০৯. কিরণচন্দ্র ভঞ্জদের জ্বর

কিরণচন্দ্র ভঞ্জদের জ্বর অনেকটা কমেছে। তবু শরীর খুব দুর্বল। কথা বললেন খুব আস্তে আস্তে। কাকাবাবুদের দেখে ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করতেই কাকাবাবু বললেন, উঠবেন না, বসুন, বসুন!

সন্তু আর জোজোও এসেছে কাকাবাবুর সঙ্গে।

কিরণচন্দ্র বললেন, আমার আর এখানে থাকা হবে না। ছেলে বলছে, কলকাতায় গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। আপনারা এখানে যতদিন ইচ্ছে থাকুন। কমলিকা আপনাদের দেখাশুনো করবে।

কাকাবাবু বললেন, না, আমাদেরও আজ চলে যেতে হবে। পুলিশের আই জি অখিল পট্টনায়ক এখানে এসেছেন, তার সঙ্গে আমার অনেক দিনের চেনা। তিনি আমাদের ভুবনেশ্বর নিয়ে যেতে চান।

কিরণচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, আপনি যে কাজের জন্য এখানে এসেছিলেন, তার কিছু হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। নানাসাহেব যে তার দলবল নিয়ে এই রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছি।

কিরণচন্দ্র বললেন, ওই সিন্দুকটা বুঝি নানাসাহেবের?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ।

কিরণচন্দ্র বললেন, কলকাতায় আপনার সঙ্গে দেখা হলে সব শুনব। ছি ছি, কী লজ্জার কথা বলুন তো! আমারই বাড়ি থেকে সিন্দুকটা চুরি হল, আর সেটা চুরি করল আমার নিজের ভাই? ছি ছি ছি। ওকে পুলিশে ধরেছে, বেশ করেছে! ওর শাস্তি পাওয়াই উচিত। অল্প বয়েস থেকেই ও খুব লোভী আর হিংসুটে।

ভাঙা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বললেন, অন্যের টাকাপয়সা দিয়ে এ-বাড়ি সারালেও কি আর আমাদের পুরনো কালের গৌরব ফিরবে? না, না, আর ফিরবে না। রাজবংশের দিন চলে গেছে!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়িতেও যে একটা সুড়ঙ্গ আছে, তা আপনি জানতেন?

কিরণচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, জানতাম বটে। কিন্তু আমার বাবা বেঁচে থাকতেই দুদিকের মুখ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। গত তিরিশ বছরের মধ্যে কেউ ওটা ব্যবহার করেনি। আমার এই ভাইটা, রুদ্র, ও আবার মুখ দুটো খুলে ফেলেছে নিশ্চয়ই। আমায় কখনও কিছু জানায়নি। রায়চৌধুরীদা, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব, আপনি আমাদের পরিবারের সম্মান বাঁচালেন। নানাসাহেবের সব জিনিস ঠিকঠাক পুলিশের কাছে জমা পড়েছে তো? রুদ্র কিছু সরাতে পারেনি?

কাকাবাবু বললেন, না। সবই জমা পড়েছে। শুধু পট্টনায়কের অনুমতি নিয়ে আমি একটা পান্নার মালা তুলে নিয়েছি। সেটা রাজকুমারী কমলিকার জন্য।

কিরণচন্দ্র কিছু বলতে যেতেই কাকাবাবু বললেন, না, না এ-নিয়ে আপনি কিছু আপত্তি করবেন না। এইটুকু একটা উপহার আমি দিতেই পারি!

আর একটুক্ষণ কথা বলে কাকাবাবুরা চলে এলেন সেখান থেকে। খাবার ঘরে কমলিকা ওদের জন্য অপেক্ষা করছে প্লেট সাজিয়ে। ওদের দেখেই বলল, লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে! সন্তু আর জোজো, তোমরা কী দিয়ে লুচি খাবে?

সন্তু বলল, বেগুনভাজা।

জোজো বলল, ক্ষীর।

কমলিকা বলল, ঠিক আছে, দুটোই পাবে!

জোজো বলল, আমি যদি আতার পায়েস চাইতুম, তা দিতে পারতে?

কমলিকা বলল, তা হলে একজন ম্যাজিশিয়ানকে ডেকে আনতে হত।

জোজো বলল, ডাকতে হবে কেন? আমিই তো ম্যাজিক জানি। দেখবে, দেখবে, তুমি যদি এখন একটা পান্নার মালা চাও, আমি এক্ষুনি কাকাবাবুর পকেট থেকে একটা লাল পাথরের মালা বের করে দেব।

সন্তু বলল, পারবি? আমি চ্যালেঞ্জ করছি, তুই কিছুতেই পারবি না!

জোজো বলল, পারব না মানে? দ্যাখ, আগে একটা মন্ত্র পড়ে নিই!

সন্তু বলল, যতই মন্ত্র পড়িস, পান্নার মালা কিছুতেই লাল হবে না। আসলে পান্না হচ্ছে সবুজ!

কাকাবাবু হাসতে হাসতে সবুজ মালাটা বের করে কমলিকার গলায় পরিয়ে দিলেন।

কমলিকা লজ্জা পেয়ে বল, না, না আমি এটা নেব না। অন্যের জিনিস নিলে আমার বাবা রাগ করবেন।

কাকাবাবু বললেন, না, রাগ করবেন না। তোমার বাবাকে আমি বলে নিয়েছি।

খাওয়া শুরু করার পর কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা সুড়ঙ্গটায় ঢোকার পর একটা জালে আটকা পড়েছিলি শুনেছি। সেখান থেকে উদ্ধার পেলি কী করে?

জোজো বলল, আমাদের আটকে রাখতে পারে, পৃথিবীতে এমন কোনও জাল তৈরি হয়নি!

সন্তু বলল, তা ঠিক। কিন্তু তুই ভয়ে কেঁদে ফেলেছিলি!

জোজো বলল, সে তো জালের জন্য নয়। ইঁদুরের জন্য। ওরে বাপ রে, অত বড় বড় ধেড়ে ইঁদুর আমি সাতজন্মে দেখিনি!

সন্তু বলল, সত্যি কথা বলতে কী, আমিও একটু ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু ইঁদুরগুলোই আমাদের বাঁচিয়ে দিল। আমরা জালে আটকা পড়েছি, একগাদা ইঁদুর ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের উপর। আমরা হাত-পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে ইঁদুরগুলো সরাবার চেষ্টা করছি, ওরা যায় না। জাল কামড়ে ঝুলতে লাগল। ওদের দাঁতের ধারে জালের দড়ি কেটে যেতে লাগল এক এক জায়গায়। তাতেই অনেকটা ফাঁক হতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম আগে, তারপর টেনে বের করলাম জোজোকে। ইঁদুরগুলোকে লাথি মারতে মারতে লাগালাম দৌড়। শেষ গর্তটায় এসে বন্ধ করে দিলাম দরজাটা। ব্যস! তারপরেই মুক্তি!

জোজো বলল, আমার পায়ে দুজায়গায় ইঁদুর কামড়েছে। যদি সেপটিক হয়, তাই দৌড়ে চলে এলাম কমলিকার কাছে ডেটল চাইতে।

সন্তু বলল, একটু পরেই দুগাড়ি ভরতি পুলিশ এসে পড়ল। তাদের মধ্যে রয়েছেন আই জি অখিল পট্টনায়ক। ওঁকে আমাদের বাড়িতে কয়েকবার দেখেছি, উনিও আমায় দেখে চিনতে পারলেন। উনি এসেছেন সিন্দুকটা সম্পর্কে খোঁজ নিতে। কাকাবাবু, তোমাকে কোথাও দেখা গেল না। তবে, নটবর সিংহ বলল, রুদ্রকুমারের সঙ্গে তুমি বাড়ির মধ্যে ঢুকেছ, আর বেরোওনি। অথচ বাড়ির মধ্যে কোথাও দুজনকে পাওয়া গেল না। অখিল পট্টনায়ক চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমার মনে হল, নিশ্চয়ই তা হলে এই বাড়ির মধ্যে দিয়ে সুড়ঙ্গে ঢোকার কোনও রাস্তা আছে। কিন্তু ঢোকার জায়গাটা কোথায়, তা বোঝা যাচ্ছিল না কিছুতেই।

জোজো বলল, আমিই তো তখন বললাম সন্তুকে, পুলিশ এ দিকটা খুঁজুক। ততক্ষণ আমরা অন্য দিকটায় গিয়ে দেখি, ওখান থেকে কেউ বেরোচ্ছে কি না!

সন্তু বলল, হ্যাঁ, জোজোই ঠিক বলেছিল। কমলিকাদের বন্দুকটা নিয়ে আমরা ওদিকে দৌড়ে গেলাম। গর্তটার মধ্যেও নামতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ ভিতরে মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে লুকিয়ে রইলাম ভাঙা দুৰ্গটায়। দেখতে চাইছিলাম, ওদের হাতে বেশি অস্ত্রশস্ত্র আছে কি না!

জোজো বলল, সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানেন, কাকাবাবু। সন্তুর হাতে বন্দুকটা ছিল কিন্তু একটাও গুলি ছিল না।

কমলিকা তাড়াহুড়োতে গুলি খুঁজে পায়নি।

কমলিকা বলল, গুলি নেই, তা খুঁজে পাব কী করে?

সবাই হেসে উঠল একসঙ্গে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, তা হলে নানাসাহেব যে এখানে ছিলেন, তার সব প্রমাণ তুমি পেয়ে গেলে?

কাকাবাবু বললেন, সবটা পাওয়া যায়নি। নানাসাহেব যে এখানে ছিলেন, কিছুদিন থেকেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারপর, আমার যতদূর মনে হয়, ডাকাতদের আক্রমণে ওঁর দলের কয়েকজন মারা যায়। বোধহয় তাদেরই মাথার খুলি পাওয়া গেছে পুকুরে। নানাসাহেব বাকি কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে পালানোর সময় সিন্দুকটা পুকুরে ফেলে যেতে বাধ্য হন।

সন্তু বলল, তারপর উনি কোথায় যেতে পারেন?

কাকাবাবু বললেন, এবার সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। সেটাই আমার পরবর্তী কাজ হবে। চলো, আপাতত আমাদের ভুবনেশ্বর যেতে হবে। ওঠা যাক।

জোজো বলল, কাকাবাবু, তার আগে একবার গর্জনতলা নামের জায়গাটা দেখে গেলে হয় না? যেখানে আমাদের তিনজনকে মেরে ফেলার কথা ছিল।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছ, সেই খাদের জায়গাটা একবার দেখে আসা যাক।

কমলিকা, তুমি জায়গাটা দেখেছ?

কমলিকা বলল, না, নাম শুনেছি। আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে।

একটু বাদে সবাই বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।

ওঁরা যখন গর্জনতালয় পৌঁছোলেন, তখন বেশ রাত হয়েছে, আকাশ ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়।

এই খাদের নীচে পড়ে গেলে সত্যিই বাঁচার কোনও আশা নেই। কিন্তু এখন উঁকি মেরে দেখলে জায়গাটা মোটেই ভয়াবহ মনে হয় না। চতুর্দিকে ছোট ছোট পাহাড় আর নিবিড় বন।

কী যেন একটা রাত পাখি ডাকছে।

জোজো বলল, ওই রুদ্রকুমারকেই এখান থেকে ঠেলে ফেলা উচিত ছিল। সেটাই হত ওর ঠিক শাস্তি।

কাকাবাবু বললেন, ওসব চিন্তা আর কোরো না। এখন এ জায়গাটা এত সুন্দর লাগছে, এখন খারাপ কথা ভাবতে নেই। খানিকটা রেলিং দিয়ে ঘিরে দিলে এ জায়গাটা চমৎকার পিকনিক স্পট হতে পারে। তোমরা কেউ একজন

একটা গান গাও।

জোজো বলল, আমি গাইব?

সন্তু বলল, না, না, তুই চুপ কর।

কমলিকা গাইবে।

কমলিকা বলল, আমি তো গান জানি না।

সন্তু বলল, অ্যাই, আমাদের বাঘের ফঁদে ফেলার আগে তুমি যে বলেছিলে দুটো গান শোনাবে?

কমলিকা মুচকি হেসে বলল, সে তো মিথ্যে কথা বলেছিলাম।

কাকাবাবু বললেন, মিথ্যে কথা বলেছিলে। খুব খারাপ! তুমি যে সন্তু আর জোজোকে বাঘের ফাঁদে ফেলে দিয়েছিলে, ওরা কিন্তু তার কোনও শোধ নেয়নি। এখন যদি গান না গাও, তা হলে ওরা কিন্তু শোধ নিতে পারে।

কমলিকা দু-এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর গেয়ে উঠল, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…