১১. কাকাবাবুর হাত বাঁধা

কাকাবাবুর হাত বাঁধা, পা দুটোও বাঁধা। দুজন লোক কাকাবাবুকে প্রায় চ্যাংদোলা করে বয়ে নিয়ে এল।

লম্বা বারান্দার একেবারে শেষে একটা ঘর। এই ঘরটাতেই সাজানো রয়েছে। কয়েকটা কম্পিউটার ও নানারকম যন্ত্র। টেবিলের ওপাশে বসে আছে শঙ্খচূড়। এখন সে পরে আছে একটা রঙিন ড্রেসিং গাউন। তার পাশে রয়েছে একটা মস্ত বড় কুকুর।

লোকদুটি কাকাবাবুকে বসিয়ে দিল একটা চেয়ারে।

শঙ্খচূড় বলে উঠল, আরে ছি ছি, ভদ্দরলোককে ওইভাবে নিয়ে এসেছ? উনি কি অসুস্থ না বাচ্চা ছেলে? হটিয়ে আনতে পারনি?

একজন বলল, আপনি তো অর্ডার দেননি সার।

শঙ্খচূড় বলল, উনি দারুণ চালাক লোক। তোমাদের জব্দ করতে পারেন বলে অন্য সময় হাত-পা বেঁধে রাখতে বলেছি। তা বলে আমার সামনে ওইভাবে নিয়ে আসবে? দাও, দাও, হাত, পা খুলে দাও।

লোকদুটি সঙ্গে সঙ্গে শিকলের বাঁধন খুলে নিল।

শঙ্খচূড় একজনকে জিজ্ঞেস করল, ওঁকে কিছু খেতে দিয়েছ তো?

সে আমতা আমতা করে বলল, আপনি কিছু বলেননি—

শঙ্খচূড় ধমক দিয়ে বলল, বলিনি মানে কী? আমি কি কখনও অর্ডার দিয়েছি যে অতিথিদের না খাইয়ে রাখবে? কিছু না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বে, তাতে কোনও কাজ হবে না। যাও, শিগগির খাবার নিয়ে এসো।

লোকদুটো চলে যাওয়ার পর শঙ্খচূড় বলল, সরি মিস্টার রায়চৌধুরী, খুব খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?

কাকাবাবু বললেন, আমি কি আপনার অতিথি?

শঙ্খচূড় বলল, এক হিসেবে অবশ্যই। গভর্নমেন্ট যাদের জেলখানায় ভরে রাখে, তারাও তো গভর্নমেন্টের অতিথি। তাদের দুবেলা খাবার দেওয়া হয়?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ফাঁসি দেওয়ার আগেও খাবার দেওয়া হয়।

হাহা করে হেসে উঠল শঙ্খচূড়।

হাত নাড়তে নাড়তে বলল, না, না, আমি আপনাকে ফাঁসি দিতে চাই না মোটেই। আগেই তো বলেছি, আপনাকে ছেড়ে দেব। তার আগে আপনাকে শুধু একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, ছোট কাজের জন্য তো আমাকে দরকার হয় না!

শঙ্খচূড় বলল, এ-কাজটা শুধু আপনিই পারবেন। এ-রাজ্যের হোম সেক্রেটারি মিস্টার এম এম রায় তো আপনার খুব ভক্ত, তাই না?

হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।

আপনাকে আমরা কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে নামিয়ে দেব। আপনি ভেতরে ঢুকে যাবেন।

রাইটার্স বিল্ডিংসের মধ্যে ঢুকে যাব? সেখানে তো আমি নিরাপদ। তারপর আর আপনার কাজ করতে যাব কেন?

করবেন, করবেন, করতেই হবে। কাজটাও খুব সহজ। এম এম রায়ের কাছে একটা ইলেকট্রনিক নোটবুক আছে। সেটা আপনি চেয়ে নেবেন।

ইলেকট্রনিক নোটবুক? নিশ্চয়ই খুব গোপন ব্যাপার। সেটা তিনি আমাকে দেবেন কেন?

দেবে, দেবে, আপনাকেই একমাত্র বিশ্বাস করে দিতে পারে। সেটা নিয়ে এসে আপনি আমার হাতে তুলে দেবেন, তা হলেই আপনার ছুটি হয়ে যাবে, মিস্টার রায়চৌধুরী।

এবার বলুন তো মিস্টার শঙ্খচূড়, আপনার এই কাজটা আমি করতে বাধ্য হব কেন?

আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, এখন আপনি আমার হাতের পুতুল। একবার নিজের পিঠে হাত দিয়ে দেখুন তো।

কাকাবাবু আগেই অনুভব করছিলেন তাঁর পিঠে কী যেন একটা লেগে আছে। এবার হাত দিয়ে দেখলেন, তাঁর জামার নীচে বাঁধা আছে একটা চাকতি।

শঙ্খচূড় মিটিমিটি হেসে বলল, ওটা কী জানেন? আর ডি এক্স-এর কথা জানেন নিশ্চয়ই। এটা প্রায় সেইরকমই আমারই আবিষ্কার করা প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ। কাল পুতুলটাকে যেরকম উড়িয়ে দিলাম, সেইরকম। আমি রিমোট কন্ট্রোল টিপলেই আপনি ঠিক সেইরকম ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন। আপনার হাত, পা, ধড়, মাথা এমন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে যে, আপনাকে আর চেনাই যাবে না!

কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু মাঝখানে যদি দেওয়াল থাকে, তাতেও রিমোট কন্ট্রোল কাজ করে? আমি থাকব রাইটার্স বিল্ডিংসের তিনতলায়, আপনি থাকবেন বাইরে, অতদূর থেকে আপনি কী করে আমায় মারবেন?

এটা এত শক্তিশালী যে, এক মাইল দূর থেকেও কাজ করবে।

কিন্তু ঘরের মধ্যে আমি কী করছি, তা তো আপনি দেখতে পাবেন না। ঘরে ঢুকেই যদি হোম সেক্রেটারিকে সব জানিয়ে পিঠের জিনিসটা খুলে ফেলি?

সে-কথা কি আমি ভাবিনি রাজা রায়চৌধুরী? আমি এত বোকা? প্রথম কথা, এটা খুলতে যাওয়াই খুব বিপজ্জনক। তাতে আপনিও মরবেন, যে খুলতে যাবে, সেও মরবে। দ্বিতীয় কথা, ঘরের মধ্যে আপনি কী করছেন, তা দেখতে না পেলেও কাকে কী বলছেন, সব শুনতে পাব।

কী করে শুনবেন?

এমন কিছুই শক্ত নয়। এবার দেখুন, আপনার জামার নীচে বুকের সঙ্গে একটা ছোট্ট বোতাম আটকানো আছে। ওটা একটা মাইক্রো-রিসিভার। আপনি যেখানে বসে যা কথা বলবেন, সব আমি শুনতে পাব। সব রেকর্ডও হয়ে যাবে। প্রমাণ চান?

সে একটা যন্ত্রের সুইচ টিপলেই শোনা গেল কাকাবাবুর গলা। এই একটু আগে তিনি ওই লোকটির সঙ্গে যা কথা বলছিলেন, সব রেকর্ড হয়ে গেছে।

যন্ত্রটা বন্ধ করে শঙ্খচূড় বলল, অর্থাৎ এখন আপনি একটি মানব-বোমা। আপনার ব্যবহারে কোনও গণ্ডগোল দেখলেই আপনাকে আমি উড়িয়ে দিতে পারি।

কাকাবাবু আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাকে রাইটার্স বিল্ডিংসে পাঠাচ্ছেন। হোম সেক্রেটারির ঘরে। সেখানে আমাদের দুজনকেই যে একসঙ্গে উড়িয়ে দিতে চান কিনা, তা বুঝব কী করে? রাইটার্স বিল্ডিংসেরও ক্ষতি করতে পারেন।

শঙ্খচূড় বলল, তাও পারি ঠিকই। কিন্তু ওই যে ইলেকট্রনিক নোটবুকটার কথা বললাম, সেটা ফেরত পাওয়াটাই আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি। ওটা আমার চাই-ই চাই। আর সেটা আপনাকেই এনে দিতে হবে।

একজন মুখোশধারী এইসময় খাবার নিয়ে এল ট্রে-তে করে। একটা ডিমসেদ্ধ, গোটা চারেক টোস্ট, দুটো সন্দেশ, এক কাপ কফি ও এক গেলাস জল।

কাকাবাবুর সত্যিই খিদে পেয়েছে। এ-পর্যন্ত শুধু এক কাপ কফি ছাড়া আর কিছুই খাননি। এখন তিনি প্রথমেই ডিমটা দুটুকরো করে একটা টুকরো মুখে পুরে দিলেন।

অন্য টুকরোটাও খেয়ে নিয়ে তিনি তুলে নিলেন একটা টোস্ট। তারপর বললেন, তা হলে যা বুঝতে পারছি, আপনার কথা শুনতেই হবে, নইলে আমাদের মরতে হবে।

শঙ্খচূড় বলল, এই তো ঠিক বুঝেছেন। হঠাৎ গোঁয়ারের মতন মারামারি করার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। আপনার পিঠে যা বাঁধা আছে, তা ছুরি বা বন্দুক-পিস্তলের চেয়েও অনেক বেশি ডেঞ্জারাস। ছুরি কিংবা গুলি ঠিকমতন গায়ে না লাগতেও পারে, কিন্তু রিমোট কন্ট্রোল একেবারে নির্ভুল। চোখের নিমেষে আপনি শেষ হয়ে যাবেন।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও বুঝতে পারিনি। ইলেকট্রনিক নোটবুক জিনিসটা কী? সেটা এত মূল্যবান কেন? এসব না জানলে আমি হোম সেক্রেটারির কাছে সেটা চাইব কী করে?

শঙ্খচূড় বলল, ইলেকট্রনিক নোটবুক একটা ডায়েরির মতন। ডায়েরিতে, যেমন হাতে লিখতে হয়, এতে তা হয় না, কি-বোর্ডে টাইপ করলে সব মেমরিতে বসে যায়।

কাকাবাবু বললেন, অর্গানাইজার?

শঙ্খচূড় বলল, তারও উন্নত সংস্করণ। আমার আবিষ্কার। আমাদের একজন। লোক ধরা পড়েছে, পুলিশ তার কাছ থেকে এটা কেড়ে নিয়েছে। অবশ্য এতে কী লেখা আছে, তা পুলিশ এখনও কিছুই বুঝতে পারেনি, কারণ সবই কোডে লেখা। আমরা খবর পেয়েছি, দিল্লি থেকে দুজন এক্সপার্ট আসছে সেই কোড। উদ্ধার করার জন্য। তার আগেই সেটা আমার ফেরত চাই। যে-কোনও মূল্যে।

কাকাবাবু বললেন, এটা যদি এতই মূল্যবান জিনিস হয়, তা হলে হোম সেক্রেটারি আমাকে দেবেন কেন?

শঙ্খচূড় বলল, আপনি একদিনের জন্য চেয়ে নেবেন। আপনিও যে একজন সাংকেতিক লিপি পাঠ করার এক্সপার্ট তা অনেকেই জানে। এর আগে অনেক শক্ত শক্ত কোড পড়ে ফেলেছেন।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার লোকটি কোথায় ধরা পড়েছে?

শঙ্খচূড় বলল, নিউ জলপাইগুঁড়ি রেল স্টেশনে। তার পেট থেকে অবশ্য কোনও কথা বার করার উপায় নেই। সে এর মধ্যেই খুন হয়ে গেছে জেলখানার ভেতরে। ইলেকট্রনিক নোটবইটা পরীক্ষা করার সুযোগ আপনাকেও দেওয়া হবে না। সেটা পাওয়ার পরই সোজা নিয়ে আসবেন আমার কাছে। অন্য কারও হাতেও দেওয়ার দরকার নেই।

কাকাবাবু একটা সন্দেশ খাওয়ার পর জলের গেলাসটা হাতে নিতে যেতেই শঙ্খচূড় ঝুঁকে নিজেই গেলাসটা তুলে নিল।

কাকাবাবু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বলল, জল খেতে হবে না, কফি খান। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

মস্ত বড় কুকুরটা একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়াল। তারপর কাকাবাবুর কাছে চলে এসে গন্ধ শুকতে লাগল চারপাশে ঘুরে ঘুরে।

কাকাবাবু কুকুরটার দিকে পলক চেয়ে থেকে তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন।

শঙ্খচূড় চেঁচিয়ে বলল, ওর গায়ে হাত দেবেন না। ও দারুণ হিংস্র।

কাকাবাবু বললেন, কুকুররা আমায় ভালবাসে। আমাদের বাড়িতেও কুকুর আছে।

সত্যিই কাকাবাবু কুকুরটাকে আদর করায় সে কোনওরকম হিংস্রতা দেখাল না।

শঙ্খচূড় ডাকল, টবি, টবি, কাম হিয়ার!

কুকুরটা ফিরে গেল তার মালিকের কাছে।

কাকাবাবু আর-একটা সন্দেশও খেয়ে নিয়ে বললেন, এটাও যেন ঠিক ফাঁসির খাওয়া। ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা এনে দিলেই আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন, তাই তো?

শঙ্খচূড় বলল, কেন, মারব কেন? বলেছিই তো, এই কাজটা করে দিলেই আপনাকে মুক্তি দেব।

কাকাবাবু বললেন, কেন, মুক্তি দেবেন কেন? মুক্তি পেলেই তো আমি পুলিশকে সব জানিয়ে দেব। আমাকে বাঁচিয়ে রেখে তো আপনার কোনও লাভ নেই।

শঙ্খচূড় বলল, আপনাকে সত্যিই মারব না। আমাকে যারা এই কাজের ভার দিয়েছে তাদের ইচ্ছে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হোক। ইলেকট্রনিক নোটবুকটা ফেরত পাওয়ার তিনদিন পরই সাঙ্ঘাতিক সব কাণ্ড শুরু হয়ে যাবে এই রাজ্যে। তখন দেখতে পাবেন শঙ্খচূড়ের আসল খেলা। তার মধ্যেই আমি রটিয়ে দেব, এক কোটি টাকার বিনিময়ে রাজা রায়চৌধুরী হোম সেক্রেটারির চোখে ধুলো দিয়ে ওই নোটবুকটা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আপনি হয়ে যাবেন চোর, লোভী, বিশ্বাসঘাতক। সবাই আপনাকে ছি ছি করবে! বাকি জীবনটা আপনাকে এই বদনাম নিয়ে কাটাতে হবে।

বাইরে কোথাও একটা কুকুরের ডাক শোনা যেতেই এ ঘরের কুকুরটা বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।

শঙ্খচূড় তাকে সামলে নিয়ে বলল, তা হলে আর দেরি করে লাভ নেই। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে। রাজা রায়চৌধুরী, মনে রাখবেন, আপনার প্রাণ আমার হাতের মুঠোয়। আমার কথায় এক চুল এদিক-ওদিক হলে সঙ্গে সঙ্গে আপনি ধ্বংস হয়ে যাবেন।