১০. বড়ঠাকুরের গাড়ি খারাপ

বড়ঠাকুরের গাড়ি খারাপ, ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা কাকাবাবুকে অনুসরণ করতে পারলেন না। কাকাবাবু চলে গেলেন অনেক দূরে।

গভীর অরণ্যের মধ্যে ঘুরতে-ঘুরতে তিনি চিল্কার করতে লাগলেন, টিকেন্দ্রজিৎ! টিকেন্দ্রজিৎ! যদি সাহস থাকে সামনে এসো! আমি একলা আছি, ভিতুর মতন লুকিয়ে থেকো না!

জঙ্গলের হিংস্র জানোয়ারের পরোয়া করলেন না, আড়াল থেকে কেউ তাঁকে মেরে ফেলতে পারে, সেকথাও চিন্তা করলেন না। তিনি একই কথা চিকার করে বলতে লাগলেন বারবার।

এখন তাঁকে দেখলে পাগল বলেই মনে হবে।

এত বড় জঙ্গলের কোথায় টিকেন্দ্রজিৎ লুকিয়ে আছে তার ঠিক নেই। এমন কি, সে মণিপুর বা অরুণাচলের দিকেও চলে যেতে পারে। জঙ্গল ছেড়ে লুকোতে পারে পাহাড়ে। তা ছাড়া ডাক শুনতে পেলেই বা সে সামনে আসবে কেন?

এ সব কিছুই কাকাবাবুর মনে পড়ছে না। প্রতিশোধের চিন্তায় তাঁর মাথায় আগুন জ্বলছে। তিনি গলা ফাটিয়ে ডাকলেন, টিকেন্দ্রজিৎ, টিকেন্দ্রজিৎ!

ভোর হয়ে যাওয়ার পরও তিনি ক্লান্ত হলেন না, কিন্তু তাঁর ঘোড়াটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর নড়তে চায় না।

ঘোড়া থেকে নামলেন কাকাবাবু।

সেটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে তিনি নিজেও একটা গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পাশে রইল গুলি ভরা রাইফেল।

তাঁর ঘুম ভাঙল ঘোড়াটার লাফাফাফি ও চিঁহিঁ ডাকে।

কাকাবাবু রাইফেলটা তুলে এদিক-ওদিক তাকালেন। ঘোড়াটা কোনও কারণে ভয় পেয়েছে। দু পা উঁচুতে তুলে বাঁধন খুলতে চাইছে।

কাকাবাবু হাঁক দিলেন, টিকেন্দ্রজিৎ! টিকেন্দ্রজিৎ!

সঙ্গে-সঙ্গে সামনের একটা ঝোপ থেকে একটা হলুদ রঙের প্রাণী এক লাফে আর-একটা ঝোপে গিয়ে পড়ল।

বাঘ! এই প্রথম বাঘ দেখা গেল এই জঙ্গলে। যতদূর মনে হয় লেপার্ড, লোকে বলে চিতাবাঘ, কিন্তু আসল চিতাবাঘ অন্যরকম, অনেক লম্বা হয়। এই লেপার্ডগুলো ছোট হলেও খুব হিংস্র। মানুষের মুখোমুখি হতে সাহস পায় না, কিন্তু ঘোড়ার মাংসের ওপর খুব লোভ।

লেপার্ডটা এখনও ঝোপের মধ্যে বসে আছে। মানুষটাকে ডিঙিয়ে কী করে ঘোড়াটাকে খাবে, বোধ হয় সেই কথা ভাবছে। ভাগ্যিস কাকাবাবুর ঘুমের মধ্যে ঘোড়াটার ওপর লাফিয়ে পড়েনি। কাকাবাবু কাচ দুটো আনেননি। ঘোড়াটা মরে গেলে তিনি একেবারে অচল হয়ে যাবেন।

কাকাবাবু আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। ঝোপের আড়ালে বাঘটার মাথা একটু-একটু দেখা যাচ্ছে। তিনি ইচ্ছে করলেই পরপর দুটো গুলি চালিয়ে বাঘটাকে মেরে ফেলতে পারেন। কিন্তু অকারণে প্রাণিহত্যা করতে তাঁর মন চায় না।

তিনি জোরে-জোরে বললেন, এই যাঃ যাঃ! পালা! হরিণ কিংবা খরগোশ ধর না গিয়ে! আমার ঘোড়াটা না হলে তোর চলছে না? যাঃ যাঃ।

বাঘটার তবু নড়বার নাম নেই। অনেকদিন নিশ্চয়ই সে ঘোড়ার মাংস খায়নি।

বাঘটা কিছুতেই যাচ্ছে না দেখে তিনি রাইফেলের ডগাটা আকাশের দিকে তুলে একবার ফায়ার করলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে বাঘটা তিড়িং করে এক লাফ দিল, আরও কয়েক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কাকাবাবু ঘোড়াটার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করলেন। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ভয় নেই, ভয় নেই রণজিৎ! আমি যতক্ষণ আছি, তোকে কেউ মারতে পারবে না।

আবার ঘোড়ায় চেপে তিনি সতর্ক দৃষ্টি মেলে এগোতে লাগলেন। মাঝে-মাঝে হাঁক দিতে লাগলেন, টিকেন্দ্রজিৎ! টিকেন্দ্রজিৎ!

তিনি ঠিক করেছেন, যেমন করে হোক, টিকেন্দ্রজিৎকে খুঁজে বের করতেই হবে। তাকে না পেলে তিনি এই জঙ্গল ছেড়ে যাবেন না। এখানেই তাঁর মৃত্যু হয় হোক!

জঙ্গলের মধ্যে কোথায় তিনি চলে এসেছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। তাঁর কাছে এই জঙ্গলের একটা ম্যাপ ছিল, সেটা তো সঙ্গে আনেননি। এদিকে কোনও ঝিল বা জলাশয় চোখে পড়ছে না, কাল রাতের জায়গা থেকে এটা নিশ্চয়ই অন্য দিকে।

ঘুরতে-ঘুরতে দুপুরবেলা কাকাবাবু এক জায়গায় কয়েকটা কুঁড়ে ঘর দেখতে পেলেন। নতুন উৎসাহ নিয়ে তিনি ছুটে গেলেন সেদিকে।

মোট পাঁচটা ঘর। কিছু হাঁস-মুরগি চরছে, দুটো ঘোড়া একটা মাটির গামলা থেকে খড়-বিচালি চিবোচ্ছে। একটি বুড়ো লোক আপনমনে কাঠ কেটে চলেছে।

কাকাবাবু কাছে গিয়ে বুড়োটিকে নমস্কার জানিয়ে অসমিয়া ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি টিকেন্দ্রজিৎকে চেনো, তাকে কাছাকাছি দেখেছ?

বুড়োটি অবাক হয়ে নিঃশব্দে চেয়ে রইল।

কাকাবাবু আবার বললেন, বেশ লম্বা লোক, কালো রঙের ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়ায়, মাথায় টুপি।

একটা ঘর থেকে আর-একজন ছোকরা মতন লোক বেরিয়ে এল। কাকাবাবু তাকেও একই কথা জিজ্ঞেস করলেন।

সে মাথা নেড়ে জানাল যে, না, ওরকম কোনও লোককে তারা চেনে না।

কাকাবাবু পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বার করে বললেন, আমার ঘোড়াটাকে কিছু খাবার দিতে পারো? পয়সা দেব।

কাকাবাবু নেমে দাঁড়াতেই সেই ছেলেটি ঘোড়াটাকে টেনে নিয়ে গেল।

কাকাবাবু একটা ঘরের দাওয়ায় বসলেন। তাঁর মনে পড়ল, তাঁরও বেশ খিদে পেয়েছে। কাল দুপুরের পর আর কিছু খাওয়া হয়নি।

দু-তিন জন স্ত্রীলোক কাকাবাবুকে কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে। কাকাবাবু তাদের দিকে হাত দিয়ে খাওয়ার ইঙ্গিত করে বললেন, আমায় কিছু খেতে দেবে? তোমাদের ঘরে যা আছে, তাই দাও।

একজন স্ত্রীলোক একটা ছোট বেতের ডালায় করে কিছু মুড়ি আর খানিকটা গুড় নিয়ে এল, কাকাবাবু সেই গুড়-মুড়িই খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন, তারপর ঢকঢক করে একঘটি জল খাওয়ার পর প্রাণটা ঠাণ্ডা হল।

ঘোড়াটাও পেটভরে খেয়ে এসে ফরর ফরর শব্দ করতে লাগল। কাকাবাবু আবার উঠে পড়ে ওই লোকদের বললেন, তোমাদের ধন্যবাদ আর নমস্কার। এখানে টিকেন্দ্রজিৎ যদি আসে, তাকে বোলো, একজন খোঁড়া লোক তাকে খুঁজছে।

আবার শুরু হল জঙ্গল পরিক্রমা। মাঝে-মাঝেই কাকাবাবু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেন, টিকেন্দ্রজিৎ! টিকেন্দ্রজিৎ। যদি মরদ হও ততো বেরিয়ে এসো। আমি একা এসেছি। আর কেউ নেই এখানে!

মাঝে-মাঝে কোনও ঝোপের মধ্যে খচরমচর শব্দ হলে তিনি থেমে যান। মনে হয় যেন টিকেন্দ্রজিৎ তাঁকে অনুসরণ করছে। তারপর দেখা যায়, খরগোশ ছুটে পালাচ্ছে। এক জায়গায় হাতির পাল দেখা গেল, সাতটা বড় আর একটা বাচ্চা হাতি। গণ্ডার এখনও চোখে পড়েনি।

একসময় একটা গোঁ-গোঁ শব্দ শুনে তিনি থেমে গেলেন। একটা গাড়ি আসছে। কাকাবাবু একটা বেশ ঘন ঝোপের আড়ালে চলে গেলেন। মাথাটা নিচু করে থাকলে এখানে তাঁকে কেউ দেখতে পাবে না। ঘোড়াটা কোনও শব্দ করলেই হয়।

কাছে আসতে বোঝা গেল, সেটা একটা পুলিশের জিপ। একজন ড্রাইভার ও তিনজন বন্দুকধারী পুলিশ, ওদের মধ্যে সন্তু কিংবা জোজো নেই। ওরা কাকে খুঁজতে এসেছে, টিকেন্দ্রজিৎকে, না কাকাবাবুকে!

কাকাবাবু ঠিক করলেন, ঘোড়াটা যদি শব্দ করে আর জিপটা এই ঝোপের দিকে মুখ ফেরায়, তা হলে তিনি গুলি চালিয়ে জিপটার সামনের আর পেছনের চাকা ফুটো করে দেবেন। তারপর পালাতে অসুবিধে হবে না। তিনি কিছুতেই ধরা দেবেন না ওদের হাতে। তার সঙ্গের থলিতে রাইফেলের অনেকের বুলেট আছে, কোটের পকেটে আছে রিভলভার।

জিপটা এদিকে ফিরলই না, সোজা চলে গেল। কেমন যেন দায়সারা ভাব। এমনভাবে খুঁজলে ওরা সারাজীবনেও টিকেন্দ্রজিৎকে খুঁজে পাবে না।

আবার ঘুরতে-ঘুরতে বিকেলের দিকে কাকাবাবু কিছু বাড়িঘর দেখতে পেলেন। জঙ্গলের মধ্যে এরকম আদিবাসীদের কিছু কিছু বসতি থাকে। এ-জায়গাটা একটু বড়, গোটা পনেরো কুঁড়েঘর রয়েছে একটা গোল উঠোন ঘিরে।

একজন বুড়ো আপনমনে কুড়ল দিয়ে একটা গাছের গুঁড়ি কেটে চ্যালাকাঠ করছে। কাকাবাবু তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নমস্কার, তুমি টিকেন্দ্রজিৎকে চেনো?

বুড়োটি একটুক্ষণ মনোেযোগ দিয়ে টিকেন্দ্রজিতের বর্ণনা শুনল, তারপর আঙুল তুলে দূরে অন্য একটি লোককে দেখিয়ে দিল। সে-লোকটি একটি খাটিয়ার দড়ি মেরামত করছে। তার পাশেই একটি ঘরের দেওয়ালে একটা হরিণের শিং-সুদ্ধ শুকনো মাথা ঝোলানো রয়েছে।

কাকাবাবুর রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। তা হলে টিকেন্দ্রজিতের সন্ধান পাওয়া গেছে!

সে-লোকটি কিন্তু কোনও পাত্তাই দিল না কাকাবাবুকে। ভুরু কুঁচকে কাকাবাবুকে আপাদমস্তক দেখে বলল, কে টিকেন্দ্রজিৎ? কখনও এনাম শুনিনি। কোনও বাইরের লোক এখানে আসে না।

কাকাবাবু অনেকরকম চেষ্টা করলেন, কিন্তু সে গোঁয়ারের মতন একই কথা বলে যেতে লাগল। এর কাছ থেকে কিছু জানার আশা নেই।

কাছেই কয়েকটি অল্পবয়েসী মেয়ে মাটিতে দাগ কেটে কী যেন খেলছে। কাকাবাবু সেদিকে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে। একটি মেয়েকে কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছে। এর চেহারাও অন্য মেয়েদের থেকে কিছুটা আলাদা। সে একটা হলুদ রঙের ফ্রক পরে আছে।

কাকাবাবু ঘোড়াটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি, তুমি ফিরোজা না?

মেয়েটিও চিনতে পেরেছে কাকাবাবুকে। সে ঘাড় বেঁকিয়ে চুপ করে রইল।

কাকাবাবু এবার সেই গোমড়ামুখো লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, এ-মেয়েটিকে তোমরা কোথায় পেলে? এ তো তোমাদের গ্রামের নয়।

সেখানে আরও অনেকে ভিড় করে দাঁড়াল। সবাই মিলে বলতে লাগল যে, এ মেয়েটি সত্যিই তাদের কারও নয়। একটা লোক এই মেয়েটার হাত-পা বেঁধে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, আর মেয়েটা খুব কাঁদছিল, তখন এ-গ্রামের কয়েকজন লোক সেই চোরটাকে মেরেধরে তাড়িয়ে দিয়েছে। সাত-আট দিন ধরে মেয়েটা এখানেই রয়ে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, ওকে ওর বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসোনি কেন? ওর বাবা-মা কত কষ্ট পাচ্ছে।

ওদের একজন বলল, ও মেয়ে যে কোথায় বাড়ি, কাদের মেয়ে, তা কিছুই বলতে চায় না। আমরা জঙ্গল ছেড়ে বাইরে যাই না, আমরা কী করে পৌঁছে দেব? আপনি নিয়ে যান না ওকে!

কাকাবাবু দোটানার মধ্যে পড়ে গেলেন।

জলিল শেখ তার প্রাণ বাঁচিয়েছে, তাঁর মেয়েকে এখানে দেখেও তিনি ফেলে যাবেন কী করে? জলিল শেখ মেয়ের জন্য খুব কাঁদছিল। মেয়েটার মাও নিশ্চয়ই কাঁদছে। কিন্তু এ-মেয়েকে এখন বাড়ি পৌঁছে দিতে গেলে আর টিকেন্দ্রজিতের খোঁজ করা হবে না।

এমনভাবে জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে তিনি কতদিন খুঁজবেন। কখনও কি তাকে পাওয়া যাবে? নাঃ, এরকম ঘুরে আর লাভ নেই। ফিরে যাওয়াই ভাল। অন্যায়ের প্রতিশোধ কিংবা অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার চেয়েও কি উপকারীর ঋণশোধ করা অনেক বড় কাজ নয়?

কাকাবাবু ফিরোজাকে কোলে নিয়ে বললেন, কী রে, দুষ্টু মেয়ে, বাড়ি যাবি?

ফিরোজা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কাকাবাবু তাকে জোর করে ঘোড়ায় তুলে নিলেন। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জেনে নিলেন জঙ্গল থেকে বেরোবার রাস্তা কোনদিকে।

ফিরোজা ফুপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

কাকাবাবু আদর করে তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কী রে ফিরোজা, তোর বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না কেন?

ফিরোজা বলল, বাবা আমাকে মারে!

কাকাবাবু বললেন, আহা, একদিন মারলেও বাবা তোকে ভালবাসে। মা ভালবাসে না?

ফিরোজা বলল, আমার নিজের মা তো নেই! বাড়িতে অন্য মা।

কাকাবাবু বললেন, তা হলেও ওটা তো তোর নিজের বাড়ি। তুই ইস্কুলে পড়িস না!

ফিরোজা বলল, হ্যাঁ, পড়ি।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ এখানে বেশ ইস্কুল ফাঁকি দিয়ে রয়েছিস। বেশ মজা, তাই না? তুই এই গ্রামে এলি কী করে?

ফিরোজা বলল, আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে একটা জঙ্গলে বসে ছিলাম। তখন একটা লোক এসে আমার হাত-পা বেঁধে ফেলল–

ওর সঙ্গে গল্প করতে-করতে ধীর গতিতে চলতে লাগলেন কাকাবাবু।

হঠাৎ তাঁর মাথায় সেই পাগলামিটা আবার ফিরে এল। এ তিনি কী করছেন? টিকেন্দ্রজিতের ওপর প্রতিশোধ না নিয়ে ফিরে যাবেন? টিকেন্দ্রজিৎ গোপন জায়গায় বসে হাসবে। একবার লোকালয়ে গিয়ে পড়লে আর তাঁর ফেরা হবে না। কলকাতায় গিয়ে অনবরত এই কথাটা তার মনে কাঁটার মতন বিঁধবে। এ পর্যন্ত যারাই তাঁর গায়ে হাত দিয়েছে, তাদেরই তিনি শাস্তি দিয়েছেন। টিকেন্দ্রজিৎ জিতে যাবে? এ ব্যর্থতা তিনি মেনে নিতে পারবেন না সারা জীবন।

উত্তেজিতভাবে তিনি বললেন, ফিরোজা, আমার একটা কাজ বাকি আছে। তুই আর দু-একদিন এই আদিবাসীদের সঙ্গে থাকতে পারবি?

ফিরোজা মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ, পারব।

কাকাবাবু এবার খুব জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে এলেন গ্রামে। ওরা আবার ভিড় করতেই তিনি একটা একশো টাকার নোট একজন বৃদ্ধকে দিয়ে বললেন, ওকে তোমাদের কাছেই রাখো। আমি ফিরে এসে ওকে নিয়ে যাব। যদি আমি ফিরে না আসি, ওকে জামগুঁড়ি গ্রামের জলিল শেখের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ো।

তারপরই আবার ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন উলটো দিকে।

বনে বনে তাঁর চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, টিকেন্দ্রজিৎ! টিকেন্দ্রজিৎ!

বিকেল শেষ হয়ে আসছে। একটু পরই রাত্রি নেমে আসবে। এই ঘোর অরণ্যের মধ্যে তিনি কোথায় থাকবেন, কী করে থাকবেন, কোনও চিন্তাই করছেন না। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি সারারাতই এইভাবে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে ঘুরছেন।

কোথাও পথের চিহ্ন নেই। গাছপালা ঠেলে-ঠেলে তাঁকে এগোতে হচ্ছে। এক-এক জায়গায় জঙ্গল এমনই দুর্ভেদ্য যে, সামনে এগোতে না পেরে ঘুরে যেতে হচ্ছে তাঁকে।

চিৎকার করতে করতে কাকাবাবুর গলা চিরে যাচ্ছে। তিনি ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছেন। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

তাঁর সেই রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে পালাল একপাল হরিণ। মাথার ওপর দিয়ে ঝটপট করে উড়ে যাচ্ছে পাখি। ঘোড়াটাও ডেকে উঠছে মাঝে-মাঝে, কাকাবাবুর ভ্রূক্ষেপ নেই।

মাঝে-মাঝে হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। ঠিক খেলার মাঠের মতন। আবার কোথাও এত বেশি ঝোপঝাড় আর লতাপাতা যে, দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। এদিকটায় ছোট-ছোট পাহাড় রয়েছে। পাথরের ফাঁকে বড় বড় সুড়ঙ্গের মতন। লুকোবার কত জায়গা। এসব জায়গা থেকে কাউকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।

কাকাবাবু তবুও খুঁজছেন আর চিৎকার করে ডাকছেন, টিকেন্দ্রজিৎ, টিকেন্দ্রজিৎ! ঝোপঝাড় ঠেলে দেখছেন, পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে-ঘুরে দেখছেন।

একটা ছোট্ট টিলা ঘুরে আসতেই সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। তার এক প্রান্তে স্থির হয়ে রয়েছে এক কালো ঘোড়ায় অশ্বারোহী।

কাকাবাবু প্রথমটায় দেখতেই পাননি, ডান দিক বাঁ দিক দেখতে দেখতে আসছিলেন, হঠাৎ সামনের দিকে চোখ পড়তেই তিনি দ্রুত ঘোড়ার রাশ টানলেন।

টিকেন্দ্রজিৎ রাইফেল তুলে তাক করে আছে।

কাকাবাবুর এক হাতে ঘোড়ার রাশ, এক হাতে রাইফেল। দু হাত দিয়ে না ধরলে ঠিকমতন গুলি চালানো যায় না। টিকেন্দ্রজিৎ একেবারে তৈরি হয়ে রয়েছে, কাকাবাবু রাইফেল তোলার সময় পেলেন না।

টিকেন্দ্রজিৎ গম্ভীরভাবে বলল, তোমার হাতের রাইফেলটা ফেলে দাও রায়চৌধুরী।

রাইফেলটা ফেলার বদলে কাকাবাবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। টিকেন্দ্রজিৎকে যে শেষ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া গেছে, তাতেই তাঁর ক্লান্তি কমে গেল। যাক, আর খুঁজে বেড়াতে হবে না!

টিকেন্দ্রজিৎ চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, কী ব্যাপার বলো তো রায়চৌধুরী, তোমার এত মরার শখ কেন? সারাদিন তুমি আমার নাম ধরে চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছ! উইপোকা যেমন মরার জন্য আলোর দিকে ছুটে আসে, সেইরকম তুমিও আমার হাতেই মরতে চাও!

কাকাবাবু বললেন, আমি একা এসেছি। সঙ্গে পুলিশ কিংবা আর্মি আনিনি। তোমার সঙ্গে আমার শেষ লড়াইটা বাকি আছে।

টিকেন্দ্রজিৎ হা-হা করে হেসে উঠে বলল, কীসের শেষ লড়াই? এক্ষুনি গুলি করে তোমার মাথা ছাতু করে দিতে পারি, সব শেষ হয়ে যাবে। এর আগে অন্তত পাঁচ বার তোমাকে পেছন থেকে গুলি করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তুমি আমার নাম ধরে এত ডাকছ, তাই আমার কৌতূহল হল। এত আন্তরিকভাবে ডাকলে লোকে ভগবানেরও দেখা পেয়ে যায়, তাই আমি তোমার সামনে এলাম।

কাকাবাবু বললেন, পেছন থেকে গুলি করে কাপুরুষরা। তুমি এক সময় খেলোয়াড় ছিলে। খেলার নিয়ম মানবে না? সাহস থাকে তো সামনাসামনি লড়ে যাও!

টিকেন্দ্ৰজিৎ বলল, এটা ছেলেখেলা নয়! তুমি আমাদের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছ। বহু টাকার ক্ষতি হয়ে গেল। সামান্য কয়েকটা গণ্ডার মরলে কী ক্ষতি হত? তার বদলে তোমাকে মরতে হবে। আমার মায়াদয়া নেই। তোমাকে এখানে মেরে ফেলে দিয়ে গেলেও পুলিশ কোনও দিন আমাকে ধরতে পারবে না। তুমি রাইফেল তোলার চেষ্টা করলেই আমি গুলি চালাব, তুমি খতম হয়ে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, এর আগে অনেকেই আমাকে একথা বলেছে, কিন্তু কেউ তো এ-পর্যন্ত মারতে পারেনি। আমি ম্যাজিক জানি, তাই আমি বারবার বেঁচে যাই। তুমি প্রথম বার টিপ ফসকাবে, সঙ্গে সঙ্গে আমি দু হাতে রাইফেল ধরে নেব। তারপর? তুমি যদি অপ্রস্তুত থাকতে, আমি কিন্তু প্রথমেই তোমাকে গুলি করতাম না। তোমাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি যখন, তোমাকে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দিতাম। যদি পুরুষ মানুষ হও, সামনাসামনি সমানে-সমানে লড়তে এসো।

টিকেন্দ্রজিৎ বলল, তোমার সঙ্গে সামনাসামনি আমি কী লড়ব? হাতাহাতি?

কাকাবাবু বললেন, রাজি আছি।

টিকেন্দ্রজিৎ বলল, এ তো আচ্ছা পাগল দেখছি! তুমি একে তো খোঁড়া, তায় প্রায় বুড়ো। তুমি পারবে আমার সঙ্গে? তুমি তো দৌড়তেই পারবে না। আমি দৌড়ে-দৌড়ে তোমার চার পাশে ঘুরব, আমাকে ছুঁতেও পারবে না তুমি। আমি তোমার হাত-পা ছিঁড়ে ফেলব, ঘাড় মুচড়ে দেব। আমার কত শক্তি, জানো না তুমি!

কাকাবাবু বললেন, তুমিও আমার শক্তি জানো না।

টিকেন্দ্রজিৎ বলল, তলোয়ার ধরতে জানো?

কাকাবাবু বললেন, জানি। জোগাড় করো, তলোয়ার লড়তেও রাজি আছি।

টিকেন্দ্রজিৎ বলল, একজন খোঁড়া লোকের সঙ্গে তলোয়ার লড়তে হবে? লোকে শুনলে হাসবে। দশ গোনারও সময় পাবে না। তোমার পেট ফুটো করে দেব। আমি ফেসিং চ্যাম্পিয়ান।

কাকাবাবু বললেন, তোমার মতো চ্যাম্পিয়ান আমি ঢের দেখেছি। আমার একটা পা-ই তোমার সঙ্গে লড়ার জন্য যথেষ্ট! তলোয়ার যখন নেই, তখন ড়ুয়েল লড়ো!

টিকেন্দ্ৰজিৎ বলল, ড়ুয়েল? হা-হা-হা-হা! তুমি জানো না, একজন পুলিশ কমিশনার আমার নাম দিয়েছে ফাস্টেস্ট গান অ্যালাইভ। তুমি চোখের পলক ফেলবার আগে আমি গুলি চালাতে পারি। তুমি মরবে, মরবে রায়চৌধুরী। তোমার আর নিস্তার নেই।

কাকাবাবু বললেন, ড়ুয়েল লড়তে গিয়ে মৃত্যু অনেক সম্মানজনক। তুমি যদি মরো, তা হলে লোকে অন্তত এইটুকু বলবে যে, তুমি বীরের মতন মরেছ।

ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে টিকেন্দ্রজিৎ বলল, ঠিক আছে, চুকিয়ে ফেলা যাক। আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।

কাকাবাবুও নেমে পড়ে বললেন, রাইফেল, না রিভলভার?

টিকেন্দ্রজিৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, যেটা ইচ্ছে, দুটোই আমার কাছে সমান।

কাকাবাবু বললেন, তবু তোমাকে আমি বেছে নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। তুমি কোনটা চাও?

টিকেন্দ্ৰজিৎ বলল, ঠিক আছে, রিভলভার। দুজনেই রাইফেল নামিয়ে রেখে রিভলভার বের করল।

কাকাবাবু বললেন, আমরা দুজনে উলটো দিকে ঠিক কুড়ি পা হেঁটে যাব।

টিকেন্দ্ৰজিৎ বলল, তারপর অন্য একজনের দশ গোনার কথা। এখানে কে গুনবে।

দুজনে দুদিকে গিয়ে দাড়াল। টিকেন্দ্ৰজিৎ বীরের মতন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছে। কাকাবাবু খোঁড়া পায়ে সোজা হয়ে দাড়াতে পারছেন না, একটু ঝুঁকে আছেন।

টিকেন্দ্রজিৎ গুনল, এক…

কাকাবাবু বাঁ হাত দিয়ে মুখটা মুছে নিলেন।

টিকেন্দ্রজিৎ গুনল, দুই, তিন, চার, পাঁচ…

কাকাবাবুর রিভলভার সমেত ডান হাতটা নীচের দিকে নামানো।

টিকেন্দ্রজিৎ গুনল, ছয়, সাত, আট, নয়..

কাকাবাবুর কোনও উত্তেজনা নেই।

তিনি সোজা চেয়ে আছেন তার প্রতিপক্ষের দিকে।

টিকেন্দ্রজিৎ দশ বলেই কায়দা করে লাফিয়ে উঠল শুন্যে। বলল, তুমি মারো! পরপর তিনটি গুলির শব্দ হল।

টিকেন্দ্রজিৎ ঝুপ করে নেমে এল মাটিতে। ওদিকে কাকাবাবুও মাটিতে পড়ে আছেন উপুড় হয়ে।

প্রথমে টিকেন্দ্রজিৎ কাতর শব্দ করে উঠল, আঃ!

কাকাবাবু আস্তে-আস্তে উঠে বসলেন। তারপর এক পায়ে লাফাতে-লাফাতে চলে এলেন টিকেন্দ্রজিতের কাছে। টিকেন্দ্রজিৎ যন্ত্রণায় মাটিতে গড়াতে শুরু করেছে। তার ডান হাত ও ডান পায়ের হাঁটুর কাছটা রক্তে মাখা। রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেছে অনেক দূরে।

টিকেন্দ্রজিৎ কাতরভাবে বলতে লাগল, আমার আঙুল, আমার বুড়ো আঙুলটা নেই। আর কোনও দিন আমি অস্ত্র ধরতে পারব না। আমার হাঁটু, হাঁটু ভেঙে গেছে। আমি আর বাঁচতে চাই না। রায়চৌধুরী, তুমি আর-একবার গুলি করে আমায় মেরে ফেলো।

কাকাবাবু বললেন, আমি মানুষ মারি না। জীবনে একটাও লোককে মেরে ফেলিনি! তোমাকে শাস্তি দেওয়ার কথা ছিল, শাস্তি দিয়েছি। তুমি আমার চুলের মুঠি ধরেছিলে। জীবনে আর কোনও কিছুই মুঠোয় চেপে ধরতে পারবে না। ডান পায়ে লাথি মেরেছিলে, আর কোনও দিন কাউকে লাথি মারতে পারবে না।

টিকেন্দ্রজিৎ আবার বলল, আমায় মেরে ফেলো। এই অবস্থায় আমি কিছুতেই বাঁচতে চাই না।

কাকাবাবু বললেন, তোমাকে খুঁজে না পেয়ে আমি আত্মহত্যা করার জন্য তৈরি ছিলাম। আত্মসম্মান বজায় রাখতে না পারলে বেঁচে থাকাটাই বিড়ম্বনা। তুমি লোককে ভয় দেখিয়ে চলতে। এখন আর তোমায় কেউ ভয় পাবে না, এটাই তোমার শাস্তি। আমার আর-একটা কাজ বাকি আছে।

টিকেন্দ্রজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি আর কথা বলতে পারছি না। রায়চৌধুরী, দয়া করে কাছে এসো, আমার মাকে শুধু একটা কথা জানাতে হবে।

কাকাবাবু কাছে এসে মুখ ঝুঁকিয়ে দাড়াতেই টিকেন্দ্রজিৎ তার অক্ষত বাঁ হাতটা দিয়ে কাকাবাবুর একটা পা ধরে হ্যাচকা টান দিল। কাকাবাবু ধড়াম করে পড়ে গেলেন।

টিকেন্দ্রজিৎ তার রক্তমাখা শরীর নিয়ে কাকাবাবুর বুকে চেপে হিংস্র গলায় বলল, আমি মরব, তার আগে তোমাকেও শেষ করে যাব।

সে কাকাবাবুর গলা চেপে ধরলেও তিনি ঘাবড়ালেন না। টিকেন্দ্রজিতের গায়ে যতই জোর থাক সে একহাতে কাকাবাবুকে কাবু করতে পারবে না। কাকাবাবু কোনওক্রমে ডান হাত তুলে একটা প্রচণ্ড ঘুসি কষালেন তার এক চোখে। তারপর তাকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন বুক থেকে।

চোখের ব্যথায় আরও জোর ছটফট করতে লাগল টিকেন্দ্রজিৎ।

কাকাবাবু হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসে বললেন, একটা কাজ বাকি আছে।

টিকেন্দ্রজিতের কোটের পকেট হাতড়ে পেয়ে গেলেন লাইটার ও চুরুট। বহুদিন পর চুরুট ধরাবার জন্য তিনি কাশলেন দু বার। মুখ বিকৃত করে বললেন, ভাল লাগছে না।

চুরুটের মুখটা যখন লাল গনগনে হল, তখন কাকাবাবু সেটা চেপে ধরলেন টিকেন্দ্রজিতের বুকে।

টিকেন্দ্রজিৎ আঁ-আঁ করে বিকট আর্তনাদ করে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, অন্য লোককে যখন কষ্ট দাও, তখন মনে থাকে না যে, নিজের শরীরে কষ্টটা কেমন লাগে?

টিকেন্দ্রজিতের গলায় একটা সরু লোহার চেনে একটা বাঘের মুখের ছবিওয়ালা লকেট ঝুলছে। কাকাবাবু একটানে সেটা ছিঁড়ে নিয়ে বললেন, এটা আর তোমাকে এখন মানায় না। তুমি এখন একটা শেয়াল।

উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, আমাকে তুমি জঙ্গলে ফেলে রেখে গিয়েছিলে, তোমাকেও ফেলে রেখে গেলাম। হয় জন্তু-জানোয়ারের হাতে মরবে, কিংবা যদি কেউ বাঁচাতে আসে, ভাগ্যে যদি থাকে, তা হলে বাঁচবে।

টিকেন্দ্রজিতের ঘোড়াটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে, নিজের ঘোড়ায় চেপে কাকাবাবু ফিরে এলেন আদিবাসীদের গ্রামে। ফিরোজাকে তুলে নেওয়ার পর তিনি গ্রামের সেই গোমড়ামুখো লোকটাকে বললেন, টিকেন্দ্রজিৎ নামে একজন লোক ওইদিকে জঙ্গলে আহত হয়ে পড়ে আছে। চিকিৎসা করলে এখনও সে বাঁচতে পারে। দ্যাখো, তাকে বাঁচাতে পারে কি না?

ফিরোজাকে তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিতে রাত ভোর হয়ে গেল। সেবাড়িতে কাকাবাবু বিশ্রাম নিলেন খানিকক্ষণ। তারপর বাংলোয় যখন ফিরে এলেন, তখন সকাল নটা বাজে।

সন্তু, জোজোরাও ফিরেছে একটু আগে। সারারাত তারা খোঁজাখুঁজি করেছে জঙ্গলে। তিনটি সার্চ পার্টি ঘুরেছে বিভিন্ন দিকে। হতাশ হয়ে ফিরে এসে সবেমাত্র তারা একটু ঘুমোবার আয়োজন করছে, এমন সময় বাগানে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ছুটে এল বারান্দায়।

ঘোড়া থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে উঠতে কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচ দুটো এনেছিস তো রে! চা-টা বানাতে বল। আজ ভাল করে ব্রেকফাস্ট খাব।

কাকাবাবুর শরীরে একটুও ক্লান্তির চিহ্ন নেই। চোখমুখ উজ্জ্বল, ঠোঁটে সেই স্বাভাবিক হাসি। তিনি একটা ইজিচেয়ারে বসলেন।

সন্তু, জোজো দুজনে একসঙ্গে নানা প্রশ্ন শুরু করতেই কাকাবাবু হাত তুলে ওদের থামিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, সব ঘটনাটা বলার আগে তোদের একটা জিনিস দেখাই। রূপকথার গল্পে পড়েছিস তো, রাজকুমার গিয়েছিল এক দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে, পাহাড়ের গুহায়। দারুণ যুদ্ধের পর তো দৈত্যকে হারিয়ে দিল রাজকুমার। কিন্তু রাজধানীতে ফিরে প্রমাণ দিতে হবে তো। সেইজন্য রাজকুমার দৈত্যের মস্ত বড় জিভটা কেটে এনেছিল। আমিও একটা জিনিস এনেছি।

কাকাবাবু কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুঠো করে কিছু তুলে আনলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী প্রমাণ এনেছি বল তো?

কোনও উত্তর না দিয়ে ওরা দুজন উৎসুকভাবে চেয়ে রইল।

কাকাবাবু মুঠো খুলে দেখালেন। টিকেন্দ্রজিতের গলার সেই বাঘমুখো ছবিওয়ালা লকেট!