১১. ইফেল টাওয়ারে উঠতে দেবে না

‘নাইটিঙ্গেল পাখিটি একটা উঁচু ডালে বসে
নীচের দিকে তাকিয়ে ভাবছে
সে যেন পড়ে গেছে নদীতে
সে বসে আছে একটা ওক গাছের শীর্ষে
তবু তার ভয় ডুবে বাবার :’
–সিরানো দ্য বারজেরাক

মার্গারিট আমাকে ইফেল টাওয়ারে উঠতে দেবে না, তা বলে কি আমি লুভর মিউজিয়ামও দেখব না? সেখানেও অজস্র টুরিস্ট ভিড় করে ঠিকই, কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত ছবিগুলিও তো সেখানে না গেলে দেখা হবে না!

মোনিক একদিন আমাদের ধমক দিয়ে পাঠাল। সেই সকালটায় রোদ নেই, টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে। মার্গারিটের হাতে একটা লাল রঙের ছাতা, মোনিক আমাকে একটা ম্যাকিনটস ধার দিয়েছে! এটা তার অন্য এক বন্ধবীর বয় ফ্রেন্ডের, একদিন ফেলে গেছে ও বাড়িতে। রেনকোট, ম্যাকিনটস, ওভারকোট, পার্কা এসব এদেশে অনেকেই একজনেরটা অন্যজন ব্যবহার করে।

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে মার্গারিট বলল, লুভর মিউজিয়াম একদিনে পুরোটা দ্যাখা যায় না, অনেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সবটা সেরে নিতে চায়, আসলে কিন্তু তারা কিছুই দেখে না। এক একদিনে এক একটা অংশ ভালো করে দেখতে হয়। তুমি কাদের ছবি দেখতে চাও? তুমি কি আগেকার ছবি, যাতে বাইবেলের গল্প, উড়ন্ত পরী, দেবশিশু আর ‘চর্বির গোলা’ নারীদের ছবিও দেখবে?

আমি বললাম, না, না, প্রি-র্যা ফেলাইট ছবিতে আমার আগ্রহ নেই। আমার বেশি দেখার ইচ্ছে পল সেজান, এডুয়ার মানে, দেগা, ক্লদ মোনে, কামিল পিসারো, রেনোয়া, পল গগ্যাঁ এঁদের ছবি।

মার্গারিট বলল, তুমি যাদের নাম করলে, তারা সবাই ইমপ্রেশানিস্ট দলের। তুমি বুঝি এই গ্রুপটাকেই বেশি ভালোবাস!

আমি বললাম, এঁদের ছবিই আমার বেশি পছন্দ। দেশে থাকতে এই সব শিল্পীদের মূল ছবি তে কিছুই দেখার সুযোগ হয় না, শুধু প্রিন্ট দেখেছি। বাংলায় একে বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো, কিংবা মধুর অভাবে গুড় খাও!

ঘোল এবং গুড়, এই দুটো কী বস্তু, তা মার্গারিটকে অনেক কষ্টে বোঝাতে হল।

মার্গারিট বলল, তুমি নিউ ইয়র্কের মিউজিয়ামগুলো দ্যাখোনি?

আমি বললাম, তা দেখব না কেন? নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামে এই গোষ্ঠীর শিল্পীদের চমক্কার কালেকশান আছে। তা ছাড়া শিকাগোতেও দেখেছি। আর পল এঙ্গেলের সঙ্গে মার্শাল টাউনে এক বুড়ির বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানেও এঁদের কয়েকটা মূল ছবি আছে। সেই সব দেখে আরও তৃষ্ণা বেড়ে গেছে।

মার্গারিট ফস করে জিগ্যেস করল, আচ্ছা সুনীল, বলো তো, ইমপ্রেশানিজম কথাটা কী করে তৈরি হল?

আমি থমকে দাঁড়ালাম। তারপর চোখ গরম করে কৃত্রিম রাগে বললাম, অ্যাই, তুমি আমাকে পরীক্ষা করছ? আমার ওপর মাস্টারি ফলাচ্ছ বুঝি?

মার্গারিট সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায়, মরমে মরে গিয়ে বলল, না, না, এমনিই হঠাৎ বলে ফেলেছি, ছি ছি ছি, কিছুদিন মাস্টারি করে আমার এই অবস্থা হয়েছে, তুমি আমার থেকে অনেক বিষয়ে বেশি জানো…

লজ্জায় মার্গারিটের শরীরটা যেন কুঁকড়ে গেছে, দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে। ওর লজ্জা দেখে আমারও খুব লজ্জা করতে লাগল, কিছুতেই ওর মুখ থেকে হাত সরানো যায় না।

আমি বললাম, আমি সত্যিই জানি না ইমপ্রেশানিস্টদের নামটা কী করে এল। তুমি বলে দাও।

মার্গারিট প্রবলভাবে মাথা নাড়তে লাগল।

সত্যিই তো এই সব বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই ভাসা ভাসা। আমি তো শিল্পী নই, কিছু ছবি দেখেছি, দু’চারটে বই এলোমেলো ভাবে পড়েছি। ফরাসিদেশে অনেকবার অনেকরকম শিল্প-আন্দোলন হয়েছে, তার ইতিহাস আমি কতটুকুই বা জানি! এই সব বিষয়ে মার্গারিটই তো আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। ওর সঙ্গে একটা ঠাট্টা করতে গিয়ে ফল হয়ে গেল বিপরীত। মার্গারিট আর মুখ খুলতে চায় না।

অবশ্য আমার একটা উপায় জানা আছে। এটা গায়কদের ক্ষেত্রে আমি পরীক্ষা করে সুফল পেয়েছি। অনেক সময় বিখ্যাত গায়ক-গায়িকারা কিছুতেই মুখ খুলতে চান না। কোনও একটা ঘরোয়া আড্ডায় কিংবা পিকনিকে তাঁদের গান গাইতে অনুরোধ করলে তাঁরা বলেন, গলা খারাপ, মুড নেই, হারমোনিয়াম নেই ইত্যাদি। এই সময় একটা কৌশল বেশ কাজে লাগে। ভালো গায়ক-গায়িকাদের সামনে বেসুরো গান শুরু করতে হয়। আমি সেরকম কোনও গায়ক বা গায়িকার কাছে জিগ্যেস করি, আচ্ছা, ‘খেলার সাথী বিদায় দ্বার খোল’ গানটার সুর কি এইরকম? বলেই আমি হেঁড়ে গলায় বন্দে মাতরমের সুরে সেটা গাইতে আরম্ভ করি। প্রকৃত গায়ক-গায়িকারা তাতে আঁতকে ওঠেন, আসল সুর আপনি বেরিয়ে আসে তাঁদের গলা থেকে। এইভাবে আমি সুবিনয় রায়, সুচিত্রা মিত্র, ঋতু গুহ’র অরাজি ভাঙিয়েছি অনেক জায়গায়।

মেট্রো ট্রেনে লুভর নামে একটা স্টেশানই আছে। কিন্তু সেখানে যেতে গেলে দুবার ট্রেন বদলাতে হবে, নতুন করে টিকিট কাটতে হয় না। তবু সেরকমভাবে বদল না করে মার্গারিট উঠে এল ওপরে। এখনও বৃষ্টি থামেনি। গতকালও শীতের নামগন্ধও ছিল না, এখন শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে। রাস্তার দুপাশের চেস্টনাট, পপলার, মেপল গাছ থেকে খসে পড়ছে অসংখ্য পাতা। মাথার ওপর গাছের পাতা খসে পড়ার অনুভূতিটা বড় চমৎকার।

আমি মার্গারিটের একটা হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বললাম, এককালে বিদ্রোহী তরুণ শিল্পীরা একটা সংঘ স্থাপন করে আলাদা প্রদর্শনী করেছিল। নিজেরাই নিজেদের নাম দিয়েছিল ‘ইমপ্রেশানিস্ট স্কুল’, তাই না?

মার্গারিট আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেই সংঘের নাম ছিল ‘সোসিয়েতে আনোনিম’ (নামহীন সমিতি)!

আমি বললাম, তা হলে কবি বদলেয়ার ওই দলটার ওইরকম নাম দিয়েছিল।

মার্গারিট বলল, বদলেয়ার ছিল ওই শিল্পীদের বন্ধু! ইমপ্রেশানিজম আখ্যাটা প্রথমে ব্যবহার করা হয়েছিল গালাগাল হিসেবে।

আস্তে-আস্তে পুরো বিষয়টা জানা গেল।

মাত্র একশো বছর আগে এই সব জগৎবিখ্যাত শিল্পীরা প্যারিস এবং কাছাকাছি অঞ্চলে থাকতেন, নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে যেসব ছবি এঁকেছেন, সেই সব এক একখানা ছবির দাম এক লক্ষ লক্ষ টাকা। এই তো কয়েকদিন আগেই কাগজে দেখেছি, পল সেজান-এর একটা ছবি কেউ কিনত না, সমালোচকরা যাচ্ছেতাই বসেছে, ধিক্কার দিয়েছে, দারুণ ক্ষোভে সেজান একসময় প্যারিস ছেড়ে এক্স-এ চলে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি সারাজীবন ছবি এঁকে যাবেন, কিন্তু বিক্রি করার চেষ্টাও করবেন না, কারুকে দেখাবেনও না। আর ক্লদ মোনের দারিদ্র্য এমন চরম অবস্থায় নেমে এসেছিল যে বন্ধুদের কাছে প্রায় ভিক্ষে করতে হত। কামিল পিসারে নিজের এক গাদা ক্যানভাস পিঠে করে নিয়ে প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন, বাড়ি ভাড়া মেটাবার জন্য তাঁকে ঘটি-বাটি বন্ধক দিতে হয়েছে অনেক সময়।

সরকারি প্রদর্শনীতে এঁদের স্থান হত না বলে এই সব শিল্পীরা নিজেদের উদ্যোগে একটা সমবেত প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। শিল্পের ইতিহাসে এই রকম ঘটনা সেই প্রথম! সেই প্রদর্শনীটির চরম ব্যর্থতা ও অসাফল্যও ঐতিহাসিক। একজনও প্রশংসা করেনি, বরং উপহাস, ভর্ৎসনা ও গালমন্দের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। কেউ বলল, বাচ্চারা যখন রং নিয়ে ছেলেখেলা করে, তাও এই সব ছবির চেয়ে ভালো। কেউ বলল, এ যেন পিস্তলের মধ্যে রং ভরে ক্যানভাসে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ বলল, এই লোকগুলো পাগল ছাড়া কিছুই না! এদের আঁকা মেয়েদের গায়ের রং স্প্যানিশ তামাকের মতন, ঘোড়াগুলোর রং হলদে, আর জঙ্গলের রং নীল! একজন যা বাঁধাকপি এঁকেছে, তা দেখে এমন ঘেন্না হল যে জীবনে আর বাঁধাকপি খাবই না! ওদের আঁকা নিসর্গচিত্র দেখলে মনে হয়, চশমায় ধুলো জমেছে!

সেই প্রদর্শনীতে ক্লদ মমানের একটি ছবির নাম ছিল, ইমপ্রেশান : সানরাইজ। সেইটাই হল প্রধান ঠাট্টার বিষয়বস্তু। এক সমালোচক লিখল, ইমপ্রেশানই বটে! ওর মধ্যে সানরাইজ নেই, ইমপ্রেশানই আছে। আমার তো মনে হল, একটা অসমাপ্ত ওয়াল পেপার দেখলেও ওর চেয়ে ভালো সমুদ্রে সূর্যোদয়ের ইমপ্রেশান হয়!

নিন্দুকেরা ওই সব শিল্পীদের গোষ্ঠীটিকে ইমপ্রেশানিস্ট বলে দেগে দিল। শিল্পীরা কিন্তু সেই পরিচয়টাই মেনে নিল আনন্দের সঙ্গে। সত্যিই তো, তারা বাস্তবের অনুকরণ করতে চায় না। অরণ্যের ছবি বহু আঁকা হয়ে গেছে। কিন্তু এক একটা অরণ্যের যে একটা নিজস্ব ঝংকার আছে, তার অনুরণন একজন শিল্পীর মনে যে অনুভূতি জাগায়, সেটাই তো নতুন করে আঁকার বিষয়।

এর আগে শিল্পীরা বিচ্ছিন্ন ছিল, যে-যার মতন ছবি আঁকত, এর পর থেকে শুরু হল ইমপ্রেশানিজমের আন্দোলন।

কথা বলতে-বলতে আমরা হাঁটছিলাম নদীর ধার দিয়ে। স্যেন নদীর দু’দিকের রাস্তা মার্গারিটের খুব প্রিয়, প্রতিদিন আমরা এর কাছাকাছি বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাই। নদীটাকে এরা কী সুন্দর কাজে লাগিয়েছে, নদীর জন্য শহরের সৌন্দর্য অনেক বেড়ে গেছে!

মার্গারিট বাড়ির নম্বরগুলো লক্ষ করছে মনোযোগ দিয়ে। আমি জিগ্যেস করলাম, তুমি কী খুঁজছ?

মার্গারিট বলল, এখানে বেশ একটা মজার বাড়ি আছে। লুভর যাওয়ার আগে সে বাড়িটা দেখে গেলে ভালো লাগবে!

রাস্তার ধারে বড় বড় দোকানপাটই দেখছি, এর মধ্যে মার্গারিট আমাকে বিশেষ কী। দেখাতে চায়?

মার্গারিট বলল, দু’বছর আগেও সেই বাড়িটা দেখে গেছি। এখন গেল কোথায়? এখানে এক সময় ছিল ‘আকাদেমি সুইস’। সেটা কী জানো? প্যারিসে তুমি এখনও দেখবে, অনেক সালে বা স্টুডিও আছে, যেখানে ছেলে কিংবা মেয়ে মডেল থাকে, অনেক শিল্পী সেই সব মডেল স্টাডি করতে যায়। অনেক শিল্পীই তো একা একটি মডেলের খরচ জোগাড় করতে পারে না, তাই এই সব জায়গায় তারা পাঁচ-দশ ফ্র্যাংক চাঁদা দিয়ে মেম্বার, তারপর এক সঙ্গে তিরিশ-পঁয়তিরিশজন শিল্পী একটি মডেলকে দেখে দেখে আঁকে।

একশো বছর আগে সেই রকমই একটা জায়গা ছিল ‘আকাদেমি সুইস’। পের ক্ৰেবাসোল নামে একজন সুইজারল্যান্ডের প্রৌঢ় এটা চালাত, মাসে চাঁদা ছিল দশ ফ্র্যাংক, তিন সপ্তাহ সেখানে একটি পুরুষ মডেল পাওয়া যেত, আর এক সপ্তাহ একটি নারী। হবু আর্টিস্টরা এক একটা নড়বড়ে টুলে বসে নিজস্ব ইজেলে সেই পুরুষ বা নারীর ন্যুড স্টাডি করত।

বহু ছেলে মেয়ে শিল্পী হওয়ার উন্মদনায় এক সময় রং-তুলি হাতে নেয়, অনেকেরই প্রতিভা থাকে না, তারা এক সময় হারিয়ে যায়, কিংবা ফ্যাশান ডিজাইনার হয় কিংবা বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকে। ‘আকাদেমি সুইস’ ইতিহাসে স্থান পেয়ে গেছে, তার কারণ, এক সময় একই সঙ্গে এখানে কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থী শিল্পী এসেছিল, যারা পরে বিশ্ববিখ্যাত হয়! এদুয়ার মানে, রেনোয়া, দেগা, পিসারো, ক্লদ মোনে, সেজান! ওদের বন্ধু বন্ধুত্ব হয়েছিল এখানেই। কল্পনা করা যায় কি, একই কলেজের এক ক্লাসের পাঁচ সাতজন বন্ধু প্রত্যেকেই নোবেল প্রাইজ পেল! অনেকটা সেইরকমই যেন ব্যাপার।

ওই বাড়িটা সম্পর্কে অনেক মজার গল্পও আছে।

বাড়িটার একতলায় ছিল সাবরা নামে এক ডেন্টিস্টের চেম্বার। আর দোতলায় শিল্পীদের মডেল স্টাডির ইস্কুল। একদিন মফস্বল থেকে এক তরুণ শিল্পী এসেছে ওই ‘আকাদেমি সুইস’-এ ভরতি হতে। ভুল করে সে ঢুকে পড়েছে এক তলায়। সেখানে একজন লোক বীভৎস আর্তনাদ করছে! দাঁতের ডাক্তার সাবরা সদ্য সেই লোকটার একটা দাঁত তুলেছে, তখনকার দিয়ে দাঁত তোলার প্রক্রিয়া ছিল আসুরিক ব্যাপার, অ্যানেসথেসিয়া ছিল না, দুজন লোক রুগীকে চেপে ধরত, আর ডাক্তার একটা সাঁড়াশি দিয়ে দন্ত উৎপাটন করত। তরুণ শিল্পীটি ভাবল, সুইস পরিচালক বুঝি শিল্পীরা আঁকায় ভুল করলে এই রকম শাস্তি দেয়। সে ‘ম দিউ’ বলেই পেছন ফিরে চোঁ চাঁ দৌড়!

আর একবার দাঁতের ব্যথায় খুব কষ্ট পেতে পেতে একজন রুগী ভুল করে উঠে এসেছে দোতলায়। দরজা খুলেই দেখে একজন পুরুষ মডেল সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে লোকটা ভাবল, এই বুঝি দাঁতের ডাক্তারের চিকিৎসা পদ্ধতি! সেও ব্যথা-ট্যথা ভুলে গিয়ে পিঠটান!

আকাদেমি সুইস উঠে গেছে কবেই, মার্গারিট আমাকে দেখতে চেয়েছিল শুধু সেই বাড়িটা। কিন্তু পাওয়া গেল না, যে ঠিকানায় ওই বাড়িটা থাকার কথা ছিল, সেখানে এখন একটি অসমাপ্ত প্রাসাদ, প্রচুর মিস্তিরি কাজ করছে। পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে মার্গারিট যেন শারীরিক কষ্ট পেল! বারবার বলল, ছি ছি ছি, এমন একটা বাড়ি নষ্ট করে ফেলল, এটা মিউজিয়াম করে রাখা উচিত ছিল, এই শহরের মেয়রটা একটা গরু!

আমরা যে রাস্তাটা ধরে হাঁটছি, তার নাম কে দেজরফেবর (Quai des Orfevres), নামটা আমার খুব চেনা লাগল। আমি মার্গারিটকে জিগ্যেস করলাম, এখানেই কি কাছাকাছি কোথাও পুলিশের হেড কোয়ার্টার?

শিল্পীদের বিষয় আলোচনা করতে-করতে হঠাৎ আমি পুলিশের প্রসঙ্গ তোলায় মার্গারিট হকচকিয়ে গেল খানিকটা। তারপর বলল, হ্যাঁ, আছে। কিন্তু তুমি সে কথা জানতে চাইছ কেন?

আমি বললাম, জর্জ সিমেনোঁর লেখায় আমি অনেকবার এই রাস্তাটায় নাম পড়েছি। গোয়েন্দা ইনসপেক্টর মেইগ্রে এই রাস্তা দিয়ে কতবার তার হেড অফিসে (আমাদের লালবাজার) গেছে, কখনও এখানকার কোনও রেস্তোরাঁ কিংবা বিসত্রা-তে গিয়ে হোয়াইট ওয়াইন কিংবা বিয়ার পান করেছে।

মার্গারিট বেশ অবাক হয়েছে বোঝা গেল।

ছেলেবেলা থেকেই আমি গোয়েন্দা গল্পের পোকা। আমাদের রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ, শশধর দত্ত আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বিদেশের প্রচুর গোয়েন্দা গল্প পড়েছি। আমার মতে, এ যুগের গোয়েন্দাকাহিনির স্রষ্টাদের মধ্যে রানির স্থান যদি পান আগাথা ক্রিস্টি, তা হলে রাজার স্থান দিতে হবে জর্জ সিমেনোঁ:-কে। সিমেন্টের লেখাগুলি উৎকৃষ্ট ক্রাইম ও ডিটেকশান স্টোরি তো বটেই, তদুপতির তাতে আছে সাহিত্য রস। সাহিত্যের কাল্পনিক মানুষগুলির মধ্যে ইনসপেক্টর মেইগ্রে আমার অন্যতম প্রিয় চরিত্র। সিমেনোঁর লেখার গুণে মেইগ্রে-কে কাল্পনিক বলে মনেই হয় না, মনে হয় যেন পুলিশের সদর দফতরে গেলে এক্ষুনি সেই ভারী ওভারকোট পরা, মুখে পাইপ, দীর্ঘদেহী মানুষটিকে দেখতে পাব।

মার্গারিট শুধু উচ্চাঙ্গের কাব্য সাহিত্যের ভক্ত, কবিতাই তার বিশেষ প্রিয়, উপন্যাসকে সে কবিতার তুলনায় নিকৃষ্ট শিল্প বলে মনে করে। এই ধরনের সাহিত্যমোদিরা ডিটেকটিভ গল্প দু’চক্ষে দেখতে পারে না। আমি ভাবলাম, সিমেনোঁ: সম্পর্কে আমার উচ্ছ্বাস দেখে মার্গারিট চটে যাবে। তা ছাড়া, সিমেনোঁ:: বেলজিয়ান, ফরাসি সাহিত্যে বিরাট স্থান জবর দখল করেছেন। ফরাসি-ভাষী বেলজিয়ানদের সম্পর্কে খাঁটি ফরাসিদের খানিকটা অবজ্ঞার ভাব আছে।

কিন্তু মার্গারিট বলল, বাঃ, তুমি সিমেনোঁ পড়েছ? আমি তোমাকে সিমেন্টের আরও বই দেব। উনি খুব ভালো ফরাসি গদ্য লেখন। অঁদ্রে জিদ ওঁর দারুণ প্রশংসা করছিলেন জানো তো! ডিটেকটিভ উপন্যাস ছাড়াও সিমেনোঁ: আরও অনেক অন্য, সিরিয়াস ধরনের উপন্যাসও লিখেছেন!

আমি অবশ্য সিমেনোঁ পড়েছি ইংরিজি অনুবাদে। ডিটেকটিভ গল্প ছাড়া ওঁর অন্যান্য উপন্যাসও পড়েছি কয়েকটা, তার মধ্যে হাসপাতাল নিয়ে একটি উপন্যাস অসাধারণ। বিভিন্ন ধরনের মানুষের চরিত্র স্টাডি করার অসম্ভব দক্ষতা আছে এই লেখকের।

সিমেনোঁ সম্পর্কে আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে বলবার মতন। প্রিয় লেখকদের ব্যক্তিগত জীবন জানতেও অনেকের কৌতূহল হয়। আমরা পাঠকরাও অনেকটা জেনেছি। সিমেনোঁর নারী-প্রীতি সাংঘাতিক, তিনি নাকি কয়েক হাজার মহিলার সঙ্গে সাময়িক প্রেম ও সহবাস করেছেন। তিনি দুর্দান্ত বড়লোক। তাঁর বইয়ের বিক্রি তো প্রচুর বটেই, তা ছাড়া তাঁর গল্প থেকে অন্তত চল্লিশটা সিনেমা হয়েছে, পৃথিবীর চারখানা দেশে তাঁর বাড়ি আছে। যেখানে যখন আবহাওয়া ভালো থাকে, তখন তিনি সেখানে থাকতে যান। কোনও একটা নতুন বই লেখার আগে তিনি আগে ডাক্তারকে দিয়ে ব্লাড প্রেসার মাপান, রক্ত পরীক্ষা করান। তারপর বাড়ির দরজা বন্ধ করেন। টেলিফোন নামিয়ে রেখে লিখতে বলেন, টানা চোদ্দো-পনেরো দিন সকাল-বিকেল লিখে শেষ করেন একটা উপন্যাস। এবার দরজা খুলে পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বেড়াতে চলে যান কোনও প্রমোদতরণীতে। তাঁর প্রত্যেকটি বই-ই হিট যাকে বলে।

এহেন একজন দারুণ সার্থক লেখকেরও মনের মধ্যে একটা অতৃপ্ত, দরিদ্র, বাউন্ডুলে রয়ে গেছে। সিমেনোঁর অনেক উপন্যাসের নায়কই একজন ঘরছাড়া মানুষ, যে প্রেমে বঞ্চিত, যে ভালো ব্যাবসা বা চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফুটপাতের মানুষদের পাশে শুয়ে থাকে। ধনীদের প্রতি একটা তীব্র বিদ্বেষের ভাব ফুটে ওঠে তাঁর সব লেখায়।

লুভর মিউজিয়াম আর বেশি দূরে নয়, কিন্তু খুব জোর বৃষ্টি নেমে গেল। আমরা দৌড়ে গিয়ে ঢুকলাম একটা কাফেতে। সামনেটা কাঁচে ঢাকা, ভেতরে ঠান্ডা নেই, কফির সৌরভে আমোদিত। নানা রঙের পোশাক পরা অনেক দেশের মানুষ সেখানে বসে আছে, জন ভারতীয়ও চোখে পড়ল, আমরা গিয়ে বসলাম ভেতরের দিকে একটা খালি টেবিলে।

একটুক্ষণ গল্প করার পর মার্গারিট হঠাৎ চুপ করে গেল। অন্যমনস্ক, ঝুঁকে পড়েছে, আঙুল দিয়ে টেবিলে দাগ কাটছে।

আমি তার বাহু স্পর্শ করে জিগ্যেস করলাম, কী হল, মার্গারিট?

মার্গারিট বলল, মনটা হঠাৎ খারাপ লাগছে।

মন খারাপের কথা শুনলে তার কারণ জানতে ভরসা হয় না। অনেক সময় মন খারাপের কারণ তো মুখে বুঝিয়ে বলাও যায় না।

মার্গারিট নিজেই আবার বলল, আমার মা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ঢলে গেছেন, তারপর সাতদিন আমি কোনও খবরই নিইনি।

আমি অপরাধী বোধ করে বললাম, সত্যিই তো, তোমার একবার যাওয়া উচিত ছিল। তুমি যাও, ঘুরে এসো। আমি এখানে দু-একদিন একলা থাকতে পারব অনায়াসে।

মার্গারিট বলল, আমার বাড়িতে তোমাকেও কি নিয়ে যাওয়া উচিত নয়? বেশি দূর নয়, ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা।

আমি এবার উৎসাহের সঙ্গে বললাম, হ্যাঁ, আমিও যাব। গ্রাম দেখতে আমার ভালো লাগে। তুমি কোথায় জন্মেছ, সেই জায়গাটা আমি দেখতে চাই। চলো, কাল সকালেই যাই।

মার্গারিট বলল, কিন্তু আমার বাড়িতে তুমি গেলে…আমার যাবা-মা যদি তোমাকে দেখে রেগে যান..তুমি হিন্দু–

আমি ভুরু তুলে বললাম, তোমার যাবা-মা কি এমনই গোঁড়া ক্যাথলিক যে একজন হিন্দুকে দেখলেই চটে যাবেন? আমি হিন্দু বাড়িতে জন্মেছি বটে, কিন্তু কোনও ধর্মেরই তো চর্চা করি না।

মার্গারিট বলল, না, না, সেরকম নয়, আমার যাবা কিংবা মা হিন্দুদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না, এমনিতে কিছুই মনে করতেন না, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, যদি ওঁরা ভাবেন, যদি ওঁরা ভাবেন…

মার্গারিট আমার হাত চেপে ধরে কাতর গলায় বলল, সুনীল, প্লিজ, তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেও না! সে কথা শুনলে আমার বাবা-মা এমন দুঃখ পাবেন–

মার্গারিটের সারল্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সত্যিই আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি কি একটা বিয়েপাগলা বুড়ো যে হুট করে ওকে বিয়ে করতে চাইব? পৃথিবীর আর কোনও মেয়ে কি এমন কথা এত সহজে বলতে পারব?

আমি মজা করার জন্য বললাম, সে কী! তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে না? সব যে ঠিকঠাক হয়ে গেছে?

মার্গারিট আরও দুর্বল হয়ে গিয়ে বলল, না, সুনীল, তুমি চাইলে আমি না বলতে পারব। কিন্তু আমার মা-যাবা এমন কষ্ট পাবেন, আমার মা অবঝ, তিনি এমন আঘাত পাবেন যে সহ্য করতে পারবেন না…না, তা আমি পারব না।

আমি বললাম, ওসব আমি শুনছি না। আমি তোমাকে বিয়ে করবই। কালই।

একটু বাদে মার্গারিট ইয়ার্কি বুঝতে পেরে ফিক করে হাসল। তারপর বলল, সত্যি, তোমাকে একবার আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে খুব ইচ্ছে করে।

আমি জিগ্যেস করলাম, তোমার যাবা-মা রেগে গিয়ে কী করবেন, মার্গারিট! আমায় জুতোপেটা করবেন? পেটে ছুরি বসিয়ে দেবেন?

মার্গারিট বলল, যাঃ, সেরকম কিছু না। যাবা তো খুব লাজুক, আর মা…যদি তোমার সঙ্গে ভালো করে কথা না বলেন? তোমার একটুও অপমান হলে তা আমার বুকে বাজবে!

আমি বললাম, ও, এই! এর চেয়ে কত বেশি অপমান আমি সহ্য করেছি! এসব আমি গায়ে মাখি না। চলো, তোমাদের বাড়িতে যাব!

মার্গারিট বলল, সত্যি যাবে? আমাদের লুদ গ্রামে? তা হলে একটা ফোন করে নিয়ে আমরা কাল পরশুই যাব!