০৯. একই সঙ্গে শূন্যতা ও পূর্ণতার বোধ

‘রক্তের মধ্যে এক তোলা ভালোবাসা
আত্মার মধ্যে এক বিন্দু সত্য
মাত্র কয়েক দানা খুদ, খুব শীতের একটি দিয়ে
একটি চড়ুই পাখির বাঁচার জন্য যেটুকু দরকার
তোমরা কি ভাবো, পৃথিবীর মহত্তম সন্তদের ওজন
এর চেয়ে বেশি?
–পিয়ের এমানুয়েল

একই সঙ্গে শূন্যতা ও পূর্ণতার বোধ মানুষের হয়। মানুষের বুকের খাঁচাটা এমনই এক রহস্যময় স্থান।

আটলান্টিক মহাসমুদ্র পেরুবার সময় আমার বুকটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। যেন অজান্তে বিষম একটা অপরাধ করে ফেলেছি। চিরকালের মতন ছেড়ে যাচ্ছি আমেরিকা, পাঁচ বছরের ভিসা থাকলেও খরচ করে ফেলেছি টিকিটটা, আর টিকিট কাটার সাধ্য আমার কখনও হবে না। আয়ওয়া নামের ছোট্ট সুন্দর শহরটির ওপর আমার মায়া পড়ে গিয়েছিল, সেখানে আমার নিজস্ব একটা ঘর ছিল, ইচ্ছে মতন লেখা-পড়া করার সময় ছিল, সেখানে থেকে গেলে আমাকে আর কখনও অর্থ চিন্তা করতে হত না। ছেড়ে এসে কি ভুল করলাম? কিংবা, নিউ ইয়র্কে অ্যালেন গিনসবার্গের বাড়ির আচ্ছা, কত কবি শিল্পীর জমায়েত সেখানে, অ্যালেন থেকে যেতে বলেছিল, থাকলে আমার অভিজ্ঞতা অনেক সমৃদ্ধ হত। ঝোঁকের মাথায় সব ছেড়ে-ছুঁড়ে এরকমভাবে চলে আসা, ভুল করেছি, না ঠিক করেছি? কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

মেঘহীন, রবিকরোজ্জ্বল দিন। বিমানের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি নীল জলরাশি। মাথার ওপরে ও নীচে বিশাল নীল শূন্যতা। বিমর্ষতার মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ আমার মনে লাগছে এক একটা ঢেউয়ের ঝাঁপটা। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্যারিসে পৌঁছব, মার্গারিটের সঙ্গে দেখা হবে। সেই সম্ভাবনার আনন্দে ভরে যাচ্ছে আমার বুক। শুধু প্যারিস দেখা নয়। মার্গারিটের সঙ্গে প্যারিস দেখা, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?

যাওয়ার পথে প্যারিস বিমান বন্দরে পা দেওয়ার সময় আমার মুখ-চোখে একটা ভীতু ভীতু ভাব ছিল, এক বছরের পশ্চিমি প্রবাসে আমি অনেক সাবালক হয়েছি। দুটো চারটে ফরাসি বাক্যও জানি। কোনও কারণে মার্গারিট আমাকে রিসিভ করতে না আসতে পারে যদি, তা হলেও একেবারে হারিয়ে যাব না।

কাস্টমস বেরিয়ারের ওপাশে অনেক লোকজন প্রতীক্ষা করে। আমার প্রথমেই চোখ পড়ল হলুদ স্কার্ট পরা, সোনালি চুলের যুবতীটির ওপর। মার্গারিট ছাড়া আর কারুকেই দেখতে পেলাম না। যেন একটা শূন্য স্থানে সে একা দাঁড়িয়ে আছে।

ধরা-ছোঁয়ার দূরত্বের মধ্যে আসতেই মার্গারিট আমায় দুহাত জড়িয়ে ধরে চুম্বন করল। ফরাসি কায়দায় দুগালে। তারপর হাসি-কান্না মেশানো গলাল বলল, আমি খুব দুর্বল, সুনীল। মাকে ছেড়ে চড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, আর তোমাকে ছেড়েও এতদিন থাকতে পারছিলাম না কিছুতেই।

সেই আনন্দের মুহূর্তেও আমার মাথায় একটা নিষ্ঠুর সত্য ঝিলিক দিয়ে গিয়েছিল। মার্গারিটকে ছেড়েও আমাকে চলে যেতে হবে। আমি ফ্রান্সে অনন্তকাল থাকতে আসিনি। কিন্তু তখনই সেই কথাটা মার্গারিটকে বলা যায় না।

এয়ারপোর্টের বাইরে এসে মার্গারিট আমাকে জিগ্যেস করল, আমরা ট্যাক্সিতে যাব, না বাসে?

আমি বললাম, ট্যাক্সি? তোমার মাথা খারাপ নাকি? অত পয়সা কোথায়? আমি কিন্তু প্রায় সব টাকাই খরচ করে ফেলেছি!

মার্গারিট বলল, ভালোই হয়েছে। আমার কাছেও টাকা নেই। মায়ের চিকিৎসার জন্য হাতে যা ছিল সব খরচ হয়ে গেছে। তবে, সুখের কথা এই যে, মা কালই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে গেছেন। আমি এখন প্যারিসে ইচ্ছে মতন তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে পারব।

আমি বললাম, তা হলে আমাদের চলবে কী করে?

মার্গারিট বলল, ধার করব। আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবী আছে, যাদের কাছে টাকা ধার করে এক বছর পরে ফেরত দিলেও চলবে।

খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে আমি জিগ্যেস করলাম, আমর থাকব কোথায়?

মার্গারিট হাসতে-হাসতে বলল, এখন তো ঠান্ডা নেই, যে-কোনও জায়গায় শুয়ে থাকতে পারি। স্যেন নদীর ধারে ভবঘুরেদের সঙ্গে কাটানোই বা মন্দ কী? রেড ওয়াইন আর লম্বা রুটি খাব! সত্যি, সুনীল, কয়েকটা দিন নদীর ধারে শুয়ে শুয়ে কাটিয়েই দেখা যাক না!

মেয়েটা সত্যি পাগলি! নদীর ধারে ক্লোশার-রা শুয়ে থাকে আমি জানি। তাদের সম্পর্কে অনেক গল্পও শুনেছি, কিন্তু আমি তাদের সমগোত্রীয় হব কী করে? আমি বিদেশি, পুলিশ আমাকে দেখতে পেলেই তুলে নিয়ে যাবে! আলজিরিয়ান কিংবা ভিয়েতনামি হলেও না হয় কথা ছিল, ফ্রান্সের প্রাক্তন কলোনির অনেক মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছে। যেমন ইংল্যান্ডে ভিড় করেছে বহু ভারতীয় ও পাকিস্তানি।

অবশ্য মার্গারিটের এই প্রস্তাবের উত্তরে আমার কোনও বাস্তবসম্মত উত্তর দেওয়া সাজে না। আমি বললাম, বাঃ, চমৎকার। নদীর ধারে শুয়ে থাকা তো অতি উত্তম ব্যাপার। কলকাতায় আমি গঙ্গার ধারের শ্মশানে শুয়ে থেকেছি কয়েকবার।

একটা বাসে চেপে আমরা চলে এলাম শহরের কেন্দ্রস্থলে, আবার অন্য বাসে প্লাস পিগাল-এ। আসবার পথে আমি ক্ষুধার্ত চোখে গিলছিলাম প্যারিস শহরটিকে। আমরা পরজীবনে বিশ্বাস করি না, এই তো আমাদের স্বর্গ। রাস্তার ধারে, ফুটপাথের ওপরেই অনেক রেস্তোরাঁর চেয়ার-টেবিল পাতা, সেখানে বসে বসে অনেক অলসভাবে কফি কিংবা বিয়ার-এ চুমুক দিচ্ছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে যেসব তরুণীরা, তারা সাজগোজ করেছে ঠিকই, কিন্তু দেখলে বোঝা যায় না, প্রসাধনের পর সেটা গোপন করাই একটা আর্ট।

এক জায়গার দেওয়ালে একটা পোস্টার দেখে চমকে উঠলাম। সেখান বড় বড় অক্ষরে আমার নাম লেখা। তারপর ক্রমশ পোস্টারের সংখ্যা বাড়তে লাগল, সবগুলিতেই সুনীল, সুনীল! প্যারিসের দেওয়ালে দেওয়ালে আমার নাম, এই শহর কি আমার মতন এক অজ্ঞাত কুলশীলকে স্বাগত জানাচ্ছে? আমি যে আজই আসব, তা জানল কী করে নগরের মেয়র?

এটা আমার স্বপ্ন নয়। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য যে সেদিন প্যারিসের দেওয়ালে অসংখ্য পোস্টারে আমার নাম দেখেছি। শুধু আমার নাম, আর কিছু লেখা নেই। আসল ব্যাপারটা হল, SUNIL নামে একটা নতুন সাবান বেরুতে যাচ্ছে, ওইসব পোস্টারে তারই বিজ্ঞাপন! অনেক বছর পরেও আমি জার্মানির এক দোকানে ওই SUNIL নামের গুঁড়ো সাবানের প্যাকেট দেখেছিলাম। সম্প্রতি ওদেশে এক নতুন বিস্কুটের বিজ্ঞাপনও দেখা যাচ্ছে, সেই বিস্কুটের নাম মুক্তি। এখন মুক্তি নামের কোনও বঙ্গীয় নারী প্যারিসে গিয়ে সেই বিজ্ঞাপনের পোস্টারগুলি দেখলে আমারই মতন চমকিত ও পুলকিত হবেন।

মুল্যাঁ রুজ নামে রেস্তোরাঁ নাইট ক্লাবটি বিশ্ববিখ্যাত। তার সামনে আমরা বাস থেকে নামলাম। মার্গারিট দোকানটির দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বলল, আমরা এখন ওখানে যাব?

আমি বিমূঢ়ভাবে ওর দিকে তাকালাম। কী ব্যাপার, মার্গারিট কি লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে নাকি?

মার্গারিট রহস্যময় ওষ্ঠে হাসতে লাগল। তারপর ঠিক মুল্যাঁ রুজ-এর মধ্যে নয়, তার পাশের একটা দরজা দিয়ে ঢুকে এল ভেতরে। সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠে গেলাম তিনতলায়। বোঝা গেল সেটা একটা বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ি, লম্বা টানা বারান্দা। এক তলায় নানান দোকান ও অফিস, ওপরের দিকে অ্যাপার্টমেন্ট। একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাবি লাগাতে লাগাতে মার্গারিট বলল, এটা এখন আমাদের!

ভেতরটা বেশ সুসজ্জিত, তিনটি শয়ন কক্ষ, বসবার ঘরটাতে বইপত্রের স্তূপ। তা হলে নদীর ধারে, আকাশে নীচে শুতে হবে না? এটা কার অ্যাপার্টমেন্ট, মার্গারিট কী করে জোগাড় করল, সে-রহস্য সে সহজে ভাঙতে চায় না, খালি উলটোপালটা কথা বলে। শেষ পর্যন্ত যা জানা গেল, তা বেশ মজার।

মার্গারিটের এক কলেজের বান্ধবীর নাম মোনিক। সেই মানিক তার অন্য দুজন বান্ধবীর সঙ্গে এই অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়া নিয়েছিল, তিনজনেই চাকরি করে। এর মধ্যে একজন বিয়ে করে নতুন অ্যাপার্টমেন্টে চলে যাচ্ছে, দ্বিতীয়জন গেছে ও মাসের শুরুতেই। আগে তিনজন ভাগাভাগি করে ভাড়া দিত, এখন মোনিক একা এত বড় অ্যাপার্টমেন্ট রাখতে পারবে না, সে-ও চলে যাবে অন্য জায়গায়। এই মাসটার ভাড়া দেওয়া আছে, তাই থাকতে বাধা নেই, খালি দুখানা ঘর সে মার্গারিটকে ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ বিনা পয়সায় আমাদের এই বিলাসের বাসস্থান!

মোনিকের সঙ্গে আলাপ হল বিকেলবেলা। মার্গারিটের সহপাঠিনী হলেও মোনিককে একটু বড় দেখায়, তার মুখে মার্গারিটের মতন সারল্য ও কৌতুক নেই, বরং বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ছাপ পড়েছে। ছিপছিপে তরুণী, কলার তোলা কালো রঙের একটা পোশাক পরা। তার কাটালো মুখখানা যে-কোনও ভাস্করকে আকৃষ্ট করবে। আমাকে স্বাগত জানালেও একটু পরেই বোঝা গেল, সে কথা কম বলে। একটিও ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করে না সে, আমি তার সব কথা বুঝে উঠতে পারি না। বারবার পারদে পারদের বললে, সে একটা মোটকা ডিকশনারি এনে আমার সামনে রাখল, সেটার নাম পেতি লারুস!

পরে আমি জেনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম যে, এই মোনিক একটি পাবলিশিং হাউজে চাকরি করে, সেখানে তার কাজ শেকসপিয়র অনুবাদ। কতখানি ইংরিজি ভাষাজ্ঞান থাকলে একজন শেকসপিয়র অনুবাদ করতে পারে তা অনুমেয়, তবু সে মুখে কিছুতেই ইংরিজি বলবে না! এমনই ছিল ফরাসিদের ভাষা-অভিমান! এখন এই গোঁড়ামি অনেকটা কমেছে।

মোনিক সকালবেলা ব্রেকফাস্ট খেয়ে অফিসে চলে যায়, আমি আর মার্গারিটও নগর সন্দর্শনে বেরিয়ে পড়ি। তখনকার ফ্রান্স কী গৌরবোজ্জ্বল, মহীরুহ সদৃশ লেখক-শিল্পীরা সেখানে বিচরণ করছেন। জাঁ পল সার্ত তখনও বেঁচে, তিনি এক রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন সকালে কফি পান করতে যান, জীবিত আছেন আরি মিশো, রেনে শ্যার-এর মতন কবিরা। ছবি আঁকছেন পিকাসো, রাস্তায় হঠাৎ দেখা যায় আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কিংবা চার্লি চ্যাপলিনকে। পশ্চিমি জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিরা জনতাকে এড়িয়ে চলেন না। লোকেও তাঁদের বিশেষ বিরক্ত করে না। হইহই হয় পপ স্টার কিংবা পপ সিংগারদের নিয়ে। সেই সময় বিটলসদের অভ্যুত্থান ঘটছে। সেই চারটি ব্রিটিশ ছোকরা গায়কদের নিয়ে তরুণ তরুণীদের কি মাতামাতি! একবার আমি পল এঙ্গেলের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের প্লাজা হোটেলে দিন দু-এক কাটিয়েছিলাম, সেই হোটেলেই উঠেছিল বিটলসরা, তাদের জন্য সর্বক্ষণ হোটেলের সামনে ট্রাফিক জ্যাম। অথচ ওখানেই ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা অ্যালেক গিনেস, তিনি লবিতে বসে কাগজ পড়তে-পড়তে চায়ে চুমুক দিতেন, কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করে কোনও ভিড় নেই।

প্যারিসে তখন এসেছিলেন রিচার্ড বার্টন এবং এলিজাবেথ টেলর, কোনও শুটিং উপলক্ষে নয়, এমনিই বেড়াতে, তাঁদের প্রেমকাহিনি নিয়ে প্রমোদ-জগৎ উত্তাল, সমস্ত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তাঁদের ছবি। উন্নাসিক ফরাসিরাও ওই যুগল চিত্রতারকাকে দেখার জন্য ক্ষ্যাপামি করছে শুনে মার্গারিটের কী রাগ!

আমি তখন তাকে একটা গল্প শোনালাম। একদিন নিউ ইয়র্কের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। সেই রাস্তারই অন্য ফুটপাতে এককালের হলিউডের নায়িকা লানা টার্নার, যাঁর অভিনয়ের চেয়ে বক্ষদেশের প্রসিদ্ধিই ছিল বেশি। লানা টার্নারকে দেখামাত্রই রাস্তায় ভিড় জমে গেল। তখন আইনস্টাইনের এক সঙ্গী আপসোস করে বললেন, স্যার, দেখুন, দেখুন, এ যুগের সভ্যতার কী ট্রাজেডি! আপনি, আপনি আলবার্ট আইনস্টাইন এখানে রয়েছেন, তবু আপনাকে কেউ চিনতে পারছে না, আর সবাই হ্যাংলার মতন ওই মেয়েছেলেটির দিকে ছুটছে!

আইনস্টাইন হেসে বললেন, এটাকে ট্রাজেডি বলছ কেন? লোকে তো দেখবেই, ওই মেয়েটির অনেক কিছু দেখাবার আছে, আমার তো আর তা নেই!

আমরা যাকে বলি আইফেল টাওয়ার, ফরাসিরা বলে তুর দেফেল, তার পাশ দিয়ে আমরা দুজনে হেঁটে যাচ্ছি, কিন্তু মার্গারিট আমাকে কিছুতেই ওর ওপরে চড়তে দেবে না। টুরিস্টরা প্যারিসে এসেই আইফেল টাওয়ারের দিকে ছুটে যায়, টুরিস্টরা যা যা করে কিংবা দেখে, তার কোনওটাই আমার চলবে না। মার্গারিটের নির্দেশ, প্রথম দিন যতখানি সম্ভব পায়ে হেঁটে প্যারিস শহরটা দেখতে হবে। শুধু এর রাস্তা। নদীর ওপর সেতুগুলি, বিচিতর সব হর্মসারি এবং গাছপালার দৃশ্য হৃদয়ঙ্গম না করলে এখানকার সংস্কৃতিও বোঝা যাবে না।

কোনও নতুন জায়গা দেখতে হলে পায়ে হেঁটে ঘোরাই যে প্রকৃষ্টতম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ক্লান্ত হলে যে-কোনও জায়গায় বসে পড়া যায়। এ তো আর কলকাতা শহর নয় যে বসার জায়গা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। প্যারিস শহরে রয়েছে প্রচুর উদ্যান, নদীর দুধার আগাগোড়া বাঁধানো, যে-কোনও জায়গায় বসে পড়া যায়। এত টুরিস্টদের ভিড়, তবু অনেক বেঞ্চ খালি পড়ে আছে। এরা সব কিছুই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রাখে।

প্যারিস শহরটার সৌভাগ্য এই যে কখনও এখানে বোমা পড়েনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় লন্ডন শহর জার্মান বোমা বর্ষণে ছাতু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু প্যারিস রয়েছে অক্ষত। শত্রুরাও এই শহরটিকে ভালোবাসে। ফরাসিরা বোধহয় তাদের অতি গর্বের এই নগরীটিকে বাঁচাবার জন্য আগেই হিটলারের কাছে হার স্বীকার করে বসেছিল। পরে আমেরিকানরাও শত্রু অধিকৃত এই সুন্দরীকে আহত করতে চায়নি। জার্মানিতেও ফ্রাংকফুর্ট শহরটাকে মিত্রবাহিনী বোমা মেরে মেরে একেবারে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু অদূরের হাইডেলবার্গ শহর তারা ধ্বংস করতে যায়নি। হাইডেলবার্গও এতই সুন্দর ও ঐতিহ্যসম্পন্ন যে তাকে নষ্ট করতে শত্রুরও হাত কেঁপেছিল।

প্যারিস বোমার ঘা খায়নি বটে, তবু বোমা-ভীতি ছিল নিশ্চয়ই। সেই জন্যই যুদ্ধ লাগার সময় প্যারিসের বিখ্যাত ভবনগুলি ধূসর রঙে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ওপর থেকে ঠিক চিনতে পারা না যায়। যুদ্ধের পর ফ্রান্সের অর্থনীতি এমনই দুর্বল হয়ে যায় যে, সেই ধূসর রং তুলে শহরের রূপ ফিরিয়ে আনাও সাধ্যে কুলোয়নি। যুদ্ধ থামার প্রায় কুড়ি বছর পর সেই কাজ শুরু হয়েছে, আমরা হাঁটতে-হাঁটতে দেখতাম, লুভর প্রাসাদ, নতরদাম গির্জার গায়ে ভারা বেঁধে মিস্তিরিরা ঘষাঘষির কাজ করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আঁচ আমরা ভারতে তেমন টের পাইনি, কিন্তু ইউরোপে তার চিহ্ন অত বছর বাদেও সর্বত্র। সেই সময়কার অধিকাংশ ফিলম ও থিয়েটার যুদ্ধ-কেন্দ্রিক।

হাঁটতে-হাঁটতে কখনও রাস্তার ধারের কোনও রেস্তোরাঁয় বসা যায়। বুলেভার-এর ওপরেই চেয়ার-টেবিল পাতা। এক ফ্রাঁ দিলেই কফি পাওয়া যায়, তখন এক ফ্রাঁ আমাদের এক টাকার সমান। কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখা যায় পথের চলমান দৃশ্য। প্যারিসের সব কিছুই যেন আলগা ধরনের লাবণ্যময়।

এক কাপ কফি নিয়েও বসে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যত কম পয়সার খদ্দেরই হোক, কোনও খদ্দেরকেই উঠে যেতে বলার নিয়ম নেই এ-শহরে। এমনকি পরিচারকরা আশেপাশে এসে ঘুরঘুরও করবে না। আরও একটা চমৎকার নিয়ম আছে এখানে। প্রত্যেক রেস্তোরাঁয় বাথরুম রাখতেই হবে। অনেকে বাথরুম ব্যবহার করার জন্য আলাদা পয়সা নেয়, অনেকে নেয় না। কিন্তু বাথরুম ছাড়া কোনও দোকান খোলাই যাবে না। এই জন্যই তো শহর এমন পরিষ্কার থাকে।

দ্রষ্টব্য হিসেবে মার্গারিট আমাকে প্রথম নিয়ে গেল একটা কবরখানায়!

পের লাসেজ নামে এই কবরখানা দেখে আমি চমকে উঠলাম। এখানে বহু বহু বিখ্যাত লেখক-শিল্পী, সমাহিত, সেই জন্যই মার্গারিট আমাকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কী

অদ্ভুত যোগাযোগ, এই কবরখানা যে আমার খুব চেনা।

অন্যান্য সমাধিফলকের দিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে এসে এক জায়গায় থেমে মার্গারিট বলল, এই দ্যাখো, এখানে গিয়ম অপোলিনেয়ার শুয়ে আছেন!

গিয়ম আপোলিনেয়ারের কবিতায় শকুন্তলার উল্লেখ আছে, সেই উপলক্ষ্যে মার্গারিটের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সেই কবি আমাদের দুজনের মধ্যে সেতু বন্ধন করেছেন। মার্গারিট ফুলের তোড়া এনেছে সেই কবির জন্য।

আমি হাসতে-হাসতে বললাম, এখানকার নাড়ি-নক্ষত্র আমি জানি!

মার্গারিট অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কী করে জানলে?

আমি বললাম, আমার বন্ধু অ্যালেন গিনসবার্গেরও প্রিয় কবি এই অপোলিনেয়ার। সে পের লাসেজ-এ এই সমাধিস্থানটা নিয়ে একটা দীর্ঘ কবিতা লিখেছে। এখানে আসবার কয়েক দিন আগেই আমি নিউ ইয়র্কে অ্যালেনের সাহায্য নিয়ে সেই কবিতাটা অনুবাদ করেছি বাংলায়। কবিতাটার মধ্যে অনেক রেফারেন্স আছে, সেসব আমি জানি না। অ্যালেন বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তাতে আমার অনুবাদ করতে অনেক সুবিধে হয়েছে।

চতুর্দিকে একবার তাকিয়ে আমি আবার বললাম, আপোলিনেয়ারের কবিতা, অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতা, আর তোমার আমার বন্ধুত্ব, সব যেন মিশেছে এখানে।

মার্গারিট বলল, তুমি পুরো কবিতাটা অনুবাদ করেছ? শোনাও, শোনাও, আমাকে বুঝিয়ে দাও?

আমি উচ্চারণ করলাম কয়েকটি লাইন :

…ফিরে এসে একটা কবরের ওপর বসে তোমার
স্মৃতিফলকের দিকে তাকিয়ে আছি
অসমাপ্ত লিঙ্গের মতো একখণ্ড পাতলা গ্রানাইট
পাথরে একটি ক্রশ মিলিয়ে যাচ্ছে, পাথরে দুটি কবিতা
একটি ওলটানো হৃদয়
অপরটি প্রস্তুত হও আমার মত অলৌকিক
উচ্চারণ করেছি আমি কসত্রোউইতস্কির গিয়ম আপোলিনেয়ার
কে যেন ডেইজি ফুল ভর্তি একটি আচারের বোতল
রেখে গেছে, এবং একটি
৫ বা ১০ সেন্টের সুররিয়ালিস্ট ধরনের কাঁচের গোলাপ
ফুল এবং ওলটানো হৃদয়ে ছোট্ট সুখী সমাধি
এবং একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে যার সাপের মতন
গুঁড়ির কাছে আমি বসেছি
গ্রীষ্মের বাহার এবং পাতাগুলো সমাধির ওপর ছাতা
এবং কেউ এখানে নেই
কোন অশুভকণ্ঠ কাঁদে গিয়ম কোথায় তুমি এলে
তার নিকটতম প্রতিবেশি একটি গাছ
সেখানে নীচে হাড়ের স্থূপ এবং হলুদ খুলি হয়তো
এবং ছাপানো কাব্য আলকুলস আমার পকেটে
তার কণ্ঠস্বর মিউজিয়ামে…