[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৯. বাড়িতে চিঠি লিখেছিলাম

বাড়িতে চিঠি লিখেছিলাম, ‘এই এতবড় একটা চিংড়ি খেলাম সেদিন!’ উত্তরে মা লিখলেন, ‘এত বড়’ মানে বুঝব কী করে কত বড়?’ সত্যিই তো। আমি লজ্জায় পড়ে গেলুম। আসলে চিঠিটা লেখার সময় আমি টেবিলের ওপর কলমটা রেখে দুটো হাত ফাঁক করে মনে-মনে বলেছিলাম, অ্যা-তো-ব-ড়। আয়তনটা লিখে জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখনও লিখতে গিয়ে আমার দু-হাত ফাঁক হয়ে যায়, আমি বলি, ই, অ্যা-তো-ব-ডু-ই হবে!। আমি যে টেবিলটায় বসে আছি, তার অর্ধেক হবে। অন্তত ঠ্যাংগুলো ছাড়াই আমার হাতের দেড় হাত লম্বা সেই বিরাট চিংড়ি।

মারশাল টাউন নামের একটা ছোট্ট শহরে নিয়ে গেছে আমার বন্ধু। শহরটা ছবির মতো সাজানো সুন্দর এবং সেই শহরের রাজার বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন। না, আমেরিকায় রাজা নেই। কিন্তু সেই লোকটিকে রাজাই বলা যায়, তিনি সেখানকার একটি বিরাট ইস্পাত কারখানার মালিক, তিনটি সিনেমা হল ওঁরই, সবচেয়ে বড় দোকানটাও ওঁর ছেলের নামে, শহরের কতগুলো বাড়ি যে ওঁর, তার আর সীমা সংখ্যা নেই, শহরের একমাত্র মিউজিয়ামটিও ওঁরই টাকায় তৈরি। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের পক্ষে, ওই শহরের শ্রেষ্ঠ হোটেলটিরও তিনিই মালিক। সেখানে আমাদের নেমন্তন্ন, সেই সন্ধেবেলা।

নিরহঙ্কার, সাধারণ চেহারার মানুষটি। তবে খুব বেশি লম্বা, এবং এমনই রোগা যে ওই লিকলিকে চেহারা দেখলে ভয় বা সম্রম জাগার বদলে হাসি পায়। আমেরিকার ধনীদের তুলনায় তিনি যদিও একটি কুচো চিংড়ি, কিন্তু সেদিন সন্ধেবেলা আমাদের এত বিরাট একটা গলদা চিংড়ি খাইয়েছিলেন, যেরকম বড় চিংড়ি মাছ আমি আর কখনও দেখিনি।

স্বয়ং হোটেলের মালিক তাঁর অতিথিদের খাওয়াচ্ছেন–সুতরাং সারা হোটেলে একটা চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। সার বেঁধে ওয়েটার ওয়েট্রেস পিছনে দাঁড়িয়ে। আমাদের প্রতিটি অনুরোধ বা হুকুমের উত্তরে খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে বলছে, ইয়েস স্যার!

অন্য আর কিছু খাওয়ার পদ নেই। সুপের পরই ওই বিরাট চিংড়ি। চিংড়িটা রান্না হয়েছে আস্ত অবস্থাতেই। আস্ত চিংড়িটা প্রথমে গরম জলের ভাপে অনেকক্ষণ সেদ্ধ করা, তারপর বেশ কিছুক্ষণ হালকা মদে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু জলে সেদ্ধ করে খেলে নাকি একটা বুনো বা জলো গন্ধ থেকে যায়।

সুপ খাওয়ার পরই আমাদের প্রত্যেককে অ্যাপ্রন পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। টেবিলে রাখা হয়েছে একগাদা রুপোর ছুরি-কাঁটা, সাঁড়াশি-হাতুড়ি ইত্যাদি একগাদা যন্ত্রপাতি। তারপর আলাদা রুপোর ট্রেতে করে প্রত্যেকের সামনে একটি করে ওই বিশাল মাছ রেখে গেল, তখন আমি ভয়ংকর চমকে গেছি! লবস্টার! লবস্টার!–বলে টেবিলে একটা কলরব পড়ে গেল। আমার পাশে এক ভদ্রমহিলা বসেছিলেন, তাঁকে জিগ্যেস করলুম, এই এতবড় মাছ কেউ একা খেতে পারে নাকি!

–কী বলছ? এরকম বড় মাছ কদাচিৎ পাওয়া যায়! মারশাল টাউনের জরজ ছাড়া এরকম মাছ কেউ খাওয়াতে পারবে না।

–কিন্তু কখন হাতুড়ি-সাঁড়াশি ব্যবহার করতে হবে, তার কোনও নিয়ম আছে?

ভদ্রমহিলা খিলখিল করে হেসে বললেন, আমাকে দেখে দেখে করে যাও!–এ কথাতেও আমি খুব নিশ্চিন্ত হলুম না। কারণ কিছুকাল আগের এক ফরমাল পার্টিতে আমি এক মহিলাকে দেখে দেখে ছুরি-কাঁটা ব্যবহার করছিলুম, কিন্তু টেবিলের সব লোক আমাকে দেখে ফিক-ফিক করে হাসছিল। পরে জেনেছিলুম সেই ভদ্রমহিলা ল্যাটা! মেয়েরা যে এত ল্যাটা হয়, আমেরিকায় এলে জানতে পারতুম না!

যাই হোক, কলকাতার বাজারে মাছ নেই, থাকলেও আকাশ ছোঁয়া দাম, ভালো গলদা চিংড়ি তো আর বঙ্গোপসাগরেই আসে না বোধহয়, সুতরাং এত বিরাট একটা সুস্বাদু চিংড়ি মাছ খাওয়ার বেশি বর্ণনা দিলে পাঠকদের প্রতি নিষ্ঠুরতা করা হবে। তা ছাড়া, সেই ভোজপর্ব আমার পক্ষেও খুব সুখের হয়নি। দুটি মাত্র হাতে অত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা সহজ নয়। সাঁড়াশি চেপে খোলা ভেঙে হয়তো চিমটে দিয়ে ভেতরের মাছ তুলতে গেছি অমনি ধাক্কা লেগে ছুরিটা পড়ে গেল কার্পেটে। আমি ওই ছুরিটাই তুলে কাজ চালাতে পারি, বড়জোর প্যান্টালুনে একবার ঘষে নেব, কিন্তু সড়ত করে একজন ওয়েটার ছুটে এসে সেটা তুলে নিয়ে, নিয়ে এল আর একটা। ইতিমধ্যে আমি আবার চামচেটা ফেলে দিয়েছি। সেটা আনতে না আনতে সাঁড়াশিটা। সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড!

বরং আমি প্রথম দিনের ব্যাঙ খাওয়ার ঘটনাটা বলি। শামুক-ঝিনুক প্রজাপতি হাঙর ইত্যাদিও আমি খেয়েছি, কিন্তু সে গল্প বলার দরকার নেই, কিন্তু ব্যাঙ খাওয়ার ব্যাপারটা না বললে চলে না। সুপার মার্কেটের মাছ-মাংস বিভাগে রোজই দেখি, ব্যাঙের ঠ্যাং বিক্রি হচ্ছে। ব্যাঙের সারা শরীরটা খায় না, শুধু পা-দুটিই খাদ্য। ছাত্রবয়সে বায়োলজি পড়ার সময় অনেক ব্যাঙ কেটেছি, সুতরাং ভেককুলের প্রতি আমার কোনও ঘৃণা ছিল না। আর ছাল ছাড়ানো ব্যাঙের পা–অবিকল সুন্দরী রমণীয় পদদ্বয়ের মতোই দেখায়, দেখে ক্রমশ আমার খাওয়ার ইচ্ছে হল! অথচ রাঁধতে জানি না। একটি ফরাসি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তাকে বললুম, মার্গারিট, একদিন ব্যাঙ বেঁধে খাওয়াও না।

সে হেসে বলল, আমি তো রাঁধতে জানি না! আমি কী করে খাওয়াব!

–সে কী! তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তুমি নিজে কোনওদিন খাওনি?

–কোনওদিন না।

–যাঃ! আমরা কতকাল থেকে শুনছি ফরাসিরা ব্যাঙ খেকো! চালাকি!

–আমি তো খাইনি বটেই, আমাদের বাড়ির কেউ কোনওদিন ব্যাঙ খেয়েছে বলেও শুনিনি। প্যারিসেও কয়েকটা বড় বড় হোটেলেই শুধু পাওয়া যায়–খুব দামি, শৌখিন খাবার!

–কিন্তু, এখানে তো খুব বেশি দাম নয়?

–তাহলে এসো একদিন দুজনেই একসঙ্গে খাই।

কিনে আনলুম। কিন্তু কী করে রাঁধব সে এক সমস্যা। একে তো স্বাদ কীরকম জানি না–তারপরে যদি রান্নার দোষে গা গুলিয়ে ওঠে কিংবা বমি আসে তাহলে? হয়তো, ব্যাঙের মাংসে কোনও বিটকেল গন্ধ আছে যা কোনও বিশেষ মশলা দিয়ে দূর করা যায়। অনেক ভেবে-চিন্তে একটা উপায় বের করলুম। ঘরে অনেক মাখন ছিল। আর মাখন দিয়ে ভাজলে দুনিয়ার সব জিনিসই সুখাদ্য হতে বাধ্য–এই ভেবে বেশ কড়া করে ভাজলুম মাখনে। তারপর টেবিল সাজিয়ে দুজনে দুদিকে বসেছি। দজুনেরই সামনের প্লেটে ভাজা ব্যাঙের ঠ্যাং, হাতে ছুরি-কাঁটা, কিন্তু চুপ করে বসে আছি। কে আগে শুরু করবে? যে প্রথমে মুখে দেবে–তারই যদি বমি আসে–তবে, অন্যজন ফেলে দিতে পারে। কিন্তু কে আগে?

আমরা দুজনেই দুজনের দিকে চোখাচোখি করে হো-হো করে হেসে উঠলুম।

তখন আমরা ঠিক করলুম, দুজনেই এক-দুই তিন গুনে একসঙ্গে মুখে পুরব। ছুরি দিয়ে এক স্লাইস কেটে কাঁটায় গেঁথে নিলাম। রেডি? এক! দুই! তিন! মুখে!

তারপর? মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি, এরকম সুখাদ্য আমি জীবনে খুব কমই খেয়েছি। ওইটুকু দুটো ব্যাঙের ঠ্যাঙের বাকিটা খেতে আমাদের আর এক মিনিটও লাগল না। তখন, মনে হল, আমাদের দেশ থেকে ব্যাঙগুলোকে কেন যে আমরা শুধু-শুধু সাপের মুখে ঠেলে দিচ্ছি! কিংবা না দিয়েই বা উপায় কী? আমাদের দেশের কোটি-কোটি সাপই বা তাহলে খাবে কী? আমরা ব্যাঙ খাব, আর সাপেরা আমাদের খাবে, তা তো আর হতে পারে না!