনেক গাছপালার মধ্যে একটা দোতলা বাড়ির সামনে থেমেছে তাদের গাড়ি। সেই বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন বেশ লম্বামতন লোক, নস্যি রঙের সুট পরা, চোখে কালো চশমা। অন্ধ ছাড়া আর কেউ যে রাত্তিরে কালো চশমা পরে, তা সন্তু আগে জানত না।

একজন লোক কাকাবাবুর এক হাত ধরে নীচে নামাতে গেল। কাকাবাবু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। বেশ জোরেই পড়েছেন, কারণ সন্তু ঠকাস করে ওঁর মাথা ঠুকে যাবার শব্দ পেল।

কালো-চশমা পরা লম্বা লোকটি ধমক দিয়ে বলল, ইডিয়েট! সাবধানে! জানো না, ওর এক পায়ে চোট আছে। নিজে নিজে দাঁড়াতে পারে না! একজন ওর মাথার কাছে রিভলভার ধরে থাকো, কখন যে কী করবে ঠিক নেই। ওকে সার্চ করেছ?

দুজন লোক কাকাবাবুকে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দিল। একজন বলল, হ্যাঁ, সার্চ করে দেখেছি, কাছে কোনও ওয়েপন্ নেই।

কাকাবাবুর গায়ে স্লিপিং সুট। খালি পা। আছাড় খাবার সময় নিশ্চয়ই খুব ব্যথা লেগেছে। কিন্তু তাঁর যেন সে বোধই নেই। তিনি আবার গুনগুন করে গান ধরলেন :

যদি যাও বঙ্গে
কপাল তোমার সঙ্গে
যারা যায় ত্রিপুরায়
যখন-তখন আছাড় খায়…।

লম্বা, কালো-চশমা পরা লোকটি বিস্ময়ে একটা শিস দিয়ে উঠল। তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, গান গাইছ, অ্যাঁ? কী রায়চৌধুরী, নেশা-টেশা করেছ নাকি?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, পি লে, পি লে, হরিনাম কা পেয়ালা–ইন ঠুন ঠুন। মাতোয়ালা, মাতোয়ালা, হরিনাম কা পেয়ালা!

লোকটি এক হাত বাড়িয়ে কাকাবাবুর থুতনি ধরে উঁচু করে বললেন, ওসব নকশা ছাড়ো। কী রায়চৌধুরী, আমায় চিনতে পারো?

কাকাবাবু একদৃষ্টে লোকটির মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, চেনা চেনা লাগছে। তুমি পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানা না?

লোকটি ঠাস করে এত জোরে চড় মারল কাকাবাবুর গালে যে, কাকাবাবুর মুখটা ঘুরে গেল। তারপর অন্য গালে ঠিক তত জোরে আবার একটা চড় মেরে লোকটা বলল, এবার নেশা কেটেছে? এবার ভাল করে দ্যাখো তো চিনতে পারো কি না?

কাকাবাবু আবার লোকটির মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন। সেই একই রকম গলায় বললেন, হুঁ, আগের বারে ভুল হয়েছিল। তুমি আসলে রামগড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা, হাসির কথা শুনলে বলে হাসব, না না না না!

লোকটি আবার মারবার জন্য হাত তুলতেই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, মারবেন না, মারবেন না। উনি সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ।

সন্তু দারুণ চমকে উঠল। এ তো ডাক্তার প্রকাশ সরকারের গলা!

কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে সন্তু তাকে দেখতে পেল না। বেশি খুঁজবারও সময় নেই। সন্তু আবার এদিকে তাকাল।

কালো-চশমা পরা লোকটি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, রায়চৌধুরী অতি ধুরন্ধর! ওসব ভেক আমি জানি। ওর পেটের কথা আমি ঠিক বার করবই। দেখি ও কত মার সহ্য করতে পারে।

লোকটি আবার এক চড় কষাতে গেল কাকাবাবুকে। তার আগেই সন্তু ছুটে গিয়ে এক কুঁ মারল লোকটার পেটে। আচমকা আঘাত পেয়ে লোকটা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল মাটিতে।

সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজন লোক এসে চেপে ধরল সন্তুকে। একজন তার কপালের ওপর রিভলভারের নল চেপে ধরল।

লম্বা লোকটি উঠে পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, বলেছিলুম, এটা একটা শয়তানের বাচ্ছা। ওর ব্যবস্থা আমি পরে করছি। আগে বুড়োটাকে টিট করি।

কাকাবাবু এই সব কোনও ব্যাপারেই একটুও বিচলিত হননি। মুখে এখনও মৃদু-মৃদু হাসি। লম্বা লোকটি তাঁর মুখোমুখি হতেই তিনি বললেন, তা হলে কী ঠিক হল? তুমি পান্তভূতের ছানা, না রামগড়ের ছানা?

লম্বা লোকটি অতি কষ্টে রাগ দমন করে বলল, রায়চৌধুরী, তোমার সঙ্গে আমি এক তাঁবুতে কাটিয়েছি সাত দিন। তুমি আমায় চিনতে ঠিকই পারছ। তুমি ভালয় ভালয় জঙ্গলগড়ের সন্ধানটা দিয়ে দাও। তারপর তোমায় ছেড়ে দেব। নইলে এখান থেকে তোমার বেঁচে ফেরার কোনও আশাই নেই।

কাকাবাবু বললেন, জঙ্গলগড়? সে আবার কী? এর কথা তো সুকুমার রায় লিখে যাননি। জঙ্গলগড়ের বদলে তুমি চণ্ডিগড়ে যেতে চাও? কিংবা গড়মান্দারনপুর?

লম্বা লোকটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, এদের ওপরে নিয়ে চলল। হাত-পা বেঁধে রাখবে। তারপর আমি দেখছি।