১১. স্টেশন ওয়াগানটা কোণ্ডাগাঁওতে

স্টেশন ওয়াগানটা কোণ্ডাগাঁওতে যখন পৌঁছল তখন রাত প্রায় এগারোটা। চারদিক একেবারে নিঝুম, রাস্তায় আর কোনও গাড়ির শব্দ পর্যন্ত নেই। কোনওদিকে এক বিন্দু আলোও দেখা যায় না।

গাড়ি চালাচ্ছেন মাধব রাও নিজেই। কাকাবাবু বসে আছেন তার পাশেই। গাড়ির মধ্যে রয়েছে অংশুমান চৌধুরী আর তাঁর সহকারী ভীমু। তাদের কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

গাড়ি থামিয়ে মাধব রাও বললেন, ব্যাস, এই পর্যন্ত! সারা দিন গাড়ি চালিয়ে আমি একেবারেথকে গেছি। আজ রাতের মতন এখানেই রেস্ট নিতে হবে।

অংশুমান চৌধুরী ঘুমোচ্ছিলেন। গাড়ি থামতেই তিনি জেগে উঠে বসলেন, পৌঁছে গেছি? কোথায় এলাম? এ জায়গাটার নাম কী?

মাধব রাও বললেন, এই তো আপনার কোণ্ডাগাঁও। দেখুন, মাইল পোস্টে নাম লেখা আছে। এবারে কী করবেন?

অংশুমান চৌধুরী জানলা দিয়ে টর্চ ফেলে রাস্তাটা দেখলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে। এবারে ডান দিকের রাস্তাটায় চলুন। এক মাইলের মধ্যে একটা সাদা বাড়ি দেখতে পাবেন, সেখানেই থামবেন। ভীমু, তৈরি হয়ে নে!

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল এবং খানিক বাদে একটা বড় সাদা বাড়িও পাওয়া গেল। সেটা একটা পি.ডব্লু.ডি.-র বাংলো। গেটখোলা, গাড়ির আওয়াজ শুনেই গেটের বাইরে একটি লোক এসে দাঁড়াল।

ভীমু আগে গেট থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল, সব ঠিক আছে?

লোকটি বাংলাতেই বলল, হ্যাঁ স্যার। সব ঠিক আছে। এখানে কুকুর-বিড়াল কিছু নেই। রান্না-টান্নাও সব করে রেখেছি।

কাকাবাবু এক দৃষ্টিতে সামনের অন্ধকার দেখছিলেন চুপ করে। আকাশে অল্প-অল্প মেঘ। অনেক দূরে মাদলের শব্দ হচ্ছে, ডুং-ডুং, ডুং-ডুং।

মাধব রাও বললেন, এবারে নামুন, মিঃ রায়চৌধুরী।

কাকাবাবু আস্তে আস্তে নামলেন। ডাকবাংলোর গেটের কাছে এসে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু এখানে আছে?

অংশুমান চৌধুরী বললেন, হ্যাঁ, আপনার ভাইপো আর আমাদের জোজো এখানেই আছে। কোনও চিন্তা নেই।

কাকাবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, সন্তু, সন্তু?

কোনও উত্তর এল না। ডাকবাংলোর লোকটি বলল, ছেলেদুটি তো চলে গেছে, স্যার?

অংশুমান চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন, চলে গেছে? তার মানে? কোথায় চলে গেছে?

লোকটি বলল, আজ সন্ধেবেলাতেই চলে গেল। ওরা বলল যে, এই জায়গাটা ভাল লাগছে না। তাই বোধহয় নারানপুরের দিকে গেল।

সঙ্গে কে ছিল?

সঙ্গে আর একজন লোক ছিল, নাম ঠিক জানি না। ৯৪

কাকাবাবু অংশুমান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি সন্তুর কথা বলে আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছেন। এখানেও সন্তুর দেখা পাওয়া গেল না। এরপরেও কি আপনাকে আমি বিশ্বাস করব?

অংশুমান চৌধুরী বললেন, এখানেই থাকার কথা ছিল। সন্ধেবেলা ওরা দুজনে কেন চলে গেল তা আমি জানি না। আপনাকে আমি মিথ্যে কথা বলব কেন? নারানপুর এখান থেকে বেশি দূরে নয়, কাল সকালেই খোঁজ করা যাবে।

আপনি যে সত্যি কথা বলছেন তার প্রমাণ কী?

প্রমাণ, মানে, তারা তো ছিলই এখানে। এই, ইয়ে, ছেলে দুটি ডাকবাংলোর খাতায় নাম-টাম লেখেনি?

ডাকবাংলোর লোকটি বলল, হ্যাঁ স্যার, লিখেছে। ওদের সঙ্গের লোকটি সব চার্জ মিটিয়ে দিয়ে গেছে।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, কই, খাতাটা দেখাও এঁকে।

সবাই ঢুকে এল ডাকবাংলোর মধ্যে। কাকাবাবু খাতাটা দেখলেন। সন্তু নিজের নাম লিখেছে। সুনন্দ রায়চৌধুরী। হাতের লেখাটা সন্তুরই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

কাকাবাবু বললেন, আপনার চালাকিটা বোঝা এমন কিছু শক্ত নয়। আপনারা সন্তুকে বলেছেন, আমি এক জায়গায় আছি। সেই শুনে সন্তু সেখানে যাচ্ছে। আবার আমাকে বলছেন, সন্তু ওমুক জায়গায় আছে। আমিও তাই শুনে সেখানে যেতে রাজি হচ্ছি। সন্তুকে এখান থেকে সরানো হল কেন আমি জানতে চাই।

অংশুমান চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, আরে মশাই, আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন? আপনার ভাইপো যদি নিজের ইচ্ছেয় অন্য জায়গায় চলে যায়, তা হলে আমি কী করব?

কাকাবাবু এর উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, মাধব রাও হাত তুলে বললেন, আগে আমাকে একটা কথা বলতে দিন। আমি খুব টায়ার্ড। এই বাংলোতে আমার থাকার ইচ্ছে নেই। আমি আজ রাতেই জগদলপুরে চলে যাব। তার আগে আমার বন্ধু অনন্ত পট্টনায়কের পক্ষ থেকে একটা ফাইনাল কথা বলে নিতে চাই।

ডাকবাংলোর লোকটির দিকে ফিরে তিনি বললেন, আপনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াবেন, প্লিজ। আমি এঁদের দুজনের সঙ্গে প্রাইভেটলি কথা বলতে চাই।

লোকটি বাইরে চলে যেতেই মাধব রাও দরজা বন্ধ করে দিলেন। চুরুট ধরিয়ে বললেন, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, এবারে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, আপনাকে কিংবা আপনার নেফিউ-কে কলকাতা থেকে নিয়ে আসার ব্যাপারে আমাদের কোনও দোষ দিতে পারবেন না। এসব ব্যবস্থা করেছেন মিঃ অংশুমান চৌধুরী। সে আপনি ওঁর সঙ্গে বুঝে নেবেন। আমরা কেউ আর এর মধ্যে থাকতে চাই না। আমরা শুধু আমাদের চুরি যাওয়া মূর্তিটা সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড।

কাকাবাবু বললেন, আপনাদের মূর্তি সম্পর্কে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।

মাধব রাও বললেন, আমার কথাটা শেষ করতে দিন। এরপর থেকে আমরা আর আপনাদের কাছে থাকব না। আমি জগদলপুরে দিন-দশেক থাকব। এর মধ্যে আপনাদের একজন যদি মূর্তিটা উদ্ধার করে আনতে পারেন, তাহলে আমরা তিন লক্ষ টাকা দেব। সব খরচ-খরচা আপনাদের। আর যদি দুজনে এক সঙ্গে উদ্ধার করে আনেন, তা হলে টাকাটা দুজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।

কাকাবাবু দারুণ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, আমি কতবার বলব যে, আপনাদের ওই মূর্তি-টুর্তির ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ নেই?

মাধব রাও বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আমি শেষবার অনুরোধ করছি, আপনি আমার সঙ্গে ওরকম ধমক দিয়ে কথা বলবেন না। আপনি কাজ করতে চান না, তো ইউ মে গো টু হেল! আপনার যা খুশি করুন। আমাদের অফার আমি জানিয়ে দিয়েছি, এখন আমি চলে যাচ্ছি!

কাকাবাবু মাধব রাও-এর হাত চেপে ধরে বললেন, না, এখন আপনার যাওয়া চলবে না। আপনি আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। এখন আপনি আমাকে নারানপুরে নিয়ে চলুন। আমি আজ রাতেই সন্তুর খোঁজ করতে চাই।

মাধব রাও এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। অন্য হাতটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আমার ওপর গায়ের জোর ফলাবার চেষ্টা করবেন না। তার ফল ভাল হবে না। আপনাকে আমি নারানপুরে নিয়ে যেতে বাধ্য কেন হব? আমি কি আপনার হুকুমের চাকর?

কাকাবাবু কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন মাধব রাও-এর দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, না, আপনি আমার হুকুমের চাকর নন। আমি আপনার সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলেছি বলে দুঃখিত্ব। আমার মেজাজ ঠিক নেই। আমাকে আর আমার ভাইপোকে আপনারা কেন অকারণে ঝাটে জড়াচ্ছেন?

অংশুমান চৌধুরী কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, কী রাজা রায়চৌধুবী, মাধব রাওকে পকেটে হাত ঢোকাতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন নাকি? আপনাকে তো সবাই খুব বীরপুরুষ বলে জানে!

কাকাবাবু বললেন, শ্রীকৃষ্ণ কখন শিশুপালকে বধ করেছিলেন জানেন? শিশুপালের একশোটা অপরাধ ক্ষমা করবার পর। আপনার অপরাধও কিন্তু প্রায় একশোটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, নিজে ভয় পেয়ে উলটে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? এবার আমার গায়ে একটু হাত ছোঁয়ালে কিন্তু আপনার অন্য পাটা আস্ত রাখব না। আমি যা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। আমার যথেষ্ট টাকা আছে। আমার আর টাকা-পয়সার প্রয়োজন নেই। ওদের ওই তিন লাখ টাকা পুরস্কারের লোভে আমি-এ কাজে নামিনি। আপনার সঙ্গে আমার একটা প্রাইভেট চ্যালেঞ্জ আছে। আপনি মূর্তিটা উদ্ধার করে আনতে পারলে ওই তিন লক্ষ টাকা আপনিই পাবেন, আমি ভাগ বসাতে যাব না। আর আপনার আগেই আমি যদি মূর্তিটা সরিয়ে আনতে পারি, তাহলে সবার সামনে আপনাকে মাথার চুল আর ওই গোঁফ কামিয়ে ফেলতে হবে। এবারে আপনাকে আমি ন্যাড়া করবই।

কাকাবাবু এখনও মাধব রাও-এর হাত ছাড়েননি। অংশুমান চৌধুরীর দিকে তিনি পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন। মাধব রাও-এর চোখ থেকে তিনি চোখ সরাননি। তাঁর ঠোঁটে পাতলা হাসি ফুটে উঠল। তিনি খুব মৃদু স্বরে বললেন, এক্সকিউজ মি!

তারপরই তিনি বিদ্যুৎ গতিতে মাধব রাও-এর হাত ধরে জোরে একটা টান দিলেন। সেই টানে অতবড় চেহারাটা নিয়েও মাধব রাও উঠে গেলেন শূন্যে, তারপর হুড়মুড়িয়ে পড়লেন অংশুমান চৌধুরীর ঘাড়ে। আচমকা আঘাত পেয়ে অংশুমান চৌধুরী যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন।

বিশেষ ব্যস্ততা না দেখিয়ে কাকাবাবু মাধব রাও-এর কোটের পকেট থেকে রিভলভারটা বার করে নিলেন। অংশুমান চৌধুরীর হাতের লাঠিটা ঠেলে দিলেন দূরে। তারপর মাধব রাও-এর দিকে আবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, উঠুন, আশা করি আপনার বেশি লাগেনি। আমি দুঃখিত।

মাধব রাও-এর চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। এখনও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, এইমাত্র যে-কাণ্ডটা ঘটে গেল সেটা ম্যাজিক না অন্য কিছু!

অংশুমান চৌধুরী উপুড় হয়ে পড়ে যন্ত্রণায় উ ঊ করছেন। কাকাবাবু মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বললেন, এনাফ অফ দিস মাংকি বিজনেস। মাধব রাও, আপনি দেখুন, ওই লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেছে কি না। ওর দিকে তাকাতে আমার ইচ্ছে করছে না। কিছুতেই আমি রাগ সামলাতে পারছি না। ওকে টেনে তুলুন।

কাকাবাবু মাধব রাও-এর রিভলভারটা খুলে দেখলেন গুলি ভরা আছে কি। সেফটি ক্যাচটা তিনি লক করলেন। তারপর তিনি বললেন, হয়তো আপনারা জানেন না, তাই জানিয়ে রাখছি যে, আমার হাতের ছটা গুলির একটাও ফসকায় না। আমার একটা পা খোঁড়া তাই আমার দুটো হাতে চারজন মানুষের শক্তি। আর মাথাটাও, লোকে বলে, বেশ ধারালো। এরপর থেকে আর কোনও রকম চালাকি আমি সহ্য করব না। উঠে বসুন, আমরা এক্ষুনি নারানপুর যাব। সেখানে সন্তুকে পেয়ে গেলে কালই আমি বাড়ি ফিরব। আপনাদের মূর্তি গোল্লায় যাক, আমার তাতে কিছু আসে যায় না।

অংশুমান চৌধুরী দেওয়ালে ভর দিয়ে উঠেছেন। কাকাবাবু বললেন, দেরি করবেন না, উঠুন!

প্রায় ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়ালেন অংশুমান চৌধুরী। কাকাবাবু তাঁর জামার পকেট থাবড়ে দেখলেন আর কোনও অস্ত্র আছে কি না। তারপর রিভলভারের নলের এক খোঁচা দিয়ে বললেন, নারানপুরে গিয়ে যদি সন্তুকে দেখতে না পাই, তাহলে আপনার ভগবানও আপনাকে বাঁচাতে পারবে না।

ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরোবার পর ডাকবাংলোর লোকটি বলল, স্যার, খাবার গরম করব?

কাকাবাবু বললেন, আপনার বাংলোতে কুকুর নেই কেন? কুকুর পোষা ভাল। রাত্তিরবেলা খাবার-দাবার বেঁচে গেলে কুকুরগুলো খেতে পারে। আমাদের এখন খাওয়ার সময় নেই।

রাত্রির অন্ধকারে স্টেশন ওয়াগনটা ছুটে চলল আবার।